যাত্রা এবার শেষের দিকে, বাতাসেরও মন ভারী
হাতের তালুতে ভেঙ্গে পড়ে ক্ষীণ তাসেদের ঘরবাড়ি।
তাসেদের গায়ে নাম লেখা কত চরাচর অঙ্কিতা
আঙ্গুলের ভুলে ছবি হারিয়েছে বদলে এসেছে কথা।
নিগূঢ় সে খেলা আবার সূচিত, চলেছে পূর্ববৎ!
থাম! তোমার হাতে টানা তাসই তোমার উপার্জিত জগত।
-ইঙ্গেবর্গ বাকমান
২) আমাদের যাত্রাও শেষের দিকে। সালজবুর্গের কয়েকটা দিন কোথা থেকে যে কেটে গেল! অস্ট্রিয়ান স্নিটজেল আর গুলাশ-এর সুস্বাদু সুপের পাশাপাশি এভার হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে স্বভাব খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। অস্ট্রিয়ানরা অন্য দেশের মত পাখির আহার করে না, রান্নার পরিমাণ থাকে যথেষ্টই। মাংসের স্টিক, কড়া করে ভাজা স্নিটজেল, সঙ্গে রকমারি রকমের উপাদেয় কেক খাওয়া চলছে এই কয়েকদিন ধরে। রেসিডেন্টপ্লাৎজে অবস্থিত 'ক্যাফে টোমাসেলি' তো কেক আর পেস্ট্রির জন্যেই বিখ্যাত, স্বয়ং মোৎসার্টও নাকি এখানে কেক খেতে আসতেন বলে শোনা যায়। সুতরাং আমরাই বা বাদ যাই কেন? পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটিও হচ্ছে প্রচুর, ফলে সব খাবারই হজম করে ফেলেছি।
ইতিমধ্যে শহরের অধিকাংশ দ্রষ্টব্যই দেখা হয়েছে। রেসিডেন্টপ্লাৎজ, সালজবুর্গ মিউজিয়াম, গির্জা, হেলব্রুন প্রাসাদের মজাদার লুকিয়ে থাকা ফোয়ারাবাগান। এখানকার গির্জাটি আবার ইউরোপের অন্যান্য সব গির্জার চেয়ে ভিন্ন। গির্জার অভ্যন্তরে সাদা রঙের ওপর অপরূপ সব ফ্রেস্কো ছবি। প্রতিটা দ্রষ্টব্যের ইতিহাস, বৈভব ও আভিজাত্য অতি যত্নে সংরক্ষিত করা হয়েছে। সালজবুর্গের দুর্গটির কথাও পৃথক ভাবে বলতে হবে। এককালে আর্চবিশপদের অধিকারে থাকা এই দুর্গের অবস্থানটির কারণেই বেশি নম্বর দিয়ে ফেললাম। পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত এই দুর্গপ্রাসাদ সালজবুর্গ নগরের মুকুটের সামিল। দুর্গের মাথার ওপর থেকে সালজাক উপত্যকার মনোরম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। সে না দেখলে বর্ণনা করা বৃথা। সবুজে মোড়া আল্পসের পাদদেশে সালজবুর্গ যেন একটা হীরের টুকরো।
দিন কাটে। প্রতিদিন সবুজে মাখামাখি মন নিয়ে বাড়ি ফিরি। হ্যারি আর এভার সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডা চলে। তাঁরা ক্যানারি আইল্যান্ডে দীর্ঘদিন থাকার কথা ভাবছেন, বছরের অর্ধেক সময় হয়তো সেখানেই থাকবেন এরপর থেকে। সামারে এখানে এলে মোটরসাইকেল নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরবেন, ক্যাম্প করে থাকবেন। এই বয়স্ক দম্পতির জীবনীশক্তি আমাদেরও আশা জোগায়। মাঝে মাঝে ওরা জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কী করব এরপর? কী প্ল্যান আমাদের? বোকার মতো হাসি দুজনেই। আমাদের কোনও প্ল্যান নেই। অর্ধেক জীবন তো প্ল্যান করেই গেল। লাভ হল না কিছুই। আমাদের না আছে মুচুয়াল ফান্ড, না গাড়িবাড়ি কেনার অভিলাষ। আছে শুধু পত্রচ্যুত শিশিরবিন্দুর মতো একগাদা স্বপ্ন। নগরজীবনে সে সব একান্তই বেমানান।
একদিন আমরা উনটের্সবার্গ পাহাড়ে বেড়াতে গেলাম। বাসে করে অনেকটা যেতে হয় শহর ছাড়িয়ে, জার্মানির সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত উনটের্সবার্গের পর্বতপ্রাচীর। এই পাহাড়ি অঞ্চলই জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার সীমানা। কেবল কার করে পাহাড়ের মাথায় উঠে যাওয়া হল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে, চোখ ভরে দেখলাম সালজাক উপত্যকার সৌন্দর্য। একদিকে সালজবুর্গ শহরের ক্ষুদে জনবসতি, অন্যদিকে জার্মানির দিকে অগ্রসর উঁচু পাহাড়ের ঘন সবুজ সারি। আর শয়ে শয়ে পাখি। আসমানি আকাশরেখা বরাবর উড়ে চলেছে তারা। আমার স্মৃতিতে বার বার ফিরে আসে মাউন্টেনিয়ারিংয়ের দিনগুলো। ইচ্ছে করে ট্রেকিং পোল নিয়ে হারিয়ে যাই এই পাহাড়ে। উনটের্সবার্গের ভিতর দিয়ে ট্রেকিং রুট চলে গেছে জার্মানির বেখতেসগাদেনের দিকে, আরো এগিয়ে গেলে ইতালি, সুইটজারল্যান্ড, ফ্রান্স। অর্ধেক মহাদেশ ছেয়ে আছে বন পাহাড়ের দেশ দিয়ে। অসংখ্য ট্রেকরুট, এক আঙুলের গ্রাম। ভেড়া আর গরু ঘুরে বেড়ায় স্বাধীনভাবে। পারমিট নিতে হবে না, গাইড নিতে হবে না, শুধু তাঁবু আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। মাসের পর মাস কাটিয়ে দাও নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধতায়। প্রয়োজনে একটা ডিসট্রেস কল করলেই রেসকিউ টিম চলে আসবে। অনেকেই যায়। হেঁটে হেঁটে রুকস্যাক নিয়ে মাস চারেক পাহাড়ে কাটিয়ে দেয়। গাজোয়ারি করলে অবশ্য ফল ভুগতে হতে পারে। হাইকিং রুটের জায়গায় ক্লাইম্বিং রুটে গেলে বিপদ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সাধ্য এবং প্রয়োজনীয় গিয়ার না থাকলে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। প্রতিবছর এই অঞ্চলে একজন-দুজন করে ট্রেকার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও শুনতে পাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষরা অবশ্য বলে, দুর্ঘটনা-ফটনা বাজে কথা। তাদের দানো নিয়ে যায়। আমাদের দেশের মতো মতো এখানেও আদিম সংস্কার থেকে গিয়েছে প্রাচীনপন্থীদের মনে।
স্থানীয় লোককথায় উনটের্সবার্গ সম্পর্কেও অনেক মিথ আছে। চলতি গল্প হল যে রোমান সম্রাট ফ্রেদেরিক বারবাদোসা নাকি পাহাড়ের তলায় ঘুমিয়ে আছেন। অনেকে আবার বলে ফ্রাঙ্ক, লোম্বার্ড আর রোমানদের সম্রাট চার্লস তার বামনসৈন্যদের নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন পাহাড়ের তলায়। প্রতি একশ বছর পর একটি কালো কাক এসে তার ঘুম ভাঙ্গায়।পাহাড়ের ওপরে সত্যি অনেক কাক ঘুরে বেড়াচ্ছে। গল্প শুনতে ভালই লাগে।
কেবল কার থেকে নেমেও অনেকটা হেঁটে চলে যাই ওপরের দিকে। ছোট বড় পাথরের ওপর দিয়ে সাবধানে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যাওয়া যায়। অনেক উঁচুতে একটা ক্রস লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটাই উচ্চতম বিন্দু। দক্ষিণে ঘন আলপাইন বন আর পাথুরে প্রান্তর দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকি সেখানে। আগামী কয়েকদিন আমরা আল্পসের আরো গভীরে চলে যাব। এই পাহাড়, হ্রদ আর পাইনের অরণ্যই আমাদের একান্ত সঙ্গী হবে তখন।
সালজবুর্গের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই। খানিক দূরেই বরফের গুহা বা আইস কেভ আছে বেশ কিছু, মাটির গভীরে উপস্থিত নুনের খনি দেখতেও যাওয়া যায়। 'সালজ' কথার অর্থই তো নুন, এই নুনের খনি থেকেই সালজবুর্গ শহরের নাম এসেছে। আল্পসের পাহাড়ে বহু মনপাগল করা ছোট ছোট গ্রাম, হ্রদ, জলপ্রপাত তো আছেই। জার্মানির শহর মিউনিখও এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়।
বিকেল বেলায় নদীর ধারের রাস্তাগুলোতে ঘুরে বেড়াই। কোনো কোনো জায়গা থেকে অপেরার সুর ভেসে আসে, কোথাও কানে আসে মোৎসার্টের কোনও সিমফনির সুর। জুলাই-আগস্ট ধরে এখানে সালজবুর্গ কার্নিভাল চলে। গির্জার সামনের চত্বরে শনি-রবিবারে জমকালো কনসার্ট তো হয়ই, তাছাড়াও নানান অনুষ্ঠান চলতে থাকে প্রতিদিন শহর জুড়ে। সবুজ এবং শিল্পের এরকম মিশেল অস্ট্রিয়া ছাড়া খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না।
সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে মোৎসার্টের এই শহর তীর্থের চেয়ে কম নয়, অনেকেই বার বার এসে হানা দেয় মোৎসার্টের হলুদ বাড়িতে। বিশ্বাস করা কঠিন যে যেই সুরকারকে নিয়ে এত উন্মাদনা তিনশ বছর ধরে, বেঁচে থাকার সময়ে তাঁকে কী পরিমাণ অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে।
মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে সুর করতে শুরু করেছিলেন মোৎসার্ট, তার সেই বয়সের সুরলিপি পাওয়া গিয়েছিল বাড়ির চিলেকোঠা থেকে। বাবা লিওপোল্ড মোৎসার্ট ছেলের প্রতিভা বুঝতে ভুল করেননি, তিনি নিজেও সুরকার ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই প্রিন্স আর্চবিশপের কাছে সুরকার হিসেবে কাজ শুরু করেন মোৎসার্ট। খেয়াল করার বিষয় হল উনবিংশ শতাব্দীর আগে সুরকারদের শিল্পী বলে মনে করাই হত না, শ্রেষ্ঠ প্রতিভারাও রাজা-উজির-বিত্তবান মানুষের কাছে সাধারণ চাকরি করতেন ও তাদের ইচ্ছেমতোই সুর তৈরি করতেন। মোৎসার্ট আর্চবিশপের কাছে কাজ করে খ্যাতি পেলেন বটে কিন্তু স্বাধীন ভাবে কাজ না করার ক্ষোভ তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিল না। দামি পোশাক ও পানীয়ের শখ থাকলেও আদতে তাঁর ভিতর একটি শিল্পীমন ছিল, স্বাধীনভাবে সুর তৈরি না করতে পেরে সেই সৃজনশীল মন বিদ্রোহ করে উঠলো।
অবশেষে তিনি কাজ ছেড়ে স্বাধীন সুরকার রূপে কাজ করবেন বলে ভিয়েনা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাবা লিওপোল্ড এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। হওয়ার কথাও নয়। লিওপোল্ড নিয়ম ও প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে যেতে ভালোবাসতেন না। তাঁর মেয়ে মারিয়ানা অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও গানের জগত থেকে নির্বাসন নিতে বাধ্য হয়েছিলেন স্রেফ গোঁড়া বাপের জন্য, না হলে হয়তো তিনি ভাইকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতেন। এহেন তিনি যে ছেলের সিদ্ধান্তে খুশি হবেন না, সে তো জানাই ছিল। সবটাই অবশ্য সংস্কার নয়। রাজপরিবারের সমর্থন না থাকলে স্বাধীন সুরকার আর সঙ্গীত সাধকদের কী দশা হয়, সেই সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতাও ছিল লিওপোল্ডের।
মোৎসার্ট কিন্তু বোনের মতো বাবার কথা শুনতে রাজি হননি। জোর করে ভিয়েনায় গিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। একের পর এক যুগান্তকারী সব কম্পোজিশন তৈরি করেছেন সে সময়। সিমফোনি, কন্সেরটোস, অপেরা। তাঁর সঙ্গীতের খ্যাতি যত ছড়িয়ে পড়তে লাগল, অর্থনৈতিক ভাবে ততটাই দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন তিনি। বাবা লিওপোল্ডের আশঙ্কা ভুল ছিল না। রাজার হাত না থাকলে আর পয়সাকড়ি পাবে কোত্থেকে? পাবলিক কনসার্ট করে যাও বা চলে যাচ্ছিল কুড়িয়েমুড়িয়ে, তুর্কীদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাও কমে এল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অর্থনৈতিক ভাবে তাঁর অবস্থা যত পড়তে লাগল, ততোই ভালো সুর কম্পোজ করে চললেন। 'ম্যাজিক ফ্লুট' অপেরার সঞ্চালনা করেন যে বছর, সেই বছরেই অসুখে ভুগে মারা যান এই প্রতিভাবান সুরকার। সালটা ছিল ১৭৯১। তখন তাঁর মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স।
একদিন বিকেলবেলায় সালজাক নদীর ধার দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, নদীর ধারের রাস্তার ওপর জমাটি বাজার বসেছে। শাকসবজি, জ্যাম, জেলি... ফার্মার্স মার্কেট বলা চলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল প্রতি শনিবার রবিবার নদীর ধারের এই বাজার বসে স্থানীয় মানুষদের জন্যে। বাড়িতে তৈরি করা জ্যামজেলি থেকে শুরু করে কাঠের জিনিস, হাতে আঁকা ছবি সবকিছুই বিক্রি হচ্ছে। নদীর ধারে দোকানের আলোগুলো রাতে ঝলমল করে। এরকম টুকরো টুকরো এক একটা ঘটনার সাক্ষী হই রোজ। আপাত সাধারণ ঘটনা, ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করার যোগ্যতা অর্জন করেনি হয়তো। কিন্তু এই বা কোন প্রথাগত ভ্রমণকাহিনি? মাঝে মাঝে পথ নির্দেশিকাই হয়ে ওঠে, তারপর কলমে উঠে আসে শ্রুতবিশ্রুত কাহিনি। আবার ব্যক্তিগত ভাবনাও ঢুকে পড়ে হুটহাট। বা স্বার্থপরের মতো সঞ্চিত রাখা সংলাপ, আগলে রাখা হাসি। কোনও ফিল্টার নেই।
ভালো লাগে, তাই লিখে রাখি। সন্ধ্যের পর এলোমেলো টহল দিতে গিয়ে কত দৃশ্যকল্প মনে পড়ে। কিছু বাস্তব ছবি, অনেকটাই কল্পনা। শিশুদের দুরন্তপনা, চেস্টনাট বিক্রেতা, ঘোড়ার সহিসদের মজলিশ, রঙিন ফোয়ারা বা রূপোলি চাঁদের আলোয় কত কত স্মৃতি তৈরি হয়ে চলেছে অবিরত। এই স্মৃতিঘন মুহূর্তের মূল্য বোঝা যায় না সে সময়, কিন্তু মনে অনেকখানি জায়গা দখল করে রাখে সেই ছবিগুলো। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াই, যখন সুরের মূর্ছনা ভেসে আসে ওল্ড টাউনের গলি থেকে। কান পেতে রই দুজনায়। পথচলতি লোকে কিঞ্চিত অবাক চোখে তাকায়। দুজন ভারতীয় ছেলেমেয়ে মাঝরাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, চোখ বন্ধ করে গান শুনছে! কেউ কেউ হাসে, বাকিরা পাত্তা দেয় না। প্রেমিকযুগলরা হাত ধরাধরি করে হাঁটে, স্মৃতিসৌধ বা প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। নদীর জলে পা দিয়ে বসে থাকে, ফুলবাগানে গা ডুবিয়ে গল্প করে। আলটুসি আদর আর নরম রোদে মাখামাখি কথা চুঁইয়ে আসে। আমরা সাক্ষী থাকি।
অন্যান্য দেশের তুলনায় অস্ট্রিয়ার ইতিহাস কিন্তু অনেকটাই নতুন। রোমান সাম্রাজ্য যখন পাহাড়ে বসতি করা এই মানুষজনদের কথা জানতে শুরু করেছে, ততদিনে ইউরোপের অন্যান্য জায়গাগুলো অর্ধেক ইতিহাস লিখে ফেলা হয়েছে। পরবর্তী কালে অবশ্য এখানকার হাপ্সবুর্গ পরিবারের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে গেছে সারা ইউরোপে। সুদূর স্পেন থেকে এসে তাঁরা এখানে তো রাজত্ব বিস্তার করেছে, এমনকি গ্রিসেও হাপ্সবুর্গ রাজাদের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস আছে। সহজ করে বলতে গেলে হাপ্সবুর্গ রাজ্যের হর্তাকর্তারা ছক কষেছিল জবরদস্ত। মাস্টারস্ট্রোক যাকে বলে! তাদের আগেই আশঙ্কা ছিল ইউরোপের শক্তিশালী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিশেষ লাভ হবে না, ও সব মহা ঝক্কির কাজ। তার চেয়ে বরং অন্যান্য রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত করে সকলকেই দলে টেনে নাও। এই পরিকল্পনা কয়েক শতাব্দী ধরে হাপ্সবুর্গ সাম্রাজ্যে 'আচ্ছে দিন' বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। পরের দিকে অবশ্য জার্মান আর নেপোলিয়ানের আক্রমণে অস্ট্রিয়ার অবস্থা ক্রমে খারাপ হয়েছে। এই প্রকাণ্ড সাম্রাজ্য বিভাজিত হয়ে অস্ট্রো-হাংরি রাজ্য হয়ে যায় একসময়। পরবর্তীকালে সেই রাজ্যও ভেঙ্গে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটো দেশে। আমাদের পরিচিত বহু কবি ও লেখক— যেমন কাফকা, পল সেলান, ম্যাক্স ব্রড— অস্ট্রো-হাংরি রাজ্যেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি অবশ্য এই অঞ্চলে চিরকালই ছিল। প্রথম দিকে জার্মানদের প্রভাব থাকলেও বিংশ শতাব্দীত অস্ট্রিয়ার শিল্প এবং সাহিত্য স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। রাইনার মারিয়া রিলকের গীতিকবিতা, আর্নস্ট জ্যানডলের 'এক্সপেরিমেন্টাল' কবিতা, কনরাড বায়ারের নৈরাশ্যবাদী কবিতার পাশাপাশি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে সমসাময়িক ঘটনাভিত্তিক উপন্যাস ও রেডিও নাটক। ইঙ্গেবর্গ বাকমান, পিটার হ্যান্ডকেরা, ফ্রায়েদরিক মেরোকের ক্রমশ পাঠকদের প্রিয় হয়ে উঠেন। হালফিলে সালজবুর্গের কবি বেটিনা বালাকার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য দেশেও।
সালজবুর্গ ছাড়ার আগের দিন আমরা চললাম হলস্ট্যাট-এর উদ্দেশে। হলস্ট্যাট হ্রদের ধারে অবস্থিত এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম অথবা মফস্বলের কথা আজকাল ইন্টারনেটের সুবাদে সারা পৃথিবীর লোকে জেনে গেছে। এত শতাব্দী ধরে নুনের খনি এবং এখানকার সংস্কৃতির জন্যেই অস্ট্রিয়ানরা হলস্ট্যাট-এর কথা জানত। কিন্তু ১৯৯৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ গ্রামের তকমা পাওয়ার পর থেকেই টুরিস্টদের আকর্ষিত করতে থাকে হলস্ট্যাট। শেষ কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের শিরোপা পাওয়ার কল্যাণে আজকাল সারা পৃথিবী থেকে টুরিস্ট হলস্ট্যাট দেখতে আসে। বিশেষ করে চাইনিজ টুরিস্টদের সংখ্যা দেখে আশ্চর্য হতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ইউরোপে নয়, আমরা চায়নাতে বেড়াতে এসেছি। ভাগ্যক্রমে যেইদিন আমরা হলস্ট্যাট যাব বলে ঠিক করলাম, কোনো কারণে ততটা ভিড় পাইনি। তাতে আমাদের সুবিধেই হয়েছিল। এমনিতেই অনেকটা পথ। সালজবুর্গ থেকে বাসে করে ঘন্টা দুই যেতে হয় ব্যাড-আইচ(Bad Ischl) বলে একটা জায়গায়। সেখান থেকে ছোট লাইনের ট্রেন ধরে মিনিট কুড়ি গেলে হলস্ট্যাট হ্রদের ধারে অবস্থিত ছোট্ট স্টেশন। তারপর ফেরি করে হ্রদ পার হয়ে হলস্ট্যাট গ্রাম।
ব্যাড-আইচ(Bad Ischl) থেকে ট্রেনে করে রওনা হওয়ার পর থেকেই দু' দিকের শান্ত, মনোরম, সবুজের সমারোহ দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন সবুজ গাছেদের পিছন থেকে প্রথম হলস্ট্যাট হ্রদের নীল জলউঁকি দিতে শুরু করল, সত্যিই রোমাঞ্চ জাগে। বিশেষণের বন্যা বইয়ে দিয়েও সেই সৌন্দর্যের উপমা দেওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র চাক্ষুষ দেখলেই সেটা অনুভব করা যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা হলস্ট্যাট স্টেশন এসে পড়ল। ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়ে হ্রদের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। হ্রদটা বিশাল। খাড়াই পর্বতশ্রেণী দিয়ে আবৃত এই হ্রদ বা লেক বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। লেকের অন্য প্রান্তে হলস্ট্যাট-এর পাহাড়ি গ্রামের প্রথম ঝলক দেখেই বোঝা গেল কেন এই গ্রাম নিয়ে এত হইচই হয়। পুরোটাই অবস্থানের যাদু। এরকম 'ম্যাজিক সেটিং' হয়তো একমাত্র রুপকথার জগতেই ভেবে থাকি আমরা। একদিকে হৃদের স্বচ্ছ নীল জল, অন্যদিকে পাহাড়ের ধাপ উঠে গেছে। হ্রদকে ঘিরে রেখেছে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় সফেদ বরফের মুকুট। গ্রামের বাড়িগুলোও তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ের ধাপে ধাপে। রূপকথার গ্রামই বটে।
ফেরি আসতে দেরি হচ্ছিল। অপেক্ষা করতে হল। ঘন্টায় একটা করে ফেরি যাত্রীদের পারাপার করে। এছাড়াও অনেক ধরনের নৌকো ঘুরে বেড়াচ্ছে হ্রদের জলে, টুরিস্টদের জন্যে নৌকো ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। অবশেষে ফেরি ধরে হলস্ট্যাটে পৌঁছালাম যখন সূর্য একেবারে মাথার ওপরে। দূর থেকে জায়গাটা দেখতে যতটা সুন্দর মনে হচ্ছিল, কাছ থেকে থেকে সেই মুগ্ধতা বাড়ল বই কমল না। ঝকমকে দোকানগুলো এমন করে নানা মরসুমি ফুলে মুড়ে রাখা হয়েছে মনে হচ্ছে ফুল দিয়েই দোকানগুলো তৈরি। অজস্র ফুলে বোঝাই গ্রামের প্রতিটা কোণা। টিম্বার ফ্রেমিং শৈলীর গির্জা, পুরোনো কাঠের বাড়ি। পাহাড়ের ওপর দিকে ঘোরানো গলি উঠে গেছে অন্যান্য পাড়ায়, সেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চললাম। মাঝে মাঝেই হ্রদ আর জলের ধারের গ্রামের বাড়িগুলো দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়ের যত উঁচুতে উঠবে, ততটাই সুন্দর হয়ে উঠবে সেই দেখা। ফার্নেকুলার করে পাহাড়ের একেবারে মাথায়ও চলে যাওয়া যায়। হাতে সময় কম বলে আমরা সেইদিকে আর পা বাড়ালাম না।
একটা পুরোনো গির্জা আর গির্জার সংলগ্ন গোরস্থানও চোখে পড়ল। কবরের ওপরে নানা রঙের ফুলের তোড়া রেখে গিয়েছে গ্রামবাসীরা। খুব কমসংখ্যক মানুষই এখানে থাকে, যদিও আধুনিক সুযোগসুবিধে সবই আছে। কয়েকটা ক্যাফে আর হোমস্টেও চোখে পড়ল। ইন্টারনেটে দেখেছি এখানে থাকার জায়গার চড়া দাম। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা বেশ কয়েকদিনের জন্যে এসে বাড়িগুলো ভাড়া নেয়। শীতকালে আবার সমস্ত গ্রামের রাস্তা ঘাট, বাড়ির ছাদ পুরু হয়ে থাকে বরফে। মনে হয় পৃথিবীর বাইরের কোনও জায়গা। ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চল থেকে লোকে এসে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে যায় এখানে তখন।
কয়েক মাসে ইউরোপের নানান দেশে ঘুরে ঘুরে সুন্দর জায়গা আমরা বড় কম দেখিনি। হলস্ট্যাট-এর মটন কত ম্যাজিক ভিলেজ প্রকৃতির খেয়ালে অনন্য হয়ে উঠেছে, ঘরে বসে কল্পনা করাও যায় না। একমাত্র সশরীরে সেখানে গেলে বোঝা যায় এই সত্যিটা। পৃথিবীতে কত সুন্দর জায়গাই না আছে! সে সব জায়গার সৌন্দর্য বজায় রাখার দায়িত্বও তো আছে। ছোট ছোট ঘুমন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে মেট্রোপলিটান শহর, এতদিনে ইউরোপিয়ানদের সৌন্দর্যবোধ নিয়ে একটা ধারণা হয়েছে আমাদের। ঘর, বাড়ি, পাড়া, শহর সাজিয়ে রাখার যে এই ঝোঁক, তার পিছনে পর্যটন শিল্প আছে ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিগত রুচির পরিচয়ও পাওয়া যায় সর্বত্র। নাহ! এই রুচি শুধুমাত্র অর্থ হলে হয় না। স্বীকার করতেই হবে যে এখানকার মানুষের স্বভাব ও চরিত্রে সৌন্দর্য নিয়ে একটা 'কালেকটিভ কনসিয়াশনেস' আছে। অনেকটা আমাদের দেশের সিকিমের মানুষের মতো। ক্যাফে করলেই যে ফুল রাখতে হবে, সেই বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এখানকার প্রতিটা ক্যাফে-রেস্তোরাঁয় সবুজ লতানে গাছ আর ফুলের বাহার দেখতে পাওয়া যায়। সবকিছুই ঝকঝকে তকতকে।
ঘন্টা তিনেক সময়। অনেকটাই ঘুরে ঘুরে দেখা হল। বিশেষ দ্রষ্টব্য তেমন কিছু নেই, কিন্তু তাও হাঁটতে ভালো লাগে। একজন প্রবাসী বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। আমেরিকায় থাকেন, সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিয়ে ইউরোপ ঘুরতে এসেছেন স্ত্রী-কন্যা নিয়ে। আমাদের দীর্ঘযাত্রার পরিকল্পনা শুনে তিনি এমন অবাক হয়ে গেলেন যে বার বার সেই কথাই বলতে লাগলেন। মধ্যবিত্ত বাড়ির বাঙালি ছেলেমেয়ের যে এরকম করে পিঠে ব্যাগ নিয়ে মাসের পর মাস দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে পারে, সেটা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। আমরা মজাই পাচ্ছি। ভদ্রলোক শেষে খুব তারিফ-টারিফ করে বিদায় জানালেন।
বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পর সালজবুর্গে ফিরে এসে নদীর ওপরে সূর্যাস্ত দেখে আবার মন খারাপ হয়ে গেল। কালকেই ছেড়ে চলে যাব। এভা আর হ্যারির সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে কি না কে জানে? আমাদের ভালো লাগায় তারা আমাদের অ্যাপ্রিকট জ্যামের একটা কৌটো উপহার দিয়েছে, বার বার করে বলেছে আবার ফিরে আসতে। রেসিডেন্টপ্লাৎজ আর গেট্রাইডেগাস অঞ্চলের পরিবেশ, কাপুজিনবার্গের গহন নিঝুম বন, মিরাবেল গার্ডেনের ফুলের শোভা, সব ছেড়ে চলে যাব কালই। নদী আর সূর্যাস্তের সঙ্গে অনেকগুলো মনখারাপও সঞ্চয় করে চলেছি এই যাত্রায়, সেই মুহুর্তগুলোও স্মৃতি হয়ে থাকবে সারাটা জীবন। সেই স্মৃতি ঝালিয়ে নিতেই হয়তো আবার ফিরে আসব একদিন...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন