২)ফ্লোরেন্সের কাউচসার্ফিং মিট-আপে গিয়ে অরিগো লুপোরি বলে একটি ফ্লোরেন্টাইন ছেলের সঙ্গে আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একটা পেল্লায় রেস্তোরাঁয় অনেক ছেলেমেয়ে জড় হয়েছে, খাবার ও পানীয়ের মাঝে টুকটাক গল্প চলছে অচেনা আগন্তুকদের সঙ্গে। পাঁচ মিনিটের আলাপেই সংকোচ চলে যায়, তখন ছুটকো আলাপ তুমুল আড্ডায় পরিণত হয়। অরিগো ছাড়াও আমাদের আলাপ হয়েছে হুমাম, ব্রায়ান, আর লিরার সঙ্গে। হুমাম সিরিয়ার ছেলে, এখন গ্রিসে থাকে। ব্রায়ান আর লিরা এসেছে জার্মানি থেকে। আড্ডা জমে ক্ষীর। ব্যাকপ্যাকিং-এর কথা থেকে সিরিয়ার অবস্থা, গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট থেকে ইতালিয়ান ভাষার উদ্ভব। অরিগো ছোঁড়া আবার ভাষাবিদ, পাঁচটা ভাষা বলতে পারে ফরফর করে, ছ'টা ভাষা ভাঙাভাঙা বলতে পারে। নতুন ভাষা তুলে নিতে তার কয়েক মাসের বেশি সময় লাগে না। আমার সঙ্গিনীও স্প্যানিশ বিশারদ, হুমাম আবার আরবি ভাষার পন্ডিত। ক্রমে আলোচনা চলে গেল ভাষাতত্ত্ব নিয়ে। আরবি ভাষার সঙ্গে স্প্যানিশ আর হিন্দির অনেক মিল আছে, সেই শুনে হুমাম বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। এই সুযোগের সদ্যব্যবহার করে আমিও তাকে বেশ খানিকটা হিন্দি ভাষার জ্ঞান দিয়ে দিলাম। চোদ্দ বছর যে হিন্দি মাধ্যমে রগড়ালাম, কিছু তো লাভ হোক!
কথাবার্তার ফাঁকে একসময় সঙ্গিনী অরিগোকে জিগ্গেস করলেন, "এত তাড়াতাড়ি নতুন ভাষা শেখ কী করে বল তো?" উত্তরে অরিগো বলল, "চিরাচরিত নিয়মগুলো দেখেছি কোনও কাজেই আসে না। আমি নতুন ভাষা শেখার সময়ে ল্যাপটপ থেকে মোবাইলের সব লেখা ওই ভাষায় করে নিই। সর্বক্ষণ নতুন ভাষাতেই সিনেমা দেখি, গান শুনি, গল্প করি, তাতে ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্তে এসে যায়।"
হুমাম বলল, "আমি দেখেছি কোনও ভাষার কবিতা বা গান শুনলে নতুন ভাষা তুলে নিতে বেশ সুবিধা হয়। ফ্লোরেন্স তো ইতালিয়ান ভাষার জন্মস্থান, ইতালিয়ান কবিদের লেখা পড়লে হয়তো সুবিধে হতে পারে।"
অরিগো মাথা নেড়ে বলল বলল, "স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান অনেকটা একরকমই। তবে তুমি ঠিক বলেছ, কবিতা পড়লে ভাষার ব্যবহারটা জেনে নেওয়া সহজ হয়ে যায়।"
অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে আমরা বন্ধুদের বিদায় জানালাম। ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে মাঝেমাঝে কথাবার্তা হবে, তখন না হয় অরিগো লুপোরির কাছ থেকে খানিকটা ইতালিয়ান ভাষা রপ্ত করে নেওয়া যাবে। অথবা কয়েকটা কবিতার বইয়ের নাম জেনে নেব। তবে সেই সুত্রে আমার ইতালিয়ান কবিতা জগতের একটা অন্য কথা মনে পড়ে গেল।
আমি কবিতার ইতিহাস অথবা আন্দোলন সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। ফরাসি সুরিয়ালিজম কিংবা ইতালিয়ান ফিউচারিজম-এর নামটুকুই জানি, বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকজন কবির কবিতা পড়েছি হয়তো। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু কয়েক বছর আগেই হঠাৎ করেই Poète Maudit কথাটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ফরাসি ভাষার এই শব্দের অর্থ হল 'অভিশপ্ত কবি'। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পল ভের্লেইন সেই নামেই একটি বই লিখেছিলেন ফরাসি কবিদের উৎসর্গ করে, তারপর থেকে এই কথাটা লোকেদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে।
পৃথিবীর নানা দেশে নানা সময় অসাধারণ প্রতিভাবান কবিরা জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁরা সমাজের গতানুগতিক ও ব্যতিব্যস্ত জীবনধারাকে পায়ে ঠেলে অনিশ্চয়তার জীবনে ঝাঁপ দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। চিরাচরিত জীবনযাত্রা ছেড়ে অনেকেই অনিশ্চয়তার পথে বেরিয়ে পড়েছেন। বহু শিল্পী অশৃঙ্খল এবং অপরাধ জীবনে জড়িয়ে পড়েছেন, নেশাগ্রস্ত অথবা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে মারা গেছেন যৌবন না ফুরোতেই। অনেকে সারা জীবনে মাত্র একটি কবিতার বই প্রকাশিত করেছেন। কিন্তু সেই স্বল্প জীবনেই তাদের কলম থেকে এমন সব বৈপ্লবিক লেখা বেরিয়েছে যা পরবর্তীকালে সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে চিরকালের জন্যে। অভিশপ্ত কবিদের জীবনের এই আশ্চর্য মিল দেখেই তাঁদের সম্পর্কে আরো খানিকটা জানবার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। বইপত্তর ঘেঁটে সেই আকর্ষণ বেড়েছে বই কমেনি।
ফরাসি কবি আর্তুর র্যাবোকে আধুনিক যুগের প্রথম অভিশপ্ত কবি বলা হয়ে থাকে সাধারণত। একজন কুড়ি বছরের যুবক কবি যে পরবর্তী কালে কবিতার একটা লাইনও লেখেনি, কী করে প্রতীকবাদের স্রষ্টা হয়ে উঠল সেই নিয়ে আজ একশ বছর পরেও গবেষণা চলছে। কিন্তু র্যাবো একলা নন। এমিলি নেলিগানের কথা ধরা যাক। কানাডার এই কবিকে কুড়ি বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণে মেন্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করা হয়। এমিলি একা একা কথা বলে যেতেন তাঁর লেখার চরিত্রদের সঙ্গে, কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর মানুষের সামনে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়াই হত না। সিজ্রফ্রেনিয়ার এই রোগ তাঁকে নিশ্চিন্তে বাঁচতে দেয়নি কোনোদিন, কিন্তু একের পর এক অসামান্য কবিতা, নাটক, গল্প লিখিয়ে নিয়েছে। তারপর ধরা যাক টমাস চ্যাটরটন। ইংল্যান্ডে জন্ম, ছোটবেলায় অক্ষর চিনতে অব্দি পারতেন না। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সমবয়সীদের চেয়ে শতগুণ এগিয়ে গেল সেই বিস্ময় বালক। বাবার লাইব্রেরির সব বই শেষ। এমন কবিতা লিখতে শুরু করলেন যে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না পনেরো বছরের কিশোর সেই সব লিখছেন। একা ঘরে বসে লিখত সেই ছেলে, লোকজনের চোখ এড়িয়ে চলত সবসময়। মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিষ খেয়ে মারা যায় টমাস চ্যাটরটন। জন কিটস, কবি শেলী আর সিলভিয়া প্লাথের কথা তো সকলেই জানে। ইতালিতে এদের সমকক্ষ হলেন দিনো কাম্পানা। ফ্লোরেন্স থেকেই কাম্পানার যাত্রা শুরু, তাই ইতালিয়ান কবিতার প্রসঙ্গে প্রথমেই তাঁর কথাও আমার প্রথমে মনে পড়ল।
বিংশ শতাব্দীর দিকপাল তিন কবি দান্নুতসিও, কার্দুচ্চি আর পাসকোলির গৌরবোজ্জ্বল কবিতাকে সরিয়ে দিয়ে নবীন কবিরা সাধারণ মানুষের বর্ণময়হীন জীবনের কথা লিখতে শুরু করেছেন তখন। গুইদো গৎসানো, জুসেপ্পে উন্গারেত্তি, উজিনো মনতালে প্রভৃতি কবিরা কবিতার নতুন ধারা 'ফিউচারিজম'-এর সৃষ্টি করেছেন। ঠিক সেই সময় দিনো কাম্পানা ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে টুস্কানি অঞ্চলের পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পোশাক-আষাক অবিন্যস্ত, থাকা খাওয়ার ঠিক নেই, মাঝে মাঝে হয়তো বা কোনও ছোট গ্রামে আশ্রয় নেন। না হলে নক্ষত্রখচিত আকাশের তলায় রাত কাটান। শুয়ে শুয়ে কবিতা আবৃতি করেন, প্রিয় কবিতার বই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন পাহাড়ে। কাম্পানার মায়ের মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না, পনেরো বছর বয়সে উন্মাদনার প্রথম লক্ষণ দেখা যায় কাম্পানার মধ্যেও। বেশ কয়েকবার মানসিক হাসপাতালের চক্কর কেটেছেন ততদিনে, পাগলামি বাড়তেই আবার তাঁকে ধরে এনে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এমন করেই চলছিল। আচমকা ১৯১৪ সালে কাম্পানার লেখা চটি কবিতার বই 'অরফিউসের গান' প্রকাশিত হওয়ার পট ইতালির সাহিত্য জগতে আলোড়ন পড়ে গেল। একজন অর্ধউন্মাদের কলম থেকে এই জিনিস কী করে বেরোয়, সেই নিয়ে শুরু হয়ে গেল হইচই। খোঁজ পড়ল কবির। কিন্তু কোথায় কাম্পানা? তিনি তখন আবার নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়েছেন। ১৯১৮ সালে পুনরায় বন্দী করে আবার মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে, আর সেখান থেকে ফিরে আসেননি দিনো। কড়িকাঠের দিকে চেয়ে কবিতার লাইন আওড়াতে আওরাতেই মৃত্যুবরণ করেছেন ইতালির এই অভিশপ্ত কবি।
ইতালিয়ান সাহিত্য অবশ্য থেমে থাকেনি। পরবর্তী কালে সালভাতোর কোয়াসিমোদো, জুসেপ্পে উন্গারাত্তি, উজিনো মনতালে, সিজার পাভেসরা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব শৈলী আছে। মনতালে আর কোয়াসিমোদোর মতন পাভেসও হয়তো পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কার পেতেন, কিন্তু সে হওয়ার নয়। অভিশপ্ত কবিদের সূচিতে পাভেসও ছিলেন। একটা কবিতায় তিনি লিখেছেন—
এক চুমুক পানীয়তে আমি পাই গাছ ও নদীর আস্বাদ
বিচ্ছিন্ন সেই স্বাদের ঘোরে নিশ্চল কিছু নীরব মুহূর্ত
জেগে থাকে, যেমন নিশ্চল জেগে থাকে আমার শরীর
আমার অনুভবে দ্বীপ হয়ে আসে সমস্ত কিছু অথবা
হয়ে আসে নীরবতার বুদ্বুদ। ঘন অন্ধকারে আমি বুঝতে পারি
যেমন বুঝি শিরার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে রক্তের প্রবাহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের খেসারত দিতে ইতালিকে অর্থনৈতিক ভাবে ভালোই নাজেহাল হতে হয়েছিল। দেশকে নতুন দিশা দেখানোর জন্যে বেনিতো মুসোলিনি এসে তৈরি করলেন ফাসিস্ট দল, হিটলারের সঙ্গে জুটি বেঁধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালিকে আগেকার গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার তার স্বপ্ন অবশ্য তার নিজের দোষেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। মুসোলিনির ফাসিস্ট চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে অনেক শিল্পীই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদেরই একজন ছিলেন সিজার পাভেস। গোপনে একটি পত্র পাঠানোর কারণে তাঁকে রাজনৈতিক বন্দী করে জেলে পাঠানো হয়। পাভেস প্রকৃতিকে ভীষণ ভাবে ভালবাসতেন, বন্দিগৃহের পরিবেশ তার সহ্য হল না। তাঁর মনোবিকার শুরু হল শীঘ্রই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও তাঁর মনোরোগ সারলো না, বরং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পাভেস বেশিমাত্রায় সেবন করতে লাগলেন 'অ্যান্টিডিশ্রাশন্ট' ওষুধ। সারাদিন উদেশ্যহীনভাবে তাঁর গ্রামের আশেপাশের খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন এইভাবেই ওষুধের 'ওভারডোজ' নিয়ে আত্মহত্যা করেন পাভেস। অভিশপ্ত কবিদের জীবন নিয়ে পড়লে সত্যিই তাজ্জব হয়ে যেতে হয়।
পরেরদিন সকালবেলায় আমরা এসে হাজির হলাম সান্তা মারিয়া নভেলা গির্জা চত্বরে। স্থানীয় মানুষের সাহায্য না পেলে ফ্লোরেন্সের মত ঐতিহাসিক শহরের মেজাজটা ধরতে পারা স্বভাবতই কঠিন, কারণ এখানের প্রতিটা পাথরেরও নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেইজন্যে এখানকার টুরিস্ট বিভাগ থেকেই বেশ কয়েকটা ফ্রি ওয়াকিং ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়াকিং ট্যুরের গাইডরা রীতিমত পন্ডিত ব্যক্তি, অনেকেই দীর্ঘদিন ফিরেঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। আমাদের গাইড দানিয়েলে আবার পঁচিশ বছর ধরে রেনেসাঁর আর্ট রিস্টোরেশন-এর কাজ করছে, ফিরেঞ্জার যাবতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, স্থাপত্য জিভের ডগায় লেগে আছে তাঁর। দানিয়েলেকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাসিলিকা অফ সান্তা ক্রসের দিকের চলেছি আমরা অনেকেই। ইতিহাসের পাতা থেকে নানা গল্প বলে চলেছে দানিয়েলে, সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে অনভিজ্ঞ চোখে না দেখতে পাওয়া স্থাপত্যের খুঁটিনাটির দিকে। কয়েকজন খুব মন দিয়ে প্লাজা চত্বরের মধ্যে বসানো মুর্তিগুলো দেখছিল, তাদের উদ্দেশ্য করে দানিয়েলে চেঁচিয়ে উঠল," সেন্যর, সেন্যরা, খুব বেশি মন দেবেন না। স্টেন্ডহাল সিনড্রম হয়ে যেতে পারে। ফ্লোরেন্সের বদলাম আছে ওইজন্যে।"
স্টেন্ডহাল সিনড্রম? সেটা আবার কি জিনিস? সকলেই দেখি মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আমাদের দুরবস্থা দেখে দানিয়েলেই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। ১৮১৭ সালে ফরাসি লেখক স্টেন্ডহাল এসে উপস্থিত হন ব্যাসিলিকা অফ সান্তা ক্রস দেখতে। ফ্লোরেন্সের ঐতিহাসিক নিদর্শনের সৌন্দর্য দেখে তিনি আগেই সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন, ব্যাসিলিকা অফ সান্তা ক্রস-এ যাওয়া মাত্র তাঁর বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। গ্যালিলিও গ্যালিলি, মিকেল এঞ্জেলোর মতো রেনেসাঁর নায়কদের সেখানেই কবরস্থ আছেন, সে কথা ভেবেই তিনি এমন উত্তেজিত হয়ে পড়েন যা তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যায়। পরবর্তী কালে এই মানসিক অবস্থাকেই স্টেন্ডহাল সিনড্রম অথবা ফ্লোরেন্স সিনড্রম নাম দেওয়া হয়েছে। ফ্লোরেন্টাইনদের মতে শিল্পের অলঙ্করণ ও প্রাচুর্য দেখে প্রতি বছরই নাকি বেশ কয়েকজন এই সিনড্রমের শিকার হয়।
বাপরে বাপ! সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু দানিয়েলে যেভাবে মা আরনোর কিরি খেয়ে বলল, তাতে বিশ্বাস হেলে যায় বইকি! রোজকার মতো চোখ কপালে তুলে হাঁটা আর হাঁ করে স্থাপত্যের দিকে তাকিয়ে থাকার বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। ততক্ষণে সান্তা মারিয়া গির্জা পেরিয়ে আমরা ব্যাসিলিকা অফ সান্তা ক্রসে পৌঁছে গেছি। সাদা রঙের ফ্রান্সিস্কান গির্জা। রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত এই গির্জাতে হাসপাতাল থেকে কবল দেওয়ার জন্যে শবদেহ নিয়ে আসা হত এককালে। দানিয়েলের কথায় জানা গেল মিকেল এঞ্জেলো নাকি এই শবদেহ কাটাকুটি করেই মানুষের শরীরের বিজ্ঞান জানার চেষ্টা করতেন। ব্যাপারটা যদিও বেআইনি ছিল, মিকেল এঞ্জেলোর ওপর সেইভাবে কেউ দোষ চাপায়নি।
দানিয়েলে বলল, "ডেভিডের প্রতিমা গড়ার আগেই এঞ্জেলো হিউমান অ্যানাটমি গুলে খেয়েছিলেন। সেইজন্যেই দেখবে ডেভিডের হাতের পাতা থেকে মাংসপেশীর শিরা, সবই হুবহু বাস্তবের মত দেখতে লাগে।"
সুযোগ পেয়ে ফ্রান্সের একটি মেয়ে জিগ্গেস করে ফেলল, "ডেভিড দেখতে গেলে আবার কুড়ি ইউরো খরচা করে আকাদেমিয়া জাদুঘরে ঢুকতে হবে। ওই মূর্তিটা বাইরে কোনও প্লাজাতে লাগিয়ে রাখা যেত না?"
দানিয়েলা এবার মুচকি হেসে বলল, "সেই তো ছিল। আগে পালাজো ভেকিওর দরজার সামনেই ডেভিডকে দাঁড় করানো হয়েছিল। গলিয়াথকে বধ করেছে, খ্রিস্ট ধর্মের কিংবদন্তি চরিত্র; তাকে দেখতে বহু লোকে ভিড় করত। ১৫২৭ সালের এক দাঙ্গায় মারামারি করতে থাকা মানুষজন একটা চেয়ার ছুঁড়ে মারে সেটার ওপরে, তাতে বেচারা ডেভিডের হাত ভেঙে যায়। সেইজন্য পরবর্তী কালে মেরামতি করে সেটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আকাদেমিয়া গ্যালারিতে। তোমরা যে মেদিচি পরিবারের বাড়ি দেখলে, তাঁরা না থাকলে এসব শিল্পফিল্প কিছুই হত না, হলেও তাদের রক্ষনাবেক্ষণ হত না। শিল্পের নিদর্শনগুলো যে বাঁচিয়ে রাখা দরকার, এই শিক্ষাটাও ফ্লোরেন্স থেকেই পাওয়া। ঠেকে শিখেছে আর কি!"
দানিয়েলে এইবার একেবারে তার আসল বিষয়ে চলে এসেছে দেখছি। আর্ট রিস্টোরেশন যার পেশা, তার কথায় গুরুত্ব দিতেই হয়। তার মানে দাঁড়াল সিজার শহর পত্তন করলেন সৈন্যদের বিশ্রামের জন্যে, সেখানে দান্তে এসে ইতালি ভাষার সঞ্চার করলেন, রেনেসাঁর সুবাদে শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য-বিজ্ঞান এল, গ্যালিলিও মহাকাশচর্চা করলেন, ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল আধুনিক নার্সিং ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করলেন, ওপেরা এল, বেহালা এল, শিল্প সংরক্ষণ এল… হরেনড্যাস ব্যাপার রে তোপসে! লিস্টি বেশিই লম্বা হয়ে যাচ্ছে দেখে আর ভাববার চেষ্টা করলাম না। বিকেলের দিকে আইসক্রিম খেয়ে ফ্লোরেন্স থেকে খানিকটা দূরে ফিয়েসোলে গ্রাম থেকে ঘুরে এলাম। পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একরত্তি গ্রাম। একটা ক্ষুদ্রতম গির্জা। কিন্তু সেখান থেকে টুস্কান উপত্যকা আর ফ্লোরেন্স শহরের দারুণ ভিউ পাওয়া যায়।
সূর্যাস্তের সময় আবার গুটিগুটি এসে হাজির হলাম মিকেল এঞ্জেলো প্লাজায়। সূর্যাস্তের আগে থেকেই সেখানে গান বাজনা শুরু হয়ে গেছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় বুঝতে পারলাম, স্টেন্ডহাল সিনড্রম যদি আমাদের হতেই হয় তাহলে তার জন্যে এর চেয়ে ভালো অবস্থান আর নেই। ফ্লোরেন্সের সব শিল্পই প্রকৃতির এই আবহমান শিল্পের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন