আমি ভেনিসে দাঁড়িয়েছিলাম দেখে দীর্ঘশ্বাসের সেতু
হাতে হাত দিয়ে থাকা প্রাসাদ ও কারাগার অহেতুক
~লর্ড বায়রন
১) অভয় দিলে বলে রাখি, পৃথিবীর প্রতিটা দেশে ভেনিসের নামে যে ছোট্ট ভেনিস, লম্বা ভেনিস, উত্তরের ভেনিস, দক্ষিণের ভেনিস, ল্যাংচা ভেনিস, ফুলকপি ভেনিস ইত্যাদি ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গে আসল ভেনিসের কোনও তুলনাই হয় না। আড্রিয়াটিক সাগরে অবস্থিত এই জলনগরী এক এবং অনন্য, এবং 'ইহাদের কোনও শাখা নাই'।
ফ্লোরেন্স থেকে ভেনিসের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। এই কয়েক মাসে ফ্লিক্সবাসের সঙ্গে আমাদের মামা-কাকার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। চোখ বুজে বাসে উঠে পড়তে পারি। সেইজন্যে ভেনিসে যে যাওয়া হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু হায় কপাল! ভেনিসে থাকার জায়গা খুঁজতে গিয়েই মাথায় বজ্রাঘাত হল।
থাকা-খাওয়া-যাওয়া-আসা-স্রোতে ভাসা-র যাবতীয় দায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপিয়েছেন মাননীয়া ডানকুনি দেবী, ঠিকঠাক ভাবে প্রজেক্ট না উতরোলে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। তাই চোখের সামনে কালপুরুষ মণ্ডল নাচতে দেখেও হার মানলাম না, বরং গা ঝাড়া দিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ডেরা খুঁজে চললাম। কুছ না কুছ তো মিলেগা বস!
ভেনিস আসলে মেনল্যান্ড থেকে দূরে সমুদ্রের বুকে শতাধিক ক্ষুদে ক্ষুদে দ্বীপের সমষ্টি, সেইখানে হোটেল বা গেস্ট হাউসের দাম দিতে আমাদের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে। (বিদেশভ্রমণ শুনে যদি পাঠকের মনে হয়, এ দুজনের আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল, তাঁদের উদ্দেশে তাচ্ছিল্যের বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া আমার কিছুই বলার নেই) কয়েকটা মোটামুটি দামের জায়গা যা ছিল, সমারের বহু আগে থেকে বুক করে নিয়েছে চালাক এজেন্টরা। রাজা-উজির না হলে যে খাস ভেনিসে থাকা অসম্ভব, সেটা আত্মস্থ করে নিতে দেরি হল না। অবশেষে বুকে পাথর রেখে মেনল্যান্ডেই জায়গা খুঁজতে শুরু করলাম। খুঁজেপেতে 'ক্যাম্পিং জলি' বলে একটা জায়গা পাওয়া গেল। নামে ক্যাম্পিং স্টে হলেও আসলে সে এক খোলামেলা রিসর্টের শামিল। ছোট ছোট পোর্টেবল কাঠের বাড়ির মতো কটেজ ছড়ানো আছে প্রকাণ্ড ক্যাম্পাসে, সুইমিং পুল, রেস্তোরাঁ সবই আছে। আমাদের মত যাদের পকেট গড়ের মাঠ, তাদের জন্যেই এই জায়গাটা নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে হল। সারা বছরই ব্যাকপ্যাকারদের আনাগোনা লেগে থাকে। লস লিডার প্রজেক্ট! মানে দাম কম রাখলেও সংখ্যায় এত বেশি মানুষ আসবে যে ইনভেস্টমেন্ট পুষিয়ে উপরি লাভ কম থাকবে না! দিনে বেশ কয়েকবার রিসর্টের বাসে করে ভেনিসে পৌঁছে দেওয়া ও নিয়ে আসার ব্যবস্থা আছে। ব্যস! মুশকিল আসান! আর কী চাই? চটপট অনলাইন বুকিং করে থাকার ব্যবস্থা পাকা করে নিলাম।
নির্ধারিত দিনে ফ্লোরেন্স থেকে বাসে চড়ে বসেছি সকাল সকাল। বাস চলতে শুরু করলে মনে করার চেষ্টা করলাম কোথায় ভেনিসের কথা প্রথম শুনেছি? কিছুই মনে পড়ছে না। হিন্দি সিনেমার গান এবং ইংরেজি সিনেমার অনেক দৃশ্য দেখেছি ঠিকই কিন্তু সে অনেক পরের কথা। হঠাৎ টুক করে কথাটা মাথায় চলে এল। ঠিক তো! প্রথম ভেনিসের নাম শুনেছি বাংলা অনুবাদে পড়া শেক্সপিয়ারের 'মার্চেন্ট অফ ভেনিস'-এ। আন্তোনিও ও শাইলকের সেই গল্পে যে ব্যবসায়ীদের কথা লেখা হয়েছিল, তারাই যে এক হাজার বছর আগে ভেনিসকে বিত্তবান করে তুলেছিল সে কথা আজ সকলেই জানে। উত্তর পূর্ব ইতালিতে লোম্বার্ডদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতে অনেকেই পালিয়ে গিয়ে এই দ্বীপগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। ধীরে ধীরে ক্ষুদে দ্বীপগুলোর মাঝে সেতু আর ঘরবাড়ি তৈরি হতে থাকে।
কিন্তু ভেনিসের আসল উত্তরণ শুরু হয় অটোমান সাম্রাজ্যের সময়। তাদের সঙ্গে চুক্তি করে ভেনিসের ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের আমদানি এবং রূপ্তানি শুরু করে দেয়। অটোমান সাম্রাজ্য সেই সময়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, কনস্ট্যান্টিপোলকে দখল করে তারা তখন ইউরোপের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। তাদের সঙ্গে ব্যবসা চালানোর ফলে ভেনিসের ব্যবসায়ীরা ফুলেফেঁপে উঠল। ক্রমশঃ ঘর-বাড়ি-গির্জা-চত্বর নির্মিত হল, নৌবহর জোরদার করা হল। অটোমান সাম্রাজ্য একসময় ভেনিসের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি ভেঙ্গে দেয়, কিন্তু ভেনিসিয়ানরা এত তুখোড় ছিল যে ততদিনে অন্য রাজ্যের সঙ্গে চুক্তিপত্র ব্যবহার করে এবং ডাচদের সন্ধান করা জলপথ ব্যবহার করে দূরদেশ থেকে মশলা আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসতে শুরু করেছে। ক্রমে ভেনিস এতটাই সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠল যে সারা ইউরোপ থেকে ব্যবসায়ী এবং শিল্পীরা এখানে আসতে শুরু করল ভাগ্যে ফেরানোর জন্য। কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই দেখা গেল ভেনেটো অঞ্চল এবং ভেনিস ইতালির অন্যতম অর্থনৈতিক এবং বিলাসকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
ভেনিসে পৌঁছানোর ঠিক আগেই সমুদ্রের ওপরে একটা দীর্ঘ ব্রিজ পার করতে হয়। ব্রিজের এই পাড়েই ভেনিসের বাসস্টপ, সুতরাং ব্রিজ পার করতে আমাদের মেকানিকল লিফটের সাহায্য নিতে হল। জলের ওপর দিয়ে কেবল কার কয়েক মুহুর্তেই আমাদের অন্য পাড়ে পৌঁছে দিল যেখানে ক্যাম্পিং জলির বাস আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে ছিল। বাস ধরতে গিয়ে দেখি ড্রাইভারের মাথার স্ক্রু বিলকুল ঢিলে, একবর্ণ ইংরেজি জানে না, তড়বড় করে ইতালিয়ান বলে চলেছে। আসলে প্রতিদিন বহু ছেলেমেয়ে এখানে থেকে ক্যাম্পিং জলিতে যায়, আগে থেকে জায়গা না রাখলে বাসে চড়তে দেওয়ার নিয়ম নেই। আমাদের কোনও কথাই পাগল ড্রাইভারটা শুনতে চায় না, বাসে যে আমাদের জন্যে জায়গা নেওয়া আছে সেটা বোঝাতে আমাদের হিমশিম খেয়ে যেতে হল। ইতালিয়ানের পো সত্যি উন্মাদ। শেষে হাত পা নেড়ে বহু কষ্টে তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বাসে চড়ে বসলাম।
অন্যরকম। আমাদের বৃষ্টি-শহর। আমাদের অন্য ভেনিস।
Camping Jolly Cottages |
ক্যাম্পিং জলিতে পৌঁছাতে মিনিট পনেরো লাগে। যেমনটা আন্দাজ করেছিলাম, সেরকমই প্রকাণ্ড ক্যাম্পাস। অর্ধেক লোকেই সুইমিং পুলে আর পুল এরিয়ার রোদ পোয়ানোর জায়গায় বসে আছে, কয়েকজন রেস্তোরাঁয় বসে গল্প করছে। আমাদের জন্যে বরাদ্দ রাখা কটেজ পেতে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। অবশেষে চাবি পেয়ে নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে দেখি চমৎকার ব্যবস্থা। সামনাসামনি সারি সারি সাদা রঙের প্রত্যেকটা কটেজের সঙ্গেই লাগোয়া বাথরুম আছে। স্নান সেরে খাওয়াদাওয়া করে নিয়ে বিকেল চারটের বাস ধরে ভেনিস শহরের দিকে চললুম।
বাস থেকে যেখানে আমাদের নামানো হল, সেখান থেকে ভেনিসের অন্য প্রান্তে অবস্থিত ব্যাসিলিকা দে সান্তা মারিয়া এবং পিয়াজা সান মার্কো। এখান থেকে প্রায় ঘন্টাখানেকের হাঁটা পথ। ভেনিস শহরের অসংখ্য সংকীর্ণ খাল ছাড়াও শহরের মাঝ থেকে 'এস' অক্ষরের মত করে গ্র্যান্ড ক্যানাল চলে গেছে। সেখানে সারাদিনই ফেরি চলছে, ফেরি করেও দ্বীপের অন্য প্রান্তে যাওয়া যায়। কিন্তু শহরের আসল চরিত্র দেখতে হলে হাঁটার কোনও বিকল্প নেই। সাধেই কি ফেলুদা হেঁটে হেঁটে শহর চষে ফেলে?
দস্তুরমত আমরাও হাঁটা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোটবেলা থেকে দেখা ঘোলাটে সবুজ জলের খাল আর সেতুগুলো একের পর এক উন্মোচিত হতে লগোল চোখের সামনে। খানিকটা করে হেঁটে যেতে না যেতেই একটা করে জলপ্রণালী। ঘুমিয়ে থাকা খালের জলের কিনারাতেই ভেনেশিয়ান ঘেটোর রঙিন বাড়িঘর। এই অসংখ্য সেতু নির্মাণ করে, একশ সতেরোটি দ্বীপকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে শহর নির্মাণ করা ছেলেখেলা নয়। এই বাড়িগুলোর ভিতও সবই জলের নিচে, একেবারে তলায় বালি আর কাদার ওপর স্লোভেনিয়া আর ক্রোয়েশিয়া থেকে আনা কাঠ পুঁতে সেই ভিত তৈরি করা হয়েছিল। এত শতাব্দী ধরে খনিজযুক্ত জলে ডুবে থাকার ফলে ক্রমে এই কাঠ শক্ত পাথরের মতন হয়ে গেছে। কাঠের ওপরে বাঁশের তক্তিগুলোও বছর দুয়েক পরপরই বদলাতে হয় জলের তলায় নেমে। বালকান অঞ্চলের কাঠের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বলে ভেনিসকে অনেকেই 'বালকান কান্ট্রি' বলে হাসাহাসি করে।
নির্জন গলি আর প্লাজা ছাড়িয়ে হেঁটে চলি। আজকাল ভেনিসে মাত্র বাহান্ন হাজার মানুষ বসবাস করলেও সারা বছর ধরে আসতে থাকা টুরিস্টদের সংখ্যা কয়েক কোটিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই হোটেল আর গেস্টহাউসের দামও আকাশচড়া। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখানকার অনেকেই তাঁদের সাদামথা অতিথিশালা খুলে বসেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এত টুরিস্টদের ঢল এলেও ভেনিসের অধিকাংশ অঞ্চলই নিস্তুব্ধ হয়ে থাকে। কুন্ডু স্পেশাল থুড়ি কন্ডাক্টেড ট্যুরে করে যারা আসেন, তাঁরা কস্মিনকালেও এসব অঞ্চলে আসেন না। গ্র্যান্ড ক্যানালে নৌকাভ্রমণ, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় ওয়াইন বা শ্যাম্পেন সহযোগে ডিনার, খুচখাকচ শপিং। ব্যস! মিটে গেল। অধিকাংশ শহর শুনশান পড়ে থাকে। গলিগুলো নির্জন, অচেনা সেতুগুলোর ওপরে গিয়ে ছায়ায় বসে বসে জলের শব্দ শোনা যায়। ঘেটোর বাসিন্দা খালের দিকেই তারের ওপর কাপড়জামা শুকোতে দেয়। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে শুকনো মশলার গন্ধ, সিগালরা গেরস্থ ঘরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেতে জটলা করে। উত্তপ্ত দুপুরেও রিনরিনে হাওয়া বয়। চারশ-পাঁচশ বছর ধরে পাড়াগুলো হুবহু একই রয়ে গিয়েছে।
ভেনিসের মধ্যভাগে অবস্থিত রিয়ালটো সেতুর কাছাকাছি যেতে ক্রমে দোকানপাট নজরে পড়তে লাগল। আর পাঁচটা ইউরোপিয়ান শহরের মত জমজমাট বিপণিকেন্দ্র, লোভনীয় খাদ্য ও পানীয়র বন্যা, স্যুভেনির শপের হাতছানি। ভ্যান্ডেটা মুখোশ বিক্রি হচ্ছে ভেনেশিয়ান কাঁচের শিল্পদ্রব্যের পাশাপাশি, আতর আর ঢাল তরোয়ালও রয়েছে।
রিয়ালটো সেতুর কাছে পৌঁছাতেই মনে হিল্লোল ওঠে। গ্র্যান্ড ক্যানালের দু'প্রান্ত যুক্ত করেছে এই সেতু। নির্মাণ দক্ষতার কথা যদি ছেড়েও দিই, মুগ্ধ হতে হয় এখানকার পরিবেশ দেখে। ১৫৮৮ সালে এই স্থপতি অ্যান্টোনিও দ্য পন্টি রিয়ালটো ব্রিজের কাজ পাওয়ার জন্য মিকেল অ্যাঞ্জেলো এবং পল্লাদিওর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। মাত্র তিন বছর সময় নিয়ে তিনি নকশা করেছিলেন এই সাদা রঙের এই ব্রিজ, সেই স্থাপত্যের মৌলিক সৌন্দর্য্য আজও অমলিন। ব্রিজের নিচে, ক্যানাল জুড়ে নানা আকারের নৌকো চোখে পড়ে। বড় বড় 'ভাপেরাত্তো' ফেরি থেকে শুরু করে ভেনিসের বিখ্যাত গন্ডোলা ভেসে বেড়াচ্ছে গ্র্যান্ড ক্যানালের জলে। রিয়ালটো ব্রিজের দু' প্রান্তেই জমজমাট দোকানপাট, লোকে-লোকারণ্য। চড়কের মেলার পলিশড ভার্সন। ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ থেকে সুস্বাদু খাবার আর কফির সৌরভ ভেসে আসার ফলে চিত্ত চঞ্চল হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?
একসময় এগোতেই হল। রিয়ালটো ব্রিজ পেরিয়ে চললুম সান মার্কো চত্বরের দিকে। গোটা শহরটাই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, হাঁটতে হাঁটতে সেই তকমাকে সমর্থন জানানো বহু শিল্প নিদর্শন চোখে পড়ল। মাঝে মাঝেই সরু খালের ওপর দিয়ে গন্ডোলা চোখে পড়ছে, সাদা জামা আর টুপি পড়ে দাঁড় টানছে মাঝি। গন্ডোলায় চড়া আমাদের সাধ্যের বাইরে, আধ ঘন্টার জন্যে আশি ইউরো দিতে হয়, তবে সে দৃশ্য চোখ দিয়ে অ্যামনে গিলছি যে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটতে বাধ্য।
সান মার্কো চত্বরে এসে সত্যিই মন ভালো হয়ে গেল। এতদিনে ইউরোপের দেশে দেশে স্কোয়ার আর প্লাজা বড় কম দেখিনি, কিন্তু এমন বিশালাকায় চত্বর কোথাও নেই বললেই চলে। একদিনে বাসিলিকা আর তার নব্বই মিটার উঁচু ক্যাথেড্রাল টাওয়ার, অন্যদিকে ভেনেশিয়ান গথিক শৈলীতে নির্মিত ডোজেস প্যালেস। এই প্রাসাদ এককালে ভেনিসের প্রধান ডিউকদের বাসস্থান ছিল। কয়েক শতাব্দী বাদেও ভবনের শিল্প অলঙ্করণ দেখে সেই আভিজাত্যের ইঙ্গিত দেয়। গোটা চত্বর জুড়ে স্ন্যাকস বার, ফ্যাশন বুটিক আর কফিশপের ছড়াছড়ি। ভেনিসের সীমানা এখানেই শেষ, সামনে সমুদ্রের লেগুনে অবস্থিত একাধিক দ্বীপ এবং সেখানকার গির্জাগুলো দেখা যাচ্ছে। সেদিক থেকে শেষ বিকেলের নোনতা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে আমাদের চুল। সামুদ্রিক পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে অহংকারি পদক্ষেপে। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে আমাদের। যেন বলতে চাইছে, "হুঁহ! ছেলেমানুষ!"
সমুদ্রের ধারে ফেরিঘাটের কাছে বসে খাব বলে দু কাপ কফি নিয়ে এলাম। কফির সুবাসের সঙ্গে সমুদ্রের গন্ধ মিশে গেল। এখান থেকে ভাপেরাত্তো ধরে চলে যাওয়া যায় দূরের দ্বীপ মুরানো, বুরানো, লিডোতে। মুরানোর রঙিন কাঁচের কাজ আর বুরানোর জলের ধারে অবস্থিত সারি সারি রামধনু রঙের বাড়ি দেখতে প্রতিদিন বহু যাত্রী পাড়ি দেয় সেখানে। দেখতে দেখতে কফিও শেষ। ঘুরে ঘুরে সারা প্লাজাটা দেখে মনে হল এত বড় প্লাজা সত্যিই আগে দেখিনি। 'ড্রয়িংরুম অফ দি ইউরোপ' বলে যে পিয়াজা সান মার্কোর সুখ্যাতি আছে, সেটা এমনি-এমনি নয়।
ফেরার সময়ে রিয়ালটো ব্রিজের কাছাকাছি এসে দেখি অন্ধকার হয়ে গেছে। দোকানের বাইরের লাল, নীল, সবুজ, কমলা আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। রঙিন আলোর ঝলমলে দ্যুতিগুলো গ্র্যান্ড ক্যানালের জলের ওপর পড়ে ছায়াপথের নীহারিকার মতোই ঝিকমিক করছে। রূপকথার জাহাজের সদৃশ নৌকোগুলো সেই মায়াবী জলের ওপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। এরকম অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য আচমকা সামনে চলে এলে চোখের পলক পড়ে না, উল্টে কান্না পেয়ে যায়। টিশার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে এগিয়ে চলি।
আরো মিনিট পঞ্চাশ আলোআঁধারি গলিপথের ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অবশেষে ভেনিস ট্রেন স্টেশনের সামনে পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। গ্র্যান্ড ক্যানালের প্রধান ফেরিঘাট এখানেই, খানিক দূরেই এই প্রান্তের সীমানা শেষ হয়েছে। গ্র্যান্ড ক্যানালের ওপর আলো পড়ে মনে হচ্ছে জলের তলায় আরেকটা ভেনিস তৈরি হয়ে গিয়েছে। আদেখলেপনা মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা নিরুপায়। অপলক তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করণীয় নেই। 'সিটি অফ মিরাজ' তকমার কারণটাও নিমেষের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেল।
বাসে করে ক্যাম্পিং জলিতে ফিরে দেখি রীতিমত হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে রেস্তোরাঁ সংলগ্ন ডিস্কোথেকে। পানাহার সহকারে উদ্দাম নাচানাচি চলছে, গমগম শব্দে টেকনো গান হচ্ছে। সেখানে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝলাম নাচানাচি ছাড়া কিছুই করার নেই, সুতরাং চুপচাপ ঘরে চলে এলাম। সকাল থেকে যা তুর্কি নাচন চলছে, আরেকপ্রস্থ নাচতে হলে তুরীয় অবস্থায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। এমনিতেও নিদ্রাদেবীর কাছে প্রচুর ঋণ হয়েছে।
২) পরের দিন সকালে রেস্তোরাঁর বাফেতে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে করে ভেনিসে পৌঁছাতে বেশ বেলা হয়ে গেল। জায়গাটার মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া গেছে কাল, আজ জলপথ ধরে এগোব ভেবে রেখেছিলাম। কাল পায়ে ব্যথাও হয়ে গেছে হেঁটে হেঁটে, তার চেয়ে ভাপেরেত্তোর 'ডেইলি পাস' নিয়ে নিলে গ্র্যান্ড ক্যানালের যে কোনও জেটিঘাট থেকে ফেরি ধরে নেওয়া যাবে। রোদের তাপ থেকেও খানিকটা নিস্কৃতি পাওয়া যাবে তাহলে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রেন স্টেশনের সামনের জেটি থেকে সাত ইউরোর দুটো ডেইলি পাস কিনে ফেললাম। টাকাগুলো দিতে মায়া হল ঠিকই, কিন্তু সুইটজারল্যান্ডে আমাদের পকেট যেইভাবে ফাঁকা হয়েছে, তার তুলনায় এ তো কিছুই নয়। কথাটা ভাবতেই মনটা সান্ত্বনা পেয়ে চুপ করে গেল। মিনিট পনেরো পর পরই সরকারি ভাপেরেত্তো গ্র্যান্ড ক্যানালকে বেড় দিয়ে সান মার্কো চত্বরে গিয়ে পৌঁছয়। সেরকম একটা ফেরি আসতেই উঠে পড়লাম। ক্যানালের জল কেটে ফেরি চলতে শুরু করল।
কাল ইন্টারনেট ঘেঁটে পিয়ের্তো বলে একটি স্থানীয় ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। বহুদিন ছোকরা রোমে ছিল, বছরখানেক ধরে ভেনিসে নিজের বাড়িতে এসে থাকছে। তার ইচ্ছে ছিল আমাদের নিজস্ব নৌকো করে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত খালগুলো ঘুরিয়ে দেখাবার, কিন্তু আমাদের সিডিউল ম্যাচ করছে না বলে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু পিয়ের্তোর কাছ থেকে ভেনিসের স্থানীয় রীতিনীতির অনেক কথাই জানা গেছে, সেইগুলো নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় আমাদের চমকে দিয়ে ফেরি একটা লম্বা ভোঁ দিল, আর সেটা শোনামাত্র আমার পাশের সিট থেকে বয়স্কা একজন ভদ্রমহিলা লাফিয়ে উঠে আতঙ্কিত স্বরে 'ও মিও দিও, অ্যাকোয়া অল্টা, অ্যাকোয়া অল্টা' বলে এদিক সেদিক দেখতে লাগলেন। ততক্ষণে আশেপাশের লোকজন মুখ টিপে হাসতে শুরু করেছে, অনেকে তাঁকে শান্ত করে আবার জায়গায় বসিয়ে দিল। কী কাণ্ড!
এমনিতে আমি ব্যাপারটার মর্ম কিছুই বুঝতে পারতাম না, কিন্তু পিয়ের্তোর সঙ্গে কথা হওয়ায় ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। গ্রীষ্মকালে মাঝেমাঝেই ভেনিসের লেগুনে জল বেড়ে গিয়ে 'হাই টাইড' এসে উপস্থিত হয়, যার স্থানীয় নাম হল 'অ্যাকোয়া অল্টা'। সমুদ্রের জল বেড়ে গিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে, শহর কর্তৃপক্ষ থেকে সাইরেন বাজিয়ে মানুষজনদের সাবধান করে দেওয়া হয়। 'অ্যাকোয়া অল্টা' ভেনিসের অনেক মানুষের মনেই ত্রাস সঞ্চার করেছে। পরিবেশ বদল আর উষ্ণায়ণের ভূমিকা সম্পর্কেও গবেষণা চলছে। বৈজ্ঞানিকদের মতে, অবস্থার উন্নতি না হলে পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে এই ঐতিহাসিক শহর জলের তলায় চলে যেতে পারে। প্রতি বছর সমুদ্রের খামখেয়ালিপনায় সামান্য হলেও জলের স্তর বেড়ে যাচ্ছে ভেনিসের, তাই বাঁধ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, অ্যাকোয়া অল্টার সময়ে যাতে অতিরিক্ত জল এসে শহরের ক্ষতি না করতে পারে। সে যাই হোক, এই ভদ্রমহিলা হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন, ফেরির ভোঁ শুনে সাইরেনের কথা ভেবেছিলেন।
গ্র্যান্ড ক্যানাল ছেড়ে ফেরি ততক্ষণে সমুদ্রে চলে এসেছে। সান মার্কোতে পৌঁছাতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগে না। সেখানে নেমে গুটি গুটি পায়ে এগোলাম 'ব্রিজ অফ সাইজ' অর্থাৎ দীর্ঘশ্বাসের সেতুর দিকে। গুটি গুটি পা ছাড়া অবশ্য এগোনোর উপায়ও নেই। সংকীর্ণ গলিগুলো ভিড়ে প্রায় উপচে পড়েছে। ছোট ছোট সেতুগুলোর নিচ দিয়ে যাওয়া গন্ডোলা আর গন্ডোলিয়ারদের ছবি তুলতে লাইন পড়ে গেছে। কোনোরকমে ভিড় কাটিয়ে জায়গাটার সামনে পৌঁছালাম। সাদা চুনাপাথরের তৈরি ছোট্ট মাথা ঢাকা সেতু, সেতুর মাঝখানে কয়েকটা পাথরের জাফরি কাটা জানলা আছে। এই বিখ্যাত সেতুটি আসলে ডোজে প্রাসাদ এবং কয়েদখানার যোগাযোগের একমাত্র পথ। কয়েদিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কয়েদখানায় পাঠানোর আগে এই সেতুর জাফরিকাটা জানলা দিয়ে তারা দেখতে পেত ভেনিস শহরের শেষ দৃশ্য। কবি বায়রন এর প্রথম এই সেতুকে 'দীর্ঘশ্বাসের সেতু' বলে সম্বোধন করেন। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে ব্রিজ অফ সাইজ ভেনিসের এক প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে।
খুব বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা এগিয়ে গেলাম। মোবাইলে ম্যাপ দেখতে হচ্ছে অনবরত। চারটে সেতু, দুটো বাঁক, একটা প্লাজা, দশটা গলি… চলেছি তো চলেছিই। গুগল ম্যাপ ছাড়া এই গলির গোলকধাঁধায় গন্তব্যে পৌঁছোনো সহজ কাজ নয়। গুগল ম্যাপও অবশ্য মাঝেমধ্যে আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু খুড়োর অধ্যবসায় আছে মানতে হবে। অবশেষে আমাদের গন্তব্য এসে গেল। প্রাসাদ নয়, গির্জা নয়, সমুদ্র নয়, একটি ছোট্ট বইয়ের দোকান।
দোকানটির নাম লিবেরিয়া অ্যাকোয়া অল্টা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বইয়ের দোকান বলে নাম করেছে হালফিলে, সে কথা লেখাও আছে এককোণে। সেই উপাধির সত্যতা জাঁচাই করা অবশ্য নিজের নিজের ব্যাপার। আমি বইয়ের দোকান দেখেই আহ্লাদিত। আর দোকানও বটে! বই একেবারে বোঝাই করে রাখা (ইতালিয়ান ভাষার বইই অবশ্য বেশি) তাতে অবশ্য দোকানের সৌন্দর্য বেড়েছে বই কমেনি । বইয়ের পাশাপাশি অবশ্য হাতে আঁকা ছবি, পোস্টকার্ড ইত্যাদিও আছে। ক্যানালের জল বেড়ে গিয়ে বইয়ের দোকানে ঢুকে আসে বহু বছর ধরেই, তাই এই দোকানের অর্ধেক বই রাখা শুরু হয় দোকানের ভিতরে থাকা গন্ডোলা নৌকোর একটি মডেলে। অনেকদিন অবশ্য জল ঢোকেনি, পিছন দিকের খালের দিকটা পাঁচিল করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু নৌকো আর বাথটবের মডেলগুলো বইয়ের দোকানের ভিতরেই রয়ে গেছে। পিছনে একফালি জায়গায় চেয়ারটেবিল পাতা, ইয়াবড়-বড় বই দিয়ে সেখানে একটা সিঁড়ি করা আছে। তাতে উঠলে খালটা চোখে পড়ে। দোকানের মধ্যেই দেখলাম একটা গাবলু বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। প্যারিসের পর ভেনিসেও বই আর বেড়ালের যৌথ উপস্থিতি দেখে বুঝলাম, বুক মার্কেটে বেড়ালের এত কদর কেন? জাপানে তো প্রতি বছর শ খানেক বই, মাঙ্গা, গ্রাফিক নভেল লেখা হচ্ছে বেড়াল নিয়ে, তার অনেকগুলোই গ্লোবাল বেস্টসেলার। তবে বইয়ের সঙ্গে বেড়ালের সম্পর্ক থাক বা না থাক, ভেনিসে প্রত্যেকের বাড়িতেই একাধিক বেড়াল থাকে। নানা প্রজাতির বেড়াল। ইউরোপে কুকুর প্রেমে আধিক্য থাকলেও ভেনিসে বেড়ালদের নিয়ে মাতামাতি আছে। মাঝে এখানে এত বেড়াল বেড়ে গিয়েছিল যে বিনামূল্যে বেড়ালদের বিক্রি করার জন্যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। ক্রোয়েশিয়ার ডুব্রোভনিক শহরে গেলে তো মনে হয়, বেড়ালরাই শহর চালাচ্ছে।
অনেকক্ষণ দোকানটায় ঘুরে ঘুরে বই দেখলাম। কবিতার বই, ছোটগল্পের বই যেমন আছে, ক্লাসিকসরেও অভাব নেই। কয়েকটা সুন্দর হাতে আঁকা ছবি কেনা হল পছন্দ করে। বাইরে বেরিয়ে গরমটা টের পেলাম। ফ্লোরেন্সের মত এখানেও যত্রতত্র জেলাতো আইসক্রিমের দোকান। এত স্বাদের আইসক্রিম খেয়ে আমরা এই কয়েকদিনে জেলাতোর ভক্ত হয়ে উঠেছি। সামনের দোকান থেকে আবার দু'কাপ আইসক্রিম কিনে খেতে খেতে চললাম যথারীতি।
নিরুদ্দেশ ভ্রমণ। নিরুত্তাপ দোকানি, নির্লিপ্ত সেতু, একা রাস্তা। একেকবার ফেরিতে চড়ি, নেমে যাই একটা দুটো স্টপ পড়ে। যেই রাস্তায় সচরাচর বাইরের লোক পা বাড়ায় না, সেইখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখি। অনেকগুলো পাড়া একেবারে নিঝুম, খাঁ-খাঁ করে। একটা মানুষও দেখা যায় না। মিনিট দশেক হাঁটলে হয়তো একটা গির্জা পড়ে। কয়েকটার ক্যাথেড্রালে খোদাই করা থাকে অসাধারণ অলঙ্করণ, কয়েকটা আবার একেবারেই সাদামাঠা। উঁকি মেরে আবার বেরিয়ে আসি। নিতান্ত এলেবেলে থাকার বাড়িগুলোতে, খালের জলে বেঁধে রাখা সৌন্দর্যবিহীন নৌকোয় লুকিয়ে থাকে যে ভেনিস, তার কথা শুনতে চেষ্টা করি মন দিয়ে।। বেলিনি, টাইটান, রাফায়েল, টিনতোরেত্তোর শৈল্পিক কেন্দ্র নয়, অমিতাভ বচ্চন-জিনাত আমানের গন্ডোলা বিলাসিতা নয়, এখানকার স্থানীয় মানুষের রোজকার জীবনযাত্রার ছবি ধরে রাখা ভেনিস। যেদিকে পা নিয়ে যেতে চায়, সেদিকেই এগিয়ে চলি।
দুপুর তিনটের সময় আমরা এসে উপস্থিত হলাম কাম্পো সান্তি আপোসতলি স্কোয়ারে। ছোট্ট এই স্কোয়ারের কাছাকাছি স্থানীয় অনেক দোকানপাট, ক্যাফে, একটা গির্জাও আছে। এখান থেকে আমরা একটা ওয়াকিং ট্যুর করে হাঁটতে হাঁটতে ভেনিসের উত্তর অঞ্চলের ঐতিহাসিক পাড়াগুলো পরিদর্শন করব। আমাদের গাইডের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই দেখা হয়েছে। নাম ফেদেরিকো। এখানে গাইড হতে হলে রীতিমত পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিতে হয়, সার্টিফাইড না হলে পর্যটন দপ্তর থেকে গাইড হওয়ার অনুমতি দেয় না। সুবিধা হল যে ফেদেরিকো খাস ভেনিসের ছেলে, স্থানীয় ইতিহাস আর অভ্যসের অনেকটাই সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। ভেনিসকে যে সে অন্য দৃষ্টিতে চিনে রেখেছে, সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল ট্যুর শুরু হতেও। ফেদেরিকো প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল গলির মধ্যে দিয়ে একটা গির্জার সামনে। গির্জার ঠিক গায়ে লাগানো একটা সরু খাল, সেখান দিয়ে খানিক পর পর গন্ডোলা নিয়ে যাচ্ছে গন্ডোলিয়াররা। গির্জার নাম সান্তা মারিয়া দেই মিরাকোলি। একদম ফাঁকা, একটা লোকও নেই।
ভেনেসিয়ান রেনেসাঁ শৈলীর প্রাচীনতম নিদর্শন এই গির্জা নির্মিত হয়েছিল রঙিন মার্বেলের পাথর দিয়ে। সামনের দিকে সাদা পাথরের সঙ্গে নকল স্তম্ভশ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়। জলের খুব কাছাকাছি অবস্থিত হলে জল লেগে সাধারণত এই ধরনের নির্মাণ একদিকে হেলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, কিন্তু এই গির্জার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। সেটা একদিক থেকে অদ্ভুত তো বটেই। 'সেভ ভেনিস' বলে একটি সংগঠন প্রায় চার মিলিয়ন ডলার খরচ করে এই গির্জার সংস্কার করেছে, রক্ষণাবেক্ষণও করছে নিয়মিত। বিয়ে করার জন্যে এটিই ভেনিসের প্রধান গির্জা। কারণ সাদা গাউন পরিহিত কনে গন্ডোলায় চড়ে একেবারে গির্জার ধারে চলে আসতে পারে। ভেনিসে হাঁটাচলা করতে গেলে আকছার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হয় আর সেতু পেরোতে হয়, গাউনের মতো মাটিতে লুটানো অভিজাত পোশাক পরে সেটা প্রায় অসম্ভব। সেই কারণেই বিবাহের জন্যে এই গির্জা অন্যতম হয়ে উঠেছে।
ফেদেরিকো হাতের তালুর মতন গলিগুলো চেনে, তার পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্পই জেনে নিলাম। কাসানোভার উদ্দাম জীবন ও জুয়াচুরি, মার্কোপোলোর অভিযান, রাফায়েলের শিল্পী জীবন, কার্লো গোলডোনিরের নাটকের কাহিনি। এরা সকলেই ভেনিসের বাসিন্দা ছিলেন। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল মার্কোপোলোর এশিয়া অভিযান, কার্লো গোলডোনি তো প্রায় ইতালির শেক্সপিয়ার হয়ে উঠেছিলেন। মার্কো পোলোর বাড়ি যেই অঞ্চলে ছিল, সেই পাড়া অতিক্রম করলাম। তারপর মধ্যযুগের গণিকালয় পাড়ার মধ্যে দিয়ে অন্য আরেকটা প্লাজাতে চলে এলাম সবাই।
ফেদেরিকো আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল, "এই যে প্রত্যেকটা প্লাজার মধ্যেখানে ঢাকা কুঁয়োর মতন দেখতে পাচ্ছ, এইগুলো এককালে সত্যি কুঁয়ো ছিল। ভেনিসিয়ান লেগুনে তো নোনাজল ছাড়া জল পাওয়া যেত না, তাই সেকালের মানুষেরা প্রতিটা স্কোয়ারে এরকম কুঁয়ো তৈরি করিয়েছিলেন। নিচে কাঁকর-পাথর ইত্যাদি দিয়ে বৃষ্টির জল পরিষ্কার করা হত।"
একজন মেয়ে জিগ্গেস করল, "তাতে আর কোনটুকু পরিষ্কার হবে? ওই জল মানুষে খেত বুঝি?"
ফেদেরিকো হেসে বলল, "আহা! আসল কথা তো বলিইনি। তখন তো আর সিওয়েজ ব্যবস্থা ছিল না। বাড়ির ওপরে যে ছাদ দেখত, বাথরুম করতে হলে ওখানেই উঠে যেত মানুষে। বৃষ্টি হলে ওইসব ধুয়ে এসে জমা হত ওই কুঁয়োর মধ্যেই। সেই জল খেলে যে কী হবে সেটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। কাপড়কাচা, বাসনমাজা ইত্যাদি কাজে সেই জল ব্যবহৃত হত।"
"তাহলে মানুষ খাওয়ার জল পেত কোথায়?" মোক্ষম প্রশ্ন করল আরেকটি মেয়ে।
ফেদেরিকো আবার হেসে জানাল, "সেই কথাতেই আসছি। ভেনেসিয়ানদের প্রতিপত্তি তো কম ছিল না। ব্যবসায় যে জাহাজগুলো যেত, সেগুলো অগাধ টাকাপয়সা নিয়ে ফিরে আসত। নতুন জায়গায় গিয়েই তো আর ব্যবসা করা যায় না, সেখানের মানুষজনকে জানতে হয়, ভাষা শিখতে হয়। এই প্রত্যেকটা জাহাজের ফিরে আসতে প্রায় পনেরো থেকে পঁচিশ বছর সময় লাগত। একজন তার জীবনকালে দু' তিন বারের বেশি সমুদ্রযাত্রায় যেতেই পারত না। কিন্তু প্রত্যেকটা যাত্রাতেই এত টাকা উপার্জন হত যে কয়েক পুরুষ সেই টাকাতে স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। সেই টাকা দিয়ে চলত ফুর্তি। ভেনেসিয়ানরা আশেপাশে অনেক আঙুর বাগান করেছিল। সেখানে তৈরি করা হত আঙ্গুরের ওয়াইন। সেই ওয়াইন খেয়েই জীবন কাটাত মানুষজন। এমন অনেকেই ছিলেন যারা সারা জীবনে একফোঁটা জলও খায়নি। জন্মের পর দুধ, তারপর সোজা ওয়াইন।"
বাপরে! কী কাণ্ড! ফেদেরিকোর মুখে শোনা গল্পগুলো শুনে মার্চেন্ট অফ ভেনিস হওয়ার আর ইচ্ছে রইল না। ওয়াইন খেয়ে না হয় থাকা গেল, কিন্তু বাথরুম করতে ছাদে যাওয়া? তার ওপর ভেনেশিয়ান মেয়েরা নাকি ব্রিটিশদের মত চুল সোনালি করার জন্যে কালো চুলে দিনের পর দিন বিশেষ এক প্রলেপ লাগাত। সেটা আর কিছুই নয়, বিশুদ্ধ প্রস্রাব। রূপচর্চার নমুনা শুনেই হিক্কা উঠতে শুরু করে। না বাবা, এই যুগের ভেনিসেই ভালো আছি।
ফেদেরিকো একেবারে চৌকস গাইড। ইতিহাসের গল্পের পাশাপাশি স্থানীয় গুজব, এখানকার ঘরায়া রান্নাবান্না, ভালো খাওয়ার জায়গা, শপিং স্ট্রিট সহ কৌতূহলোদ্রেকারী সমস্ত জিনিসের হদিস দিয়ে দিয়েছে। আড়াই ঘন্টার সফরে এক মিনিটের জন্যেও একঘেয়েমি অনুভব করার জায়গা নেই। বিদায় নেওয়ার আগে ফেদেরিকো আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল, "দোকানের বাইরে খাবারের ছবি দেখলে খবরদার ঢুকবে না। কোনও স্থানীয় রেস্তোরাঁ ওরকম করে গ্রাহকদের ডাকে না। ওইসব টুরিস্ট ট্র্যাপ। বাজে খাবার। আর অনুরোধ রইল মুরানো গ্লাসের পেইন্টিং কেনার ইচ্ছে থাকলে তোমরা মুরানোতেই যেও। সস্তার জিনিস সবই নকল। সেগুলো কিনলে তোমাদেরও লাভ হবে না, আর আসল শিল্পী যারা এখনও এই শিল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তাদের পেটেও লাথি পড়বে। নকল জিনিস কেনার চেয়ে বরং কিনো না, সেটা শিল্পীদের জন্য ভালো হবে।" হক কথা। ফেদেরিকোকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমরা রিয়ালটো ব্রিজের কাছে জেটিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এদিকে আকাশের রঙ দেখি কালো হয়ে এসেছে। ঘন বেগুনি মেঘ এসে গোটা ভেনিসকে ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যে ভীষণ জোরে বৃষ্টি হতে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই। ফেরিতে উঠে দেখি গ্র্যান্ড ক্যানালের জলে বিশাল বিশাল ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। আকাশের কালো ছায়া এসে পড়েছে রঙিন ঘেটোগুলোর ওপর। টুরিস্টদে মুখও অন্ধকার, ওইদিকে, আমার আহ্লাদ আর ধরে না। মেঘ আর বৃষ্টি দেখলেই আমার মনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মেহফিল বসে যায়, মন জানলার পর্দা ওড়ে শন শন হাওয়ায়। এত মানুষের ভিড়ে সে উচ্ছ্বাস বহিরঙ্গে প্রকাশ না পেলে কী হবে, 'মন মে লাড্ডু ফুটা' অনুভূতি আমাকে চঞ্চল করে তুলেছে। ভেনিস তো অনেকেই আসে, কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিতে তাকে ধোয়া-পাকলা হতে আর দেখেছে কতজন? এদিকে হুহু করে হাওয়া বইছে তখন। ঢেউয়ের ওপর লাফাতে লাফাতে ফেরি অবশ্য সান মার্কোতে ঠিকঠাক পৌঁছে গেল। নেমে দু' পা এগোতেই আমরা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল। আর যায় কোথায়, দেদার দৌড়ে সব মানুষজন এসে উপস্থিত হল ব্যাসিলিকার নিচের ছাউনিতে। সে কী মুষলধারে বৃষ্টি।
আজ মনে হয়, ভাগ্যক্রমে প্রকৃতির এই অনন্য রূপের সাক্ষী হয়েছিলাম আমরা ক'জন। অঝোরে ঝরে চলেছে বারিধারা, নোঙর বাঁধা নৌকোগুলো দাপাদাপি করছে প্রকাণ্ড ঢেউয়ের সামনে পড়ে, পাল্লা দিয়ে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। কড়কড় শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে, নবাগন্তুকদের মনে ভীতির সঞ্চার। জলের তোড়ে সমুদ্র ঝাপসা। ডোজে প্রাসাদ, ব্যাসিলিকা, ক্যামপানিলি টাওয়ার ঠায় জলে ভিজছে, তাদের তো ছুটে পালানোর উপায় নেই। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে আকাশও। একধাক্কায় তাপমাত্রা পড়ে গিয়েছে অনেকটা। ঠান্ডা হাওয়ার দমকে আমাদের ভেজা শরীরগুলোও কেঁপে কেঁপে উঠছে। 'অ্যাকোয়া অল্টা'-র সাইরেন অগ্রাহ্য করে সমুদ্রের ফেনায়িত জলে আকাশ ছোঁয়া ঢেউ খেলছিল সেই বিকেলে, ধুয়ে যাচ্ছিল সান মার্কো চত্বরের পরিপাটি মেজাজ। নিরাবরণ হয়ে উঠছিল অন্য এক জলশহর। বৃষ্টি থেমেছিল এক সময়, আর আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল এক অন্য ভেনিস। দ্য সিটি অফ মিরাজ। জলে ভিজে যে শহরের খোলস খসে গেছে। আমরা ছাতা মাথায় সেই শহরে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
এই বরং ভালো। অন্যরকম। আমাদের নিজস্ব স্মৃতিতে এক অন্য ভেনিসের দৃশ্য আঁকা হয়ে রইল চিরকালের জন্যে। বৃষ্টিভেজা ভেনিস। যেখানে কোনও উপরি চমক নেই, কোনও রূপকথা নেই, কোনও আলোকসজ্জা নেই, নেই কোনও জাহির করা। আছে শুধু জীবনের রোজনামচা। বিমর্ষ বৃদ্ধ, প্রণয়াসক্ত প্রেমিক, কৌতূহলী শিশু, গৃহপালিত গুঞ্জন। স্মৃতি, বিচ্ছেদ আর আক্ষেপের কাহিনি। আছে জলে থইথই বিবর্ণ গলি। মনখারাপ করা নোনাধরা বাড়ি। নিস্প্রভ আলো। হয়তো কাল মেঘ কেটে যাবে। আবার খটখটে রোদ উঠবে কাল। আবার সেজে উঠবে এই শহর। কিন্তু আমাদের কাছে এই মুহূর্তটাই ভেনিসে আসার প্রতীক হয়ে ধরা থাকবে। এই ভালো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন