Bruges |
যাও কবিতা, এবার ফোটো, পায়ে পায়ে
জীর্ণ জমির বুকে একটা সিলমোহরও তুমি লাগাতে পারোনি
যেখানে কবরগুলো নতুন অতিথিদের দেখে মুচকি হাসে
একটার ওপর আরেকটা লাশ পড়ে আছে
যাও ঢলে পড়ো তার ওপরেই,
সে কে আমি জানি না
~হুগো ক্লাউস
১) ফ্লিক্সবাস আসতে প্রায় আড়াই ঘন্টা দেরি করেছে। অবশেষে ব্রাসেল্স থেকে বাস ধরে ব্রূগ্স পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার হয়ে গেল। ব্রূগ্সকে যদিও পশ্চিম ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলের রাজধানী বলে গণ্য করা হয়, বাস্তবে এ এক অতি ছোট্ট শহর। মাত্র একলক্ষ জনসংখ্যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। বাস-টাস বেশি রাতে পাওয়াই যায় না। বাস থেকে যেখানে নামলাম সেখান থেকে ব্রুগ্সের ক্যানাল অর্থাৎ খালটি দেখা যাচ্ছে। স্ট্রিট ল্যাম্পের কমলা আলো জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে অদ্ভূত এক আলোছায়া তৈরি করেছে। লোকজন চোখে পড়ছে না। আলোও খুব বেশি দেখা গেল না। দেখে মনে হচ্ছে মধ্যরাত। এদিকে ঘড়িতে দশটাও বাজেনি। আমাদের হোস্ট সাগাকে জিগ্গেস করে জেনেছি শেষ বাস সাড়ে সাতটাতেই চলে গেছে। তার বাড়ি খুব দূরে নয় যদিও, মিনিট তিরিশেক হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। হাঁটতে আমাদের অসুবিধেও নেই, 'ওয়াক এন্ড টক'-এর ব্যাকপ্যাকিং আদর্শ মেনে ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে বেড়াব বলেই জম্পেশ দুটো রুকস্যাক নিয়ে আসা হয়েছে। কোমরের আর বুকের স্ট্র্যাপ কষে পথ চলতে শুরু করলাম।
খালের পাশ দিয়ে বাঁধানো রাস্তা, ঘাসের গালচের ওপর বৃক্ষসমষ্টি। বার বার হাঁটা থেমে যাচ্ছে রাতের ক্ষণস্থায়ী দৃশ্যের মোহজালে, আবার সেই সম্মোহন কেটে বেরিয়ে পথ অতিক্রম করি। খাল পেরিয়ে প্রধান পথ, পথ পেরিয়ে ফুটপাথ। ঘাসজমি আর মোরাম বিছানো রাস্তাও পড়ছে। জনশুন্য নগরী। হেঁটে চলেছি। এদিকে গ্রিন ডে-র গান মাথায় বাজছে... “আই ওয়াক অন এম্পটি স্ট্রিট, অন দ্য বুলেভার অফ ব্রোকেন ড্রিমস।” আমাদের কাঁধে ব্যাগ, হাতে ফোন। পথের কমলা ল্যাম্পের অনুজ্জ্বল আলোয় অন্ধকারের ঘন চাদরে কয়েকটা ছিদ্র হয়েছে মাত্র। প্রায় মিনিট পঁচিশ পর কয়েকটা দোকান, রেস্তোরাঁ দেখা গেল। কাবাব বিক্রি হচ্ছে, সঙ্গে সেই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। রাস্তা পেরিয়ে নির্জন একটি পাড়া। সেখানেই সাগার বাড়ি।
মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন তিনতলার ঘরে। এখানকার বাড়িতে সবই কাঠের সিঁড়ি, ওঠানামা করতে গেলেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হয়। ঘরটা টঙের ওপর হলেও সুন্দর করে সাজানো। ফ্রিজে ঠান্ডা পানীয়, জলের আর ওয়াইনের বোতলের পাশাপাশি চকোলেট রাখা। মাইক্রোওয়েভ। স্টাডি টেবিল। কয়েকটা ভ্রমণ সংক্রান্ত গাইডবুক আর ম্যাপও আছে। অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। বেশ রাত হয়েছে, সাগার সঙ্গে তেমন গল্প হল না। ব্যাগে যা ঘাসপাতা আর রুটি রাখা ছিল, তা দিয়েই একটা স্যুপ করে নমো নমো করে ডিনার সেরে শুয়ে পড়া হল।
২) পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গরমটা বেশ কমেছে। সকালের ব্রেকফাস্টের জন্যে আমরা এমনিতে দুধ আর মুসেলি কিংবা কর্নফ্লেক্স কিনে রাখি, রান্না না করেই ঝটপট খাওয়া হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে বাইরেও খেয়ে নিতে হয়। তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি পাড়াটা ক্যালেন্ডারের ছবির মতো সুন্দর। ছিমছাম হালকা রঙের আধুনিক বাড়িগুলোর সামনে ছোট্ট লন অথবা বাগান। সামনেই একটা মন ভালো করা চেস্টনাট রঙের গির্জা আছে। ডান দিকে থাকা বেকারি থেকে মাখন আর ক্রোয়াশের সুগন্ধ ভেসে আসছে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে রাস্তার মাটি ভিজে, তার ওপর পড়ে আছে অনেক ফুল। এরকম সকাল দেখলে মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ‘সুন্দর’ কথাটা এত বেশি ব্যবহার করছি যে বলার নয়! বিদেশ বলে সবই কি সুন্দর নাকি? তা অবশ্য নয়। প্যারিসে কালোঝুলি মাখা কলকারখানা দেখেছি, বার্সেলোনায় বাসে ঝগড়া করতে দেখেছি চালককে। দু’ একজন গাঁক গাঁক করে কথা বলে, থুতুও ফেলে রাস্তাঘাটে। সে আর আলাদা করে কী বলব? কিন্তু মোটের ওপর প্রকৃতি এখানে দরাজ, আর প্রকৃতিকে রোজকার জীবনযাত্রার সঙ্গে পৃথক করার চেষ্টা বিশেষ চোখে পড়েনি। মানুষের হাতে গড়া সভ্যতা আর প্রকৃতি সাবলীলভাবে মিশে গেলে সব কিছুই চোখে সুন্দর লাগে। সেই সৌন্দর্য যে এখানে ভুরি ভুরি আছে, সেটা অস্বীকার করা চলে না।
পদব্রজে ভ্রমণ শুরু হল যথারীতি। এইখানে আসার পর থেকেই ডানকুনির ডানপিটে মেয়ের লাফালাফি বহুত বেড়ে গেছে। তিনি নাকি এমন সুন্দর শহর আগে দেখেননি। তাঁকেও দোষ দেওয়া যায় না। অন্য অনেক শহরের মতন এই শহরের প্রাচীন কেন্দ্রটা প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে থাকার ফলে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, কিন্তু এখানকার মেজাজ অনেকটাই অন্যরকম। যেহেতু শহরের প্রাণকেন্দ্রকে বেষ্টন করে আছে সমুদ্র থেকে ঢুকে আসা ছোট বড় নানা খাল। প্রধান খাল হল দাইভর(dijver), তবে আমাদের চেনা খালের চেহারা নয়, বরং মনে হয় সুন্দর ছিমছাম একটা ছোট্ট নদী ঘুরে ফিরে চলে গেছে শহরের ভিতর দিয়ে। খালের ধারেই ঐতিহ্যশালী প্রাচীন বাড়ি ঘরদোর, গির্জা, মিউজিয়াম, ব্রিউয়ারি, স্যুভেনির আর কেকের দোকান, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। (ওল্ড টাউন মানেই সুদৃশ্য ক্যাফে, রেস্তোরাঁ থাকবেই, নিয়মের নড়চড় নেই। ভাবছি এরপর থেকে এ নিয়ে একটা লাইনও খরচ করব না) প্রথম দর্শনে মনে হয় পরীদের রাজত্বে চলে এসেছি। এমনিতে ইউরোপের সব শহরই সুন্দর, যত্ন করে ধরে রাখে প্রাচীন স্থাপত্য আর ইতিহাসের চিহ্ন। তার মাঝেও ব্রূগ্স-এর মতন কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট মুক্তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মুগ্ধতার আবেশ কাটতেই চায় না।
ব্রূগ্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা হল রোজেনহোদকাই। এখানে দাইভর খালটা একটা বাঁক নিয়ে মিশেছে গ্রয়েনেরেই খালের সঙ্গে। সেই সন্ধিস্থলে অবস্থিত ছোট্ট উল্ফস্ট্রাট সেতু। সেতুর মাঝে সেন্ট জোয়ান ভ্যান নেপমুকের প্রতিমাটি তৈরি করেছিলেন ফ্রেমিশ শিল্পী পিটার পেপার্স। যেখানে খালটা ঘুরেছে সেখানে অনেকগুলো গেস্ট হাউস গড়ে উঠেছে, তাদের দেওয়ালের ওপর নেমে এসেছে সবুজ গাছের লতাপাতা। নৌকো করে খালের সরু সর্পিল জলধারা দেখার ব্যবস্থা আছে, সেখানে মানুষের ঢল। জায়গাটা ঘিরে মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করা খয়েরি আর পাথুরে হলুদ রঙের বাড়ি। তাদের ঢালু টালির ওপর সার দিয়ে থাকা লাল চিমনি। একসময় এখানে ‘Rosarie’ অর্থাৎ জপের মালা বিক্রি হত গির্জাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, সেই সূত্রেই খালটার নাম হয়ে গেছে রোজেনহোদকাই। চওড়া শান বাঁধানো পাথরের ফুটপাথের ওপর দিয়ে হেঁটে একসময় এগোতেই হল। ইনস্টাগ্রামসেবী দর্শকের জুলুম এমনই বেড়েছে যে কল্পনার আরামকেদারায় দু’ দন্ড বসে চোখে চোখ রাখা প্রায় গর্হিত অপরাধের পর্যায়ে চলে গেছে। যত কবিতার লাইন মাথায় আসে স্যাটাস্যাট মাথায় লিখে রাখো, পাবলিক প্লেসে কাব্যি করা চলবে না।
ব্রূগ্স শহরের খ্যাতি শুধু জলপ্রণালীর জন্যেই নয় অবশ্য। হুগো ক্লাউসের জন্ম হয়েছিল এখানেই। প্রায় পঞ্চাশ বছরে ফ্লেমিশ সাহিত্যকে অন্য পর্যায় নিয়ে গেছেন ক্লাউস। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ ‘বেলজিয়ামের দুঃখ’ রাতারাতি তাঁকে বিশ্ব সাহিত্যিকের তকমা এনে দিয়েছিল। ঝড়ের বেগে লিখতেন ক্লাউস। কবিতা, নাটক, উপন্যাস। বিধ্বংসী ভাষায় আক্রমণ করতেন রাজনৈতিক ভন্ডামি আর সামাজিক অসঙ্গতিকে। শেষ বয়সে যখন আলজাইমারে কাবু করে ফেলেছে, তিনি স্বেচ্ছামৃত্যর অর্থাৎ ‘ইথনেসিয়া’ চেয়ে আবেদন করেন সরকারের কাছে।
ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলে আরো বহু প্রতিভাধর শিল্পী ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছে। ফ্লেমিশ সাহিত্যের অগ্রণী সাহিত্যিক হেন্ড্রিক কনসাইন্স, গাইডো গেজেল থেকে আধুনিক কালের লুই পল বুন সকলেই ব্রূগ্সে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। ফ্লেমিশ রেনেসাঁর প্রধান শিল্পী জন ভ্যান আইক বহু বছর থেকেছেন এই শহরে, ব্রূগ্সের ব্যবসায়ী আর্নলফিনির আঁকা তার পোর্ট্রেট ন্যাচুরালিজ্ম এর অন্যতম উদাহরণ হয়ে রয়েছে আজও।
আমরা সংকীর্ণ পাথুরে নকশাদার গলি দিয়ে এগোতে এগোতে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই অসাধারণ কোনও কারুকার্যখচিত স্থাপত্যের নমুনা অথবা লোভনীয় কোনও কফিশপের হাতছানি দেখে। সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি গড়ে তুলতে পারেনি শিল্পীরা। আমাদের পরিযায়ী চোখে মুগ্ধতার রেশ কাটে না। বার বার মনে হয় ছোটবেলায় দেখা বিদেশী পোস্টকার্ডের ছবি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এখানকার মানুষের রোজনামচা, আমাদের কাছে সেই অতিকথন হয়ে ধরা দেয়। স্বল্পসময়ের ভ্রমণে এই হল প্রধান ঝামেলা। এর থেকে বেরোতে না পারলে না চাইতেও গতানুগতিক টুরিস্ট ট্র্যাপে আটকে শহরের দ্রষ্টব্যের চক্কর কেটে যাব শুধু। সেটা মোটেও কাম্য নয়।
হোলি ব্লড ব্যাসিলিকাতে প্রার্থনা চলছে। গির্জার চুড়োতে সোনালি রোদের মাখামাখি। কাঠের সিঁড়ি। পায়ে পায়ে উঠে গেলাম। কানায় কানায় ভর্তি গির্জার হল। যীশুর প্রতিমার সামনে জ্বলে আছে বহু মোমবাতি। ধর্মানুলম্বীদের প্রত্যয়ী দৃষ্টি নিবদ্ধ ফাদারের ওপর। ‘মাস’-এর পর ফাদার বাইবেলের কয়েকটা অংশ পড়বেন। অপেক্ষা করছে লোকজন। মুখ দেখা যাচ্ছে না কারো। আমাদের ভক্তিভাব বরাবরই কম, বেরিয়ে এলাম বাইরে।
প্রধান স্কোয়ারে অবস্থিত বিখ্যাত গথিক স্থাপত্য বেলপার্ক টাওয়ার। গির্জা, প্রাচীন স্থাপত্য আর দোকানপাটের রমরমা। ঘোড়ার গাড়ি করে করে অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাকিরা জড় হয়েছে স্কোয়ার চত্বরে চলতে থাকা ফ্লেমিশ গানের আসরে। প্রায় দশ বারো জন ছেলে মেয়ে সাদা জামা গোলাপী প্যান্ট পরে ফ্লেমিশ বাদ্যযন্ত্র সহকারে একটা ‘ওপেন পারফর্মান্স’ দিচ্ছে, অনেকেই হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে তাদের। নতুন শিল্পীরা এরকম প্রকাশ্যে তাদের শিল্পকলার প্রদর্শন করে নিজস্ব গান বাজনার সিডি বিক্রি করে, খানিক পরিচিতিও পায়।
মিনেওয়াটারপার্কের দিকে পা বাড়ালাম একসময়। চোখ খুঁজছে নতুন দৃশ্য, স্মৃতিতে রেজিস্টার করে রাখতে হবে সব। মাঝে মাঝে কানে ভেসে ওঠে হারমোনিকার সুর। আপন মনে বেহালা বাজানো কিশোর। লেবুরঙা রোদে হাতে আইসক্রিম আর বার্গার নিয়ে টলমলে পায়ে দৌড়চ্ছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। কোলেপিঠে খেলে বেড়ানো মফস্বলের রোদ্দুর আচমকা দেখা পেয়েছে প্রবাসী বন্ধুর। লাবণ্যপ্রভার উজ্জ্বল হাসি একই রকম কোমল। পথের বাঁকে বাঁকে মনকেমনিয়া জলধারা উঁকি মেরে আবার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায়। ক্যামেরার চোখ ওভারটাইম খেটে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে, তাই মনের ক্যামেরায় ছবি তুলি। মাটিরঙা চকোলেট খেয়ে দেখা হল। মাটি মাটিই স্বাদ সন্দেহ নেই, কিন্তু চকোলেটও বটে। ওইটুকু জায়গাতেই একের পর এক জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি। মধ্যযুগীয় স্থাপত্য, ফ্লেমিশ সংস্কৃতি আর লোককথার ঝুলি উপুড় করা জাফরান রঙা ঐতিহ্যের বাহুডোর।
পঞ্চদশ শতাব্দিতে ডাচ সংস্কৃতিতেই উইচ বা ডাইনিদের আবির্ভাব। কত রমণীকেই ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। বেলজিয়ান শিল্পী পিটার ব্রুগেলের আঁকায় এই সময়েই উঠে আসে আমাদের চেনা ডাইনিদের কল্পচিত্র। ঝাড়ুর উপরে বসে উড়ে যাওয়ার ছবি, কালো বেড়াল সঙ্গে নিয়ে মস্ত হাঁড়িতে তৈরি করা জাদুবিদ্যার টোটকা। এই ছবির অনেকগুলোই আঁকা হয়েছে ব্রূগ্সে বসে, বছর বছর ‘উইচেস অফ ব্রূগ্স’ বলে একটা প্রদর্শনীও হয় এখানে।
মিনেওয়াটারপার্কে এসে আবারও চোখ জুড়িয়ে গেল। অশোকবাটিকাও হয়তো এর চেয়ে বেশি সুন্দর ছিল না। সবুজ ঘাসের গালচের ওপর রঙবেরংয়ের ফুলগাছ, তার মাঝ দিয়ে স্বচ্ছ চওড়া জলধারা এগিয়ে গিয়ে শেষে একটা হ্রদে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে রাজহাঁস জল কেটে সাঁতার দিচ্ছে সেখানে। ছোট ছোট ধনুষাকারের কাঠের সেতু জলধারার ওপর দিয়ে চলে গেছে। হাঁসের দলের সমান্তরালে কাঠের নৌকোও চলেছে যাত্রীদের সঙ্গে করে, তাদের ছানাবড়া দৃষ্টিকে তোয়াক্কাই করছে না হাঁসের দল। নাহ! এ বড় ডেঞ্জারাস জায়গা। এত সুন্দর চোখে সইবে নাকি? এখান থেকে তড়িঘড়ি কেটে পড়তে হবে দেখছি।
কোথায় যেন পড়েছিলাম ব্রুগ্সের মানুষেরা আবেদন জানিয়েছিল শহরের সৌন্দর্য়ীকরণের প্রতিবাদ করে। তাঁদের অভিযোগ, ভ্রমণ ব্যবসার কথা ভেবে ব্রূগ্সকে এমন সুন্দর করে রাখা হয়েছে, যে সাধারণ মানুষের সহ্য করতে অসুবিধে হচ্ছে। কোথাও ধুলোবালি নেই, কুরুচিকর বাড়িঘর নেই, অপ্রিয় দৃশ্য নেই, সৌন্দর্যের আধিক্যে ডিজনিল্যান্ড হয়ে গেছে সবকিছু। এত সুন্দর বরদাস্ত করা যায় না, খানিকটা অযত্ন আর অপরিস্কার না থাকলে কোনও শহর মানুষের বসবাসের যোগ্য হয় না। তখন প্রচন্ড হাসি পেয়েছিল এই পাগলামি দেখে, কিন্তু ব্রূগ্সে আসার পর ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। স্বর্গকানন মাটিতে নেমে এলে মানুষ স্বর্গে যেতে চাইবে কেনে? পাপপুণ্যের হিসেবও করতে হবে না বেঁচে থাকতে।
ফোনে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। খুলে দেখি কাউচসার্ফিং চ্যাটে একজন পিঙ করেছে। বার্ট রেব্রূক বলে একজন জানতে চেয়েছে আমরা তার সঙ্গে দেখা করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিতে ইচ্ছুক কি না? কাউচসার্ফিং হ্যাংআউটের একটা সুবিধে, নতুন কোনও জায়গায় গেলে সেখানের স্থানীয় মানুষ অথবা টুরিস্টদের সঙ্গে দেখা করা যায় হ্যাংআউটে যোগাযোগ করে। তাতেও অনেক নতুন বন্ধু হয়, বেশ খোলামনে আড্ডা চলে। বার্টকে সম্মতি জানিয়ে দিলাম চটপট। বাঁচা গিয়েছে। এই অসহ্যকর সুন্দর জায়গাটা থেকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে চলে যেতে হবে, বরাতজোরে একজন স্থানীয় ছেলেকে পেয়েছি। আর কী চাই? কাছাকাছি একটা পরিত্যাক্ত গির্জার দায়িত্বে আছে বার্ট, সেখানে সে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে।
মিনেওয়াটারপার্ক থেকে বেরিয়ে গুগল ম্যাপের সাহায্যে এগিয়ে চললাম। এই গলি সেই গলি করে প্রায় মিনিট কুড়ি লাগল জায়গাটায় পৌঁছাতে। বার্টকে ফোন করতেই সে বেরিয়ে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। তার বয়স চৌঁতিরিশের আশেপাশে হবে, যদিও মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে অনেকটা। আমাদের সে জিগ্গেস করল, “কী খাবে বল? বেশি কিছু নেই... হোয়াইট ওয়াইন, রেড ওয়াইন আর খানিকটা পেপসি আছে।” আমাদের কিছুতেই আপত্তি নেই। বার্ট বলল, “চল, গির্জার ভিতরে গিয়ে বসা যাক।” ভিতরে ঢুকে বেশ আরাম হল। গির্জাটা মামুলি, মাথা খারাপ করা সৌন্দর্য নেই। তাছাড়া অনেকদিন যে ব্যবহারে নেই সেটাও বোঝা যায়। যদিও মাসের জন্যে রাখা ডেস্ক, ঝাড়লন্ঠন, সাজসজ্জা সবই করা আছে। সামনের জায়গাটা যেখানে যীশুর মূর্তি থাকে, সেটা অবশ্য শুন্য। সেখানে লম্বা টেবিল পেতে একটা পাবের ড্রিংক কাউন্টারের মতন করা হয়েছে।
আমি কান চুলকে বার্টকে জিগ্গেস করলাম, “এই ব্যাপারটা কী ব্রো? গির্জাটাকে কি নাইটক্লাব করা হবে নাকি?" বার্ট একগাল হেসে বলল, “ইয়াপ ডুড। প্রায় ওরকমই ব্যাপার। আসলে গির্জাটা অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যিনি কিনেছেন, তাঁর ইচ্ছে নানা রকম বেসরকারি নিজস্ব অনুষ্ঠান, পার্টি করা হবে এখানে। সময়ে সময়ে কয়েকটা হয়েছেও। রঙিন আলো দিয়ে সাজিয়ে দিলে পুরোনো গির্জাটা নাইটক্লাবের চেয়ে কম যায় না, বরং ঐতিহাসিক এই ঝাড়বাতি আর অলঙ্করণের জন্যে অন্য একটা আবেশ তৈরি হয়। ওই ইভেন্ট ম্যানেজার হিসেবেই জায়গাটা দেখাশোনা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পরে অবশ্য গির্জাটা হয়তো ভেঙ্গে ফেলার পরিকল্পনা করা হবে।” কয়েকটা ছবি সে দেখাল আমাদের। কথাটা ভুল বলেনি। অনুষ্ঠানের সময় গির্জাটা নাইটক্লাবের মতনই দেখাচ্ছে বটে। বার্ট ততক্ষণে যত পানীয় ছিল সব নিয়ে এসেছে।
তার সঙ্গে এইবার আলাপ হল ভালো করে। এখানে কাজ করলেও আসলে বার্ট শহরের বাইরে একটা ছোট্ট গ্রামে থাকে। এখান থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার। সাইকেল অথবা মোটরসাইকেল করে চলে আসে। কাজটা নিয়ে সে খুব একটা সন্তুষ্ট নয়, আপাতত কাজ চালানোর জন্যে করছে। আমাদের পরিচয় দিলাম তাকে। পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে আমার সঙ্গিনী বার্টকে জিগ্গেস করলেন, “এত সুন্দর গির্জাটা ভেঙ্গে ফেলার কথা ভাবছে কেন? আমরা তো ভাবতাম এইখানে সব হেরিটেজই যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়।”
বার্ট একটু হোয়াইট ওয়াইন গলায় ঢেলে নিয়ে বলল, “তা হয়, কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব হয় যখন সেই হেরিটেজ থেকে সরকারের আয় হয়। তুলনায় এই গির্জাটা দেখতে সুন্দর হলেও তেমন কোনও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই এটার, প্রতিদিনের প্রার্থনাতেও লোকজন খুব কম আসত। তাই বন্ধই করে দেওয়া হয়েছিল। যিনি কিনেছেন তার অত হেরিটেজ-ফেরিটেজে আগ্রহ নেই, বরং মুনাফা কামানোর ইচ্ছে বেশি। ভদ্রলোকের নানারকম ব্যবসা আছে। বিলিয়নার। হয়তো কোনও ফন্দি মাথায় ঘুরছে।”
বার্ট তার মায়ের সঙ্গে থাকে, গার্লফ্রেন্ড আপাতত নেই। আগেরজনের সঙ্গে ব্রেকাপ হয়ে গেছে। স্কুবা ডাইবিং-এর কোর্স করেছে, জলের নিচে ডাইভ দিতে বেশ কয়েকটা জায়গায় গেছে। সেই নিয়ে কথা হতে লাগল। মেক্সিকোর ভূমিগত নদীর সেনোটেগুলো ইদানিং কালে ডাইভারদের কাছে অন্য জগতের দরজা খুলে দিয়েছে, সকলেই সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। বিরাট গির্জায় শুধু আমরা তিনজন বসে বসে গল্প করছি। কথার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পরিত্যক্ত গির্জায় আমাদের আড্ডা জমে উঠেছে ভালোই।
কথায় কথায় সঙ্গিনী বললেন, “একটা কথা বল তো! তোমরা সাধারণত বাড়িতে কী খাও? রোজকার খাবার বলতে যা বোঝায়, রেস্তোরাঁয় সেইরকম জিনিস তো দেখা যায় না। রোজ রোজ নিশ্চয়ই স্টিক আর বার্গার খায় না মানুষ।”
বার্ট হেসে বলল, “একেবারেই না। ওইসব কেউই খায় না। বাড়িতে বেশিরভাগ দিনেই মোটা মোটা পাউরুটি অথবা ইনস্ট্যান্ট রাইস খাই আমরা। সঙ্গে একটা মিট স্যুপ থাকে, বড়জোর কয়েকটা সবজি সেদ্ধ না ভাজা। তোমাদের দেশে কী খাও?"
আমি বললাম, “সহজ। প্রতিটা রাজ্যে খাওয়াদাওয়ার তফাৎ আছে বটে কিন্তু লাঞ্চ অথবা ডিনার করতে গেলে আনে রেস্তোরাঁতেই সব পদ নিয়ে একটা কমপ্লিট মিল অথবা 'থালি' থাকে, সেইরকম স্থানীয় মানুষরাও খায়। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, রুটি, সবজি যাই হোক।”
বার্ট-এর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার কলেজ জীবন, বেলজিয়ামের জীবনযাত্রা, গ্রামের বাড়ি, আমাদের দেশের নানা কথার মাঝে অনেকক্ষণ সময় কেটে গেছে। ইন্টারনেট এসে যাওয়ায় এই বন্ধুত্বগুলো ফেসবুক অথবা ইনস্টাগ্রামের দৌলতে পরেও টিকে থাকে, এখনও মাঝে মাঝেই বার্টের সঙ্গে গল্প হয় আমার। কোভিড চলাকালীন বেচারা বেশ মুষড়ে পড়েছিল, বছর দুই বাড়ি থেকেই বেরোয়ইনি প্রায়।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর যখন বার্টকে বিদায় জানিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম, বিকেল হয়ে গেছে। আমাদের 'ওয়াল অফ বিয়ার'-এ যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বার্ট, অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগোলাম সেইদিকে। কাছেই সেই জায়গা। বিয়ারের একটা দোকানে নানা ধরনের বিয়ার আর তার উপযুক্ত গেলাস সাজিয়ে রাখা হয়েছে দেওয়াল জুড়ে। গেলাসের সাজবাহার দেখেও বাহবা দিতে হয়। এরা পারেও বটে।
মিউজিয়ামের ভিতরে ঢোকার ইচ্ছে নেই আমাদের, বরং পায়ে পায়ে গোটা পুরোনো শহরটা চক্কর দেওয়ার মতলব করেছি। এই পরীর রাজ্যে আমাদের হাতে মাত্র আজকের দিনটাই, যতখানি অভিজ্ঞতা সঞ্চার করা যায়। চেনা অচেনা খালের পাড়ের রাস্তা দিয়ে চলেছি। বিকেলে স্বাভাবিক ভাবেই সব রেস্তোরাঁ আর পাবে ভিড় হয়ে আছে। স্টিকের গন্ধে জিভে জল এসে যায়।
খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছালাম ব্রূগ্সের সাদা অতিথিশালা বা কলোনিগুলোর কাছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে জলপথে ব্যবসা চালিয়ে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এখানকার ব্যবসায়ীরা, তাদের দেওয়া অনুদান কাজে লাগিয়ে শহরের নানা জায়গায় নিঃসম্বলদের থাকার জন্যে এই দরিদ্রাশ্রম কলোনিগুলো তৈরি করা হয়েছিল। মাঝারি একটা পরিসর জুড়ে থাকা একতলা ছোট ছোট সাদা বাড়ি সার সার দাঁড়িয়ে, মাঝখানে অনেকটা বাগান। শান্ত পরিবেশ। খানিকক্ষণ বসে থাকা হল।
বেলপার্ক টাওয়ারের উল্টো দিকেই ব্রূগ্সের শপিং স্ট্রিট স্ত্রিনস্ট্রাট। নামকরা ব্র্যান্ডের দোকান, ফ্রাইয়ের বড় বড় রেস্তোরাঁ, জামাকাপড়, স্যুভেনির, বেকারি থেকে ব্যাঙ্ক সব কিছু পাওয়া যায়। নামকরা একটা দোকান থেকে খানিক ফ্রাই কিনে চিবোতে চিবোতে ম্যাকডোনান্ডে ঢুকে পড়া হল। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। বার্গার খেয়ে খনিকটা ক্ষিদে মিটবে।
আলোচনা করে ঠিক করা হোল যে সন্ধ্যের আগাআগি বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক, রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করে আবার রাতে আসা হবে। অন্ধকার হলে এই জায়গা কেমন দেখতে লাগে, সেটা জানার একটা আগ্রহ ছিল। সেইমতো রাতের খাওয়ার জন্যে রুটি আর কাবাব কিনে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
ঘন্টা আড়াই পড়ে যখন আবার রাস্তায় নামা হল, আগের রাতের পরিবেশটা ফিরে এসেছে। অনকেই ব্রূগ্সে আসে ব্রাসেল্স থেকে ডে ট্রিপ করতে, তারা সন্ধ্যের আগাআগি ফিরে যাওয়ায় শহরটার বাস্তব চরিত্র জেগে উঠেছে। নিরিবিলি। নির্জন। খালের জলে তখনও পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভাটা অদৃশ্য হয়ে যায়নি, বাড়িফেরা পাখিদের কলতান শোনা যাচ্ছে অনবরত।
সকাল থেকে হাঁটাহাটি কম হয়নি। পায়ে ব্যথা হওয়াই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে চলে এলাম দুই খালের সন্ধিস্থলে। সকালে যেখানে অজস্র মানুষের কোলাহল চাক্ষুষ করেছি, সেই লাস্যময়ী সেতু এখন ফিকে আলোয় একলা দাঁড়িয়ে আছে। কোনও গুঞ্জরণ নেই, নেই উল্লাস। ফিকে হলুদ আলোয় অন্যরকম লাগছে তাকে। কিছুটা অন্যমনস্ক। ক্যামেরার চোখ সেটা বোঝে না।
এগিয়ে চলি। গির্জার সামনে গমগমে আওয়াজ। ফ্রি কনসার্ট হচ্ছে। বহু মানুষের ভিড়। নীল, সবুজ আলোর ঝলকানিতে দেখা যায় হরিণচোখি গায়িকাকে। কান্ট্রি মিউজিকের মাদকতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দর্শকদের। অনেকে নাচছে। বাকিরা মাথা নাড়ছে গানের তালে তালে। আরোহী গানের সুরে ব্যবধান কমছে। উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তাগুলো ক্রমশঃ কোনঠাসা। অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে দেশের সীমানা। হাত ধরাধরি, কোলাকুলি। অপরিচিত মানুষ পরিচিত হয় বিয়ারের ক্যান আর হাসির ফোয়ারায়। গানে ভেসে যাওয়া জীবন।
এইটুকুই। এইটুকুই চাই মাত্র! যাতাযাতের অন্তরে থাকা ভ্রান্তিবিলাস! অপরিচিত হাতের ছোঁয়া! এই মুহূর্তটুকু থাক! বাকি সব হারিয়ে যাক গানের চাদরে।
Minnewaterpark |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন