সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০১৫

দুপুরে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল.বিকেলবেলা ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ কচলে আকাশের দিকে তাকাতেই নানা খেয়াল ভিড় করে এলো মাথায়.দুই সপ্তাহ আগে এইরকমই এক শেষ বিকেলের আলোয় বসে ছিলাম সুদুর আসামে,মানস নদীর তীরে,হেঁটে গেছিলাম শুকনো পাতার ওপর দিয়ে জঙ্গলের পথে.পরের দিন কাজে যাওয়ার চিন্তা ছিল না,ফোন রিসিভ করার ব্যস্ততাও ছিল না.খালি মরা বিকেলের আলোয় দেখা নদীর জল আর জঙ্গলের গাছপালা.আজও সেই রকমই বসে আছি বিকেলের পড়ন্ত আলোয়.সব কিছুই একরকম.সূর্য সেখানে আজও এক ভাবে ডোবে,আকাশে লালিমা ছড়িয়ে যায় চারপাশে.এখানের মত ট্রাফিকের শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয় না,বনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় না এত অগুন্তি মানুষ.আকাশ সম্পূর্ণ ভাবে ধরা দেয় চোখে,এখানের মত manmade obstacles আটকে যায় না তার রূপের সৌন্দর্য.সূর্য ডুবে যাচ্ছে বাঙ্গালোরে কিন্তু আমি আজও বসে মানসের তীরে.ভারাক্রান্ত মনে এক কাপ চা খেতে উঠলাম.চায়ে চুমুক দিতেই কয়েকটি দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পর্দায়.মাজুলি থেকে ফিরছি.লঞ্চ ভর্তি লোক.নদীর জল কেটে লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছে.ধারের সিটে বসে আমি.কানে বাজছে 'বইজুয়া'.আমার নেশা হয়েছিল.হাতে এক কাপ চা.যখন ঘুরতে বেরোই,হুহু করে কেটে যায় সময়.একই দেশ,কিন্তু কত অন্তর লোকেদের রোজকার জীবনযাত্রায়,আশাআকাঙ্খায়.সময় কম হওয়ার দরুন আগে থেকে ঠিক করা থাকে পরের ঠিকানা.ভালো লাগা-খারাপ লাগার মুহূর্ত,নতুন স্বাদ,গন্ধ,দৃশ্য,অপরিচিত লোকের ব্যবহারে পাওয়া উষ্ণতা.. দ্রুত চলতে থাকে একের পর এক.তার মূল্য বোঝার সময় তখন থাকে না.পরে হঠাৎ করে একটিন মনে পড়ে সেই সব কথা.ফিরে আসার পর.চিরব্যস্ততার মাঝে চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে যায় পথে পাওয়া সেই দিনগুলির স্মৃতি.বুকের ভেতর ভারী হয়ে আসে.কত কিছু ছেড়ে এলাম পিছনে.মানসের নদীর বুকে আজও ঠিক তেমন ভাবেই হচ্ছে সুর্যাস্ত,কিন্তু আজ আমি নেই সেখানে.জ্যোত্স্না আজও ছড়িয়ে পড়বে মাজুলির ধানক্ষেতের ওপর,কিন্তু ব্রিজের ওপর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে কেউ চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকবে না সেই দিকে.হারপ্রীত হয়ত গিটার বাজাবে বিটের সঙ্গে বসে,কিন্তু তাদের হাসিতে আজ আমি যোগ দিতে পারব না.এলিজাবেথ এতদিনে ফিরে গেছে নিউইয়র্ক.সিপ আর ক্লায়ের হয়ত নেপালের পথে.বায়রন বোধহয় নতুন অতিথিদের জন্যে রান্না করছে.সইকিয়া সাহেব অন্য কয়েকজনকে নিয়ে গেছেন মথানগুরিতে,শর্মাবাবুর হাতের রান্না খাবেন আজ.আরও কত মানুষ যাদের সঙ্গে ভাগ করেছি কয়েক টুকরো কথা,কয়েক চিলতে হাসি,এদের সবার জীবন চলবে নিজের মতন করে.হয়ত জীবনে আর কোনদিন এদের সঙ্গে দেখা হবে না.কোথাও পড়েছিলাম প্রত্যেক মুহূর্তই বেঁচে থাকে পৃথিবীতে.পৃথিবীর প্রত্যেক কণার মেমরি আছে নিজের নিজের.কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না চিরতরের জন্য.এই স্মৃতিগুলোও বেঁচে রইলো অদৃশ্য কোনো ড্রাইবে.কয়েকটি মুহূর্তই সই,জঙ্গলের কিছু রাত,সূর্যের শেষ রশ্মিতে মানস নদীর চিকচিক করে ওঠা জল,এই দৃশ্য আমারই রইলো.ঝিঝির অবিরাম শব্দে জীবন্ত গারো হিলসের বনও আমি সযত্নে রেখে দিলাম মনের কোন কোনে.অন্ধকার রাতে সাইকেল চালাতে চালাতে দেখা জ্যোত্স্নাও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে.কোনদিন কি ফেরা হবে?যদি বছর কয়েক বাদে এক রাতে পৌঁছে যাই বাই দা ওয়েতে,অথবা বায়রনএর হোমস্টেতে,মথনাগুড়ির বাংলায়,আনন্দে কি মন উৎফুল্ল হয়ে উঠবে না চোখের কোন ভিজে যাবে?জানা নেই.সূর্য ডুবে গেছে.শেষ পনেরোটা দিনের অপেক্ষায় কেটেছিল নটা মাস.কত পরিকল্পনা.অপেক্ষা শেষ.সফর শেষে ফিরে এসেছি রোজকার বাস্তব জীবনে.ট্রাফিকে আটকে,বাসকন্ডাকটারের গালাগালি খেয়ে,ধুলো মেখে,অফিস যাওয়ার চিন্তা করে কাটানো আরেকটি সন্ধ্যে.বাস্তব!চূড়ান্ত অবাস্তব!পরিকল্পনার আর দরকার নেই.বেঁচে থাকার তাগিদ খুঁজে নিতে হবে.গলাটা ভারী হয়েই রইলো.বাস্তবের হিসেব নিকেশ কে কলা দেখিয়ে,রোজকার জীবন অস্বীকার করে যদি জীবন আরেকবার ফিরে যায় মানস নদীর ধারে!হারিয়ে যেতে!....সূর্যাস্তের আগে!সূর্যাস্তের সময়!