মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩

এক থি ক্যাটারিনা

 


কমিউনিস্ট রাশিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যতটা আগ্রহ বা জ্ঞান, অষ্টদশ শতাব্দী বা তার আগের রাশিয়া নিয়ে ততোটা আগ্রহ চোখে পড়ে না। অথচ একটু চোখ বোলালে বোঝা যায়, রাশিয়ার ইতিহাস দারুণ মজাদার। মজাদারই বলা উচিত, কারণ যুদ্ধ-বিগ্রহ-খুনোখুনি-প্রতিশোধ বাদেও জারশাহির ইতিহাসের কেমন একটা নির্বোধ চরিত্র আছে, তাকে খুব একটা কুচুটে বলা যায় না। আরো একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এর প্রধান কারণ হল, রাশিয়ার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি। ওরেব্বাস! কী বিশাল দেশ রে ভাই! সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে খানিকটা এগোতে না এগোতেই গোটা ইউরোপের দূরত্ব কভার হয়ে যাবে, উরালের পার্বত্য অঞ্চল আর সাইবেরিয়ার জনশুন্য বনাঞ্চলেই তিন চারটে ভারতবর্ষ ঢুকে যাবে। এই বিশাল জায়গা জুড়ে লোকবসতি প্রায় নেইই, উরালে তো পাঁচশো বছর আগেও কেউ থাকত কিনা সন্দেহ। থাকবে কী করে? শীতে মাইনাস সত্তর, গরমে প্লাস চল্লিশ! কার মাথা খারাপ হয়েছে? এখানে কাউকে ছেড়ে দিলে হয় পটলপ্রাপ্তি ঘটত, নয় মানুষ নিজেই জানোয়ার হয় শিকার করে কাঁচা মাংস খেতে শুরু করত। ইয়ার্কি নয়, এরকম ঘটনার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। কিছু দুর্দান্ত শিকারী গোষ্ঠী বা কয়েদি ছাড়া এখানে কেউই থাকেনি কোনোদিন, এখনও খুব কম মানুষই থাকে। ভূতপ্রেত তন্ত্র মন্ত্র সব বহাল তবিয়তে আছে। বাংলা অলৌকিক সাহিত্য অনুবাদ করে সাইবেরিয়ায় পাঠালে রাদুগা প্রকাশনের মতো উল্টো বিপ্লব হতে পারে!

মস্কো থেকে ব্লাদিবাস্তক মানে সেই উত্তর কোরিয়ার বর্ডার যেতেই ট্রেনে ছ দিন লাগবে, সে আবার পুরো অন্য দুনিয়া। চারশো বছর আগে যে ব্যাটাচ্ছেলে ব্লাদিবস্তকে থাকত, মস্কো বা উরালের খবর জানার কোনো উপায়ই তাদের কাছে ছিল না। যে সাইবেরিয়ায় থাকবে, সে ফিনল্যান্ডের কাছাকাছি ব্ল্যাক সি লাগোয়া রাশান শহরের কথা থোড়াই না জানবে? এমতাবস্থায় 'দেশ'--এর কোনো ধারণা কি সম্ভব? কে তাদের রাজনীতির পাঠ দেবে? কে বন্ধুর পিঠে ছুরি চালাতে শেখাবে? 

আর মার্ক্সবাদী বিপ্লব? ওরেবাবা! সে আবার কোন চিড়িয়ার নাম? কোথায় ব্ল্যাক সি, কোথায় সাইবেরিয়া, কোথায় লাপ্টেভ সাগর, কোথায় কামচাটস্কা, কোথায় মস্কো? সকলে অন্য দুনিয়ার মানুষ, আরামসে এলিয়েন বলা চলে! যেখানে কারো সঙ্গে কারো কমিউনিকেশনই নেই, কারো কাছে কোনো খবরই নেই, সেখানে বিপ্লবের পরিকল্পনাটাই বা করবে কে? আর করবেই বা কেন? কোথায় কে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ছাপিয়েছে, সেসব পড়তে যাচ্ছে কে? আবার সর্বহারাদের বিপ্লব? কে জার কে মার্ক্স কে বোলশেভিক... বয়ে গেছে লোকের জানতে! হরিণ শিকার করতে পারলেই তারা খুশি! ঘাসকাটা হলেই আগুন জ্বালানোর আর রাতের উৎসবের বন্দোবস্ত পাক্কা।

তবু কিনা শেষমেশ এই দেশে বিপ্লব হল! আর সেই বিপ্লব গোটা দুনিয়াকে প্রভাবিতও করল। কী করে এই অসাধ্যসাধন ঘটল? ভাইকিং রুশ প্রজাতি আর শমনদের তন্ত্রমন্ত্র থেকে শুরু করে জার শাসন, পিটার দ্য টেরিবল আর পিটার দ্য গ্রেটের গল্প, ক্রিশ্চান, মঙ্গোল, মুসলমানদের সঙ্গে রেষারেষি করা থেকে গোগোল আর পুশকিনের উদ্ভব...তারপর রাশিয়ান বিপ্লব! বলতে পারলে দারুণ মজার গল্প হয়! এই নিয়ে একটা বই পড়তেই প্রথমে একটা দারুণ কিসসা জানা গেল। সংক্ষেপে বলে রাখি। 

রুস শব্দের ট্রাডিশনাল মানে হল 'রো', মানে যে নৌকা চালিয়ে আসে। সন ৮৬২ সালে ভাইকিং সর্দার রুরিক দুই ভাইকে নিয়ে নৌকা চালিয়ে নাভগ্রাদ পৌঁছাতেই স্থানীয় বাসিন্দারা বলল, "তোমাদের দেখে তো বেশ তাগড়া মনে হচ্ছে। আমরা বহুদিন ধরে এখানে সুখে বাস করছি কিন্তু আমাদের গায়ে বেশি জোর নেই। তোমরা দেখছি পালোয়ান লোক, আমাদের রাজা হয়ে রাজত্ব করতে পারছ না?"

রুরিক মাথা চুলকে রাজি হয়ে গেল। এই থেকেই রুশ দেশের সূত্রপাত, যদিও এদের মূল নিবাসী ছিল স্লাভিক। রুরিক সহ অন্যান্য ভাইকিংরা এখানে এসে নিজ নিজ সংস্কৃতি এনেছিল ঠিকই, কিন্তু ধর্ম নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। তখন স্লাভ জাতির লোকজন মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী। পেগানিজম তলানির দিকে, ইসলাম আর ক্রিশ্চানরা রেষারেষি করছে। সে যাই হোক, রুরিক বংশ শুরু হওয়ার চার দশক পরেই রানি ওল্গা কন্সটানটিন মানে ইস্তাম্বুল ঘুরতে গিয়ে প্রায় ক্রিশ্চান হয়ে ফিরে এল। সবাই শুনল, এ এক নতুন ধর্মের আমদানি হয়েছে বুঝি! সে হোক, বাইজান্টিন সাম্রাজ্য মনেপ্রাণে চাইত রুশিরা ক্রিশ্চান হয়ে যাক। মুসলমানদের সঙ্গে ধর্মযুদ্ধ করতে হলে তারা এতে বেশে আপারহ্যান্ড পাবে। কিন্তু সে সময় রুশের রাজা ব্লাদিমির মার যুদ্ধ করে সবাইকে কচুকাটা করছেন, তার শরীরে ভাইকিং রক্ত, কথা বলার আগেই না গলা কেটে ফেলে! তাকে ধর্মান্তরিত করবে কার সাধ্য! এমন সময় একদিন ব্লাদিমির বেডরুমে বসে হাড় চিবুচ্ছেন, পুরাতন ভৃত্য এসে বলল, "শুনেছেন তো!"

'''কী?" ব্লাদিমির অবাক।

"আরে কন্সানটিনের প্রাসাদে এক রয়াল ব্লু সুইট আছে। সেখানে এক পরমাসুন্দরী রাজকন্যা থাকে। ক্যাটারিনা ক্যায়েফ ফেল! কেউ ওকে দেখতে পায় না।"

"ক্যানে রে ভাই? দেখতে পায় না কেনে?" ব্লাদিমিরের হাড় চিবোনো থেমে গেছে। 

ভৃত্য গালে হাত দিয়ে বলল, 'কে জানে? শুনি রাজকন্যা তাঁর সলমান খানের জন্য অপেক্ষা করে আছে!"

আর যায় কোথায়, ব্লাদিমিরের ঘুম চটকে গেল। ঠিক করলেন, বাইজান্টিন সাম্রাজ্য আক্রমণ করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কয়েক মাসের মধ্যেও লুটপাট করে হারেরে করতে করতে ঢুকে পড়লেন সেখানে, একের পর এক শহর ধুলোয় মিশে যেতে লাগল। অবশেষে ক্রিমিয়ার কাছে যখন পৌঁছেছেন, বাইজান্টিনের রাজা বেসিল দ্বিতীয় সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে হাজির হলেন।

ব্লাদিমির হাই তুলে বললেন, "সে আমি চলে যেতেই পারি। এমনকি আরবরা তোমাদের ভড়কি দিলে আমিই না হয় গিয়ে তাদের নাক কেটে আসব। কিন্তু তোমার বোন ক্যাট থুড়ি অ্যানা যে ব্লু সুইটে থাকে, ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে হবে।"

বেসিল রাজা বললেন, "সে বেশ কথা। কিন্তু ও মেয়ে ঠিক করেছে ক্রিশ্চান না হলে বেটি বিয়েই করবে না।"

ব্লাদিমির ভেবে বললেন, "সে ঠিক আছে। আমার দিদা নিজেই ক্রিশ্চান হওয়ার জন্য পাগল ছিল। আমাকে অবশ্য কারা যেন মুসলমান হতেও প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তাতে নাকি হুইস্কি রাম কিছুই খাওয়া যাবে না। তাই হাঁকিয়ে দিয়েছি। পাগল নাকি? রুশিরা ওসব না খেয়ে বাঁচে? তোমাদের ধর্মেও ওসব বারণ নাকি?"

"মাথা খারাপ? আপনি বরং হাগিয়া সোফিয়া এসে আমাদের বিশেষ পানীয় চেখে দেখুন, শহরের শোভা দেখুন! পছন্দ হলে সিদ্ধান্ত নেবেন!"

ব্লাদিমির বললেন, "বেশ। আমি কথা দিচ্ছি, আমার ভালো লাগলে আমি আমার রাজ্যের সমস্ত প্রজা সহ ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে নেব। তারপর তোমার বোনকে বিয়ে করব।"

কী আশ্চর্য, হলও তাই! ব্লাদিমির সহ গোটা রাশিয়া... আই মিন... গোটা রা...শি...য়া একবাক্যে ক্রিশ্চান হয়ে গেল ক্যাটারিনার সঙ্গে রাজার বিয়ে করানোর জন্য। এক কথায়! টুরু লাভ একেই বলে। ওপর থেকে কিছু বদল মনে না হলেও এই ধর্মান্তকরণ ভাইকিং স্বভাবচরিত্রকে ধীরে ধীরে অনেক নরম করে ফেলল। ভাবা যায়! 


সিম্বায়োসিস অফ শেপস

 


হাউস্টান মালুদি কঙ্গোর শিল্পী। পিকাসোর ভক্ত, প্রথাগত শিক্ষাও পেয়েছেন। কিন্তু সমসাময়িক শিল্পী ও শিল্প থেকে বহু যোজন দূরের জিনিস আঁকেন। এমন এক অদ্ভুত স্টাইল বানিয়ে ফেলেছেন, দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায়। প্রথম যখন ওঁকে আবিষ্কার করি, পাগল পাগল দশা হয়েছিল। মালুদি এই স্টাইলের নাম দিয়েছেন "Monochromique Cubism Symbiotique Quantique". দূর থেকে দেখে অ্যাবস্ট্রাক্ট মোনোক্রম মনে হয় সব ছবিই, কিন্তু তারপর মন দিয়ে দেখতে শুরু করলে মাথা ঘুরতে শুরু করে। আসলে প্রতিটা ছবির বিষয়বস্তু আলাদা, আর ডিটেলিং এর লেভেল তো চিন্তাও করা যায় না। এক একটা ক্যানভাস আছে অর্ধেক ঘর জুড়ে, একটা দেখতেই মাসকাবার। কিন্তু মালুদির কাছে ও জিনিস আঁকা রোজকার ব্যাপার হয়ে গেছে। এই সিম্বায়োসিস অফ শেপস নিয়েই তাঁর কারবার। তাঁর কথায়, তিনি ছবি আঁকেন না, ছবিগুলোই আসলে তাঁকে, তাঁর জীবনকে আঁকছে। আমার মতো বোকাচণ্ডী চানাচুর কিছু বোঝাতে অপারগ, কিন্তু মালুদির আঁকা সম্পর্কে এক নামকরা আর্ট ক্রিটিক কী বলেছেন সংক্ষেপে নীচে দিলাম।

The line expresses life in its dynamism. It endlessly fills up the canvas in a Horror Vacui that evokes at the same time the reality of a crowded city like Kinshasa and the absence of void in the universe. The limited color palette used by the artist accentuates the graphic quality of his work. From far away they almost look like abstract monochromes, before revealing their vivid depictions of cityscapes. In the symbiotic, error does not exist, If you know how to use it, it becomes a line integrated to the composition of the work.







রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩

দিনযাপন -বসন্ত ২০২৩

 


দিন কেটে যায়...

দেশ থেকে ফিরে প্রায় দেড় মাস হতে চলল। মাঝে শীত কমেছিল, সোনালি রোদের উত্তাপ বসন্তের আভাস নিয়ে এসেছিল, রঙবেরঙের টুলিপের কুঁড়ি আর সতেজ সবুজ পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে দিন গুজরান করছিলাম বেশ। ভিয়েনা পার্কের শহর, শহরে রাস্তাঘাটের চেয়ে গ্রিন স্পেস ঢের বেশি, প্রতিবার ম্যাপ দেখে এক একটা নতুন পার্ক আবিষ্কার করি, তারপর সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। পার্ক বলতে সারাজীবন আমি স্লিপ আর দোলনা লাগানো ঘাসহীন খালি জমি দেখে এসেছি, বড়জোর ব্যাঙ্গালোরের জগার্স পার্ক, সেখানে ইউরোপের পার্কগুলো আমার স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে। শেষ আর হয় না। মাইলের পর মাইল সবুজের বিস্তার, বসন্তের অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা পত্রহীন গাছের অদ্ভুত শরীরগুলো আঙুল বাড়িয়ে মেঘ ছুঁতে চাইছে, অজানা লেজঝোলা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে, হরেকরকম ঘাসফুল আর টলটলে দীঘিকে সঙ্গে নিয়ে উঁচুনিচু জমি তেপান্তরের মাঠের মতো খেলে বেড়াচ্ছে, আমরা কাঠবিড়ালির মতো সেখানে দাপাদাপি করছি। ইস্টারের ছুটি, বাতাসে একটা মন ভালো করা আমেজ, সূর্য অস্ত যেতে যেতে সাড়ে আটটা, ফলে আঠ থেকে আশি সবাই মনের আনন্দে কমলালেবু রোদ গায়ে মেখে ঘুরতে বেরোয়। আমরাও এই দলে শামিল হয়েছি। দুপুরবেলায় রোদ পিঠে নিয়ে ট্রামে চড়ে বসি, এক একটা পার্কে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। ম্যাগনেলিয়ায় বোঝাই হয়ে থাকে গাছগুলো, এক একটার এক এক রকমের বাহার। গোলাপি, লাল, সাদা তো আছেই, বাদামি সাদা সরভাজা রঙের একটা ফুল দেখে আমি নাম দিয়েছিলাম রাবড়ি ফুল। কিন্তু যে ফুলটা দেখে আমি প্রেমে পড়েছি, সেটা একটা পুঁচকে ফুল। পাঁচটা করে পাঁপড়ি, তিনটে সাদা, দুটো বেগুনি। মাঝখানে সূর্য আঁকা হলুদ কালো ড্রয়িং। বাকি তিনটে পাঁপড়িতেও বেগুনির ছাপ আছে। ফুল বড় হলে সবগুলোই বেগুনি হয়ে যায়, সে যে কী সুন্দর লাগে! নেট ঘেঁটে দেখলাম ফুলের নাম প্যান্সি। কী কাণ্ড! নাম জানি, ফুল চিনি না। এই আমাদের অবস্থা। পাখি, ফুল, ফল কিছুই চিনি না, খালি বার বার অবাক হয়ে যাই। বিস্ময় আর যায় না! হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, প্যান্সিরাও চোখ টিপে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। এদিকে আকাশে তখন মেঘের নৌকা পাড়ি দিয়েছে। রোদ আর ছায়ার সঙ্গে আপস করে মেঘের দল এগিয়ে চলে, সে দেখে আবার বেজায় অবাক হয়ে তাকাই। মুখে অবশ্য ভাব করি কিছুই কেয়ার করছি না, নির্লিপ্তির আড়ালে এদিকে আমার মনে নেরুদার 'মার্চ ডেজ কাম উইথ দেয়ার কোভার্ট লাইট' উঁকি মেরে যায়। 

মার্চের দিনগুলি ফিরেছে তাদের গোপন আলো নিয়ে

আর বিশাল এক মাছ সাঁতার কেটে যায় আকাশপথ দিয়ে...

তারপর একদিন বসন্তবিলাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আচমকা হুট করে আল্পসে তুষারপাত হল আর টুলিপরোদ উবে গিয়ে ফিরে এল শীত। দামাল হাওয়ার দুষ্টুমি আর বৃষ্টির বদমায়েশি নিয়ে আমার অভিযোগ নেই, কিন্তু তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে বলে বৈকালিক ভ্রমণে ছেদ পড়ল। ফায়ারপ্লেস রাত আর স্টেক ডিনারের বালাই নেই, ফলে মুড়ি চানাচুর খেতে খেতে নেটফ্লিক্স দেখা আর অপেক্ষা করা, কবে শীত যায়! শীত গেল না, কিন্তু গরম পড়ে গেল কলকাতায়। আকাশের মুখ ভার, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক খারাপ খবর আসতে লাগল। 

আত্মীয়স্বজনদের শরীর খারাপ, বন্ধুবান্ধবদের ডিপ্রেশন, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, মামলা মোকদ্দমা, মৃত্যুসংবাদ। শুনি। কিছু করার নেই, কোভিডের পর মনের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। মনে পড়ে যায়, দু বছর আগের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কথা। একের পর এক কাছের মানুষকে হারিয়েছিলাম আমরা সবাই,  তখনও করার কিছু ছিল না। দু বছর, এরই মধ্যে সব নিজের জায়গায় ফিরে গিয়েছে, কিন্তু আমাদের বদলে দিয়ে গেছে। বিচ্ছেদ আর বিদায় এখন অনেক স্বাভাবিকভাবে ধরা দেয়, কিন্তু এই নীরব আঘাতের অভিঘাত হয় অনেক বেশি। দিন কয়েক আগে উজ্জ্বলদা, উজ্জ্বল সিংহ মারা গেলেন। বছর আটেক আগে কলকাতা টু ব্যাঙ্গালোর ট্রেন জার্নিতে উজ্জ্বলদা ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ, সেই তিরিশ ঘণ্টার আলাপের পরও আমাদের মনে রেখে দিয়েছিলেন দুজনে।  আমরাও তাদের আন্তরিক ব্যবহার ভুলে যাইনি। এমন হাসিখুশি, সদালাপী, বিদ্বান ব্যক্তি, কবি, অনুবাদক, সম্পাদক...সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, কত বই লিখেছেন, স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছিলেন শুধুমাত্র নিজের মনে পড়াশোনা করবেন বলে, গত বছর স্ত্রীর চলে যাওয়ার পর একা হয়ে গিয়েছিলেন, এবার নিজেও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। শুনলাম। বুকে একটা কাঁটা বিঁধে রইল। উজ্জ্বলদার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একটা ফোনও করিনি, করেও বা কী বলতাম! মনখারাপ আসে, চলেও যায়। কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক মারা গেলেন, তরুণ কবিদের চলে যাওয়ার খবর এল। দু একটা পোস্ট, দু একজনের স্মৃতিচারণ, তারপর রিসেট বোতাম টিপে নিজের নিজের কাজে ফিরে যাওয়া। সেই নতুন বই আর সিনেমা, রান্নাবান্নার ঝামেলা, নতুন জায়গায় ঘোরার প্ল্যান। আকাশের মুখ ভার, তিষ্ঠোতে না পেরে আমরাও বেরিয়ে পড়ি। ভিয়েনা থেকে মার্সেই, মার্সেই থেকে রোডস... পথের কাছে ফিরে যাওয়ার শান্তিটুকু অন্তত কেউ কেড়ে নিতে পারে। নীল আকাশ, নীল সমুদ্র, মানুষজনের জীবনেও যেন এই নীলাভ উষ্ণতার ছাপ পড়েছে। ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমি মানুষের মুখ দেখি, তাদের স্লাইস অফ লাইফ' মুহুর্তগুলোর আড়ালে থাকা গল্পগুলো বোঝার চেষ্টা করি। কত রকমের মানুষ! তাদের রোজনামচা দিয়ে গড়ে ওঠা শহর! শহরের ইতিহাস! বর্তমানও!

গ্রিসে এসে খবর পেলাম, জেঠু মারা গিয়েছে। কিছু এলোমেলো স্মৃতি ভেসে এল, আর বিশেষ কিছু মনে হল না। বেনারসের বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে জেঠুই ছিল সবচেয়ে বড়। বয়স হয়েছিল, মুম্বাইয়েতে দাদার কাছে গিয়ে ছিলেন। আর্মিতে কাজ করতেন, দাপুটে মানুষ, গুণের পাশাপাশি দোষও কম ছিল না। জানতাম, এরকম একটা ফোন একদিন পাবই। ওই বাড়িতে শেষ মৃত্যু ঘটেছিল তেইশ বছর আগে, ঠাকুমার সময়। তারপর বহুদিন কেটে গিয়েছে। সময় বদলেছে, বাড়ির বাসিন্দাদের জীবনও বদলে গিয়েছে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট যে, যার কাছে ওই বাড়ি আর শহরটার স্মৃতি সবচেয়ে বেশি করে জড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে আছেও, তার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে বাড়িটার। এ হওয়ারই ছিল। অভিজ্ঞতা বেড়েছে, বন্ধু কমেছে। নতুন বন্ধু অনেক হয়েছে দেশদুনিয়া ঘুরে, কিন্তু কেন জানি না একটা পরিমিত দূরত্ববোধ বজায় রাখতে হয়েছে। কৈশোরের মতো ঘনিষ্ঠতা কারো সঙ্গেই হয়নি, হবেও না। বড় হওয়া, পরিণত হওয়ার এই এক সাইড এফেক্ট, বাস্তবটা মেনে নিতে আর বিশেষ কষ্ট হয় না। অভিমান করার জায়গাগুলো ক্রমে হারিয়ে যায়। এখন আমি জানি, দূরত্ব বাড়লে সম্পর্কের উষ্ণতা কমে আসবে, বয়স বাড়লে মানুষ মারা যাবে, আমার মাথার ওপর যারা ছিল, যারা আছে, যারা স্নেহ করতেন বা করেন, তারা সবাই একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। আমার আগে বা আমার পরে। সাইকেল অফ লাইফ।

তবু, জীবন চলে। আমি দেশ ঘুরে বেড়াই। স্টিল লাইফে ধরে রাখি মানুষের জীবন। এক একটা সাদামাটা মুহুর্ত, যা নিয়ে সেই মানুষটার মাথাব্যাথা নেই, কিন্তু এই মুহুর্তগুলোই তার অলক্ষ্যে তার জীবনের পথ ঠিক করে দিচ্ছে। কেউ জ্যাকেট নামিয়ে কফি খেতে খেতে বই পড়ছে, কেউ উঁচু গলায় ফোনে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া করছে, কলেজ বা ঘুরতে আসা বন্ধুরা হয়তো প্যাস্টিস খেতে খেতে সিনেমা বা বই নিয়ে তুমুল তর্ক করছে,  বেড়ালকে পাঁচিল থেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে এক যুবক। এই সব ছোটোখাটো দৃশ্য। এই নিয়েই আমার বেড়ানো। আর সব ভুলে যাব হয়তো, কিন্তু এই ছবিগুলো থেকে যাবে। থেকে যায়। চিরকাল।





 












শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ ফিকশন

 


আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ সাহিত্য নিয়ে জয়ঢাক প্রকাশন একটা উচ্চাকাঙ্খী কাজ করেছে ২০২৩ সালে। 'বাংলায় এই প্রথম' বা 'আসতে চলেছে বিশাল চমক' টাইপ স্লোগান দেওয়ার কোনও মানে হয় না, কিন্তু আমার ধারণা স্কেলের দিক থেকে এই কাজটা সত্যিই একটা মাইলস্টোন। চার বছরেরও আগে শুরু হওয়া এই প্রজেক্টে (যখন প্রজেক্ট বলে কিছু ছিলই না) প্রায় ছশোটা মেলই করেছি আমি। কমপক্ষে তেরোটা দেশের  চল্লিশজন লেখক অনুবাদক ও সম্পাদক যুক্ত ছিলেন এই কাজে। তার চেয়েও বড় কথা, এটা শুধুই একটা বিচ্ছিন্ন অনুবাদ সংকলন নয়, বরং একটা কন্টিনিউড কালচার এক্সচেঞ্জ প্রজেক্টের প্রথম পদক্ষেপ। 

খাতায় কলমে এই সংকলনের প্রথম খণ্ডের সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার। দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদক জনপ্রিয় স্পেকুলেটিভ ফিকশন লেখক শ্রী দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। তবে আমরা একা ছিলাম না, কারণ এই প্রোজেক্টটাও ছিল আর চারটে অনুবাদ সংকলনের চেয়ে আলাদা।সঙ্গে ছিলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত আফ্রিকান লেখক ওলে তালাবি, এই প্রজেক্টের প্রধান সম্পাদক। বিদেশি গল্প নিয়ে অনুবাদ আগেও হয়েছে, পরেও হবে। তবে এই সংকলনে ঠিক কী কী আলাদা হল সেটা ডকুমেন্টেশনের জন্য খুব সংক্ষেপে জানিয়ে রাখলাম। 

১) বিশ্বসাহিত্যে আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ আজকাল যে উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে, তাতে এই জনরার লেখকদের মোটেও অগ্রাহ্য করা চলে না। তাঁদের অনেকেই বিপুল জনপ্রিয়, আফ্রিকা বাদেও ইউরোপ, আমেরিকা, চিন ও জাপানে তাঁদের লেখা নিয়মিত অনুবাদ হয়, পাঠকও কম নেই। কয়েক বছর ধরে আমি এই ধারার লেখা পড়েছি, এখনও পড়ছি, আর আফ্রিকার লেখকদের কলমের গুণে মুগ্ধ হচ্ছি বারবার। তাই ভেবেছিলাম, যদি বাংলায় এই গল্পগুলো অনুবাদ করা যায়! তবে অনুবাদ করা মানে অবশ্য আমি অনুমতি নিয়ে অনুবাদ করাই বুঝি, হুট করে নেট থেকে বা বই থেকে গল্প তুলে অনুবাদ করাটা আমার মূল্যবোধে আটকায়। তাই লেখকদের ব্যাপারটা বোঝানো এবং রাইটস হস্তান্তরণ করাটা প্রধান সমস্যা ছিল। আমি উটকো একজন পাঠক, প্রকাশক তো নইই। সে সময় জানতামও না ভবিষ্যতে জয়ঢাক এই বই করতে আগ্রহী হবে, বা আমাকে সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। শুধু চেয়েছিলাম, লেখাগুলো বাংলা পাঠকদের কাছে পৌঁছাক। গত চার আড়াই বছরে প্রায় আট দশজন লেখকের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সত্যি সত্যি যখন কাজটা বাস্তবায়িত হওয়ার জায়গায় আসে, তখন গিয়ে অবশেষে দেবজ্যোতিদাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম। 

'জয়ঢাক প্রকাশন কি কন্টেম্পোরারি আফ্রিকান স্পেকুলেটিভ রাইটারদের কাজ অনুবাদ করতে ইচ্ছুক?'

গ্রিন সিগন্যাল এসেছিল মুহুর্তের মধ্যে, কিন্তু তারপরেও প্রচুর বাধাবিপত্তি এসেছে। বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর অবশেষে ব্যাপারটার ফাইনাল ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়। ভেবেছিলাম, এইবার মানেমানে কেটে পড়ব, কিন্তু সে আর হল না। দেবজ্যোতিদা আমাকেই সম্পাদনার দায়িত্ব দিলেন। কাজটা ইন্টারন্যাশনাল কোলাবরেশন হিসেবে নেওয়াটাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তাই ওলে অবশ্যই সঙ্গে ছিলেন। একটা এ ধরনের কাজে কালচার এক্সচেঞ্জ না হলে, বিদেশি সাহিত্য আর বাংলা অনুবাদ নিয়ে সত্যিকারের আগ্রহ না থাকলে শুধু রাইটস বিনিময় করে কী লাভ? 

২) এই বইটা কেবলমাত্র একটা ট্রান্সলেশন অ্যান্থলজি নয়, প্রোজেক্টটার মাধ্যমে আমি বাংলা সাহিত্য ও বইবাজার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি বিদেশি সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের। অনেক লেখককে নেওয়া সম্ভব হয়নি প্রথম কাজে, কিন্তু গত দু' বছরে গোটা আফ্রিকার প্রায় কুড়ি তিরিশজন লেখক সম্পাদককে আমি সমসাময়িক বাংলা ও ভারতীয় স্পেকুলেটিভ সাহিত্য সম্পর্কে ক্র‍্যাশ কোর্স দিয়েছি বলা যায় (তাই বলে এ নিয়ে আমি খুব বেশি কিছু জানি বলে দাবী করছি না, উল্টে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য নিয়ে আমার পড়াশোনা খুবই কম) অনীশ দেব থেকে মিমি মন্ডল বা দীপেনবাবু, রণেন ঘোষ থেকে সোহম গুহ, অদ্রীশ বর্ধন থেকে সুমিত বর্ধন, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য থেকে সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ থেকে অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, সৌভিক চক্রবর্তী থেকে সৌরভ ঘোষ, ইন্দ্রপ্রমিত দাস থেকে গৌতম ভাটিয়া, ফ্যান্টাস্টিক থেকে কল্পবিশ্ব। স্বাভাবিকভাবেই সম্পাদক বা পত্রিকাগুলোর নাম বলব না, কিন্তু এইটুকু বলতে পারি, আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে  এদের অনেকের লেখার লিংক শেয়ার করেছি এদের সঙ্গে, প্রয়োজনে মাল্টিলিংগুয়াল অ্যান্থোলজির জন্য বিদেশি লেখকদের গল্প বাংলায় অনুবাদও করে দিয়েছি। (অনেক সম্পাদক জিজ্ঞেস করতেন, তুমি নিজে বেশি বেশি করে কল্পবিজ্ঞান লেখো না কেন? তখন নিজেই বুঝতাম না কী বলব😁) 

কাজটা জরুরি গ্রাউন্ডওয়ার্ক হিসেবেই ধরেছিলাম, কারণ একটা বই করে বসে থাকলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আর বদলাতে হলে এই কাজগুলো করা প্রয়োজন। কান্নাকাটি করে কিছুই হবে না। বলতে পারি, প্রথম পদক্ষেপে খুব একটা হতাশ হইনি। যারা অনুমতি দিয়েছেন, প্রায় প্রত্যেকেই প্রজেক্ট চলাকালীন কন্ট্যাক্টে ছিলেন, আপডেট নিচ্ছিলেন অনেকেই। এই অ্যাক্টিভ এঙ্গেজমেন্ট অন্য প্রজেক্টে হয় কিনা আমার জানা নেই। নো ওয়ান ইন উইন্টার স্লিপ! আর কী চাই? আশা করি, আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থাকলেও জয়ঢাক পরবর্তীতে এ ধরনের কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবে।

৩) সম্পাদনার দায়িত্ব পাওয়ার পরেই ঠিক করেছিলাম, আমি নিজে কোনও গল্পের অনুবাদ করব না। (দ্বিতীয়  খণ্ডে অবশ্য অনুবাদে হাত দিতে হয়েছিল, সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব ছিল না) কল্পবিজ্ঞানে মৌলিক লেখা বা অনুবাদ করার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা নেই, সেটা স্বীকার করাই ভালো। এমন একটা কাজে যোগ্যতাটাই প্রথম এবং শেষ শর্ত হওয়া উচিত। টিম নির্বাচনে যেটুকু আমার ইনপুট ছিল, তাতে কোনও পার্সোনাল ইমোশন বা দাদাইবাসা/দিদিয়াবাসা মার্কা বায়াস দেখাতে যাইনি। বিশেষ চেনাজানা ছিল না অনুবাদকদের সঙ্গে, অনেকের সঙ্গে তো আমি এই প্রথম কথা বলেছি। কিন্তু কথা না হলেও তাঁদের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ঠিকই। কে কোন গল্প অনুবাদ করবেন, সেটাও ঠিক করেছি তাঁদের ব্যক্তিগত পছন্দ, দক্ষতা ও আগের কাজ দেখে। এখন বলতেই পারি, অনুবাদকরা অসামান্য কাজ করেছেন। হ্যাঁ, পাঠকদের ভালো মন্দ লাগা নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে, সে অন্য বিষয়। 

৪) লেখকরা সবাই যাতে অনুবাদক ও তাঁদের প্রোফাইল সম্পর্কে অবগত থাকেন, সে কাজটা আমি প্রথমেই করে দিয়েছিলাম। সময়ে সময়ে আপডেটও দিয়েছি সবাইকে। অনুবাদকরাও ইচ্ছে করলে লেখককে যোগাযোগ করতে পারবেন, সেও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল হয়েছিল। পাশাপাশি আফ্রিকার অন্যতম সম্পাদককে প্রকাশনার সমস্ত ওয়ার্ক সিডিউল জানানো হয়েছে, এবং সম্মতিও নেওয়া হয়েছে প্রতিটা পদক্ষেপে। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, কাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রত্যেক লেখকের সঙ্গে আইনি চুক্তি করা হয়েছে, প্রয়োজনে দীর্ঘ নেগোসিয়েশনও হয়েছে বইকি। কিন্তু যে জিনিসটা নিজের তরফ থেকে গোড়া থেকেই এড়িয়ে যেতে চেয়েছি সেটা হল অপেশাদার অ্যাটিটিউড। বড় ইন্ডাস্ট্রি না হতে পারে, বড় প্রকাশক না হতে পারে, কিন্তু বাংলা ভাষার কাজগুলো নিয়ে আমাদের ভিশনটুকু অন্তত যেন বড় হয়! এইটুকু যেন ভুলে না যাই আমরা কেউই। 

এই সংকলন দুটির এক একটা গল্প এক একটা বোমা বটেক। শুধু নেবুলা, হিউগো, নোম্মো, কেইন মনোনীত/বিজয়ী গল্প বলে নয়, বরং গল্পের চরিত্রের কথা ভেবেই এটা বলা। এখানে যত না বিজ্ঞান আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি করে আছে মানুষ। মানুষের ভয়, মানুষের দ্বিধা, মানুষের  রাগ, মানুষের নিরাসক্তি, মানুষের অসহায়তা, মানুষের মনস্তত্ত্ব, মানুষের জেদ... এই বইয়ের প্রতিটা গল্প আফ্রিকার মানুষের কান্না রক্ত ঘাম দিয়ে লেখা। কোথাও সেটা খুব প্রমিনেন্ট, কোথাও অদৃশ্য। কিন্তু এই সততাটা অনুভব করতে পারবেন সকলেই। গল্পগুলো মন দিয়ে পড়লে মাথা ঘোরা তো দূর, গোটা পৃথিবীটাই উল্টোদিকে ঘুরে যেতে পারে।

বিষয়বস্তুর বৈচিত্র‍্যের দিক থেকে দ্বিতীয় খণ্ডটা খানিকটা বেশি নম্বর অবশ্যই পাবে। উগাণ্ডা, নাইজিরিয়া, কেনিয়া, সেনেগল, গাম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বোটসওয়ানা আর মিশরের এই এগারোজন লেখক কতভাবে স্পেকুলেটিভ ফিকশনকে ব্যবহার করেছেন, কল্পনা ও বাস্তবকে কী অসামান্য দক্ষতায় মেনস্ট্রিম সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন, বিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসিকে হাতিয়ার করে কী সাবলীলভাবে তৎকালীন সমাজ ও মনুষ্যত্বের গল্প বলে গিয়েছেন, তা পড়লে বার বার চমকে উঠতে হয়, মুগ্ধ হতে হয়। গল্প নির্বাচনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সেই মুগ্ধতা বেড়েছে বই কমেনি।

আর লেখক সূচি! তাঁদের নিয়ে কথা বলতে গেলে তো আলাদা প্রবন্ধ লিখতে হবে! বলতে বাধা নেই, এত বড় বড় সাহিত্যিকদের কাছ থেকে অফিসিয়াল অনুমতি নিয়ে গল্পগুলো অনুবাদ করা বড় সহজ ছিল না। তবে পেশাদারভাবে কাজটার নিষ্পত্তি হল বলে আমি খুশি। বাংলায় অনুবাদ করতে গেলে কপিরাইটের পরোয়া অনেকেই করে না, সেটা দুর্ভাগ্যজনকই বটে। ওলে তালাবি আর জয়ঢাক টিম তো যথাসম্ভব সাহায্য করেছেন ঠিকই, মূল লেখক ও তাঁদের লিটারারি এজেন্টদের কাছেও কৃতজ্ঞ রইলাম। মার্ভেলের জেসিকা জোন্সের সিরিজের প্রধান লেখিকা ও ফিনান্সিয়াল ফিউচারের বিশেষজ্ঞ স্যাম বেকবেসিঞ্জার আছেন,    একেপকি আছেন, নিক উড আছেন, আফ্রিকান স্পেকুলেটিভে ঝড় তোলা লেখক মামে ডিয়েনে আছেন। জে এম কোয়েটজির স্নেহধন্য ছাত্রী ও বিশ্বসাহিত্যে তুমুল আলোচিত হেনরিয়েটা রোজ-ইন্স আছেন তাঁর একটি অসামান্য পুরস্কার প্রাপ্ত গল্প নিয়ে, সমসাময়িক সময়ে 'শাইনিং গার্লস' লিখে প্রায় সেলেব হয়ে যাওয়া লরেন বিউকসও আছেন। অ্যাপল টিভি 'শাইনিং গার্লস' নিয়ে সিরিজ করার পর তাঁর খ্যাতি এখন সারা দুনিয়ায়। স্টিফেন কিং থেকে নীল গাইমান, সবাই তাঁর লেখার তারিফ করেছেন একসুরে। 

অনুবাদক সূচিও চমকে দেওয়ার মতো। যশোধরা(রায়চৌধুরী) দি ও সৈকত (মুখোপাধ্যায়) দার পাশাপাশি এই সময়ের সেরা কিছু অনুবাদক এই গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন। আই অ্যাম অন ক্লাউড নাইন। ভাগ্যিস বছর চারেক আগে আমার মাথায় পোকা কামড়েছিল কাজটা করার।

যে কথাটা না বললেই নয়, সেটা হল, দয়া করে কেউ শুধু প্রচ্ছদ ভালো লেগেছে বলেই বা আফ্রিকার গল্প শুনেই বই কেনার সিদ্ধান্ত নেবেন না। শিল্পী সুবিনয় দাস দুই খণ্ডেই দারুণ প্রচ্ছদ করেছেন, পুস্তানির কাজও অসামান্য, কিন্তু সেই ছবিগুলোই কেবল মূল আকর্ষণ না হলেই ভালো। এই দুটো সংকলনে থাকা গল্পগুলো শুধুই আমাদের চেনা প্লটভিত্তিক 'গল্প' নয়, সাহিত্যসৃষ্টির বিভিন্ন হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে, ভাষা-ফর্ম-ক্রাফট দিয়ে বুনে তোলা এক একটা বক্তব্য। অসম্ভব প্রাসঙ্গিক, ভীষণ ব্যক্তিগত। প্রায় প্রতিটা গল্প আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে, এক একটা গল্প নিয়ে অনলাইন ফোরামে বছরের পর বছর আলোচনা চলেছে, তা এমনি এমনি নয়। কিন্তু এ-ও জানি, বাংলার পাঠকদের কাছে এই ঘরানার গল্প এখনও খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি, সেটা অস্বীকার না করাই ভালো। একটা গল্পকে ভালো বা মন্দ বলার জন্য যে সমস্ত প্যারামিটার আছে, তার অনেকগুলোর সঙ্গে আমাদের এখনও সেভাবে পরিচয় হয়নি। আচমকা নতুন জিনিস পাতে পড়লেই যে সবাই সেটা একইভাবে অ্যাপ্রিসিয়েট করতে পারবে, সেটা জরুরি নয়। ইতালো কালভিনোর উপন্যাস পড়ে প্রথমে অনেকেই দুরছাই করেছে, গিবেরিশ আর ইন্টারেক্টিভ সাহিত্যকে পাঠকের নিন্দেমন্দ শুনতে হয়েছে, এমনকি প্রাপ্তমনস্ক গ্রাফিক নভেল যে সত্যিকারের সাহিত্য হতে পারে, সে কথা এস্ট্যাবলিশ হতে এক শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। আমার এক পরিচিত সাহিত্যিক বন্ধু দুনিয়ারাজ্যের বই পড়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন, কিন্তু 'পার্সেপলিস' বা 'প্যালেস্তাইন' এর মতো সাড়াজাগানো গ্রাফিক নভেল পড়েও তাঁর ওই ফর্মটা ঠিক পছন্দ হয় না। মাঝে মাঝে আমার হাতেও এমন এক একটা বই হাতে আসে, প্রচুর নামডাক থাকলেও সেগুলো পড়তে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। মাথার চুল ছিঁড়তে হয় এই ভেবে যে, এই লেখাটা নিয়ে এত হইহই কেন?

এই সূত্রে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। শুনেছিলাম গুলজার প্রথম যখন অপেরা শুনতে গিয়েছিলেন, সেদিন তাঁর বিরক্তই লেগেছিল, কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু আর সকলের মতো তিনি অপেরারা ব্যাপারটা নাকচ করে দেননি আগেভাগে। এত এত শ্রোতা কেন সঙ্গীতের এই ফর্মটাকে পছন্দ করেন, সেটা জানার সদিচ্ছা তাঁর ছিল। তাই বিদেশে থাকাকালীন নিয়মিত অপেরা শুনেছেন, সে নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, যতদিন না এই অজানা শিল্পমাধ্যম তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে। একসময় গুলজার অপেরাকে ভালোবেসেছেন। কেউ তাঁকে জোর করেনি এত সব করতে, নতুন জিনিসকে বোঝার আর নিজের চিন্তাভাবনার প্রসারতাকে বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাঁকে নিজেই নিতে হয়েছিল। এইজন্যই তিনি গুলজার।

আমরা কেউই সবজান্তা নই। সবাই এখনও শিখছি। তবে নতুন জিনিস শেখার ও অ্যাপ্রিসিয়েট করার ইচ্ছেটুকু, ওই আগ্রহটুকু অন্তত বজায় থাকুক, সেটাই প্রার্থনা। স্পুনফীড করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। দেশবিদেশের স্পেকুলেটিভ ফিকশনের অনুরাগীদের এই বই ভালো লাগবে, সে বিশ্বাস আমাদের আছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন পাঠকদের  কয়েকজনের মনেও যদি কয়েকজনের মধ্যেও এই লেখাগুলো, এই জনরা সম্পর্কে ইনকুইজিটিভনেসটুকু জাগিয়ে তোলা যায়, কেউ যদি এই এই বইটা পড়ে নেটে গিয়ে অন্যান্য কিছু গল্প পড়েন, আমাজন থেকে হেনরিয়েটা রোজ-ইন্স বা ওলে তালাবির একটা বই আনিয়ে পড়েন, তাহলেই আমাদের সমস্ত পরিশ্রম সার্থক হবে।

লেখক ও অনুবাদক সূচী 

১. আগামী রাত্রির উপাখ্যান 

২. আলো আঁধারের উপাখ্যান 

Chikodili Emelumadu, Ivor W. Hartmann, Oghenechovwe Ekpeki Donald, Nick Wood, Wole Talabi, Nerine Dorman, Kofi Nyameye, Dare Segun Falowo, T.L. Huchu, Blaize Kaye, Eugen Bacon, Suyi Davies Okungbowa, Sam Beckbessinger, Ada Nnadi, Emad El-Din Aysha, Mame Bougouma Diene, Biram Mboob, Tlotlo Tsamaase, Richard Oduor Oduku, Derek Lubangakene, Henrietta Rose-Innes, Lauren Beukes and Chinelo Onwualu.

Soham Guha, Dip Ghosh, Debjyoti Bhattacharya, Rajarshee Gupta, Santanu Bandopadhyay, Saranya Mukhopadhyay, Anushtup Sett, Sumit Bardhan, Partha De, Arindam Debnath, Aditi Sarkar, Mahasweta, Amit Debnath, Partha Chattopadhyay, Tapas Moulik, Arindam Ganguly, Saptarshi Chatterjee, Saikat Mukhopadhyay, Kaushik Bhattacharya, Mousumi Ray, Yashodhara Ray Chaudhuri and Nandini Das Chattopadhyay.

যদি কেউ পড়তে চান, জয়ঢাক প্রকাশন বা আমাজন থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।

দুই বন্ধুর কিসসা

 


দুই বন্ধু। দুই শিল্পী। রাম কুমার আর হুসেন। ছয়ের দশকের প্রথম দিকে এই জুটি রঙ তুলির বোঁচকা নিয়ে বেনারসে এসে উপস্থিত হয়েছিল। দুজনেই তখন আঁকা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে। সবাই শুধু বলে, বেনারসে গেলেই নাকি আঁকার সাবজেক্ট পাওয়া যায়। তাই এই যাত্রা! তার আগে অবশ্য এলাহাবাদে গিয়েছেন দুজনেই, মুনশি প্রেমচন্দের ছেলে শ্রীপত রাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেখানেই, ফলে বেনারসে থাকার ব্যবস্থা হল প্রেমচন্দের বাড়িতেই। সেখানে সর্বক্ষণ সাহিত্যিকদের আনাগোনা। একে তো সাহিত্যিক, তারপর আবার বেনারসের! কথার তোড়ে দুই বন্ধুর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। ভয়ানক বিপদ। ঠিক হল, রোজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে। দুজনে যাবেন দু দিকে, যদি কিছু পাওয়া যায় কাজের জিনিস।

সেই 'সিলসিলা' চলল। হুসেন একদিকে যান, রাম কুমার অন্যদিকে। গরুর গুঁতো, রিকশার ঠেলাঠেলি, দোকানিদের ভিড় কাটিয়ে নির্জন গলিতে গিয়ে পড়েন, কাশীনরেশের পরিত্যাক্ত হাভেলিতে গিয়ে বসে থাকেন। সন্ধ্যার সময় পায়রার দল উড়ে যায়, বিষন্নতার রঙ ধরা দেয় মাঝি মাল্লাহদের উজ্জল মুখের আড়ালে। দুই শিল্পী নিজের মতো করে দেখতে চান সে সব। তাঁদের পিছু নেয় শহরের ধুলো, মসলিনের আবরণের মতো সে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ঘুরে বেড়ান দুজনে। নৌকায় বসে থাকেন, ঘাটের সিড়িতে বসে চা খান, গল্প জুড়ে দেন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে।  রাত ঘনালে বাড়ি ফেরেন, কোনোদিন আবার গঙ্গার ঘাটেই রাত কেটে যায়। রাতের অন্ধকারে, ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় বুঝতে চেষ্টা করেন বেনারসের চরিত্র। কখনও পারেন, কখনও পারেন না। এই শহর সবাইকে একভাবে ধরা দেয় না।

হুসেনের চঞ্চল মন বেনারসের সঙ্গে ভাব জমাতে পারেনি। পনেরো দিনের মাথায় তিনি বোরিয়াবস্তা তুলে ফিরে যান, পালিয়ে বাঁচেন বলা যায়। রাম কুমার থেকে যান। সপ্তাহ কাটে, মাস কাটে, বছর কাটে। এক বছর, দু বছর... রাম কুমার বেনারস ছেড়ে নড়েন না। কত সময় কাটল, ক'টা ছবি আঁকলেন, কতটা দূরত্ব অতিক্রম হল এ জীবনে, সে সব তখন অবান্তর। তখন তিনি রমতা যোগী। এই শহরের ভিতর যে আরেকটা শহর বয়ে যায়, তার সন্ধান খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি, সেই শহরের নেশা ধরে গিয়েছিল রাম কুমারের। পরবর্তীতে বলেছিলেন, তাঁর সমস্ত শিক্ষার মূলে আছে এই শহর। বারাণসী।

ভারতবর্ষে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট আর ফিগারেটিভ শৈলি নিয়ে যে কাজ করে গিয়েছেন রাম কুমার, সে নিয়ে জীবনকালে দেশে তেমন আলোচনাও হয়নি। তিনি ফাইন আর্টস নিয়ে গতানুগতিক পড়াশোনা করেননি, দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স থেকে ইকোনমিক্স নিয়ে পোস্ট  গ্র‍্যাজুয়েশন করেছিলেন। সেলেব আর্টিস্ট হওয়ার বাসনাও তাঁর ছিল না। আজীবন প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপের সদস্য ছিলেন, যা মনে এসেছেন তাই এঁকেছেন। কী আঁকলে নাম হবে, প্রদর্শনী হবে, পয়সা হবে, সে সব নিয়ে তাঁর কোনও চিন্তাই ছিল না। 

ভিয়েনার একটা অকশন হাউসের পোস্ট দেখার সময় জানতে পারলাম, রাম কুমারের আঁকা নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি তাঁর আঁকা পেইন্টিং 'ভ্যাগাবন্ড' এক মিলিয়ান ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। তাঁর 'মেলোফি' স্টাইল মানে মেলানকলিক লোনলি ফিগার্স এর চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে ইউরোপের নিলামঘরগুলো হন্য হয়ে তাঁর পুরোনো ছবি খুঁজতে শুরু করেছে। কেউ খুঁজে দিলে পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকছে। যতদূর মনে পড়ছে, ছোটবেলায় তাঁর আঁকা ছোট ছোট বেশ কিছু ছবি দেখেছিলাম লোকাল একজিবিশনে। নামমাত্র দামে বিক্রি হত সেগুলো। যদি... যাকগে! প্রথম ছবিটা রিচার্ড বার্থেলোমিউর তোলা। দুর্লভই বলা চলে।






পিটার টার্নলির ইউক্রেন সিরিজ

 


পিটার টার্নলিকে আবিষ্কার করেছিলাম পুরোনো নিউজউইক পত্রিকা থেকে। আট আর নয়ের দশকে এই মার্কিন-ফরাসি ফোটোগ্রাফারের ছবি নিয়মিত ভাবে নিউজউইকে ছাপা হত। সেকালে ফ্রেঞ্চ স্কুল অফ হিউম্যানিস্ট ফোটোগ্রাফিতে বাইরের শিল্পীদের বিশেষ পাত্তা দেওয়া হত না, তাই টার্নলিকে নিয়েও প্রথমে কেউ মাথা ঘামায়নি। এমনিতেও এই মানুষটা ছিলেন খানিক ক্ষ্যাপা পাগলা টাইপ। ইন্ডিয়ানাতে জন্ম, সেখানে পড়াশোনা করার সময় থেকেই জমজ ভাই ডেভিডের সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়তেন, সঙ্গে থাকত একটা আদ্যিকালের ক্যামেরা। ফিরে আসতেন ঝুলি, থুড়ি ক্যামেরা ভর্তি করে। স্ট্রিট ফোটোগ্রাফি ব্যাপারটা মনে হয় তাঁর রক্তে ছিল, সে সব তাঁকে শিখতেও হয়নি।

আগামীতে পিটার Instituts d'études politiques থেকে উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন, সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই ফরাসি ইন্সটিউশনের এমন নামডাক যে বলার নয়। অর্ধেক ছেলেমেয়েই ভর্তি হতে পারত না, নাহলে ডাহা ফেল করত। আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা এলেও অনেকেই পালিয়ে যায় বেগতিকে পড়ে। সে অন্য গল্প। মোদ্দা কথা পিটার টার্নলে আর তাঁর ক্যামেরা, দুজনেরই চোখ ছিল আলাদা। আলাদা ছিল মনও। পিটার যে ভাবে মানুষকে দেখেছেন, দেখছেন, সকলে পারে না। মানুষের জীবনকে ডকুমেন্ট করার জন্য পিটার কোথায় না পাড়ি দিয়েছেন? গত চল্লিশ বছরে দুনিয়ার যে কোনো কনফ্লিক্ট জোনের কথা মনে করুন, পিটার সেখানে গিয়েছেন। যে কোনো হিউম্যান ট্র‍্যাজেডি বা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা ভাবুন, পিটারের ক্যামেরা সেখানে উপস্তিত। চেচেনিয়া, বসনিয়া, প্যালেস্তাইন, হাইতি,  আফগানিস্তান... গাল্ফ ওয়ার, সোমালি সিভিল ওয়ার, তিয়ানমেন স্কোয়ার, ৯/১১ পরবর্তী গ্রাউন্ড জিরো, বার্লিন ওয়ার ডেমোলিশন, কোভিড... পিটার কিছুই বাদ রাখেননি। কিন্তু তাতে কি! এরকম কত ফোটোজার্নালিস্টই তো আছেন। সবাই পিটার টার্নলি হয় না। 

পিটারের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি নিজেকে চিত্রসাংবাদিক ভাবেনই না। তাঁর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই, কোনো এসওপি নেই। তিনি ক্যামেরা ব্যাগে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন, তারপর হাঁটতে থাকেন। হাঁটতেই থাকেন। প্রয়োজনে লোকাল ট্রান্সপোর্ট নেন। সেটা প্যারিস বা নিউইয়র্ক হোক, বা হালের ধ্বসে যাওয়া ইউক্রেন। বিপদ বা ঝুঁকির কথা তাঁর মাথাতেই আসে না। চায়ের দোকানে, কফিশপে, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। নিজে থেকে কিছুই জানতে চান না, লোকেরাই তাঁকে গল্প বলে। তিনি শুনে যান। গল্পের পর গল্প জমতে থাকে। একসময় টুক করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেন, ফের ডুবে যান গল্পে। এই করে দিন কাটে। এক সপ্তাহ, এক মাস, দু মাস... আবার যখন প্যারিস বা নিউইয়র্ক এ তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন, সেই ছবিগুলো বের করেন। যে গল্পগুলো তাঁর মনে দাগ কেটে যায়, সেগুলো সামনে আনেন, বাকি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখে দেন। এই করে করে পিটার গোটা মানবসভ্যতাকে ডকুমেন্ট করে ফেলেছেন। মাঝে মাঝে এই অভিজ্ঞতাগুলো লিখেও রাখেন তিনি। সেইগুলো পড়া একটা অভিজ্ঞতা বটে। খারকিভে একটা ছবি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন।

Vitali, 48, from Kharkiv, stood outside a box car staring into a window where his daughter Valeria, 8, and his wife, Lelena, were looking back at him. They stared at each other quietly but intensely for a long time. Suddenly, without notice, the train began to move, and before the family could be prepared they were separated. I found myself wanting to stop the train, to give Vitali time to say goodbye—but it was gone, and so was any certitude of a family’s future.

বহু বছর আগে 'প্যারিসিয়ান' বইতে পিটারের তোলা ছবি দেখার পর আমার রীতিমত নেশা লেগে গিয়েছিল। সে নেশা আর ছাড়েনি। পিটারের নাম দেখলেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর কাজ দেখি। ছবি তো নয়, কবিতা। যদি সিনেমা দেখার অভ্যেস থাকে, তাহলে বলতে পারি, তার্কোভস্কির ছায়াছবি দেখে যেরকম মনের ভাব হয়, পিটার টার্নলির ছবি দেখেও আমার প্রায় তাই হয়। এক একটা ছবি নিয়ে বসে থাকি বুঁদ হয়ে, চোখই সরতে চায় না। কিছু কিছু অশ্রুত গল্প যেন আমিও শুনতে পাই সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে। 

কিছু ছবি দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না। এইগুলো অধিকাংশই ইউক্রেন যুদ্ধের, গত মার্চে তোলা।









হেলো বিউটিফুল

অ্যান ন্যাপোলিটানোর নতুন বই 'হ্যালো বিউটিফুল' নিয়ে পাঠকরা উচ্ছ্বসিত। জটায়ুর কথায় বইখান একদম গরম খাস্তা কচুরির মতো বাজার থেকে উড়ে যাচ্ছে। তাঁর আগের বই 'ডিয়ার এডোয়ার্ড' নিয়েও প্রায় এই লেভেলের পাগলামি দেখা গিয়েছিল, অ্যাপল টিভি ঝটপট সিরিজও বানিয়ে ফেলে। কিন্তু 'হ্যালো বিউটিফুল' যেন সেই বইটাকেও ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু তবু এতদিন বইটা পড়িনি, কারণ সার সংক্ষেপ দেখে পড়ার আগ্রহ বোধ করিনি। ইয়ে, খানিকটা হামবড়া ভাব বলা যেতে পারে, কিন্তু এত এত বই যেখানে না পড়া আছে, সেখানে নতুন একটা বই ঠিক কেন পড়ব, সেখানে নানা ধরনের ফিল্টার লাগাতেই হয়। 

প্রতি বছর বাংলায় (এবং অন্যান্য ভাষায়) এরকম বহু লেখা প্রকাশিত হয়, যেগুলো আসলে 'লাইফ হ্যাপেন্স' গোত্রের লেখা। সাধারণ মানুষের জীবন, সম্পর্ক, প্রেম, বিচ্ছেদ নিয়ে লেখা গল্প, স্টোরিলাইন বা প্রেক্ষাপটে বিশেষ নতুনত্ব কিছুই থাকে না। পড়তে বসে দিব্যি পড়া হয়ে যায়, আবার ভুলে যেতেও সময় লাগে না। এই লেখাগুলো কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে না আজকাল, হয়তো বয়স বেড়েছে বলেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, লেখকের লেখার হাতটি তো বেশ, লিখতে জানেন, গল্প বলতে জানেন, তবু কেন সেই একই চর্বিতচর্বণ ঘটনা আর প্লট নিয়ে লিখছেন? এখন সেটা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার সে কী লিখতে চায়, তাতে আমার কী বলার থাকতে পারে? কিন্তু মোদ্দা কথা, এই লেখাগুলো পড়তে আর বিশেষ আগ্রহ বোধ করি না, সে যতই বেস্টসেলার তকমা পাক না কেন! ওই যে বললাম, সময় কম! আর পাঠকের রুচি যে ভিন্ন ভিন্ন হবে সে কথাও নতুন নয়। ফলে, ফিল্টার না লাগিয়ে উপায় নেই। কিন্তু এরই মধ্যে এক একটা বই ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে, ভাব, ভাষার ব্যবহার বা ক্রাফট সাধারণ গল্পগুলোকে অসাধারণ করে তোলে, তখন বোকা হয়ে যেতে হয়। বাংলায় সমসাময়িক কিছু কলম সেটা বার বার করে থাকেন। 

তাই শেষমেশ হ্যালো বিউটিফুল পড়তে শুরু করেছিলাম। যদি তেমন কোনো এক্সপেরিমেন্ট থাকে! ভাষা বা লেখনীর মধ্যে এমন কিছু নতুনত্ব থাকে, যা আগে দেখিনি! কারণ, গল্পে তো কিস্যু নেই। মানে, গল্প একটা আছে বটে, ওই লাইফ হ্যাপেন্স টাইপ গল্প, প্রেম বিচ্ছেদ বোকামি অবসাদ মন কেমন উপলব্ধি... জীবন যেমন বয়ে যায়...ইত্যাদি ইত্যাদি, সে সব নিয়েই উপন্যাস। এক্সক্লুসিভ বলতে কিচ্ছু নেই। এ বাদে কী আছে কী নেই, সেটা অবশ্য পড়া শুরু করার পর বোঝার উপায় রইল না, কারণ আমি টানা সাড়ে তিনশো পাতা পড়ে বই বন্ধ করলাম। এমন গোবেচারা কোন উপন্যাস (যেখানে কিছুই নেই আসলে) আমি একটানা পড়েছি মনে করতে পারলাম না। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, অ্যান ন্যাপোলিটানোর লেখায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, ভাষার ব্যবহার বা ট্রিটমেন্টে বিশাল কিছু এক্সপেরিমেন্ট নেই, নন লিনিয়ার ন্যারেটিভও তেমন নেই, কল্পনার সঙ্গে বাস্তব মিশিয়ে বিশাল কোনো চমক দেওয়ার চেষ্টাও তিনি করেননি (একবার অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বইটা 'লিটল উমেন' এর আধুনিক অ্যাডাপ্টাশন হতে পারে, সেটা তেমন কিছু নয়) তবু হ্যালো বিউটিফুল আমাক্ব উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি প্রায় সবগুলো চরিত্রকে ভালোবেসে ফেললাম। তিনদিনে বই শেষ করে আমি অ্যান ন্যাপোলিটানের আগের বইটা পড়ব বলে তুলে ফেলেছি। এরই মাঝে বোঝার চেষ্টা করলাম, বইটা আমার ঠিক কেন ভালো লাগল?

যা বুঝলুম, হ্যালো বিউটিফুল বইখানায় শুধু একটাই জিনিস আছে, সেটা হল যত্ন। ভালোবাসা বা মমতাও বলা যায়। এমন মমতা দিয়ে গড়া গল্প যে পড়ে মনে হয় কেউ নিজের জীবনের কথাই বলছে। কিন্তু যে কথাটা আসলে মনে পড়ছে, সেটা হল 'টেন্ডার'। এই মাধুর্য, এই টেন্ডারনেসটা গোটা বই জুড়ে ছড়িয়ে আছে। চরিত্রদের সংলাপে, ব্যবহারে, রাগ বা বিষন্নতায়... আর এই টেন্ডারনেসের ম্যাজিকেই পাঠক গলে যায়, ভুলে যায় অন্য সব কিছু। এই গল্পে কোনও ভিলেন নেই। সবাই সাধারণ মানুষ, একটু বেশিই ভালো তারা। ভালো বন্ধু, ভালো বোন, ভালো দম্পতি, এক দুসরে সে কারতে হ্যায় পেয়ার হম মার্কা ফ্যামিলি! কিন্তু কিছুতেই ব্যাপারটা ন্যাকামি বলে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। এমন একটা ফ্যামিলি ভ্যালু আর বন্ধুত্বের গল্প দিয়ে আজকালকাল দিনে বেস্টসেলার হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অ্যান সেটা পেরেছেন। কী করে যদি বুঝতে চান, বইটা পড়ে ফেলুন।

বলিভিয়ান আর্ট

 


রবার্টো মামনি আর মেস্তিজো বোরাকে স্টাইলের ঊর্ধ্বে বলিভিয়ার কীরকম আঁকা হচ্ছে? আদৌ কি হচ্ছে? এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর পরপর আন্দোলনের মাঝে নতুন শিল্পীরা কী আঁকছেন? 

কোচাবাম্বার একটা আর্ট গ্যালারির কিছু স্যাম্পল রইল আগ্রহীদের জন্য।