শনিবার, ৪ মে, ২০২৪

সাঞ্চেজের দুনিয়ায়

 


সব দিন একরকম যায় না। কোনো কোনোদিন কত ছোটবেলার কথা, কত অবান্তর চিন্তা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে, সেসব লেখা যায় না, শেয়ার করাও যায় না। পেঁজা তুলোর মতো চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে ভাসে, ভেসেই যায়। 

চিন্তামেঘ...

নামটা মনে আসতে এক শিল্পীর কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম যে ছবিটা, তার নামও এক। চিন্তামেঘ। থট ক্লাউড। একটা নয় আসলে, একগুচ্ছ ছবি আছে এই সিরিজে।

থট ক্লাউডের স্রষ্টা আধুনিক কিউবার কিংবদন্তি শিল্পী তোমাস সাঞ্চেজ। নীল নদী, সাদা মেঘ, ঘন সবুজ বন যাঁর সিগনেচার। প্রায় তিন দশক ধরে নিউইয়র্কের মার্লবোরো গ্যালারি তাঁর 'ইনার ল্যান্ডস্কেপ' সিরিজের এক্সিবিশন করছিল, গত মাসেই সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। সাঞ্চেজের অনুরাগীদের মন খারাপ, অনেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য করা বিক্ষোভে তাঁর আঁকা থট ক্লাউডের ছবি নিয়ে গিয়েছেন। কিউবার সবচেয়ে নাম করা এই শিল্পীর ছবির যাদু এমনই যে গ্যালারি বা আর্ট ক্লাসের কয়েক ঘণ্টা নয়, এই শিল্পীর কাজ বহু মানুষের জীবনের অভিন্ন অংশ হয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। 

এমন সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ডিটেলিং ল্যান্ডস্কেপ ছবিতে করা সহজ কাজ নয়। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না যে এই ছবিগুলো হাতে আঁকা। এখন তো আবার গত কয়েক মাস ধরে সাঞ্চেজ স্টুডিওকে এআই প্রুফ সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হচ্ছে। অ্যানিমে আর্টিস্টদের যে ছবি মুহুর্তে ইন্সটার পর্দায় চলে আসে, সাঞ্চেজ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরে সেরকম এক একটা ছবি এঁকেছেন, আঁকছেন। কিন্তু, যন্ত্রের সঙ্গে রক্তমাংসের শিল্পীর পার্থক্য হল, সাঞ্চেজের ছবি শুধু দেখতে সুন্দর নয়, তার একটা ভাষা আছে, একটা দর্শন আছে। এক একটা ছবিতে দেখা যায়, দিগন্তের দিকে তাকিয়ে এক পুরুষ বসে আছেন। ঘাসবনের ওপর দিয়ে একলা মেঘ বয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন বৃক্ষের সমষ্টির মাঝ দিয়ে একটা আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে। মন অস্থির থাকলে যদি কেউ মন দিয়ে কিছুক্ষণ সাঞ্চেজের ছবি দেখে, মনে হয় জীবনটা এখনও সুন্দর। যতদিন বেঁচে আছি, এই প্রকৃতিকে দেখছি, গাছপালা মেঘ নদী রোদ্দুরকে সঙ্গে নিয়ে এক একটা মুহুর্ত কাটাচ্ছি, এসবের মূল্য চোকানো যাবে না কোনোদিন। এমন হতেই পারত, যে এই পৃথিবীতে আসার মতো ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটত না, তাহলে এসব দেখার সুযোগও হত না। এই মেডিটেটিভ অনুভূতির জন্য আসলে শিল্পীকেই দায়ী করতে হয়, কারণ
সাঞ্চেজ তুলি হাতে ছবি আঁকতে বসে নিজেই সব ভুলে যান, তারপর তিনি ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর সামনে একটা কল্পনার বাগানের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটা ছবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তিনি নিজেই বলেছিলেন, “When I enter a state of meditation it’s as if I’m in a jungle or a forest; the mind enters into a great exhilarated state, like an exuberant jungle where you can experience fear, desire, anguish—all types of emotions and feelings. When I begin to feel that there’s a point of inner consciousness everything goes toward that inner space, that inner river. Everything goes toward that place of quiet, that realm of tranquility within the forest where there is a lake."

আসলে সাঞ্চেজের অধিকাংশ ছবিই প্রেমের ছবি। ছবি না বলে চিঠিও বলা যায়। তাঁর এক একটা ছবি যেন প্রকৃতিকে লেখা প্রেমপত্র। সেখানে নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা আছে, সমর্পণ আছে, কিন্তু কোনও স্বার্থ নেই। এই নিঃস্বার্থ প্রেমের সিগনেচর দেখে খোদ গার্সিয়া মার্কেজ সাঞ্চেজের প্রেমে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, "মানুষ যেভাবে এই দুনিয়াকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করছে, ফের যদি কোনোদিন আমাদের এই পৃথিবীটাকে প্রথম থেকে সাজানো হয়, তাকে সাঞ্চেজের ছবির মতো হতে হবে।"

মন খারাপ থাকলে ইন্টারনেটে খুঁজে খুঁজে তোমাস সাঞ্চেজের ছবি দেখুন। হয়তো মন ভালো হবে। হয়তো মনে হবে, সব দুঃখ কষ্ট বিচ্ছেদ সহ্য করেও বেঁচে থাকাটা আসলে মন্দ নয়।












শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪

মালাগা সফর- এপ্রিল ২০২৪

 


এককালে তাঞ্জিয়ারকে বলা হত আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশপথ। উত্তর আফ্রিকার সর্ববৃহৎ বন্দর, আমেরিকা ইউরোপের বাণিজ্য জাহাজ এসে নোঙর করত মরক্কোর এই শহরে। সেই বন্দর এখনও চালু আছে যদিও, কিন্তু আগের মতো রমরমা নেই। হাফ দিনের মধ্যে দেখে যা বুঝলাম, তাঞ্জিয়ার বেশ বড় শহর। আধুনিক একটা কস্মোপলিটানে যা যা থাকতে পারে, এখানে সব কিছুই আছে, কিন্তু শহরটা মরক্কোর টুরিস্ট সার্কিটে নেই। এ হল আমজনতার শহর, জিনিসপত্র সস্তায় পাওয়া যায়, আবার টাকা ওড়ানোর ঠেকও আছে। যাই হোক, পোস্টটা তাঞ্জিয়ার নিয়ে নয়, যে শহর থেকে আগে সবাই আফ্রিকায় ঢুকত, সেই শহর থেকে ফ্লাইটে করে আমরা ইউরোপে ফিরে এলাম। 

কোথায় ফিরলাম? মরক্কোয় গেলে যেখানে না গেলেই নয়! জায়গাটা কাছে তো বটেই, আর আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানা আছে, এই অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের একটা নাড়ির যোগ আছে। বেশ কয়েক বছর আগে যখন স্পেনের দক্ষিণ মানে আন্দালুসিয়ায় আসা হয়েছিল, সেভিয়া, গ্রানাদা, রন্দা দেখলেও মালাগায় আসা হয়নি। এইবার সেই ভুল সুধরোতে চারদিনের মালাগা সফর। কোস্টা দেল সূরের সবচেয়ে বড় শহর, পিকাসো জন্মভূমি, অলিভ গাছের বন, টারকোয়ায়েজ সমুদ্র, কবিদের তীর্থস্থান আর অগুন্তি ছোট ছোট মন কেড়ে নেওয়া গ্রাম আর টাউন, আন্দালুসিয়ায় যাদের নাম পুয়েবলো ব্লাঙ্কোস। ১৯২৭ সালে যখন দেশে চরম অরাজকতা চলছে, সারা দেশ থেকে লেখক আর কবিরা এসে জড় হয়েছিলেন এই অঞ্চলে। শুরু হয়েছিল জেনারেশন অফ ২৭। কবিতা নাটক চিত্রনাট্য ছোটগল্প উপন্যাসের চিরাচরিত স্টাইল ভেঙে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে আগ্রহী এই সাহিত্য আন্দোলনে কে ছিলেন না? লোরকা তো ছিলেনই, সঙ্গে ছিলেন নামকরা কবি আর ভাষাবিদ হোর্হে গুলিয়েন, রাফায়েল আলবের্তি, সুরিয়েলিস্টিক স্টাইলের ভক্ত কবি ভিসেন্তে আলিহেন্দ্রে, স্টাইলিস্টের প্রতিষ্ঠাতা আমাদো আলোনসো, পেদ্রো সালিনাস, ডামাসো আলোনসো, এমিলিও প্রাদোস প্রভৃতি। 

বছর ছয়েক আগে যখন এই অঞ্চলে এসেছিলাম, তখনই বুঝেছি, স্পেনের আত্মাকে বুঝতে হলে মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার চেয়ে দক্ষিণে আসাই বেটার। মাদ্রিদ পুরোপুরি ইউরোপীয় ক্যাপিটাল, সেখানকার হিস্প্যানিক সংস্কৃতি বড়ই 'টেলার্ড' বা সাজানো, আর বার্সেলোনা তো একেবারেই কাতালান কালচারের জায়গা। আন্দালুসিয়ার সে দায় নেই, হিস্প্যানিক কালচারের গোটাটাই এখানে অনুভব করা যায়। সেক্ষেত্রে কথা হল, কী এমন আছে এই হিস্প্যানিক কালচারে? পেশাদারী সৌজন্য? আন্তরিক আতিথেয়তা? ফুর্তিবাজ জীবন?

হুমম। সে বলা কঠিন। স্পেনে তর্তিয়া বোকাদিয়া স্যান্ডউইচে দিয়ে খায়, মালাগার রেড সুইট ওয়াইন আইসক্রিমেও ব্যবহার হয় আর বাস্কেটবল টিম ম্যাচ জিতলে রাজ্যের লোক টিমকে সংবর্ধনা দিতে রাস্তায় নেমে পড়ে আর পুলিশ রাস্তা ব্লক করে নিজেরাও সেই উৎসবে শামিল হয়, শুধু এসব বললে কি আর বোঝা যাবে? লোরকা জিপসি ব্যালাডে লিখেছিলেন...

“It will be a long time, if ever, before there is born an Andalusian so true, so rich in adventure. I sing of his elegance with words that groan, and I remember a sad breeze through the olive trees."  

সব যদি বলে আর লিখেই বোঝানো যেত, তাহলে আর এত ঝক্কিঝামেলা নিয়ে ঘোরাঘুরির দরকারটাই কী ছিল? আসল কথা হল দেখা! নির্লিপ্তভাবে, বোঝার জন্য নয়, দেখার জন্যই দেখা! যেমন, মালাগার মেট্রো আর বাসে অসংখ্যবার দেখলাম, একজন মেয়ে বা ছেলে তার পার্টনারকে কথা বলে যাচ্ছে, অন্যজন মন দিয়ে শুনে যাচ্ছে। একান্ত মনযোগ তাদের চাহনিতে। একটা বিশালবপু মহিলার বয়ফ্রেন্ড তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে আর মহিলাটি তাকে নরম গলায় ওয়ার্কপ্লেসের ঘটনা জানাচ্ছে! বলছে তো বলছেই। কিংবা, সেলিব্রাল পালসি (বা পঙ্গু) আত্মীয়কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে এসেছে একজন আর দুজনেই জোরে জোরে হাসছে, বা ব্যস্ত টুরিস্ট আওয়ারেও মাছদিদি বা পেসকাদো দাদা ফোনে কথা বলেই চলেছে, খামোনের স্লাইস কাটতে কাটতে সুর ভাঁজছে বুড়ো মাংসওয়ালা... এমন অজস্র ছোট ছোট দৃশ্য। এই সব নিয়েই আসল স্পেন।

একটা দেশের কালচার ফিল করতে হলে সেখানকার ইতিহাস, সমাজ আর বাঁকবদলের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকাই সমীচীন, আমার অন্তত তাই ধারণা। সে সব লিখে বোঝানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাছাড়া  সেই চেষ্টা করলেও সবসময় পাঠকদের ধৈর্য থাকে না। সেবার ইউরোপ থেকে ঘুরে এসে এত সবকিছু এতটাই ডিটেলে লেখার চেষ্টা করেছিলাম যে অনেকেই হয়তো বোর হয়ে বইটা মাঝপথে ফেলে পালিয়েছে, 'ভ্রমণ সাহিত্য' কতটা সাহিত্য হবে কতটা ভ্রমণ (ভ্রমণও আবার নানাভাবে হয় পথে নামলে। একটা চলে বাইরে, একটা চলে মনে মনে) হবে সে ভাগাভাগি করা মহা ঝামেলা, আর সব কিছু ব্যালেন্স করতে হলেও সকলের অত ধৈর্য থাকে না। তাই আর বইফই নিয়ে মাথা ঘামাই না। যাই হোক, অবান্তর কথা না বলে এই ছোট্ট ট্রিপের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করে রাখি বরং।

মালাগা শহরটা ছিমছাম, পাহাড় সমুদ্র গ্রিনারি সহ একেবারে টিপিকাল 'ট্রাংকিলো' মেজাজের শহর। এই ট্রাংকিলোই আসলে আন্দালুসিয়ার কালচারের সবচেয়ে বড় জিনিস, কিন্তু গুগলে মানে খুঁজলে কিছুই বোঝা যাবে না। কিন্তু আসলে ট্রাংকিলো হল একটা কালেকটিভ লাইফস্টাইল... 'কাম ডাউন। হ্যাভ আ ড্রিংক। নিঃশ্বাস নাও বাছা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। আমরা আছি তো। চলো, প্লাজা থেকে একটু হেঁটে আসি। এই মেয়ে, স্প্যানিশে গিটারে একটা সুর তোল না! ওই ছেলে, কমলালেবুর রসটা খাও! ভালো লাগবে! কুল! হ্যাভ আ ব্রেথ!" এই মেজাজটাই হল আসলে ট্রাংকিলো। মালাগা, নেরহা বা ফ্রিগালানো... যেখানেই গেলাম এই যাত্রায়, সেই ট্রাংকিলো লাইফস্টাইলের ছাপ সর্বত্র! আসলে, এই স্বভাবটার জন্যই হিস্প্যানিকরা ফ্রাঙ্কোর মতো স্বৈরাচারী শাসনকে সার্ভাইভ করে গেছে। চল্লিশ বছরের ডিক্টেটরশিপ আর তুমুল সেনশরশিপও হিস্প্যানিক সাহিত্য সংস্কৃতিকে খুব একটা আটকাতে পারেনি, এখানকার শিল্পীরা, এই মাটিতে জন্মানো কবি লেখক চলচ্চিত্র পরিচালকরা নিজেদের কথা বলার উপায় ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন। রুবেন দারিও থেকে হেমিংওয়ে, সারা দুনিয়া থেকে তাবড় তাবড় শিল্পীরা এসে প্রেমে পড়েছেন আন্দালুসিয়ার, অনেকে সব ছেড়েছুড়ে এই ট্রাংকিলো জীবনের স্বাদ পেতে এখানেই চিরস্থায়ী ঘর বেঁধে থেকে গেছেন। আমার ঘরবাড়ির বালাই নেই, তাই ভবিষ্যতের চিন্তা না করে দেখেই যাই। রাস্তাঘাট, গাছপালা, মানুষজন। গোটা শহরটাই বেগুনি জাকার‍্যান্ডা গাছে ছেয়ে আছে, শান্ত পাড়াগুলো যেন আরো রঙিন। সবুজে সবুজ। সাদা পাঁচিল থেকে নুয়ে পড়ছে আইভি লতা আর বাগানের বোগেনভিলিয়া গাছগুলোয় টুকটুকে লাল রঙ ধরেছে। গোলাপ আর হাজার রকম পুটুসের ঝাড় তো আছেই। আর আছে বেড়াল। যে পাড়ায় আমরা ছিলাম, সেখানে এক প্যান্থার সাইজের মিশমিশে কালো বেড়াল দেখলাম, মনে হল ব্রাউন সাহেবের বাংলোর সাইমন এর লতায়পাতায় পরিচিত হবে, যদিও এ ব্যাটা বাঘের মাসি নয়, সত্যিই বাঘ।

সকাল সকাল সেজেগুজে জুমোস, বোকাদিয়া আর কাফে কোন লেচে (মানে কমলার রস, স্যান্ডু আর কফি আর কি) খেয়ে 'চাউ চাউ' বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ি, তারপর সারাদিনের টো টো কাহিনি। আগের চেয়ে স্পেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে মনে হল, যদিও অস্ট্রিয়ার মতো গলাকাটা নয়। তবে এখানে লোকজন আমুদে, কথা বলতে ভালোবাসে, আর আমাদের মধ্যে একজন স্প্যানিশ ভাষী বলে এক্সট্রা অ্যাডভান্টেজ তো আছেই। এইপাড়া সেই পাড়া করে বইয়ের দোকানে আশ্রয় নিই। মালাগার নবীন লেখক জাভিয়ের কাস্তিয়োর গল্প এখন সবাই জেনে গেছে, ফিনান্সে কাজ করতেন এই যুবক। কাজে যাওয়ার সময় বাসে মেট্রোয় মোবাইলে লিখে লিখে প্রথম বইটা সেল্ফ পাবলিশ করেছিলেন, তারপর সে বই এমন হিট হয় যে পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে, নেটফ্লিক্সে ইতিমধ্যেই তাঁর বইয়ের ওপর নির্ভর করা সিরিজ এসে গেছে। কাসা দে লিবরোতে তুমুল প্রচার চলছে তাঁর নতুন বইয়ের, অন্যান্যদের পাশাপাশি আমাদের প্রিয় সেসার মাইয়োর্কির ছোটদের জন্য লেখা নতুন বইটাও দেখলাম। ওল্ড টাউনে রবিবার অনেকগুলো মিউজিয়াম ফ্রি থাকে, সেখানে পিকাসো মিউজিয়ামের সামনে এইসা লম্বা লাইন পড়েছে যে বলার নয়! লোকের হুজুগ দেখি আর হাসি পায়! পিকাসো এখানে জন্মেইছেন, তাঁর শিল্পজীবনের সঙ্গে এখানকার কোনওই সম্পর্ক নেই। বরং তাঁর বাবার কথা শুনে বেশ মজা লাগল। হোসে রুইজ ই ব্লাস্কো মানে তাঁর বাবার কাছ থেকেই আঁকায় হাতেখড়ি হয়েছিল পিকাসোর, কিন্তু কেন জানি না হোসে শুধুই পায়রার ছবি আঁকতেন সবচেয়ে বেশি। পিকাসোর মনে বাসা বেঁধে ছিল সেই সব ছবি। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া সাদা পায়রা। একাধারে পলিটিকাল এবং পার্সোনাল। সাদা পায়রাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে এস্ট্যাবলিশ করার ক্রেডিটও পিকাসোরই। যাই হোক, ভিড়ের হাত থেকে রেহাই পেতে আমরা পিকাসোকে ভুলে পম্পডেই মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। প্রায় কেউই নেই সেখানে, সবাই মডার্ন আর্ট আর আর্টিস্টকে ভুলে পিকাসোকে নিয়েই মেতে আছে, তাই আমাদের মৌজ, যদিও মিউজিয়ামটা চমৎকার। বেশ কিছু সমসাময়িক আধুনিক শিল্পীদের কাজ দেখা হল, সে নিয়ে পারলে অন্য একটা পোস্ট দেওয়ার চেষ্টা করব।

মালাগা সহ দক্ষিণ স্পেনের সর্বত্র মুসলিম আর্কিটেকচার বা বারোক মুদেহার স্থাপত্যের আধিপত্য, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কাস্তিও দে জিব্রাল্ফোরো থেকে আল্কাজাবা বা শহরের অসংখ্য প্রাসাদোপম বাড়ি, গির্জা বা বাজারে সেই ছাপ দেখা যায়। তবে গ্রানাদায় আলহাম্ব্রা প্যালেস দেখা হলে আলাদা করে আর সে নিয়ে কিছু দেখার দরকার নেই, তাই এই যাত্রায় আমরা কেল্লা ফেল্লার টিকিট কাটতে যাইনি। তবে টিকিট না কাটলেও কেল্লার একপ্রান্ত অব্দি উঠতেই হয়, কারণ শহর-সমুদ্র- বন্দর- সিয়েরা নেভাভা মাউন্টেন মিলিয়ে যে তিনশো ষাট ডিগ্রি (নাহ, দুশো কুড়ি ফুড়ি হবে বোধহয়) প্যানারোমিক দৃশ্যটা সেখান থেকে দেখা যায়, সেটা দেখে মনমেজাজ নিজে থেকেই ফুরফুরে থুড়ি ট্রাংকিলো হয়ে যায়। উপরি পাওনা বৃষ্টি। এই সফরে ব্যাগের মধ্যে ছাতা ঢুকিয়েও বার করা হয়েছে, (আমিই বলেছিলাম। একটা হ্যান্ডস ফ্রি লাগেজ যেখানে সম্বল, সেখানে ছাতা কী হবে? মরক্কো বা স্পেনে কোথাওই বৃষ্টির কথা ছিল না ফোরকাস্টে, এমনিতেই এপ্রিলের শেষে এখানে বৃষ্টি হয় না, কিন্তু আমাকে মুখ ভেঙানোর জন্যই যেন দুই জায়গাতেই বৃষ্টি হল। আমার জন্মই বৃষ্টিলগ্নে যে!) তাই আমি ক্রমাগত চোখ রাঙানি সহ্য করছি। তবে বৃষ্টি যখন হয়েছে, তখন কি আর ম্যাজিক বাদ যাবে? তাই ভিজে জামা গায়ে দিয়ে যখন দূরের বুলফাইটিং এরিনা আর নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি পাহাড়ের ওপর থেকে, তখন হুট করে কিছুটা মেঘ সরে গেল, আড়ালে থাকা সূর্যের আলো মেঘের ছাঁকনি থেকে তেরছা হয়ে গলে গোটা চরাচরকে উদ্ভাসিত করে তুলল, আর আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা প্রকাণ্ড রামধনুর অংশ। 

শীত বাই বাই করেছে, প্রায় সোয়া ন'টা পর্যন্ত আলো থাকে আকাশে। রাতে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিদিন আকাশে রঙের খেলা শুরু হয়, আমরা সেদিকে চোখ রেখে ঘরের কাছের একটা কাফেতে ঢুকি। কাফে কাম রেস্তোরাঁ, নাম ono... পাশেই একটা হাসপাতাল আছে, সেখান থেকে সবুজ গাউন পরা ডাক্টার আর নার্সরাও এখানে কফি খেতে আসে, কেউ কেউ মথায় পট্টি বা পায়ে প্লাস্টার বেঁধে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে হাজির হয়। রান্নাবান্না কিন্তু চমৎকার। সর্বক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যেও বেয়ারারা যথাসম্ভব কী বলব মানে ট্রাংকিলোইস্ট... এদিকে কাউন্টারের ওপর কিছুক্ষণ চোখ রাখলেই বোঝা যায় কী স্পিডে কাজ হচ্ছে। একসঙ্গে চারটে মেশিন থেকে এসপ্রেসো বেরোচ্ছে, ভিতর থেকে রান্নার বাটি আসছে, জুস বের করছে দুজন, সবাই বিল কাটছে, নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমরা কফির সঙ্গে আপেল বা গাজর এর কেক অর্ডার করি, বা চুরোজ। চুরোজ কোন চকোলেট। তোহফা খেতে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি, পিছনের বাগানে পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে বোগেনভিলিয়াকে স্নান করাচ্ছে, সাইমনের জ্ঞাতিভাই ম্যাও ম্যাও করতে করতে চক্কর মারছে।

মালাগায় খানিক হাওয়া লাগিয়ে একদিন নেরহায় চললুম। আলসার বাসের কদর আছে বলেই স্পেনে এখনও ফ্লিক্সবাস জাঁকিয়ে বসেনি, একঘণ্টায় পৌঁছে দিল নেরহায়। ইউরোপের বালকনি বলা হয় এই টাউনকে, টিপিকাল টুরিস্টি মফস্বল, চকচকে পাথরের রাস্তার দুইধারে স্যুভেনিরের দোকানপাট। স্কার্ফ, সুগন্ধি, রেশমের ওড়না, দামি পাব। যদিও সমুদ্রের ওপরের সেই প্রকাণ্ড বালকনি কাম ভিউ পয়েন্ট দেখে আঙুল কামড়াতে হয় বইকি। সুইমিং সিজন বা বিকিনির মরসুম এখনও আসেনি, জোর হাওয়া দিচ্ছে, এরই মধ্যে অনেকে ট্যান হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমাদের ভারতীয় চামড়া, ট্যান ফ্যান বুঝি না, বেশিক্ষণ রোদ লাগলেই পুড়ে যাওয়া বেগুনভাজার মতো মুখ হয়ে যায়। তা সেসব কথা থাক! স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে একদম মাশাল্লাহ পারফর্ম্যান্স দিচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়, গান নির্বাচনের জন্যই তারিফ সহ তাঁকে এক্সট্রা ব্রাউনি পয়েন্ট দিয়ে দিলাম। নেরহা ছোট জায়গা হলেও পাহাড় দিয়ে ঘেরা, ফুরফুরে হাওয়ায় গরম তো লাগে না। ঘুরপথে এই গলি সেই গলি করে, রেদোন্দা বারে মিটবল ইন আমন্ড সস আর মালাগা ওয়াইন খেয়ে, কিছুক্ষণ ফুলে বোঝাই লাল গাছগুলোর দিকে মুগ্ধতার আবেশ কাটানো হল... তারপর আমরা চললাম ফ্রিগলিয়ানায়। 

ফ্রিগলিয়ানা দক্ষিণ স্পেনের ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম। সব বাড়িঘর সাদা, হোয়াইট ভিলেজ বা পুয়েবলো ব্লাংকো এই অঞ্চলে চারিদিকেই আছে, তাদের মধ্যেও ফ্রিগলিয়ানার একটা নিজস্ব চার্ম আছে। আমাদের বাড়িওয়ালা দানিয়েল বারবার করে বলে দিয়েছিল এখানে আসতে, আমি যদিও খানিকটা আন্ডারএস্টিমেট করছিলাম। এসব টুরিস্টি জায়গা আমাকে খুব একটা টানে না। কিন্তু এসে বুঝলাম, জায়গাটা ঠিক তথাকথিত ডে ট্রিপার প্যারাডাইজ নয়। বরং বলা যায়, হাওয়াবদল এর জন্য অনেকে এখানে আসে। অনেকটা সে যুগের শিমুলতলা বা মধুপুর এর মতোই। অনেক বাড়িই লং টার্ম এর জন্য ভাড়া নিয়ে থাকে অনেকে, কাজকর্মও করে। অনেক জায়গা থেকে কিবোর্ড বা টাইপরাইটারের শব্দ ভেসে আসছিল। হ্যাঁ, টাইপরাইটারই। এই যুগেও। তিন সত্যি করছি। 

ঘোরানো রাস্তা দিয়ে হাঁটি আর ভিউপয়েন্ট দেখে থমকে যাই। সত্যিই সুন্দর। হাইকার আর বাইকারদের জন্য অসংখ্য ট্রেইলও আছে এ পাহাড়ে, সে দু কিলোমিটার থেকে দুশ কিলোমিটার, যার যা ইচ্ছে। ছিমছাম প্লাজা, গোছানো কাফে, শান্ত পাড়া, খাড়াই উৎরাই রাস্তা, পাথরের সিড়ি, একটা সাজানো গোছানো পাহাড়ি গ্রামে যা হবে আর কি! হ্যাঁ, বাড়িগুলো একদম দুধসাদা, আর ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। এক একটা বাড়ির সামনে এসে নিজেই পা থেমে যায়। টবের মধ্যে হরেক রকম ফুল, আর ফুলের লাল যে এমন রক্তিম হয় চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ঝকঝকে রোদ্দুর, তকতকে বাড়ি, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে তাদের কুচকুচে কালো বেড়াল নিয়ে খেলা করছে টুকটুকে লাল ফুলগাছের কাছে৷  উজ্জ্বল হলুদ রঙের পুটুস ফুল, কমলালেবু ভর্তি গাছ, মানুষ হলে এসব দেখে মুখে হাসি ফুটবে না, এ আমি মানি না। নীল আকাশ বলেও যে কথাটা জানতাম, সে জিনিসটাও আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। এখন চোখ খুলেছে। নীল আকাশ, সুন্দর নীল আকাশ, ভীষণ সুন্দর নীল আকাশ আর ভয়ংকর সুন্দর নীল আকাশের মধ্যে কিছুটা তফাত করা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, আকাশি বা স্কাই ব্লু রঙ বলেই প্রাথমিক পাঠ শেষ হলে চলবে না, সেলুরিয়ান ব্লু আর টিলের ব্যাপারটাও জেনে রাখা দরকার। 

হাঁটতে হাঁটতে চলি। যেমন ট্রাংকিলো মানুষ, তেমন ট্রাংকিলো বাড়ি, আর মজার কথা হল, প্রতিটা বাড়িরই একটা নাম আছে। কাসা লোর, কাসা আজুল... কয়েকটি বাংলা করে রেখেছিলাম। একটাও বানানো নয়, মেলাতে চাইলে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। নীলবাড়ি, গল্পের বাড়ি, বিল্লি বাড়ি, সাদা গোলাপের বাড়ি, হলুদ মেয়ের বাড়ি, রূপকথার বাড়ি, ফুলের বাড়ি, স্বপ্নের বাড়ি, এবং... বাতাসবাড়ি। গল্প ভাবছেন? ঠিকই, আন্দালুসিয়ার জীবনে এমন গল্প বারবার ফিরে আসে।





























মরক্কো সফর- (৩) দ্য সিম্ফনি অফ সানসেট

 


সূর্যাস্তের একটা নিজস্ব ঐকতান আছে। বলা যায়, দ্য সিম্ফনি অফ দ্য সানসেট, প্রতিটা শহরের সূর্যাস্তের এই কম্পোজিশন তার নিজস্ব। বেশ কয়েক বছর ধরে আমি বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে এই সিম্ফনি সঞ্চয় করার চেষ্টা চালাচ্ছি। সাহারা থেকে ফিরে এসে মরক্কোয় যে কয়েকটি দিন কাটল, প্রতিটা দিনেই অসামান্য এক একটা সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম। কয়েক বছর পর ফিরে চাইব যখন, প্রথমেই সূর্যাস্তের সেই সুরগুলো স্মৃতিতে ভিড় করে আসবে।

প্রথমেই বলা দরকার মারাকেশের সূর্যাস্তের কথা। ঘটনাসূত্রে মারাকেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত হয় যে জায়গায়, সেখানে ইচ্ছে করেই যাওয়া হয়নি। লা পালমেরাই (Palmeraie) নামের এই জায়গাটার ইতিহাস অবশ্য চিত্তাকর্ষক, বর্ণনা শুনে জায়গাটাও সুন্দর বলেই মনে হয়। প্রায় হাজার বছর আগে আরব যোদ্ধারা এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাম গাছ লাগানোর প্ল্যান করেছিল একটা বিরাট ওয়েসিস বা মরুদ্যান বানানোর জন্য, তার জন্য ব্যবহার হয়েছিল খেট্টর ইরিগেশন সিস্টেম। খেট্টরের এই প্রযুক্তিও কম ইন্টারেস্টিং নয়, ভূমিগত কুয়ো বা অ্যাকোয়াডাক্ট থেকে ভূপৃষ্ঠে জল টেনে নিয়ে আসার নজির আরব দুনিয়ায় বেশ কিছু আছে। যাই হোক, অত বড় না হলেও শুনেছি  হাজারটারও বেশি গাছ আছে আজও, পালমাইরির এই পাম গ্রোভে হাজার খানেক গাছের পিছনে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য ঠিক কেমন হতে পারে, নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন। আমরা অবশ্য যাইনি, কারণ পাম ওয়েসিস থেকে হিউমান ওয়েসিস ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তাই সারাদিন এদিক সেদিক করে, মেশুই ল্যাম্বের লোভনীয় সুবাসের মায়া কাটিয়ে, গরম বাঁচাতে গ্লাসের পর গ্লাস ফ্রুট শেক খেয়ে, কুতুবিয়া মসজিদের কুকি হকারের কাছে কয়েক দিরহাম ঠকে, শেষমেশ ছ'টা নাগাদ উপস্থিত হলাম মারাকেশের নিজস্ব মক্কা... জামা আল ফানায়। ততক্ষণে রুফটপ রেস্তোরাঁর রুফ ফুল, ওপরে যেতে হলে কয়েক দিরহাম গচ্চা দিয়ে ফালতু চা বা ড্রিংক নিতে হবে, তাই সই। ভাগ্য ভালো, বৃদ্ধ এক দম্পতি দমকা হাওয়ার জন্য বিরক্ত হয়ে একটা টেবিল ছেড়ে দিলেন আর আমরাও কাঠ দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসা অবস্থায় থিতু হয়ে নিচের পৃথিবী থুড়ি স্কোয়ারের দিকে নজর দিলাম।

এইবার, জামা আল ফানার স্কোয়ারটা যে ঠিক কী জিনিস, তার খানিকট আভাস আমি আগের একটা পোস্টে দিয়েছি৷ সেলিব্রেশন অফ লাইফ বলা আন্ডারস্টেটমেন্ট হয়ে যাবে। এই প্রকাণ্ড লাইভ ইভেন্ট যে প্রায় পাঁচশো (মিনিমাম) বছর ধরে প্রতিদিন হয়ে চলেছে, সেটা ভাবলেই মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। জেমা আল ফনা নামটার ব্যাখাও নানাভাবে করা যায়, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না, কারণ যতগুলো মানে আমি অন্তত মনে মনে ভেবেছি, তার সবগুলোই এখানে পার্ফেক্টলি খেটে যায়৷ ফনা নামটার সঙ্গে কোথাও গিয়ে আরবির 'আফনান' ﺍﻓﻨﺎﻥ কথাটার যোগ আছে, মানে শাখাপ্রশাখা। তা এই স্কোয়ারকে যদি বোধিবৃক্ষ বলে কল্পনা করার চেষ্টা করি, (বিশেষ মেহনত করতেও হবে না, জায়গাটার মাহাত্ম্যই এই),  তাহলে সেই বৃক্ষের 'শাখাপ্রশাখা' মানে 'শোউক'রূপী বাজারের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে অনন্ত অসীমে ছড়িয়ে গেছে। আবার উর্দুতে দেখতে গেলে 'ফনা' হল too perish, বা আরো ভালো করে বোঝাতে হলে 'মরণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া', হিন্দিতে যাকে বলে  'নিয়োছাওয়ার কর দেনা'; (ইশক মে ফনা হো জানা শুনেছেন তো? ওই) আবার 'ফন' হল আর্ট, ফনকার মানে আর্টিস্ট... এদিকে জেমা অল ফনা আবার হাজার বছর ধরে আর্টিস্টদের তীর্থস্থান। 'ফিনা' বলেও একখান কথা আছে শুনলাম, মানে আরবিতে ওপেন স্পেস। জেমা মানে আবার দেখা যাচ্ছে, congregation, কিন্তু মসজিদ বা ধর্মীয় আধ্যাত্মিক স্থলের জন্যও শব্দটা ব্যবহার হয়। তাহলে কী দাঁড়াল? সব কেমন খাপেখাপ মিলে যাচ্ছে না! 

এমন কি বলা যেতে পারে না, যে জেমা আল ফানা এমন একটা স্প্রিচুয়াল ওপেন স্পেস, স্পেসটাইমের এই অদ্ভুত জায়গার সম্মোহন ফন আর ফনকার, মানে আর্টিস্ট ও তাদের আর্টকে সম্মোহন করে, তাদের নিজের সেরা দিয়ে এই স্প্রিচুয়াল আপহিভালের জন্য 'ফনা' হয়ে যেতে এনকারেজ করে, উদ্বুদ্ধ করে। যদি তা না হত, তাহলে কেন ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েও চোদ্দ ঘণ্টা হেনা আর্টিস্টরা লোকদের ডেকে যায়, সাপ আর বাঁদরখেলার মতো আদ্যিকালের বোকাসোকা অ্যানিমাল ক্রুয়েল্টি সম্পৃক্ত খেলার রেওয়াজ এখনও বর্তমান, কেন অনবরত কুড়িরকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে চলে বাদ্যকররা, যে সব বাজনা এখন পাওয়াই যায় না, কেনই বা ইংরেজি আর ফরাসীভাষী টুরিস্টদের সামনে এখনও স্ট্রিট আর্ট আর হিকায়তদের আসর বসে? বেদুইনদের মতো সাজগোজ করে মাঝবয়সী মানুষগুলো নেচে নেচে লোক জড় করে? প্রতিদিন। অক্লান্ত, অবিরাম। নো সেমিকলন, নো কমা, নো দাঁড়ি। আর এই এত এত ফনকার, এই হাজার বছর প্রাচীন শিল্প আর তাদের স্রষ্টাদের এই যাপন শুধুই উপার্জনের জন্য নয়, এই পারফর্ম্যান্সের, এই এক্সিস্টেন্সিয়ান আর্টিসস্টির আবহমান উপস্থাপনার মধ্যে একটা মারাত্মক তীব্রতা আছে, একটা নেশা আছে, যা এখানে না এলে, দীর্ঘক্ষণ ধরে চাক্ষুষ ব্যাপারটা না দেখলে, বোঝা সম্ভবও নয়। কিন্তু যদি কেউ সত্যিই ব্যাপারটা বুঝতে চায়, তাহলে তার সেরা সময় হল 'ঘুরুব', উর্দুতে বলে ঘুরুব এ আফতাব, মানে...  সূর্যাস্ত। ওই যে বলছিলাম, সানসেটের একটা নিজস্ব সিম্ফনি আছে। আমরা বুঝি না বুঝি, বিশ্বচরাচর সেটা ঠিকই বোঝে। সেই সময়টায়, সানসেট সিম্ফনির তালের হাইনোটের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জামা আল ফানা যেভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে, তাতে অভিজ্ঞতাটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যায়, যা সত্যিই অতিমানবিক, অতীন্দ্রিয়। গোটা এক ঘণ্টা ধরে, সূর্যের পড়ন্ত আলো কমতে কমতে অন্ধকার হয়ে আসা আর বিজলি বাতি জ্বলে ওঠার পাশপাশি আকাশের রঙ বদলে যাওয়া, আর মসজিদ শৌক মাদিনার পটভূমিতে যে জিনিসটার সাক্ষী হয়ে রইলাম, সেটা শুধুই লক্ষাধিক মানুষের ভিড় নয়, শুধুই কসমিক এক্সিস্টেন্সের অন্তহীন বিলাপ বা উচ্ছ্বাস নয়, শুধুই একটা 'সানসেট মোমেন্ট' নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি। এর চেয়ে বেশি বোঝানো সম্ভবও নয়।

ফেজ। কাসাব্লাঙ্কা, মহমেদিয়া, রাবাত হয়ে ট্রেনে করে এখানে আসা। মারাকেশ থেকে ফেজে আসলে অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, কারণ মদিনার সেই গোলকধাঁধা থেকে শুরু করে ফেজে মারাকেশের প্রায় সব কিছুই আছে, মারাকেশ থেকে ফেজ অনেক বড়, দুনিয়ায় বৃহত্তম আরবান কার ফ্রি জোন, পাহাড় দিয়ে ঘেরা বলে এখানের আবহাওয়া অনেকটা মোলায়েম, শহরটা পরিচ্ছন্নও বেশি, এখানকার মদিনার অবস্থানও তুলনামূলক ভাবে বেশি উচ্চতায়, গোটা শহরটাই টিপটপ, পাম গাছের সারি দিয়ে সজ্জিত চওড়া রাজপথ আছে, ওদিকে মদিনার ভিতরে সঙ্কীর্ণ গলিপথগুলো খাড়াই বা উতরাই বেয়ে এগিয়ে গিয়েছে, 

কিন্তু... মারাকেশের সেই অতিরিক্ত এনার্জি আর জেমা আল ফানার উন্মাদনা এখানে নেই। গ্রাহকদের বিক্রেতারা সাধাসাধি করে খানিক, কিন্তু লাফালাফি করে না। অনেকে তো পাত্তাও দেয় না, তারা নিজের কাজ করতেই ব্যস্ত।

তবে তাই বলে এই শহরটাকে হেয় করার কোনও কারণ নেই, কারণ ফেজ সব অভাব পুষিয়ে দিয়েছে তার ইন্টেলেক্টুয়াল হেরিটেজ দিয়ে। ফেজ ইসলামিক আর্কিটেকচার এর তীর্থস্থান, এখানের অলিগলিতে হুটহাট এমন সব অভাবনীয় স্থাপত্য আর শিল্পকলার নমুনা চোখে পড়ে যে চোখ কপালে উঠে যায়। 

প্রায় পনেরো'শ বছর আগে এখানে প্রথম এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল, তারপর থেকে ফেজ চিরকালই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হয়ে থেকেছে। আব্দেল্লাতিফ লাব্বি থেকে মোহাম্মদ বেনিস, আল্লাল আল ফাসসি থেকে ফাতিমা বোহারকার মতো ফেজের কবি আর লেখকরা তো আছেনই, টেনেসি উইলিয়ামস থেকে এডিথ হোয়ার্টন অব্দি অনেকেই এই শহরে ফিরে ফিরে এসেছেন। ২০১১ সাল থেকে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ডস পোয়েটস ফর চেঞ্জ বলে একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় ফেজে, সেখানে অন্যান্য দেশের সাহিত্যিকরাও আসেন। ফেজের গলিতে গলিতে অসামান্য সব আর্টের ছড়াছড়ি, সে সূক্ষ্ম মোজায়েকের কাজ করা ফাউন্টেন হোক বা সাইকেডেলিক আর্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা আধুনিক শহরের পেইন্টিং। কিন্তু এই সমস্ত শিল্পের ঊর্ধ্বেও একটা শিল্প আছে আল্লাহতালার, যা বোঝা যায় ঠিক সূর্যাস্তের সময়েই। মাদিনার গেট থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের রাস্তায় উঠে গিয়ে অনেকটা ওপরে গিয়ে একটা কবরখানা, পাথরের ভাঙা তোরণ আর স্থাপত্য দিল্লির কথা মনে করিয়ে দেয়, সেখানে দাঁড়িয়ে গোধুলিবেলায় যখন এই সীমাহীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের চলমান ছবির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, অ্যাটলাস পর্বতশ্রেণীর আড়ালে যখন সূর্যের শেষ রশ্মি মিলিয়ে যায় আর আকাশরেখায় অদ্ভুত রঙের ছায়াখেলা শুরু হয়, তখন অনুভব করি, একেকটা শহরের বুকে আলাদিনের চিরাগের মতো কত জাদু, কত কবিতা লুকিয়ে থাকে! সাধেই কি লাব্বি ফেজকে কবিতার গাছ বলে তুলনা করেছেন...

Some say it's a question of public interest, 

but I say it's a question of memory. 

From time to time, 

the memory of men reaches saturation point, when they offload the heavy weight of the past and make room to prepare for the beloved new.

These days, 

old species aren't fashionable. 

They have invented trees that grow quickly and make do with only water and sunshine, 

and who go about being trees both quietly and soullessly.

I am the poem tree. 

They have tried to manipulate me, 

but their efforts came to naught; I'm intractable, the master of my own mutations...

মরক্কো ছাড়ার আগে যে শহরে সূর্যাস্ত দেখলাম, তার কথা বলার আগে একটা নিজস্ব রিয়ালাইজেশনের কথা জানাই। এই উপলব্ধি আমার নিজের, তাই বাকিদের কথা বলতে পারব না। 

বছর কয়েক ধরে ইন্সটাগ্রামে ভালো ভালো জায়গার ছবি দেওয়ার চল শুরু হয়েছে, সে ব্যাপারটা আমার নিজের পছন্দ হোক না হোক সে অন্য কথা, কিন্তু তাতে অনেকেই লাভবান হয়েছে। লোকজন মালদীব থেকে মাচুপিচু, সব জায়গায় গিয়ে ছবি তুলছেন, ফোটোশপ করছেন আর অন্যদের লোভ দেখাচ্ছেন। এইবার, এই ব্যাপারটা কাউন্টার করতে দেখছি অনেকেই ইন্সটাগ্রাম ভার্সেস রিয়ালিটি বলে কতগুলো রিল করে, তাতে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে আসলে যে জায়গাগুলো ইন্সটাতে এডিট করে সুন্দর দেখানোর চেষ্টা করা হয়, সেগুলো নিতান্তউ সাধারণ জায়গা, মোটেও অত সুন্দর না! খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে, ব্যাপারটা আঙুর ফল টক ছাড়া কিছুই নয়। হ্যাঁ, দশটার মধ্যে দুটো ছবি হয়তো এমনটা করে থাকতেই পারে, সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই, কিন্তু সার্বিকভাবে, ইন্সটাগ্রামে যে শহর বা দৃশ্য দেখে অসামান্য সুন্দর মনে হয়, চোখের সামনে সেই সমস্ত জায়গা এলে মনে হয়, ইন্সটাগ্রাম কোন ছার? জায়গাগুলো আসলে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি সুন্দর।

কথাটা উল্লেখ করতে হল, কারণ মরক্কোর চেফচাউয়েন এর কথা ইন্সটাগ্রামের সুবাদে এখন সারা দুনিয়ার লোক জানে, মরক্কোর এই নীল শহরে গিয়ে কায়দা করে ছবি তোলাচ্ছেন অনেকেই, কিন্তু জায়গাটার অবস্থান এবং সামগ্রিক সৌন্দর্য যে ঠিক কেমন, ঠিক কতটা সুন্দর, এত এত ছবি দেখেও আমার সেই সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। উত্তর মরক্কোর ল্যান্ডস্কেপ যে এমন সতেজ সবুজ এবং আলপ্সের সঙ্গে অনায়াসে তার তুলনা করা যায়, ফেজ থেকে চেফচাউয়েনের ঘন্টা পাঁচেকের বাস যাত্রা না করলে আমি জানতেও পারতাম না। এখানকার ভূদৃশ্য চমৎকার, একের পর এক বুনিয়াল, পুষ্পবতী গাছ, গ্লেশিয়াল লেক না হলেও স্বচ্ছ জলের অসংখ্য পাহাড়ি হ্রদ চোখে পড়ে। চেফচাউয়েন শহরটা আসলে পুরোপুরি হিল স্টেশন, প্রথমবার বাস হেয়ারপিন বেন্ড নেওয়ার পর শহরটা চোখে পড়ে যখন, সত্যিই বিশ্বাস হয় না পাহাড়ের আড়ালে এমন একটা রূপকথার রাজ্য লুকিয়ে আছে। 

যাই হোক, নীল সাদা রঙে ডুব মেরে বসে থাকা এই ছোট্ট গ্রামটা ঠিক কেমন দেখতে, সে নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করব না। এইটুকু অবশ্য জানানো যায় যে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মারিজুয়ানার চাষ হয়, (যদিও ব্যাতিক্রম কাউকে বিশেষ জয়েন্ট ফুঁকতে দেখলাম না), শহরে যত না মানুষ, তার চেয়ে বেশি বেড়ালের রাজত্ব, চতুর্দিকে গড়াগড়ি খেতে থাকা অজস্র কমলালেবু আর এই গ্রামের ইতিহাস আর স্থাপত্যের সঙ্গে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, বের্বের সহ আরো অনেক গোষ্ঠীর গল্প জড়িয়ে আছে। 

মরক্কোতে আমাদের শেষ সানসেট কাটল এই গ্রামেই। আসলে গ্রামে নয়, বরং সেখান থেকে একটা ঝরনা পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় অনেকটা উঠে গিয়ে একটা স্প্যানিশ মসজিদ কাম ভিউপয়েন্টে, চতুর্দিকে ঢেউখেলানো সবুজ পাহাড়ের সারি, আর সবুজ ঘাসের বন ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। সেই ঘাসের জমিতে শুয়েবসে আছে অনেকেই, আর সেখান থেকে চেফচাউয়েনের নীল সাদা গ্রামটা হ্যামলেটের মতোই দেখতে লাগছে। সূর্য প্রায় মধ্যগগনে, যখন আমরা সেই ঘাসের ওপর গিয়ে বসেছি। এরপর কয়েক যুগ ধরে সূর্যাস্ত এর পালা চলল, প্রকৃতির মঞ্চে আলোর খেলা সম্পন্ন হল। আমরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম, আর কীই বা করার আছে?

নীল গোলাপি বেগুনি রঙের আভা যখন ক্রমে অন্ধকারের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে আর নীল গ্রামে একটা একটা করে সাদা হলুদ আলো জ্বলে উঠছে, এমন সময় আচমকা, আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে, স্প্যানিশ মস্ক থেকে ভেসে এল আজানের সুর, আর যেন তার সঙ্গে সঙ্গত করতেই গ্রামের বিভিন্ন মসজিদ থেকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই একই ঈশ্বরবন্দনা, সেই একই আজান... সেই ঐশ্বরিক মুহুর্তে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা একদল মানুষের ক্যামেরা স্তব্ধ হয়ে গেল, লক্ষ করলাম অনেকে ফোন নামিয়ে রাখল, কেউ কেউ হাত ভাঁজ করে বুক স্পর্শ করল, কেউ চোখ বন্ধ করল, আকাশে রঙের আলপনা আর আঁধারময় বেগুনি আলোর আমেজ জুড়ে একটা  নীল আলো খেলে গেল, কোনো এক মসজিদ থেকে ফেলা ফ্লাডলাইট এর আলো... আজানের সুর আরস ফনা হয়ে যাওয়া দিনের আলো একে অপরের সঙ্গে মিশে এক নিজস্ব সিম্ফনি তৈরি করেছে... এই অপরূপ মুহুর্তের কোনও বর্ণনা করা যায় না... আর তখুনিই, ঠিক সেই মুহুর্তে, আমি আচমকা এক মুহুর্তের জন্য অনুভব করতে পারলাম, আমি হয়তো আজও পুরোপুরি নাস্তিক হতে পারিনি।