People watching in Paris |
মাতাল হতে হবে তোমাকে
এখানেই আছে সকল সমাধান—
এবং এটাই শেষ পথ....
কীসে মাতাল হবে?
মদ, কবিতা অথবা ধর্ম; যেমন ইচ্ছে তোমার
কিন্তু মাতাল হতেই হবে তোমাকে
....
প্রশ্ন করো তুমি, এখন কীসের সময়?
হাওয়া, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি— প্রত্যেকে ওরা দেবে উত্তর—
এখন সময় মাতাল হবার
সময়ের ক্রীতদাস না হয়ে বরং মাতাল হও;
এক মুহূর্ত সুস্থতা নয়
মদ, কবিতা কিংবা ধর্মে; যেমন ইচ্ছে তোমার— মাতাল হও!"
~শার্ল বোদলেয়ার
অধিকাংশ মানুষই সময়ের ক্রীতদাস। গতানুগতিক জীবনযাত্রা আর আর্থিক স্বচ্ছলতার আঙ্গিকে জীবন কাটিয়ে চলেছে। কিন্তু দৃষ্টির অন্তরালে কয়েকজন মানুষ পরিচিত জীবনের শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে নিজের ইচ্ছেয়, নিজস্ব চিন্তাধারা নিয়ে, উদ্বুদ্ধ করে পরবর্তী প্রজন্মকে। ফরাসি দেশ এবং প্যারিসের পাড়াগুলোতে একসময় এমনই কিছু শিল্পীদের আগমন হয়েছিল। তাঁরা ভবিষ্যৎ-এর পথ দেখিয়ে গিয়েছেন বহু যুবক যুবতীকে, শিখিয়ে গিয়েছেন স্বপ্ন দেখার সাহস বজায় রাখতে। যাদের জীবন আর কাজ, দুইই উদ্বুদ্ধ করেছে নতুন যুগের শিল্পীদের।
ইউরোপের সভ্যতা চিরকালই অর্থ ও ধর্ম নির্ভর। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বহু মানুষের কর্ম সংস্থান হতে থাকে নতুন স্থাপিত মিলগুলোতে। সেখানে তাদের প্রচন্ড ভাবে খাটানো হত। কিন্তু উপায় কী? পেটে রুটি তো জোগাতে হবে। তাই কাজের সন্ধানে বহু মানুষ শহরে আসতে শুরু করল গ্রামগঞ্জ ছেড়ে। শয়ে শয়ে লোক অন্নসংস্থানের আশায় ছোট ছোট বস্তিতে দিন কাটাতে লাগল দারিদ্রে।
এমন সময় একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল শিল্পের জগতে। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলেই রোমান্টিক যুগের সূত্রপাত। জঁ জাক রুসো (Jean Jacques Rousseau) ১৭৬২ সালে 'এমিল' বলে একটা বই লিখে ফেললেন। এমিল বলে একটি শিশুর বড় হওয়ার কাহিনীর মাধ্যমে রুসো সামাজিক মনোভাবের পরিকাঠামোতে প্রচন্ড ভাবে আঘাত করলেন। রুসোর মতে মানুষ স্বাধীন প্রকৃতিতেই সৎ ও নিষ্ঠাবান হয়ে থাকতে পারে, সমাজের তৈরি কৃত্তিম বেড়াজাল তার স্বাভাবিক স্বভাবের মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
এই ঘটনার আট বছর পর আরেকটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায় লন্ডনের বুকে। ব্রূক স্ট্রিটে থমাস চার্টন বলে এক যুবক কবি আত্মহত্যা করে। প্রচন্ড দারিদ্রের মাঝে, সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে, সেই যুবক কবিতা লিখে গেছে বছরের পর বছর। কিন্তু সভ্য সমাজের ব্যক্তিত্বরা তাঁর লেখা বুঝতেই পারেননি। নিজের অজান্তেই চার্লস রোমান্টিকতাবাদের প্রথম শহীদ হয়ে ওঠে ইতিহাসে। সেই শুরু। এরপর একে একে গোয়া, টমাস কোল আর ওয়ার্ডসওয়ার্থরা এসে বেঁচে থাকার প্রচলিত ধারণাকেই ধুলিসাৎ করে দেন। ধীরে ধীরে শিল্পীদের মনে রোমান্টিকতাবাদের ধারণা প্রবল হতে থাকে। সমাজের যান্ত্রিক পরিকাঠামো আর বদ্ধ জীবনের উর্ধ্বে কবি, লেখক, শিল্পীদের মনের কল্পনা বিকশিত হতে থাকে প্রকৃতির মাঝে, অনিয়মের উচ্ছ্বাসে, নিজস্ব অভিজ্ঞতায়। বায়রন, কিথ, ভ্যান গঘ এমনকি জিম মরিসন সকলেই এই রোমান্টিকতাবাদের শহীদ হয়ে অমর হয়ে গিয়েছেন।
১৮৫০-এর দশকে প্যারিসে শার্ল বোদলেয়ার কবি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং একের পর এক ছকভাঙা কবিতা লিখে রোমান্টিকতাবাদের ধারণাকে চরিতার্থ করে তোলেন। তাঁর সাঙ্গীতিক ভাষা আর মৌলিক চিন্তাধারা নিয়ে পরবর্তীকালে বহু চর্চা হয়েছে। স্তেফান মার্লামে, পল ভার্লেইন, র্যাঁবো, জোলা, হেমিংওয়ে সহ বহু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী তাঁর কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বোদলেয়ার-এর সৃষ্ট 'ফ্ল্যানর' চরিত্রের মধ্যেই রোমান্টিক শিল্পীর আত্মাকে বুঝতে পারা যায়। একজন বেকার লোক... যে প্যারিসের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় মনের সুখে। তীক্ষ্ণ চোখে খেয়াল করে নাগরিক জীবনের আসা যাওয়া কিন্তু সামিল হয় না তাতে। একঘেয়ে জীবনের ফাঁদে পা না দিয়ে সে বেঁচে থাকে মুহুর্তের আনন্দে। হিমুর কথা মনে পড়ছে? বা নীললোহিত? সন্দেহ নেই, তাঁরা আমাদের 'ফ্ল্যানর'-ই বটে। একদিক থেকে দেখতে গেলে আদর্শ প্রেমিক, রোমান্টিক হিরোর চরিত্রে খাপেখাপ। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে ক্ষ্যাপা। বোকাচণ্ডী বেকার।
বোদলেয়ারের ব্যক্তিগত জীবনে উদ্দাম নেশা করেছেন। বোহেমিয়ান প্যারিসের শিল্পীপাড়ায় জীবনযাপনের মাঝেই একসময় লিখে ফেলেন একটি দীর্ঘ কাব্যগ্রন্থ। 'লি ফ্লাজ ম্যাল' অর্থাৎ শয়তানের ফুল। লেখক মহলে দারুণ ভাবে সমাদৃত হলেও সমকামী প্রেম ও প্যারিসের নাগরিক জীবনের অভ্যন্তরীণ জগৎ দেখানোর ফলে ফরাসি সরকার লেখাটিকে ‘ব্যান’ করে। নিষিদ্ধ সাহিত্যের স্রষ্টা হওয়া তাঁর কাছে নতুন কিছুই নয়। তাই বলে বোদলেয়ারের বন্ধু কিছু কম ছিল না। ভিক্টর হিউগো, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার থেকে এডওয়ার্ড মানে সকলেই প্রতিবাদ করেছিলেন এই অন্যায়ের। কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে কবি যখন মারা যান, নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা কবিতার নতুন ভাষা পেয়ে গেছে।
যে সময়ে বোদলেয়ার নতুন কবিতার সৃষ্টি নিয়ে মজে আছেন, ঠিক সেই সময়ে উত্তর ফ্রান্সের শার্লিভেলে কবিতার বীজ অংকুরিত হচ্ছিল এক বালকের মনে। বিস্ময় বালক বলাই হয়তো ঠিক, যাঁর হাত ধরে প্রতীকবাদ বা সিম্বলিজমের জন্ম। সেই সময়ে পল ভার্লেইন প্যারিসের নাম করা কবি, চাকরি জীবন থেকে ইস্তফা দিয়ে উদ্দাম নেশা করছেন আর কবিতা লিখছেন পাগলের মতো। এমন সময় তাঁর হাতে এসে পৌঁছাল সেই বালকের লেখা কবিতা, শার্লিভেল থেকে সে চিঠি লিখেছে তাঁকে। কবিতা পড়ে ভার্লেইন মুগ্ধ হয়ে ডেকে পাঠালেন ছেলেটিকে। ১৮৭১ সালে যখন প্রথম আর্তুর র্যাঁবোর সঙ্গে দেখা হয় ভার্লেইনের, তিনি জানতেন না তাঁদের দুজনের সম্পর্ক ধরেই উঠে আসবে কাব্যের এক নতুন ধারা।
র্যাঁবোর সঙ্গে ভার্লেইনের সমকামী সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথাই লেখা হয়েছে। ১৮৭০ সাল, দুজনেই ডুবে আছেন ‘অ্যাবসিন্থ’-এর আসক্তিতে, গাঁজা আর মদের সঙ্গেই চলছে কাব্যচর্চা। নেশার বিভ্রমে এমন সব কবিতা লিখতে শুরু করলেন, যাতে বাস্তববাদের কোনও দিশা পাওয়া যায় না। এই লেখাগুলো থেকেই প্রতীকবাদী কবিতার সূত্রপাত। তাঁদের সম্পর্ক মাত্র বছর তিনেক চলেছিল, কিন্তু ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরেও বিরহ এই দুজনকে তাড়া করে বেরিয়েছে। লন্ডনে একসঙ্গে গেছিলেন র্যাঁবো আর ভার্লেইন। সেখান থেকে ভার্লেইন ফিরে এলেন প্যারিসে, কিন্তু মন খারাপ করতে লাগল র্যাঁবোর জন্যে। চিঠি লিখে দেখা করতে বললেন ব্রুসেল্সে, কিন্তু সেখানে এমন তর্ক বিতর্ক হল যে ভের্লেইন বেরিয়ে এসে প্রচুর নেশা করে রিভলবার কিনে এনে কব্জিতে গুলি করলেন র্যাঁবোকে। র্যাঁবো চলে যান শার্লিভেলে, জেল খাটতে হয় ভের্লেইনকে। মনকে অন্যদিকে করতে 'নরকে এক ঋতু' আর 'ইলুমিনেশন' লিখে ফেলেন র্যাঁবো। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে লেখা এই কবিতাগুলো আধুনিক প্রতীকবাদের শ্রেষ্ঠ নমুনা হিসেবে রয়ে গেছে ইতিহাসে। এর পর সতেরো বছর আরো বেঁচেছিলেন র্যাঁবো, একটা কবিতাও লেখেননি। র্যাঁবোর সতেরো বছর বয়সে লেখা 'মাতাল তরণী' পরে উন্মাদের মতন পড়েছে পাঠকেরা, প্যারিসের দেওয়ালের মুরালে খোদাই করে রাখা হয়েছে এই কবিতা। কুড়ি বছর বয়সে কবিতার জগৎ থেকে নেওয়া তার স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েও পরবর্তীকালে লেখালিখি বড় কম হয়নি। বিখ্যাত কবি রেনে শাঁর লিখেছেন—
"তুমি ছেড়ে গিয়ে ভালোই করেছো, আর্তুর র্যাঁবো। বন্ধু ও শত্রুদের প্রতি সমানভাবে তোমার আঠারো বছরের অবহেলা, প্যারিসের কবিদের ন্যাকামির প্রতি, আর সেই বন্ধ্যা ঝিঁঝির একঘেয়ে সুর— তোমার গ্রাম্য ও পাগলাটে পরিবার— তুমি ভালো করেছো তাদের উদার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে, তাদের অহংকারী গিলোটিনের খাঁড়ার নিচে পেতে..."
এদিকে বোদলেয়ারের মৃত্যুর পর প্যারিসের বোহেমিয়ান পাড়াগুলো আরো চঞ্চল হয়ে উঠেছে সে সময়ে। ক্রমে শিল্পী, চিত্রকর, কবি, লেখকদের মধ্যে সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানদের বিপক্ষে রোষও আরো বেড়ে উঠেছে। ততদিনে ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরাও দলে ভারী হয়েছেন। 'আকাদেমি দে বোজার' বছরের পর বছর ধরে তাঁদের কোনও ছবিকেই যোগ্য বলে মনে করেননি, বাস্তববাদ ভুলে থাকা তুলিকে শিল্পের আখ্যা দিতে তাঁরা নারাজ। সম্রাটের কাছে আবেদন করে শেষে শিল্পীদের জায়গা হয়েছিল 'স্যালন দে রেফউসে' বা প্রত্যাখ্যাত শিল্পের প্রদর্শনীতে। কিন্তু তার পর প্রায় চার পাঁচ বছর কেটে গেছে। বিচ্ছিন্ন শিল্পীরা সমবেত হয়েছে। ক্লদে মোনে, এডগার দেগা, জাঁ রেনোয়া, পল সেজান, কামিল পিসারো, আলফ্রেদ সিসলি সকলে মিলে বার বার অনুরোধ করেছেন নতুন করে তাঁদের জন্যে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করতে, যদি কেউ কোনও ছবি কেনে! না কিনলেও ছবি আমজনতাকে দেখানোর সুযোগ তো হবে। শিল্পীদের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে চলেছে। ভিক্ষে করে আর আফিম থেকে তৈরি করা 'লাউডাভাম'-এর নেশা করে দিন কাটছে অনেকেরই। আফিমের নেশা করলে ক্ষিদে পায় না, বরং ভুলে থাকা যায় যুক্তিবাদী আর হৃদয়হীন সমাজের কথা। ভেসে থাকা যায় আনন্দে। নেশা কাটলে ক্ষিদের চোটে সারা দেহে জ্বালা করে, কিন্তু পকেটে পয়সা নেই।
এমন সময় পল দুযাঁ হুয়েল বলে একজন আর্ট ডিলারের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। তাঁর সাহায্য নিয়ে চিত্রশিল্পী আর ভাস্কর্যদের নতুন সংগঠন গড়ে প্রদর্শনী করতে শুরু করে ইম্প্রেশনিস্টরা। বার চারেক প্রদর্শনী করার পর জঁ পেতিতের নজর পড়ে তাঁদের ওপর। পেতিত প্যারিসের বিখ্যাত আর্ট ডিলার, সরকারি স্যালনের সব ছবিই তিনি বিক্রি করেন। একটু একটু করে বাড়তে থাকা ইম্প্রেশনিস্ট ছবির গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে ভবিষ্যতের আভাস দিয়ে দেয়। একটা দুটো করে তিনি ছবি কিনতে শুরু করেন হুয়েলের কাছ থেকে। এদিকে প্রদর্শনীতে বেশি ফরাসি খদ্দের না পেয়ে হুয়েল শেষে ক্যামিল পিসারো আর মোনের কয়েকটা ছবি বিক্রি করে দেন আমেরিকানদের। হুয়েল পরে বলেছিলেন, “ফরাসিরা হাসতে জানে। আমেরিকানরা কিনতে জানে। তাঁরা কিনেছিল বলেই কয়েকজন প্রাণে বেঁচে গেছে।”
ইম্প্রেশনিস্টদের দল অবশ্য সমবেত ভাবে খুব বেশিদিন চলেনি। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে (সম্ভবত না খেতে পেয়ে) সিসলি মারা যান ১৮৯৯ সালে। ১৮৮০ সালে প্রভেন্সে চলে যান সেজান, ১৯০৬ সালে তিনি সেখানেই মারা যান জ্বরে ভুগে। যখন ইম্প্রেশনিস্ট ছবির চাহিদা সত্যিই বাড়তে থাকে, তখন আসল দলের প্রায় কেউই সেরকম ছবি আঁকছেন না। শিল্পীরা ঝুঁকেছেন পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ম আর সুরিয়ালিজমের দিকে। পেতিত ইম্প্রেশনিস্ট ছবির সবচেয়ে বড় ডিলার হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর সঙ্গে হুয়েলের প্রতিদ্বন্দিতা চলতে থাকে সারা জীবন।
ফরাসি ইতিহাসের বোহেমিয়ান কবি আর শিল্পীদের দর্শন তখনকার লোকে বুঝতেই পারেনি। কালকের খাওয়ার টাকা নেই, অথচ আজকে পানাহারে বসে এমন উৎসাহে সাহিত্যচর্চা চলছে যেন জীবনে আর কোনও সমস্যাই নেই! এই দর্শনই হল রোমান্টিকতাবাদের মূল। মানুষ হিসেবে আমরা আনন্দের সন্ধান করি। অর্থ উপার্জন, স্বচ্ছল জীবনের গতানুগতিক সকাল আর বিকেল আমাদের জন্যে নয়। আমরা মুক্ত প্রকৃতিকে বাঁচব, তুমুল শিল্পচর্চা করব, আর ফুরিয়ে গেলে মারা পড়ব হাসিমুখে। খেয়াল করলে দেখা যায় বহু যুগান্তকারী শিল্পীরা চল্লিশে পৌঁছানোর আগেই মারা গিয়েছেন।
এই নিয়ে লেখালিখি কম হয়নি। তাহলে এই কথাগুলো কেন বলা দরকার? কারণ আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভালো মন্দের অনুভূতির মধ্যে রোমান্টিকতাবাদ আর বোহেমিয়ান সংস্কৃতি বাসা বেঁধেছে ওই সময়ের পর থেকেই। আমরা নিজেরা চাকরি করি আর না করি, স্বাধীন চিন্তাধারা আর ট্রাজিক হিরোদের জন্যে সমবেদনা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। প্যারিসের সঙ্গে শিল্পমনস্ক ব্যক্তিদের একাত্ম হওয়ার প্রধান কারণ হল এই সংস্কৃতিকে ভালোবাসা। সেই শিল্পীদের কথা মনে করে রোমাঞ্চিত হওয়া যারা নিজের শর্তে বেঁচেছেন, লিখেছেন, এঁকেছেন, ভেবেছেন, তারপর কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন। এই সময় থেকেই আধুনিক মানসিকতার উত্থান, যেখানে দেশ, ধর্ম, জাতি, অর্থের উর্ধ্বে আমরা সবাই মানুষ।
আপাতত আমরা হাঁটছি পের লাসেজের কবরখানার রাস্তা দিয়ে। দু’দিকে অজস্র গাছ, আর সারি সারি কবর। মেট্রো করে ফিলিপ অগাস্তে স্টেশনে নেমে এখানে পৌঁছাতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি। বহু লেখক, শিল্পী, কবিদের সমাধি আছে এই কবরখানায়। গিয়ম অপোলিনেয়ার, পল এলুয়ার, জর্জ ম্যালেস, অস্কার ওয়াইল্ড, জিম মরিসন প্রভৃতি শিল্পীদের সমাধিফলক দেখতে কিছু মানুষ আসে। চেস্টনাট গাছের পাতা পড়ে আছে মাটির ওপর, বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে রোদ্দুর থাকা সত্ত্বেও। সমাধিফলকগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছি। দার্শনিক এবারেল্ড আর তার প্রেমিকা সন্যাসিনী হেলুইসের যৌথ সমাধিও আছে এখানেই, যাদের নিয়ে একাধিক সিনেমা আর গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে।
পের লাসেজের কবরখানা থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম সেন্ট মিকেল গির্জার দিকে। মেট্রোতে মিনিট কুড়ির মতন লাগে। নদীর ধারেই এই গির্জা। এখান থেকে একদিকে রোমান কোয়ার্টার, অন্যদিকে গেলে নত্রেদাম গির্জা। প্যারিস শহরটা আহঁদিস্ম(arrondissement) অর্থাৎ পৌরসভার ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ করা আছে। প্রশস্ত রাজপথগুলো ইংরেজিতে বলতে হলে বলতে হয় বুলেভার(boulevard), কারণ ফরাসিতে বলতে গেলে জিভ ভেঙে যেতে পারে। এমনিতেও নাকি ফ্রেঞ্চ শিখতে গেলে বহু নাকানি চোবানি খেতে হয়। ফরাসিরা ‘র’-এর উচ্চারণ করে না আর কোনও শব্দের শেষের ব্যঞ্জনবর্ণও উচ্চারিত হয় না। মেট্রোতে স্টেশনের নাম ঘোষণা করা হয়, তা শুনে শুনে এইটুকু মাথায় ঢুকেছে যে 'in' হলে 'আঁ’। সেইজন্যেই Rodin হল রদ্যাঁ, Saint হল 'সাঁ'। এর চেয়ে বেশি শেখার ধৈর্য আমার নেই। আমার সঙ্গিনীর অবশ্য আছে। নতুন ভাষা দেখলেই রপ্ত করে নেওয়ার একটা বাজে অভ্যেস আছে দিদিমণির, ক্রমাগত তাঁর মুখে তুবড়ির মত নতুন ভাষার ব্যাকরণ জ্ঞান ফুটছে, রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই।
সেন্ট মিকেল গির্জার সামনে বহু লোকে জড় হয়েছে। প্যারিসে সারা বছরই টুরিস্টের আনাগোনা লেগে থাকে, ওয়াকিং ট্যুরেও তার প্রমাণ পেলাম। পথের দু’ধারে কফি শপ আর সুসজ্জিত দোকানপাট, 'প্লেন' গাছের সারি থেকে ঝরে পড়ছে পাতা। কোনও বাড়িই নতুন নয়, ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করে আছে পরস্পরের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক বাড়ির নিচের 'কাভ' বলে পাথরের একটা গুপ্ত ঘর থাকত। পানীয় রাখার পাশাপাশি বোমা পড়লে সেখানে লুকিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেইদিক থেকে প্যারিসিয়ানরা অবশ্যই সৌভাগ্যশালী, হিটলারের আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও জেনারেল দিত্রিচ বলে নাজি সৈন্যের একজন পদস্থ অফিসার সেই নির্দেশ পালন করেননি। মেক্সিকোবাসী আলবের্তোর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে আরো কয়েকটা মজার মজার গল্প শুনলাম।
Random Shot |
সেইন নদীর ওপরের বর্তমানে সাঁইতিরিশটি সেতু আছে, যার মধ্যে প্রধান কয়েকটা হল পন্ত দেস আর্টস, পন্ত দে লেনা আর পন্ত দে নিউফ। মধ্যযুগের আগে অনেক সেতুই কাঠের ছিল, পাথরের সেতুগুলো নতুন করে তৈরি করা হয়েছে পরে। এর মধ্যে নতুন সেতু বা পন্ত নিউফ আসলে সবচেয়ে পুরোনো নির্মাণ। নদীর দু’দিক থেকে সেতুটি এসে মাঝের ছোট্ট দ্বীপে মিশেছে। এই ছোট্ট দ্বীপেই আছে নত্রেদাম গির্জা। উনবিংশ শতাব্দিতে এই সেতুর ওপর দাঁতের হাতুড়ে ডাক্তাররা বসে থাকত যন্ত্রপাতি নিয়ে। সেইকালে অ্যানেস্থিসিয়ার বালাই ছিল না, দাঁত বের করতে হলে ছেনি হাতুড়ির দরকার পড়ত। তাই ব্যথা যাতে কম হয় তাই রুগীরা সেতুর ওপর ডাক্তারদের কাছে বসে বসে আকণ্ঠ মদ গিলত বোতলের পর বোতল। যতক্ষণ না প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় চলে যায় রুগী, ততক্ষণ ডাক্তার তাঁকে বাধ্য করতে খেয়ে যেতে। তারপর নেশায় প্রায় বেহুঁশ হয় হয়, এমন সময়ে রুগীকে শক্ত করে চেপে ধরে আঁকশি দিয়ে মুখ হাঁ করিয়ে ছেনি লাগিয়ে বেশ কয়েক ঘা হাতুড়ি মেরে দাঁতগুলো বের করা হত। রুগীর চিকিৎসার এহেন নমুনা শুনে আমারই দাঁতে ব্যথা শুরু হয়ে গেল।
নেপোলিয়ানের সময় আর্টস সেতুর নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের পর থেকে এই সেতু জনপ্রিয় হয়ে ওঠে 'লাভ লক ব্রিজ' নামে। প্রেমিক-প্রেমিকারা এসে সেতুতে তালা লাগিয়ে চাবিটা ছুঁড়ে ফেলত নদীতে। শেষে এত তালা হয়ে গেল যে ওজন সইতে না পেরে ব্রিজ প্রায় ভেঙ্গে পড়ে! সাবধানতা অবলম্বন করে তারপর থেকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে লাগানো তালাগুলোও খুলে নেওয়া হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা লুভ্য়র মিউজিয়ামের গায়ে লেগে থালা টুইলেরিস গার্ডেনে এসে গেছি। অনেকেই দু এক দিনের মধ্যে লুভ্য়র যাবার জন্যে মনে মনে তৈরি হয়ে আছে। প্যারিসে প্রথম এসে লুভ্য়র যাবে না এরকম মানুষ সংখ্যাতে খুব বেশি নেই। তার প্রধান কারণ অবশ্য লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা 'মোনালিসা’। গত একশ বছরে এই মহামূল্যবান ছবি নিয়ে উত্তেজনা এমনই বেড়েছে যে বলার নয়। এইখানে আলবের্তো আমাদের একটা কাজের পরামর্শ দিল যেটা আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম এবং তাতে চমৎকার কাজ হয়েছিল।
আলবের্তোর কথা শুনে জানা গেল যে ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়ামে থেকে মোনালিসা চুরি হয়ে যায়। সেইসময়ে মোনালিসার কথা কিঞ্চিৎ হাতেগোনা মানুষই জানত। ভিনসেনজো পেরুজিয়া, ল্যান্সেলত্তি ও মিকেলে নামের তিন জন মিলে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। সেই সময়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আজকের মতো ছিলো না। চুরি যাওয়ার দুই বছর পর্যন্ত মোনালিসার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৯১৩ সালে পেরুজিয়া ছবিটি নিয়ে প্যারিস থেকে ফ্লোরেন্সে আসে। এরপর উফিজি গ্যালারির আর্ট ডিলারের কাছে ছবিটি বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। মোনালিসাকে প্যারিসে ফেরত পাঠানো হয়। ওই চুরির পর থেকেই বিখ্যাত হয়ে যায় মোনালিসা।
আলবের্তো মিচকে বলল, “তোমাদের একটা ভালো ট্রিক বলছি। যদি লুভ্যরেতে যাও, মোনালিসার সামনে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে না থেকে একপাশে সরে যেও। ছবির দিকে নজর না দিয়ে যারা ছবিটা দেখতে এসেছে, তাদের দেখো। সত্যিকারের একটা অভিজ্ঞতা হবে তোমাদের।”
সেই পরামর্শ কাজে লাগিয়েছিলাম সত্যি সত্যিই। সে এক কাণ্ড বটে! বেশিরভাগ লোক কোনও দিকে না চেয়ে সোজা মোনালিসার ছবি খুঁজে চলেছে মিউজিয়ামে। হলওয়ে পেরিয়ে, এই করিডোর, সেই হল পেরিয়ে গরুখোঁজা চলছে। আর কোনও ছবির দিকে নজর নেই। তারপর হয় সেলফি স্টিক নিয়ে মোনালিসার সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলতে দৌড়াদৌড়ি করছে, অথবা একবার ডানদিকে একবার বাঁদিকে গিয়ে দেখছে মোনালিসার চোখের দৃষ্টি তাদের দিকে ঘোরে কি না? দেখে হাসি চাপা মুশকিল। পৃথিবীতে বহু ছবির চোখেই এই ব্যাপার আছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে? এই নিয়ে প্রচুর খিল্লি করেছি। এতগুলো লোকের এরকম বোকা বোকা কাণ্ড দেখলে হাসি পাওয়াই স্বাভাবিক।
লুভ্যরে মিউজিয়াম ছাড়াও বহু মিউজিয়াম তৈরি হয়েছে আজকাল। ক্লাসিকাল পেইন্টিংয়ে উৎসাহ না থাকলে বরং সেখানে না গেলেও চলে। এত বড় মিউজিয়াম একদিনে দেখা সম্ভবই নয়। আমার ধারণা ছিল ইম্প্রেশনিস্ট আর মডার্ন আর্টের খানিকটা উর্সে আর খানিকটা লুভ্যরে মিউজিয়ামে আছে। কিন্তু ক্লাসিকাল যুগের ধার্মিক ছবি আর ভাস্কর্য ছাড়া বাকি সব ছবিই চলে গেছে অন্যান্য জায়গায়। প্রায় পাঁচ ঘন্টা হাঁটাহাটি করেও তেমন লাভ হয়নি। ক্লাসিকাল পেইন্টিং-এর সম্পর্কে বেশি জানা নেই, বাইবেলের নানা গল্প বলা থাকে তাতে। অনেক অসামান্য ছবি আর আছে ঠিকই কিন্তু একসময় উত্তেজনা থিতিয়ে আসে। ধার্মিক ছবি আমার মনে ঠিক দাগ কাটে না।
আলবের্তোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খানিকক্ষণ টুইলেরিস বাগানের ঘাসের ওপর নিরিবিলিতে বসে থাকা হল। দূরে আইফেল টাওয়ার দেখা যাচ্ছে, মাথার ওপর নীল আকাশ। ঘাসের ওপর বসে অনেকেই চিজ সহকারে ওয়াইন অথবা বিয়ার খাচ্ছে, অনেকে ঘুম দিয়েছে। সুখ আর কাকে বলে? ফরাসিরা তাড়াহুড়ো মোটেই পছন্দ করে না, এক কাপ কফি আর এক বোতল ওয়াইন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারে বুলেভারের ধারে পেতে রাখা ক্যাফের চেয়ারগুলোতে বসে। আগস্ট মাস থেকে প্রায় অক্টোবর মাস পর্যন্ত অনেক স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে, প্যারিসিয়ানরা আমুদে বিকেল কাটিয়ে দেয় কাফেতে বসে বসে। স্থানীয় লোকেরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আড্ডা চালিয়ে যেতে পারে অথবা কফির কাপ হাতে দেখে যেতে পারে নাগরিক জীবন। প্যারিসিয়ানদের প্রত্যেকের চরিত্রে একটা করে ‘ফ্ল্যানর’ আছে। ‘পিপল ওয়াচিং’-এর মত সর্বজনস্বীকৃত সংস্কৃতি প্যারিসের মতো অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। কথায় বলে, “In Paris its all about seeing and being seen.”
বার্সি যাওয়ার উদ্দেশ্যে পিরামিদেস স্টেশন থেকে মেট্রো ধরলাম। মাত্র দু’দিন হল প্যারিস এসেছি, এর মধ্যেই নানা দেশের মানুষ চোখে পড়েছে। এশিয়ান, আরব, ভারতীয়রা তো আছেই, বিপুল সংখ্যক আফ্রিকানও দেখতে পেয়েছি। আধুনিক যুগে প্যারিস শুধুমাত্র শিল্পীদের আখড়া নয়, বিশ্বায়নের বাজারে অর্থনীতির একটা রঁদেভু পয়েন্ট। আগের শতাব্দীতেই ফ্যাশন ক্যাপিটালের আখ্যা পেয়েছিল প্যারিস, একবিংশ শতাব্দীতে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এসে জুটেছে আইটি সফটওয়্যার, টুরিজ্ম, রিয়্যাল এস্টেট, এন্টারটেইনমেন্ট, ই-কমার্স ইত্যাদি। প্রচুর মানুষের জীবিকা চলছে। শিল্পীদের শহর মুছে যায়নি, কিন্তু মহানগরীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যুগের হাত ধরে।
চলেছি সিনেমাথেক ফ্রাঁসেজে। ১৯৩৬ সালে তৈরি এই জায়গা চলচ্চিত্র ইতিহাসের বারো আনা সংরক্ষণ করে রেখেছে। দেশ বিদেশের সিনেমার চিত্রনাট্য, লেখার খসড়া, ব্লক ডিজাইন, সঙ্গীতের দুর্লভ সংগ্রহ যেমন আছে তেমনই আছে চলচ্চিত্র প্রেমীদের সারা দুনিয়ার ভালো ভালো সিনেমা দেখার সুযোগ। প্রতিদিন নানা দেশের নানা ভাষার সিনেমা দেখানো হয় এখানে।
Cinematheque Francaise |
আমরা দুজনেই সিনেমাপাগল, কিন্তু পাগলামির মাত্রাটা আমারই বেশি। প্যারিসে এসে এরকম জায়গার পায়ের ধুলো মাথায় না থাকলেই চলছে না। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে পথের পাঁচালির প্রথম খসড়ার খাতাটা সত্যজিৎ রায় দান করেছিলেন সিনেমাথেক ফ্রাঁসেজে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটা খোয়া যায়। লক্ষ লক্ষ খসড়ার মধ্যে বেছে বেছে সেটাই খোয়া গেল কী করে সেই ভূতুড়ে রহস্যের সমাধান হয়নি। অনেকের মতে সেই খসড়া ‘সিনেমা মেমোরিবিলিয়া’-র কালো বাজারে চড়া দামে বিকিয়ে গেছে।
ফ্রান্সে কবিতা, চিত্রকলা আর সাহিত্যের নানা ধারা নিয়ে যেমন একের পর এক আন্দোলন হয়েছে, সিনেমাও সেই বিপ্লব থেকে বঞ্চিত হয়নি। পঞ্চাশের দশকে নিউ ফ্রেঞ্চ ওয়েভ মুভমেন্ট সিনেমার আঙ্গিককে পুরোপুরি বদলে দেয়।
চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল কাইয়্যে দু সিনেমাতে আন্দ্রে বাঁজা, জ্যাক ডনিয়ল-ভ্যালক্রজে, জোসেফ মারিও দ্য লুকার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, জ্য লুক গঁদার, এরিক রোমার, জ্যাক রিভেতেরা লেখিলিখি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অভিনবতার অভাবে সিনেমার মান ক্রমেই পড়ে যাচ্ছে বলে সমালোচনা করতে থাকেন তাঁরা। না গল্পে নতুনত্ব আছে, না ন্যারেটিভে। টেকনিকাল দিকগুলো আরো খারাপ। বাঁজা আর ত্রুফোদের কলমে ফরাসি সিনেমার সমালোচনা আর আমেরিকান পরিচালক অরসন ওয়েলস আর জন ফোর্ড প্রভৃতির প্রশংসা সমসাময়িক ফরাসি পরিচালকদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। রেগেমেগে তাঁরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন, “অত সমালোচনা না করে নিজে ভালো ছবি করে দেখাক দেখি!"
ব্যস! ত্রুফো, গঁদার এবং অন্যান্যরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নেমে পড়লেন মাঠে। আক্ষরিক অর্থেই খেলার প্রথম বলেই ছয় হাঁকড়েছিলেন ত্রুফো। তাঁর প্রথম ছবি ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ' উচ্ছ্বসিত প্রসংসা পায় সারা পৃথিবীতে। এরপর গঁদারের 'ব্রেথলেস' এসে চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাষাই বদলে ফেলে। ট্রলির ব্যবহার কমিয়ে হ্যান্ড শট নেওয়া শুরু করেন তিনি, একই সঙ্গে খরচ কমাতে 'জাম্প কাট' ব্যবহার করেন প্রচুর পরিমাণে। শুধু ভালো স্ক্রিপ্ট আর অভিনয়ের ওপর জোর দিয়ে নামমাত্র খরচে একের পর এক যুগান্তকারী সিনেমা তৈরি হতে থাকে। এই আন্দোলন আধুনিক চলচ্চিত্রের জনক তো বটেই, ইন্ডি ফিল্মের পৃষ্ঠপোষকও বটে। ফর্ম ও থিমের বিপ্লব ঘটিয়ে শিল্প রূপে আধুনিক সিনেমার পদার্পণ সেই থেকেই। একই সঙ্গে নিউ ওয়েভ মুভমেন্টের পরিচালকেরা দেখিয়ে দেন যে ক্যামেরা কীভাবে কলম অথবা তুলি হয়ে উঠতে পারে।
সিনেমাথেক ফ্রাঁসেজে সিনেমা দেখার সুযোগ অবশ্য হয়নি। টিকিটের দাম বেশ চড়া। কিন্তু সিনেমা নিয়ে যে বিশাল কর্মকাণ্ড হচ্ছে সেটার একটা আন্দাজ পাওয়া যায় সহজেই। আসন্ন সূর্যাস্তের আলোয় ফিরে চললাম। ফিরতি পথে অপেক্ষা করা সেইন নদীর সেতুরা ডাক দেয়, ঠিক গিয়ম অপোলিনায়েরের কবিতার মতোই...
মিরাবো সেতুর তলা দিয়ে সেন বয়ে চলে অনিবার
আর আমাদের যত প্রেম
স্মৃতি হবে কি জাগাতে তার
সুখ দেখা দিত দুঃখের জ্বালা জুড়োলে বারংবার
রাত্রি নামুক প্রহর গড়াক দিন
যায় চলে যায় আমি রই গতিহীন...
এই শহরেই জীবন কবিতা হয়ে উঠতে পারে...যে কোনও মুহুর্তে…
প্যারিস-তৃতীয় পর্ব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন