An evening in Paris |
পাখি আনতে বলেছি
মেনুতে দেখে
সঙ্গে অবশ্য একটা নদীও আনিয়েছি
যাতে জল নেই বললেই চলে
নদীর জন্যে জল বলেছি
গাছের জন্যে শাখা
সবই পাখিদের জন্যে
পাতার স্তুপের ওপর ফিসলে যাওয়া ক্ষণস্থায়ী আলোর শব্দ
আর কোলাহলের মাঝের সঘন নীরবতা বলেছি
এখন অপেক্ষা করছি আমি
আমার অর্ডার কখন দিয়ে যাবে?"
~প্যাট্রিক দুবোস্ত
ব্যাকপ্যাকিং অভিযানে এসে যে শেষে ফরাসি আতরের দোকানে যেতে হবে, সেটা আমি কল্পনাও করিনি। কিন্তু নিয়তিকে খোদ ক্রিস্টোফার কলম্বাস আর ডেভিড লিভিংস্টোন খন্ডাতে পারেনি, আমি কোন গাছের হনু? প্যারিসে এসে আমার ব্যাকপ্যাকিং পার্টনার বিশ্বসংসারের মায়ায় পড়ে যাবেন, এ আমার কল্পনার উর্ধ্বে ছিল। জেদ ধরেছেন তিনি ফ্রেঞ্চ পারফিউম না কিনে ফিরবেন না, তাও আবার নিজের জন্যে নয়, অন্যদের উপহার দেওয়ার জন্যে।
শুনেই মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করছিলাম। টিপে টিপে পয়সা খরচ করা হচ্ছে, বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে এসে মাসের পর মাস ইউরোপ চষে বেড়ানো কি সোজা কথা? ইউরোপের অর্ধেক মানুষ বিকেল হলেই ক্যাফে রেস্তোরাঁয় এসে জোটে, এদিকে ক্ষিদে পেলে আমরা বড়জোর টুক টুক করে হেঁটে ম্যাকডোনাল্ড-এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে বড়ই বেগ পেতে হয়। আর এ বলে কিনা পারফিউম কিনবে? ফরাসি আতরের কত দাম জানা আছে? ইচ্ছে করছিল আতরের আগে একটা মাঙ্কি ক্যাপ কিনে উপহার দিই। ওই হনুমান টুপি পরে দুর্গাপুজোয় পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে আলুপোস্ত, বেগুনভাজারর সন্ধান করলেই হত, ব্যাকপ্যাকার হতে কে বলেছিল? যত্তসব!
শেষে বেগতিক দেখে ঘাড় নাড়লাম চুপচাপ। দরকার নেই বাবা। বড় বড় যোগীদেরও পদস্খলন হয়, আমরা তো দুদিনের ব্যাকপ্যাকার মাত্র। কথায় আছে, ‘দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন'! কসমিক কন্সপিরেসি হলে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমাদের আশ্রয়দাতা ডনিকের বান্ধবী বার্বারা সাঁজে লিজেতে প্রতিদিন যায়, কোথায় কোথায় সস্তায় ভালো আতর পাওয়া যায় তার একটা মস্ত লিস্টি করে দিল সঙ্গিনীকে। আমি চুপ করে কাণ্ড দেখে গেলাম।
ফ্যাগোনা(Fragonard), গেঁলাহ(Guerlain) প্রভৃতি নামকরা আতরের দোকানে গিয়ে কোনও লাভ নেই। একটা পুঁচকে শিশির দামই সেখানে হাজার ইউরো। অতঃপর বার্বাবার উপদেশ শুনে আমরা এসে হাজির হলাম সাঁজে লিজের ওপরে থাকা অপেক্ষাকৃত কম দামি দোকানগুলোতে। আগে বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছি এই বিখ্যাত বুলেভার দিয়ে, লিডো সিনেমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি, ক্যাফে তিরোলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে গিলেছি আলোকসরণীকে। কিন্তু ক্রেতা হয়ে কোনও দোকানের ভিতরে ঢুকব সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। এইবার সেই উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকে পড়লাম জনপ্রিয় দোকান 'সেফোরা'-তে। একের পর এক আতরের পরখ চলতে লাগল। কেনা অবশ্য কিছুই হল না। সেফোরাতে চাইলে এমনিতেই হোমিওপ্যাথিক শিশির মতন ছোট শিশি করে খানিকটা নমুনা দিয়ে দেয়, সেই নিয়েই বেরিয়ে পড়া হল। পরে অবশ্য প্রায় সারা শহর তোলপাড় করে সঙ্গিনীটি ন্যায্য দামে খাঁটি আতর কিনেছিলেন, সেই রহস্য আর ভাঙছি না।
চিন্তার কথা হল ফ্রেঞ্চ বলতে গিয়ে দাঁত ভেঙ্গে যাচ্ছে বলে স্থানীয় মানুষজনের জন্যে খুব একটা আড্ডা দেওয়া যাচ্ছে না। ফ্রান্সে গিয়ে ‘প্যারিস’ বা পারি বললেও অনেকে না বোঝার ভান করে, এখানের লোকেরা বলে 'পাহ্বী'। কিন্তু মুখোমুখি দেখা না হলেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে দিব্যি স্থানীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যায়, অনেক কিছু জানাও যায়। কাউচসার্ফিং আর ফেসবুকের একাধিক গ্রূপ তো আছেই, তাছাড়াও মিয়াও, স্কাউট নানা অ্যাপ আছে, স্থান বিশেষের চ্যাটরুমে গিয়ে দিব্যি গল্প করা যায় সেখানকার স্থানীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। এক সপ্তাহ আগেই ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফুটবলে ২০১৮ -তে বিশ্ববিজয়ী হয়েছে। এখন প্যারিসিয়ানদের মন মেজাজ বেশ ভালো আছে। অ্যাপের মাধ্যমে কয়েকজন প্যারিসিয়ানদের সঙ্গে গল্পগাছা চলছে, সমসাময়িক অনেক ঘটনাই জানতে পেরেছি সেই সূত্রে।
যারা ফরাসি নন, তাদের মনে প্যারিসের শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়ে যে কল্পচিত্র আছে, সেই ছবি আবছা হয়ে গেছে বহু বছর। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ আর মঁমার্তের স্টুডিওতে ছবি আঁকেন না, ভিক্টর হিউগোকে আর সকাল বেলায় কফিশপে দেখা যায় না। কিন্তু তাই বলে শিল্পচর্চা থেমে থাকেনি। ১৯৬৮ সালের জনতান্ত্রিক আন্দোলনের পর নবীন শিল্পীদের ভাষা আধুনিক ও বহুমুখী হয়ে ওঠে। পোস্টকলোনিয়াল সাহিত্যে উঠে আসে গতভাঙা কবিতা ও উপন্যাস, সঙ্গে কমিক ও গ্রাফিক নভেল। গণনাটক, স্বাধীন চলচ্চিত্র আর সঙ্গীতে ফরাসি নাগরিকদের স্বর আলোচিত হতে থাকে শিল্প ও সাহিত্যের জগতে।
গত কুড়ি বছরে টমাস ভিনো, ফ্রেদেরিক হাউদা, গ্রেগরি দামন, আঙ্গেলা পাউলি, প্যাট্রিক দুবোস্ত, সিলভি নেভ সহ নানা কবি উঠে এসেছেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। এদের মধ্যে কেউ আগে নাটক করতেন, কেউ কবিতার সমালোচক ছিলেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। অনেকের নিজস্ব ব্লগও ছিল। এদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র চিন্তাধারা আছে, তাঁদের কবিতাতেও তা প্রকাশ পায়। দুবোস্ত এক জায়গায় লিখেছেন—
কয়েকজন বলে:
বিশৃঙ্খলা আসলে একটি অরণ্য
এবং ম্যাপল গাছের পাতার জানলা দিয়ে...
পথচারীরা সময়ের ছবি দিয়ে যায়
আমি বলি:
পথচারীরা
পাতাদের মতনই গতিহীন
ম্যাপল গাছের দৃষ্টি দিয়ে দেখা কোনও ছবি!
আমার আনাড়ি হাতের ভাবানুবাদে আসল কবিতার রসাস্বাদন সম্ভব নয় জানি, কিন্তু হয়তো কবি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হতে পারে। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন....
জানলা যখন খোলা থাকে
বাতাসকে ভালবাসতে হয় তোমায়
যদি বাতাসের গতি থাকে আরেকটি জানলার দিকে,
তোমাকে খুঁজে পেতে হয় সেই শব্দ
অতিক্রম করতে হয় তাকে
শব্দরাও বাস্তবে
ক্ষুদ্রকায় জানলার সামিল
কবিতা নিয়ে ফরাসিরা চিরকালই ভাবপ্রবণ। কিন্তু তাই বলে যে গদ্য পিছিয়ে আছে তা নয়। গত কয়েক বছরে ফ্রেঞ্চ সাহিত্যে অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে বহু গদ্য লেখা হয়েছে। লীলা সিল্মানি, মাথিয়া এনার্দ, এরিক ভুইলার্দ, আতিক রহিমীর মতন বহু লেখক উঠে এসেছেন ধারালো কলম নিয়ে। বিশেষ করে লীলা সিল্মানির লেখা উপন্যাস 'লুলাবাই' আর আলজিরিয়ান উপন্যাসকার বৌয়ালেম স্যানসালের লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস ‘২০৮৪’ সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে। এই সাহিত্যিকদের অনেকেই প্রবাসী। কেউ হয়তো মরক্কো থেকে এসে বসবাস শুরু করেছেন প্যারিসে, কারো শিকড় আবার আফগানিস্তানে। শুধু সাহিত্যেই নয়, খেলাধুলোতেও প্রচুর প্রবাসীরা উঠে আসছে। বিশ্বকাপ ফুটবলে লক্ষ করে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের টিমে থাকা বেশিরভাগ ফুটবলার আসলে ফ্রান্সে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ফ্রান্সে থাকা প্রবাসীরাও নিজের দেশের হয়ে খেলতে পারে, তাই অনেকেই সুযোগ পেয়ে এগিয়ে গেছে খেলার জগতে।
আমাদের বাড়ির চারপাশে তুরস্ক ও মধ্যপুর্বের ব্যবসায়ীদের দোকান। কাবাব, দুরুম রোল, সাবার্মা সবই পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে সেখান থেকে খাবার কিনে নি। ফ্রান্প্রিক্স আর সিটি স্টোর থেকে কেনা হয় রান্নার জিনিস। কলা, দুধ, ডিম। শিল্পচর্চা ভালই হচ্ছে, সঙ্গে চলছে শহর দর্শন। ইহুদি পাড়ায় থাকা হুই দে হোসিয়ের ফুড স্ট্রিট, যা 'ফলাফল' স্যান্ডউইচের জন্যে নাম কিনেছে। অ্যাভেনিউ দে ফ্রান্স, জার্দাঁ দু লুক্সেম্বুর্গ এর উদ্যান এবং প্রাসাদ, ল্যাটিন কোয়ার্টারের বিস্ময়কারী গলিঘুঁজি, গারে দে নাঁর ও গারে দে লিওর ট্রেন স্টেশন, প্যান্থেনন স্মৃতিসৌথ যেখানে ভিক্টর হিউগো আর ম্যারি কিউরির কবর আছে, সাঁত-শাপেলের গথিক গির্জা সবই দেখা হয়েছে একে একে।
কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে এমনিই রাস্তা দিয়ে অথবা সেইন নদীর ধার দিয়ে হেঁটে বেড়াতে। দুর্বোধ্য নামগুলো মনে রাখি জোর করে, দিকচিহ্ন ভুলে মেরে দিই। কিন্তু পদচারণা চলে অবিরত। এক একটা পাড়া যেন এক একটা রঙের। জাফরানি, আসমানি, সবজেটে আমেজ পড়ন্ত সূর্যালোকে বদলে বদলে যায়। হঠাৎ হঠাৎ কানে আসে চেলো, বেহালা অথবা অন্য কোনও বাদ্যযন্ত্রের সুর। রং বেরঙের ম্যাকারন বিস্কুট উঁকি মারে বেকারির দরজার পিছন থেকে, গরম কফির সুবাস ভেসে আসে। গানের তালে তালে জোড়া পায়ের কেরামতি থমকে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের, নদীর ধারে একদল মানুষ নাচছে। হাসির তরঙ্গে মিশে যাওয়া কথার ঢল। নিরুত্তাপ। আমুদে। রোমান্টিক। প্যারিসিয়ান।
কোনোদিন বাসে বা মেট্রো করে চলে যাই বহুদূর। জৌলুস আর স্বপ্নের উর্ধ্বে থাকা মেটে রঙের রাস্তায়। শহরতলি। আফ্রো-ইউরপিয়ানদের দোকানপাট। হাট বাজার। পশমের শাল। স্কার্ফ। স্ট্রিট আর্ট। বৈপ্লবিক গ্রাফিতির ঝলকানি। প্রবাসী পাড়া। জেল্লা দেওয়া চকচকে রোদ্দূরের রংও অনেকটা ফ্যাকাসে সেখানে, কিন্তু সেইন নদীর না দেখা সেতুগুলো চোখে পড়ে। এক একটা দিন কেটে যায়। কতদিন আর সময়? অমোঘ নিয়তির টানে দূরদেশ থেকে এসে উপস্থিত হয়েছি এ শহরে, কিন্তু আলাপচারিতা দীর্ঘায়িত হবে কী করে? রাতের বেলা আলো ঝলমল রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় অনুভব করি বিদায়ের আসন্ন মুহূর্ত। আরো একটা দিন চলে গেল। প্যারিস ছেড়ে চলে যেতে হবে দু’এক দিন পর, সেটা ভাবলেই মন কেমন করে ওঠে।
এরই মধ্যে একদিন বিকেলে এসে পৌঁছালাম মঁমার্তে। শতাব্দীপ্রাচীন শিল্পী পাড়া। অনেকটা প্রাচ্য মধ্যযুগীয় বাড়িঘর এখনও টিকে আছে এখানে, দেখলেই অদ্ভূত এক ভাব জেগে ওঠে। কত মনীষী আর অচেনা শিল্পীর দল জীবন আর মৃত্যুর হিসেব রেখেছে মঁমার্ত। মোঁপারনাস আর মমার্তে হাজার হাজার শিল্পীরা বাসা নিয়ে থাকত সত্তর বছর আগেও। এইখানেই ভাই থিওর সঙ্গে বছর দুয়েক থেকেছিলেন ভ্যান গঘ। পিকাসোর বাড়ি, সালভাদোর দালির স্টুডিও, ওয়াইন তৈরি করার জন্যে আঙুরের বাগান। কাছাকাছি ভিড় করে আছে বিখ্যাত সব নাইট ক্লাব আর ক্যাফেহাউস। জ্যাঁ পিয়্য়া জুনের ‘কাল্ট’ সিনেমা ‘অ্যামিলি’-র অনেকটাই চিত্রগ্রহণ হয়েছিল মঁমার্তের সুদৃশ্য ক্যাফেগুলোতে। এককালে নাইট লাইফ আর ক্যাবারের প্রতীক হয়ে থাকা মল্যা রুঁজ আর তার মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা পরিচিত হাওয়া কল। আজও প্রতিদিন নাচ গান সহ পানাহার চলে সেখানে, বসার জায়গা পাওয়া যায় না। হাজার হাজার ইউরো উড়ে যায় একরাতে।
মমার্ত অঞ্চলটা বেশ উচ্চতায়। চড়াই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুগ্ধ হয়ে কল্পনা করছি ইতিহাস। রেনোয়ার আঁকা 'মঁমার্তের একটি উদ্যান' ছবিটার সঙ্গে মিল খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছি। এইখানেই থেকে গেছেন লুত্রেক, সুজান ভালাদোন, এডগার দেগা, ক্লদে মোনে, গিয়ম অপোলেনিয়ার। ১৮৮১ সালে রোদাল্ফে সালি পিয়ানো বাজানোর জন্যে ছোট্ট এক ক্লাব খুলে বসেন এখানে, ক্যাবারে সংস্কৃতির সেই প্রথম ক্যাবারে কালো বেড়াল বা ‘Le Chat Noir’ আড্ডা হয়ে ওঠে বোহেমিয়ান শিল্পীদের। এ ছাড়াও শিল্পের বহু যুগান্তকারী কাজের সাক্ষী হয়ে আছে এই পাড়া। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে যে শিল্প বিপ্লব ঘটেছে প্যারিসে, তার প্রায় অর্ধেক একজন মানুষের মাথা থেকে বেরিয়েছিল। তিনি গিয়ম অপোলেনিয়ার।
শিল্পের প্রচলিত আঙ্গিক ছাড়া বাকি সব কিছুই অবজ্ঞার চোখে দেখার একটা স্বাভাবিক অভ্যেস ছিল সে যুগের শিল্প সমালোচকদের। কিন্তু অপোলেনিয়ার সে সব আমল দেননি। নিজে একজন কবি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রচুর উৎসাহ ছিল চিত্রকলা, ভাস্কর্য্য, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদিতে। পিকাসো এবং জর্জ বারোক সহ বহু শিল্পী তাঁর বন্ধু ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনার ফলেই সূত্রপাত হল কিউবিজমের। এদিকে অপোলেনিয়ার একের পর এক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কবিতা ও আঁকা নিয়ে। শিল্পে যে সব কিছু পরিস্কার করে জানিয়ে দিতে হবে, এই মতবাদে তাঁর মোটেই বিশ্বাস ছিল না। আলোছায়া, ধোঁয়াশা ও রহস্যময়তার মোড়কেই যে শিল্পের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে, এই যুক্তি দিয়েই তিনি সুরিয়ালিজমের উন্মেষ ঘটালেন।
আন্দ্রে ব্রেঁতোকে সুরিয়ালিজমের প্রধান বলে মনে করা হয় ঠিকই, কিন্তু এর সূচনা হয়েছিল অপোলেনিয়ারের কাজ থেকেই। কিন্তু শিল্পদর্শন সেখানেই থামেনি, এর পরেই তিনি কবিতার জগতে আরেকটা বিপ্লবের সূচনা করে বসলেন। সেই আবিষ্কারের নাম 'ক্যালিগ্রাম'। ক্যালিগ্রাফি আর ইডিওগ্রামের সংযোগে তৈরি এই আঙ্গিক কবিতার জগত আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। আগে একটা ছবি এঁকে তাঁর কবিতার শব্দ সাজানো শুরু করলেন রেখাচিত্রের ওপর। কবিতার নামও ছবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লিখতেন, যেমন 'বৃষ্টি' কবিতার স্তবকগুলো বৃষ্টির ফোঁটার মত তেরছা হয়ে মাটিতে নেমে আসছে। ফলে আধুনিক কবিতার দিশাই পাল্টে গেল। শুধু ক্যালিগ্রাম কবিতা নয়, সারা পৃথিবীর কবিরা প্রচলিত আঙ্গিকের ওপর নির্ভর না থেকে ভাবপ্রকাশের নতুন পন্থা খুঁজতে শুরু করল।
Its Raining-calligram |
মমার্তের বিভিন্ন পাড়া থেকে রাস্তাগুলো ওপরে উঠে পিঠোপিঠি মিশেছে যেখানে, সেখানটাকে বলা হয় 'আর্টিস্ট স্কোয়ার’। শিল্পীরা সেই চত্বরে ক্যানভাস টাঙিয়ে ছবি বিক্রি করছেন, টুরিস্টদের ছবি আঁকছেন। আর্টিস্ট স্কোয়ারের চারিদিকে কোবাল্ট পাথরের রাস্তা, ছোট ছোট জমজমাট পাব আর রেস্তোরাঁর টেবিলে উপচে পড়া ওয়াইনের পাত্র সূর্যাস্তের অপেক্ষায়। বোরদো ওয়াইনের দুটি পাত্র নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম আমরাও। খানিকটা এগোলেই পাহাড়ের উচ্চতম বিন্দুতে স্যাক্রে ক্যুর গির্জার চত্বর, তার সামনে থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে প্যারিসের বুকে। পুরো শহরটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, লোকে বিয়ারের ক্যান হাতে বসে আছে সিঁড়িতে। নানা বয়সের, নানা দেশের মানুষ। সন্ধ্যের গোলাপি আমেজ, গুঞ্জন আর গানের মাঝে গিটারের সুর, অলস হাসির ফোয়ারা। আলতো চুমু। প্রেমের ঝিলিক।
যাপনকথার এই মুহুর্তে চেনা দৃষ্টির অন্তরালে এসে দাঁড়িয়েছে আরো অনেক মানুষ। যারা বেঁচেছিলেন এই শহরকে ভালোবেসে, চেনা পথ আর প্রিয় বন্ধুদের কৌতুকে, পানীয়ের আসরের উত্তেজনায়, কেউ হয়তো সঙ্গী পেয়েছেন পরবর্তী জীবনে, বাকিরা নিভৃতে একাকী জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন প্রেয়সীর সঙ্গে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই প্রেয়সীর চোখের তারায় একটা একটা করে আলো ফুটে ওঠে আজও, যেমন ফুটছে আজ। এই অপেক্ষাই তো জীবন...অন্য জীবন...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন