আকাশের রঙ উজ্জ্বল থাকে পাহাড়িয়া প্রতিশ্রুতি
গ্রামের ওপারে নীরবে ভেসে আসে মেঘেদের অভিশ্রুতি
হলুদ রঙের হাতমোজা পরে, ছোট্ট মেয়েটি চুপ
উঁকি মেরে সে ফুটো দিয়ে দেখে, বেণীপুতুলের স্তুপ
অব্যবহৃত তারা, ভুলে গেছে লোকে বন্ধ ঘরে রেখে
মেয়েটির চোখে তবু বিস্ময়, অবাক চোখে সে দেখে
~ম্যারি রুয়েফলে
১) ওপরের কবিতাটি লিখেছেন মার্কিন কবি ম্যারি রুয়েফলে। কবিতার নাম 'বাভারিয়া'। জার্মান আল্পসের বাভারিয়া অঞ্চলের অভূতপূর্ব সৌন্দর্য দেখে যে তিনি এই কবিতা লিখেছেন বললেই চুকে যেত, কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে ভুল তথ্য দেওয়ার সাহস আমার নেই। কবি নিজে কী ভেবেছেন অথবা বলেছেন সেই সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, কিন্তু বহু ব্যক্তির মতে রুয়েফেলের এই কবিতার অনুপ্ররণা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাভারিয়াতে অবস্থিত ফ্লোসেনবার্গ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। হিটলারের নাজি রাজত্বের অন্যান্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতন বাভারিয়ার এই ক্যাম্পেও হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। হেইনরিখ হিমলারের আদেশে অমানুষিক অত্যাচার ও গণহত্যা করা হয়েছে বহু ইহুদি বন্দীদের। ১৯৪৫ সালে যখন আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়ে একের পর এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প অধিকার করে মুক্ত করছে বন্দিদের, হিমলার আদেশ দেন একটা ইহুদি বন্দিও যেন জীবিত অবস্থায় শত্রুদের হাতে না পড়ে। ১৭০০ জন ইহুদিকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য ক্যাম্পে। পথে মার্কিন বিমানের আক্রমণে যত বন্দী আহত হয়েছিল, তাদের গুলি করে মারা হয়। নির্দ্বিধায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয় প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষকে। ফ্লোসেনবার্গ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সেই অতীত বিভীষিকা হয়ে রয়ে গিয়েছে মানুষের মনে। এই অকালমৃত অতৃপ্ত আত্মাদের কথা বোঝাতেই হয়তো অব্যবহৃত বেণীপুতুলের কথা বলা হয়েছে, যাদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ মেঘের শব্দের মত ঘোরাফেরা করে বাভারিয়ার পাহাড়ে।
আমরা যেই গ্রামটার দিকে চলেছি, তার নাম রামসাউ। বাভারিয়ার ছোট্ট শহর বেখতেসগাদেন থেকে আরো অনেকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। টুরিস্ট সার্কিট থেকে বহুদূরে অবস্থিত পাহাড়কোলের এই জনপদে পঞ্চাশ-ষাটটা পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। শান্ত, নির্জন, কোলাহলশুন্য। প্রথম থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, পরিচিত জায়গার পাশাপাশি অন্তত কয়েকদিন আল্পসের কোলের কোনও ঘুমন্ত গ্রামে গিয়ে ডেরা বাঁধব। নিজের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটানোর জন্যে যে নির্জনতার প্রয়োজন, সেই নির্জনতাকে আহ্বান জানানোর পথটুকু যেন খোলা থাকে। খোঁজখবর করে অবশেষে এই গ্রামটির সন্ধান পেয়েছি। পাহাড়ের জঙ্গুলে পথে হাইক করব, গ্লেশিয়াল হ্রদের জলে স্নান করব, খরস্রোতা নদীর ধারে চুপ করে বসে কাটিয়ে দেব। এইটুকুই...
সালজবুর্গ থেকে বাসে করে বেখতেসগাদেন। সেখান থেকে বাস বদলে রামসাউ। আমাদের থাকার গেস্ট হাউসটা বড় রাস্তার ঠিক পাশে, যদিও গাড়ি প্রায় চোখেই পড়ে না। ঘন্টায় একটা করে বাস যায়, বিকেলের পর সেও বন্ধ। এখানে দু' তিনটের বেশি থাকার জায়গাও নেই, অতএব প্রতিটা গেস্ট হাউসেই রেস্তোরাঁ থাকে। স্থানীয় মানুষেরাও সেখানে খেতে আসে মাঝে মাঝে।
রামসাউ গ্রামটা এতটাই ছোট যে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই শেষ হয়ে যায়। পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠলে অনেকটা দূরে দূরে খানকয়েক নির্জন কটেজ আর দোতলা কাঠের বাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু এত দূরের বাড়িগুলোকে ঠিক গ্রামের আওতায় ফেলা চলে না। একশ মিটার দূরেই একটা আদ্যিকালের সাদা রঙের গির্জা। রাস্তার ধার বরাবর একটা খরস্রোতা পাহাড়ি নদী বয়ে চলে গেছে, তার ওপরে কয়েকটা কাঠের সেতু দেখতে পাওয়া যায় । কাঠের সেতু পেরিয়ে চড়াই রাস্তা সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফোঁকরে হারিয়ে গেছে। নদীর ধারেই রঙবেরংয়ের ঘাসফুল, মখমলে সবুজ ঘাসের জাজিমকে বেষ্টন করে থাকা বৃক্ষরাজি। ইতিউতি উঁকি মেরে যায় পযমন্ত পাহাড় চুড়ো। বরফের গুঁড়ো গায়ে মেখে থাকা বুগিয়াল। আহ্লাদি আকাশের দিকে হাত বাড়ানো পাইন-ওক-দেবদারু গাছের অলিভ আঙুল। ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে হিনটারসি অর্থাৎ হিনটার হ্রদের দিকে। 'see' মানে জার্মান ভাষায় হ্রদ, এই অঞ্চলে কোনিগসে, হিনটারসি, চিমসি, স্টার্নবার্গসি, আমারসি, ওয়াগিঙ্গারসি নানা বিখ্যাত হ্রদ ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশ হ্রদই গ্লেশিয়াল লেক, তাদের উৎপত্তি হিমযুগের সময়ে। ধারেকাছে কোনও জনবসতি নেই, মাইলের পর মাইল জুড়ে গভীর অরণ্য আর উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি।
সুজান বলে যেই মেয়েটি আমাদের সঙ্গে হেসে হেসে আলাপ করে গেল তার জার্মান পদবি বলতে গেলে আমার দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সেই চেষ্টা করব না। এমনিতে মেয়েটির স্বভাব চমৎকার, মোটামুটি ভালোই ইংরেজি বলে। একটা ম্যাপ দিয়েছে এই অঞ্চলের, এছাড়া বাসে যাওয়ার জন্যে একটা কার্ডও। এই কার্ড দেখালে বাসে টিকিট কাটতে হবে না। সুজন আমাদের বলল, "বসে না থেকে বরং আজ কোনিগসে লেকটা দেখে এসো। বেখতেসগাদেনের বাস আসবে এখনই। ওখান থেকে কোনিগসের বাস আছে, পয়সাও দিতে হবে না। যাও যাও। ঘুরে এসো , ঘুরে এসো!"
সুজানের উৎসাহ সংক্রমিত হল আমাদের মনেও। ঘুরেই আসি তাহলে! কোনিগসে লেক নাকি প্রকাণ্ড, অনেকটা খাঁড়ির মত এগিয়ে গেছে উঁচু উঁচু পাহাড়ের গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে। দু'দিকের উঁচু পাহাড়গুলো এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ 'ওয়াৎজম্যান' এর শাখাপ্রশাখা। নৌকোয় করে খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে অনেকদূর চলে যাওয়া যায়। এই অঞ্চলেই যে সে লেক অবস্থিত, সেটা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। কোনিগসে লেক আসলে বেখতেসগাদেন ন্যাশনাল পার্কের অংশ। সেখানে যাওয়ার কথা আমাদের এভাও বলেছিল। তখন যাওয়া হয়নি বটে, কিন্তু এখন যখন সুযোগ পেয়েছি, ঘুরে আসাই যায়।
চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গেস্টহাউসের সামনেই বাসস্টপ। বাস পেয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। বেখতেসগাদেন থেকে বাস বদলে ঘন্টাখানেক পর যখন কোনিগসের কাছাকাছি পৌঁছালাম, তখন ঘড়িতে দুটো বাজছে।
হ্রদ তো নয়, যেন সমুদ্র। কোনিগসে লেক এমনিতেও বিখ্যাত জায়গা, সামনের চত্বরে বহু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, জনসমারোহ যাকে বলে। গ্রীষ্মকালে সপরিবারে পিকনিক করতে এসেছে, প্রথম মোলাকাতের উদ্দীপনা নেই কারো। যত আকুলিবিকুলি আমাদের মতো হতভাগ্যদের, চাতক পাখির মতোই প্রকৃতির আশ্লেষ পাওয়ার জন্য বসে থাকা। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। নৌকোর টিকিট কাটতে হবে। লেকের মাঝে দুটো দ্বীপ অবস্থিত। প্রথম দ্বীপ থেকেই ফিরে আসা যায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, আবার দ্বিতীয় দ্বীপেও চলে যাওয়া যায়। টিকিটের দামে অনেকটাই তফাৎ, আমরা দুজনের জন্যে প্রথম দ্বীপ সেন্ট বার্থলোমার টিকিট কেটে নৌকোয় উঠে বসলাম।
কোনিগসে যে জার্মানির সবচেয়ে স্বচ্ছ জলের হ্রদ, সেই কথাটা আগেই শুনেছিলাম। চাক্ষুষ দেখে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল। জল এতটাই পরিষ্কার যে মাঝে মাঝে মনে হয় একটা আয়না বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দূষণ যাতে না হয়, সেইজন্যে নৌকোগুলোও চলে বিদ্যুতে। জারদৌসী শাড়ির পাড়ের মতো স্বচ্ছ জল কেটে এগিয়ে চলেছি। ধীরে ধীরে জেটি দূরে সরে যাচ্ছে। অনেকটা গিয়ে ডানদিকে বাঁক নিতেই আধুনিক যুগের সমস্ত চিহ্ন মুছে গিয়ে একেবারে আদিম প্রকৃতির মাঝে গিয়ে পড়লাম। দু'দিকে উঁচু উঁচু পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চওড়া খাঁড়ি, মাঝে মাঝে ন্যাড়া রক ক্লাইম্বিং ওয়াল। সবজেটে কুয়াশায় আচ্ছাদিত লেকের জল, সামনে এগোলে যেন মাল্টিভার্সের পর্দা সরে যেতে থাকে। টারকোয়ায়েজ ব্লু জলে উঁকি মেরে দেখি, জলের নীচে আরেকটা নৌকা চলেছে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ঘোর কেটে যায় পাখির ডাকে। নিস্তব্ধতা খানখান করে আচমকা অচেনা পাখির সুরেলা ডাক ভেসে আসে কানে। মাছরাঙা আর অন্যান্য জলজ পাখি উড়ে যায়। কোথাও কোনও শব্দ নেই। জোরে কথা বললে পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হতে থাকে সাতবার ধরে। এ এক আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবী। বেশিক্ষণ এসব জায়গায় কাটালে এক অদ্ভুত নির্লিপ্তি এসে বাসা বাঁধে মনে। মনে হয়, আমরাও তো এই অরণ্যের অংশ।
প্রায় মিনিট চল্লিশ নৌকোযাত্রার পর সেন্ট বার্থলোমা দ্বীপের গির্জা এবং রেস্তোরাঁ চোখে পড়ল। কয়েকটা মাত্র ঘরবাড়ি নিয়ে ভ্রমণার্থীদের জন্যে নির্মিত এই দ্বীপে অবশ্য তেমন কিছু করার নেই। শুধু উন্মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাওয়া। অনেকে ইচ্ছে হলে স্নান করে হ্রদের জলে, কয়েকজন ছেলেমেয়ে রক ক্লাইম্ব করতে যায় কাছাকাছি পাহাড়ে। বিকেলের পর অবশ্য কেউই থাকে না এখানে। নৌকো ছেড়ে আমরাও নেমে পড়লাম। এখান থেকেই ফিরতি নৌকোয় উঠে যাওয়া যাবে।
গির্জার আশেপাশে কয়েকটা রেস্তোরাঁ আছে ঠিকই, কিন্তু তার পরেই গভীর অরণ্য। হ্রদের পাড় ধরে বনের সমান্তরালে একটি কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। সেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকগুলো বালির সৈকত চোখে পড়ল। কয়েকজন মনের সুখে স্নান করছে। স্বচ্ছ সবুজ জল, আমাদেরও লোভ হচ্ছিল জলে নেমে পড়ার জন্যে। কিন্তু স্নানের জামাকাপড় আনিনি। কিছুদূর এগোতে আরো একটা দ্বীপ। পান্না সবুজ তৃণভূমি, নীলকান্তমণি আকাশ। শত শত বছর ধরে জায়গাটা এক রয়ে গেছে। সবুজ, শান্ত, আদিম। ফরেস্ট গ্রিন রঙের খান কতক কাঠের বাড়িও চোখ পড়ল। এখানেও কিছু মানুষ থাকে। নিজের মতো করে জীবন কাটায়। একা। সারা জীবন ধরে। ভাবলেই অদ্ভুত একটা আবেশ ঘিরে ধরে যেন। গায়ে কাঁটা দেয়।
আমাদের মেয়াদ শুধুই ঘণ্টা তিন। তারপর ফিরতি নৌকো ধরে আগের জায়গায়। এইসব পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যের পর বাস-ফাস বড় বেশি চলে না, বেশিরভাগ লোকের কাছেই নিজস্ব গাড়ি আছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে বেখতেসগাদেনের বাস পাওয়া গেল বটে কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই রামসাউ গ্রামের শেষ বাস চলে গেছে। প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা। আতান্তরে পড়ে অবশেষে ট্যাক্সি নিতে হল। রামসাউ যখন পৌঁছালাম সারা গ্রামে শেষ বিকেলের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আল্পসের এই অঞ্চলে যে প্রকৃতি কতটা সুন্দর সেটা বলে বোঝানো সত্যিই কঠিন। নির্জন রাস্তার ধারে আপেল গাছের সারি, রাশি রাশি আপেল পড়ে আছে মাটিতে, কেউ তোলার নেই। আমরাই তুলে নিলাম, কামড় দিলাম। বেশ মিষ্টি। কোঁচড়ে আপেল সংগ্রহ করে বাড়ির পথে এগিয়ে যাই। নদীর স্রোতের শব্দ কানে এসে লাগছে। আলো ক্রমে কমে আসছে আর ছোট্ট গ্রামটা আরো বেশি নিঝুম আর রহস্যময় হয়ে উঠছে। বড় ভালো লাগে।
গেস্ট হাউসে এসে দুটো কফি নিলাম। এখানে ছটার সময়েই বেশিরভাগ লোকে ডিনার সেরে নেয়, আমাদের সেই অভ্যেস নেই। প্রত্যেকেই চোস্ত জার্মানে খটমট করে কথা বলছে, তাদের ইংরেজি শুনলে বিষম লাগে। বহুকষ্টে জানা গেল নদী পেরিয়ে একটা রেস্তোরাঁ আছে খানিক দূরে, সেটা রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেখানেই যাব স্থির করে আমরা কফিতে চুমুক দিতে শুরু করলাম।
মিঠে আদুরে হাওয়ায় যেন শীতকালের ছোঁয়া। গ্রীষ্মেও দুষ্টু শীতকাল লুকিয়ে রয়ে গিয়েছে এখানে। আকাশে রঙের খেলা। হেঁটে নদীর ওপরের কাঠের সেতুর ওপরে পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় একজনকেও দেখলাম না। এক অতিকায় পক্ষীর ডানার মতো করে সন্ধ্যে নামছে এই গ্রামে, ঘুপ অন্ধকার হতে খুব দেরি নেই। আবছা একটা লালচে আভা ছড়িয়ে আছে সাদা গির্জার ওপর। সারা গ্রাম নিস্তব্ধ, শুধু নদীর শব্দ কানে আসে।
নদী পেরিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই জায়গাটা দেখতে পেলাম। রেস্তোরাঁটির নাম Wirtshaus Waldquelle (বাংলায় কী উচ্চারণ হবে বলতে পারছি না)। বাগানের ওপর চেয়ার-টেবিল পাতা। অনেকেই খেতে এসেছে, জায়গাটার সুনাম আছে বোঝা যায়। নদী, পাহাড়, হ্রদ, জঙ্গল দেখে সঙ্গিনীর মেজাজ খুশ, বহুদিন পর আজ তার পাস্তা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। বাভারিয়ান বিয়ারের সঙ্গে পাস্তা আর স্নিটজেল চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সুস্বাদু রান্না, খেয়ে বেশ তৃপ্তিই হল। এতদিন বেশিরভাগ জায়গাতেই নিজে রান্না করে খেয়েছি, দরকার না পড়লে বাইরে খাইনি। যাত্রার শেষের দিকে সেই অভাব পুষিয়ে নিচ্ছি। এখানে কে রান্না করবে? নটার কাছাকাছি অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ফিরে এলাম। ঠাণ্ডা বেড়ে গিয়েছে। শীতের চোটে দাঁতকপাটি লেগে যায় আর কি!
২) পরের দিন সকালে গেস্ট হাউসেই ব্রেকফাস্ট করা হল। আমাদের খুব একটা তাড়াহুড়ো নেই, তেমন কোনও পরিকল্পনাও নেই ঘুরতে যাওয়ার। তবে সুজানের কাছ থেকে বাসের পাস যখন পাওয়া গেছে, এদিক সেদিক যাওয়া যেতেই পারে। বেখতেসগাদেনের কাছেই কেহ্লস্টেইন পর্বতের চূড়ায় 'ইগলস নেস্ট' বলে একটা জায়গা আছে। প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচু এই প্রাসাদ একসময় নাজি পার্টির আধিকারিক ও হিটলারের বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। বেরিয়ে পড়লাম।
বেখতেসগাদেন থেকে ওবেরসালজবার্গ। সেখান থেকে বিশেষ বাসে করে কেহ্লস্টেইন পাহাড়ের চুড়োয় যাত্রা। হেঁটে হেঁটে হাইক করেও যাওয়া যায় অবশ্য, কিন্তু হাতে সময় কম বলে ওঠার সময়ে আমরা বাসে যাওয়াই স্থির করলাম। ওবেরসালজবার্গ থেকে বাসে করে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠার সময় ঘন ঘন টানেল পড়ে। কত কষ্ট করে এই সমস্ত টানেল নির্মাণ করতে হয়েছিল সেকালে! অথচ হিটলার ছুটি কাটাতে মাত্র এক দু'বার এখানে এসেছে, কেহ্লস্টেইনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তার মোটেও আস্থা ছিল না। ক্ষমতা বেড়ে গেলে আর মনে স্বস্তি থাকে না হয়তো। যুদ্ধের শেষের দিকে রয়্যাল এয়ার ফোর্স এসে জায়গাটা দখল করে নেয়।
উচ্চতা যত বাড়ছে, চারিদিকের দৃশ্যও তত সুন্দর হচ্ছে। ইউরোপের ভুদৃশ্যের একটা বিশেষত্ব হল যে কোনও কিছুই চোখের দৃষ্টিকে আড়াল করে না। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠঘাট, অরণ্য, পর্বত খালি পড়ে আছে, বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সেই কথাটা আবারও প্রমাণিত হল ইগলস নেস্ট-এ এসে। একটা ভুগর্ভিত টানেলের মধ্যে দিয়ে লিফটে করে উঠতে হয় চূড়ায় থাকা রেস্তোরাঁয়। টানেল আর লিফ্ট সহ সব ব্যবস্থাই সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের, লিফটের পিতলের পাতগুলো এখনও চকচক করছে। ওপরে উঠে যথারীতি বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া। জায়গাটা যে কতটা উঁচু, আগে অনুমান করতে পারিনি। ইগলস নেস্টের মাথা থেকে বেখতেসগাদেন তো বটেই, অনেক দূরের সালজবুর্গও দৃশ্যমান। এমনকি কোনিগসে হ্রদের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। পাহাড়ের পর পাহাড়, তার মাঝে অনেক নিচে অরণ্যের সান্নিধ্যে নদীর মত এঁকে বেঁকে থাকা হ্রদের আকৃতি। চোখ সরানো যায় না।
রেস্তোরাঁর সামনে থেকে চড়াই উঠে গেছে পাহাড়ে। আর সমস্ত জায়গার মতোই কয়েকটা ট্রেকিং রুট, বাকিগুলো হাইকিং ট্রেল। বেখতেসগাদেন ন্যাশনাল পার্কের অভ্যন্তরে যে কোনও জায়গায় চলে যাওয়া যায়, কোনও বাধানিষেধ নেই। অনেকক্ষণ সময় কাটানো হল পাহাড়ের মাথায়। এরকম জায়গা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। দু' কাপ কফি নিলাম। রেস্তোরাঁটি আজকাল নিজস্ব সম্পত্তি, সরকারি সাহায্যও অবশ্য পায়। এই বাড়িতেই বেনিতো মুসোলিনির উপহার দেওয়া লাল মার্বেলের একটা অসামান্য ফায়ারপ্লেস ছিল, তাছাড়াও অনেক রকম ভেনেশিয়ান গ্লাসের তৈরি প্রতিকৃতি ছিল। অনেক কিছুই অবশ্য আজকাল জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
একসময় নামতে শুরু করলাম। হেঁটেই নামব ভেবে রেখেছি। কাঁচা রাস্তা দিয়ে অনেক হাইকার হেঁটে হেঁটে উঠছে বা নামছে। নামার সময় বেশি পরিশ্রম করতে হল না। পাহাড় ছাড়িয়ে একসময় ট্রিলাইনে ঢুকে পড়লাম। পাইন, ওক, পপলার গাছের বন ঘিরে ধরল। মাঝ দিয়ে সুঁড়িপথ, পাকা রাস্তাও আছে। মাঝে মাঝে এক একটা পরিবার চোখে পড়ে। কচি কচি বাচ্চাদের নিয়ে মা বাবা দাদু দিদা সবাই চলেছে পাহাড়ি রাস্তায়। এদের পাহাড়প্রীতির এই অভ্যেসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ছোটবেলা থেকেই স্বাভাবিক ভাবে শরীরচর্চার অভ্যেস তৈরি হয়ে যায় সকলের, সেই কারণে নড়বড়ে স্বাস্থের জোয়ান মানুষ প্রায় চোখেই পড়ে না। আমাদের তাড়া নেই। আস্তে আস্তে হাঁটি। দাঁড়িয়ে জঙ্গল দেখি। গাছ চেনার চেষ্টা করি। আবার চলতে শুরু করি। মাঝে একবার পথ হারিয়ে নাজেহাল হয়েছি। সব জায়গায় বোর্ড নেই। হারাতে আমাদের ভালোই লাগে। পথ হারাই ঠিকই, আবার ঠিক খুঁজে খুঁজে ঠিকও পথে চলে আসি।
ওবেরসালজবার্গ-এর স্টপে ঠিক সময়েই ফিরলাম। আজকে আর ভুল করিনি। বাসের সময় থাকতে থাকতে ফিরে এসেছি রামসাউতে। এই ছোট্ট গ্রামটা বিকেলবেলায় এক মায়াবী রূপ ধারণ করে। আগেও বলেছি, কয়েকটা জায়গায় গেলেই সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মনের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক, রামসাউয়ের বিকেল আর সন্ধ্যেটাও অনেকটা সেই রকম। নদীর ওপরে দাঁড়িয়ে থেকে একের পর এক ছবি তুলে যাও, ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থাকো, কিন্তু কখনই একঘেয়ে মনে হবে না।
৩) পরের দিন লেক হিনটারসি যাব ভেবে রেখেছিলাম। সেইমতো কোমরে গামছা বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গুলে পথ ধরে। ট্রেকিংয়ের মোটামুটি অভ্যেস আছে, সেই তুলনায় এ পথ খুবই সহজ। মাঝে মাঝে উঁচুনিচু পাথর আছে কিন্তু বেশিরভাগটাই শুকনো পাতার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া একটা সুঁড়িপথ। চড়াই নেই। কিন্তু দু'ধারের পরিবেশ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। নদী কখনও বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে চলেছে, আবার কোথাও ছোট্ট ঝরনা অবলীলায় দাঁড়িয়ে আছে পথের বাঁকে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে কাঠের বেঞ্চি, হাইকারদের জন্যে লিখে রাখা বোর্ড। আবার কোথাও ঘন বনে একা দাঁড়িয়ে থাকা লগ কেবিন, 'হাইকার্স ডেন', শীতকালে আসা স্কি করতে আসা ছেলেমেয়েদের জন্যে তৈরি করা ক্যাফে।
একসময় হিনটারসি হ্রদের দেখা পেলাম। কোনিগসের মতো বিশাল না হলেও আকারে বড়ই বলতে হয়। আজ আর ভুল করিনি। স্নান করব বলে তৈরি হয়েই এসেছিলাম। গাছের ছায়ায় তোয়ালে বিছিয়ে অনেকেই স্নান করছে, পিকনিক করছে। আমরাও তাদের দলে ভিড়ে গেলাম। প্রথম ডুব দিতেই অবশ্য ঠান্ডা জলে লাফিয়ে উঠতে হল। গ্লেশিয়াল লেক বলে সারাবছরই এরকম ঠান্ডা জল থাকে। শীতে তো জমেই যায়। এখানকার লোকেদের অভ্যেস হয়ে গেছে। স্নান সেরে কমলালেবু আপেল খেয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। মেঘমুক্ত আকাশ, সামনে স্বচ্ছ জলের দীঘি, চারিপাশে আল্পসের অপরূপ শোভা, শান্ত পরিবেশ। আর কী চাই?
ঘন্টাদুয়েক পর হিনটারসি থেকে বাস ধরে চলে এলাম বেখতেসগাদেন ন্যাশনাল পার্ক। ন্যাশনাল পার্কটি অসামান্য, হাতে সময় থাকলে ওয়াৎজমান পাহাড়ের চূড়াতেও উঠে যেতে পারতাম। কিন্তু দুপুর পড়ে এসেছে, খুব বেশিক্ষণ হাইকিং করা সম্ভব নয়। কিন্তু খুব কাছেই Wimbachklamm Eintritt বলে একটা গর্জ বা গিরিখাত আছে, সেটা দেখা যেতেই পারে। দু ইউরো করে টিকিট, মেশিন থেকে টোকেন নিয়ে স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গর্জের ওপরে তৈরি করে কাঠের প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়লাম। সজোরে উইমবাক নদীর জল আছড়ে পড়ছে সংকীর্ণ গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে। জলের শব্দে কিছুই শোনা যায় না। কাঠের প্ল্যাটফর্মটা জলে ভিজে আছে, সাবধানে এগোতে হয়। খুব দীর্ঘ নয়, কিছুটা এগিয়েই গর্জটা শেষ হয়েছে। সেখান থেকে নদীর ধার বরাবর একটা নির্জন চড়াই পথ চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। খানিকদূর হেঁটে হেঁটে গেলাম। নদী কোথাও শুকনো, কোথাও জল আছে অল্প। মাঝে মাঝে পাথর। ডানদিকে জঙ্গল ঘন হয়ে আছে। সারা অঞ্চলটাই সবুজে সবুজ হয়ে আছে।
এদিকে বিকেল হয়ে গেছে। আর এগোনো যাবে না। রামসাউ গ্রামে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে সূর্যাস্ত। সবুজ পাহাড় আর পাহাড়িয়া নদীর স্রোত ।সেটা মিস করার কোনও ইচ্ছেই নেই। ফেরার পথ ধরলাম। সন্ধ্যের আগেই ফিরে এলাম। অপেক্ষায় রইলাম শেষ বিকেলের। বিদায় জানাতে হবে তাকে। হয়তো কোনদিন আবার ফিরে আসব, কিন্তু এই যাত্রায় তার সঙ্গে আজই শেষ দেখা। চোখের নীরব দৃষ্টি আর মুগ্ধতার আবেশ ছাড়া বিদায় জানানোর কোনও ভাষাও আমাদের কাছে নেই।
St Bartholomew Konigsee |
Lake Königsee from Top |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন