বার বার তবু জেনেছি আমি আদরের ল্যান্ডস্কেপ
ছোট্ট উঠোনে, বেমানান তার বিষাদগ্রস্ত নাম
ভয় পাওয়ানো অতলে কাকে হারানোর আক্ষেপ?
বার বার তোর হাতে হাত রেখে হেঁটে চলে যাই চল
প্রাচীন গাছের ছায়া মেখে থাকা সুপ্ত মনস্কাম
ফুলের শয্যা, আকাশের দিকে চেয়ে থাকি অবিচল
~রাইনার মারিয়া রিলকে
১) পরিযায়ী পাখিদেরও একটা বাসা থাকে। দীর্ঘ উড়ানের পর এক সময় তারা ঠিকই ফিরে যায় পরিচিত আস্তানায়। শিকড়ের টানে। কিন্তু পিছুটান যদি না থাকে? তাহলে? বাড়ির চৌহদ্দির ছবি আমার অবচেতনে ফুটে ওঠে না। পরিচিত মানুষের মুখ দেখার জন্যে আমি ছটফট করি না। পরিযায়ী পাখি হতে পারিনি ঠিকই, যাযাবরবৃত্তি করার সাহসও হয়নি। বাস্তব জীবনের চাকায় পিষ্ট হয়ে কেটে চলেছে সময়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছি, এই কাঠামোর মধ্যে বেঁচে থাকাই আমাদের জীবন। আপাত যুক্তিহীন। উদ্দেশ্যহীন। এবং অতীব বিপজ্জনক। প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে চলা। গতে বাঁধা সুখ, দুঃখ, আশা, অনুতাপ, হাসিঠাট্টার মাঝে আচমকা পথের ছবি মাথায় ভিড় করে আসে। সব কাজ ছেড়েছুড়ে তখন বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশের পথে।
এটারনাল ট্রাভেলিং সিন্ড্রম বলে একটা কথা আছে মনোবিদদের ভাষায়। এই রোগে আক্রান্ত মানুষেরা পথের টানেই বেঁচে থাকে। বেশিদিন ঘরে থাকলেই তাদের শরীর শুকিয়ে যায়, চোখের তলায় কালি পড়ে, অথবা চেহারায় কিছু বোঝা না গেলেও ভিতরে ভিতরে তারা অস্থির হয়ে ওঠে। কোনও একটা জায়গায় দীর্ঘদিন কাটালে তারা কিছুতেই সুখে থাকতে পারে না। আমাকে পরীক্ষা করে একজন মনোবিদ বলেছিলেন, আমার মধ্যেও সেই রোগের লক্ষণ আছে। সত্যি যদি তাই হয়, তাহলে আমি ভূতের রাজার বর পেয়েছি বলা চলে। দীর্ঘদিন ধরে এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার এই যাত্রা আমার কোনোদিনই একঘেয়ে বলে মনে হয় না, বরং প্রত্যেকবার নতুন ছেড়ে আসা জায়গার জন্যে যতটা মনখারাপ হয়, ততটাই নতুন দেশ দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকি। তবে সব বরের সঙ্গেই কিছু সাইড এফেক্ট থাকে, এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা নেই। পথে ঘুরতে ঘুরতে, এক শহর থেকে অন্য শহরে জীবন কাটাতে কাটাতে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করেছি, আমার আর সে অর্থে কোনো শিকড় নেই। বাড়ি বলে যে ছবিটা আমার মনে ভেসে উঠত, সেই চৌহদ্দির ছবি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। এই মুসাফিরনামা, এই নিরন্তর যাযাববৃত্তিরর মধ্যেই আমার সুখের চাবিকাঠি, আমার অস্তিত্ব। আমি এক শহর থেকে অন্য শহরে ভেসে যাই, সেই শহরটাও ভেসে যায় সময়ের নিয়মে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় তার পথঘাট। মানুষজন। চিন্তাধারা। আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে না সে। দৈবাৎ যদি কোনোদিন ফিরে যেতে হয়, আমার চোখ মানিয়ে নিতে পারে না এই বদলে যাওয়া রূপ। আমি তখনও সেই অতীতের শহর খুঁজে চলি। তখন অজানা এক অভিমানে বুক ভারী হয়ে আসে। ভেনিস থেকে অস্ট্রিয়ার শহর সালজবুর্গে যাওয়ার সময়ও জানতাম না, এই অদেখা শহরের সঙ্গে আমার মনের সুতো এত গভীর ভাবে জড়িয়ে যাবে!
সালজবুর্গ। আল্পসের রানি। সল্ট মাইন ক্যাপিটাল। এবং মোৎসার্ট-এর জন্মস্থান। বর্তমানে এই শহর ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীতের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। সালজাক নদীর ধারে আল্পসের কোলে অবস্থিত এই শহর জার্মানির সীমানার খুব কাছে। বাভারিয়ান আল্পসের অপরূপ শোভা আর সাংস্কৃতিক রুচিশীলতার এরকম সন্ধিস্থল ইউরোপেও বড় একটা নেই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যা এখানে আছে, তা হল শান্তি। এত শান্ত শহর এই সফরে আমি খুব একটা খুঁজে পাইনি।
আমরা ভেনিস থেকে ট্রেনে চড়েছি সকাল দশটার সময়ে। বাসে করে যেতে বড় বেশি সময় লাগে, তাই শেষমেশ ট্রেনে যাওয়াই স্থির হয়েছে। ভিলাক শহরে নেমে আমাদের ট্রেন বদলে সালজবুর্গের ট্রেনে উঠতে হবে। ভিলাকের কাছেই ইতালি আর অস্ট্রিয়ার সীমানা। ভেনিস থেকে প্রায় ছয় ঘন্টা সময় লাগবে সালজবুর্গে পৌঁছাতে।
আগেও বলেছি, ইউরোপের বেশিরভাগ ট্রেন ফাঁকাই থাকে। শীততাপনিয়ন্ত্রিত ট্রেন, বড় বড় কাঁচের জানলা। আরাম করে জানলার ধারে বসে বসে চলে যাওয়া যায়। এক চিলতে ক্যাফেটেরিয়া আছে, ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে কফি অথবা স্ন্যাক্স নেওয়া যায়। আমাদের সামনে একজন ভদ্রমহিলা তার ছুটকু বাচ্চাকে নিয়ে বসেছে। সে গোল গোল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এক কাপ কফি খেয়ে, বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর সামনের বাচ্চাটাকে মুখ ভেঙাতে-ভেঙাতেই ভিলাক চলে এল। ট্রেন বদল করে সালজবুর্গের ট্রেনে চড়ে বসলাম। ট্রেন চলতে শুরু করল।
বেশ খানিকক্ষণ থেকেই পাহাড় শুরু হয়েছে। সুইটজারল্যান্ডের মতনই সবুজ পাহাড়ের ঢালু জমি। অনেক নিচে ছবির মত সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। মাঝে মাঝে এক একটা শান্ত, নিরিবিলি স্টেশন আসে। বাইরের দৃশ্য ক্রমেই স্বপ্নের মত সুন্দর হয়ে আসছে। গিরিখাত, তৃণভূমি, ঘন নীল রঙের ছোট বড় হ্রদ, উঁচু উঁচু পাহাড়িয়া সেতু, তিরতিরে বয়ে চলা নদী। দেখে চোখ ফেরানো যায় না। ঠিক সুইটজারল্যান্ডের মতো, কিন্তু কী যেন একটা পার্থক্য আছে! না বলতেই বোঝা যায় যে এটা সুইটজারল্যান্ড নয়। আমরা ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বসলাম। বাইরের দৃশ্য এতই সুন্দর যে ইচ্ছে করছে সালজবুর্গ না গিয়ে ট্রেনেই বসে থাকতে। একসময় সঙ্গিনীকে বললাম, "ওই, আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। সেটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত তাতে বদলাবে না।"
সঙ্গিনী টেরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে ফেললাম, "অস্ট্রিয়াতে প্রকৃতি সুইটজারল্যান্ড থেকে বেশি সুন্দর। পিরিয়ড।"
সুইটজারল্যান্ড থেকেও বেশি সুন্দর প্রকৃতি কোথাও হতে পারে, সেটা অবশ্যই ভাবা কঠিন। অনেকে এই কথা শুনে রে-রে করে উঠতে পারে ঠিকই, কিন্তু অস্ট্রিয়ার প্রকৃতিতে একটা স্নিগ্ধভাব আছে। সুইটজারল্যান্ডের মত এখানকার পাহাড় দেখে বিস্ময়ে শ্বাসরোধ না, বরং একটা মায়াজড়ানো ভালোলাগার অনুভূতি হয়। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরলে অশ্বথতলা, পোড়া শিবমন্দির বা পদ্মপুকুর দেখে কেমন একটা অনুভূতি হয় না? অনেকটা সেরকম। অন্য কারো কাছে সেটা নাও হতে পারে, কিন্তু অস্ট্রিয়ার আল্পসে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বিশ্বাসে কোনও ভুল ছিল না।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময়ে সালজবুর্গ ট্রেন স্টেশনে নেমে পড়লাম। ট্রেন স্টেশনের জার্মান নাম জু-বানহফ (Zug-Bahnhof)। অস্ট্রিয়াতে জার্মান ভাষাই চলে, সব কিছুই ইংরেজির পাশাপাশি জার্মানে লেখা আছে। পর্যটন বিভাগের অফিস থেকে কয়েকজন বাস স্টপে সাহায্য করার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জিগ্গেস করেই নির্ধারিত বাসে উঠে পড়লাম।
সালজবুর্গ খুব নাম করা জায়গা হলেও অন্যান্য মেট্রোপলিটান শহরের মত ব্যস্ততা চোখে পড়ে না। শান্ত, সবুজ পরিবেশ। লোকজন আছে, গাড়িঘোড়াও চলছে। কিন্তু সবকিছুই ছিমছাম, গুছোনো। বাসে করে সালজাক নদী পেরিয়ে অন্য পাড়ে এসে বাস বদলাতে হল। নদীর ধারেই বাস স্টপ। সেখান থেকে বাস নিয়ে আমরা চললুম কুর্জেরওয়াগের দিকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শহরের বাড়িঘর পেরিয়ে দু'দিকে সবুজ মাঠ, জঙ্গল ও পাহাড় চলে এল। শহরের প্রায় গায়ে লেগে আছে প্রকৃতি, পা বাড়ালেই তার নাগাল পাওয়া যায়। মিনিট পনের পর যেখানে আমরা নামলাম, সেই অঞ্চলটা নিঝুম। বাসের একটা রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। দু'দিকের পাড়াগুলো একদম শান্ত। পাখি ডাকছে অনবরত। বাংলো ধরনের কয়েকটা বাড়ি আছে, খানিকটা হেঁটে গেলেই একটা নদী, তারপর দিগন্তপ্রসারী প্রকৃতি, জঙ্গল আর পাহাড়।
আমাদের গন্তব্যও এখানেই কোথাও। হেঁটে হেঁটে গলি দিয়ে সেখানে চলে এলাম। সাদা রঙের দু'তলা বাড়ি, সামনে অনেকখানি বাগান। বাগানে সাদা চেয়ার-টেবিল পাতা, সেখানে বসে কয়েকজন গল্প করছিল। আমাদের দেখেই টি শার্ট পরা মাঝবয়সী একজন এসে হাত জোড় করে হেসে বলল, "নমস্তে। আই অ্যাম হ্যারি।"
Harry and Eva's Home |
হ্যারি আর তাঁর স্ত্রী এভা যে ভারতপ্রেমিক, সেটা আমরা আগেই জেনে গিয়েছিলাম। আসার আগে আগে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে। দুজনেই বেশ কয়েকবার ভারতবর্ষে গেছে, হ্যারি তো দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এসেছে সেখানে। প্রায় ছয়-সাত বার ভারত সফর করেছে সে, ভারতবর্ষের আচার অনুষ্ঠান খাওয়া দাওয়া নিয়ে তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। আমরাও হেসে হিন্দিতে হ্যারিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর সঙ্গে এগিয়ে চললাম ভিতরের দিকে। পরবর্তী সময়ে হ্যারি আর এভার সঙ্গে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। তাঁদের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে পরবর্তী জীবনের পরিকল্পনা, সব কিছুই আমাদের প্রভাবিত করেছে। গত কয়েক বছরে এই সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে, এখনও মাঝেমধ্যে কথা হয়।
হ্যারিদের বাড়িটা সুন্দর করে সাজানো। দুজনেই অনেক দেশে বেড়াতে গিয়েছে, ভ্রমণের সেই স্মৃতিগুলো দেওয়ালে ফ্রেম করে বাঁধানো আছে। আমাদের ঘরের সামনেও একটা ছোট্ট খোলা বালকনি, সেখানে বসার জন্য চেয়ার-টেবিল রাখা আছে। এভার সঙ্গেও দেখা হল। বেশ লম্বা ভদ্রমহিলা, আমাদের নিচে ডাইনিং রুমে নেমন্তন্ন করলেন চা কফি খাওয়ার জন্যে। আমি তৈরি হয়ে নিচে যেতেই কফির আয়োজন হয়ে গেল। খেতে খেতে আমরা গল্প করতে লাগলুম।
আমি তারিফের সুরে করলাম, "তোমাদের বাড়িটা এত সুন্দর! আমাদের দেশে এত বড় বাড়ি করার কথা ভাবাও যায় না।"
হ্যারি হেসে বলল, "সে কথা ঠিক। আমি তো ছয় মাস আট মাস করে ভারতে গিয়ে থেকেছি। বাইকে করে গোয়া থেকে মুম্বাই দিল্লি অনেক জায়গায় গেছি। তাছাড়াও ইরান, পাকিস্তানের মতো অন্যান্য দেশেও গেছি। সেখানে এরকম বাড়ি করতে বহু টাকা লাগে। এখানে লোকজন কম, খুব একটা সমস্যা হয় না। তবে লেবার ল কড়া, অন্যদের দিয়ে কাজ করালে খরক সামলানো অসম্ভব। আমরা এই বাড়ির সব কাজই নিজেরা করেছি। ইঁটের গাঁথুনি ঠেকে শুরু করে রঙ করা, বাগানের মাটি কোপানো, লাইটের কানেকশন... বহু বছর লেগেছে। অথচ আজকাল আমরা প্রায় মাস ছয়েক বাড়িতে থাকিই না, দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। তখন বাড়িটা ভাড়া দেওয়া থাকে। এখানে থাকলে অবশ্য এয়ার বিএনবির মাধ্যমেই লোকজন আসে।"
আমি একগাল হেসে বললাম, "তুমি দেখছি সারা দুনিয়া চষে ফেলেছ। তোমাকে দন্ডবৎ প্রণাম ঠুকছি গুরুদেব। আমি এই তোমার চ্যালা হলাম আজ থেকে। তোমাকে গুরু বলেই ডাকব।"
সেই শুনে হ্যারিও হেসে বলল, "অথচ কী জানো, এখনও ইউরোপটাই অনেকটা দেখা হয়নি। তোমরা তো স্পেন ঘুরে এসেছ, আমি এখনও যাইনি। পরের বছর আমরা ক্যানারি আইল্যান্ড যাব ভাবছি। সেইজন্যে স্প্যানিশ শিখতে হচ্ছে। "
ততক্ষণে সঙ্গিনীও নেমে এসেছেন। তাঁকে কফি দিয়ে এভা বলল, "আমাদের শহরটাও খুব সুন্দর। খুব শান্ত। কোনোরকম অশান্তি নেই। তোমরা ভালো করেছ খানিকটা সময় নিয়ে এসেছ। অনেকে হুড়োহুড়ি করে আসে, জায়গাটার পরিবেশটাই বুঝতে পারে না। ওই কয়েকটা দেখেই হুড়োহুড়ি করে পালায়। তোমরা বরং একটা সালজবুর্গ কার্ড নিয়ে নাও। খুব সস্তা, অনেক জায়গা দেখে নিতে পারবে। আমি তোমাদের সব বলে দেব। আজকে বরং বাড়ির পিছন দিকটা ঘুরে এসো। কিছুটা গেলেই নদী পেরিয়ে জঙ্গল পাবে, সেখান থেকে অনেক দূরের পাহাড়ও দেখা যায়। বাসরাস্তা দিয়ে মিনিট পনেরো হাঁটলে একটা অস্ট্রিয়ান রেস্তোরাঁও আছে। নাম লাসেনস্কিহোফ। খুব ভালো স্থানীয় খাবার পাওয়া যায়, দামও বেশি নয়। আমরাও মাঝে মাঝে খেয়ে আসি। ইচ্ছে হলে সেখানেও ডিনার করে নিতে পারো।"
ততক্ষণে সঙ্গিনীর সঙ্গে স্প্যানিশ শেখার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে হ্যারির সঙ্গে। একসময় সে জিগ্গেস করল, "এখানে ভারতীয়রা আছে নাকি?"
হ্যারি মাথা নেড়ে বলল, "অনেক ভারতীয় আছে। খুব শান্তিপ্রিয়, ঝঞ্ঝাট ঝামেলা এড়িয়েই চলে ওরা। এশিয়ার অন্যান্য জায়গার মানুষও আছে। এখন অন্যান্য জায়গা থেকেও লোকজন আসছে। কী জানো, মিডিল ইস্ট অথবা আফ্রিকা, যেখান থেকে খুশি লোক আসতেই পারে! গৃহযুদ্ধের ফলে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে অনেক ইমিগ্র্যান্টকেই নেওয়া হয়েছে, তবে সত্যি বলতে কি সকলেই তো মানুষ ভালো নয়। আগে সালজবুর্গে ছোটখাটো চুরি পর্যন্ত হত না। আজকাল মাঝে মাঝেই ছোট খাটো অপরাধ হচ্ছে... ডাকাতি, গুলিবাজি। তদন্ত করলে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগই অন্যদেশীয় লোকের কাজ। উপরি ইনকামের জন্য এইসব করে। আমরা তো বরাতজোরে প্রিভিলেজড, অস্বীকার তো করা যায় না! সমস্যা হল এই সবের ফলে রাইট উইং নেতারা আরো বেশি করে বিদ্বেষ ছড়ানোর মালমশলা পেয়ে যাচ্ছে।"
মাথা নাড়লাম। ইমিগ্র্যান্ট সমস্যা নিয়ে ইউরোপের শান্ত দেশগুলো ইদানীং কালে বারবার ক্ষোভ উগরে দিয়েছে। সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় কয়েক মিলিয়ন শরনার্থী সেখান থেকে পালিয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। এত লোককে আশ্রয় দেওয়ার ফলে যে তাদের কোনও রকম সমস্যাই হয়নি সেটা ভাবা খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে, অনেকেই এই সুযোগে ব্যক্তিগত গায়ের ঝাল মেটাতে নেমে পড়েছে। অতি দক্ষিণপন্থী পার্টির নেতারা আরব শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে নারাজ। অস্ট্রিয়া, নেদরল্যান্ডস, পোল্যান্ড সহ অনেক দেশেই গত কয়েক বছরে রাইট-উইং নেতাদের জনপ্রিয়তা হু-হু করে বেড়ে চলেছে। অস্ট্রিয়ার একত্রিশ বছর বয়সী চান্সেলর সেবাস্টিয়ান জুর্কের অ্যান্টি-ইমিগ্র্যান্ট পলিসি তাঁকে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে। ফ্রান্স ও জার্মানির মতো কিছু দেশের জন-প্রতিনিধিরা শরণার্থীদের পক্ষ টেনে কথা বললেও অল্টারনেটিভ ফর জার্মানির মতো কিছু দলের তুমুল সাফল্য দেখেই বোঝা যায় যে রাইট-উইং নেতাদের সমর্থন ক্রমেই বাড়ছে। এই সমস্যার কোনও সহজ সমাধান নেই। সময়ই বলে দেবে ইউরোপের ভবিষ্যৎ কোনদিকে চলেছে?
আরো খানিকক্ষণ গল্প করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। পাড়া বেড়ানো যাকে বলে! কিন্তু এই পাড়ায় একটা নদী আছে, ঘন জঙ্গল আছে, দিগন্তখোলা মাঠ আর ঘাসের জঙ্গল আছে, খরগোশ, হরিণ আর পাখি আছে, এমনকি পাহাড়ও আছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শান্ত রাস্তা ধরে কাঠের বাংলো বাড়িগুলো পিছনে রেখে নদীর সামনে চলে এলাম। সরু নদী, তিরতির করে জল বইছে। একটা ছোট্ট ব্রিজ নদী পেরিয়ে জঙ্গল আর পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। দু' একজন কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে, কয়েকজন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। অস্ট্রিয়াতে প্রতিটা স্কুলে নিয়ম করে সাইকেল ও সাঁতার শেখানো হয়, এমনকি সাইকেল চালানোর পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্সও নিতে হয় বলে শুনেছি।
বাতাসে বেশ আদুরে শীত শীত ভাব। ফের পাহাড়ি অঞ্চলে চলে এসেছি, ইতালির মত গরম না থাকারই কথা। হেঁটে হেঁটে শুকনো পাতা মাড়িয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলতে লাগলাম। কয়েকটা গাছ এত পুরোনো যে ডাল থেকে শিকড় মাটিতে ঢুকে গেছে। উঁচুনিচু জঙ্গুলে পথ। মাঝে মাঝে খরগোশ লাফিয়ে পালায়। খানিকটা এগোতেই একটা প্রকাণ্ড ঘাসের জঙ্গল, জংলা ঝোপ আর ছোট ছোট পুকুর। কাকচক্ষু জল শেষ বিকেলের আলোয় জগমগ করছে। মাঠের অপর প্রান্ত থেকে উঁচু উঁচু পাহাড় শুরু হয়েছে। এই জঙ্গল পাহাড় বহুদূর চলে গেছে, সময় থাকলে অনেকেই সারাদিনের জন্যে হাইকিং করতে চলে আসে। সূর্য অস্ত যাবে এক্ষুনি, আমরা আর না এগিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মনে মনে হ্যারি আর এভাকে হিংসেই হল। এদের কী ভাগ্য! পাড়ার মধ্যেই আস্ত পাহাড়, জঙ্গল নিয়ে বসে আছে। জীবনে আর কী চাই?
বাসের রাস্তা ধরে এভার বলে দেওয়া রেস্তোরাঁয় পৌঁছাতে মিনিট কুড়ি মতন লাগল। আসলে এটা একটা থাকার হোটেল, নিচে রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। বেশ সাজানো-গোজানো। গ্রীষ্মকালে ইউরোপে কেউই বন্ধ জায়গায় খেতে ভালোবাসে না, সুতরাং রেস্তোরাঁর চেয়ার সব খালি। লোকেরা ভিড় জমিয়েছে বাইরের ওপেন এয়ার ডাইনিং-এ। ছিমছাম করে পাতা টেবিল চেয়ার। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেল। একেবারে চোস্ত অস্ট্রিয়ানদের মতোই স্থানীয় পানীয় এবং খাবার বলে দিয়েছি। ড্রাফট বিয়ারের সসের মধ্যে মাংসের স্টিক, সঙ্গে খানিকটা করে ভাত, স্যালাদ আর আলুভাজা। বেশ ভারী খাবার। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে খাওয়াদাওয়া সারা হল। রাতে বাড়ি ফেরার সময়েও হাঁটা। দু'দিকের জঙ্গল মধ্যে দিয়ে নির্জন রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, আকাশে পরিষ্কার চাঁদ উঠেছে।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে দেখি এভা আমাদের জন্যে রাজ্যের রান্না করেছে। নানা ধরনের পাউরুটি, জেলি, কর্নফ্লেক্স, ফল, সালামি, বেকন, জুস তো আছেই, তার সঙ্গে হাতে তৈরি করা মার্মালেদ, স্যালাদ, ডিমের ওমলেট। শেষ আর হয় না। খেতে খেতে সঙ্গিনী এভাকে জিগ্গেস করলেন, "কাছাকাছি এত জায়গা, কোথা থেকে শুরু করি বল তো?"
এভা বলল, "হ্যারি বলছিল 'লেক এন্ড মাউন্টেন হপ অন হপ অফ' একটা নতুন বাস শুরু হয়েছে। ওতেই বরং চলে যাও। আশেপাশের অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখতে পাবে অনেকক্ষণ ধরে। টাকাও বাঁচবে।"
সেই কথাই রইল। দু' কাপ কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাসে করে গেট্রাইডেগাস অঞ্চলে পৌঁছে পর্যটন বিভাগের অফিস থেকে লেক এন্ড মাউন্টেন বাসের টিকিট ছাড়াও সালজবুর্গ কার্ড কেনা হল। আজ সেটা ব্যবহার করা হবে না, কারণ আমরা চলেছি শহরের বাইরে। গেট্রাইডেগাস আসলে সালজাক নদীর সমান্তরালে চলে যাওয়া একটা সরু গলি, তার আশেপাশেই সালজবুর্গ শহরের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মোৎসার্টের বাড়ি, রেসিডেন্টপ্লাৎজের গির্জা, প্রাসাদ ও মিউজিয়াম ছাড়াও পিছনদিকের পাহাড়ের ওপরেই অবস্থিত সালজবুর্গ-এর দুর্গ।
আমাদের অবশ্য এখনই এই অঞ্চলে ঘোরার সুযোগ হবে না। সাড়ে দশটার সময় মিরাবেল গার্ডেনের সামনে থেকে বাস ছাড়বে, অতঃপর সালজাক নদীর সেতু পেরিয়ে অন্য দিকে চলে এলাম। এই সেতুটি শুভুমাত্র পথচারীদের জন্যে, প্যারিসে অবস্থিত লক সেতুর মতো এখানেও অজস্র তালা লাগানো আছে সেতুর গায়ে। এখনও সেগুলো খুলে নেওয়া হয়নি। নিচে নদীর স্বচ্ছ জল খুব গভীর নয়, কিন্তু স্রোত আছে বেশ। অপেরা হাউস পেরিয়ে মিরাবেল গার্ডেনের কাছে চলে এলাম। এই উদ্যানের কথা সালজবুর্গের প্রতিটা মানুষেই জানে, ফুলের সাজে সারা বছর অনন্য সুন্দর হয়ে থাকে মিরাবেল গার্ডেন। উদ্যানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা আর্ট গ্যালারিও আছে, বারোক শৈলীর শিল্পকর্মের নিদর্শন। কিছুক্ষণ মিরাবেল গার্ডেনে গার্ডেনে ঘোরাফেরা করে আমরা নির্ধারিত জায়গা থেকে গিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। বাসের সিটের সঙ্গে একটা করে ইয়ারফোন দেওয়া আছে। বাস যেখান দিয়ে যাবে, ইয়ারফোনে সেই জায়গা সম্পর্কে সব বিবরণ দিয়ে দেওয়া হবে। বেশ ভালই ব্যবস্থা। আমরা লেক ফুসলে(Fuschl) হয়ে সেন্ট গিলগেন যাব, সেখান থেকে লেক উলফগ্যাঙ হয়ে এগিয়ে যাব মন্ডসের দিকে। যেখানে খুশি নেমে পড়তে পারি, ঘুরে ফিরে পরের বাসে উঠে পড়লেই হবে।
দু'দিকের সবুজ পাহাড় আর ঢালু ঘাসজমির মাঝ দিয়ে চকচকে রাস্তা হারিয়ে গেছে পাহাড়ে। লেক ফুসলের দেখা পেলাম মিনিট কুড়ির মধ্যেই। পাহাড় ঘেরা নীল রঙের হ্রদ, অপূর্ব সুন্দর। এখানে কোনও গ্রাম নেই, কিন্তু সেন্ট গিলগানের কাছে কয়েকটা ছবির মতো পাহাড়ি গ্রাম আছে। বাসও চলেছে সেই দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলের সবটুকুই হিটলারের কবলে ছিল। নাজি পার্টির আরেক নেতা হাইনরিখ হিমলার সেন্ট গিলগেনে তৈরি করিয়েছিলেন দাচাউ কনসেনট্রশন ক্যাম্প, যেখানে ইহুদি বন্দিদের এনে রাখা হত। বন্দীদের ওপর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর নারকীয় অত্যাচার তো চলতই, সেই সঙ্গে নানা ডাক্তারি পরীক্ষা-নীরিক্ষাতে গিনিপিগ করা হত তাদের। কত লোকে যে দাচাউ কনসেনট্রশন ক্যাম্পে মৃত্যু বরণ করেছে, সেই ফিরিস্তি দেখলে চমকে উঠতে হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দিক থেকে যুদ্ধ করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে অস্ট্রিয়া জার্মানির সঙ্গ দেয়নি। অস্ট্রো-হাঙ্গারি রাজ্য অনেকদিন আগেই ভেঙ্গে গেছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধবস্ত হওয়ার পর আবার তারা যুদ্ধে যেতে চায়নি। কিন্তু মানসিকতায় খুব একটা বদল আসেনি। অনেকেই মনে মনে হিটলারের মনোভাবকে সমর্থন করত, জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সম্পর্ক তো আজকের নয়। ভাষাগত সাদৃশ্য তো আছেই, সংস্কৃতিও অনেকটা একরকম। এখানকার বিখ্যাত কবি, লেখক, শিল্পীরা অস্ট্রিয়া আর জার্মানিতে কোনোদিনই পার্থক্য করেননি। মরিয়া হিটলার সেই আবেগের সুযোগ নিয়ে সারা অস্ট্রিয়া থেকে ছেলেদের নাজি সৈন্যদের দলে ঢুকিয়ে দেয়। অস্ট্রিয়ার ওপর চড়াও করে অকপটে হুকুম চালাতে শুরু করে হিটলার-হিমলার জুটি।
সেন্ট গিলগেনের অসামান্য প্রকৃতি দেখে অবশ্য ইতিহাসের সেই কথা মনে পড়ে না। প্রকৃতি এখানে সব সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে। বাস থেকে নেমে পড়ে ততক্ষণে আমরা জলের দিকে এগিয়ে গিয়েছি। লেক উলফগ্যাঙ-এর বিস্তীর্ণ হ্রদের ওপর আকাশ এবং সবুজ পাহাড়ের রং প্রতিফলিত হচ্ছে। নৌকো করে হৃদের অন্যপাড়ে গিয়ে মাউন্টেন রেল অথবা কেবল-কার করে পাহাড়ের মাথায় উঠে যাওয়া যায়, সেখান থেকে দেখা যায় বহুদূরের হ্রদ আর ভূদৃশ্য। আমাদের হাতে অত সময় নেই। অনেকক্ষণ ধরে লেক উলফগ্যাঙ-এর ধারে বসে রইলাম। জলের ওপরে রাজহাঁস সাঁতরে বেড়াচ্ছে। উঠতে ইচ্ছে করে না। একসময় উঠে পড়তেই হল। কাছেই আইসক্রিমের দোকান। আইসক্রিম খেতে খেতে ঘুরে গ্রামটাও দেখা হল।
সালজবুর্গের এই অঞ্চলের নাম সায়েসকামাগুট (Salzkammergut), সেন্ট গিলগেনের মতন অনেক ছোট ছোট গ্রাম, হ্রদ ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। এই গ্রামগুলোকে এক কথায় বলা হয় 'মোৎসার্ট ভিলেজেস'। প্রকৃতির সান্নিধ্যে খানিকটা সময় কাটানোর জন্যে অনেকেই এখানে দিন কাটাতে আসে, সেই সুত্রে সারা অঞ্চলটাই 'রিসর্ট এরিয়া' করে দেওয়া হয়েছে।
সেরকমই আরেক হ্রদের ধারের জনপদ হল মোনডাসে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। বিখ্যাত মিউজিকাল ছবি 'সাউন্ড অফ মিউজিকের' অনেকটাই সেখানে তোলা হয়েছিল, বিশেষ করে ছবিতে দেখানো হলুদ রঙের গির্জাটি দেখতে আজও প্রতিদিন বহু মানুষ আসে। মোনডাসে ঘুরে আমরা পাহাড়ের আরো দূরের গ্রামগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম একসময়। এই পাহাড়ি অঞ্চলের মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা ঢালু জমিতে শীতের সময় স্কিং করার জন্যে এসে হাজির হয় নানা দেশের মানুষ। বেশি উচ্চতায় গ্রাম যে কটা আছে, নেহাৎই কয়েক বাড়ি নিয়ে তৈরি। কিন্তু তারা যে সম্পন্ন, গ্রামের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। কয়েকটা কারখানাও নজরে পড়ল।
সালজবুর্গে যখন ফিরে এসেছি মাঝদুপুর। এখনও হাতে অনেক সময় আছে। কিন্তু তার আগে পেতে কিছু দেওয়া দরকার। সালজবুর্গ খুব সস্তার জায়গা নয়, গেট্রাইডেগাসের গলির মধ্যে নানা ধরনের খাবার দোকান আছে বটে কিন্তু দামে কিছুই কোলাচ্ছে না। শেষমেশ আবার আমাদের পুরোনো জ্ঞাতিভাই ম্যাকডোনান্ডের শরণে গিয়ে উদ্ধার পেলাম।
গেট্রাইডেগাস অঞ্চলের পাশেই সালজাক নদীর তীরে পাহাড় উঠে গেছে খাড়া। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে থাকা এই পাহাড় আর জঙ্গল। শহরের ঠিক মাঝখানে এমন অরণ্য দেখে আমরা অবাক হলেও এখানে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আল্পস অঞ্চলের লোকেরা প্রকৃতি ছাড়া থাকতে পারে না, অনেকেই কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে নির্জন পাহাড়ি পথে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে কোনো কোনো দিন। নদীর অন্য পাড়ের পাহাড়টার নাম কাপুজিনবার্গ। আমরা আগেই ভেবে রেখেছিলাম সেখানে উঠব। খাওয়া সেরে সেই উদ্দেশে এগিয়ে যাওয়া হল।
ধাপ-ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে খানিকটা। তারপরেই চড়াই আর জঙ্গল শুরু হয়েছে। একটা মনাস্টেরিও চোখে পড়ল। মধ্যে মধ্যে জিরোনোর জন্যে বসার জায়গা আছে, সেখান থেকে সালজবুর্গ দুর্গ ও শহরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। খানিকটা বিশ্রাম নিতে নিতে এগিয়ে চললাম। জঙ্গলে নানা রকমের গাছ আছে, অনেক পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কে বলবে একটা আন্তর্জাতিক ইউরোপিয়ান শহরের কেন্দ্রে এরকম একটা নিবিড় জঙ্গল রয়ে গেছে। আবার হিংসে হল এখানকার লোকেদের ওপর।
ঘন্টাখানেক হেঁটে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেলাম। একটা চত্বর মতন আছে, সেখানে একটা গির্জা। শহরের অন্যদিকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অনেক নিচে থাকা রাস্তাঘাট, পুতুল গাড়ি, লোকজন। জনবসতি ছাড়িয়ে সবুজের উঁচু নীচু ঢিলা আর পাহাড় চলে গেছে জার্মানির সীমানা ছাড়িয়ে। কষ্ট করে পাহাড়ে ওঠার পর এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেলে কার না ভালো লাগে?
নামার সময়ে ধীরে ধীরে নামলাম। সময় নিয়ে, অন্য পয়েন্টগুলো দেখতে দেখতে। পাখির ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাঝে মাঝে একনাগাড়ে ঝিঁঝিঁদের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। অনেকটা নেমে একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সন্ধ্যে হব হব করছে। সূর্যাস্ত হবে এক্ষুনি। সালজাক নদীর আর সালজবুর্গ শহরের ওপর সূর্যের লাল রং পড়ে অপরূপ দেখাচ্ছে। সূর্যাস্ত তো অনেক জায়গাতেই দেখেছি, কিন্তু এখানে দেখছি ঘন রক্তিম রঙের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সালজবুর্গ দুর্গের ঠিক পিছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সেই আলো লেগে দুর্গের দেওয়ালগুলো সোনালি হয়ে উঠেছে। চোখ ফেরানো যায় না। এখানেও একটা সোনার কেল্লা আছে তাহলে!
একসময় নেমে এলাম সমতলে। আলো হয়ে জ্বলে উঠছে নাগরিক সভ্যতার যাবতীয় নিদর্শন। কিন্তু প্রাচুর্য্য নেই। বাড়িঘর, নদী, রাস্তা সবই একটা রহস্যের আড়ালে চলে গেছে অনুজ্জ্বল আলোর আভায়। আমাদের সম্বল বলতে পা। এই গলি সেই গলি। বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে পরিপাটি ক্যাফে-রেস্তোরাঁ, স্যুভেনিরের দোকান, বেকারি, হস্তশিল্পের নানা রকমারি দোকান। চ্যাপ্টার স্কোয়ারের কাপিটালপ্লাৎজ থেকে শুরু করে প্রতিটা দোকানের বাইরে লোহার পাতে কারুকার্যখচিত দোকানের নাম, সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। কিছুই বুঝি না। জার্মান শব্দের সঙ্গে ভাব পাতানো সহজ নয়। এদিকে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে পশ্চিমী ধ্রুপদ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান চলছে, কনসার্ট হচ্ছে। এখানকার পুতুলনাচের অনুষ্ঠানও বেশ জনপ্রিয়। টিকিট কেনার সামর্থ্য নেই, তাই বাইরে থেকেই দেখি। শুনি। মনে মনে ছবি আঁকি কল্পচক্ষুর সাহায্য নিয়ে।
রাতে আমাদের বাড়ির কাছের রেস্তোরাঁটাতেই খাওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সস্তায় স্থানীয় রান্না চেখে দেখা যায়, বাইরে বসবার ব্যবস্থাটাও সুন্দর। ফিরতি পথে ঠিক করলাম নদীর পাড় বরাবর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব। পাকা রাস্তা করা আছে বহুদূর পর্যন্ত, সেখান দিয়ে গল্প করতে-করতে হেঁটে যায় অনেকেই। হেঁটে যেতে যেতে দেখি প্রতিটা সেতুই নীল আলোয় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ল্যাম্পপোস্টার আবছা আলোয় একটা মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বড় যত্ন করে রাখা হয়েছে এই শান্ত শহরটিকে। প্রকৃতিও যেন সাজিয়ে রাখতে চেয়েছে এই সালজাক নদীর ধারের এই মুক্তোটিকে। এক ফ্রেমে পাহাড়, নদী, দুর্গ, প্রাসাদ, গির্জা আর বর্তমান জীবনের এমন সন্ধিস্থল বোধহয় খুব বেশি নেই। অস্ট্রিয়ান কবি রাইনার মারিয়া রিলকের কবিতা 'ল্যান্ডস্কেপ অফ লভ' হয়তো এখানকার কথা ভেবেই লেখা হয়েছিল। কত কত সুন্দর শহরই তো দেখলাম, কিন্তু সব শহরকে সমান ভাবে ভালোবাসা যায় না। তাদের ছেড়ে যেতে মন খারাপ করে না। পাহাড়তলির এই শহরটা যেন আমাদের অজান্তে একটা ছোট্ট বাসা করে মনের কোনায় ঢুকে পড়েছে একদিনের মধ্যেই। কয়েকদিনের মাত্র, তারপর আবার বেরিয়ে পড়ব। পিছুটান হয়তো নেই, কিন্তু মনখারাপটা রয়েই যায়। কে জানে…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন