সোমবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২৪

এখনি অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা


"আমার এখন কোনও প্রত্যাশা নেই। ফিরে পাবার, ফিরে যাবার। ইচ্ছে হত বলে কত দীর্ঘকাল কেবল উপকরণের প্রাসাদজীবনে কেটে গেল। জীবনের কী দীর্ঘ অপচয়।"

প্রজ্ঞাদীপা হালদারের নতুন বই ৯ঋকাল বুকস প্রকাশিত 'এখনি অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা'। সংসার গহনে, নির্ভয় নির্ভর আর নির্জন সজনে নামাংকিত তিনটে ভাগে তাঁর লেখা স্মৃতিকথন, চিন্তাভাবনা, স্বপ্ন-জীবন ও সমাজদর্শনের বয়ান, যাপনকথা! পড়তে ভালো লাগে। কিছু আগে ফেসবুকে পড়েছি, অনেকগুলোই পড়িনি। মাঝেমাঝে একটু গলা চিনচিন করে, মাঝে মাঝে দখিনা হাওয়া গায়ে লাগে, রাগও হয় কম নয়। লেখার তাপ কোথাও কোথাও বড় বেশি, তখন বই বন্ধ করে লেখিকার কথা আওড়াই, "আজকাল আমি কিচ্ছু ভাবি না।' ঘর ছেড়ে বারান্দায় আসি, মনে মনে বলি, 'একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে'। 

৯ঋকালের সম্পাদনা ও প্রোডাকশন বরাবরের মতো যত্নশীল, উপমা চক্রবর্তীর পেন্সিলের আঁচড়ে আঁকা ছবিগুলো সহজ, সাবলীল, সুন্দর ও লেখার সঙ্গে মানানসই। 

এইটুকু বললেই চলে যায়, কারণ এরপর কিছু বলতে গেলেই যে সমস্ত কথা মাথায় ভিড় করে আসে, তার সঙ্গে বইয়ের যোগাযোগ বিশেষ নেই। সেই অকিঞ্চিকর, অপ্রাসঙ্গিক কথা তুলে আনা বেমানান! তারপর ভেবে দেখি, কে আর পড়ছে? না কেউ এই লেখা পড়বে, বিশেষ কেউ প্রজ্ঞাদীপার বইও পড়বে বলে মনে হয় না। তাহলে আর কীসের নিষেধ, কীসের বাধা?

প্রজ্ঞাদীপার আগের বই 'আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী' পড়ে যখন বিহ্বল হয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, তখন সে বইটা জনাদশেক মানুষ পড়েছিলেন কিনা সন্দেহ! প্রজ্ঞা নিজে একদিন মস্করা করে বলেছিলেন, আমার বইটা আমি ছাড়া স্রেফ একজন পড়েছে। তুমি। আমার সঙ্গে বয়সের তফাত বিশেষ নেই, কিন্তু আমি পনেরো বছরের কিশোরীদেরও অনায়াসে দিদি বলতে পারি, এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। লেখক লেখিকাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব বজায় থাকে সাধারণত, মেসেঞ্জারে কাউকে কিছু বলতে যাই না, আড্ডা হয় না, বই নিলে সই নেওয়ার চেষ্টা করি না, সেল্ফি তোলানোর ইচ্ছেও আমার নেই, বই লেখার জন্য বলি না, ফ্রেন্ডলিস্টে তাঁদের ঢোকানোর ইচ্ছেও থাকে না। কিন্তু লেখা পড়ার ইচ্ছে থেকেই যায়। প্রজ্ঞাদীপাদির ফেসবুক বাদেও খুঁজে খুঁজে ব্লগে তাঁর আগের লেখা পড়েছি, পরের বইয়ের অপেক্ষা ছিল। কিন্তু সে বই আর আসে না। ইতিমধ্যে একদিন দেখি তিনি পিং করে লিখেছেন, "তোমার পোস্টে রেকামেন্ড করা হোয়্যার দ্য ক্রড্যাড সিংস' বইটা পড়ে আমি মুগ্ধ! সিনেমাটাও দেখেছি!" দু এক কথা হতে আমি সাহস করে বললাম, "কিছু লিখছেন না?" তাতে তাঁর জবাব, "শুয়াপঙখী উড়ে গেছে।" নিজের বানানো নিয়ম ভেঙে আর্জি দিলাম, "লিখুন মাঝে মাঝে! সময় নিয়ে!" এরপর মাঝেমাঝে কথা হয়েছে। পরিমলদার লেখা নিয়ে। সত্যি রূপকথা নিয়ে। প্রান্তিক মানুষের জীবন নিয়ে। কোভিড নিয়ে। ঘনিষ্ঠতা হয়নি, কিন্তু তবু জোরাজুরি করে আমাদের একবার বাড়িতে ডেকে খাতির করেছেন, বই উপহার দিয়েছেন। কেন জানি না। একটু আস্কারা পেয়ে বলেছিলাম, "পরের বই আসতে কত দশক লাগবে?" উত্তরে হাসি পেয়েছিলাম। বই মেলায় এল বছরখানেক পর...প্রজ্ঞা এলেন না। 

"গ্বালিবের মতো ভাঙচুরের আওয়াজে কান পেতে থাকি। ম্যাঁয় হুঁ অপনে শিকস্ত কী আওয়াজ। আমি তো নিজেই নিজে ভেঙে যাওয়ার শব্দ, শহর আর কত ভাঙবে। কতই বা আর।"

আমার ইমোশনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রজ্ঞার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা বা স্পেকুলেশনের অধিকার, এক্তিয়ার বা ইচ্ছা আমার নেই। যা আমি বলতে পারি, বলতে চাই, সেটা হল, প্রজ্ঞার মতো কলম খুঁজে পাওয়া যায় না, তৈরি করা যায় না, ইভলভ হয় না সময়ের সঙ্গে, তাঁরা স্পেসটাইমের একটা বিন্দুতে কিছুক্ষণ জ্বলজ্বল করেন। কতক্ষণ সে আলো থাকে, আগে থেকে জানা যায় না! তাঁর সমাজদর্শন, তাঁর এমপ্যাথি, তাঁর স্মৃতিকথার আটপৌরে মোহময়তা আর সরস্বতীসুলভ ভাষার ব্যঞ্জনার প্রতিধ্বনির আড়ালে একটা আগুন থাকে, একটা বিষণ্ণ অসহায়তা, একটা রাগ থাকে, যা সকলের কাছে ধরা দেয় না। বিশ্বসাহিত্যে সেরিব্রাল লিটারেচার বলে একটা কথা আছে, 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' হোক বা হালেই পড়া হারনান ডিয়াজের ' ট্রাস্ট'... এই গল্পগুলো গল্পের গল্পময়তাকে অতিক্রম করে একটা অন্য জগতে চলে যায়, সবসময় সে লেখা অনুধাবন করাও যায় না। কিন্তু সেরিব্রাল সাহিত্যের মধ্যেও সেরা হল সেই লেখা, যা ভাষার গুণে দিব্যি পড়ে নেওয়া যায়, লেখনীর মাধুর্য আর নস্টালজিয়ার ছোঁয়ায় মন ভিজে যায়, ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে, তারপর বই শেষ করার দিন তিনেক পর আচমকা এমন একটা উপলব্ধি হয়, যা বইটাকে অন্য স্তরে নিয়ে যায়। প্রত্যেকের জন্য এই উপলব্ধি আলাদা। প্রজ্ঞাদীপা যেমন লিখেছেন, "বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে 'কিচ্ছু বদলাবে না' মানুষকে বদলে দেয়।" বয়স বাড়লে এই উপলব্ধিও মনে হয় বদলে বদলে যায়। প্রজ্ঞাদীপার লেখা পুরোপুরি সেই জাতের। সেরিব্রাল। কিন্তু অ্যাক্সেসিবাল। নির্লিপ্ত, কিন্তু আবেগী। বিপ্লবী, কিন্তু আদুরে বেড়ালের গায়ের মতো কোমল। 

"জলখাবারের মর্ম আমার চাইতে বেশি কেউ জানে না। জলখাবার শব্দটার মায়া-মোহময়তা পঞ্চেন্দ্রিয় জড়িয়ে রাখে। আহা, জলখাবার কী অপূর্ব জিনিস, না জানি সে খেতে কেমন। আমার তখন উপেনবাবুর গল্পের বামুনের কাঁচা ফলার, পাকা ফলার দশা!"

প্রজ্ঞার লেখা যাঁরা পড়েননি, তাঁদেরকে অনুরোধ, তাঁর লেখার উৎকর্ষ বুঝতে হলে "আত্মহত্যার সম্পূর্ণ বিবরণী' পড়ে দেখতে। আর যাঁরা তাঁর অসম্ভব শক্তিশালী কলমের পরিচয় পেয়েছেন, "এখনি অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা" তাঁদের জন্য। আমি জানি, প্রজ্ঞা লেখা নিয়ে কী করতে পারেন, এই বইটা তাঁর লেখাকে জানার জন্য নয়, তাঁকে জানার জন্য! কিছুটা বারাসাত, কিছুটা চিকিৎসক জীবন, অনেকটা ফেলে আসা সময়কে আঁকড়ে ধরা কাহিনি! সেই সব হতভাগ্যদের দেখে লেখা কিছু ঘটনা, যাদের কেউ দেখেও দেখে না। প্রজ্ঞা দেখেন, লেখেন, তারপর এই দেখাকে নাকচ করে এগিয়ে যান।

"গরিব মানুষের গায়ের একটা গন্ধ আছে, গরিব মানুষের, দলিত মানুষের, প্রান্তিক মানুষের, অসুস্থ মানুষের। মাস্ক না থাকলে সেই গন্ধটাই আমাকে এতদিন পাগল করে দিত সন্দেহ নেই। কিন্তু গন্ধটা আমি আর পাই না। কোভিডের পার্মানেন্ট ড্যামেজ, কেউই আর গন্ধ পায় না। দেখেও না সম্ভবত। আমিও দেখি না।"

আরেকটা কথা মনে পড়ছে, লিখেই রাখি! বইটা উৎসর্গ করা হয়েছে তাঁদের, যাঁরা মেকানাইজেশন মেনে নেয়নি। যে যুগের সাক্ষী হয়ে আছি, তাতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার! কাজকর্ম দূরের কথা, ব্যক্তিগত জীবনেও মেকানাইজেশনের বিস্তার আমাদের অচল করে রেখেছে! প্রেম অপ্রেম, সমর্পণ বিরোধিতা মিলন বিচ্ছেদ রাগ দুঃখ, আনন্দ শোক এবং সেই শোকের বহির্প্রকাশ, এখন তো সবই মেকানাইজড! মাপা! নিয়ম মেনে! (প্রজ্ঞাদীপা সে কথা জানতেন না, আমি বিশ্বাস করি না!) তাই আমার ধারণা, এই বইয়েরও বিশেষ পাঠক পাওয়া যাবে না। মেকানাইজেশন যাঁদের অচল করে দিয়েছে, সেরকম কয়েকজন পাঠক বইটা কিনবেন, পড়বেন, পোস্ট দেবেন হয়তো, বিশেষ করে তাঁরাই, যাঁরা লেখিকার নাম বা কলমের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু এরও মধ্যে যদি কেউ প্রকাশনার স্টলে গিয়ে প্রজ্ঞাদীপা সম্পর্কে কিছুই না জেনে এই বইটা নেড়েচেড়ে দেখেন, কেনেন ও পড়েন, বুঝব বইটা তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছে।

প্রজ্ঞাদীপাদি! মনের সুখে বাজারঘাট করো, বেড়াল পোষো, ভালো থেকো! একদিন দেখা হবে!