Granada International Poetry Festival
৩) বিস্রস্ত হাওয়া, গ্রীষ্মের সকালে কানের লতি ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া রাতের সোনালি স্বপ্নগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রানাদার অলিতে-গলিতে। সূর্যরশ্মি কৈশোরের চঞ্চলতা ত্যাগ করেনি এখনও, দিগন্তরেখায় আন্দালুসিয় কমলাবীথিকার স্বর্ণাভ উজ্জ্বলতায় আড়ামোড়া ভাঙছে আলহাম্বরা প্যালেস।
দিকভুল, ক্যামেলিয়া-গাছ, বিস্ময়ের নৈঃশব্দ্য আর ছুটকো বাক্যলাপে ইতিহাসের পাতাগুলো স্পর্শ করে আমরা এগিয়ে চলেছি। মাথা উঁচু করে দেখে চলেছি বাড়ির অলিন্দে আর দেওয়ালে লেখা আরবি কবিতা, আবার মাথা নত করে দেখতে হয় প্লাজা আর গলিতে আঁকা ডালিমের ছবি, যা গ্রানাদা রাজ্যের প্রতীক। অনেকের মতে পমাগ্রানেট কথা থেকেই গ্রানাদা নামটির উৎপত্তি।
ভার্জিনিয়া বয়সে তরুণী, গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্থাপত্য আর বিবর্তন নিয়ে পড়াশুনা করছে, তাকে গাইড পেয়ে আমাদের সুবিধেই হয়েছে। গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আছে এ দেশে, স্পেনের বাইরে থেকেও বহু ছাত্রছাত্রী এখানে পড়তে আসে। এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর স্থাপত্যের রকমফের বুঝতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক নির্মাণকার্যে প্রাচীন শৈলীর ওপর নতুন যুগের প্রলেপ পড়েছে, কিন্তু পূর্ববর্তী স্থাপত্য শৈলীর চিহ্ন এখনও দৃশ্যমান।
কোরাল ডেল কার্বনে গিয়ে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর কয়েকটা বিন্দুর সঙ্গে আমাদের পরিচিতি হল। কোরাল ডেল কার্বন চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত 'আলোনদিগা' অথবা বাজার। নানা ধরনের জিনিসপত্র, বিশেষ করে রেশম ক্রয় বিক্রয় এবং সঞ্চয় করা হত এখানের গোদামঘরে। এই আলোনদিগা নাসরেদ বংশের সবচেয়ে প্রাচীন নির্মাণ কার্যের একটা যা এখনও সংরক্ষিত আছে।
বাজারে ঢোকার মুখেই প্রধান দরজা অথবা 'ফ্যাসাড'-এর দুর্দান্ত অলঙ্করণ দেখে অবাক হতে হয়। ইসলাম স্থাপত্যে আলফিজ সজ্জার বাহুল্য আছে, সেখানে একটা আয়তাকার প্যানেলের সাহায্যে দুটো আর্ককে স্থিতিশীল করা হয়। দরজার উঁচু অংশের ওভারহ্যাং এর আলঙ্কারিক সজ্জা সাতশ বছর পরেও প্রায় একই আছে।
দরজা দিয়ে ভিতরে গিয়ে পড়লে একটা বর্গাকার প্রাঙ্গন। কেন্দ্রে একটা কুঁয়ো ছিল কোনোকালে। চারিদিকের তিনতলা বাড়িগুলোর ছাদ এবং জানলার খড়খড়িগুলো অভ্যন্তরীণ। ইসলামিক স্থাপত্যে জানলা দরজার ছাদ অন্দরমহলের দিকে মুখ করে থাকে, বাড়ির উঠোনের মাঝে জলের একটা উৎস তৈরি করা হয় অন্দরমহলকে শীতল রাখার জন্যে। বাড়ির কাঠের ফ্রেম থেকে লতাপাতা বেরিয়ে বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে, কিন্তু প্রাচীনকালের আবহ এখনও অনুভব করা যায়। ইদানিং কালে এখানে ফ্লামেংকো আর অপেরার অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেই কারণে নিয়মিতভাবে দেখাশোনা করা হয় এই জায়গাটা।
কোরাল ডেল কার্বন থেকে বেরিয়ে আমরা গির্জার দিকে এগোলাম। চকচকে পাথরের রাস্তার দুইধারে স্যুভেনিরের দোকানপাট। স্কার্ফ, সুগন্ধি, রেশমের ওড়না। আল্কায়সেরিয়া বাজার এককালে ইউরোপের সবচেয়ে নামকরা রেশম বাজারের মধ্যে অন্যতম ছিল। কাছেই রয়্যাল চ্যাপেল। রাজা ফার্দিনান্দ আর রানী ইসাবেলের সমাধি। ১৪৯২ সালে ফার্দিনান্দ দ্বিতীয় আর ইসাবেলা প্রথম যখন গ্রানাদা পুনর্দখল করে, তারাও হয়তো ভাবেনি এই শহরেই তাদের কবর দেওয়া হবে। চ্যাপেলের মনোমুগ্ধকর অলঙ্কারসজ্জা দেখে আমরা ততক্ষণে পায়ে পায়ে গির্জার কাছে।
স্পেনের দ্বিতীয় এবং পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম গির্জা। স্প্যানিশ রেনেসাঁর অদ্বিতীয় উদাহরণ। গ্রানাদা দখলের পরেই রানী ইসাবেল এই গির্জার নির্মাণকার্য শুরু করেন প্রাচীন মসজিদের ওপর। এনরিকে ইগাস সেই সময় গথিক স্থপতির মাথা ছিলেন, তার নকশা অনুয়ায়ী কাজ শুরু হয়েছিল গির্জার কিন্তু দিয়েগো বলে অন্য একজন স্থপতি এসে অনুরোধ করেন গির্জার নির্মাণ হোক রেনেসাঁ শৈলীতে। দিয়েগো ইতালিতে গিয়েছিলেন, সেখানে গথিক শৈলীর কাজ মোটামুটি বন্ধই হয়ে গেছে, রেনেসাঁর হাওয়া লেগেছে স্থাপত্যে। অতএব গথিক ভিতের ওপরেই শুরু হল নতুন শৈলীর কাজ।
Corral del Carbon |
শ'পাঁচেক বছর ধরে নির্মাণ করা সত্ত্বেও অনেক পরিকল্পনাই শেষমেশ বাতিল করতে হয়েছিল। ক্যাপিলা মেয়রের প্রধান টাওয়ারের অন্যপ্রান্তে কোনও টাওয়ার নির্মাণ করা যায়নি স্থিতিশীলতার কথা ভেবে। গির্জার ভিতরের জাঁকজমক, পেইন্টিং আর বারোক শৈলীর কাজ দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে আমরা গ্রান ভিয়ার অপর প্রান্তে এসে গেছি। কাইয়ে কালদেনেরিয়া নুয়েভার গলিতে ঢুকতেই মনে হল সোজা মরক্কোয় চলে এসেছি। এই গলিকে এখানকার লোকে মরক্কো গলিও বলে। দুইদিকে জমজমাট দোকানপাট, ছোট ছোট ক্যাফে, ‘তেতেরিয়া’ অর্থাৎ চায়ের দোকান, বেকারি, মরোক্কোর খাবারদাবার, প্রসাধন সব ঢালাও বিক্রি হচ্ছে। দোকানদারদের চোদ্দ আনাই মরক্কো থেকে এসেছেন এক সময়। দোকানের নাম পড়তে পড়তে আর তেতেরিয়ার সংখ্যা গুনতে গুনতে সান গ্রেগরিয় গির্জার ছোট্ট ইমারতের সামনে পৌঁছে গেলাম। কাছেই নজরে পড়ল আরেকটা কালচারাল সেন্টার।
এইটকু সময়ের মধ্যে এখানে এতগুলো সংস্কৃতি ভবন ওরফে কালচারাল সেন্টার নজরে পড়েছে যে রীতিমত অবাক হয়ে গেছি। এমনিতে গ্রানাদার সুনাম আছে সাহিত্য সংস্কৃতিতে। ইউনেস্কোর সিটি অফ লিটারেচারেও গ্রানাদার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। অল সিকান্দী থেকে শুরু করে ফ্রান্সিসকো নিয়েভা আর হালের সালমান রুশদী, শত শত বই লেখা হয়েছে গ্রানাদাকে কেন্দ্র করে। এখানের পাথরের ওপর খোদাই করা উক্তি আর কবিতার সংখ্যা নিয়েও কাজ করে চলেছে গবেষকরা। আলহাম্বরা প্যালেসের দেওয়ালে, অলিন্দে আর ছাদে খোদাই করে লেখা নানান আরবি উক্তি, কোরানের আয়াত আর কবিতার উৎকীর্ণ ভাব আর ভাষা নিয়েও প্রায় শখানেক বই লিখে ফেলেছে তারা। সারা বছর ধরে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য স্থানে কবিতা এবং সাহিত্য নিয়ে নানা অনুষ্ঠান চলতেই থাকে, আর গ্রানাদার আন্তর্জাতিক কবিতা মেলা তো পৃথিবী বিখ্যাত। আগের বছরই নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ডেরেক ওয়ালকট, মারিও ভার্গোস ইয়োসা, ওলে সয়েনকিনা আর হেরতা মুলারের মতন কবিরা এখানে কবিতা পড়ে গেছেন। কিন্তু নামকরা কবিরাই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কবিতা আর সাহিত্য নিয়ে যেরকম উন্মাদনা দেখা যায় এই শহরে, স্পেনের অন্য শহরে তেমনটা নজরে পড়ে না। হয়তো গার্সিয়া লোরকার ঐতিহ্যই এই কবিতাপ্রেমের বীজ পুঁতে দিয়ে গেছেন গ্রানাদার মাটিতে।
Alberti & Lorca |
গৃহযুদ্ধেই ফাসিস্টদের হাতে লোরকাকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। নিয়তি যখন সত্যিই আলবের্তিকে ১৯৮৩ সালে গ্রানাদায় টেনে আনলো, সিয়েরা নেভাদার ভিজনার গিরিখাদের কোনও জায়গায় লোরকা চিরঘুমে ঘুমিয়ে। এই জন্মে আর দুই বন্ধুর দেখা হল না গ্রানাদায়। 'বিস্ময়' কবিতার কয়েকটি লাইনে লোরকা যে মনের কথা বলেছেন তিনি কি জানতেন তার জীবনেও সেই দুর্যোগ নেমে আসবে...
মৃতদেহটি পড়ে রইল পথের ওপর
বুকে ছুরি বসানো
চিনল না কেউ তাকে!”
আলবের্তি অবশ্য বন্ধুকে কোনদিনই ভুলতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিতে লিখেছিলেন..
যাও, তুমি ঘুরে এস আঙ্গুরের ক্ষেত এবং শহর
রূপান্তরিত হয়েছে বিশাল জল মৃগে
উজ্জ্বল ভোরের সমুদ্র হয়ে বেঁচে থেকো
থেকো ঢেউয়ের ওপর মাছরাঙার বাসা হয়ে
লেখালিখি আমার ওপরেই ছেড়ে দাও,
ক্ষণস্থায়ী শীতল বেনুবাঁশে
চলমান জল আমার নাম হয়ে থাক
বাতাসে কেঁদে মরুক, একা, যেমন নদী
হয়তো ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকার আশীর্বাদেই আজ গৃহযুদ্ধের আশি বছর পর গ্রানাদার প্রকাশনা সংস্থাগুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে। লোকে আজও তার লেখা 'জিপসি ব্যালাড'-এর কবিতার সঙ্গে পড়ছে তাঁর রচিত নাটকের ট্রিলজি 'ব্লড ওয়েডিং, ইয়ের্মা, দি হাউস অফ বের্নার্দা এলবা'।
সাত ও আটের দশকে যখন বাংলা কবিতায় ‘কৌরব’ পত্রিকার সূত্রপাত, ঠিক একই সময়ে কয়েকজন তরুণ কবি আত্মপ্রকাশ করে গ্রানাদায়। কবিতাকে তাঁরা বলত 'পোয়েট্রি অফ এক্সপেরিয়েন্স'। আলভারো সালভাদোর, লুইস গার্সিয়া মন্টেরো, হাভিয়ের এগিয়া, আনগেলেস মোরার মতো তরুণ কবির দল কয়েক বছরের মধ্যেই সাহিত্যিক জগতে আলোড়ন ফেলে দেয়। তাদের হাত ধরেই একের পর এক কবি, লেখক আর সাহিত্যের নতুন ঢেউ এসে লাগে আন্দালুসিয়ায়। ইদানিং কালে ফের্নান্দো ভেরভের্দে গ্রানাদার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। এদের লেখা ইংরেজিতে খুব একটা অনূদিত হয়নি আগে, যদিও এখন অনুবাদের ওপর জোর দেওয়া শুরু হয়েছে স্প্যানিশ প্রকাশনার জগতে।
ভার্জিনিয়ার কথায় জানা গেল যে লোরকার পৈত্রিক বাড়ি লা হুয়ের্তে দে সান ভিসেন্তেতে মাঝে মাঝেই কবিতার অনুষ্ঠান হয়। বাড়িটা আজকাল মিউজিয়াম করে দেওয়া হয়েছে, লোরকার ভক্তদের আনাগোনা লেগেই থাকে। আমাদের দলেই বয়স্কা এক ভদ্রমহিলা ছিলেন, তিনি আগেও গ্রানাদায় এসেছেন। কথায় কথায় তিনি বললেন যে এই তার পরিচিত এক বন্ধু সত্তরের দশকে আর্জেন্টিনা থেকে পালিয়ে এসে গ্রানাদায় লা তের্তুলিয়া বলে একটা ক্যাফে খুলে বসেন। আর্জেন্টিনাতে তখন রাফায়েল ভিদেলার স্বৈরতন্ত্র চলছে। ছোট্ট এই ক্যাফেটি কবি, সাহিত্যিক, হিপি, বোহেমিয়ান শিল্পীদের আড্ডা হয়ে ওঠে কয়েক বছরের মধ্যেই। কত তরুণ যে এই ক্যাফেতে চা খেতে গিয়ে নিজের অজান্তে কবিতা লিখতে শুরু করে তার কোনও হিসেব নেই। কথাটা শুনে বেশ মজাই লাগল। লা তের্তুলিয়া যেতে পারলে মন্দ হত না, কিন্তু জায়গাটা বেশ দূর। আমাদের হাতে সময় তেমন নেই।
Fernando Valverde Rodríguez |
কত কত গির্জা, সিনাগগ, হাভেলি, জাদুঘর, মিউজিয়াম ইত্যাদি আমাদের নজরে পড়ল সেই হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। দর্শনীয় স্থানের ধারা বিবরণী লেখার ইচ্ছেও আমার নেই। তবে সংক্ষেপে বলা চলে যে গ্রানাদার মতো জায়গায় সময়ের হিসেব করে আসা মোটেই কাজের কাজ নয়। আরবি আর ইহুদিদের পাড়ার সংস্কৃতি মিশে গেছে জিপসিদের গানের সঙ্গে, আলহাম্বরার আয়াতের সঙ্গে বাজানো হচ্ছে বাইজেন্টাইন গিটারের সুর। এখানে গলির গোলকধাঁধায় যে অজানা কতগুলো আরো গ্রানাদা লুকিয়ে আছে, সেই অনুসন্ধান দু' চার দিনে মোটেই সম্ভব নয়।
ভার্জিনিয়াকে বিদায় জানিয়ে আলহাম্বরার উদ্দেশে এগিয়ে চললাম। নিচু পথ ধরে কমলাবিথির দিকসীমায়, যেখানে লোরকার পরিচিত তিন বন্ধু এনরিকে, এমিলিও, লোরেনসো হয়তো আমাদের অপেক্ষা করছে।
এনরিকে,
এমিলিও,
লোরেনসো।
ওরা তিনজনই ছিল চুপচাপ
এনরিকে তার শয্যা জগতে,
এমিলিও চোখ আর রক্তাক্ত হাতের দুনিয়ায়,
লোরেনসো ছাদহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবীতে।
এনরিকে, এমিলিও, আর লোরেনসো নাকি অদৃশ্য সহচর ছিল লোরকার, এদের সঙ্গে নিয়েই তিনি বেড়াতেন এই শহরের অলিগলিতে। হয়তো আজও তাঁরা অদৃশ্য হয়ে চলেছে আমাদের সঙ্গে।
La Tertulia Granada |
গ্রানাদা- তৃতীয় পর্ব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন