বুধবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

অফিস ছুটি হয়ে গেছে.এক এক করে সব লোকজন বেরিয়ে পড়ছে বাড়ি ফেরার উদ্দ্যেশ্যে.রঞ্জুও বেরিয়ে পড়ল.বাড়ি যেতে হবে.বেশ খানিকটা পথ.হেঁটেই যাওয়াআসা করে সে.মাঝে ভেবেছিল একটা সাইকেল নিয়ে নেবে,কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি.সকালে অফিসে আসার সময়ে তাড়াহুড়ো তে একটু কষ্ট হয় বটে,কিন্তু অফিস ছুটির পর ঐটুকু রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে ভালো লাগে রঞ্জুর.সন্ধ্যে নামার মুখে মুখে ছোট ছোট দোকানগুলোতে আলো জ্বলে ওঠে এক এক করে.বেশ লাগে.শহরতলি বলেই হয়ত এখানে গাড়িঘোড়া অত চলে না.পরিবেশ শান্ত থাকে বেশিরভাগ.রাস্তার লাগোয়া ছোট মাঠে কয়েকটি বাচ্চা ছেলে আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে.কিছু লোকে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়.সাদামাঠা গল্পগাছা করে.হাতে গোনা দোকানপাট,গোছানো একতলা কয়েকটা বাড়ি.এই সময় বাড়িগুলো থেকে শাঁখ বাজানোর শব্দ শুনতে পাওয়া যায়.                                                                                                       আজ পথঘাটের চেহারা খানিকটা অন্যরকম.মাঘী পূর্নিমা উপলক্ষ্যে ছোট্ট একটা মেলা বসেছে.কিন্তু এখানকার মেলাতেও অত হইহুল্লোড় আর ব্যস্ততা নজরে পড়ে না.লাউডস্পিকারে কান ঝালাপালা করে দেয় না.বেশ ছিমছাম ভাবে কিছু দোকান বসেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে.বিক্রি হচ্ছে মুখরোচক খাবার.ফুচকা,আলুকাবলি,জিলিপি,লজেন্স,পাটিসাপটার দোকান.কয়েকটা দোলনাও আছে.একদিকে কিছু লোক বিক্রি করছে ঘর সাজানোর জিনিসপত্র.আরও আছে রঙিন চুড়ি,হাতে কাজ করা ওয়ালপেন্টিং,প্লাস্টার অফ প্যারিসের তৈরী মুর্তি.লোকজন হাসিমুখে ঘোরাফেরা করছে,কিন্তু কোনরকম গাদাগাদি নেই.জমজমাট হয় আছে জায়গাটা.রঞ্জুর ফট করে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল,দাদার হাত ধরে রথের মেলায় যাওয়া.প্রতিবছর তার যাওয়া চাইই চাই.ওখানে গিয়ে রথ কেনার জন্যে বায়না ধরত রঞ্জু.বেশ কয়েকবার দাদা কিনেও দিয়েছে.প্রচণ্ড ভিড় হত রথের মেলায়,কোনো কিছুই স্বস্তি করে দেখা যেত না.কিন্তু তাও যাওয়া চাই.বেলুন ফাটানো আর নাগরদোলায় চড়ার স্মৃতি আজও অমলিন.আরও থাকত ম্যাজিক দেখার আর নানখাটাই খাওয়ার লোভ.কিন্তু সেটাই শেষ নয়.রঞ্জুর আসল আকর্ষণ ছিল রথের মেলায় বিক্রি হওয়া টক মিষ্টি তেঁতুলের হজমি.বছরের অন্য সময়ে ওই হজমি লজেন্স পাওয়া যেত না.কালো কালো দেখতে তেঁতুলের হজমি লজেন্সের গায়ে চিনি মাখানো থাকত.দেখে রঞ্জুর জিভে জল আসত.কৌটো ভর্তি করে তেঁতুল লজেন্স কিনেছে প্রতিবার.এক হাতে দাদার হাত ধরে আর এক হাতে তেঁতুল লজেন্স চাটতে চাটতে যাওয়া ছোট ছেলেটার ছবি একই রকম রয়ে গেছে মনে.হঠাৎ করেই কবে থেকে যেন মেলায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল.রঞ্জু আর ছোট রইলো না.দাদা আজকাল বোম্বেতে থাকে.রথের মেলাও উঠে গেছে.তেঁতুলের লজেন্স আর রঞ্জুর খাওয়া হয়নি কোনদিন.
রঞ্জু মেলার দোকানপাট গুলো ঘুরে দেখতে লাগলো.খারাপ লাগে না.শহরের চেয়ে অনেক সস্তায় পাওয়া যায় জিনিসপত্র.আঁকিবুঁকি করা কাপের সেট,পুজোর সরঞ্জাম,আরও কত কিছু.অনেকরকম দোকান আছে.ঘুরতে ঘুরতে মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় প্রথম সেই নাগরদোলায় চাপা.ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল রঞ্জু.এখন হাসি পায়.সামনে একটা শিঙাড়া-চপের দোকান.অনেকক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করে খিদেও পেয়ে গেছে তার.দোকানে এসে রঞ্জু দুটো শিঙাড়া বলে দেয়.বেঞ্চির ওপর একটা পুঁচকে দুবছরের বাচ্চা ছেলে লাল সোয়েটার আর লাল মাঙ্কি ক্যাপ পরে বসে আছে,তার হাতে আবার কে একটা শিঙারা ধরিয়ে দিয়েছে,পুঁচকেটা আবার সেটা খাওয়ার চেষ্টা করছে.রঞ্জুর হাসি পেয়ে গেল.ছেলেটাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর.কার ছেলে রে বাবা?জানা গেল দোকানিরই ছেলে.শালপাতার ঠোঙ্গাটা হাতে ধরে রঞ্জু ছেলেটার সামনে বসে পড়ল.বাব্বা!শিঙারা যা গরম,হাতে খেলাতে খেলাতেই সময় চলে যাবে.এক কামড় দিয়েই ঝালের চোটে রঞ্জু হুহা করতে লাগলো.বাপরে.কি ঝাল,কিন্তু দারুন খেতে.প্রায় কুড়ি মিনিট পর যখন রঞ্জুর শিঙারা খাওয়া শেষ হলো,গরমে আর ঝালে তার নাক চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে.দোকানির কাছে গিয়ে জল চাইল রঞ্জু.দোকানি হাসতে হাসতে বলল,"জল খেইয়ে কিছু হবেনি বাবু,দু মিনিট বসেন.ওষুধ আছে".দোকানি এসে পুঁচকে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,"এইদিকার লোকজন ঝাল খাইতে ভালবাসে বাবু.আমার এই ছেইলেটারও ঝাল পছন্দ বাবু.এই ল্যান."বলে ছোট্ট ছেলেটার প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করে রঞ্জুর হাতে দিয়ে দিল.রঞ্জুর অবস্থা তখন খারাপ ঝালের চোটে.চট করে কাগজের মোড়কটা খুলে মুখে দিয়ে দিল সে.পর মুহুর্তেই রঞ্জুর মনে পড়ে গেল সেই স্বাদ.আরে!এ তো সেই ছোটবেলার তেঁতুল লজেন্স.টক,মিষ্টি তেঁতুল হজমি.যা কৌটো করে নিয়ে যেত সে.সেই স্বাদ.একচুলও বদলায়নি.কত পুরনো স্মৃতি,দাদার কথা,আবছা কিছু দৃশ্য আর টুকরো টুকরো সংলাপ ভিড় করে এলো হঠাৎ মনের মধ্যে.চোখ খুলে রঞ্জু জিগ্গেস করলো,"তুমি এই হজমি কোথায় পেলে?কোন দোকানে?"দোকানি হাসলো.বলল,"বাবু,এ জিনিষ আর দোকানে পাওয়া যায় নে গো.আমার আব্বা বানাইত.হজমি,টকঝাল লজেন্স,আমসত্ব.বাচ্চারা খুব ভালবাসত এইসব.শহরে রথের মেলায় দোকান দিত বছরে এইকবার.অনেকদিন হইলো ছেইড়ে দিয়েছে.বয়স হইয়েছে তো!এই আমার ছেইলেটার জইন্যে আজকাল একটু আধটু বানায়."বলে দোকানি চলে গেল উনুনের সামনে.হঠাৎ রঞ্জুর কান্না পেয়ে গেল.অনেক চেষ্টা করেও সে নিজেকে আটকাতে পারল না.জামার কোনে চোখ মুছতে মুছতে রঞ্জু দেখতে পেল,মাঙ্কিক্যাপ পরা পুঁচকে ছেলেটা গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে রঞ্জুর দিকে.