এই ঝকঝকে মুক্তোটিকে চেয়ে দেখো
যেন গলিত রুপোর ঘুর্নিতে পড়ে গেছে
স্বচ্ছ রত্নের মাঝ দিয়ে বয়ে যাবে বলেই সে
মার্বেলের চেয়েও সাদা, স্ফটিকের চেয়েও স্বচ্ছ”
~ইবন জাম্রাক (আলহাম্বরার উদ্দেশ্যে)
আধুনিক কালে গৃহযুদ্ধ, জেহাদী সন্ত্রাসবাদ আর রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে বহুসংখ্যক ইসলামিক দেশগুলোর যে উগ্র ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে হাজার বছর আগেকার ধার্মিক মতাদর্শের আকাশপাতাল তফাৎ। সপ্তম শতাব্দীতে উমায়দ বংশের আরব মুসলমানেরা যখন দামাস্কাস অধিকার করে নিয়েছিল, সেখানের ইহুদি আর ক্রিশ্চানদের জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করানোর কোনও চেষ্টা করা হয়নি। সামান্য ছুতোয় অন্য ধর্মের মানুষের ওপর অত্যাচার করায় তাদের অনীহা ছিল। বরং শিল্প, সাহিত্য নিয়ে উৎসাহ ছিল অনেক বেশি। আরব দেশে সেই সময়ে শিল্পকলা, জ্যামিতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি ফুলেফেঁপে উঠেছিল। বেশিরভাগ সম্রাট প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী, গণিতজ্ঞ, স্থাপত্যকরদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অনেকেই চাইতেন তাদের রাজ্যকালে দৃষ্টান্তমূলক কোনো স্থাপত্য নির্মাণ করে রেখে যেতে। এই মনোভাবের কারণেই দামাস্কাস থেকে গ্রানাদা ইসলামিক শিল্পের অনন্য চিহ্ন বহন করছে।
গ্রানাদা দখল করে আরাগনের সম্রাট ফার্দিনান্দ আর কাস্তিয়ার রানী ইসাবেল যখন প্রথম এসে চাক্ষুষ করলেন আলহাম্বরা প্রাসাদের অন্দরমহলকে, তাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। রেনেসাঁ শৈলী আর বারোক শৈলীর প্রাচুর্য ছিল সে সে সময়, স্প্যানিশ গথিক স্থাপত্যে এরকম এক বিরাট রাজপ্রাসাদ তৈরি করার কথা কেউ ভাবতে পারেনি। আলহাম্বরা প্যালেস শুধু স্থাপত্য আর অলঙ্করণ সজ্জার জন্যেই বিখ্যাত নয়, এই নির্মাণের পিছনে সেকালের বহু খ্যাতিমান প্রযুক্তিবিদ, বৈজ্ঞানিক আর গণিতজ্ঞদের অবদান ছিল।
গ্রানাদার সুলতান ইউসুফ প্রথম যখন এই নির্মাণ কার্যে হাত দিয়েছিলেন, প্রতিরক্ষার কথাই তার মাথায় ছিল। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীতে নাসরেদ এমিদ মুহম্মদ বেন আল আহমার এই প্রাসাদ পুনর্নির্মাণ করে ভোল পাল্টে দিয়েছেন। ফার্দিনান্দ আর ইসেবেলার এই প্রাসাদ অধিকার করার পরেই একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল যাতে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে গেল সম্পূর্ণ ভাবে।
কয়েক বছর ধরেই ইতালির এক ছোকরা এসে ঘ্যানঘ্যান করছে আর্থিক সহায়তার জন্যে। ছেলেটি বহু দেশ ঘুরেছে জাহাজে জাহাজে, পূর্বের ওরিয়েন্টের সন্ধানে কয়েকটি জাহাজ নিয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়তে চায় সমুদ্রে। অতলান্তিকের ওপর দিয়ে পশ্চিম দিক থেকে ওরিয়েন্টে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সে সাহায্যপ্রার্থী। তিনটে জাহাজ এবং এক বছর সময় দিতে হবে থাকে। তিন বছর আগে রানি ইসাবেলা তার প্রস্তাব শুনে একটা কমিটির কাছে সেই প্রস্তাবের সত্যতা বিচার করতে বলেছিলেন, কমিটির সিদ্ধান্তে অভিযানের উদ্দেশ্য প্রতিপাদিত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ছেলেটি একদম নাছোড়বান্দা। সে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সে এই অভিযান করতে পারবে, সামান্য আর্থিক সাহায্য পেলেই সে নতুন এক রাস্তা খুঁজে বের করবে কাস্তিয়ার ব্যবসায়ীদের জন্যে।
১৪৯২ সালে আবার সম্রাটের কাছে এসেছে ছেলেটা। ততদিনে গ্রানাদার অধিকার পেয়েছে কাস্তিয়া আর আরাগনের মিলিত শক্তি। হয়তো এবার কিছু সাহায্য পাওয়া যাবে সম্রাটের কাছ থেকে। রানি ইসাবেলা প্রথমে রাজি হননি। নতুন গির্জার নির্মাণের জন্যে আগেই অনেক অর্থ ব্যায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় সম্রাট ফার্দিনান্দ ছেলেটাকে আবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন দরবারে।
সম্রাটের অনুমতি পেতে আর দেরি হয়নি। ১৪৯২ সালের অগাস্ট মাসের তিন তারিখে তিনটে জাহাজ নিয়ে পালোস দে লা ফ্রন্তেরা বন্দর থেকে প্রথম অতলান্তিকে পাড়ি দেয় ক্রিস্টোফার কলাম্বাস। এর পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। বহু গবেষকদের মতে আলহাম্বরার অতুলনীয় সৌন্দর্য দেখেই সম্রাট ফার্দিনান্দ এই অভিযানে সায় দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্য বিস্তার আর যুদ্ধ ছাড়াও যে ইতিহাস তৈরি করা যায়, এই যুক্তি বুঝতে তাকে বেগ পেতে হয়নি।
প্লাজা ইসাবেল থেকে সি থ্রি নম্বর বাস ধরে সোজা আলহাম্বরার প্রধান ফটকের সামনে হাজির হলাম। অনেকে চড়াই হেঁটে হেঁটেও আসে। লোকে লোকারণ্য। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত এই অমরাবতীতে প্রায় সাত কোটি টুরিস্ট আসে প্রতি বছর। স্পেনে তো বটেই, বিশ্বেও এতসংখ্যক পর্যটক খুব কম জায়গাতেই যায়। অব্যবস্থা এড়াতে নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে যে একসময়ে নির্ধারিত সংখ্যক মানুষই প্রাসাদের ভিতরে যেতে পারবে। অতএব টিকিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মাস তিনেক আগে থেকেই সব টিকিট ফাঁকা হয়ে যায়। বেশি দামের কয়েকটা টিকিট থাকে বটে, কিন্তু সেই টিকিট পাওয়াও মহা মুশকিল।
তবে টিকিট না থাকলেও রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন অংশ টিকিট ছাড়াই ঘুরে দেখা যায়। নাসরেদ মহল আর অন্দরমহলের কয়েকটা বিশেষ জায়গা আর উদ্যান ছাড়া প্রায় সবজায়গাতেই টিকিট না কিনে হেঁটে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। একশ মিটার নিচে প্রবাহিত দারো নদীর জল নিয়ে এসে এই উদ্যান সেঁচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেকালে, ব্যাপারটা বিস্ময়করই বটে। অ্যাকুয়াডাক্ট অথবা পাহাড়ের ওপরে জল নিয়ে যাওয়ার প্রণালী অনেক জায়গাতেই আছে, কিন্তু আলহাম্বরার বাগানের বিন্যাস দেখলে চোখের পলক বন্ধ হয় না।
প্রতিটা নির্মাণেই ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর ছাপ। ক্যালিগ্রাফিতে যে এককালে আরব বিদ্বানরা শ্রেষ্ঠ ছিল সেই সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। নানা হরফে দেওয়ালে খোদাই করে রাখা উর্দু অক্ষরে বোঝানো হয়েছে... ইশ্বরের জয়! জ্যামিতি আর ‘টেসেলেশন’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘরের ছাদগুলো এমন ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে সমান্তরাল পৃথিবীর ভাবনা দৃশ্যমান হয়। ঘরে ঘরে রঙের ছ’টা, জ্যামিতিক নকশায় তৈরি বীথিকা রঙিন সিরামিকের টুকরো আর নানান কাঠের ব্লকের সঙ্গে একত্র হয়ে একটা মায়াবী পরিবেশ রচনা করেছে। শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ রচনাকৌশল পরিদর্শকের মনকে আবিষ্ট করে রাখে। জেনেরালাইফ উদ্যান, কোর্ট অফ মিরটল, রয়্যাল কমপ্লেক্স দেখতে দেখতে সময় কোথা থেকে চলে যাচ্ছে বুঝতেও পারছি না।
১৮২৮ সালে আমেরিকান লেখক ওয়াশিংটন ইরভিং গ্রানাদায় এসে উপস্থিত হন। জোনাথন ওল্ডস্টাইল ছদ্মনামে তিনি বহুদিন ধরে লেখালিখি করছেন, কয়েক বছর আগেই 'লিজেন্ড অফ স্লিপি হল' লেখার ফলে তখন তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। ইরভিংয়ের গুণ ছিল তিনি কোনও একটা ফর্মে নিজেকে আটকে রাখতেন না। ছোটগল্প, ইতিহাস, স্কেচ বুক, রোমান্টিক উপন্যাস, বায়োগ্রাফি যা তাঁর ইচ্ছে হত সেই অনুযায়ী কলম চালাতে শুরু করে দিতেন। পরবর্তী কালে চার্লস ডিকেন্স, ওয়াল্টার স্কটের মোট নামজাদা ইউরোপিয়ান সাহিত্যিকরা তাঁকে শ্রেষ্ঠ আমেরিকান গল্পকারদের একজন বলে মর্যাদা দিয়েছিলেন।
এহেন গ্রানাদায় এসে ইরভিং যে বইটা লিখলেন, সেটার নাম 'টেলস অফ দি আলহাম্বরা’। বইটি একই সময় ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় প্রকাশিত হয়। পশ্চিম জগতের কাছে এই বই আলহাম্বরা আর গ্রানাদার পরিচিতির প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। এর পরে অজস্র বই আর উপন্যাসে আলহাম্বরার উল্লেখ হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের একটা শহরের নামই হয়ে গিয়েছে 'আলহাম্বরা'। ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীর লোকের কাছে এই প্রাসাদের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আমেরিকা আর ইউরোপের নানান অঞ্চল থেকে তো বটেই, মধ্য আরব, ইরান, ইরাক, আফ্রিকা আর এশিয়া থেকেও লক্ষ্য লক্ষ্য ভ্রমণকারী আলহাম্বরার টানে গ্রানাদায় চলে আসে।
পিছন দিকের খোলা প্রাঙ্গনে এসে দেখি সেখান থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। হেঁটে হেঁটে অনেকেরই পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে। অনেকে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে দূর দিগন্তের দৃশ্য দেখছে। পাঁচিলের ধারে ছবি তুলবে বলে ভিড় করে আছে বহু ছেলেমেয়ে, সেইদিকে না গিয়ে আমরা অন্যদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লাম। পা ছাড়ানো দরকার। আমাদের কাছেই একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁর সঙ্গে বসে দুজন ভদ্রমহিলা মোবাইলে মুকেশের হিন্দি গান শুনছেন। ইউরোপে ভারতীয়, পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশের মানুষের দেখা আকছার মেলে, অনেকেই প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পূর্বে এসে বসবাস শুরু করেছেন বিদেশে। প্রবাসে অবশ্য আজকাল দেশের সব জিনিসই মোটামুটি পাওয়া যায়, ইন্টারনেটের মাধ্যমেও জিনিসপত্র কিনে নেই লোকজন। এছাড়াও বহু লোকে বিলাস ভ্রমণ করতে আসে প্রতি বছর। প্রথম প্রথম এত ভারতীয় চেহারা দেখে অবাক হয়েছি, পরে বুঝতে পেরেছি এদের বেশিরভাগই প্রবাসী ভারতীয়। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে তারা এসেছে ঠিকই কিন্তু ফিরে যাওয়ার ঠিকানা আমেরিকা অথবা ইউরোপের অন্য কোনও দেশ, ভারত অথবা পাকিস্তান নয়।
ভদ্রলোক নিজেই আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন। তাঁর নাম নাসির, মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করলেও স্বাধীনতার এক বছর পরেই দেশভাগের দরুণ মুম্বাই থেকে লাহৌরে গিয়ে বসবাস শুরু করে তাঁর পরিবার। বড় হয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, তখন ভারতের গুজরাতে এবং অন্যান্য কয়েক জায়গায় যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমেরিকায় চলে যান, সে থেকে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। ভদ্রলোক নাকি ভারতের সঙ্গীত আর চলচ্চিত্রের একনিষ্ঠ ভক্ত। আমাকে পেয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন সে সম্পর্কে। প্রায় কুড়ি মিনিট নাসির ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে আমি বুঝতে পারলাম পাকিস্তানের নাগরিক হলেও সাধারণ ভারতীয়দের সঙ্গে তাঁর বিন্দুমাত্র তফাৎ নেই। বারে বারে তিনি আমাকে রাজকোটের কথা জিগ্গেস করছেন, সেখানে তাঁর অনেক বন্ধু থাকে। কলকাতায়ও একবার গিয়েছেন, সেখানকার খাবার চেখে দেখেছেন, দোকানের নামগুলোও তার মনে আছে। নিজামের রান্না তাঁর প্রিয়। বিদায় নেওয়ার সময় তিনি আমাদের চিবুকে হাত দিয়ে বললেন, “খুশ রহনা বেটা। খুশ রহনা বিটিয়া।"
একসময় আমরা প্রাসাদ ছেড়ে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। সব রাস্তাই পাথর দিয়ে বাঁধানো, মাঝে মাঝে ক্যাফে আর অন্যান্য দ্রষ্টব্য সাজিয়ে ভ্রমণার্থীদের আকর্ষণ করার জন্যে বসে আছে দোকানিরা। বিকেলের পর প্রতিটা ক্যাফেতে ঝলমলে আলোকসজ্জা দেখা যাবে। এখানকার স্থানীয় বিয়ার সেরভেজা আর খাবারের সঙ্গে তত্ত্ব-চিন্তা সাবলীলভাবে চলে, অক্লেশে চলতে থাকে থাকে গ্রীষ্মের উল্লাসও। ঝাঁকে ঝাঁকে চাইনিজ টুরিস্ট এসেছে, কোনও জায়গাই ফাঁকা পাওয়া যায় না সন্ধ্যের সময়। একসময়ে বিদেশে ঘুরতে যাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। একশ বছর আগেও উড়োজাহাজ চালু হয়নি, জাহাজে করে আসতে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস লেগেও যেত। এখন সেইসব কোনও ব্যাপারই নয়। ভারতীয়দের তাও ভিসা নিতে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, উন্নত দেশের নাগরিকদের সে দরকারও পড়ে না। শয়ে শয়ে বিমান কোম্পানি রোজ বিমানসেবা দিচ্ছে, টাকা থাকলেই হুট করে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে চলে যাওয়া যায়। ঘুম থেকে উঠে মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলেই হল।
ঘন্টাখানেক পর সমতলে নেমে এসে আমরা দুরুম কাবাবের খোঁজে চললাম, পেট ভরিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়াই বেস্ট। 'সিয়েস্তা'র প্রবণতা এই অঞ্চলে বেশি, দুপুরবেলায় অনেক দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রোদ্দূরের তাপও বেড়েছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ ডিগ্রী। খানিকটা সময় বিশ্রাম করে না হয় আবার বেরিয়ে পড়তে হবে আলবাইজিন কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে। যা ভেবেছিলাম, তিন ঘণ্টায় রোদের তাপে খুব একটা হেরফের হল না। গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম, তার মধ্যেই সাড়ে পাঁচটার সময় বেরিয়ে পড়া হল কোনোক্রমে। আমাদের সিয়েস্তা শেষ, ঘরে বসে বসে সময় কাটানোর মানেই হয় না। এমনিতেও গলির ভিতর দিয়ে দিয়ে রাস্তা, দু'দিকে প্রাচীন উঁচু উঁচু বাড়ি, বড় রাস্তা অথবা প্লাজাতে না বেরোলে রোদ লাগবে না গায়ে।
ইউরোপের ফ্রি ওয়াকিং ট্যুরের ব্যাপারটা আমাদের খাঁটি লেগেছে। প্রতি শহরেই একাধিক ওয়াকিং ট্যুরের ব্যবস্থা আছে, যেটাতে খুশি ঢুকে গেলেই হল। লোকাল ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভালো করে কে আর শহর চেনে? গাইডরা চৌকস তো বটেই, অসম্ভব বন্ধুভাবাপন্নও। ইতিহাস আর সমসাময়িক ঘটনাক্রম তাদের নখদর্পনে, তাছাড়াও যা ইচ্ছে জিগ্গেস করে নেওয়া যায়। ট্যুর শেষ হলে ইচ্ছেমতো ‘টিপ’ বা বখশিস দাও, না দিলেও চলে। সেটা করতে পারলে আর্থিক ভাবে লাভই হত, কিন্তু চক্ষুলজ্জা বলেও একটা ব্যাপার আছে। আড়াই তিন ঘন্টার এই হাঁটাহাটিতে শহরের চরিত্র এমন করা ধরা দেয় যা ওয়াকিং ট্যুর না নিলে অসম্ভব।
বেশিরভাগ লোকেই পাঁচ অথবা দশ ইউরো করে টিপ দেয় গাইডকে, কেউ কেউ পঞ্চাশ অথবা একশ ইউরো দিতেও পিছপা হয় না। খোঁজ খবর করে জানতে পেরেছি যে মাথাপিছু তিন ইউরো গাইডকে ট্রাভেল কোম্পানিকে দিতেই হয়, কুড়ি জন যদি পাঁচ ইউরো করে টিপ দেয়, চল্লিশ ইউরো গাইডের, ষাট ইউরো কোম্পানির কাছে। টিপ না পেলেও কোনও জোরাজুরি করা হবে না, অথচ প্রত্যেকেই টিপ অবশ্যই দেয়। কারণ লোককথা, রাজনীতি, শিল্প, সিনেমা, ইতিহাসের মিশেলে তৈরি আড়াই তিন ঘন্টার এই সহজ কিন্তু মনোগ্রাহী অভিজ্ঞতা আসলে অর্থের উর্ধ্বে।
আজকে আমাদের আলাপ হল আলবের্তোর সঙ্গে। সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে, দেখতেও সুন্দর। চেষ্টাচরিত্র করলে অ্যাকশন হিরোর চরিত্র পেয়ে যেতে পারে। প্রথমেই সে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে চলল আরব বাথ দেখাতে। রোমানদের মতনই আরবেরা নানা জায়গায় স্নানাগার বানিয়ে গিয়েছে। শুধু স্নান করার জায়গা বললে অবশ্য অন্যায়ই হবে। যে পরিমাণ যত্ন নিয়ে এই স্নানভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সমাজের বিত্তশালী ও প্রতিপত্তিশীল ব্যক্তিরা এখানে বেশ খানিকটা সময় কাটাতেন। একটা গরম জলে স্নান করার জায়গা, একটা ঠান্ডা জলে স্নান করার জায়গা, উষ্ণ বাষ্পের সাহায্যে ‘স্টিম বাথ’-এর চলনও ছিল। প্রতিটা স্নানাগারেই স্নানের তিন চারটে ঘর, বিশ্রাম নেওয়ার অতিরিক্ত স্থানও ছিল। গ্রানাদায় খোঁড়াখুঁড়ি করে এরকম অনেকগুলো স্নানাগার পাওয়া গেছে। আরবদের আগে বাইজেন্টিয়াম শাসনেও এই স্নানাগার তৈরি করা হয়েছিল। আলবের্তো আমাদের যে জায়গাটায় নিয়ে গেল প্রাচীন নির্মাণের স্থাপত্যর বিশেষত্ব বোঝাতে, সেটা আসলে একটা প্রাইভেট প্রপার্টি। মাথাপিছু বারো ইউরো টিকিট আছে, কিন্তু আলবের্তোর চেনা বলে আমাদের এক পয়সাও দিতে হল না। দিব্যি ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখে নিলাম।
আলবাইজিন শুধু প্রাক্তন মুরদের নিবাস অঞ্চল নয়, বর্তমান সময়ের গ্রানাদার অন্যতম বোহেমিয়ান এবং শৈল্পিক কেন্দ্র। দারো নদীর কাছ থেকে চড়াই উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর, সেই পাহাড়েই এখানের সাদা বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিল। সরু সরু রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠেছে দুধসাদা বাড়িগুলোকে বেষ্টন করে। একজন সামান্য মুসলমান কী করে বাড়ি করত সেটা বোঝানোর জন্য আলবের্তো আমাদের নিয়ে চলল তার এক পরিচিত বন্ধুর বাড়িতেই। আরব মুসলমানদের কিছু উত্তরসূরি আজও এইসব বাড়িতে থাকেন, ১৯৮৪ সালে আলহাম্বরা সমেত আলবাইজিন অঞ্চলটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ করে দেওয়ার ফলে অনেক বাড়িই অবশ্য হেরিটেজ হোটেলে বদলে গিয়েছে। এই সব ইমারতের প্রত্যেকটাতেই প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকে একটা উঠোন, মাঝখানে জলের একটা ব্যবস্থা আছে, সেটা ফোয়ারা, চৌবাচ্চা যা কিছু হতে পারে। জলের স্রোত থাকলে বাড়িটা ঠান্ডা থাকবে, এই ভেবেই এই নির্মাণ করা হয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দু’তলায় সারি সারি ঘর। কাঠের সিঁড়ি আর থাম মিলিয়ে একটা সমান্তরাল জ্যামিতির ব্যাপার আছে। অনেক বাড়ির দেওয়ার থেকেই ফুলের গাছ অথবা লতাপাতা বেয়ে উঠেছে। কয়েকটা গাছ বেগুনি অথবা লাল রঙের ফুলে বোঝাই, এত সুন্দর যে দেখলে চোখ সরানো যায় না।
আলবাইজিনের গলিতে ঘুরতে ঘুরতে আলবের্তোর কাছ থেকে এখানকার ‘ফ্রি স্পিরিট স্ট্রিট কালচার’ সম্পর্কে জানতে পারলাম। এই শহরের সংস্কৃতি আর ইতিহাস এতটাই বৈচিত্রময় যে নানা দেশ থেকে নানা শিল্পী, হিপির দল, বোহেমিয়ান ব্যক্তিত্বরা এখানে এসে জটলা করেন। প্লাজা নুয়েভা অথবা প্লাজা লার্হাতে প্রায় প্রতিদিনই খোলা আকাশের নিচে স্প্যানিশ ফ্লামেংকো আর গিটারের সুরের কনসার্ট হয়ে থাকে। রাউজ রুইকা এখানের নামকরা স্ট্রিট আর্টিস্ট, তাঁর আঁকা গ্রাফিতি আলবাইজিন ছাড়াও স্থান পেয়েছে শহরের অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষ করে রিয়ালেহ অঞ্চলে গেলে তো মনে হয় গলিগুলো স্ট্রিট আর্ট মিউজিয়ামের অংশ। মরোক্কোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলে আরব সঙ্গীতের জলসাও মাঝেমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় এখানে। আর জিপসিদের হাতে তৈরি জিনিসের চাহিদা তো আছেই। প্লাজা দে সান নিকোলাসে সেই হস্তশিল্পের বাজার আমরা সচক্ষেই দেখতে পেয়েছিলাম।
আলবাইজিন অঞ্চলের অনেক জায়গা থেকেই আলহাম্বরা প্যালেসের অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। আলবের্তোর দয়ায় এমন কয়েকটা ভিউ পয়েন্টে দেখার সৌভাগ্য হল যেখানে যাওয়ার কথা আমরা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারতাম না। অধিকাংশই নিজস্ব বাড়ি অথবা হোটেল, চেনাজানা না থাকলে টুরিস্টদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। এও জানা গেল যে দীর্ঘ কুড়ি বছর পর গত বছরে গ্রানাদায় ভালো তুষারপাত হয়েছিল। সিয়েরা নেভাদার বরফ ঢাকা পাহাড়চূড়ার সামনে বরফের কুচি গায়ে মাখা আলহাম্বরার যে কী রূপ ছিল সেই সময়, সেটা কল্পনা করেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলাম।
মিরাডোর দে সান নিকোলাসে পৌঁছে গ্রানাদার প্রধান মসজিদ দেখতে পেলাম। রকমারি রঙের মার্বেলের টালি দিয়ে নির্মিত এই মসজিদ অনেকটা জেরুসালেমের আল অক্সা মসজিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। কাঠের পাটাতনের ওপর নকশা কাটা জাফরি আর ইস্তাম্বুলের মসজিদের আদলে তৈরি 'কিবলা' খিড়কিগুলোর ওলাসিয়াস নকশা এই ইমারতে অন্য এক মাত্র যোগ করেছে। মিনারের অন্য দিকে বাগিচায় অলিভ, কমলালেবু, বেদানা আর মশলা গাছের বাহার। তার পিছনেই দারো নদীর উপত্যকা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে মিরাডোর দে সান নিকোলাস চত্বর। আলবের্তো অবশেষে আমাদের বিদায় জানাল। এখান থেকে সূর্যাস্তের অসামান্য দৃশ্য দেখা যায়, আর যাত্রা শেষ করার জন্যে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। সূর্যাস্তের ছবি তুলবে বলে তখন বহু মানুষ সমবেত হয়েছে প্লাজায়। জিপসিরা দোকান সাজিয়ে রকমারি জিনিসপত্র বিক্রি করছে। কাছেই নামকরা কয়েকটা ক্যাফে আছে, অনেকে পা বাড়িয়েছে সেইদিকে। কিন্তু এই হট্টগোলের মধ্যে গ্রানাদার শেষ সূর্যাস্ত দেখতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। আলবের্তোকে বলতেই চটজলদি সমস্যার সমাধান মিলল। কাছেই মিরাডোর দে সান ক্রিস্তবাল বলে আরেকটা জায়গা আছে, সেটার খবর খুব কম লোকেই জানে। সেখানে গেলে নিরিবিলিতে সূর্যাস্ত দেখার সম্ভাবনা আছে।
আলবের্তোকে প্রচুর ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়ালাম সান ক্রিস্তবাল ভিউ পয়েন্টের দিকে। আকাশের রং কমলা হয়ে এসেছে, আলহাম্বরার রক্তিম দুর্গে ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই সোনালি আলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এই গলি সেই গলি করে এসে পৌঁছালাম মিরাডোর দে সান ক্রিস্তবালে। লোকজন সত্যিই নেই বললেই চলে। এমন একটা অসামান্য অবস্থান যে শুধু আমাদের কথা ভেবেই অপেক্ষা করে আছে ভাবতেই রোমাঞ্চে গা শিরশির করে উঠল। ওই তো, দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়! গ্রানাদা শহর সহ দূরের সিয়েরা নেভাদা পর্বতশৃঙ্খলাও দেখা যাচ্ছে শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয়। আলহাম্বরা প্যালেস যেন এই পাহাড়ের অনামিকায় বসানো হীরের আংটি। বাইজেন্টাইন, ভিসিগথ, মুর, ক্যাথলিক সাম্রাজ্যের পাতাগুলো আবহমান কালের গর্ভে হাতধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে সেই উপত্যকায়। আন্দালুসের বুকে এই আমাদের শেষ সূর্যাস্ত। শহরের বুকে একটা একটা করে জ্বলে উঠছে নতুন শতাব্দীর আলো। সেই আলোয ধুয়ে যাচ্ছে আমাদের সমস্ত অভিমান, সমস্ত অহংকার। গলিত সোনার সদৃশ আলোয় অভিযোগহীন দ্যুতি গায়ে মেখে তাকিয়ে রইলাম। এই শ্বাশ্বত মুহুর্তের সাক্ষী রইল আলহাম্বরার দীর্ঘশ্বাস আর এই জাদু আলোর রোশনাই আর... সাক্ষী রইলাম আমরা। ভালো থেকো, গ্রানাদা। খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে। ততদিনের জন্য... বিদায়! হাস্তা প্রোন্তো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন