রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২০

পরিবর্তনশীল প্রাগ

কাফকা, কাসল এবং কল্পনাইস্টার্ন ব্লক থেকে চেক রিপাবলিক
Charles Bridge Prague

স্মৃতিরা আবদ্ধ করে রাখে মাঝে মাঝে

কাঁচি দিয়ে কাটা যায় না কঠিন বুনন

সুতো হোক অথবা দড়ি!


শিল্পীদের বাড়ির পাশের সেতুটি দেখছেন?

সেই সেতুরই কাছে ছেলেটিকে গুলি করেছিল পুলিশ

সে হেঁটে আসছিল আমারই দিকে


কিন্তু আজও হেঁটে গেলে স্মৃতিটুকু ফিরে আসে

হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাই পাশাপাশি

আমার তখন কতই বা বয়স? মাত্র কুড়ি! 


ইহুদী কবরখানার শুনশান গলিপথে

যেখানে তাদের রাইফেলের হাত থেকে বাঁচতে

আমি ছুটে গিয়েছিলাম ফটকের অভিমুখে


অনিশ্চিত পদক্ষেপে বছর এগিয়ে যায়

সঙ্গে আমিও চলি, শুধু মেয়াদ ফুরিয়ে যায়

তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়...সময়! 

~জারোস্লাভ সেইফের্ত

১) “আর কত বাকি আছে রে?" নাক মুখ কুঁচকে জিগ্গেস করলাম সঙ্গিনীকে।

মোবাইল ঘেঁটে তিনি উত্তর দিলেন, “কুড়িয়ে-কাচিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তোর কথা যদি ভুল হয় তাহলে সোজা ভাল্টাভা নদীতে লাফিয়ে পড়িস।”

“মানে?” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ই আবার কী কাণ্ড ভাই?টাকা কম হলে খুব বড়জোর না খেয়ে রাত কাটাতে হবে। নদীর জলে লাফাব ক্যানে? ব্যাকপ্যাকারদের শাস্ত্রে ওই সব পাগলামির নিধান নেই। তাও যদি আমরা মারিজুয়ানা- ফুয়ানা নিয়ে ঘুরতাম।

সঙ্গিনী নিশ্চিন্ত মুখে বললেন, “খুব তো কনফিডেন্স দেখাচ্ছিলি ইস্টার্ন ব্লক সস্তা বলে। সব জিনিসপত্র নাকি জলের দরে পাওয়া যাবে। ভুল হলে বুঝব তোর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল বলেও ওইসব আট-ভাট বকছিলি। তাই নদীতে লাফালে জল খেয়ে পেটও ভরবে, মাথাও ঠান্ডা হবে।” 

এইবার আমি একটা অবজ্ঞার হাসি দিলাম। ইল্লি আর টকের আলু? হুঁহ! যত্তসব! আমি সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা করছি? আমার ইনফরমেশনে ভুল হবে? কভি নেহি। আর প্রাগ? প্রাগ তো আমার নিজের শহর। মনে মনে কতবার আমি এই শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেরিয়েছি। ভাল্টাভা নদীর ধারে অবস্থিত পার্কের বেঞ্চে বসে বিষণ্ণনয়না মহিলাদের সঙ্গে গল্প করেছি, শীতের রাতে ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় দাঁড়িয়ে নীল বরফের কুচি হাতে নিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি, তারপর বেসমেন্ট বিয়ার হাউস আর স্থানীয় 'হোস্পদা'-য় গিয়ে বিয়ার হাতে রাত্রি কাটিয়েছি। কারেল হিনেক মারওয়া আর কাফকার সাহিত্য নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা করেছি চেক বন্ধুদের সঙ্গে, জানুয়ারির হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে মরুভূমির উষ্ণতা অনুভব করেছি, মাল্স্ত্রদার ক্যাফেতে বসে বোজেনা নেমকোভার উপন্যাস 'গ্র্যান্ডমাদার' পড়েছি আর জিরি ওয়াইসের পরিচালিত সিনেমা 'রোমিও জুলিয়েট অ্যান্ড ডার্কনেস' দেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। সময় আর দূরত্বের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে এই শহর কখন যে আমার নিজের শহর হয়ে উঠেছে, সে আমারও জানা নেই। কী করে? সেই রহস্য ফাঁস করব, কিন্তু তার আগে খানিক গৌর চন্দ্রিকা সেরে নেওয়া যাক। 

ইউরোপের পূর্বদিক অথবা চলিত ভাষায় 'ইস্টার্ন ব্লক'-এর দেশগুলো নিয়ে আমার মনে আগ্রহ প্রথম থেকেই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত দেশের 'রেড আর্মি' এসে চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গরি, পোল্যান্ড সহ বেশ কিছু রাষ্ট্রকে নাজিদের কবল থেকে মুক্ত করে। এই প্রত্যেকটা দেশেই যুদ্ধের পর কমিউনিজম ঘাঁটি গেড়েছিল, ইস্টার্ন ব্লক-এর দেশগুলো সোভিয়েত রাশিয়ার পরিপূরক হয়ে ছিল বহু বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নের হর্তাকর্তারা খাতায় কলমে মস্কোয় থাকলেও গুপ্তচর সংগঠন কেজিবির স্পাইরা গিজগিজ করত প্রাগে। কমিউনিস্ট সরকারের বিপক্ষে গিয়েছো কি মরেছ! স্নায়ুযুদ্ধের সময় চেকোলোভাস্কিয়া বা রোমানিয়া থেকে কেউ প্যারিস, লন্ডন বা কোপেনহেগেনে গেলে সকলেই ট্যারা চোখে তাকাত। বিড়বিড় করে বলত, "ফ্রম প্রাগ? ইউ মিন... বিহাইন্ড দ্য আয়রন কার্টেইন?"যে কথাটা ওপরে না বলে মনে মনে বলত, সেটা হল"ব্লাডি কমিউনিস্টস!"

পরে অবশ্য সময় বদলেছে, পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে লোহার পর্দায়। সশস্ত্র এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলস্বরূপ এখনকার মানুষ সাম্যবাদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। কয়েকটি রাষ্ট্র হয়তো পুরোপুরি পশ্চিম ইউরোপের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছে, প্রতিরক্ষার কথা ভেবে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে, বাকিরা পুঁজিবাদ আর সাম্যবাদের মাঝামাঝি  কোনও একটা গন্তব্য ঠিক করতে চেয়েছে। সে যাই হোক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক বৈচিত্রের দিক থেকে দেখতে গেলে কিন্তু ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলো সর্বদাই প্রথম সারিতে থাকবে। পরিকাঠামো এবং জীবনধারণ ইউরোপের আর চারটে দেশের মতো হলেও এখানকার সংস্কৃতি, খাবারদাবার, রাজনীতি অথবা মানসিকতা যেমন পশ্চিমের অন্যান্য দেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। মুশকিল হল ইস্টার্ন ব্লকের অধিকাংস দেশে যেতে গেলে আলাদা করে ভিসা নিতে হয়, শুধু সেনগেন ভিসা থাকলে চলে না। কয়েকটা দেশে অবশ্য যাওয়া যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম হল চেক রিপাবলিক এবং এর রাজধানী প্রাগ। আমাদের মতো ব্যাকপ্যাকারের কাছে যে প্রাগ এবং বুডাপেস্ট-এর মত শহরগুলো যে একটা বিশেষ জায়গা দাবী করে তার আরেকটা কারণ হল, জিনিসপত্রের দাম এখানে ওয়েস্ট ইউরোপের তুলনায় অনেক কম। 

প্রাগ যে বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহরের মধ্যে একটি, সে কথা আমরা এই সফরেও আগে অনেকবার শুনেছি। ভাল্টাভা নদীর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক নগরী প্রথমদিকে বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়া রাজত্বের অংশ ছিল। এখানে বলে রাখা ভালো যে বোহেমিয়া আসলে চেক রাজ্যের একটি অঞ্চল, এই রাজ্যের অধিবাসীদের বলা হত বোহেমিয়ান। বোহেমিয়ান রাজ্য একসময় প্রবল শক্তিশালী ছিল, বহু বছর তারা এই দেশে রাজত্ব করেছে। আমাদের পরিচিত শব্দ 'বোহেমিয়ান' এর উত্পত্তিও এই দেশেই, স্বাধীনচেতা এবং শিল্পমনস্ক ব্যক্তিদের চরিত্র বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার সেই যুগ থেকেই হয়ে আসছে।

মধ্যযুগের শেষ দিকে প্রথমে হাপ্সবুর্গ সাম্রাজ্য, তারপর অস্ট্রো-হাঙ্গরি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল চেক রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রো-হাঙ্গরি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, চেকোস্লোভাকিয়া নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তা নতুন দেশের আনন্দ খুব বেশিদিন থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাজি বাহিনী এসে প্রাগের দখল নেয়। এই অঞ্চলে সে যুগে প্রচুর ইহুদি আর মুক্তমনা শিল্পী ও সাহিত্যিকরা বসবাস করত। ফলে হিটলারের অধীনে প্রাগে কী ঘটেছিল, সেটা হয়তো সকলেই অনুমান করতে পারবে। তা হিটলার খুড়োও বেশিদিন রাজত্ব বজায় রাখতে পারেননি, যুদ্ধ শেষের মুখে সোভিয়েত সৈন্যরা একেবারে রে রে করে এসে তাদের তাড়িয়ে দেয়। চেকরা হিটলারকে মোটেও পছন্দ করত না, সোভিয়েত সৈনিকরা জয়ী হতে তারা খুশিই হয়েছিল। সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে ১৯৪৬ সালে সাম্যবাদী চেকোস্লোভাকিয়া সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে পুরোপুরি ভাবে দখল নেয় দেশের। এরপর পরবর্তী একচল্লিশ বছর ধরে সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার একাধিকার করে ছিল চেকোস্লোভাকিয়ায়।

তা প্রথম দিকে লোকজন দিব্যি আনন্দেই ছিল। সাম্যবাদী শাসকেরা যে রাষ্ট্রের মঙ্গলের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, সেই সম্পর্কে তাদের কোনও ধারনাই ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেলে কে কমিউনিস্ট, আর কে ক্যাপিটালিস্ট? ফরাসি মার্ক্সবাদী নেতা উলস গুয়েসে নাকি একবার স্বয়ং কার্ল মার্ক্সকেই অভিযুক্ত করেছিলেন যে তিনি মোটেও মার্ক্সবাদের নিয়ম মেনে চলছেন না। তা কার্ল মার্ক্স দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলেছিলেন, "ce qu'il y a de certain c'est que moi, je ne suis pas marxiste." এর মানে, যা বুঝছি, তাতে একট কথা নিশ্চিত। আমি মোটেও মার্কক্সিস্ট নই।" 

রাজনৈতিক মতাদর্শ আর রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। যুগে যুগে যা ঘটেছে, প্রাগে তার ব্যতিক্রম হবে কী করে? ফলে যা হওয়ার তাই হল। সাম্যবাদী সরকারের স্বৈরাচারী শাসনে বাকস্বাধীনতা ধুলোয় মিশে গেল, রাষ্ট্রবিরোধী বা মার্কিন গুপ্তচরের তকমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে টপাটপ তুলে নিয়ে যেতে লাগল সরকার। গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ওপর তাদের কড়া দৃষ্টি, কেউ যাতে সরকারের বিরুদ্ধে একটা কথাও না বলতে পারে। টুঁ শব্দটি করেছ কি কেজিবি লেলিয়ে দেওয়া হবে মস্কোর ইশারায়। 

পঞ্চাশের দশকের পর স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয় আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার। দুই পক্ষের মধ্যে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ব্যালিস্টিক মিসাইল নির্মাণ ও সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। ইস্টার্ন ব্লকের সাম্যবাদী মানসিকতার সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া 'ওয়ারশ প্যাক্ট'-এর চুক্তি করে ইস্টার্ন ব্লক-এর আটটি রাষ্ট্রের সঙ্গে। যুক্তি অনুযায়ী তারা প্রত্যেকে পরস্পরকে অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দেবে দরকার পড়লে এবং স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত দেশের সাহায্য করবে। এর কাট হিসেবে পশ্চিমের দেশগুলো ন্যাটো চুক্তি করে। ব্যস! আর যায় কোথায়? যুযুধান দুই পক্ষ সেই যে মুখোমুখি হল, সেই ঘটনার জের এখনও চলছে পূর্ব ইউরোপে।  

চেকোস্লোভাকিয়া তখন সোভিয়েতে প্রধান সঙ্গী। তারা প্রধান ভূমিকা পালন করছে ইউরোপে। গোপনে খবর সরবরাহ হচ্ছে মস্কোতে। সে একটা যুগ ছিল। কোনও চেক শিল্পী আমেরিকান কবিতার সুখ্যাতি করলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে জেলে পাঠানোর বিধান। বাকিদের কথা বাদই দিলাম, জারোস্লাভ সেইফের্ত-এর মতো নোবেলজয়ী সমাজতান্ত্রিক কবিকেও এরকম ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তখন কেউ ভাবতেও পারেনি একসময় ভাক্লাভ হাভেল বলে একজন লেখকই চেক রাজ্যের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন। মিলন কুন্দেরা পাকাপাকি ভাবে প্যারিসে চলে গিয়েছেন, জোসেফ স্করেস্কি কানাডায় পালিয়ে গেছেন, নিষিদ্ধ সাহিত্য লেখার মূল্য দিতে অনেকে লেখা থেকেই অবসর নিয়েছেন। তাজ্জব ব্যাপার হল এই পরিস্থিতিতেও চেক সাহিত্যে উচ্চমানের কাজ হয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। হ্যাঁ, হতে পারে সে সাহিত্য সরাসরি সমসাময়িক সরকারের বিরোধিতা করেনি কিন্তু 'হিউম্যান স্টোরি' তুলে ধরতে পিছপা হয়নি। তবে চেকরা যে এই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চেষ্টা করেনি তা নয়। ছুটকো-ছাটকা আন্দোলন চলছিল অনেক বছর ধরেই, কিন্তু সে আন্দোলন পরিবর্তন আনতে পারেনি। আলেকজান্ডার ডুবাকের নেতৃত্বে ১৯৬৮ সালের 'প্রাগ স্প্রিং' আন্দোলন অনেকের মনে আশার সঞ্চার করেছিল কিন্তু শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন সশস্ত্র সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সেই আন্দোলন থামিয়ে দেয়।

অবশেষে পরিবর্তন এল ঠিকই। সেই পরিবর্তন আনল ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভোলিউশন'। ততদিনে অবশ্য অনেক কিছু বদলেই গেছে। ওয়ারশ প্যাক্ট ভেঙ্গে গিয়েছে, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি পুনরায় এক হওয়ার মুখে। প্রাগেও এই বদলের ছায়া পড়ল। সেই অহিংস বিপ্লবে গোটা দেশের ছাত্রদের সঙ্গে একজোট হয়ে সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ মিছিল ও হড়তাল শুরু করেছিল। কিছুতেই তাদের থামানো যায়নি। একসময় সরকার বরখাস্ত হয়, লোটাকম্বল নিয়ে বিদায় নেয় কমিউনিস্টরা। ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া বিভাজিত হয় এবং চেক রিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়া দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র হয়ে পৃথিবীর মানুষের সম্মুখে আসে। এই হল ইতিহাস। উইকিপিডিয়াতেও আছে। তাই না বললেও চলত। কিন্তু তাও বলতে হল, কারণ এই প্রেক্ষাপট না জানা থাকলে প্রাগের গলিতে ঘোরার অনুভূতিটা বোঝানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি, একজন মানুষের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে না। তাঁর কথা যথাসময়ে জানাব। আপাতত ব্যাক টু বেসিকস। 

ভিয়েনা থেকে ফ্লিক্সবাস করে প্রাগে আসতে আমাদের সময় লেগেছে মোটামুটি পাঁচ ঘন্টা। এইদিকের ভূদৃশ্য অন্যরকম, দেখলেই বোঝা যায়। ঘন সবুজের বদলে রংমিলান্তির খেলা। ফিকে সবুজ আর কমলা রঙের উঁচু নিচু প্রান্তরে ফসল ফলানো হচ্ছে। শুকনো খড় বোঝাই করে রাখা ক্ষেতের মাঝে এক একটা ফার্মহাউস, আনারস রঙা বাড়ি। মাঝে মাঝে ইট রঙের ঘরবাড়ি-গির্জা নিয়ে ছোট ছোট জনপদ। মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। প্রাগে নামলাম যখন, গরম অনেকটাই কমে গেছে।

আমাদের থাকার কথা প্রিস্তাভিস্তে অঞ্চলের একটি হোমস্টেটে। হুড়োহুড়ি থেকে দূরে অবস্থিত শান্ত পাড়া, খানিক দূরেই নদীর ধার দিয়ে ট্রাম লাইন চলে গেছে। বাড়িওয়ালার নাম পেত্র, সময়াভাবে তার সঙ্গে বেশিক্ষণ আড্ডা দেওয়া গেল না। সে নিজেই দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে, সেইজন্যে আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়েই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল। আমরাও কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখেমুখে জল দিয়ে, সেজেগুজে ট্রাম স্টেশনের দিকে চললাম। নতুন শহরে এসে কে ঘরে বসে থাকে? 

প্রিস্তাভিস্তে থেকে ট্রাম ধরে শহরের দিকে চলেছি। আমাদের বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভাল্টাভা নদী। আজ বিকেলের গন্তব্য প্রাগের অনন্য চার্লস ব্রিজ। বোহেমিয়ার রাজা এবং সেকালের রোমান সম্রাট চার্লস চতুর্থ এই সেতুটির নির্মাণ কার্য শুরু করার আগে রীতিমত সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্য নিয়েছিলেন। ১৩৫৭ সালের জুলাই মাসের 9 তারিখে সকাল পাঁচটা একত্রিশ মিনিটে রাজামশাই সেতুর গোড়াপত্তন করেছিলেন। মুহূর্তটি দীর্ঘ ভাবনাচিন্তার পর ঠিক করা হয়েছিল যাতে একটা প্যালিনড্রম তৈরি হয়  (১৩৫৭-৯-৭-৫-৩১)। তিরিশটি বারোক শৈলীর প্রতিমা দিয়ে সজ্জিত এই সেতু আজ প্রাগের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ এবং সময়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে আজও চার্লস ব্রিজ সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। 

মজলিশি নদীর স্রোত। অ্যালবাট্রস মেঘ। লাপিস লাজুলি আকাশ। লাল পাড় সাদা শাড়ি ট্রাম। ঘটাং ঘটাং শব্দটা সত্যিই মিস করি।  নদীর কাছেই অবস্থিত রঙচঙে বাড়িগুলো দেখতে দেখতে যখন চার্লস ব্রিজের কাছে পৌঁছেছি, সূর্যাস্ত হতে খুব বেশি দেরি নেই। সেতুটা সুন্দর তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা এখানকার পরিবেশ। এমন জমজমাট সেতু হয়তো আর কোথাও নেই। চার্লস ব্রিজ আজকাল বোহেমিয়ান শিল্পী আর বাস্কার্সদের অন্যতম ঠেক, প্রায় মেলা বসে যায় বিকেলের দিকে। নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজছে, শিল্পীরা ছবি আর পেইন্টিং নিয়ে বসে আছেন। কয়েকজন দেখি মানুষের মুখের স্কেচ করছেন। একজন অপেরা গাইছে। একটা ম্যাজিশিয়ানেরও দেখা পেলাম। পথচারীরা  কোনও  না  কোনও  শিল্পীর সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে, বাকিরা নদী ও নদীর অপর প্রান্তে পাহাড়ের ওপর থাকা প্রাসাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে ভাল্টাভা নদীর জলে। অনেকগুলো নৌকো আর যাত্রীবাহী ক্রুজ এগিয়ে যাচ্ছে জল কেটে। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ সরানো কঠিন হয়ে পড়ে। কাছেই নদীর ওপর কাম্পা দ্বীপ আছে, সেখানে ততক্ষণে নদীর ধারের রেস্তোরাঁয় আমুদে সঙ্গীত আর অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। এমন সময় আমার আবার মনে হল, এ দৃশ্য তো আমার খুব পরিচিত। ওই যে দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, ওখানে স্পরুস আর হর্নবিম গাছের তলায় একটা বেঞ্চি আছে। দূরের গির্জায় ঠিক সতেরো মিনিট পর ঘণ্টা বাজবে। আমি এখানে আগেও ঘুরে গিয়েছি বহুবার। 

কেন বার বার এরকম মনে হওয়া? তার কারণ আর কিছু নয়, একজন মানুষ। যার কলম পড়ে আমি এই শহরকে চিনেছি, বুঝেছি, ভালোবেসেছি। না, কাফকা নন, ইয়ান নেরুদা বা কুন্দেরাও নন, বরং আমাদের দেশেরই এক মানুষ। হিন্দি সাহিত্য যার হাতে পড়ে বদলে গিয়েছে বরাবরের মতো। নির্মল বর্মা। ষাটের দশকে প্রায় দশ বছর এই দেশে থেকেছেন তিনি। এখানকার সাহিত্য, পরিবর্তনশীল রাজনীতি, ছাত্রজীবন, বিপ্লব ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তা বার বার তাঁর সাহিত্যে দৃশ্যমান হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প, ভ্রমণসাহিত্য আর উপন্যাস পড়লে পাঠকের মনে যে প্রাগকে ঘিরে যে ছবি গড়ে ওঠে, সে ছবি আজীবনের মতো তাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। নির্মল বর্মার কলমে এমন একটা মায়াবী ব্যাপার আছে, একটা যাদুজড়ানো নির্লিপ্ততা আছে, যা প্রথম লাইন থেকে পাঠকদের সম্মোহিত করে রাখে। তাঁর গভীর জীবনবোধ ও সমাজদর্শন তাঁর সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে, একইসঙ্গে প্রাধান্য পেয়েছে চেক সাহিত্য ও প্রাগের উদারমনা মানুষদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, নির্মল বর্মা কোনোদিন ভারতীয় মূল্যবোধের নিরিখে এখানকার সমাজকে বিচার করেতে চেষ্টা করেননি। ভুলে গেলে চলবে না, ষাটের দশকের প্রাগ আর আজকের প্রাগ এক নয়। বিহাইন্ড দ্য আয়রন কার্টেনে অবস্থিত বলে প্রাগকে লোকে এড়িয়েই চলত। কিন্তু নির্মল বর্মা অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনি সমস্ত ইউরোপে ভ্রমণ করেছেন, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। হোস্পাদায় রাতের পর রাত বিয়ার হাতে ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন, ধ্রুপদ সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি সজগ দৃষ্টি রেখেছেন, সমকালীন সাহিত্যিকদের লেখা গুলে খেয়েছেন, আবার পেট চালাতে সামার ও উইন্টার হলিডেতে পার্ট টাইম জবও করেছেন। চেক সাহিত্যকে অন্যান্য ভাষায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন নির্মল। ফলে চেক ভাষাও শিখেছেন, প্রাগ সাহিত্যের বিভিন্ন লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করতেও পেছপা হননি। পরবর্তী কালে হিন্দি সাহিত্যের 'ট্রেলব্লেজার' হয়ে উঠেছিলেন নির্মল। সমকালীন কবি লেখকদের মধ্যে অনেকেই নির্মল বর্মার লেখা পড়ে সাহিত্যের প্রেমে পড়েছেন। বলা বাহুল্য, আমিও তাঁর একজন ক্ষুদ্র পাঠক। ফলে প্রাগ নিয়ে আমার আলাদা আবেগ তো থাকবেই। নির্মল বর্মার লেখা 'ওয়ে দিন' পড়ে প্রাগের প্রেমে পড়বে না, এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া কঠিন। গল্প অবশ্য খুবই সহজ। এক ভারতীয় ছাত্র(নির্মল নিজে) প্রাগে থাকে। শীতের ছুটিতে আচমকা সে একটা কাজের সন্ধান পায়, অস্ট্রিয়ান এক মহিলার ইন্টারপ্রেটার হতে হবে কিছুদিনের জন্যে। সেই কাজের সূত্রে পরিচয় হয় রাইনার সঙ্গে, একটা সম্পর্কও তৈরি হয়। তারপর বইয়ের পাতা জুড়ে বরফ, কুয়াশা, বিষাদ, আর প্রেম। প্রাগের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দু'জন, ল্যাম্পপোস্টের ধোঁয়া ধোঁয়া আলো কুয়াশার সৃষ্টি করেছে।

একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি অনেকক্ষণ আগে থেকেই পড়ছিল, কেউ গায়ে মাখেনি। কিন্তু এইবার টনক নড়েছে অনেকের। চটপট বড় বড় ছাতা বাহারি ছাতা অথবা রেনকোট বেরিয়ে পড়ল। আমাদের কাছেও খাস মধ্যবিত্ত বাঙালি কালো রঙের জোড়া ছাতা আছে, মাথার ওপর খুলে শান বাঁধানো পাথরের রাস্তা দিয়ে সেতুর অন্য দিকে এগিয়ে চললাম। 

শান বাঁধানো রাস্তার ওপর বৃষ্টির জল পড়েছে বলে দোকানের জগমগে আলো প্রতিফলিত করছে। প্রাগের অলিগলি সব জায়গাতেই গথিক স্থাপত্যের দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায়, সেইসব দেখতে দেখতে চলেছি। ক্যাফে আর রেস্তোরাঁগুলো থেকে বেরিয়ে আসা সুবাসে মন চনমন করে। প্রাগে গুলাস আর ডার্ক বিয়ারের নামডাক আছে, সেইসবও চেখে চেখে দেখতে হবে। একজন মানুষ প্রতিমার মত অনড় হয়ে কোমর মুড়ে বসে আছে, সামনে টুপি। যদি কেউ খুচরো পয়সা দেয়! ভিক্ষে চাওয়ারও রকমারি 'স্টাইল' দেখতে পাওয়া যায় দেশে দেশে ঘুরলে। আমাদের কাছে খুচরো থাকলে না হয় দেওয়া যেত। প্রাগে আবার ইউরোর চলন নেই। এখানকার স্থানীয় টাকা চেক কোরুনা, এটিএম থেকে সেই টাকা বের করতে হবে।

সেই দিন সন্ধ্যেবেলা ওল্ড টাউনের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল। এক একটা গলিতে ঢুকি আর এক একটা গল্প চোখের সামনে উন্মোচিত হয়। কতবার যে রাস্তা হারালাম তার ঠিক নেই। তবে নতুন শহরে রাস্তা হারানোর মতো মজা আর কিছুতেই নেই। প্রতিটা শহরের যে নিজস্ব একটা সত্তা থাকে, সেটা বুঝতে হলে এই নিরুদ্দেশ ভ্রমণ জরুরি হয়ে পড়ে। কোনও  নির্দিষ্ট গন্তব্য অথবা দ্রষ্টব্যের সন্ধান না করলে বহু খুঁটিনাটি চোখে পড়ে, যা সেখানকার প্রতিদিনের জীবনের অংশ। যেমন প্রথম দিন ঘুরেই আমরা বুঝতে পারলাম প্রাগে চাইনিজ আর থাই খাবারের ব্যাপক চাহিদা। থাইল্যান্ডের লোকজনও আছে অনেক। ছোট ছোট মনিহারী দোকানে ঢেলে থাই নুডলসের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে, লোকে কিনছেও দেদার। এরকম তথ্য কোনও গাইড বুকে পাওয়া যাবে কি না কে জানে?


২) পরের দিন সকালে নীলের সঙ্গে আলাপ। প্রাগের স্যান্ডেম্যান ওয়াকিং ট্যুরের গাইড নীল যতটা রোগা, ততোটাই লম্বা। জাতে ইহুদি এবং জন্ম থেকেই প্রাগের বাসিন্দা। ওল্ড টাউন স্কোয়ার আদতে প্রাগের হৃদয়কেন্দ্র। ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো বহু অজানা গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে চত্বরেই। সেন্ট ভিতাস গির্জা, অ্যাস্ট্রনমিকাল ক্লকের পাশাপাশি আর্ট গ্যালারি, নবীন এবং প্রাচীন সৌধ, প্রস্তর প্রতিমাগুলো দেখা হয়ে যায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেই, কিন্তু গল্পগুলো অজানাই থাকে। নীলের সুবাদে আমাদের অনেকগুলো গল্পই জানা হল। ক্যাথোলিক ও প্রোট্যাসটেন্টদের রেষারেষি, বিদ্রোহে শহরের কর্তাদের দপ্তরের জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, ধর্মসুধারক জান হুসকে আগুনে পুড়িয়ে মারার বর্বর ইতিহাস, সবই চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।

ওল্ড টাউনের একদিকে নতুন শহর, অন্য প্রান্তে ইহুদি পাড়া। প্রাগের ইহুদি পাড়া যে হিটলারের খুবই পছন্দের জায়গা ছিল, সে তথ্য এখন জানে।  শেষ জীবনটা এখানেই কাটাবেন এমন একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন ফুয়েরার। তাই বলে এখানকার ইহুদিদের নরম চোখে দেখতেন না মোটেও। উল্টে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় থাকতে হত প্রাগের ইহুদিদের। মৃতদেহ সমাধিস্থ করার জন্যও জায়গা পাওয়া যেত না।  কবরখানার জন্যে নতুন জায়গার অনুমতি না পেয়ে পুরোনো কবরের ওপরে মাটি ফেলে মৃতদেহদের সমাধিস্থ করতে হত তাদের। হিটলার আসলে চেয়েছিল পাড়াটা তার কৃতিত্বের চিহ্ন হয়ে রয়ে যাবে পৃথিবীতে! লোকে সেখানে এসে দেখবে হিটলারের হাতে পড়ে সিধে হয়ে যাওয়া এই নিকৃষ্ট জাতি ঠিক কী করে জীবনধারণ করত! তার এই অমানবিক পরিকল্পনা সত্যি হয়নি ঠিকই, কিন্তু ইহুদি পাড়ায় আজও অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস অনুভব করা যায়। 

এই অঞ্চলে অজস্র কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে। ভূত আর দৈত্যের মজাদার গল্পের পাশাপাশি নীল আমাদের আরো একটি গল্পের হদিস দিল, সিনেমার মতো মনে হলেও যা সত্যি ঘটনা। অনেকেই অবশ্য এখন ঘটনাটার কথা জেনে গিয়েছে, কিন্তু তাতে তার প্রভাব কমে যায়নি মোটেও।

সিনাগগ দেখে কবরখানার পাশের সংকীর্ণ নিচু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছে নীল বলল, "সিন্ডেলার্স লিস্ট ছবিটা কি তোমরা সকলে দেখেছ?"

আমরা দুজন তো সিনেমার পোকা। কিন্তু স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত 'সিন্ডেলার্স লিস্ট' ছবিটি দেখেনি, এমন চলচিত্রপ্রেমী পাওয়া মুশকিল। এই ছবিটি অস্কার সিন্ডেলারের কাহিনি নিয়ে করা, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্ট চলাকালীন অসংখ্য পলিশ ইহুদিদের তাঁর কারখানায় কাজ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন । 

নীল বলল, "অস্কার সিন্ডেলার্সের জীবন সম্পর্কে এখন সবাই জেনে গিয়েছে। কিন্তু আরেকজন মানুষ আছেন যিনি নিজের জীবনের পরোয়া না করে প্রাগ থেকে ছশোরও বেশি অনাথ ইহুদি ছেলেমেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন, তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন ব্রিটেনে। তাঁর নাম নিকোলাস ওয়ান্টান। তিনি না থাকলে বাচ্চাগুলো তাদের মা-বাবার মতনই  কোনও  না  কোনও  কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারা যেত।"

ধীরে ধীরে ঘটনাটা জানা গেল। ১৯৩৮ সাল। ইহুদিদের ওপর যে ধরনের অমানুষিক অত্যাচার হচ্ছিল, সেই খবর পেয়ে ব্রিটেন ইহুদি শিশু শরণার্থীদের জায়গা দিতে রাজি হয় এই শর্তে যে তাদের থাকার জন্যে  কোনও  না  কোনও  পরিবার ঠিক করতে হবে এবং মাথাপিছু প্রত্যেকটি বাচ্চার জন্যে একটা নির্দিষ্ট মূল্য ধরে দিতে হবে। সে সময় যুদ্ধ চরমে, জার্মানির নাজি সৈন্য আর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রাগ অধিকার করে নেবে। এমন সময় সমাজকর্মী মার্টিন ব্লেকের আহ্বানে নিকোলাস উইন্টান এসে পৌঁছোন প্রাগে, জানতে পারেন অনাথ ইহুদি শিশুদের কথা। ব্লেক নানা কাজে ব্যস্ত, অতএব দায়িত্বটা পুরোপুরি নিজের ঘাড়ে তুলে নেন ওয়ান্টান। সেই অরাজক পরিস্থিতিয়ে একটা নতুন সংগঠন দাঁড় করিয়ে প্রতিটা ছেলেমেয়ের জন্যে ব্রিটিশ মুলুকে ফস্টার হোমের সন্ধান করা, নথিপত্র যোগাড় করা, হল্যান্ড থেকে দরকারি অনুমতি আনানো... কাজ বড় কম ছিল না। কিন্তু ওয়ান্টান একবারের জন্যও দমে জাননি। নানা অসুবিধে সত্ত্বেও ৬৬৯ জন ইহুদি ছেলেমেয়েকে তিনি সুরক্ষিত ভাবে পাঠিয়ে দেন ব্রিটেনে। 

এই ঘটনার কথা পৃথিবীর মানুষ জানতেই পারেনি। বহু বছর পড়ে বাড়ির চিলেকোঠা থেকে ওয়ান্টানের স্ত্রী একটি ডায়েরি খুঁজে পান, সেখানে প্রতিটা ছেলেমেয়ের কথা বিস্তারে লিখে রেখেছিলেন তিনি। গ্রেটে ওয়ান্টান সে ডায়েরি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। এরপর একে একে কয়েকজন এই ঘটনার কথা জানতে থাকে। ক্রমে ঘটনার কথাটা জানাজানি হয়, সংবাদমাধ্যমেও লেখালিখি হয়। এই ঘটনার কথা জানানোর জন্যে নিকোলাস ওয়ান্টানকে একটি মিডিয়া প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বৃদ্ধ ওয়ান্টান জানতেন না যে দর্শকদের সকলেই বাস্তবে সেই ছশো উনত্রিশ জন এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। এক সময়ে যখন জিগ্গেস করা হয় কতজন মানুষ নিকোলাস ওয়ান্টানের জন্যে জীবন পেয়েছেন, প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ উঠে দাঁড়ায়। এই ঘটনার পর থেকেই নিকোলাস ওয়ান্টানের গল্প পরিচিত হয়ে ওঠে বৃহত্তর সমাজে। সেই ভিডিও দেখলে একদিকে গায়ে কাঁটা দেয়, অন্যদিকে চোখে জল চলে আসে। তাঁকে সম্মান দেওয়ার জন্যে প্রাগের ট্রেন স্টেশনে ওয়ান্টানের একটি প্রতিমাও স্থাপন করা হয়েছে।  

ইহুদি পাড়া থেকে ফ্র্যাঙ্ক কাফকার বাড়ি, সেখান থেকে অপেরা হাউস আর ওল্ড টাউনের গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে নিউ টাউনের ওয়েনসেসলাস স্কোয়ার। ওয়েনসেসলাস স্কোয়ারে গেলেই ভেলভেট বিপ্লবের কথা মনে পড়ে, পাবলিক প্রোটেস্টের জন্যে এই জায়গাটা আজও ব্যবহার করা হয়। ভাবলে অবাক লাগে যে এই পথ দিয়ে এককালে সোভিয়েত সৈন্যরা এখানে রীতিমত সামরিক ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে। ইতিহাস আর সমসাময়িক ঘটনার চর্চার মধ্যে দিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল। কাছেই একটা জায়গায় হাজার হাজার ধাতুর পাট দিয়ে নির্মিত কাফকার মুখের একটা অটোমেটিক রেপ্লিকা আছে, মুখটা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে। সেটা আমরা দেখে নিয়েছি। ইচ্ছে ছিল কাফকা মিউজিয়ামে যাওয়ার কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হল না। প্রাগের মানুষেরা কাফকার জটিল মনস্তাত্ত্বিক কাহিনীর যত ভক্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি ভক্ত মোৎসার্ট-এর কম্পোজিশনের। বলাবলি করা হয় ভিয়েনার চেয়েও বেশি মানুষে প্রাগে মোৎসার্টকে নিয়ে মাতামাতি করে, তাঁর মৃত্যুর পর এখানে টানা কয়েকদিন ধরে শোক পালন করা হয়েছিল। তুলনায়, তিরিশ বছর অ প্রাগে কাফকাকে অধিকাংশ মানুষ চিনত না। বিপ্লব পরবর্তী কালে দেশ স্বাধীন হতে মার্কিন টুরিস্টরা এসে যখন কাফকা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে, এখানকার লোকজন তাঁকে আমেরিকান ঠাউরেছিল। তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। কাফকা ছিলেন প্রাগের ইহুদি, কিন্তু লিখতেন জার্মানে। সেই লেখা তাঁর মৃত্যুর পর ইংরেজিতে অনূদিত হয়। চেক সাহিত্যে তাঁকে নিয়ে কোনও উন্মাদনা ছিল না।  

কাফকার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই জানে। সে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। বরং এই সুযোগে অন্য একজনের কথা জানিয়ে যাই, যিনি চিরকাল অন্ধকারে থেকে গিয়েছেন। অথচ, কাফকার অধিকাংশ লেখাই এই মানুষটি না থাকলে জনসমক্ষে আসত না। জানি, পাঠকদের অনেকেই কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের কথা ভাবছেন। বন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে সমস্ত লেখা প্রকাশিত করার জন্য আমরা ম্যাক্সের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কৃতজ্ঞ থাকব কাফকার ছোট বোন ওতলার কাছে। 

হ্যাঁ, কাফকার এক বোন ছিল। আসলে বোন ছিল তিনটে। গ্যাব্রিয়েল, ওয়ালি আর ওতলা। কিন্তু বয়সে প্রায় নয় বছর ছোট ওতলাকে প্রথম থেকেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন কাফকা। ওতলাও কাফকা বলতে অজ্ঞান ছিলেন। কাফকা বরাবর চাপা স্বভাবের ছিলেন, তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্ট চিন্তা ভাবনা জটিলতার আন্দাজ কেউই পেত না, কিন্তু বোন ওতলার কাছে তাঁর এই গাম্ভীর্য উধাও হয়ে যেত। দেখা হলে নির্দ্বিধায় কথা বলে যেতেন কাফকা, ওতলা শুনতেন মন দিয়ে। দেখা না হলে চিঠি লিখতেন পরস্পরকে। ওতলাই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কাফকার প্রতিভাকে বুঝেছিলেন। তিরিশ বছর বয়সে কাফকা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার পর ওতলা ভাইকে বোহেমিয়ায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে জান। ছোট্ট টাউন, নাম জুরাউ। সেখানে ওতলা মেয়ে ভেরা আর হেলেনাকে নিয়ে থাকতেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভাইয়ের সেবা করে গিয়েছেন ওতলা, তাঁকে লিখতে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। সন্ধ্যের পর কাফকা বোনকে প্লেটো পড়ে শোনাতেন, ওতলা পিয়ানো বাজাতেন ভাইয়ের জন্য। এই সময়টার কথা কাফকার লেখায় বার বার উঠে এসেছে। হয়তো বোনের জন্য শেষ জীবনে কিছুটা শান্তি পেয়েছিলেন তিনি। শেষের দিকে কাফকার কলম এতটাই পরিণত হয়ে উঠেছিল যে তাঁর লেখা প্রতিটা বাক্য মানব সভ্যতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করত। তাঁর শেষ গ্রন্থ 'জুরাউ অ্যাফোরিজম' এই কথার সত্যতা প্রতিপাদন করে গিয়েছে। 

কাফকা মারা গিয়েছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে। ওতলার লড়াই কিন্তু থামেনি। এমনিতেও প্রথম থেকেই জেদি স্বভাবের ছিলেন ওতলা, শত বারণ করা সত্ত্বেও ফার্ম চালাবেন জন্য কৃষিকার্যের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, বাবার আপত্তিকে আমল না দিয়ে ইহুদি হয়েও ক্যাথোলিক প্রেমিকের সঙ্গে ঘর পেতেছিলেন। ১৯৪২ সালে যখন হিটলার ইহুদি হত্যার যজ্ঞে মেতে উঠেছে, ওতলার চরিত্রের এক অন্য দিক উন্মোচিত হয়। স্বামী আর মেয়েদের বাঁচানোর জন্য তিনি ইচ্ছে করে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করেন। ওতলা খুব ভালো করেই জানতেন যে তাঁর সঙ্গে থাকলে ভেরা আর হেলেনাকে বাঁচানো অসম্ভব, ফলে মেয়েদের শত কান্নাতেও তিনি মনকে শক্ত করে রেখেছিলেন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই নাজিরা তাঁকে টেরেজিন কনশেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তাঁর কাজ ছিল পোল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ইহুদি বাচ্চাদের স্নান করানো, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। বাচ্চাগুলোর চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, লিকলিকে হাত পা। সবাই জানে বেশিদিন তারা বাঁচবে না। কিন্তু ওতলা তাদের সাহস দিতেন, গল্প বলতেন। মাঝে মাঝে ট্রাকে করে আরো ছেলেমেয়ে আসে, তারাও যোগ দেয় এই ক্যাম্পে। একসময় ওতলা জানতে পারেন সমস্ত বাচ্চাকে একসঙ্গে আউসউইৎজ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। শোনামাত্র তিনি সবটাই বুঝে যান। ওতলা টেরেজিন ক্যাম্পের কতৃপৃক্ষকে অনুরোধ করেন তাঁকেও বাচ্চাদের সঙ্গে পাঠানোর জন্য। এই অনুরোধ শুনে কতৃপৃক্ষ বাঁকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি জানো না?"

ওতলা জবাব দিয়েছিলেন, "জানি।"

"তাহলে?"

ওতলা মৃদুহেসে বলেন, "আমি ওদের মরার আগে মরতে দেব না।" 

ওতলা অনুমতি পেয়েছিলেন। শেষযাত্রায় বাচ্চাগুলোকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন হাসি আর গল্পে। ভাইয়ের মতো করে আগলে রেখেছিলেন প্রতিটা বাচ্চাকে। আউসউইৎজ ক্যাম্পে যাওয়া মাত্র ওতলা সহ সমস্ত বাচ্চাকে হত্যা করা হয়। ওতলার সঙ্গে ওতলার গল্পও হারিয়ে যায় চিরকালের মতো।  

একসময় ট্যুর শেষ হল। নীলকে বিদায় দিয়ে আমরাও অন্যদিকে এগোলাম। বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছে। স্টিক, গুলাশ আর প্রাগের মিষ্টি কালো রঙের বিয়ার সহযোগে লাঞ্চ করে ধড়ে প্রাণ এল। প্রাগের 'বিয়ার কালচার' খানিকটা বেলজিয়ামের মতোই, মাথাপিছু কত হাজার লিটার বিয়ার যে এরা একবছরে পেটে ঢালে ভাবলেই মাথা ঝিমঝিম করে।

ওল্ড টাউন চত্বরটা এত সুন্দর যে ঘুরে ঘুরে দেখেও মন ভরে না। নানা ধরনের দোকানপাট, থিয়েটার, ম্যাজিক, ক্যাফে ইত্যাদি তো আছেই, তাছাড়াও বিকেলের দিকে মেন স্কোয়ারে অদ্ভূত অদ্ভুত খেলা দেখানো হয়। কেউ আগুন নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে, কেউ পুতুল নাচাচ্ছে, কেউ উদ্ভট  কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছে। প্রত্যেকেই বেশ ভালো, খেলা শেষে তালি বাজিয়ে খুচরো দিয়ে আসে উৎসাহী লোকে। দিব্যি প্রাণবন্ত পরিবেশ।

এদিকে বৃষ্টি হয়ে বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। রোদ্দুর পড়ে গেলে শীত শীত করে। তারপর হুটহাট বৃষ্টি। 'ট্রাদেলনিক' বলে একরকম স্থানীয় মিষ্টি পাওয়া যায়, লম্বা লম্বা কাঠিতে লাগিয়ে ঘোরানো সেঁকা একটা জিনিস, মাথায় চিনি ছড়ানো থাকে, এরকম পরিবেশে গরম কফি দিয়ে খেতে মন্দ লাগে না। আমরা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। আমার মাথায় নির্মল বর্মা ভর করে থাকেন সবসময়। নিউ টাউনের রাস্তাঘাট, স্থানীয় বাজার, ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাঁফিয়ে পড়লে মেট্রো অথবা বাসে উঠে পড়ি। সন্ধ্যে নামার আগে হাঁটতে হাঁটতে আবার যাই চার্লস ব্রিজের কাছে। একই রকম মায়াবন্ধনী পরিবেশ। অনেকক্ষণ বসে থাকা হয়।

পরের দিন প্রাগ কাসল দেখতে চললাম। পাহাড়ের মাথার ওপর এই দুর্গ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দুর্গের তকমা পেয়ে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে। হাজার বছরেরও আগে নির্মিত এই দুর্গের প্রাসাদের রক্ষনাবেক্ষণও হয় সেইভাবেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঠে যেতে হয়। দুর্গের নিচের তলায় প্রকাণ্ড উদ্যান করা হয়েছে, সেখানে ঘুরে বেড়ালেই সময় কেটে যায়। আরো ওপরে বিরাট গথিক গির্জা, রাজপ্রাসাদের নানা মহল, জাদুঘর, একদিনে দেখে শেষ করা অসম্ভব। আমরা সব জায়গায় ভিতরে যাই না। আমাদের আগ্রহ দুর্গের মাথা থেকে দেখতে পাওয়া শহরের দৃশ্যের দিকে। এত ওপর থেকে ভাল্টাভা নদীর অনেকগুলো সেতু দেখা যাচ্ছে, কাম্পা দ্বীপ ও বাড়িঘরের ঢালু ইট রঙের ছাদ ছাপিয়ে দেখা যাচ্ছে ওল্ড টাউনের বিস্তার। ক্যামেরা নিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ি, এমন দৃশ্যের হদিস পেলে কয়েক দশক আগে যে শান্তি পাওয়া যেত, ডিজিটাল ক্যামেরার দৌলতে সেই শান্তি উধাও হয়েছে। খুঁজে খুঁজে একটা নীরব কোণে গিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে যাই। 'কাসল হিল' এর কাছেই 'পেট্রিন হিল' বলে আরেকটা পাহাড় আছে। সমস্ত পাহাড়টা একটা উদ্যানে পরিণত করা হয়েছে আজকাল। ফার্নেকুলার করে পাহাড়ের মাথায় চলে যাওয়া যায়। সেখানে আইফেল টাওয়ারের আদলে নির্মিত পেট্রিন টাওয়ারের লাল নীল আলো রাতে বহুদূর থেকে দেখা যায়। একটা তারামন্ডল আছে, কয়েকটা রেস্তোরাঁও করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের হাতে তাড়া নেই, ধীরে সুস্থে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পাহাড়টা। ইউরোপিয়ান মেট্রোপলিটান শহরগুলোতেও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার কোনও  না  কোনও  উপায় রাখা হয়েছে, স্থানীয় লোকেরা ইচ্ছে করলেই যখন তখন এখানে চলে আসতে পারে। এইসব দেখে কংক্রিট জঙ্গলে থাকা আমার মতো বহু মানুষই দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। 

Gulliver Airship

Troubled eyes of Kafka

এরকম করেই দু' তিনদিন কেটে গেল। একদিন সকালে আমরা ট্রামে করে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় নামব ঠিক করিনি, ট্রাম চলছে, আমরাও চলেছি বাইরে দৃষ্টি রেখে। ট্রামের পথের ওপরেই একটা বাড়ি পড়ে, নাম 'ডান্সিং হাউস'। বাড়িটার নকশাটা এমন মনে হয় কোমর বেঁকিয়ে নাচছে। রোজই নজরে পড়ে আর আমার হাসি পেয়ে যায়। চার্লস ব্রিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে ভাল্টাভা নদী ডান দিকে ঘুরে গিয়েছে, সেই নদী পেরিয়ে গিয়ে নিউ টাউনের যেই জায়গাটায় নামলাম তার খুব কাছেই ম্যাপে দেখি একটা মিউজিয়াম। ডকস সেন্টার অফ কনটেম্পরারি আর্টস। বাস ধরে চলে এলাম সেখানে। নানা ধরনের শিল্পাকৃতি আছে কিন্তু জায়গাটার বিশেষত্ব হল মিউজিয়ামের ছাদ জুড়ে তৈরি করা প্রকাণ্ড এক আকাশযানের মডেল। কাঠ আর অন্যন্য জিনিস দিয়ে তৈরি এই আকাশযানের নাম 'গুলিভার এয়ারশিপ'। বহু বছর ধরে একটু একটু করে শিল্পীরা গড়ে তুলেছে এই অসামান্য প্রতিকৃতি। প্রথম দেখায় বিশ্বাস হতে চায় না।

প্রাগ ছাড়ার আগের দিন বিকেলে শেষবারের মত চার্লস ব্রিজে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রাচীন ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। জোরে হাওয়া দিচ্ছে আজও। পেট্রিন টাওয়ারের মাথা থেকে বিচ্ছুরিত আলোর রেখাও ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ভাল্টাভা নদীর জলে অন্ধকারের ছায়া। কুড়মুড়ে হাওয়ায় লালনউড়ান চুল। এর মধ্যেই চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকি। গোধুলির দৃশ্য দেখে মন ভারী হয়ে আসে। চলে তো যেতেই হবে! কত মানুষ চলে গিয়েছেন, নির্বাসন নিয়েছেন, স্বয়ং নির্মলও চলে গিয়েছিলেন প্রিয় শহর ছেড়ে। আবার চোখে জল আসে। চোখের জল মুছে নদীর দিকে তাকাই, এমন সময় মাথায় চিড়িক করে ওঠে কয়েকটা লাইন। একটা কবিতা। একটা দৃশ্য। শুনশান রাস্তা, কয়েকটা ভারী বুট পরা সৈনিক, তাদের হাতে রাইফেল এবং চার্লস ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবক। হঠাৎ রাইফেলের শব্দ হল, কয়েক রাউন্ড গুলি চলল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল যুবকটি। ভারী বুট এগিয়ে আসতে লাগল। সেদিনটাও এমনই মায়াময়ী ছিল। সেদিনটাও গোধূলি আছড়ে পড়েছিল মৃত যুবকটির গায়ে। 


সেইফের্ত কিছুই ভুল বলেননি। মানুষ আর সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে কিছু দৃশ্য একই থেকে যায়। বছর ঘোরে, কিন্তু সময় দাঁড়িয়ে থাকে স্থির।


ভাল্টাভা নদীর ওপর তখন অন্ধকার নেমে আসছে।


ক্রমশঃ
পরের পর্ব এখানে পড়ুন
আগের পর্ব এখানে পড়ুন 

যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 
যাত্রা শুরু-মাদ্রিদ

শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০

ভিন্নমুখী ভিয়েনা

সৌধ, সত্ত্বা ও সঙ্গীত— কফি কালচার এবং অন্যান্য
Vienna

কিছুতেই না,

লিখবেই না সে

আত্মকথা


জীবন যতটা 

তার কাছে শুধু

—অশ্লীলতা


ঘেঁটে পাওয়া কিছু 

কথা মনে মনে

রেখে দেয় খালি

দ্বিধা নেই 

তবু হাতড়াতে যায়

যত ধুলোবালি


খুঁজে খুঁজে যায়  

ছন্দ সমানে

কত অনুতাপ  


কবিতায় লিখে

করে চলে শুধু

জীবনের পাপ


~আর্নস্ট জ্যানডল



১) পুরোটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল তো? হবে না? একে তো এমন উদ্ভট কবিতা! তারপর আমার মত অকর্মার ঢেঁকি যদি সেই কবিতার অনুবাদ  করতে যায়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অথবা এখনকার কবি অনিমিখ পাত্র বা শৌভিক দে সরকারের মতো সুযোগ্য অনুবাদকের হাতে পড়লে এই কবিতার অনুবাদ পড়েই হয়তো আহা-উহু করতাম (যেখানে যেখানে স্মৃতি কাজ করেছে অম্লানবদনে গুণীজনদের অনুবাদ ব্যবহার করতে মোটেও পিছপা হইনি। আশা করি তাঁরা অধমের দোষ ধরবেন না) এখন সেই অনুবাদ আমার মত অকবির হাতে পড়ে পরিত্রাণ চাইছে। সে যাকগে! সাহিত্যের মানের বিচারের জন্যে এই কবিতা নয়, এখানে লাইনগুলো ব্যবহার করার অন্যতম কারণ হল আর্নস্ট জ্যানডল-এর (জার্মান উচ্চারণ করতে অক্ষম বলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী) লেখার অভিনব ক্ষমতা এবং আধুনিক ভিয়েনা এবং ইউরোপের কবিতার জগতে কবিতাকে শ্রবণযোগ্য করে তোলার কৃতিত্ব। আমাদের দেশের মত ইউরোপে শ্রুতিনাটক অথবা 'রেডিও প্লে' শুধু গল্প আর উপন্যাসের ওপর নির্ভর হয়ে থাকে না। শ্রুতিনাটকের শ্রবণযোগ্যতা যে একটি বিশেষ গুণ, সেই বিশ্বাসে ভর দিয়ে বহু সাহিত্যিক সারা জীবন শুধুমাত্র রেডিওর জন্যে শ্রুতিনাটক লিখে গেছেন। কবি জ্যানডলও রেডিওতে শ্রুতিনাটক লিখতেন এবং সেখানেই তাঁর দেখা হয় ফ্রেদেরিকে মেয়োরিকেরের সঙ্গে। পরবর্তী কালে ফ্রেদেরিকেকেই বিয়ে করেন জ্যানডল এবং এরপর দুজনেই সারাজীবন ধরে একসঙ্গে শ্রুতিনাটক নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। 

ফ্রেদেরিকে স্বভাবে প্রচন্ড সংবেদনশীল ছিলেন। একবার কবিতা প্রসঙ্গে কথা উঠতে তিনি বলেছিলেন, "আমি বেঁচে থাকি ছবিতে। ছবির ভিতরেই আমার জীবন। আমার ভালো মন্দ, স্মৃতি, বর্তমান সবকিছুই আমি ছবিতে দেখি।"ফ্রেদেরিকের ছবি সর্বস্ব কবিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্যানডল লিখতে শুরু করলেন শ্রুতিনির্ভর কাব্য। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা কিছু চিত্র, যা পড়তে যতটা উদ্ভট, শুনতে ততটাই প্রভাবশালী। তার লেখার ধরনও অন্যরকম। যেমন এই লেখাটা...


দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা আমার কস্মিনকালেও মনে ছিল না

 তৃতীয় স্ত্রীর কথাও মনে ছিল না কোনোকালে

 একটা কথাই আমি মনে রাখি, মনে রেখেছি চিরকাল

 আমার কোনোকালেই  কোনও প্রথম স্ত্রী ছিল না।


আস্তে আস্তে জ্যানডল অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপের কাব্যজগতে শ্রুতিনির্ভর, এক্সপেরিমেন্টাল কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করে তুললেন। আমেরিকা ও এশিয়ার নানান দেশে তাঁর লেখা নিয়ে চর্চা হতে লাগল। তাঁর কয়েকটি লেখা গভীর অর্থবহনকারী, আবার কয়েকটি শুনলে ঠোঁটে হাসি খেলে যায়। 'ভিয়েনিস ফক্কড়'-এর উপাধি পাওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল তাঁর। এই ধরুন, তাঁর লেখা কবিতা 'ওত্তোস মোস'-এ ইংরেজি স্বরবর্ণের 'O' ছাড়া কোনও স্বরই ব্যবহার করেননি। এই লেখা অনুবাদ করতে গেলে হাবুডুবু খেতে হয় ঠিকই, কিন্তু এর প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। জ্যানডলের লেখা পড়ে অন্যান্য ভাষার কবিরাও এই ধরনের কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন সে সময়।

এইবার মোদ্দা কথা হল আর্নস্ট জ্যানডলের কথা হঠাৎ আমার মনে পড়ল কেন? ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে বসে আনাড়ির মতো সাহিত্যের ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছি, এদিকে পেটে বিদ্যা নেই কিছুই। কবিতা নিয়ে আলোচনা করাও আমার সাজে না। ভিয়েনিস ফক্কড়ের কথা ওঠার একমাত্র কারণ হল ভিয়েনা। ভাবলে অবাক হতে হয় যে একশ বছর আগেও ভিয়েনা এবং অস্ট্রিয়ার স্বাধীন শিল্পসত্তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। রাষ্ট্রই তো তৈরি হয়নি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রো-হাংরি রাজ্যের অধিকাংশ শিল্পী অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক পরাজয়ের পর কচ্ছপের গতিতে নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু কাব্যচর্চার কামাল হোক বা কিসমত কা খেল, পঞ্চাশের দশকের পর সেই দেশেই একের পর এক শিল্প, সাহিত্য ও রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে। এই সাহিত্য বিপ্লবগুলো কিছুটা হলেও দেশের মানসিকতাকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তুলেছে।

আমরা সালজবুর্গ থেকে ট্রেনে করে এসে নেমেছি ভিয়েনায়। তথ্যপ্রযুক্তি এবং সুযোগসুবিধের ব্যবস্থা একইরকম, তফাতের মধ্যে সালজবুর্গ ছিল একাধারে পাহাড় আর হ্রদ ঘেরা একটা শান্ত শহর, আর ভিয়েনা পুরোদস্তুর ইউরোপিয়ান মেট্রোপলিটান। মেট্রো করে হের্বসট্রাসে বলে একটা জায়গায় গিয়ে নামলাম। দু' রাত্তিরের ব্যাপার, কাছাকাছি একটা এয়ার বিএনবি পাওয়া গেছে। খুব বেশি খুঁজতে হল না, রাস্তার ধারেই গেয়র্গের বাড়ি। গেয়র্গ এই হোমস্টের কর্তা, বেশ কয়েকজনকে ঘর ভাড়া দেয়। বাড়িতে সব ব্যবস্থাই আছে, শুধু ঘরগুলো ছোট ছোট। বেশ আমুদে মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, কাঁচাপাকা দাড়ি নিয়ে হাসলে অনেকটা ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মত দেখতে লাগে। কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিলাম। ভেনিসে আমরা মাত্র একদিনের জন্যে এসেছি শুনে অবিকল ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মত করে মাথা নেড়ে বললেন, "হাতে খুব কম সময়, কিন্তু ভালো কথা হল কম দিনের জন্যে এলে আবার ফিরে আসার প্রত্যাশাটা বেড়ে যায়।"


কে জানত কয়েক বছর পর এই শহরে ফিরে আসতে হবে? তাও আবার দু' এক দিন বা সপ্তাহ নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য। 

দুপুরে চললাম স্কনবার্ন প্যালেসের দিকে। হাপ্সবুর্গ সম্রাটদের বিশ্রামগৃহ ছিল এই প্রকাণ্ড প্রাসাদ। ভালো করে দেখতে গেলে যতটা সময় ও অর্থ প্রয়োজন, তার সিকিভাগও আমাদের কাছে নেই। বাইরে থেকে দেখলে তবু খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। প্রাসাদের চেয়েও বিশাল তাকে ঘিরে রাখা উদ্যান। গাছের পাতা ছেঁটে নানারকমের আকার দেওয়া হয়েছে, ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালোই লাগে। হলুদ রঙের প্রাসাদের মহলগুলো দেখলে সম্ভ্রম তো জাগেই, হাপ্সবুর্গ বংশের কতটা প্রতিপত্তি ছিল, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। একসময় ওল্ড টাউনের দিকে এগোনো হল ধীরেসুস্থে। মনটা তখনও সবুজে মাখামাখি হয়ে আছে, আল্পসের পাহাড় থেকে নগরজীবনে ফিরে খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছি না। ওল্ড টাউন নিয়েও যে খুব একটা যে আগ্রহ ছিল তা নয়। আহে বহু ইউরোপিয়ান শহরের ওল্ড টাউন দেখে একটা ধারণা করে নিয়েছি মনে মনে। স্বভাবতই অনেক জায়গায় মতন এখানকার ওল্ড টাউনও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, সে আর এমন কী! সেই তো গির্জা আর ক্যাফে-রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমার কথা শুনে মোটেও অবাক হইনি।

কিন্তু ওই যে বলে, বেশি চালাকের গলায় দড়ি! ভিয়েনার স্টিফেনপ্লাৎজ অঞ্চল যেন আমাদের অহংকার দূর করতেই অপেক্ষা করেছিল। মেট্রো করে উপরে উঠতেই মনে হল গালে কেউ 'ঠাস-ঠাস' করে চড় কষিয়েছে।  হ্যারি পটারের দিব্যি, স্পেন থেকে শুরু করে ইতালি, কোনও শহরেই এরকম রাজকীয় বৈভব আর আভিজাত্য আমাদের নজরে পড়েনি। যা পড়েছে, তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে ভিয়েনার ওল্ড টাউন। ভিয়েনার কথা উঠলে যেই শব্দটা আমার সারা জীবন মনে পড়বে, সেটা হল 'ওপেন এয়ার মিউজিয়াম'। শুধু আমার মন নয়, একই বক্তব্য প্রায় সকলেরই, এমনকি উইকিপিডিয়া খুলেও দেখি সেই একই কথা লেখা আছে।

সত্যিই যেন সমস্ত জাদুঘরটাই নেমে এসেছে রাস্তায়। অপূর্ব শৈলীর সব প্রতিকৃতি, শ্বেতপাথরের প্রতিমা, চমকপ্রদ ফোয়ারা, ঝর্ণাবাতি ছড়িয়ে আছে দিগ্বিদিকে। যেদিকেই তাকাই মনে হয় অবিকল কোনও বৈভবশালী রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল। জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্মিত রাস্তায় যে এমন বৈভবশালী শিল্পদ্রব্য সাজিয়ে রাখা যায়, সে আমাদের কল্পনার ঊর্ধ্বে ছিল। প্রাসাদ, উদ্যান, জাদুঘর নিয়ে ভিয়েনার ওল্ড টাউন আমাদের পুরো ভোম্বল করে দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

ওল্ড টাউনে ঠিক কোন দ্রষ্টব্য দেখেছিলাম আর মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ এখানে লিখব না। তবে এটুকু বলা যায় যে গোটা অঞ্চলটা জুড়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও অজস্র সরকারি ইমারত, দপ্তর, জাদুঘরের অস্তিত্ব আছে। এখানকার বাসিন্দারা রীতিমত এই দপ্তরে চাকরি করতেও আসে। ওল্ড টাউনকে বেষ্টন করে রিং রোড চলে গিয়েছে, ট্রাম নম্বর এক আর দুই সর্বক্ষণ চলছে সেখান দিয়ে। একটা ট্রামে উঠে পড়লেই হল। আমরাও পরের দিন ট্রামে করে বেড়ানোর পরিকল্পনাই নিয়েছি। 

মধ্যযুগে হাপ্সবুর্গ রাজাদের আদালত বসত এই অঞ্চলেই, সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে বলেই হয়তো ভিয়েনিজদের ব্যবহার অনেকটা সংযত, পরিশীলিত। সাধারণ মানুষ গতানুগতিক ফ্যাশন পছন্দ করে, বিনয়ী কন্ঠে মৃদু হেসে কথা বলে। ইংরেজির চেয়ে ডয়েচে বলতেই পছন্দ করে বেশি, যদিও শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার ভূমিকা আছে। পরবর্তী কালে ভিয়েনার অনেকের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাঁদেরকে দেখেও এই সিদ্ধান্তের পুষ্টি হয়েছে। ভিয়েনার সংস্কৃতির অভিন্ন অঙ্গ হল এখানকার 'কফি কালচার'। বৈঠকি আড্ডা থেকে শুরু করে প্রেমে পড়া, রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে কবিতা পাঠ, কোনও  কিছুই কফি ছাড়া করতে ভিয়েনিজরা নারাজ। শুধু কফি অবশ্য নয়, সঙ্গে এখানকার নাম করা অ্যাপলস্টুডেল এবং চকেলেট কেক আছে, যার ভিয়েনিস নাম হল 'সাখে তোর্তে'। ঘরে বসে কাজ করার চেয়ে খাতা কলম ল্যাপটপ নিয়ে কফিশপে চলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। ফ্লাস্কে কফি নিয়ে পার্কে গিয়ে শুয়েবসে বই পড়া বা আড্ডা দেওয়ার মতো দৃশ্যও সর্বদাই চোখে পড়ে। 

ওল্ড টাউনের রাস্তায় চক্কর মেরে মেরে যতটা সম্ভব স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে আমরা চললুম নদীর দিকে। ড্যানিয়ুব নদীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত হবে ভিয়েনাটএই। সেই ড্যানিয়ুব... যাকে নিয়ে ভুরি-ভুরি কবিতা আর গান লেখা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটা দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া এই সুদীর্ঘ নদী যে কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে! শহরে নদী না থাকলে এমনিতেই আমাদের মন খারাপ হয়, ড্যানিয়ুব দেখার জন্যে যে মন অধীর হয়ে থাকবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

অনেকক্ষণ আগেই অন্ধকার হয়েছে। আমরা ড্যানিয়ুব নদীর ব্রিজের ওপর গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, নদীর বুকে আলোর রোশনাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ড্যানিয়ুব নদী এখানে প্রকাণ্ড চওড়া। এতটাই চওড়া যে নদীর সেতুর মাঝামাঝি একটা মেট্রো স্টেশন করতে হয়েছে। নদীর মধ্যে দীর্ঘ একটা দ্বীপ নির্মাণ করা হয়েছে। ডোনাউইঞ্জে(Donauinsel) নামের এই দ্বীপ সংস্কার করার পিছনে যদিও বন্যা এড়ানোই প্রধান কারণ ছিল, কিন্তু এখন জায়গাটা আমোদকাননে রূপান্তরিত হয়েছে। সবুজে সবুজ হয়ে থাকে ডোনাউইঞ্জে। সাইকেল, স্কেট, প্যাডলবোর্ড, সাঁতার, দৌড়ের জন্য আদর্শ জায়গা, অলস দুপুর কাটাতেও এর জুড়ি মেলা ভার। মেলা বসে থাকে বছরের আট মাস। এখনও সেই উৎসবের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। বিশাল বিশাল দোলনা আর রেস্তোরাঁর লাল, নীল, সবুজ আলোর প্রতিফলন হচ্ছে নদীর কালো জলে। অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্ধকার হয়ে গেছে বলে 'ব্লু ড্যানিয়ুব' দেখা হল না ঠিক, কিন্তু যা দেখলাম তাও মনকে আবিষ্ট করে রাখার ক্ষমতা রাখে।

ড্যানিয়ুব নদীর একটি শাখা শহরে ঢুকে এসেছে খানিকটা। সেই খালের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকদূর যাওয়া যায়। বেশ  জমকালো এই ক্যানাল পাথ, সমসাময়িক ভিয়েনিজ স্ট্রিট আর্টের নানান নিদর্শন চাক্ষুষ দেখার সুযোগ মেলে। 'ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল'-এর জন্যে ভিয়েনার নামডাক থাকলেও গত কয়েক দশকে নতুন ঘরানার বহু শিল্পী উঠে এসেছেন এই শহর থেকে। এদের প্রচলিত নাম 'আন্ডারগ্রাউন্ড আর্টিস্ট'। চেনা পরিধির বাইরে বেরোলে চোখে পড়ে অদ্ভুত গরণের রেকর্ড-এর দোকান, রংচঙে দেওয়াল লিখন আর সাংকেতিক সব ছবি। 

অন্য ধারার শিল্প-আন্দোলন নিয়ে অবশ্য ভিয়েনার মাতামাতি এই প্রথম নয়। ভিয়েনা সাকসেশন মুভমেন্টের কথা তো প্রায় প্রত্যেকে জানে। এই শহরের অন্যতম শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট অর্থ-প্রতিপত্তি বিসর্জন নিয়ে অন্য পথ বেছে নিয়েছিলেন, বিত্তবান মহিলাদের অন্যধারার পোর্ট্রেট করার জন্য অশ্লীলতার অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল তাঁর ওপর। আশ্চর্যের কথা, আজ ক্লিম্ট-এর এক একটা ছবি ইতিহাস তৈরি করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি সৈনিকরা তাঁর অনেক ছবিই বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, অনেক ছবির খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও। কিন্তু যে সব ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, সে সবের চাহিদা অভাবনীয় জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। 'উম্যান ইন গোল্ড'-এর অধিকার নিয়ে তো ছবির মালিক অল্টম্যান পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি যুদ্ধ হয়েছে অস্ট্রিয়া সরকারের, সে নিয়ে চলচিত্রও হয়েছে। ক্লিম্ট অবশ্য এসব দেখে দেখে যেতে পারেননি। তবে ক্লিম্ট একা নন, শিল্প বিপ্লবে তাঁর উত্তরসূরিরাও কম যান না।  ভিয়েনার প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ইগোন শীল, অস্কার কোকস্কার প্রভৃতির হাত ধরে এগিয়ে চলা শিল্পের জগৎ ষাট ও সত্তরের দশকে'অ্যাকশনিজম'-এর স্রোতে দীক্ষিত হয়েছিল। ফলে সমান্তরাল শিল্পের একটা ধারা সে যুগেও সক্রিয় ছিল। সময়ের সঙ্গে শিল্পচেতনা আরো বেশি অভিনব ও প্রাপ্তমনস্ক হয়ে ওঠে। অ্যাকশনিজমের মূলমন্ত্র ছিল যাবতীয় বুর্জোয়া মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শিল্পকে 'অ্যাকশন'-এর মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা। ওটো মিউল আর গুন্তুর গ্রাসের নেতৃত্বে অ্যাকশনিস্টরা তুমুল সাড়া ফেলেন। ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিক জগৎ থেকে বেরিয়ে তাঁরা তুলি চালানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন মানবশরীরকে। এই ছকভাঙ্গা শিল্পের মাধ্যমে শুরু হয় আন্দোলন। শাসকবর্গের দ্বিচারিতা ও মানবতাবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যত বিক্ষোভ আর উত্তেজনা ছিল, সে সব বডি পেইন্টিং, ফোটোগ্রাফি, ও ফিল্মের মাধ্যমে ধরা দিতে শুরু করে। কেউ রক্ত দিয়ে গির্জার বুকে ক্রস এঁকে দিচ্ছেন, কেউ সারা শরীরে সাদা কালো প্লাস্টার মেখে হাঁটছেন ভিয়েনার রাস্তা দিয়ে, কেউ ভিডিওতে তুলে ধরছেন পশুবলির নৃশংসতা। 'পাবলিক ডিসপ্লে অফ ইনডিসেন্সি' অর্থাৎ অশালীন আচরণ করার ফলে এদের অনেককেই সে কালে হাজতবাস করতে হয়েছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আন্দোলন থিতিয়ে এলেও সেই মনোভাব ধরে সমসাময়িক শিল্পের নানা রূপ প্রকাশ পেতে থাকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে। ধীরে ধীরে পারফরম্যান্স আর্ট সারা পৃথিবীতে নিজস্ব একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। 

রাতে গেয়র্গের বাড়ি এসে দুজন ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। একজন কানাডার ক্যালগিরি থেকে ইউরোপ ঘুরতে এসেছে, অন্যজন থাকে স্লোভাকিয়ায়। দুজনেই প্রাগ থেকে ভিয়েনা এসেছে, উল্টোদিকে আমরা যাব ভিয়েনা থেকে প্রাগ। কিছুক্ষণ গল্পগাছা হল। পথের বন্ধু, ফলে পথের গল্পই হয় বেশি। কার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে সব ভাগাভাগি করে নেওয়া। সেই সূত্রেই এসে পড়ে ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা। পরিবার, কেরিয়ার, অর্থসমস্যা, রাজনীতি… আমি নাম দিয়েছি পাঁচফোড়ন পাঁচালি। খেয়াল করে দেখেছি, এসব আড্ডা দীর্ঘায়িত হয় অচিরেই। সময়ের জ্ঞান থাকে না। অনেক রাতে আড্ডা ভাঙল। তাড়াহুড়ো করে রান্না চাপানো হল। সুপারস্টোর থেকে টিনের মাছ কিনে আনা হয়েছে, ডিনারে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে ঘুম।


২) পরের দিন সকালে পরিকল্পনা মাফিক রিং রোড থেকে ট্রামে উঠে পড়েছি। ট্রাম চলছে, আমরা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বসে আছি। ইচ্ছে ছিল কোথাও নামব না, সোজা স্টিফেনপ্লাৎজ চলে যাব। খামোখা রোদ্দূরে হাঁটাহাঁটি করে কী হবে? কিন্তু সেটা আর সম্ভব হল না। টাউন হলের সামনে আসতেই জায়গাটা দেখে মন চনমন করে উঠলো। ট্রামে বসে আর কোনটুকু দেখা যায়? 'ধুত্তোর' বলে নেমে পড়লাম। বিরক্ত লাগে! এমন করে শহর সাজাতে আছে? শুধু শুধু আমাদের মত লোকজনদের হীনমন্যতায় ভোগানো! হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে যায় কিন্তু তাও কিছুই দেখা হয় না। তারপর এমন সবুজের মেলা। গণ্ডায় গণ্ডায় পার্ক। পার্ক তো নামেই, আসলে বলা উচিত ন্যাশনাল পার্ক। ড্যানিউব আইল্যান্ডটাই তো প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দীর্ঘ এক পার্কের শামিল। তারপর প্রাটার বলে একটা পার্ক আছে, সেখানে দিনদুপুরে হরিণ আর শেয়াল ঘুরে বেড়ায়। এমন গহীন অরণ্য দেখতে আমদের দিন সাতেকের ছুটি নিতে হয়। কিন্তু শহরের যে কোনও প্রান্ত থেকে প্রাতারে পৌঁছতে বড়জোর আধ ঘণ্টা লাগে। জঙ্গলের মধ্যে হর্সরাইডিং ট্র্যাক আছে, ছায়াঘন দীঘি আছে, মাছ ধরার সুযোগ আছে, আবার গল্ফ কোর্স বা বেসবল গ্রাউন্ডও আছে নাগালের মধ্যেই।   

টাউন হলের কাছে গিয়ে দেখি ভিতরে রীতিমত সরকারি দপ্তর আছে। এরকম প্রাসাদপ্রতিম দপ্তরে কাজ করতে এসে লোকজনদের মনে কী ভাব হয় সেটা কে বলতে পারে? হয়তো সকলেই নিজেকে রাজাগজা ভাবতে শুরু করে। সুবিশাল চত্বর। প্রায় চার মাস ধরে প্রতি রাতে টাউন হলের সামনে খোলা জায়গায় মঞ্চের ওপর বিনামূল্যে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সিনেমা, নাচ, গান, কমেডি, নাটক কিছুই বাদ যায় না। শীতের দিনে চলে আইস স্কেটিং। আজ সন্ধ্যের সময়ও গানের অনুষ্ঠান আছে। তাছাড়া আজকাল গ্লোবাল ফুড ভিলেজ ফেস্টিভ্যাল চলছে, সারা পৃথিবীর খাবার পাওয়া যায় সস্তায়। ভিয়েনিজ থেকে ভিয়েতনামিজ, আমেরিকান থেকে আফ্রিকান... যা ইচ্ছে খেতে পারো। ঠিক হল বিকেলেই এখানে চলে আসা হবে। বিনামূল্যে এরকম অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে, এমন সুযোগ কে হারায়?

টাউন হলের কাছেই ন্যাচুরাল হিস্টোরি মিউজিয়াম। খানিকটা হাঁটলেই মিউজিয়াম কোয়ার্টার, সেখানে অজস্র মিউজিয়াম আর আর্ট গ্যালারির ছড়াছড়ি। সমসাময়িক শিল্প আর সিনেমা থেকে শুরু করে সিগমন্ড ফ্রয়েড আর কফিনের মিউজিয়াম ইস্তক সব কিছু মজুদ। প্রত্যেকটা স্থাপত্য যত্ন নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, মিউজিয়ামে না গিয়ে শুধু শুধু বাইরে বসে থাকতেও ভালো লাগে। খোলা চত্বরে নানা রকমের শিল্পাকৃতি আর বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, শুয়েবসে থাকায় যায়। সিজন টাইম বলে অনেক লোকে ঘোরাঘুরি করছে, নাহলে এসব জায়গা নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য আদর্শ।

দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর আমরা এগোলাম। কালেনবার্গ বলে একটা জায়গায় যাব বলে ঠিক করেছি, বাসে উঠতে হবে। কালেনবার্গ আর লিওপোল্ডস্ট্যাট আসলে ভিয়েনার ওল্ড টাউন থেকে বেশ খনিক দূরে অবস্থিত দুই পাহাড়। প্রতিবেশীও বলা যায়। ডে ট্রিপ বা কয়েক ঘন্টার জন্য হাইকিং করতে হলে এমন জায়গা আর হয় না। আঙুরের চাষ হয় এই অঞ্চলে, ওয়াইনারিও আছে। পাহাড়চুড়োয় একটি গির্জা আছে বলে শুনেছি, সেখান থেকে ভিয়েনা শহর তো বটেই, ড্যানিউব নদীর বিস্তারও দেখা যায়। এই যাত্রায় হাইকিং করার সময় নেই বটে, কিন্তু বাস তো চলছেই। আমরা প্রথমেই 'ডে পাস' কিনে নিয়েছ দু' দিনের, অতএব বাসে চড়তে আলাদা করে টিকিট কাটার দরকার নেই।

প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে। ঘুরে ঘুরে রাস্তা। ভিয়েনা শহরের অপেক্ষাকৃত অজানা পাড়াগুলো দেখতে দেখতে এক সময় বাসটা পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। এইদিকটা ফাঁকা ফাঁকা, জনবসতি নেই বললেই চলে। দুদিকে জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝ দিয়ে হাইকিং ট্রেল উঠে গেছে। পাহাড়ের মাথায় একটা রেস্তোরাঁ করা হয়েছে, সেখান থেকে অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ল। নীল ড্যানিয়ুব নদী এঁকে বেঁকে চলে গেছে, তার দু'দিকে ভিয়েনা শহর। নদীর ওপরে কত সেতু! ডোনাউইঞ্জে দ্বীপটাও দেখা যায়। হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে তাও সরতে ইচ্ছে করে না। অবশেষে সত্যি আমাদের 'ব্লু ড্যানিয়ুব' দেখা হল, এই প্রথম। আলাপচারিতা হল না সেভাবে, সে না হয় পরে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। অত অভিমানী চোখে তাকানোর কী আছে বাপু?

সন্ধ্যেবেলা আবার ব্যাক টু ওল্ড টাউন। আলো জ্বললে স্টিফেনপ্লাৎজের আনাচে কানাচে অবস্থিত পাড়াগুলো আরো মোহময়ী হয়ে ওঠে, ঠিক যেন আরব্যরজনীর  কোনও শহর। মায়া বুনে চলে মায়ের হাতের সোয়েটারের মতোই। উলগোল্লার রঙিন সুতো আলোর রূপ নিয়ে শহরে ছড়িয়ে থাকে। এই মায়ার বুননে জড়িয়েমড়িয়ে যাই বারেবারে। রাস্তার মাঝ দিয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলে যায়, আমরা বেঞ্চিতে বসে হলদে চাঁদের রূপ দেখি। প্রসাধিত উদ্যান, আলোকিত গির্জা, গির্জার ওপর বিরাজমান ধুসর চাঁদের আলো। আদুরে আলোয় গা এলিয়ে আলাপচারিতা চলে। 

ক্যাফেগুলোয় পা রাখার জায়গা নেই, প্রায় সকলেই দোকানের সামনের চত্বরে টেবিল চেয়ারে বসে আছে। এখানকার বিখ্যাত জায়গা ক্যাফে মোৎসার্ট, সেখানে দেখি দীর্ঘ লাইন পড়েছে। আমরাও বাদ যাই কেন? এক জায়গায় বসে অ্যাপলস্টুডেল এবং সাখে তোর্তের সঙ্গে কফি অর্ডার করা হল। মুখে দিতেই ম্যাজিকের মত মিলিয়ে যাওয়া হালকা মিষ্টির অসামান্য সেই চকোলেট কেক। আহা! সেই স্বাদ মনে করেই জিভে জল আসে এতদিন পরেও। ভাগ্যে না থাকলে সেরকম সাখে তোর্তে জোটে না। বেশিরভাগ দোকানে ভেজাল কেকই থাকে। 

রাত ন'টার কাছাকাছি টাউন হলের সামনে ওপেন মিউজিক কনসার্টে গিয়ে দেখি বেশিরভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। অন্য  কোনও  জায়গার অনুষ্ঠান ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে বিশাল পর্দায়, অন্ধকারের মধ্যে মঞ্চে ঝিলিক দিয়ে যায় চকমকে ডিস্কো লাইট। বাইরের চত্বর থেকে নানা ধরনের খাবারদাবারের সুবাস ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে কানে আসছে উদাত্ত গলার গান। অনেকক্ষণ বসে বসে শুনলাম।  

Related image
Museum Quarter
Related image
Old Town

রাত দিনের  কোনও  তফাৎ নেই। ওল্ড টাউনের শিল্পাকৃতিগুলো সোনালি আলোয় এখনও ঝকঝক করছে। আমরা এই গলি সেই গলি দিয়ে হেঁটে চলি। দিক ভুল হয়, আবার ম্যাপ দেখে ঠিক রাস্তায় ফিরে আসি। কত ধরনের দোকানপাট, রাস্তাঘাট, মানুষজন রাতে ঘুরতে বেরিয়েছে সেজেগুজে। যেন দুর্গাপুজোর আমেজ। আমরা এগিয়ে চলি। আজই তো শেষ রাত এই শহরে। 

এমন করেই চলে। এক একটা শহর তার নিজস্বতা নিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে। কয়েকদিন সেখানে রয়ে যাই, তাদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি জীবন, তুলনা টেনে আনি পূর্বঅভিজ্ঞতার। হাসিঠাট্টার অন্তরালে নিঃসঙ্গ মুহুর্তগুলো জড়িয়ে থাকে আঙ্গুল। তখন দুজনে পাশাপাশি বসে থাকি চুপচাপ,  কোনও  কথা না বলে। অনুভবগুলো জীবন্ত হয়ে ভাসে পরদেশী বাতাসে। তারপর একদিন আবার বেরিয়ে পড়ি। কখনও বিচ্ছেদের বেদনা হয়, কখনও পরবর্তী পদক্ষেপের জন্যে আকুল হয়ে থাকি। যাত্রা থামে না। ভিয়েনার রাতে হেঁটে চলে দুই পথচারী... পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে।

Image result for vienna
Random Shot at Night
ক্রমশঃ
পরের পর্ব এখানে পড়ুন

আগের পর্ব এখানে পড়ুন 


যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 
যাত্রা শুরু-মাদ্রিদ