শেষ কথা বিশ্বাস না করাই ভালো
হয়তো সেসব বিখ্যাত কোনও উক্তি
ইদানিং আমিও বার বার সুধরে নি
ভাবনার দোলাচলে থাকা যুক্তি
জোয়ার আর ভাঁটার টানে, আলো
হারিয়ে গেছে মুক্তি আমার জানি,
যাওয়ার আগে শুধু নিজেকে বলেছি বার বার,
যথেষ্ট হয়েছে, নাটক কোরো না তো আবার
~এলিজাবেথ আইবার্স
১) নেদরল্যান্ডস একটা আশ্চর্য দেশ। আপাতদৃষ্টিতে আপাদমস্তক চারটে ইউরোপিয়ান দেশের মতো মনে হলেও এখানকার চরিত্র এবং ইতিহাস অনন্য। এমন বিরোধাভাসও সম্ভবত খুব কম দেশের অতীতেই আছে। গতানুগতিক পাশ্চাত্য বিচারধারার উর্ধ্বে গিয়ে ডাচরা অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্যে বার বার মননশীল মনের পরিচয় দিয়েছে। আবার অন্যদিকে বিবেকের তোয়াক্কা না করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে ডাচ উপনিবেশের হাজার হাজার অধিবাসীকে। একদিকে যুগান্তকারী প্রযুক্তি এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে খাদ্য ও কৃষিকার্যে বিপ্লব এনে দিয়েছে, আবার অন্যদিকে দায়িত্বহীন ভাবে রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার করে ক্ষেপিয়ে তুলেছে পরিবেশবিদদের।
অ্যামস্টারডাম ইউরোপের বহুল পরিচিত এবং জনপ্রিয় শহর। কসমোপলিটান সংস্কৃতি ছাড়া এই শহরের একটা অন্যরকম মেজাজ আছে, যেটা উপেক্ষা না করতে পেরে অনেকেই ফিরে ফিরে আসে সেখানে। উদার ড্রাগ নীতি, বৈধ বেশ্যাবৃত্তি এবং সহিষ্ণু সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ অ্যামস্টার্ডামকে আধুনিক কালের ছেলেমেয়েদের জন্য আদর্শ গন্তব্যে পরিণত করেছে। এখানে সারা পৃথিবীর মানুষ থাকে। অন্যান্য দেশের তুলনায় জাতি, দেশ, ভাষা আর রঙের ভিত্তিতে বিদ্বেষ নেই বললেই চলে।
অ্যামস্টারডাম আসার পথেই আমরা রোটারড্যাম পেরিয়ে এলাম। এই দুটো শহরের বন্দর থেকেই পাঁচশ বছর আগে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা ডানা মেলেছিল সেই অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত, যেখানকার সম্পর্কে অন্য মহাদেশের মানুষের কোনও ধারণাই ছিল না। আরো কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গেলে দেখা যায় নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণাঞ্চলে সেই কেল্ট, ফ্রাঙ্ক আর রোমান যুগ থেকে ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহ হয়ে আসছে। এছাড়াও স্ক্যান্ডেনিভিয়া থেকে আসা ভাইকিংদের আক্রমণে অর্থনীতির বারোটা বেজে গিয়েছিল। এককালে অন্যদের কাছে সারা দেশটাই হল্যান্ড বলে পরিচিত ছিল, যদিও সেটা সঠিক নয়। হল্যান্ড আসলে নেদারল্যান্ডের মধ্যভাগে থাকা একটি অঞ্চল মাত্র, যেখানে কয়েক শতাব্দী আগে বেশিরভাগ ডাচরা বসবাস করত।
অ্যামস্টারডামে এসে মেট্রো করে শহরে আসতে ঘন্টাখানেক লাগল। প্রকাণ্ড শহর। আধুনিক স্থাপত্যের সব নিদর্শনই রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে কাটাকুটি করে যাওয়া অসংখ্য খাল বা ক্যানাল। খাল না বলে অ্যামস্টারডামের শিরা উপশিরা বলাই ন্যায্য। এই জলশিরাদের পরস্পরছেদী বিন্যাস ছাড়া অ্যামস্টারডামের কল্পনাও করা যায় না।
ব্রূগ্স থেকে অ্যামস্টারডামে আসার জন্যে ভোরবেলায় উঠতে হয়েছিল, সেই কারণেই দেখছি আমার সঙ্গিনীর মেজাজ খিঁচড়ে আছে সকাল থেকেই। আমারও যে ঘুম পাচ্ছে না তা নয়। বিশাল একটা হাই তুলে তাঁকে এক ঠ্যালা মেরে বললাম, “ঘুমাচ্ছিস যে বড়? হাত জোড় করে কপালে ঠেকা। ডাচরা না থাকলে তোদের কোম্পানিও থাকত না, কোম্পানির শেয়ার মার্কেটও থাকত না, তোর ক্রেডিট রিস্কের কাজও থাকত না।”
শ্রোতা যে আমার কথায় কর্ণপাত করলেন সেটা মনে হল না। বরং প্রত্যুত্তরে আরেকটা প্রকাণ্ড হাই তুলে বিকট যে অঙ্গভঙ্গি তিনি করলেন, তার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘চেপে যা’। চুপসে গেলাম। বেশ ভালো রকম ইতিহাসের গল্প ফেঁদে তাক লাগিয়ে দেব ভেবেছিলাম, কোথায় কী? আজকাল মানুষের কিছুতেই উৎসাহ নেই।
শেয়ার মার্কেটের গল্পটা যদিও মিথ্যে নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা দেশের ওপর অধিকার করে নেয়। ততদিন ডাচ ব্যবসায়ীরা কোনোক্রমে চালিয়ে নিচ্ছিল। নৌবিদ্যায় দক্ষ ছিল ডাচজেঠুরা, পালতোলা জাহাজে করে সমুদ্রে পাড়ি দিত পর্তুগালের উদ্দেশে। সেইসময় মশলার ব্যবসায় একছত্র অধিকার ছিল পর্তুগালের, তাদের শয়ে শয়ে জাহাজ এশিয়া আর অন্যান্য পূর্বের দেশ থেকে মশলা আর জিনিসপত্র নিয়ে আসে এবং ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে লিসবনে। ডাচরাও লিসবন থেকে জিনিস কিনে ইউরোপের অন্যান্য দেশে চালান দিত। কিন্তু একসময়য় দেখা গেল স্প্যানিশ রাজত্ব বিস্তারলাভ করেছে পর্তুগালেও। যথারীতি ডাচ ব্যবসায়ীদের জন্যে লিসবনের দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হল।
ডাচজেঠুরা পড়ল মহাফাঁপরে। নিজেরা জাহাজ পাঠিয়ে কলোনি তৈরি করে ব্যবসা করতে যত পুঁজি দরকার, তার একাংশও তাদের কাছে নেই। অথচ একবার কলোনি স্থাপিত করতে পারলে মশলাপাতির ব্যবসায় তো তারা অধিকার করবেই, এশিয়া থেকে ক্রীতদাস নিয়ে এসে বিক্রিও করতে পারবে। এদিকে তখন ফিরসে যুদ্ধ লেগেছে। স্প্যানিশরা তখন পর্তুগালের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করছে ইংরেজদের সঙ্গে, এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।
আগে কয়েকটা জাহাজ পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ডুবেছে সমুদ্রের বুকে। এশিয়া পৌঁছানোর নতুন সামুদ্রিক পথ খুঁজতে গেলে প্রচুর অর্থ চাই। পরামর্শ করে সব ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে হল্যান্ডের রাজার অনুমতি নিয়ে পত্তন করল ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যার ডাচ নাম ছিল Verineegde Dostindische Compagnie অথবা ভিওসি। কিন্তু মালকড়ি দেবে কে? গালে হাতে দিয়ে ভাবতে বসল সবাই। ভাবাভাবি চলছে তো চলছেই। একসময় একজন বণিককাকু চেঁচিয়ে উঠলেন। দিমাগ কী ঘণ্টি বজি! তাঁর কথা শুনে সবাই বলতে লাগল, "হোয়াট অ্যান আইডিয়া সরজি!" আইডিয়া হল, অর্থের জন্য আবেদন করা হবে সাধারণ মানুষের কাছেই। যে কেউ টাকা দিয়ে কোম্পানির একাংশ কিনে নিতে পারবে। কোম্পানির লাভের ভাগীদার হবে প্রত্যেকে যারা অর্থ দিয়েছে। মধ্যযুগে এই অভিনব ব্যবস্থাই আধুনিক কালের শেয়ার মার্কেট এবং পুঁজিবাদের জনক।
একসময় দেখা গেল, ডাচরা তো বটেই, প্রবাসীরাও ভিওসিকে সাহায্য করতে শুরু করেছে। কোম্পানি সে সময় প্রায় ছয় মিলিয়ন গিল্ড সঞ্চয় করেছিল। আজকের হিসেবে তার আর্থিক মূল্য একশ দশ মিলিয়ন ডলারের সমান। সেই অর্থের সাহায্যে একের পর এক সামুদ্রিক অভিযান শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ইন্দোনেশিয়া, তারপর ভারত, চিন, সুরিনাম সহ নানান জায়গায় উপনিবেশ স্থাপিত করে ডাচরা রেশম, মশলা, ক্রীতদাস ইত্যাদি চালান দিতে শুরু করল ইউরোপে। ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে দেরি হল না। লাভের অনুপাত পনেরশ শতাংশেরও বেশি। বিপুল আয় করেছে মানুষজন। জেঠুস আইডিয়া ওয়াজ আ হিট! হোয়াট অ্যান আইডিয়া সরজি!
১৬৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করল ডাচেরা। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাভের একাংশ খরচ হল রাজ্যের স্বার্থে। নেদারল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকাই অত্যন্ত নিচু বলে সমুদ্রের জল ডুবে থাকে, কিন্তু পরিখা কেটে জল বার করে দিলে সেই অঞ্চলগুলো প্রচন্ড উর্বর হয়ে ওঠে। সমুদ্রের কবল থেকে জমি উদ্ধার করা চলল কয়েক শতাব্দী ধরে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ আর ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে হওয়া যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যখন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়, দেশের চেহারাই বদলে গেছে। সমুদ্রের কবল থেকে জমি উদ্ধার করে করে দেশের ক্ষেত্রফল বেড়ে গেছে অনেক। নতুন জমির উর্বর জমিতে চাষ করা হচ্ছে শাকসব্জি। আধুনিক যুগে তাপমাত্রা ও আদ্রতা নিয়ন্ত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে হাজার হাজার গ্রিন হাউস। সেখানে সারা বছর ফলন চলে। বরফ পড়ুক, ঝড় উঠুক, বৃষ্টি হোক… নো টেনশন। গ্রিনহাউসের ভিতর কৃত্তিম উপায়ে ঋতুবিশেষের আবহাওয়া তৈরি করে দেওয়া হয়েছে চাষের জন্যে। নামমাত্র জল ব্যবহার করে হাজার হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করে ডাচরা এইটুকু একটা দেশ অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়ে খাদ্যসমগ্রী রপ্তানিতে দু' নম্বরে উঠে এসেছে।
এতদিন ধরে পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে আমরা বেশ সড়গড় হয়ে গেছি। গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশন থেকে। এই জায়গাটা যাকে বলে শহরের প্রাণকেন্দ্র। সামনেই নিউমার্কেটের অভিনব স্থাপত্যের গির্জা, 'ফার্মার্স মার্কেট'-এর প্রশস্ত চত্বর। অ্যামস্টারডামে হোমস্টে পাওয়া যায়নি সস্তার, তাই কাছাকাছি একটা ব্যাকপ্যাকার হস্টেলে দুজনের জন্যে ডরমিটরি বুক করা হয়েছে। ইউরোপে একা এলে এই হস্টেলগুলোই থাকার জন্যে সেরা জায়গা। অনেক হস্টেলেরই সারা ইউরোপের শহরে শাখা আছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সস্তা। মাথাপিছু দশ থেকে কুড়ি ইউরো (বা আরো কম) দিলেই থাকা যায়, তাতে অনেক সময় 'কম্পলিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট'-ও থাকে। টাকা বাঁচাতে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে সুপারস্টোর থেকে খাবার কিনে হস্টেলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেয়। কেটলিতে চা কফি করে নেওয়া যায়। ফ্রিজ আছে, সেখানে জিনিসপত্র রাখা যায়। নানা দেশের নানা ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব আর আড্ডা হয় হস্টেলে, অনেক রকম ভালো মন্দ অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু দুজনের জন্যে আবার দেখেছি হস্টেলের চেয়ে হোমস্টে সস্তা পড়ে বেশ খানিকটা, সেখানে রান্নার ব্যবস্থা থাকে বলে নিজে রান্না করেও খাওয়া যায়। নাহলে হস্টেলে থাকাই আমার প্রথম পছন্দ।
রিসেপশনের ছেলে দুটো ভলান্টিয়ার হয়ে এসেছে কয়েক মাসের জন্যে। মিচেলের বাড়ি জার্মানিতে, ভিকটর থাকে হেগ শহরে। ছেলে আর মেয়েদের ডরমিটরি এখানে পৃথক। শেল্টার সিটি হস্টেলটা ক্যাথোলিক ক্রিশ্চানদের একটা সংগঠন নিয়ন্ত্রিত করে। কাজেই হইহুল্লোড় আর আড্ডার পাশাপাশি বুকসেল্ফে যীশুর উপদেশের বই, মাঝেমাঝে বাইবেলের কয়েকটা লাইন নিয়ে কথাবার্তা আলোচনা হয়। সেইসবে আলোচনায় অবশ্য দু' চারজন ছাড়া কেউই উৎসাহ দেখায় না। বাকিরা বাগানের চেয়ার টেবিলের ওপর বসে কফি খেতে খেতে বই পড়তে অথবা আড্ডা দিতে বেশি পছন্দ করে।
দু'তলায় উঠে নির্দিষ্ট ঘরে নিজের বেড খুঁজে নিয়ে রুকস্যাক নামিয়ে রাখলাম। হালকা আলাপে পরিচয় বল ব্রান্ডন, রিকি, জর্জি আর আনটোনিওর সঙ্গে। কেউ ফিনল্যান্ড থেকে এসেছে, কেউ এসেছে সুদূর আমেরিকা থেকে। খানিকক্ষণ গল্প করে তখনকার জন্যে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
লাঞ্চ করা হয়নি। ব্রূগ্স থেকে সাতসকালের বাস ছিল, ব্রেকফাস্টও বাদ গেছে। কিছু খেতে হবে দেখেশুনে। খুঁজেপেতে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় যাওয়া হল। বেশিরভাগ শহরেই আজকাল সারা পৃথিবীর কুইজিন পাওয়া যাচ্ছে। পেট ভরে ফ্রায়েড রাইস খেয়ে শরীর মন চাঙ্গা হল অবশেষে।
বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে আসার পর থেকেই। আমরা ছাতা নিয়ে বেরিয়েছি, বৃষ্টির পরোয়া করি না। অ্যামস্টারডামে যত নাম করা নিদর্শন আছে; ডোম স্কোয়ার, সেন্ট্রাম অর্থাৎ শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত ক্যানাল ডিস্ট্রিক্ট, মিউজিয়াম পাড়া, অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি সব কাছাকাছি, হেঁটে চলে যাওয়া যায়। বলতে গেলে সেন্ট্রামের একেবারে মধ্যবিন্দুতেই আমাদের হস্টেল, পিছনের পাড়াটাই এখানকার রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট। ধীরে সুস্থে দেখে নেওয়া যাবে, আপাতত মেঘ বদলের কাব্য আউড়াতে আউড়াতে আমরা মেট্রো ধরে চললুম ভন্ডেলপার্কে। পার্কপাগল বলে বদনাম আছে আমাদের, আর ইউরোপের পার্ক পেলে তো কথাই নেই।
প্রায় চারশ বিঘে জমিতে বিস্তারিত এই অভাবনীয় উদ্যান বর্তমানে ইউরোপের জনমানসের অন্তরে বিশেষ একটা জায়গা অধিকার করেছে। সৌন্দর্যের নিরিখে দেখতে গেলে তো বটেই, তা ছাড়াও অ্যামস্টারডামের উদার ও শৈল্পিক জীবনযাত্রার অন্যতম প্রতীক এই ভন্ডেলপার্ক। সবুজ ঘাসের চাদরের বিস্তীর্ণ গালিচার ওপর ছড়িয়ে থাকা ফুলের বাগান, ছোট বড় দীঘি, নাট্যকার লেখকদের মূর্তি, বাদ্যমঞ্চ ইত্যাদি নিয়ে দিনে রাতে বছরের প্রতিদিন জমজমাট হয়ে থাকে এই দেড়শ বছর পুরোনো উদ্যান। প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখানো হয় ওপেন এয়ার থিয়েটারে, চেনা অচেনা ব্যান্ডদের একাধিক অনুষ্ঠানও হয় প্রতিদিন।
জামরঙা শাড়িতে সেজে থাকা আকাশ। মিহি চিনির দানার মতো বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে গা ভেজে না। সঙ্গে অবশ্য উপস্থিত মেঘছেঁড়া রোদ্দুরের ম্যাজিক শো। বৃষ্টিতে ভেজা ঘাসের ওপর শতরঞ্চি পেতে বসে আছে মানুষজন। কেউ বই পড়ছে হ্রদের নীল সবুজ জলের ধারে শুয়ে, কেউ কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে মগ্ন। এছাড়াও আছে স্কুলপালানো ছেলেমেয়ে, ভবঘুরে, জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিকযুগল এবং হাঁসের দল। নির্ভয়ে হাঁসের মানুষের কাছাকাছি চলে আসছে, আবার গিয়ে নেমে পড়ছে জলে। হ্রদের ধারে ঘন গাছের সমষ্টি ছায়াঘন জায়গায় তাদের বাসা, সেখানে গাছের ডালে ডালে পাখিদের বচসা চলছে। হ্রদগুলোর ওপর ছোট ছোট ধনুষাকার কাঠের সেতু। সেতুর ওপর থেকে জলে পদ্যফুলের বাহার দেখতে পাচ্ছি, ঠিক যেন ইম্প্রেশনিস্ট ছবি। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম 'ব্যান্ডস্ট্যান্ড'-এর দিকে। জনপ্রিয় একটি স্থানীয় ব্যান্ডের অনুষ্ঠান সবে শেষ হয়েছে, সেখানকার জনসমাগম দেখেই বোঝা যায়। কাগুজে ঝালর আর ফুলের তোড়া দিয়ে সাজানো একের পর এক সাদা তাঁবু আর শামিয়ানার নীচে গিটারবাদকেরা শ্রোতাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। আর্দ্র রোদ্দুরে মাখামাখি তারিফ, মুদ্ধতার জোয়ার। যুবকদের চোখে কোবাল্ট ব্লু ঢেউ, তরুণীদের দৃষ্টিতে টাকিলা সানলাইট। বয়স্করা অবশ্য মিশুকে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে কফিশপের জানলায় গিয়ে বসেছেন, শিরশিরে হাওয়াকে তোয়াক্কা না করে জ্বালিয়ে ফেলেছেন সিগারেট, চুমুক দিয়েছেন এসপ্রেসো বা লাটেতে। বাকিরা তাদের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ফেরার পথে। পাশেই একটা টেনিস কোর্ট, সঙ্গে রেস্তোরাঁ ও কফিশপ। এখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না আমাদেরও। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে একটা কফি নিলাম। সামনে কোর্টে এক যুবতী টেনিস খেলছে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালই লাগে।
কফিও একসময় শেষ হল। ভন্ডেলপার্ক থেকে বেরিয়ে প্রধান রাস্তায় পৌঁছে একটা ট্রামে উঠে পড়লাম। নতুন শহরে গিয়ে কোনও নির্দিষ্ট স্থানে না গিয়ে বেমক্কা বাসে ট্রামে করে বহুদূর চলে যাওয়া আমাদের স্বভাব, নেশাও বলা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে বোঝা যায় এতে, শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের একটা স্পষ্ট ছবিও আন্দাজ করা যায়। জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকো, শহর এক সময় নিজেই যেঁচে আলাপ করতে চাইবে তোমার সঙ্গে!
শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক চক্কর মেরে যখন আমরা ড্যাম স্কোয়ারে এসে পৌঁছালাম, বিকেল হয়ে গেছে। অ্যামস্টারডামে প্রধান চত্বর এই স্কোয়ার, কাছাকাছি নানা ঐতিহাসিক ইমারত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে প্রধান হল এখানকার রয়্যাল প্যালেস, মাদাম তুঁসো মিউজিয়াম এবং ন্যাশনাল মনুমেন্ট। এক সময়ে অ্যামস্টাল নদীর ওপরে এক ড্যাম অর্থাৎ বাঁধের নির্মাণ হয়েছিল যার ফলে এই স্কোয়ার এবং শহরের নাম দেওয়া হয়। শহরের ইতিহাসের প্রতিটা ভালো ও মন্দ, বিপ্লব ও উৎসবের সাক্ষী এই স্কোয়ার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যে কোনও ঘটনার তাৎক্ষণিক জনপ্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা যায় ড্যাম স্কোয়ারে।
জমজমাট জায়গা,অনেকটা লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের মতনই। চত্বরের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত ন্যাশনাল মনুমেন্ট। এখান থেকে দাম্রাক আর রোকিন স্ট্রিটের রাস্তা চলে গেছে, সেখানে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ঝকমকে দোকানগুলোর আকর্ষণে পর্যটকেরা জটলা করেছে। অনেক মানুষ কাজে অকাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক, তাদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় এবং চাইনিজ। আমাদের দেশ থেকেও অনেকে বেড়াতে যায় অ্যামস্টারডামে, তারা ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে ব্যস্ত।
ড্যাম স্কোয়ারের ঠিক পরেই ডে ওয়ালেন অঞ্চল। ডে ওয়ালেনকে অবশ্য শতকরা নব্বইজন মানুষ রেড লাইট স্কোয়ার বলেই চেনে। ১৯৮৮ সালে এই বেশ্যাপাড়া নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বাকবিতন্ডা শুরু হয়ে যায়। কারণ আর কিছুই নয়, নেদারল্যান্ড সরকারের বেশ্যাবৃত্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত। ২০০০ সালে বেশ্যাবৃত্তিকে একটা পেশা বলে মেনে নেয় সরকার এবং নানা ভাবে যৌনবৃত্তিতে জড়িয়ে থাকা মানুষজনকে আইনি ব্যবস্থার অন্তর্গত এনে সাহায্য করতে শুরু করে। ডে ওয়ালেন অঞ্চল জুড়ে আছে অসংখ্য ক্যানাল বা খাল। তার সমান্তরালে সংকীর্ণ গলির দুই পাশে আলো ঝকঝকে সেক্স মিউজিয়াম, সেক্স শো ক্লাব, এস এন্ড এম শপ আর কফিশপ ছড়িয়ে আছে। তার সঙ্গেই সংকীর্ণ গলিগুলোয় অবস্থিত আছে প্রায় তিনশো কাঁচের দরজা যুক্ত কেবিন, যেখানে বিকেলের পর থেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় স্বল্প পোশাকে সজ্জিত যৌনকর্মীদের। এই অঞ্চল পেরিয়েই নিউমার্কেট মেট্রোর কাছাকাছি আমাদের হস্টেল। হেঁটে যেতে মিনিট কুড়িও লাগে না। এখনও সন্ধ্যে হয়নি, আলোও জ্বলেনি রাস্তায়। তার মাঝেই কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কয়েকজনকে।
যেই ব্যাপারটা সত্যি ভাবায়, সেটা হল এই অঞ্চল 'রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট' বলে পরিচিত হলেও পরিবেশে নিষিদ্ধ পাড়ার অসহজ ভাব অথবা 'ট্যাবু' নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। (বিদেশের অনেক জায়গাতেই নিষিদ্ধপল্লী নিয়ে নিয়ে যথেষ্ট রাখঢাক দেখেছি) আরো চারটে সুন্দর পাড়ার মতনই বন্ধুভাবাপন্ন ক্যাফের মালিক, উৎসাহী ব্যাকপ্যাকারের দল, নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে যাওয়া পথচারী। ২০১০ সালে সারা অঞ্চলটাই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ করে দেওয়া হয়েছে, সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকেরা বেড়াতে আসে এইখানে। বেশ্যালয়ের পাশাপাশি ক্যাফে আর পাব গিজগিজ করছে। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই একটা না একটা ক্যানাল, ছোট ছোট লোহার সেতুর ওপর আলোর রোশনাই। ক্যানালের সমান্তরাল পথে ফুলগাছের সারি। হলুদ, গোলাপি, বেগুনি, সাদা ফুলের গুচ্ছ উপচে পড়ছে। জলে অনেক ছোট ছোট নৌকো বাঁধা। লোহার সেতুর ওপর প্রায় সবসময়ই কয়েকটা সাইকেল রাখা থাকে তালা দিয়ে, সেগুলোও ফুল দিয়ে ঘেরা। আশেপাশে যারা কাজ করতে আসে তারা সকলেই সাইকেল নিয়ে চলাফেরা করে।
হস্টেলে ফিরে এলাম। পিছনদিকে একটা ছোট্ট ক্যাফে আছে হস্টেলের মধ্যেই, সঙ্গে একটা সুন্দর করে সাজানো ছোট্ট বাগান। কাঠের ডেস্ক আর টেবিল চেয়ার দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে জায়গাটা, একটা কফি নিয়ে সেখানে বসলাম। কয়েকজন ছেলে বসে বসে গল্প করছিল, তাদের সঙ্গে আলাপ হল। সেবাস্টিয়ান জার্মানি থেকে গরমের ছুটিতে ঘুরতে এসেছে, মুহম্মদ আর তার বন্ধু নাথান এসেছে আমেরিকা থেকে। প্রায় এক মাস ধরে ইউরোপের নানান জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা আছে, সেই নিয়ে কথা হতে লাগল। আমরা বার্সেলোনা হয়ে এসেছি, মুহাম্মদরা এখান থেকে বার্সেলোনা যাবে। আমরাও আমাদের পরিকল্পনার কথা জানালাম। ব্যাকপ্যাকারদের সঙ্গে কথা হলে প্রথমেই তারা পথের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চায়। কোন শহরটা কেমন? সুযোগ পেলে কোথায় ফিরে যাব? এখান থেকে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
নাথান আমাদের জিগ্গেস করল, “তোমরা বাইরে থেকে ঘুরে এলে? কেমন লাগল শহরটা?"
সঙ্গিনী একটু হেসে বললেন, “আমার তো ভালই লাগছে বেশ। প্রথমে একটু একঘেয়ে লাগছিল বটে কিন্তু এখন অনেকটা ঘুরে নেওয়ার পর পরিবেশটা বুঝতে পেরেছি। আসলে ব্রূগ্সেও কয়েকটা ক্যানাল আছে ঠিকই কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে শহরটা জলের ওপরেই তৈরি হয়েছে।”
আমি আরো একধাপ বেশি হেসে বললাম, “আমার একটা ধারণা আছে এই নিয়ে। যদি অবিরাম একের পর এক শহরে গিয়ে মানুষ ঐতিহাসিক নিদর্শন আর প্রকৃতি দেখে চলে, এক সময় সে হাঁফিয়ে পড়বেই। তা যত সুন্দর শহরই না হোক না কেন? কিন্তু যদি সেখানকার সংকৃতি আর ইতিহাসের সঙ্গে একটা পূর্বপরিচিতি থাকে তাহলে সেরকম মনে হয় না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সেখানকার স্থানীয় মানুষ ও অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা। নিছক আড্ডা চাই। একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন চাক্ষুষ করার চেয়ে একটা নতুন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারা মোটেও কম ইন্টারেস্টিং নয়। সেটাই বরং এই দীর্ঘ যাত্রার ইচ্ছেটাকে সতেজ করে রাখে।”
কথায় কথায় আড্ডা ঘুরে গেল অন্যদিকে। পথের অভিজ্ঞতা থেকে অন্যান্য দেশের মানুষের স্বভাব, সরকারের মনোভাব, প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
সেবাস্টিয়ান কথায় কথায় বলল, “লন্ডনে গিয়ে আমার প্রচন্ড অসহজ লেগেছে। রাশি রাশি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় প্রায় শহরটাই ছেয়ে গেছে। কয়েকদিন আগেই একটা ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে আমেরিকার মতন ব্রিটেনেও গোপনে প্রত্যেক মানুষের ওপর নজর রাখা হচ্ছে তাদের অজান্তে। সিকিওরিটি সিস্টেম হ্যাক করে বসে আছে ফোন, ইমেইল সবকিছু। এডওয়ার্ড স্নোডেন আমেরিকার কারচুপির কথা ফাঁস করে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সেও হয়তো জানত না যে পশ্চিমের প্রায় সব দেশের সরকারই দেশের মানুষদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করে যাচ্ছে। এই মনোভাব কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।”
কথাটা খুব মিথ্যে নয়। লন্ডনে তো বটেই, বেশিরভাগ পশ্চিমের দেশেই সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলার জন্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। দেশের সরকার সেই কথা স্বীকার করে না বটে কিন্তু উইকিলিক্স আর এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতন অনেক মানুষেই ইন্টারনেটে তথ্যসহকারে এই ঘটনার সত্যতা জাহির করেছে। ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক যে সাধারণ মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, সেই নিয়ে আজকাল তুমুল আন্দোলন চলছে। হলে কী হবে? সার্ভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজমের এই যুগে সবই সম্ভব।
মুহাম্মদ সেবাস্টিয়ানের কথায় সায় দিয়ে বলল, “আমি গত কয়েক বছরে এই মনোভাবের প্রমাণ পেয়েছি। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও সিকিওরিটি ক্যামেরার নজরে থাকবে, আর তাতে নাকি সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করা যাবে। সেই কোনকালে জর্জ ওরওয়েল এই অবস্থার কথা কল্পনা করে '১৯৮৪' উপন্যাস লিখেছেন, দেখা যাচ্ছে তাতে কোনও ভুলই নেই। অথচ পরিসংখ্যান বলছে উদারবাদী মনোভাব থাকলে কিন্তু অপরাধ কমে। হাজার হাজার কেসস্টাডি আছে এ নিয়ে।”
আমি বললাম, “যতদূর জানি, অ্যামস্টারডামেও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে যখন থেকে এ অঞ্চলের কফিশপের মাধ্যমে আফিম আর গাঁজার মত মাদক আইনগত ভাবে বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তখন থেকে এখানে নেশা করার লোক ক্রমেই কমছে।”
সেবাস্টিয়ান তুড়ি মেরে বলল, “একদম ঠিক বলেছ। কফিশপে 'ক্যানোপি' বিক্রি হলেও স্থানীয় মানুষের তাতে কোনও আগ্রহই নেই। টুরিস্টরাই ওখানে যায়। নেদরল্যান্ডসে অন্যান্য অনেক জায়গায় আবার এই নিয়ে কড়াকড়ি আছে, স্থানীয় মানুষ ছাড়া অন্যরা মাদক কিনতে পারবে না। তাই সবাই এসে জড় হয় অ্যামস্টারডামে। শুধু মাদকই নয়, বেশ্যাবৃত্তি বৈধ করে দেওয়ার ফলে যৌন অপরাধের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।”
আমি একটু ভেবে বললাম, “কোন জিনিসই নিষিদ্ধ করলে সেটার প্রতি একটা স্বাভাবিক কৌতূহল তৈরি হয় মানুষদের। অ্যামস্টারডামে 'ব্যান' কথাটা বাদ দিয়ে 'রেগুলেশন' অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত করায় অনেক বেশি জোর দেওয়া হয় বলে পড়েছি। কফিশপে আফিমের বিক্রি বৈধ হলেও সেই দোকান যাতে স্কুলের কাছাকাছি না হয়, অবৈধ ভাবে মাদক সাপ্লাই না হোক সেখানে, সেই সবে কড়া নজর আছে প্রশাসনের। অনেক কফিশপই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নিয়ম না মানায়। এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি আদর্শ না হলেও অন্য অনেক জায়গা থেকে বহুগুণ ভালো বলে আমার বিশ্বাস। ”
অনেকক্ষণ ধরে আড্ডা চলল। প্রায় ঘন্টাদুয়েক পর সেবাস্টিয়ানদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। dডিনার সারতে হবে, সঙ্গে রাতেরবেলা এই অঞ্চলের চেহারাটাও দেখা দরকার।
রাস্তায় নেমে দেখি অন্ধকার হওয়ামাত্র শহরের চেহারাই পাল্টে গেছে। গলিগুলোতে মানুষের ঢল নেমেছে। ভিনদেশি রেস্তোরাঁগুলো ভর্তি পর্যটকের ভিড়ে। লাল আলোর ঝলমলানিতে রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কাঁচের কেবিনগুলোর চারপাশে লাল রঙের টিউবলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে লাস্যময়ী প্রস্তরমূর্তি। এদিকে ক্যানালের জলের ওপর লাল, নীল, সবুজ আলো প্রতিফলিত হয়ে একটা মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ভাঁজ করে রাখা নৌকোর মোড়কগুলোর পাটাতনে রক্তিম আলো নাচানাচি করছে। বিস্ময়কারী চোখের কোণে কৌতূহল আর আবিষ্কারের নেশা।
ডিনার সেরে অনেকক্ষণ ধরে হেঁটে বেড়ালাম। লেজার আলোর ঝলকানিতে একেকবার মনে হয় কল্পবিজ্ঞান নির্ভর কোনও সিনেমার ভিতরে ঢুকে পড়েছি। রাত অনেক হয়েছে। পাড়াগুলো এখন ফাঁকা হয়ে আসছে। এক সময় ফেরার পথ ধরতেই হল। আমাদের হস্টেলের গলির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি এমন সময় লাল টিউবলাইটের কেবিন খুলে দুজন যুবতী বেরিয়ে এল। পরনে সাধারণ টিশার্ট, জিন্স, কাঁধে ব্যাগ। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ দেওয়া সোয়েটশার্ট পড়ে আছে। মেয়েদুটির মুখের উপর সামান্য অন্ধকার। বাদবাকিটা আলো। একটা মেয়ে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে অন্যজনকে দিল, তারপর বলল, “'ইন উইখ। 'অন্য মেয়েটা ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল। তারপর দুজনেই নিশ্চিন্তে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল জনসমুদ্রে।
নিখাদ একটা ভালো লাগায় আমার মন শান্ত হয়ে গেল। যাক! বই পড়ার মানুষের অভাব নেই আজও। এখানেও। মানুষের জীবনে কত অভিমান, কত অভিযোগই না থাকে। সেগুলো না হয় তোলাই থাক…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন