রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০

দ্য সাব্লাইম সুইটজারল্যান্ড (দ্বিতীয় পর্ব)

The Swiss Alps


কয়েক পাতা হতাশ কল্পগীতি, শেষ না হওয়া উল্টোপাল্টা কলম

অর্থ অবুঝ রেখার অনুরতি, জীবনটাও অনেকটা সেই রকম


~ম্যাক্স ফ্রিস্ক

এই লেখাটা কবিতা নয়। ম্যাক্স ফ্রিস্ক কস্মিনকালেও কবি নন। জার্মান সাহিত্যের এই নামজাদা ব্যক্তি সুইস দর্শনবিদ্, নাট্যকার এবং উপন্যাসকার রূপেই পরিচিত। কিন্তু তাঁর চরিত্রদের সংলাপের মধ্যেই একটা কাব্যিক দর্শন আছে। তিরিশের দশকে ফ্রিস্ক জুরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান সাহিত্য সংবাদকারিতায় যোগ দেন, তারপর কয়েক বছর ধরে ইউরোপ ঘুরে এসে সাংবাদিকতায় নাম লেখান। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কর্মসূত্রে ফ্রিস্কের মোলাকাত হয় নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে। ইউরোপের অনেক জায়গায় তাঁর বন্ধুবান্ধব ছিল, যুদ্ধের সময় তাঁদের  মানসিক অবস্থার কথা জানতে পেরেছিলেন ফ্রিস্ক। যুদ্ধ চলাকালীন এমন বহু জার্মান পদস্থ অফিসারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় যারা সরকারি আদেশে নিরুপায় হয়ে বহু নির্দোষ মানুষকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের অপরাধবোধ সারা জীবন ধরে তাদের তাড়া করে চলেছে। সেই সময়ে হিটলার বিরোধী মন্তব্যের মূল্য দিতে বহু জার্মান কবি, সাহিত্যিক চিরকালের জন্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। বেশ কিছু ইহুদি কবি আশ্রয় পেয়েছেন ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালিতে। অনেকে পাড়ি দিয়েছেন আমেরিকাতে। এদের নাম দেওয়া হয়েছে 'এক্সাইল পোয়েটস'। বিতাড়িত, নির্বাসিত এবং হতোদ্যম মানুষদের জীবন এবং পাশাপাশি টমাস মান, বেরটোল্ট ব্রেখট, নেলি সাক্স-এর মত কবি-সাহিত্যিকদের লেখা ফ্রিস্ককে ভাবিয়ে তুলেছিল সে সময়। 

এদের কথাই ফিরে ফিরে আসে ফ্রিস্কের লেখায়। যুদ্ধের পর প্রথমে নাটক, তারপর একসময়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা 'ডন জুয়ান', 'হোয়েন দি ওয়ার ওয়াস ওভার' এবং 'দি ফায়ারবাগস' নাটকের দুনিয়ার তুমুল সাড়া ফেলে। বাস্তব এবং স্বপ্নের ধোঁয়াশার মাঝেই ফ্রিস্ক অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতেন চরিত্রদের নৈতিক দ্বন্দের রেখাচিত্র। সুইটজারল্যান্ডে সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতেই দেখা হয়। ফলে রবার্ট ওয়ালসর, ফ্রাইডরিখ ডুরেনমাট আর হেরমান হাসের পাশাপাশি তাঁকে নিয়েও আলোচনা শুরু হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

সুইটজারল্যান্ডের পরিবেশ শিল্প সাধনার জন্যে শ্রেষ্ঠ জায়গা কি না, সে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এবং শান্তির পরিবেশে থাকলেই যে শিল্পীরা অসাধারণ কাজ করতে পারবেন, এই যুক্তির বিপক্ষে হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যায়। সমাজ ও দেশের সংকটকালেই সারা পৃথিবীতে বহু কালজয়ী শিল্পের রচনা হয়েছে, সেরা শিল্পীদের অনেকেই সারা জীবন প্রচন্ড কষ্টে কাটিয়েছেন। বহু শিল্পী ও সাহিত্যিক আর্থিক অবস্থার অবনতির ফলে অন্নকষ্ট পর্যন্ত ভোগ করেছেন। কিন্তু আবার এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে চিন্তামুক্ত জীবনে শিল্পীরা নিরন্তর কাজ করে যেতে পারেন, মনোনিবেশ করতে পারেন নিজ নিজ শিল্পক্ষেত্রে।

সুইটজারল্যান্ডের মত দেশ যে আধুনিক কালের শিল্পীদের আকৃষ্ট করবে সেটা খুবই স্বাভাবিক। বিংশ শতাব্দীর বহু মনীষী নিজের দেশ ছেড়ে এসে এখানে থিতু হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হেরম্যান হাস থেকে আধুনিক যুগের হেট্রা মুলার সকলেই আছেন। জাঁ জক রুসো, যিনি ফরাসি বিপ্লবের সমর্থনে সারা জীবন গলা ফাটিয়েছেনফরাসি দর্শন ও শিল্পে তাঁর যথেষ্ট অবদান আছে তিনিও কিন্তু সুইটজারল্যান্ড ছেড়ে ফ্রান্সে গিয়ে থাকেননি কোনোদিন। আধুনিক কালে 'ডায়াসপোরা' লেখকদের সাহিত্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। সারা পৃথিবী থেকে জনপ্রিয় সাহিত্যিকরা স্বদেশ ছেড়ে এসে থিতু হয়েছেন পশ্চিমের নানা দেশে। বিতর্ক এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার উর্ধ্বে অনেক শিল্পী স্বীকার করেছেন তাঁরা শুধুই শিল্পী, স্বদেশ ও বিদেশ তাঁদের কাছে সমান। একমাত্র শিল্পের প্রতিই তাদের দায়বদ্ধতা আছে, আর আছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের অনুরাগী এবং পাঠকদের প্রতি। সেই ক্ষেত্রে সুইটজারল্যান্ড যে তাঁদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কি? ভুলে গেলে চলবে না ইংরেজি সহ চারটি পৃথিবীর চারটি প্রধান ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এই দেশে।

সুইটজারল্যান্ডের টুরিস্ট বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে একটা ই-বুক পাওয়া গেছে, তাতে ফিলিপ জাকাতে, কোরিনা বল, এরিকা বুর্কার্ট, লুইসা ফামোস, কার্ল স্পিটার, ফেলিস ফিলিপিনি প্রভৃতি বহু কবিদের লেখার অংশ আছে। সাহিত্য জগতের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণও লেখা আছে। সেটা মুখে দিয়ে বসে আছি ট্রেনে। সুইস লেখকদের লেখা সম্পর্কে কিছুই জানি না, একমাত্র হেরমান হাস এর জনপ্রিয় বই 'সিদ্ধার্থ' আর 'স্টেপিনউল্ফ' ছাড়া প্রায় কিছুই পড়া নেই। বাইরে কিছুই দেখার নেই, কারণ ট্রেন চলছে টানেলের মধ্যে দিয়ে, অতঃপর বিনামূল্যে পাওয়া এই হ্যান্ডবুক থেকে জ্ঞান সংগ্রহ চলছে। 

আমার পথসঙ্গিনীও ব্যাজার মুখে হাতে মোবাইল নিয়ে বসে আছেন। মহা মুশকিলে পড়েছে ভদ্রমহিলা। কাল লাউটারব্রুনেনে গিয়ে এন্তার ছবি তুলেছেন, ফলে মোবাইলের মেমোরি একেবারে দু' হাত তুলে আত্মসমর্পণ করেছে। কয়েকটা ছবি ডিলিট না করলে আর চলছে না; অথচ কিছু ডিলিট করতে গেলেই হাত কেঁপে যাচ্ছে তার। এই ঘোর বিপদ সামলাতে দিদিমণি ব্যস্ত। চিন্তিতও। 

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য মোবাইল মুখে দিয়ে বসে থাকা গেল না। হুশ করে ট্রেনটা একসময় দিনের আলোয় বেরিয়ে এল, অমনি আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠলো জেনেভা হ্রদের ফিরোজা রঙের ম্যাজিক। 

আমরা আপাতত চলেছি সিঁলো দুর্গ(Chillon Castle) দেখতে। মনট্রাক্স শহরের বাইরেই লেক জেনেভার ধারে অবস্থিত এই দুর্গ দেখা ছাড়াও দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের একটা ধারণা পাওয়া যাবে বলে আমরা সফরের দ্বিতীয় দিন বেছে নিয়েছি এই জায়গা। লাউটারব্রূনানে প্রচুর দৌড়ঝাঁপ হয়েছে, একদিন অন্তত ধীরে সুস্থে বেড়ানোর জন্যে এই অঞ্চলের তুলনা হয় না। সকালবেলা ডানিয়েলার বোন অফিসে যাওয়ার সময় আমাদের গ্রাম থেকে ভিস্প অব্দি গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে, সেখান থেকে মনট্রাক্স এর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছি আমরা।

ট্রেন চলেছে রোন নদীর পাহাড়ি উপত্যকা ছাড়িয়ে। বাঁদিকে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত জেনেভা হ্রদের জল, ডানদিকে পাহাড় ধাপে ধাপে আরো ওপরে উঠে গেছে। এই দেশে চাষের উপযুক্ত জমি নেই, সেই জন্যেই মনে হয় পাহাড়ের ধাপে ধাপে ফসল ফলানোর চেষ্টা হয়েছে। ট্রেন মাঝে মাঝে এক একটা সেতুর ওপর পড়ছে, অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে মনট্রাক্স শহর। আরো মিনিট কুড়ি পর মনট্রাক্সে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে বাস নিয়ে চললাম সিঁলো দুর্গের দিকে। 

মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। আকারে খুব বিশাল না হলেও দুর্গটির অবস্থান এককথায় অসামান্য। হ্রদের জলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দুর্গের মাথার নেপথ্যে উঁচু পাহাড়ের চূড়াগুলো এখন শ্যামল-সবুজ রঙে রাঙা। বছরের অনেকটা সময় এই চূড়াগুলো তুষারশুভ্র হয়ে থাকে, তখন সেখান থেকে চোখ ফেরানো যায় না। এই দুর্গের নির্মাণ করা হয়েছিল রোমান যুগে, প্রায় দু হাজার বছর আগে। হ্রদের জলের ওপর একটি ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত এই দুর্গ এককালে সেভয় কাউন্টদের বিলাসপ্রাসাদ ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে জায়গাটা একাধারে কয়েদখানা এবং অস্ত্রাগার রূপে ব্যবহৃত হতে থাকে। আধুনিক কালে ইউরোপের জনপ্রিয় ঐতিহাসিক দুর্গের মধ্যে সিঁলো দুর্গ অন্যতম। 

ইউরোপের আর চারটে ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যের মতনই যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে দুর্গের আসবাব-পত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের মন বার বার চলে যাচ্ছে দুর্গের পাথুরে জানলার বাইরের ফিরোজা নীল জলরাশির দিকে। ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে বেরিয়ে পড়লাম। দুর্গের বাইরেই একটা উদ্যান আছে, সেই উদ্যান দিয়ে হেঁটে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে আছি, এমন সময় খেয়াল করলাম কাছেই একটা জেটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল বড় বড় যাত্রীবাহী জাহাজ এখান থেকে যাত্রীদের বেড়াতে নিয়ে যায় লুজান(Lausanne) অব্দি। প্রায় দেড় ঘন্টার জলসফরে সুইস পাস থাকলে  কোনও  টিকিট কাটতে হয় না। শুনেই চাহনি বিনিময় হল। আমাদের চোখের ভাষায় একই কথা। মার দিয়া কেল্লা! এ যে মেঘ না চাইতেই জল! এই সুযোগ হারানোর  কোনও  মানেই হয় না।  হাতে সময়ও আছে। চলো দিল্লি থুড়ি লুজান। 

মিনিট তিরিশ পরেই ধপধপে সাদা রঙের বিশাল এক জাহাজ জেটিতে এসে দাঁড়াল। যাত্রীবাহী জাহাজই বটে, কিন্তু ব্যবস্থার কোনও খামতি নেই। ফার্স্ট ক্লাসে নিজস্ব ডেক আছে রোদ পোয়ানোর জন্যে, ক্যাফেটেরিয়া, ড্রিংক কাউন্টার সবই যথাযথ। জাহাজের ইউনিফর্ম পরিহিত কর্মচারীদের পাস দেখিয়ে সেকেন্ড ক্লাসের ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোঁ দিয়ে জাহাজ চলতে শুরু করল হ্রদের জল কেটে।

ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। হু হু করে হাওয়া এসে চুল এলমেলো করে দিচ্ছে। মনট্রাক্স শহর ছাড়িয়ে গেছে জাহাজ। দূরের সবুজ পাহাড়গুলো রোদে আবছা মনে হচ্ছে, কিন্তু একেকবার কালো মেঘ এসে পড়তেই সবুজের রঙ সতেজ হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট শহর। রঙিন বাড়িঘর, গির্জা। জেটির ধরে ছেলেময়ে নৌকো চালাচ্ছে, জলে দাপাদাপি করছে। কিছুক্ষণের জন্যে জাহাজ দাঁড়িয়ে পড়ে, আবার চলতে শুরু করে। এই হ্রদের ধার দিয়ে চলতে থাকলেই সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় জেনেভা, প্রায় ঘন্টা তিনেক লাগে। এই জাহাজ লুজান শুধু অব্দি যাবে, সেখান থেকে আমরা ট্রেন ধরব ভিস্পের জন্যে। 

জলসফরের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। সিগাল ও যাত্রীদের দ্বৈত কলরব শুনতে শুনতে, হাতের দু' পিঠে রোদ খেলাতে খেলাতে, স্বপ্ন আর বাস্তবের দাঁড়িপাল্লা ওজন করতে করতেই সাক্ষী হয়ে রইলাম রঙবেরংয়ের জলছবির। নদীকেন্দ্রিক মানবসভ্যতার কম্পমান আকৃতি ভেসে উঠেছে জলে, যেন নাগরাজার প্রাসাদ। ডুব দিয়ে চলে যাওয়া যায়। 

লুজান অঞ্চলে ফরাসি ভাষা চললেও দেশের অন্যান্য সব জায়গার ন্যায় এখানেও সমস্ত দোকান, স্টেশনের নাম চারটে ভাষায় লেখা। লুজান বেশ বড় জায়গা, বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন তো আছেই, কাছেই জুরা পর্বতমালার অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখতেও দর্শনার্থীরা আসে। ওয়ার্ল্ড ওলম্পিক কমিটির প্রধান দপ্তরও লুজানেই অবস্থিত, সেই সুত্রে সারা বছর একটা না একটা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।

লুজান থেকে ট্রেনে করে ভিস্পে যাওয়ার সময়ে কালকের পরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। জেনেগেন গ্রামটার ওপর এই তিনদিনে আমাদের মায়া পড়ে গেছে, বিকেলের পর সেখানকার পরিবেশ এমন সুন্দর হয়ে যায় যে আমরা বালকনিতেই বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। ডানিয়েলার আন্তরিক ব্যবহারে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে এই পোস্টকার্ড গ্রামে আমাদের থাকার মেয়াদ মাত্র তিন দিন। কিন্তু এই মায়া কাটানোর সময়ও উপস্থিত। কালকেই আমরা দানিয়েলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাব লুক্রিনে, অনেকে অবশ্য লুজার্নও বলে। লুজার্ন যাওয়ার আগে একবার জেরম্যাট ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু রুকস্যাক পিঠে করে সেখানে যাওয়া চলবে না। অতএব ডানিয়েলার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছি সকালে গোছগাছ করে বেরিয়ে ভিস্প স্টেশনের স্টোরেজে জিনিসপত্র রেখে আমরা জেরম্যাট চলে যাব ট্রেনে করে। সেখান থেকে ফিরে এসে রুকস্যাক নিয়ে আবার ট্রেনে করে বার্ন, সেখান থেকে লুজার্ন। লুজার্নে আমাদের হস্টেল বুক করা আছে, সেখানে জিনিসপত্র রেখে দেওয়া যাবে। বিকেলে আবার ট্রেন ধরে চলে যাব জুরিকে, সেখানে আমার বন্ধু সিদ্ধার্থ বেশ কয়েক বছর ধরে আছে। আমরা সুইটজারল্যান্ডে এসেছি শুনে সে আমাদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে জুরিকে তার বাড়িতে। সিদ্ধার্থের বাড়ি থেকে রাতে আবার লুজার্ন ফেরা। অর্থাৎ ট্রেনে করে একদিনে সারা দেশটাই আমরা চষে ফেলছি কাল। জ্যামপ্যাকড প্ল্যান। 

সন্ধ্যের আগেই জেনেগেনে ফিরে এলাম। সন্ধ্যের আকাশের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা মন খারাপ হয়ে গেল। ডানিয়েলারাও জানে কাল আমরা চলে যাব, আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গল্প হল ডানিয়েলা ও পিটারের। ডানিয়েলার তিন ছেলে এখনও স্কুলে পড়ছে। সুইটজারল্যান্ডে ফার্মাসুটিকাল্স-এর চাহিদা আছে, বড় ছেলের ফার্মা নিয়ে পড়বে ঠিক করেছে। মেজ ছেলে আবার কাঠের কাজ তৈরি করতে ভালোবাসে। কাঠ কেটে নানান ধরনের বসার জায়গা তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছে। ডানিয়েলা ও পিটার দুজনেরই ভারতে আসার খুব ইচ্ছে, আল্পসের সঙ্গে হিমালয়ের পার্থক্যর কথা জানাতে তারা বেশ আগ্রহী হয়ে পড়ল। অনেক রাত অব্দি আমরা গল্প করেছিলাম সেদিন।

পরদিন সকাল সকাল ডানিয়েলাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাসে করে ভিস্পে এসে পাঁচ সুইস ফ্রাঁ দিয়ে লোহার সিন্দুকে রুকস্যাক রেখে জেরম্যাটগামী মিটার গেজের ট্রেনে উঠে পড়লাম। পর্বতারোহীদের পছন্দের বেস বলে সারা পৃথিবী থেকে অভিযাত্রীরা ম্যাটারহর্ন শৃঙ্গে ওঠবার জন্যে জেরম্যাটে জড় হয়। সুইটজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে যে কোনও পাহাড়ে দিনের পর দিন ক্যাম্প করা যায়। সাধারণ পথচারীদের জন্যে সহজ পাহাড়ি পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেই হাইকিং ট্রেল ধরে অনেকেই দীর্ঘদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আরো কঠিন ট্রেলগুলো ট্রেকিং রুট। যারা আরো গভীরে চলে যেতে চান অপেক্ষাকৃত কঠিন সেই ট্রেকিংয়ের পথ ধরে এগিয়ে চলে। তারপর প্রশিক্ষিত পর্বতারোহীদের জন্যে ক্লাইম্বিং রুট তো থাকেই। সব ট্রেলেই ক্যাম্প করার জন্যে কাঠের ছোট ছোট টুকরো কেটে ডাঁই করে রাখা হয় নির্দিষ্ট জায়গায়, সেখানে যে কেউ তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস করতে পারে। এই পয়েন্টগুলো থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাহাড় আর উপত্যকার অসাধারণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। বিশেষ করে সুইটজারল্যান্ডের মতো 'হাইকিং ফ্রেন্ডলি' দেশ আমি আর একটাও দেখিনি।

জেরম্যাটের ট্রেন লাইনের দু'ধারেও এই ধরনের অজস্র দৃশ্য ছড়িয়ে রয়েছে। প্রথম প্রথম আমাদের চমক লাগত, আজকাল এই মন ভালো করা সবুজ বন-পাহাড়ের দেশে আমরা মানিয়ে নিয়েছি। কোথাও পাহাড়ি ঝোরার উদ্দাম জলধারা সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ট্রেনের সামনে, কোথাও বরফ ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেছে প্রাচীন কাঠের সেতু। লালচে-বেগুনি-হলুদ ফুলে ঝোপগুলো রঙিন হয়ে আছে আর পাথুরে জমিতে মখমলের মত কাশ্মীরি পশমের শাল বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকো নদীর ধারে, সঙ্গে রাখো এক ঝুড়ি কমলালেবু। মনে মনে বোনো পশমিনা সুতোর শাল। আদর বিছানো ঘাসফুলের গালচেতে শুয়ে কল্পনা করো ছায়াপথ। ব্যস, জীবন কেটে যাবে।

এক ঘন্টার রাস্তা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে জেরম্যাট থেকেই ম্যাটারহর্ন শৃঙ্গের শিংয়ের মত আকৃতি দেখা যায়, কিন্তু আজকে আবহাওয়া মেঘলা। সেই সুযোগ নেই। জেরম্যাটে নেমে স্টেশনের বাইরে আসতেই আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মনে হল, দু'খানা ডানা পেয়েছি। কেউ ভালোবাসার আলপনা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে এই মফস্বলের পথ, আমারই অপেক্ষায়। এখান থেকে আম ফিরব কী করে? ফেরা সম্ভব? এই অভিভূত আচ্ছন্নদশার একমাত্র কারণ আমার পাহাড়প্রীতি। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর নেশা যাদের আছে, তাদের কাছে জেরম্যাট স্বপ্নের জায়গা। 

চড়ুইপাখি টাউন। গ্রামও বলা চলে। চারিদিকে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘিরে থাকা সবুজ-হলুদ উঁচুনিচু পাথুরে রাস্তা আনমনে ঘুরেফিরে পাহাড়ের বুকে হারিয়ে গিয়েছে। সামনেই মাউন্টেন রেল স্টেশন। চল্লিশ ডিগ্রী কৌনিক রেখায় এই রেল সোজা পাহাড়ে উঠে গেছে ম্যাটারহর্ন পর্যন্ত। বহু দূর-দূরান্তরের পাহাড়েও এই ট্রেনে করে চলে যাওয়া হয়। এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন, কারণ ভারতে এই ধরনের কোনও  ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ি টয়ট্রেন বলতে আমরা যা বুঝি, সেই ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠা আর জনপ্রিয় হিল স্টেশনে নেমে যাওয়া নয়, এই ট্রেনে করে মিনিট কুড়ির মধ্যেই জনহীন পাহাড়ের বুকে বরফের রাজ্যে চলে যাওয়া যায়। সেখানে মানুষের বসতি নেই, কোলাহল নেই, শুধু আল্পসের শান্ত প্রকৃতি যাত্রীদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। আর আছে অসংখ্য হাইকিং রুট। পুরো আল্পস তোমার জন্য খোলা। কতদূর যেতে চাও?

জেরম্যাটে একটাই রাস্তা, সেখানে আর চারটে শহরের মতোই জমকালো দোকানপাট, কফিশপ, ক্যাফেটেরিয়া। মাউন্টেন গিয়ার আর সাইকেল ভাড়া করা যায় ইচ্ছে হলে। কিন্তু একটা জিনিসের ভীষণ অভাব, সেটা হল শব্দ। হই-হট্টগোল, শব্দ দূষণ তো অনেক দূরের কথা। অসীম, অমোঘ নীরবতা বিরাজ করে থাকে। শুধু পাখি ডাকে। মেঘ ডাকে। পাহাড়ও ডাকে। এই অলীক নিস্তব্ধতার কারণ আর কিছুই নয়, জেরম্যাটে যে  কোনও  ধরনের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। সেই জন্যে বাস, কার, বাইক কিছুই চলে না। কয়েকটা ব্যাটারিচালিত নিঃশব্দ গাড়ি আছে বটে, তাদের সংখ্যাও হাতে গোনা। শব্দদূষণ করবে, এরকম যন্ত্রপাতিও নিষিদ্ধ। এখানকার মানুষজনও কথায় কথায় গলা তোলে না, ফলে প্রকৃতির প্রত্যেকটা নিশ্বাস এখানে জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাখিদের কলকাকলি শোনা যায় স্পষ্ট। নদীর জলের শব্দ কানে এসে লাগে।

এরকম জায়গায় এলে হুহু করে কেটে যায় সময়। স্মৃতিতে কয়েক কাপ কফি আর মিষ্টি বাতাসের গন্ধ ধরা থাকে, ডায়রিতে লেগে থাকে কুচি কুচি বরফের গুঁড়ো। এক একটা অপরিচিত মুখও হয়তো অবচেতনে অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির মত লুকিয়ে পড়ে। স্টোরিবোর্ড-এর কিছু অগোছালো, এলোমেলো ব্লক ডিজাইনও সঙ্গ নেয়। বাকি দৃশ্যগুলো প্রগাড় অপেক্ষার সুতো নিয়ে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক পাটি ভবঘুরে জুতোদের পথের ঠিকানা বলে দিতে হয়…কিন্তু আমাদের তো ফিরতেই হবে! ফেরা! মাঝে মাঝে এই শব্দটা এত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে কেন? 

জেরম্যাট থেকে ভিস্প ফিরে তল্পিতল্পা নিয়ে দু'বার ট্রেন বদলে লুজার্নে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল চারটে হয়ে গেল। লুজার্ন সুইটজারল্যান্ডের প্রধান শহরের একটি, মেট্রোপলিটান শহরের সব বিশেষত্বই আছে সুইস মেজাজের মোড়কে। এখন বেশি কিছু দেখার সময় নেই, হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠে বেলপার্ক হস্টেলে পৌঁছে গেলাম। কয়েকজন কোরিয়ান ছেলেমেয়ে এই হস্টেলটি চালায়, বেশিরভাগই এশীয় বংশোদ্ভুত। অন্যান্য ইউরোপিয়ান হস্টেলের মতন খোলামেলা আন্তরিক পরিবেশের কিঞ্চিত অভাব মনে হল। আমাদের একদিনের মেয়াদ, অত ভেবে কী করব? কফিমেশিন খুলে এক কাপ কফি খেয়ে ব্যাগ রেখেই আবার পথে। সিদ্ধার্থের কথামতো সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরে জুরিকে গিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে, আমাদের সঙ্গে অফিস ফিরতি সেখানেই দেখা করে নেবে সে।

সুইটজারল্যান্ডের ট্রেন ব্যবস্থার হাল হকিকত এর মধ্যে জানা হয়ে গেছে। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া  কোনও  ব্যাপারই নয়। অনেকেই প্রতিদিন দেশের এক প্রান্ত থেকে দেশের অন্য প্রান্তে চাকরি করতে যায়, ট্রেনের সময়টুকু ল্যাপটপ দেখে অথবা বই পড়ে কাটিয়ে দেয়। সিদ্ধার্থের অফিস বাসেলে, রোজ জুরিক থেকে বাসেল আসা যাওয়া করতে হয় তাকে। 

সিদ্ধার্থের সঙ্গে আমার পরিচয় তিন বছর আগে ঋষিকেশ-এ। আমি তখন উত্তরকাশী যাচ্ছি পর্বতারোহণ শিখতে, ঋষিকেশ-এর হস্টেলে আচমকা তার সঙ্গে আমার আলাপ। আমার চেয়ে বছর কয়েক বড়ই হবে, কিন্তু আলাপ থেকে বন্ধুত্ব গড়াতে বয়সটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সেই সময়ে সে জুরিকে একটা হিয়ারিং এইড কোম্পানির রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার ছিল, পরিকল্পনা করছিল টানা বারো মাস ছুটি নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করার। সেই সূত্রেই আমাদের পরিচিতি। এর পর কোনোদিন দেখা না হলেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ রয়ে গেছে, বন্ধুত্বতেও মরচে ধরেনি। কিন্তু সুদূর জুরিখে এসে যে একদিন আমার সঙ্গে তার দেখা হবে, সেটা আমরা কেউই ভাবিনি। জুরিক স্টেশনে তিন বছর পর সিদ্ধার্থকে দেখে মনে হল সে একদম একই রকম রয়ে গেছে।  বিহারের ছেলে, ইংরেজি ছাড়াও চোস্ত জার্মান বলতে পারে। কিন্তু আমাদের দেখেই খাঁটি ভারতীয় হিন্দিতে কথা শুরু করে দিল সে। ইতিমধ্যে তার বিয়ে হয়েছে একতা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে, সম্প্রতি একটি মেয়েও হয়েছে। আমাদের নিয়ে সে চলল তার বাড়িতে। 

লোকাল ট্রেনে করে সিদ্ধার্থের বাড়ি যেতে যেতে কথা হতে লাগল। আমার  সঙ্গিনী যথারীতি সিদ্ধার্থের কাছ থেকে জার্মান ভাষা সম্পর্কে জেনে নিচ্ছে। এক ফাঁকে জিগ্গেস করলাম, "তুমি বাড়ি কিনলে বুঝি?" সিদ্ধার্থ হেসে বলল," নেহি ইয়ার। ভাড়াবাড়িই, কিন্তু খুঁজে খুঁজে নিরিবিলি জায়গা বেছেছি। পিছন দিয়ে একটা নদী চলে গেছে ঘন জঙ্গলে। লোকজন খুব কম।" আমি হেসেও বললাম, "এখানে আবার  কোন  জায়গায় লোকজন বেশি আছে? বেশিরভাগ জায়গায় তো কেউ চোখেই পড়ে না।" সিদ্ধার্থ মাথা নেড়ে বলল, "তা বটে। কিন্তু জুরিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র বলে শহরে প্রচুর লোকজন থাকে। অবশ্য আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা চলে না। আমার স্ত্রী একতাও দিল্লিতে থাকত, প্রথম দিকে এখানকার নির্জন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অসুবিধেই হয়েছে।"

সত্যিই সিদ্ধার্থের পাড়াটা শান্ত। গাছ থেকে ফুল পড়ে আছে মাটিতে, পাখি ডাকছে। তিরিশ চল্লিশ বছর আগে  কোনো  কোনো নিঝুম মফস্বলে এরকম কিছু ঘুমপাড়ানি বিকেল আর সন্ধ্যে পাওয়া যেত, দোতালা খড়ের চালা আর নীল হাওয়া সঙ্গে নিয়ে বিভূতিভূষণের গল্প থেকে উঠে আসা কিছু গ্রাম বেঁচেছিল এই সেদিন পর্যন্তও। উন্নয়নের ঠেলায় আজকাল আমাদের দেশে সেই সব চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে। এই দূর দেশে এসে সেই জায়গাগুলো স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

সিদ্ধার্থের স্ত্রী একতাও বেশ হাসিখুশি। হিন্দিতে কথা বলার মানুষ পাওয়া যায় না, আমাদের পেয়ে সে অনেক কথা বলে যেতে লাগল। কথার মাঝে একতার হাতে তৈরি খাস সুইস খাবার 'রাকলেট' খাওয়া হল। চিজ আর আলু দিয়ে বেক করা এই রান্না এখানে জনপ্রিয়। 

রাতের খাবারের আয়োজনও লোভনীয়। ভাত রুটি সহ বেশ কয়েকটা ভারতীয় পদ রান্না করেছে একতা। পশ্চিমী খাবার খেয়ে খেয়ে, বিশেষ করে ম্যাকডোনাল্ড-এর সস্তা বার্গার চিবিয়ে আমাদের মুখ মরে গিয়েছিল, অনেকদিন পর ভারতীয় রান্না পেয়ে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া  হল। 

বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমাদের লুজার্ন ফিরতে হবে। সিদ্ধার্থও ছেলেকে চেস্ট ক্যারিয়ারে বসিয়ে নিয়ে চলল, একতাও চলল আমাদের বিদায় জানাতে। দূরে জুরিক শহরের আলো দেখা যাচ্ছে। একতা কথায় কথায় বলল, "বাচ্চা ছেলেকে একদম ছোটবেলা থেকে রোজ বাইরে না নিয়ে বেরোলে এখানে প্রচন্ড বকাবকি করে। প্রথম দিকে ছেলেকে দেখতে সরকারি দপ্তর থেকে একজন এসেছিল, তখন বাচ্চাটা পনেরো দিনের। শীতকাল। বাইরে বরফে ছেয়ে আছে। এসেই সেই মেয়ে জানতে চাইল ছেলেকে নিয়মিত বাইরে নিয়ে যাচ্ছি কি না? আমি তো অবাক! এত বরফে ওইটুকু বাচ্চাকে বাইরে নিয়ে যাব কী করে? ইনিয়েবিনিয়ে ঠান্ডার কথা জানাতে সে আমাদের প্রচন্ড বকাবকি করতে লাগল। ঠান্ডা, গরম, রোদ, বৃষ্টি যাই হোক, বাচ্চা যাতে বাড়ির ভিতর না থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে ভালো ভাবে সম্পর্ক না হলে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি হয় না বলে এখানে দেখবে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও সাইকেল নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরছে মা বাবার সঙ্গে, সাঁতার কাটছে। আমাদের দেশে এরকম ভাবাই যায় না।"

হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধার্থ বলল, "চলো, তোমাদের একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাব।" নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা  উঁচু মতো জায়গায় পৌঁছে গেলাম। জুতো খুলে ভিতরে গিয়ে দেখি তাজ্জব ব্যাপার! হুবহু দক্ষিণ ভারতের কায়দায় তামিলনাডুর মন্দির নির্মাণ করে ফেলেছে। খালি গায়ে সাদা ধুতি পরে তামিল ব্রাহ্মণরা ঘোরাঘুরি করছে, দেখে মনে হয় ভারতেই চলে এসেছি। আমার মুখ দেখে সিদ্ধার্থ মুচকি হেসে বলল, "আসলে শ্রীলংকাতে তামিল লিবেরাশন ফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের যে যুদ্ধ চলেছে, সেই সময়ে বহু তামিল ইম্মিগ্রেন্ট এই দেশে আশ্রয় পেয়েছিল। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের আগেও বহু মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে এসেছে, আগে অত কড়াকড়িও ছিল না। এই অঞ্চলে বহু তামিল আছে, তারাই এই মন্দির বানিয়ে চালাচ্ছে।"

গল্প করতে করতে স্টেশনে এসে পড়লাম। বিদায় জানানোর সময় বার বার করে বললাম দেশে গেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। গাড়িতে উঠে সিদ্ধার্থ আর একতার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে গাড়ি ছেড়ে দিল। দেশের পথে যেই বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, বিদেশের পথে আবার তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আবার ক'বে দেখা হবে কে জানে? 

এই ঘন্টা তিনেকের আড্ডা, গল্প, পুরোনো স্মৃতি ফিরে দেখা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা, এগিয়ে চলা নতুন দেশের পথে— এই সব ভালোবাসার মুহুর্তগুলোই ছাড়া আমাদের সঞ্চয় বলতে আর কিছুই তো নেই। 


ক্রমশঃ
পরের পর্ব এখানে পড়ুন

আগের পর্ব এখানে পড়ুন
সুইটজারল্যান্ড-প্রথম পর্ব

যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 
যাত্রা শুরু-মাদ্রিদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন