সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১

দ্য আয়রনি অফ লিবার্টি




১৯১৮ সালের ছবি। চার্লি চ্যাপলিন ওয়াল স্ট্রিটের সাবট্রেজারি বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে লিবার্টি লোন বা লিবার্টি বন্ডের প্রচার চালাচ্ছেন। তখনও চ্যাপলিন নিজে সিনেমা পরিচালনা শুরু করেননি সেভাবে, দ্য কিড আসতে আরো তিন বছর বাকি। কিন্তু সিনেমায় তাঁর 'ট্র‍্যাম্প' অবতার ( ট্রাম্প নয় রে বাবা!) দেখে জনতা তাঁকে নায়কের আসনে বসিয়েছে ইতিমধ্যেই। আসল চ্যাপলিনকে কেউ না চিনলেও 'ট্র‍্যাম্প'-কে সারা দুনিয়ার লোক চেনে, তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছে। এমন সময় মার্কেটে এল লিবার্টি লোন। মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে এই ফিনান্সিয়াল বন্ড লঞ্চ করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই। উদ্দেশ্যে মিত্রশক্তি বা 'অ্যালাইড পাওয়ার্স' এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেওয়া। কিন্তু সাধারণ মানুষ আর খামোখা সে নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন, কষ্ট করে সঞ্চিত অর্থ নিয়ে এই লিবার্টি বন্ড কিনতেই বা যাবে কেন? প্রথম দিকে কেউই গ্যাঁটের টাকা খরচ করে এই পেপার বন্ড কিনতে যায়নি। উপায়ান্তর না দেখে সরকার লিবার্টি লোন নিয়ে বিপুল প্রচার শুরু করে। দেশ জুড়ে মিডিয়া ক্যাম্পেন শুরু হয়, পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় শহরের রাস্তা। লিবার্টি লোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় দেশপ্রেম। বড় বড় স্লোগান পড়ে। 


"হামারে জাওয়ান সীমা পে লড় রহে হ্যায়! ইউ ক্যান সেভ দেম!"


"ইউ লেন্ড অ্যাজ দে ফাইট!"


"ইওর ডিউটি টু বাই লিবার্টি বন্ড। ইউ এস এ মিন্স ইউ সাবস্ক্রাইব অ্যাট ওয়ান্স!"


"বিট ব্যাক দ্য হুন উইথ লিবার্টি বন্ডস!"


টিপিকাল ন্যাশনালিস্ট স্টাইলের প্রচার। দেশপ্রেমের চাটনি মাখিয়েও অবশ্য লিবার্টি লোনের বিশেষ গ্রাহক পাওয়া যায়নি। এরপর সরকার নিয়োগ করে জনপ্রিয় অভিনেতা, নায়ক, গায়কদের। ডগলাস ফেয়ারব্যাংকস,  ম্যারি পিকফোর্ডদের নিয়ে তুমুল ক্যাম্পেন চালানো হয়, চ্যাপলিন 'দ্য বন্ড' বলে একটা দেশাত্মবোধক (এবং ভুলভাল ইনফরমেশনে ঠাসা, প্রোপাগাণ্ডা ফিল্ম বলাই ঠিক) তথ্যচিত্র নামিয়ে দেন। চার্লি চ্যাপলিনকে সামনে রেখে লিবার্টি লোনের মার্কেট বেশ ফুলেফেঁপে ওঠে। অনেকের কাছে চ্যাপলিন হয়ে ওঠেন ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকার প্রতীক। 'ট্র‍্যাম্প' এর বেশে প্রচার করতে এসে ওয়াল স্ট্রিটে কত লোক হয়েছিল আর সেদিন ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে কী কী করা হয়েছিল সে সব আর বলে লাভ নেই।

কে জানত এই চ্যাপলিনকেই একদিন আমেরিকা থেকে নির্বাসিত করা হবে? দ্য কিড, দ্য উম্যান অফ প্যারিস, মডার্ন টাইমস, সিটিলাইটস... একের পর এক সিনেমাতে গরীবগুর্বো মানুষদের কথা বলে গিয়েছেন চ্যাপলিন, হিটলারকে নিয়ে স্যাটায়ার করতেও দু' বার ভাবেননি। দ্য গ্রেট ডিক্টেটর প্রকাশ্যে আসার পর জার্মানির রাজনৈতিক মহলে হইচই পড়ে গিয়েছিল, নাজি পার্টির জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। জার্মানিতে হলিউডে মাহাত্ম্য আগেও ছিল, হিটলার খোদ গোয়েলেসের সঙ্গে বসে গ্রেটা গার্বোর সিনেমা দেখেন মোহিত হয়ে, তিনি নাকি গার্বোর প্রেমেও পড়েছিলেন। গার্বোকে সরকারিভাবে নিমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন হিটলার জার্মানিতে আসার জন্য, গার্বো সরাসরি সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। পরে অবশ্য এই মহীয়সী মহিলা জানিয়েছিলেন, হিটলারের কথা শুনে জার্মানি গিয়ে তাঁকে হত্যা করে আসলেই ভালো হত। 

যাই হোক, চ্যাপলিন যে আসলে শোষিত বর্গের সমব্যাথী আর চোরা কমিউনিস্ট, সেই অভিযোগ তদন্ত করা শুরু করে এফবিআই। চারের দশকে একের পর এক ট্রায়ালে জড়িয়ে পড়েন তিনি, আমজনতার চোখে তাঁর ইমেজ কলুষিত করার সব চেষ্টাই চলছিল পুরোদমে। চ্যাপলিন সিভিল লিবার্টি আন্দোলনে শরিক ছিলেন কিন্তু নিজেকে কমিউনিস্ট বলতে তাঁর আপত্তি ছিল। বরং নিজেকে 'পিসমংগারার' বলতেন তিনি। 

আয়রনি আর কাকে বলে? ছিলেন ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকার দেশপ্রেমের ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, হয়ে গেলেন কমিউনিস্ট কন্সপিরেসির অপরাধী! কেন যে সাধারণ মানুষের পক্ষ টেনে কথা বলতে গিয়েছিলেন?

লাভ কিছুই হয়নি। এফবিআই আর মার্কিন সরকারির বাড়াবাড়িতে আমেরিকা ছেড়ে সুইটজারল্যান্ড চলে যান চ্যাপলিন, যদিও তাঁর অধিকাংশ সম্পত্তিই রয়ে গিয়েছিল আমেরিকাতে। প্রায় চার দশক আমেরিকায় থেকেও এই বিপুল জনপ্রিয় অভিনেতা আমেরিকার নাগরিকতা পাননি। ইউরোপে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকায় আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ৮৮ বছর বয়সে সুইটজারল্যান্ডেই মারা যান তিনি।


শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

ফ্লোরেন্স সামার্স

 গরমকালে ফ্লোরেন্সে যাওয়ার প্ল্যান থাকলে সাবধান করে দিলাম, পকেটে লেবু-পেঁয়াজ আর বোতলে ঘোলের শরবত নিয়ে ঘুরবেন। নর্থ কলকাতার গরম হার মেনে যায়, এইসা রোদ্দুর। দু' পা হেঁটেই নোরা ফাতেহী স্টাইলে বলতে ইচ্ছে হয়, "হায় গর্মী!"


মনে হয় রোদের হাত থেকে রক্ষা পেতেই এখানকার শিল্পীরা রেনেসাঁ যুগের ভালো ভালো সব পেইন্টিং এঁকেছিল ঘরে বসে বসে। যারা বাইরে ছিল তারা জেলাতো আইসক্রীম খেয়ে নদীতে হুটোপুটি করত বোধহয়।

আজকেও অবস্থা প্রায় এক। এমনিতেও ইতালিয়ানরা মহাকুঁড়ে, সব তালগোল পাকিয়ে রাখে। বাসস্টপে বাস আসে না, টোবাকো শপ থেকে বাসের টিকিট কাটতে হয়, দরজায় কলিং বেল নেই, ওল্ড টাউন ছাড়া বাকি শহরটা একেবারে সাদামাঠা। টুরিস্টদের অবশ্য ওতে কিছু আসে যায় না। গুচ্ছের জেলাতো শপ, আইসক্রীম খাচ্ছে আর লোটাকম্বল বেঁধে গ্রাম কে গ্রাম লোক সান্দ্রো বতিচেল্লির 'বার্থ অফ ভিনাস' দেখতে উফিজি গ্যালারিতে ছুটছে।

কিন্তু, এই সমস্ত কিছুই বদলে যায় সুর্যাস্তের সময়। কোনো অদৃশ্য জাদুঘর ম্যাজিক ওয়ান্ড ঘুরিয়ে শহরটাকে পিছিয়ে নিয়ে যায় পাঁচশো বছর। নরম আলোয় আভাসিত হয় চরাচর, কানে ভেসে ওঠে চেলোর সুর, জোয়ানেস মার্টিনির ব্যারিটোন সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে পড়ে ওল্ড টাউনে। সেরকম একটা মুহূর্ত তুলে ধরার অক্ষম চেষ্টা করলাম এই ছবিটা দিয়ে।



শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১

তোলেদো- গুপ্তধনের শহর

 তোলেদো। তাগুস নদীর কিনারায় অবস্থিত প্রাচীন পার্বত্য নগরী। শহর না বলে গ্রাম বলাই ঠিক। তবে একরত্তি একলা গ্রাম নয়, বেশ জমাটি 'ভিলেজ টাউন'। স্পেনের এই এক চিলতে জায়গায় কী জাদু কে জানে, হাজার বছর ধরে অনুপ্রবেশকারীরা তোলেদো দখল করবে বলে হাপিত্যেশ করে বসে থেকেছে। রোমান, মুর, ভিসিগথ-- নতুন প্রজন্মের সঙ্গে নতুন নতুন ইতিহাসের পাতা যোগ হয়েছে তোলেদোতে কিন্তু পুরোনো পাতাগুলো মুছে যায়নি কোনোদিনই, বরং সময়ের সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।


সেই শহরে গিয়ে পৌঁছেছি সেইবার। রূপকথার রাজ্য, কিন্তু সে রাজ্য পাথর দিয়ে গড়া। লোরকার ভাষায় স্পেন হল জ্যান্ত ভূতের দেশ, বর্তমান এখানে গৌণ। ভুল বলেননি। এখানকার ভুগোল, ইতিহাস, শিল্প, কিংবদন্তি সবই অতীতের পরিচয় বহন করে, পাথরের গির্জা, প্লাজা, স্কোয়ারে ভূত ঘোরাঘুরি করে জ্যান্ত মানুষের পাশাপাশি, ম্যাকডিতে গিয়ে বার্গারও খায় সম্ভবত।

গুগল ম্যাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এরকম জায়গায় এসে গলির গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে না গেলে ঠিক জমে না। ইহুদি-মুর-ক্রিশ্চান সভ্যতার নিদর্শন, স্যুভেনিরের দোকান, ক্যাফে,রেস্তরাঁ,জামাকাপড়,গয়নার দোকান। অনেক জায়গায় ট্রেজার হান্টিং ম্যাপ আর যন্ত্রপাতিও পাওয়া যায়। কিং সলোমনের হারিয়ে যাওয়া সোনার টেবিল আর চাবি খুঁজতে এক সময় সারা দুনিয়া থেকে ইন্ডিয়ানা জোন্সের জ্ঞাতিগুষ্টি এসে হাজির হয়েছিল, তাদের অর্ধেককে ভূতে ঘাড় মটকেছে, বাকিরা হতাশ হয়ে বা ভয় পেয়ে পিটটান দিয়েছে। (মস্করা নয়, ভূতের কথা পুলিশও স্বীকার করে, 'আনসলভড মার্ডার' এর ফাইলে সে কথা লেখাও নাকি আছে!)

খোঁজ অবশ্য এখনও চলছে, তোলেদো গুপ্তধনের ডিপো কিনা! সলোমনের গুপ্তধন ছাড়াও একটা গুজব ছিল গির্জা তৈরী করার সময় কয়েকশ টন সোনা নাকি আর্চবিশপরা লুকিয়ে রেখেছে কোনো গুপ্তস্থানে।

সে সব আমার ভাগ্যে নেই। গুপ্তধন দূর, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এ ব্যালেন্স দেখলে হিক্কা উঠতে থাকে। বন্ধুবান্ধবরা ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ি কিনে খুশ! মস্তিতে চাকরি করে করে টাকা জমাচ্ছে, আমি জমাচ্ছি স্মৃতি। নতুন জায়গায় এলে স্মৃতির খাতায় সূর্যাস্তগুলোও ঢুকে যায়। এক একটা সূর্যাস্ত এক একটা ইনভেস্টমেন্ট! সে নিয়ে গাফিলতি করি না।

সুতরাং সবচেয়ে জনপ্রিয় সানসেট পয়েন্টের খোঁজে হাঁটা শুরু হল, সাত কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পর পড়ল মিরাদোর দেল ভাইয়ে।

আকাশের গায়ে তখন ঘন কমলার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। দূরে তোলেদো শহরের ওল্ড টাউন সূর্যাস্তের অপেক্ষায় সাজতে শুরু করেছে এক একটা করে আলোর টিপ পরে। তাগুস নদী এখানে বাঁ দিকে বেঁকেছে। অনেক নীচে নদীর পাড় দিয়ে কয়েকজন জলের ধারে গিয়ে মাছ ধরছে। রাস্তার ধরে উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের কালস্থায়ী,আবহমান জীবনদৃশ্যের দিকে। সূর্যাস্ত হচ্ছে। আলোহিত আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে বাসায় ফিরে চলেছে পাখির দল। নদীর গর্ভে হয়ত মাছেরাও ঘুমোনোর তোড়জোড় শুরু করবে এইবার। দূরে তোলেদো শহর অনন্তকাল ধরে এই সায়াহ্নের সাক্ষী। আমার চোখের সামনে এই মুহূর্তে ইতিহাস, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক ফ্রেমে। নিজের অজান্তেই এই মুহূর্ত আমাদেরও ইতিহাসের পাতায় বন্দী করে রাখলো, চিরকালের জন্যে।

আরো কিছু মুহুর্ত ফ্রেমবন্দি করলাম, অভিজ্ঞতার ফিক্সড ডিপোজিটে ফেলে তালাবন্ধ করলাম। ম্যাচয়োর হলে এই মুহুর্তগুলো ভাঙিয়েই জীবন চলবে।

সেই মুহুর্তের একটা ছবি। 




পুলনা- হারিয়ে যাওয়া গ্রাম

 গ্রামের নাম পুলনা। চিরতরে হারিয়ে গেছে এই গ্রাম। না, নামটা আছে, গ্রামটাও আছে। কিন্তু বদলে গেছে আমার স্মৃতিতে ধরে রাখা এক চিলতে গ্রামের সেই পরিচিত দৃশ্য, যেখানে সূর্যের আলো মাথায় হাত দিয়ে ঘুম ভাঙাত। চা-ওয়ালা রমনকিশোর ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর ট্রেকারদের চা দিতে ভুলে গিয়ে মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকত আচমকা জেগে ওঠা রামধনুর দিকে। হেমকুণ্ড সাহিবগামী তীর্থযাত্রীরা চলে যেত এই গ্রামের পাশ দিয়েই কিন্তু ফিরেও চাইত না গ্রামের মোড়ল রামধনীর দিকে। গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান যদি নিয়ম করে নদীর ধারে গিয়ে রঙিন পাথর কুড়োয় তাহলে কে আর পাত্তা দেয়?


গোবিন্দঘাটের হইচই থেকে দূরে পাহাড়ের কোলে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকত পুলনা। নাম না জানা পাখিরা নিয়ম করে তাদের নিজস্ব 'সারেগামাপা' প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত সাতসকালে, সাক্ষী থাকত আকাশ, সাক্ষী থাকত বনের গাছপালা। প্রতিদিন পাতার বস্তা নিয়ে গ্রাম থেকে ঘাঙরিয়া যেত আমার বন্ধু শীতল, সেখানে তাঁবুওয়ালা আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন সেই পাতা কিনে আগুন জ্বালত। পুলনা গ্রামের মুখে সহিসরা ঘোড়া বেঁধে রাখত, তারা অলস ভঙ্গিতে ঘাস চিবিয়ে যেত সর্বক্ষণ। এই ঘোড়া করেও অনেকে হেমকুণ্ড সাহিবে যাবে, তখনও সেখানকার রাস্তায় ব্ল্যাক আইস আর কুচো বরফের বিপদ ওঁত পেতে আছে।

মাত্র তো তিন চার মাস, তারপর তো বরফের আচ্ছাদনের নীচে ঢেকে যাবে সমস্ত ভুন্ডার ভ্যালি, শান্ত হয়ে ঝুপড়িতে সেঁধিয়ে যাবে লোকজন। শুধু লক্ষণগঙ্গা আর অলকনন্দার সঙ্গম থেকে জলের উচ্ছ্বাসের শব্দ ভেসে আসবে। কিন্তু বর্ষার এই সময়টা এখানে বসন্তের সামিল। ট্রেকাররা আসে, কিছু আয়ও হয়। পাখিদের গলার স্বরে চাশনি, আকাশের গায়ে সিঁদুর মাখা রোদ, জলের শব্দে মিশে যাওয়া সেতারের সুর-- সেই অপেক্ষায় সারা বছর বসে থাকে রমনকিশোর বা রামধনীরা।

আঁকাবাঁকা পথ, সোনারঙা আকাশ আর কচিকলাপাতা রঙের সবুজ বন নিয়ে বেঁচেছিল পুলনা।

এলোমেলো, অলস জীবন।

সেই পুলনা আর নেই। ২০১৩ সালে উত্তরাখন্ডে 'ক্লাউড বার্স্ট' -এর সময় পুরো গাঁ ভেসে গিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। যে ক'জন থাকত, অনেকে প্রাণ হারিয়েছে, বাকিরা শরণার্থী শিবিরে মাথা গুঁজেছিল। আবহবিদরা বার বার করে সাবধান করেছিলেন আসন্ন বিপদের কথা ভেবে পরিবেশ সচেতনটার দিকে মনযোগী হতে, এখনও করছে, ও সব কে শোনে? বছর দুয়েক পর পুলনা পঞ্চায়েত গড়ে আবার ঘরবাড়ি দাঁড় করানো হল; সরকারের পক্ষ থেকে কিছু লোকজনকে বসিয়ে দেওয়া হল টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে। পাকা বাড়ি, টুরিস্ট সেন্টার, বিদ্যুৎ --- খালি সেই মানুষজনগুলো ফিরল না। তারা যে আদৌ এখানে থাকত, সেটা প্রমাণ করার জন্যে অনেকেই কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সরকারের কাছে। পরবর্তী কয়েক বছরে একের পর এক হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রোজেক্ট বসেছে এই অঞ্চলে, জঙ্গল কাটা পড়ছে দ্রুত। ফুলো কী ঘাটি যাওয়ার পথে যে গ্লেশিয়ার পড়ে সেটা প্রায় ভ্যানিস হওয়ার মুখে। পাখিদের গান কমে গেছে, আকাশের রঙ ঝাপসা, মেঘেরা এক্কাদোক্কা খেলতে আসে না। পুলনা গ্রামের মতো হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছু...

আজ প্রায় দশ বছর আমার এক বন্ধুর মারফত ফেসবুকে জানলাম রমনকিশোর আজকাল উত্তরকাশির কাছে জোশিয়ারা ব্যারেজ হাইড্রো প্রজেক্টে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। এ কয়েক বছরে একদম বুড়িয়ে গেছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে, দৃষ্টি শূন্য। পুলনার কথা শুনলে উত্তর দেয় না, বিড়ি টেনে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে নির্বিকারে। এরকম শত শত রমনকিশোর সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে হয়তো...

পুলনার কোনো ছবি নেই আমার কাছে। সে যাত্রায় পকেটে ১৯৭৭ টাকা ছিল, স্মার্টফোনের যুগ তখনও আসেনি। ঘাঙরিয়ার একটা ছবি দিলাম।



ভেনিস ও বৃষ্টির এক বিকেল

 সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল ভেনিসে। কালো হয়ে এসেছিল আকাশ, বাতাস বইছিল শন শন। গ্রেট ক্যানালে 'অ্যাকোয়া অল্টা'-র সাইরেন অগ্রাহ্য করে সমুদ্রের ফেনায়িত জলে আকাশ ছোঁয়া ঢেউ খেলছিল, ধুয়ে যাচ্ছিল সান মার্কো চত্বরের পরিপাটি মেজাজ, নিরাবরণ হয়ে উঠছিল অন্য এক জলশহর। আমরা ছাতা মাথায় সেই শহরে হারিয়ে গিয়েছিলাম।


নিরুদ্দেশ ভ্রমণ। নিরুত্তাপ দোকানি, নির্লিপ্ত সেতু, একা রাস্তা। জলে টইটম্বুর। বৃষ্টি থামলে মাঝে মাঝে ফেরিতে চড়ি, নেমে যাই দু'টো তিনটে স্টপ পর। যেই রাস্তায় সচরাচর বাইরের লোক পা বাড়ায় না, সেইখান দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখি। অনেকগুলো পাড়া একেবারে নিঝুম, খাঁ-খাঁ করে। একটা মানুষও দেখা যায় না। মিনিট দশেক হাঁটলে হয়ত একটা গির্জা চোখে পড়ে। কয়েকটা ক্যাথেড্রালে খোদাই করা থাকে অসাধারণ অলঙ্করণ, কয়েকটা আবার একেবারেই সাদামাঠা। নিতান্ত এলেবেলে থাকার বাড়িগুলোতে, খালের জলে বেঁধে রাখা সৌন্দর্যবিহীন নৌকোয় লুকিয়ে থাকে যে ভেনিস, তাঁর কথা শুনতে চেষ্টা করি মন দিয়ে।

বেলিনি, টাইটান, রাফায়েল, টিনতোরেত্তোর শৈল্পিক কেন্দ্র নয়, অমিতাভ বচ্চন-জিনাত আমানের গন্ডোলা বিলাসিতা নয়, মার্কো পোলো বা ক্যাসানোভার জনপ্রিয় গল্প নয়, এখানকার স্থানীয় মানুষের রোজকার জীবনযাত্রার ছবি ধরে রাখা ভেনিস। দ্য সিটি অফ মিরাজ। জলে ভিজে যে শহরের খোলস খসে গেছে। আমরা ছাতা মাথায় সেই শহরে হারিয়ে গিয়েছিলাম।



নাহুমের গ্রাম

 একটা বই কী করে লেখা হয়?


একটা পেইন্টিং, একটা কম্পোজিশন, একটা চলচ্চিত্র, একটা ভাস্কর্যের আড়ালে গোটা একটা জীবন থাকতে পারে। একটা জাতির ইতিহাস কোনও জায়গায় গিয়ে মিশে যায় ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে, স্মৃতির সাবকনশিয়াসে সংরক্ষিত শব্দ, গন্ধ, রঙ ও সুর লিখিয়ে নেয় এক একটা বই, রচিত করে সুরমালা, বাধ্য করে শিল্পীকে শিল্পের সামনে আত্মসমর্পণ করতে। শিল্পের আঙ্গিক, উৎপত্তি, বিবর্তনের সমান্তরালে শিল্পীর চেতনা ও অবচেতন নিয়ে আলোচনা ও লেখালিখি কম হয়নি, কিন্তু নন ফিকশনে গূঢ় মনস্ত্বাত্তিক তদন্ত করতে গিয়ে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে খুব বেশি বই পারে না। নাহুমের গ্রামে লেখকের ভাষার মায়া ও চিন্তার গভীরতা চুপ করিয়ে রাখে পাঠককে, ভাবতে বাধ্য করে। এই বইয়ের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু বলা যায় না, কারণ পাঠের এই অনুভব প্রত্যেকের ক্ষেত্রে নিজস্ব। শিল্পের সার্থকতা ও আবহমান প্রাসঙ্গিকতার এই দীর্ঘ অণুবীক্ষণে বার্গমান, তারকোভস্কি যেমন আছেন সেরকম সমরেশ বসু ও মার্কেসও আছেন। সমসাময়িক শিল্পের কথা যেমন আছে, হারিয়ে যাওয়া শহর ও ইতিহাসের মহামারীর অন্তরালে বদলে যাওয়া মনোজগতের কথাও আছ। আর কিছু না বলে বরং বইয়ের খানিকটা অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম। যদি পড়ে ভালো লাগে, অনুরোধ করব বইটা পড়তে। একাধিক বার পড়তে। আমার ধারণা, আমাদের মধ্যে অনেককেই এই বইটা ফিরে ফিরে পড়তে হবে সারাজীবন।

#পুস্তকাংশ

ক্‌ফারনাউম : গ্রিক শব্দ, হিব্রু ভাষায় উৎপত্তি। আদতে দুটি শব্দ, কেফার ও নাহুম, অর্থাৎ নাহুমের গ্রাম।গ্যালিলি সাগরের উত্তর উপকূলে এক সুপ্রাচীন মাছ-ধরাদের গ্রাম। কোনো এককালে জনসংখ্যা ছিল দেড় হাজারের মতো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু হয়ে এগার শতক পর্যন্ত একটানা মানুষের বসবাস ছিল এখানে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খনন করে উদ্ধার করেছেন দুটি সুপ্রাচীন সিনাগগের ধ্বংসাবশেষ, একটির ঠিক ওপরে আরেকটি। ক্রুসেডের আগে গ্রামটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়। ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি বিরাট ভুমিকম্প হয়েছিল। ক্‌ফারনাউম, নাহুমের গ্রাম। শব্দবন্ধটি কীভাবে যে হয়ে উঠল এলোমেলো জড়ো হওয়া অবিন্যস্ত অবান্তর জিনিসের স্তূপ, সেসব ভাষাতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়।

সিলিকন আর ইন্ডিয়া রাবার দিয়ে ওকে বানানো হয়েছিল চীনের গুয়াংঝাউ শহরে। এরপর হংকং ঘুরে চলে যায় লিসবনের বাজারে। চীনে তৈরি হলেও চেহারাটা কিন্তু মঙ্গোলয়েড ধাঁচের নয়, বরং অনেকটা যেন ভূমধ্যসাগরীয়দের মতো। ঘন কালো চুল, সবুজ আঙুরের মতো চোখ, পুষ্ট স্তন, চওড়া জঘন ও শ্রোণি; পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি পুতুল। খুব জীবনানুগভাবেই বানানো, এমনকি মুখের গড়নেও নিখুঁত ফুটে আছে লাস্য আর বিষাদ। পোল্যান্ডের দুই নাবিক ভাগাভাগি করে কিনেছিল ওকে। ওরা ছিল অভিন্নহৃদয় বন্ধু, বিভিন্ন বন্দরে একই বেশ্যালয়ে যেত। কখনো কখনো এমনকি একই নারীর কাছে। মাসের পর মাস দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় পুতুলটি হাতবদল হয়ে চলত ক্যাবিন থেকে ক্যাবিনে। ওর একটি নামও দেওয়া হয়, হেলেন। ডান পায়ের গোড়ালির নীচে মার্কার পেন দিয়ে লেখা থেকে জানা যায়। এই নামটি কেন দিয়েছিল, সেটা অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো ওদের চেনা কোনো নারীর নাম, যে ওদের একজনকে, এমনকি হয়তো দুজনকেই, প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রেমিকার নাম কখনোই নয়। ‘হেলেন’ নামের নীচে পোলিশ ভাষায় লেখা ছিল দুটি শব্দ -- বেদনার কুয়ো।

বছর দুয়েক পরে ওদের মালবাহী জাহাজটি কিনে নেয় ক্যারিবিয়ানের এক শিপিং কোম্পানি। কর্মী বদল হয়, কিন্তু পুতুলটি কোনোভাবে থেকে যায়। হয়তো ফেলে রেখে গিয়েছিল দুই যুবক। ওরা নাবিকবৃত্তি ছেড়ে অন্য পেশায় ফেরে। একজন ওয়ারশ-য় রুটির দোকান দেয়, অপরজন গ্রামে খামারবাড়িতে ফিরে গিয়ে চাষবাস শুরু করে, বিয়ে করে সংসার পাতে। হেলেনের শুরু হয় আরেকরকম জীবন।


জাহাজে নতুন কোম্পানির নাবিকদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ল্যাটিনো ও মেস্টিজো। এছাড়া রসুইখানার কাজে চট্টগ্রামের তিন বাঙালিও ছিল। ওদেরই মধ্যে একজনের প্রথম চোখে পড়ে হেলেনকে। অবশ্য ওর নাম বদলে দেওয়া হয়েছিল কী না সেটা আর জানা যায়নি। ওর দেহে আর কিছু লেখা হয়নি কখনো। তবে এই সময়ে সে বিভিন্ন হাতে ঘুরতে থাকে। জাহাজটি একবার উত্তর মেরু অঞ্চলে হিমজমাট সমুদ্রে আটকা পড়েছিল আড়াই মাস (নরওয়ে থেকে হাঙরের তেল আর পাম্পের যন্ত্রাংশ বহন করছিল)। অত্যধিক ব্যবহারে হেলেনের দেহে রাবারের অংশগুলি ক্লান্ত আর শিথিল হয়ে পড়তে থাকে এইসময়, মাথায় ও দেহের অন্যত্র কেশও ঝরতে থাকে। যদিও সিলিকন অটুটই ছিল। এবং এক কুয়াশাঢাকা ভোরে অস্বচ্ছ তেলের মতো প্রশান্ত মহাসাগর পার হবার সময় -- জাহাজটি পানামা থেকে লাওস যাচ্ছিল -- তাকে পোর্টহোল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এক বাঙালি রন্ধনকর্মী। মাসাধিককাল এলোমেলো ভেসে বেড়ানোর পর হেলেন আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্যস্রোত পেয়ে যায়, এবং গোলার্ধ পরিক্রমা করে বিষুবরেখা পেরিয়ে চলে আসে বঙ্গোপসাগরে। এক পূর্ণিমার জোয়ারে আন্দামানের একটি অগম্য দ্বীপে এসে ওঠে।

দ্বীপে বাস করত অস্ট্রিক জনজাতির একদল মানুষ। ওরা সভ্যতার কোন ভোরে মূল ভূখন্ড থেকে এসেছিল ভেলায় চেপে। মাছ ধরে, ফলমূল কুড়িয়ে, ছোটোখাটো প্রাণী শিকার করে জীবন নির্বাহ করত। চাষবাস তেমন জানত না। নারকোলপাতা দিয়ে তাদের ঘর বানিয়ে নিত আর পশুর চামড়া ও গাছের বাকল পরত কটিদেশে। এছাড়া উল্কি আঁকার এবং নাক ও কান ছেদন করার প্রথা ছিল। বিশ-পঁচিশ জনের ছোটো ছোটো দলে ওরা থাকত প্রায় আশি বর্গমাইল সিমের বিচির আকারের দ্বীপটায়। একশো কুড়ি থেকে দেড়শোর মধ্যে ওঠানামা করত ওদের জনসংখ্যা। জন্মহার কম এবং শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় এই ভারসাম্যটা বজায় থাকত। সমুদ্রে খাঁড়িতে অঢেল মাছ, অঢেল নারকোল গাছ, বনে ভোজ্য পাতা ও কন্দ অঢেল থাকায়, এবং চাষের প্রয়োজনে জমির ব্যবহার না থাকার কারণে, বিবাদ বিসম্বাদ প্রায় ঘটতই না। সেভাবে কোনো সংগঠিত ধর্মও ছিল না ওদের। কিছু কিছু আদিম ভীতি এবং লোকবিশ্বাস ছিল। যেমন, ওরা মনে করত পিতৃপুরুষেরা মৃত্যুর পর উইপোকা হয়ে যায়। সেজন্য পিঁপড়ের ডিম ও কিছু কিছু পোকার লার্ভা ওদের খাদ্যতালিকায় থাকলেও উইপোকাদের রক্ষণাবেক্ষণ করত। এমনকি মাটি আর নারকোল পাতা দিয়ে বানানো ওদের শঙ্কুর আকারের ঘরগুলোয় ছেয়ে থাকত উইয়ের বাসা। এভাবেই পূর্বপুরুষদের নিবিড় সান্নিধ্যে সহাবস্থান করত ওরা।

এবং এভাবেই রয়ে গিয়েছিল শত শত বছর। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্র আন্দামানের আদিবাসী নাগরিকদের জন্য কিছু কিছু জনহিতকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে কমবেশি সাড়াও দিয়েছে কয়েকটি জনজাতি। কোনো কোনো গোষ্ঠী এমনকি পোর্ট ব্লেয়ার ও অন্যান্য শহরে মূলস্রোতে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে কেউ কেউ। এই দ্বীপের জনগোষ্ঠীকে অবশ্য বশে আনা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা হয়, কিন্তু সাড়া মেলেনি। চিনি, সুতির কাপড়, পলিথিনের শিট ইত্যাদি উপঢৌকন হিসেবে রেখে আসা হয়, কিন্তু সেসব পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় ওরা। এরই মধ্যে একবার এক বেপরোয়া মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ গোপনে একটি নৌকা নিয়ে দ্বীপে চলে আসেন গবেষণার উদ্দেশ্যে। তিনি আর ফিরতে পারেননি। খবরটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে এবং এব্যাপারে কূটনৈতিক স্তরে চাপ তৈরি হলে ভারতের উপকূল রক্ষীবাহিনির বিশাল একটি দল প্রায় দশদিন পরে দ্বীপে গিয়ে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে। দেহটি বেলাভূমিতে নারকোল গাছের গায়ে বাঁধা ছিল। কড়া রোদে এবং নোনা হাওয়ায় শুকিয়ে গিয়েছিল, এবং সম্ভবত এক বিশেষ ধরণের গুল্মের রস মাখানো থাকার জন্য পশুপাখিতে কোনো ক্ষতি করেনি। প্রায় অবিকৃতই ছিল।

রবার ও সিলিকনে তৈরি চীনা পুতুল, একদা যার নাম ছিল হেলেন, যখন অর্ধেক পৃথিবী ভেসে দ্বীপের খাঁড়িতে গিয়ে ঢুকল, ওরা তাকে তুলে নিয়ে এসেছিল। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জাহাজডুবির সামগ্রী ও অন্যান্য আবর্জনা ভেসে এসেছে দ্বীপে। ওরা কখনো সেগুলো অনুসন্ধিৎসার বশে কুড়িয়ে নিয়েছে, কখনো নেয়নি। ছেঁড়া জাল, প্লাস্টিকের বোতল ও জেরিক্যান ছাড়া আর প্রায় কোনো কিছুই ওরা কাজে লাগায়নি। কিন্তু এবার এক দুর্জ্ঞেয় কারণে হেলেনকে নিয়ে এসে ওরা তুলল বসতিতে। শুধু তাই নয়, নারকোলপাতা মাটি আর কাঠ দিয়ে ওর জন্য একটি ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিলে কৌম উঠোনের এক কোণে। দিনের পর দিন সাগরের নোনা জলে ভেসে ভেসে হেলেনের সব চুল খসে গিয়েছিল, দেহের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত স্তন এবং যোনিদেশে, ইন্ডিয়া রাবারের অংশগুলো কোনও বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিকট স্ফীত ও বিকৃত হয়ে এসেছিল, এছাড়া জলপাই তেলের মতো চামড়ার রঙ সম্পূর্ণ উঠে বেরিয়ে পড়েছিল সিলিকনের দগদগে সবুজ। ওরা লতাপাতার রস দিয়ে ওদের বিশিষ্ট উল্কি আঁকল, নাক ও কান বিঁধিয়ে দিল, সাজিয়ে দিল মাছের কাঁটার গয়নায়।

এভাবেই শুরু হল। যেভাবে শুরু হয়।

পর পর ঠিক কী কী ঘটেছিল সেসব অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো যাবেও না কোনোদিন, কারণ এই জনজাতির কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবে হেলেনকে কেন্দ্র করে কোনো বিবাদ, হিংসা কিংবা হানাহানির সূত্রপাত ঘটেছিল বলে কোনো প্রমাণ নেই। কিংবা, সাধারণত যেমন ঘটে থাকে, নতুন কোনো ক্ষমতার বিন্যাস গড়ে ওঠেনি। পরিবেশের ওপরেও কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে পুতুলটি উদ্ধার হবার পর ওদের মধ্যে, বিশেষ করে পুরুষ এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, এক অদ্ভুত ধরণের বিষণ্ণতার অসুখ দেখা দেয়। সবচেয়ে উদ্যমী আর কর্মঠরাও যেন জীবনীশক্তি হারায়। খাঁড়িতে মাছ ধরা, জঙ্গলে ঢুকে ফল কন্দ সংগ্রহের কাজে উৎসাহ হারায়। বনে এক ধরণের মাদক ছত্রাক খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। এমনকি নারকোলপাতা জড়ো করে কুঁড়ের চাল ছাইবার উদ্যমও হারায়। একটি গোটা ঋতুতে দ্বীপে কোনো নতুন শিশুর জন্ম হয় না। এবং আরও কিছু কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। মরা মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী ভেসে এসে উপকূল ছেয়ে যায়, সমুদ্রে ভাসে কালো তেল, নারকোল গাছে অদৃশ্য কীটাণুর প্রকোপে অপুষ্ট ফলগুলো শুকিয়ে ঝরে যেতে থাকে। এই দ্বীপের ত্রিসীমানায় কোনো পণ্যবাহী জাহাজের পথ নেই, কিন্তু রাত্রিবেলা দিকচক্রবালে বিচিত্র আলোর আনাগোনা দেখা যায়। এইসব লক্ষণ গণনা করার পর গোষ্ঠী প্রবীণেরা বলেন, জ্বরে কাঁপছে মেদিনী। এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রথমে টের পায় উইপোকারা। উপকূলের লাগোয়া ভিটে ছেড়ে তারা সারি দিয়ে উঠে যেতে থাকে উঁচু জমিতে। তারপর একদিন, কার্ত্তিক পূর্ণিমার তিনদিন পর, দুপুরের পর থেকে সমুদ্র সরতে শুরু হয়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য : মনে হয় যেন মেদিনীর সরা থেকে সব জল এক চুমুকে পান করছে এক দৈত্য। বিস্তীর্ণ তটভূমি উন্মোচিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে আগ্নেয় শিলার ভাস্কর্য, চাটান, গুহা, ধাপকাটা সিঁড়ি, পাথর কুঁদে তোলা দৈত্যাকার পাখি ও বিচিত্র সব প্রাণীর রিলিফ।

দ্বীপবাসীরা অবশ্য সেসব খুঁটিয়ে দেখার জন্য বেলাভূমিতে অপেক্ষা করেনি। তারা উইপোকাদের পথ ধরেছিল। এবং যথারীতি সূর্যটা ডুবে যাবার আগেই ধেয়ে এল বিপুল জলরাশি, নারকোল বীথির মাথায় মাথায়, ওদের বসতিগুলি ভাসিয়ে নিল।

শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল তিন প্রজন্ম আগে। সেবারও তটভূমি উন্মোচিত হয়ে দেখা দিয়েছিল এই আশ্চর্য পাথরের দেশ, বহুবর্ণ প্রবালে ছাওয়া। আগুনের ধারে বসে সেই স্মৃতিকথা শুনে বড়ো হয়েছে এরা। তারও অনেক কাল আগে ওই আগ্নেয় শিলার দেশে, ওইসব গুহা আর চাটানে বাস করত ওদের পূর্বপুরুষ। সেই কাহিনি এতবার বলা ও শোনার ভেতর দিয়ে কল্পনায় এমন সুস্পষ্ট খোদাই হয়েছিল যে মেদিনীর জ্বর সেরে যাবার পর সমুদ্র যখন ফিরে গেল নীচু এলাকা থেকে, জলের নীচে ঠিক কোথায় ওই শিলাপ্রবালের দেশ রয়েছে সেটা নিখুঁত নিরূপণ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ওই ডুবে-যাওয়া অঞ্চলটা উপকূল থেকে বাইশ দমের পথ, আট দম গভীর।

এমনিতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে দ্বীপের সকলেই হাঁটতে শুরু করার পরেপরেই সমুদ্রে সাঁতার দিতে শিখে যেত। তিন, চার এমনকি পাঁচ দম গভীরে সাঁতার দিতে পারার ক্ষমতা অনেকেরই ছিল। সাত, আট কিংবা তার বেশি দম নীচে যেতে পারত যারা, তাদের মধ্যে থেকেই কুলপতি নির্বাচন হতো। স্বাভাবিকভাবেই কুলপতির ওপরে ভার পড়ল হেলেনকে জলের নীচে শিলাপ্রবালের দেশে রেখে আসার। তার আগে ওর নাক ও কান থেকে খুলে নেওয়া হলো মাকড়ি, গা থেকে খোলা হলো মাছের কাঁটার অলংকার। এরপর সবজে সিলিকনের গা থেকে ঘসে ঘসে সব উল্কি তুলে ফেলল ওরা। দেহের প্রতিটি ছিদ্রপথে ভরে দিল ডুমুরের বীজ। তারপর সারাদেহ ছাই আর পাতায় মুড়ে ভেলায় চাপিয়ে নিয়ে গেল বাইশ দম, ঠিক যেখানে ঢেউয়ের মাঝে একটি সুস্থির ঘোল চিহ্নিত করেছে শিলাপ্রবালের দেশ। এরপর কুলপতি পাতায় মোড়া পুতুলটিকে পিঠে বেঁধে নিয়ে ডুব দিল।

আর উঠে আসেনি।

জলের নীচে প্রবালগুহায় ছিল অসংখ্য গোলকধাঁধার ফাঁদ, স্বতঃপ্রভ মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের দেশ। সেখানেই ভোররাতের স্বপ্ন, শিশুর দেয়ালা আর না-পাওয়া পুরুষ কিংবা নারীর জন্য গলার কাছে চিনচিনে ব্যথাগুলো সব থরে থরে জমা হয়ে থাকে। বর্ষার রাতে নারকোল ছাউনির ভেতর আগুনের ধারে বসে সেই গোলকধাঁধার গল্প বোনে গোষ্ঠীপ্রবীণারা। হয়তো সেই কাহিনির বুননের ভেতর কোনো একটি বাঁকে রয়ে গিয়েছিল কুলপতি। আর ফিরে আসেনি।

নাহুমের গ্রাম ও অন্যান্য মিউজিয়াম
অবভাস



লোকি ও বুড়োবাবার গল্প

 আমার মতো যারা মার্ভেলের নতুন সিরিজ 'লোকি' দেখে মুগ্ধ, তাঁরা অনেকে জানেন না ১৯৫২ সালে স্ট্যান লি লোকিকে এনেছিলেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। সেই লোকি তখন ভিলেন হয়েও ভুলভাল বকত, মাথায় ছিটও ছিল কম নয়। মাঝেমধ্যেই দরকারি কথা ভুলে যেত। মিস্ট্রি ৮৫ কমিক্স-এ তো লোকির সংলাপ শুনে বিষম লাগে। থর-এর শক্তির কথাও ব্যাটাচ্ছেলে বেমালুম ভুলে গেছে। বলছে, ""Oh...I forgot - the hammer's greatest power - whenever Thor throws it, it returns to him!"

কে জানত, এমসিইউতে সেই লোকিই এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু সম্প্রতি মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট জানিয়েছে, লোকির চরিত্রে টম হিডলসনকে দেখে বুড়োবাবা স্ট্যানলি চোখ মটকে বলেছিলেন, 'এ ছেলে বহুত দূর যাবে! লোকিকে তোমরা শুধু ভিলেন করে রেখে দিও না হে! এ ব্যাটা থরকেও ছাড়িয়ে যাবে।" বুড়োবাবার কথা সচরাচর ভুল হয় না, এবারও হয়নি।
মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট আর স্ট্যানলিকে চমৎকার কয়েকটা বই আছে। Excelsior! The Amazing Life of Stan Lee বলে যে অটোবায়োগ্রাফিটা আছে, সেটা পড়া হয়নি কিন্তু মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট-এর অবিশ্বাস্য সাফল্য নিয়ে লেখা এই বইটা আমার বেশ লেগেছে। শর্ট রিড কিন্তু ইনফরমেটিভ। যে কমিক্স কোম্পানি প্রায় ডুবতে বসেছিল, সেটা কিনা সারা বিশ্বের এক নম্বর মিডিয়া ব্র্যান্ড হয়ে বসল। কী হল আচমকা? আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন সিনেমা? উঁহু! সিনেমায় তো মার্ভেলের চরিত্ররা কবে থেকেই আছে, তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। সময় পেলে আর পাঁড় মার্ভেল ফ্যান হলে 'মার্ভেল স্টুডিওস স্টোরি' বইটা পড়ে ফেলতে পারেন। খুব সস্তায় পাওয়া যায় বইটা। নাহলে স্ট্যান লিকে নিয়ে এই লেখাটাতে চোখ বুলোতে পারেন। কিছুটা ইনফো পেয়ে যাবেন। জয়ঢাকের জন্য লিখেছিলাম বছরতিনেক আগে। দীর্ঘ লেখা, ধৈর্য না থাকলে বরং প্রথম কমেন্টে থেকে লিংকটা নিয়ে পড়বেন। ছবিসহ পড়তে পারবেন।
‘আমরা সবাই সুপারহিরো’-স্ট্যান ‘এক্সেলসিওর' লি
স্কুলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে কুড়ি পেয়েছে ভুটু। ইংরেজিতে সাতাশ। ক্লাসে স্যার যাচ্ছেতাই কথা শুনিয়েছেন তাকে। বাড়িতে এসে আরেকপ্রস্থ ধমক ধামক। বাবার হাতে চড় চাপড়ও খেতে হয়েছে। মা তাকে বকতে বকতে নিজেই কেঁদে ফেলেছে। সে যে ড্রয়িং এ একানব্বই পেয়েছে সেটার কথা কেউ বলছেও না। ক্লাসের বন্ধুগুলোও এত বাজে, কথায় কথায় তার মাথায় চাঁটি মারে। ভুটুর ভালো নাম যে অতীশ, সেটা জানলেও সারাক্ষণ ‘ভুটু সর্দার’ বলে তার পিছনে লাগে। কি করে জানি বাড়ির ডাকনামটা জেনে গিয়েছিল তার বন্ধু সন্তু। তখন থেকেই। ভুটুর মন একেবারেই ভালো নেই। মনের দুঃখে ছাদের অন্ধকারে এসে বসে ছিল সে। এই রকম করে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। এমন সময় আলোর একটা উজ্জল রেখা এসে ছাদটা আলোকিত করে দিল। ভুটু অবাক হয়ে দেখল আলোর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে খয়েরি কোট আর কালো চশমা পরা একজন মানুষ। তার মুখে চওড়া হাসি। নাকের নীচে মস্ত গোঁফ। ভুটুর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন, “এই তো। পেয়ে গেছি। “
ভুটু অবাক হয়ে জিগ্গেস করল, “কী পেয়ে গেছেন? আপনি কে? “
লোকটা বলল, “আমি স্ট্যান লি। আরে অন্য গ্রহ থেকে এলিয়েনরা এসে আক্রমণ করেছে। ওদের মোকাবিলা করতে গেছে আমার সুপারহিরোর দল। অ্যাভেঞ্জারদের দলে একটা ছেলে কম পড়ছে। তোমাকে পেয়ে গেছি। ব্যাস। আজ থেকে তোমার নাম ভুটুম্যান। “
ভুটু ক্যাবলার মত তাকিয়ে বলল, “আমি সুপারহিরো? আমার চোখে চশমা। গায়ে জোরও নেই। অঙ্কেও খুব খারাপ। আমার তো কোন সুপারপাওয়ারই নেই। আমি তো সকলের মতন সাধারণ। ” লোকটা মুচকি হেসে বলল, “তুমি খুব সাধারণ, সেই জন্যেই তো তুমি অসাধারণ। সাধারণ মানুষদের মধ্যেই আসল সুপারহিরোরা লুকিয়ে থাকে। আমার চেয়ে ভালো সেটা কেউ জানে না। চললুম। আজ থেকে তুমি সুপারহিরো। এক্সেলসিওর। “
ওপরের গল্পটা নিছক গল্পই। কিন্তু বাস্তবটা খুব একটা অন্যরকম নয়। ২০১৮ সালে সুপারহিরোদের নিয়ে যে বিশ্বজোড়া উন্মাদনা, তার অনেকটাই স্ট্যান লি তৈরি করেছেন সাধারণ মানুষের গল্প বলে।
১৯২২ সালে জ্যাক আর সেলিয়া লিবারের বাড়িতে জন্ম হয়ে স্ট্যান লির। ভালো নাম স্ট্যানলি মার্টিন লিবার। জ্যাক লিবারের তেমন কোন রোজগার ছিল না, মাঝে মাঝে দর্জির ছোটখাটো কাজ করে দিন চলত। ছেলেবেলা থেকেই অভাবের সংসার, ১৯২৯ সালে মন্দার পর পয়সার অভাবে ব্রঙ্কস অঞ্চলের তিনতলার একটা ছোট্ট ঘরে উঠে যেতে হয় লিবার পরিবারকে।
স্ট্যান আর তার ভাই ল্যারি ভাই তখন স্কুলে যেতে শুরু করেছে। পড়ালেখায় মেধাবী হলেও স্ট্যান প্রচন্ড মুখচোরা। ক্লাসের অন্য ছেলেরা যখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে হুল্লোড় করে ছোট্ট স্ট্যান পাল্প ফিকশনের সস্তা ম্যাগাজিনে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে। সেই সময়ে এরোল ফ্লিন বলে একজন অভিনেতা পর পর অ্যাডভেঞ্চার সিনেমাতে কাজ করে নাম করেছেন, স্ট্যান তার অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়লো। তিনতলার ছোট্ট ঘরের জানলা থেকে বাইরে কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু স্ট্যানের কল্পনার জগৎ তখন বহুদূরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে বইয়ের নেশা এমন করে পেয়ে বসেছে যে স্কুলের পড়া হুড়মুড় করে শেষ করে সে একটা না একটা বই নিয়ে বসে পড়ে। পড়তে পড়তে নানা বিষয়ে তার জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দুইই বেড়েছে, মাত্র দশ বাঁচার বয়সে স্ট্যান কোনান ডয়েল আর মার্ক টোয়েনের পাশাপাশি শেক্সপিয়ার পড়তে শুরু করে দেয়।
পনেরো বছর বয়সে নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন সংবাদ পত্রিকা হাই স্কুল ছাত্রদের জন্যে একটা রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সপ্তাহের সবচেয়ে বড় খবর নিয়ে লিখতে হবে ছাত্রদের। আসল উদ্দেশ্য অবশ্য লেখার গুণ পরখ করা। আকর্ষণীয় ভাবে লিখতে পারলে ছোট্ট একটা ঘটনাও সবচেয়ে বড় খবর হয়ে যেতে পারে সংবাদপত্রের দুনিয়ায়। কিশোর স্ট্যানের হালকা লেখালিখির অভ্যেস আগেই ছিল। সে এই প্রতিযোগিতায় লেখা পাঠায় এবং পর পর তিন বার প্রথম পুরস্কার পেয়ে যায়। নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউনেইর সম্পাদক স্ট্যানের উচ্ছসিত প্রশংসা করেন এবং তাকে আরো নিয়মিত ভাবে লেখালিখি করতে বলেন।
কিশোর স্ট্যানের মনে সেই সময়ে লেখালিখি নিয়ে যেই আগ্রহ জন্মায়, সেই আগ্রহই তাকে পরবর্তী সত্তর বছর ধরে লিখিয়ে চলেছে। সেই সময়ে স্ট্যানের ইচ্ছে ছিল সে একদিন এক আমেরিকান ক্লাসিক লিখে লোকদের তাকে লাগিয়ে দেবে, কিন্তু নিয়তির বিধানে তাকে নিয়ে অন্য পরিকল্পনা করা ছিল।
সতেরো বছর বয়সে হাইস্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই স্ট্যান খুচরো লেখালিখির কাজে হাত পাকাতে থাকে। কোথাও সমাধিফলক লিখছে, কোথাও বিজ্ঞাপনের খসড়া লিখছে। এরই মাঝে এক পরিচিতের কথায় সে মার্টিন গুডম্যানের টাইমলি পাবলিশিং কোম্পানিতে অফিস ‘গোফার’ হিসেবে যোগ দেয়। গোফারদের আসল কাজ ছিল খুচরো লেখালিখি, পত্রিকার নিয়মিত লেখকেরা ব্যস্ত থাকায় নতুন ছেলেদের টুকিটাকি লিখতে গোফার হিসেবে নেওয়া হত। কাজ না থাকলে তার কালির দোয়াতে কালী ভর্তি করত, লেখক আর সম্পাদকদের কফি দিত, বলা ভালো লেখা ছাড়া আর সব কাজই করত। মার্টিন গুডম্যান তখন কয়েকটি পাল্প ফিকশন পত্রিকা চালিয়ে নাম করেছেন। সস্তা কিন্তু ক্রাইম আর নায়ক-নায়িকা-গুন্ডাদের নিয়ে চালানো এই পত্রিকাগুলো নিউইয়র্কে বহু লোকে পড়ত সে কালে। মার্টিন গুডম্যান তার পাশাপাশি কমিক্সের একটি বিভাগ আরম্ভ করে দিলেন তার টাইমলি পাবলিশিং পত্রিকায়।
স্ট্যান লির হাতে তেমন কোন কাজ নেই। তার কমিক্সে লেখার তেমন আগ্রহ নেই, খালি সময় বাঁশি বাজায় আর লোকজনদের ব্যবহার দেখে তার ভবিষ্যতের ক্লাসিক উপন্যাসের চরিত্র গঠন করে। লেখক হতে গেলে যে দেখার চোখ চাই, এই মন্ত্র মাথায় রেখে সে শ্যেন দৃষ্টিতে পাবলিশিং এর কাজকর্ম বোঝার চেষ্টা শুরু করে দিল। কি কাজ হচ্ছে, কোন কাজটা পাঠকে পছন্দ করছে, কোনটা সম্পাদক ছাপতে চাইছেন না, সব তার ক্ষুরধার স্মৃতিতে আঁকা হয়ে যেতে লাগল।
এমন সময় কার্টুনিস্ট জো সাইমন আর জ্যাক কিরবি ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’ বলে একটা চরিত্র তৈরি করে ফেললেন কমিক্স বিভাগের জন্যে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনা করা হলো এই সুপারহিরোর। কিন্তু প্রথম দুটো সংখ্যা লেখার পরেই কিরবি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কমিক্সের তেমন চাহিদা নেই, নতুন চরিত্র এনে হাজির করতেই অনেক সময় যায়, তারপর তাকে নিয়ে ক্রমাগত একের পর এক গল্প লিখতে গেলে অন্য কাজে মন দেওয়া চলে না। ছবির সঙ্গে আগে থেকে ঠিক করা গল্পের সংলাপ লিখে দিতে ডাক পড়লো স্ট্যান লির। কাজটা সে করলো বটে কিন্তু তাতে তার মন ভরলো না। তাকে লেখক হতে হবে, এইসব ছুটকো কমিক্স লিখলে পরবর্তী কালে সম্পাদকরা তাকে পাত্তা নাও দিতে পারে! তার ওপর গল্পটা তার মনঃপুত হয়নি। বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব আছে। কিন্তু তার আর করার কি আছে? সপ্তাহে আট ডলার করে পাচ্ছে, হুকুম মত কাজ করতে হবে।
ক্যাপ্টেন আমেরিকা অবশ্য স্ট্যান লিকে নিষ্কৃতি দেয়নি। একচল্লিশ সালেই সাইমন আর কিরবি দুজনেই ইস্তফা দিলেন মার্টিন গুডম্যানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়। মার্টিন গুডম্যান নতুন লোক না নিয়ে উনিশ বছরের স্ট্যান লিকে সোজা কমিক্স বিভাগের সম্পাদকের পদে আসীন করে দিলেন। কিশোর ছেলেটার গল্প আর চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার ইচ্ছেটা তাকে প্রভাবিত করেছিল।
প্রায় একবছর ধরে স্ট্যান ক্রমাগত ক্যাপ্টেন আমেরিকার গল্প লিখে চলে। সঙ্গে সৃষ্টি হয় ডেস্ট্রয়ারের মত চরিত্র। কিন্তু লেখার চেয়ে ব্যাবসার বাড়ন্তের দিকেই বেশি নজর ছিল স্ট্যানের। মার্টিন সাহেবের সুনজরে পড়ে তার মাইনে বেড়েছে ঠিকই কিন্তু কমিক্স লিখতে সে চায় না। ইতিমধ্যে আসল নাম ব্যবহার না করে সে শুধু ‘স্ট্যান লি’ নামটা ব্যবহার করেছে কমিক্সের লেখক হিসেবে যাতে বই লিখলে কমিক্স লেখকের সাথে একজন ভবিষ্যতের ক্লাসিক লেখককে পাঠকেরা গুলিয়ে না ফেলে।
১৯৪২ সালে আমেরিকা পুরোপুরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেমে পড়ে। ইচ্ছে না থাকলেও স্ট্যান লিকে মার্কিন সেনায় যোগ দিতে হয়। প্রথমে সিগন্যাল কর্পসে টেলিগ্রাফ পোল মেরামতির কাজ, তারপর ট্রেনিং ফিল্ম ডিভিশনে গিয়ে ম্যানুয়াল, স্লোগান প্রভৃতি লেখার পাশাপাশি স্ট্যান লি চিঠির মাধ্যমে ক্রমাগত লিখে যেতে থাকে টাইমলি কমিক্সের নানা সিরিজে। যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার ছায়া এসে পড়ে ক্যাপ্টেন আমেরিকার নানা গল্পের মধ্যে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হতে স্ট্যান লি ফিরে এসে আবার লেখালিখি শুরু করে। কিন্তু এই কয়েক বছরে কমিক্সের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে ন্যাশনাল কমিক্স পাবলিকেশন। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, হকম্যান, ওয়ান্ডারওম্যান একের পর এক সুপারহিরো এসে পাঠকদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। হইহই করে কমিক্স বিক্রি হচ্ছে তাদের, তুলনায় টাইমলি কমিক্সে নতুন চরিত্র যোগ হয়নি বললেই চলে। যুদ্ধের বাজারে ব্যাবসা বাঁচাতে বহু টাকা খসাতে হয়েছে ইহুদি মার্টিন কোলম্যানকে।
পঞ্চাশের দশকে কোম্পানির নাম পাল্টে অ্যাটলাস কমিক্স করে দেন গোল্ডম্যান। ততদিনে স্ট্যান বিয়ে করেছেন জোয়ান কোলম্যানকে, এক ছেলে এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। পরিবারের দায়িত্ব নির্বাহ করতে স্ট্যান লি মার্টিন সাহেবের কথা মত একের পর এক কমিক স্ট্রিপ লিখছেন, কিন্তু কিছুতেই তার তৃপ্তি হচ্ছে না। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কমিক্স কোড অথোরিটি বসানো হয়েছে, গতানুগতিক ছেলেমানুষি লেখার বাইরে কমিক্সে কিছু বাস্তববাদী কথা বলতে গেলেই সি সি এর তরফ থেকে চিঠি চলে আসে। স্ট্যানের মন খারাপ, কমিক্সের জগৎ ছেড়ে অন্য কাজ করবেন, বই লেখাতে মনোনিবেশ করবেন, এই সব ভাবছেন, ইতিমধ্যে একটা ছোট ঘটনা ঘটে যাওয়াযা তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল আবার।
ন্যাশনাল কমিক্স ততদিনে নিজেকে ডিসি কমিক্স বলতে শুরু করেছে। সুপারহিরো ‘ফ্ল্যাশ’ এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তারা সব সুপারহিরোদের নিয়ে ‘জাস্টিস লিগ অফ আমেরিকা’ বলে একটা কমিক্স প্রকাশিত করে বসল। আমেরিকার লোক তখন সদ্য টেলিভিশনের স্বাদ পেয়েছে, কমিক্সে তাদের রুচি কমে এসেছিলো কিন্তু জাস্টিস লিগ গরম কচুরির মতন বিক্রি হতে শুরু করলো মার্টিন কোলম্যান স্ট্যান কে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ডিসির সমকক্ষ হওয়ার জন্যে নতুন চরিত্র, নতুন লেখার দরকার। স্ট্যানকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে লেখার ব্যাপারে।
স্ট্যান স্ত্রীর পরামর্শে নতুন উৎসাহে কাজ শুরু করলেন। কমিক্স বলেই ফ্যালনা নয়, একটা কমিক্সও ক্লাসিক হয়ে যেতে পারে লেখার গুণে। এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে স্ট্যান লির মাথায় নতুন গল্প, নতুন চরিত্ররা ভিড় করতে শুরু করলো। ততদিনে জ্যাক কিরবি ফিরে এসেছেন পুরোনো কোম্পানিতে। দুজনের একনিষ্ঠ চেষ্টায় তৈরি হলো ফ্যান্টাস্টিক ফোর। বাজারে ছাড়তেই ফ্যান্টাস্টিক ফোর মন জয় করে নিল পাঠকদের। স্ট্যান লি দ্বিগুণ উৎসাহে নতুন চরিত্রদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন। ডিসির হিরোদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা তার নায়কেরা, সাধারণ মানুষ যারা বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে হিরো হয়ে উঠছেন। হাল্ক, থর, ডেয়ারডেভিল, এক্স মেন, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ একের পর এক নায়ক আসছে স্ট্যান লি আর কিরবির হাত ধরে আর পাঠকের মন জয় করে নিচ্ছেন।
তখন আমেরিকার সঙ্গে শীত যুদ্ধ চলছে সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর। পুঁজিবাদ বনাম সাম্যবাদের আলোচনায় বাজার গরম হয়ে উঠেছে। এমন সময় স্ট্যান লি কলম থেকে উদয় হল আইরন ম্যান। বিশাল বড়লোক, ব্যবসাদার, অহঙ্কারী অথচ একটা দুর্ঘটনায় সে হয়ে উঠল সুপারহিরো। বাস্তবের সঙ্গে কতটা পরিচিতি থাকলে এইরকম একটা চরিত্রের সৃষ্টি আর পরবর্তী কয়েক দশক ধরে তাকে নিয়ে লেখা সম্ভব হয়ে, যে না পড়েছে তাকে বলে বোঝানো কঠিন। কিন্তু স্ট্যান লির তুরুপের তাস হয়েছিল অন্য এক হিরো।
একদিন স্ট্যান লি এসে মার্টিন কোলম্যানকে বললেন যে আমেরিকান এক কিশোরকে নিয়ে তিনি নতুন এক সুপারহিরো সিরিজ শুরু করতে চান। স্কুল আর বাড়ি, কিশোর ছেলের বন্ধু বান্ধব, হতাশা, সাফল্য আর নিয়তির সামনে বার বার হেরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। গল্পের প্লট শুনে মার্টিন কোলম্যান সোজা না করে দিলেন। এরকম উদ্ভট সৃষ্টি ভিলেনদের জন্যে, হিরোদের জন্যে না। লোকে পড়বে তো নাই, এতো কষ্টে অন্য চরিত্রগুলো দাঁড় করানো হয়েছে সেগুলোও হোঁচট খেয়ে পড়বে। কিন্তু স্ট্যান নাছোড়বান্দা। বিপক্ষের বহু আলোচনা সত্ত্বেও নিজের দায়িত্বে প্রকাশিত হলো সেই গল্প আর স্ট্যান লি আর মার্ভেলের সঙ্গে কমিক্স দুনিয়ার প্রিয়তম চরিত্র হয়ে উঠল পিটার পার্কার ওরফে স্পাইডারম্যান।
মাকড়শার কামড়ের এমন সাইড ইফেক্ট কোলম্যান স্বপ্নেও ভাবেননি। স্ট্যান্ডে আসার আগেই স্পাইডারম্যানের সব কপি শেষ হয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন থেকে ফোন করছে লোকজন এনিমেশন তৈরি করার জন্যে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের ব্যাগে স্পাইডারম্যানের কমিক বুক। মাকড়সা দেখলে লোকে ঘেন্নায় রি রি করে উঠত, এবার দেখা যেতে লাগলো পকেটে করে মাকড়সা নিয়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। কী কান্ড! ওইদিকে ডিসি কমিক্সও নড়েচড়ে বসেছে। একটা স্কুলের বেঁটেখাটো চশমা পরা ছেলে কী করে অন্য গ্রহ থেকে আসা দৈবী শক্তিধারী সুপারম্যান আর অন্যান্য নায়ককে টেক্কা দিচ্ছে বিক্রিতে, সেটা তারা অনেক ভেবেও বুঝতে পারল না।
স্ট্যানকে আর পিছনে ঘুরে তাকাতে হয়নি। বাস্তবকে কলমে তুলে ধরতে কোনদিন ভয় পায়নি সে। অ্যাভেঞ্জার্স সুপারহিরো টিম, ব্ল্যাক ইউডো, ব্ল্যাক প্যান্থার একের পর এক ব্যতিক্রমী চরিত্রে মন জয় করে নিয়েছে তার কলম। নতুন ছেলেমেয়েদের নতুন ভাবনাকে সম্মান দিয়ে চরিত্ররা পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিয়েছে কমিকসের জগতে। সত্তরের দশকে বাস্তববাদী লেখাকে সম্মান দিতে কমিক্স কোড অথরিটিকে অনুরোধ করেন স্ট্যান। তার কথা মেনে নিয়ে কমিক্স কোডের পরিবর্তন করা হয় আধুনিক সাহিত্যের প্রেক্ষিতে।
এর পর প্রায় নব্বই সাল অব্দি অনবরত লিখে গেছেন স্ট্যান লি। পঞ্চাশের দশকের অ্যাটলাস কমিক্স তখন মার্ভেল কমিক্স নাম বিখ্যাত। কমিক্স লেখা কবে সে সাহিত্যের মূলধারায় ঢুকে গেছে তার হাত ধরে তার নিজেই জানা নেই।
নব্বই সালের পর থেকে কমিক্সের বিক্রি অনেকটাই কমে আসে। নতুন প্রযুক্তি, টেলিভিশন, ভিডিও গেমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ধুঁকতে থাকে কমিক্স জগৎ। মুনাফা বাড়াতে টেলিভিশনে মার্ভেলের চরিত্রগুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু ‘হাল্ক’ ছাড়া কোন ধারাবাহিকই জনপ্রিয় হয়নি। স্ট্যান লি তখন যদিও অবসর নিয়েছেন মার্ভেল থেকে, কিন্তু কোম্পানিতে তার যথেষ্ট প্রভাব আছে। রোনাল্ড পেরালমেন ১৯৯৬ সালে মার্ভেলকে দেউলিয়া প্রচার করে বিক্রি করে দেন টয় বিজ গ্রূপকে। স্ট্যান লিকে ফোন করে রোনাল্ড পেরালমেন আর কোম্পানির নতুন মালিক আভি আরিদ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার মনোভাব জানতে চাইলে স্ট্যান বলেন, “শুধু এইটুকু মনে রেখো যে কোন সময় যে কোন মানুষ সুপারহিরো হয়ে উঠতে পারে। যারা নতুন, যারা এখনো কিছু প্রমাণ করে উঠতে পারেনি, তাদের কথা শুনো। তাদের সুযোগ দিও। নতুন প্রযুক্তি আসছে। সময় ঘুরবে। “
পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যে যে সময় এতটা ঘুরে যাবে সেটা অবশ্য স্ট্যান নিজেও ভাবেননি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নানা জাজ নিয়ে। শিশুদের নিয়ে সমাজ সংস্কারের নানা দায়িত্ব, নানা জায়গায় লেখালিখি, সারা বিশ্বজুড়ে ‘কমিক কন’ ফেস্টিভ্যালে কমিক্সের শিল্পী ও পাঠকদের মনোযোগী ও উৎসাহী করে তুলতে সময় কেটে যাচ্ছিলো। এই কয়েক বছরে তিনি কমিক্স দুনিয়ার ঈশ্বরের জায়গা নিয়েছেন। তার চিত্তাকর্ষক কথা শুনতে বহু লোকে আগ্রহী, তার অনলস ও সদাহাস্যময় ব্যক্তিত্বের সামনে এলেই সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ‘এক্সেলসিওর’; স্ট্যান লির এই স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সারা দুনিয়ায়।
ইতিমধ্যে মার্ভেলের ‘স্পাইডারম্যান’ আর ‘ব্লেড’ সাড়া ফেলেছে হলিউডের সিনেমায় , কিন্তু তাতে আর্থিক ভাবে কোম্পানির কোন লাভই হয়নি। স্পাইডারম্যানের দুটো সিনেমা প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, কিন্তু মার্ভেল এন্টারপ্রাইজ মাত্র সাতষট্টি মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এমন সময় নতুন এক ছেলে এসে আভি আরিদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আভি আরিদ সম্মতি দেয়। মাইসেলের বয়স বেশি নয়, অভিজ্ঞতাও নেই তেমন কিন্তু স্ট্যান লির কথাগুলো আরিদের মাথায় থেকে গেছে। যে কোন সাধারণ মানুষ সুযোগ পেলে সুপারহিরো হয়ে যেতে পারে।
মাইসেলের পরামর্শ ছিল এক লাইনের।
“সিনেমাগুলো নিজেরাই প্রযোজনা করুক মার্ভেল।"
পরামর্শটা স্বীকার করে কাজে লাগিয়ে ছিল আরিদ। প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে মার্ভেল ২০০৮ সালে যখন ‘আইরন ম্যান’ প্রয়োজনা করে, তারা বুঝতে পেরেছিল এটাই তাদের শেষ সুযোগ। আধুনিকতম প্রযুক্তির ব্যবহার করতে প্রায় সব টাকা ঢেলে দেওয়া হয়েছে যাতে কোন খুঁত না থাকে। রবার্ট ডাউনি জুনিয়ারকে নেওয়ার ঝুঁকি আরও মারাত্মক, ড্রাগ নিয়ে বার ছয়েক জেলে গেছে নব্বইয়ের দশকে। কয়েকটা ছোটমোট চরিত্র ছাড়া কোথাও সুযোগ পায়নি। তাকে সুপারহিরো চরিত্রে নেওয়ার ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু স্ট্যান লির কথা মনে গেঁথে ছিল মার্ভেলের সকলের মনে। যারা এখনো কিছু প্রমাণ করে উঠতে পারেনি, তাদের সুযোগ দিও। যে কোন সাধারণ মানুষ সুযোগ পেলে সুপারহিরো হয়ে যেতে পারে।
আয়রন ম্যান মুক্তি পেতেই যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে দেয়। রবার্ট ডাউনি জুনিয়ার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যান এক সপ্তাহের মধ্যে। এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। একের পর এক সুপারহিরো সিনেমা বানিয়ে মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্ট জনপ্রিয়তার শিখরে চলে গেছে। আঠারোটা ছবিতে প্রায় পনেরো বিলিয়ন ডলার আয় করেছে তারা। বিশ্ব জুড়ে তুমুল উন্মাদনা প্রতিটি সিনেমা নিয়ে, পাশাপাশি কমিক্স আর মেমোরিবিলিয়া বিক্রি হচ্ছে হইহই করে। ক্যাপ্টেন আমেরিকা থেকে ব্ল্যাক প্যান্থার, স্পাইডারম্যান থেকে ক্যাপ্টেন মার্ভেল, অ্যান্ট ম্যান থেকে অ্যাভেঞ্জার প্রতিটাই সাধারণ মানুষের অসাধারন হয়ে ওঠার কাহিনী। এর প্রতিটাতেই স্বভাবসুলভ হাস্যময়তা নিয়ে বৃদ্ধ স্ট্যান লি অভিনয় করে গেছেন ক্যামিও রোলে।
স্ট্যান লি গত সত্তর বছরে সাধারণ মানুষকে যেরকম করে সুপারহিরো হতে শিখিয়েছেন, সেটাই আসলে একটা ক্লাসিক উপন্যাসের সামিল। পঁচানব্বই বছর বয়সে মৃত্যুকে সামনে দেখেও এই চিরকিশোর নির্দ্বিধায় বলে উঠতে পারেন, “এক্সেলসিওর। আমরা সবাই সুপারহিরো। ”
# লেখাটা সার্বিকভাবে একটা আইডিয়া পাওয়ার জন্য মাত্র। খুঁটিনাটি ভুল হওয়া অসম্ভব নয়



গাছের বই

রিচার্ড পাওয়ার্স মার্কিন সাহিত্য জগতে পরিচিত নাম। তাঁর একাধিক বই ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর খ্যাতিও আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি আগে তাঁর কোনও লেখাই পড়িনি। কত বইই তো পড়া হয় না। কী আর করা যাবে!

কিন্তু 'দ্য ওভারস্টোরি'-র কথা জানামাত্র ঠিক করেছিলাম এই বইটা পড়তেই হচ্ছে। তার কারণ আর কিছুই নয়, বইটার বিষয়বস্তু। পাওয়ার্স বইটা লিখেছেন গাছেদের নিয়ে। আরো ভালো করে বলতে গেলে দ্য ওভারস্টোরি নয়জন ব্যক্তির কাহিনি, যাদের জীবনে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। পাওয়ার্স এই বইয়ের মূল ধারণা নিয়েছেন ইকোলজিস্ট সুজান সিমার্ডের mycorrhizal networks নিয়ে করা গবেষণা থেকে। গাছেদের নিউরাল নেটওয়ার্ক বলা যায়! ('অবতার'-এর মাদার ট্রি- কথা মনে আছে নিশ্চয়ই!) সিমার্ড গবেষণা করে দেখেছেন উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের মধ্যেও একটা ইন্টারস্পিসিজ কোঅপারেশন আছে। এই বইতে সেই গবেষণাকে মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয়েছে এক কাল্পনিক কাহিনি যেখানে গাছেদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তাদের জীবনকে ভিন্ন ভিন্ন পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
২০১৮ সালে বুকার প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিল এই এনভায়রনমেন্ট ফিকশন। ২০১৯ সালে পুলিৎজর প্রাইজ ফর ফিকশন জিতে নেয়। তার আগে থেকেই বইটা পড়ব পড়ব করছি, হচ্ছে আর না! অবশেষে আজ হাতে পেলাম। এইবার আগেপরে ঠিক পড়া হয়ে যাবে।



কোরিয়ার সাহিত্য- জনপ্রিয় একটি বই

 কোরিয়ার সাহিত্যিকদের মধ্য চো নাম জু আজকাল তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর লেখা প্রথম দুটো বই বেশ সাড়া ফেলেছে, আর তিন নম্বর বই 'কিম জিয়োয়ুং বর্ন ১৯৮২' তো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে মুড়িমুড়কির মতো বিকোচ্ছে। জনপ্রিয়তা এলে সঙ্গে বিতর্কও আসবে, এই বইটা নিয়েও দুনিয়ারাজ্যের ক্রিটিকরা দু' ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। অনেকের মতে 'কিম জিয়োয়ুং বর্ন ১৯৮২' মডার্ন ফেমিনিন লিটারেচারের মাইলস্টোন, আবার অনেকে এটাকে উপন্যাস বলে মানতেও নারাজ। কোরিয়ার থ্রিলার নিয়ে আমরা যতই নাচানাচি করি না কেন, সেখানে আবার সামাজিক অসঙ্গতি আর স্যাটায়ার নিয়ে লেখাই জনপ্রিয় হয় বেশি। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে যে এই বইটা নিয়ে যে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মহৎ সাহিত্য হোক বা না হোক, লেখাটা আক্ষরিক অর্থেই কোরিয়ার আর্থ সামাজিক মহলে বদলের সূচনা করেছে। জেন্ডার ইকোয়ালিটির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় আইনও তৈরি হয়েছে এই বইটা প্রকাশ হওয়ার পর, কিন্তু সে কথা থাক। মোট কথা, বইটা ঠিক কেমন?


সত্যিই বলছি, আমি জানি না।

কিম জিয়োয়ুং বিবাহিত, তার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। চাকরি ছেড়ে আপাতত সে মেয়ের দেখাশুনা করছে। বর আইটিতে কাজ করে, টেনেটুনে চলে যাচ্ছে। এমন সময় একদিন কিম অবিকল তার মায়ের গলায় কথা বলতে শুরু করে। বর বিশেষ পাত্তা দেয়নি, কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই তার মধ্যে প্রাক্তন প্রেমিকার ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। এরকম কয়েকটা এপিসোডের পর কিমের বর ভয় পেয়ে তাকে থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যায়। বাকি বইটা আর কিছুই নয়, কিমের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের কথা।

মাত্র ১২০ পাতার একটা বই। তাতে গল্প বলতে একটা মেয়ের বড় হয়ে ওঠা ছাড়া প্রায় কিছুই নেই। যা আছে তা হল নিঁখুত ভাবে উপস্থাপিত কিছু সোশ্যাল প্র্যাক্টিসের কথা আর মেয়েদের ভোগান্তির বর্ণনা, যা পড়লে রাগে গা চিড়চিড় করে। তখন আর বইয়ের ভালো মন্দের কথা মনে থাকে না। আমি ফেমিনিজম লিটারেচার সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ, নারীবাদী মানসিকতা সম্পর্কে কিছুই বলা আমার মানায় না। ছেলে হয়ে জন্মেছি বলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বহু সংস্কার আমার মাথায় গেঁথে গেছে অজান্তেই। এই সাবলিমিনাল হিপোক্রেসি আমাদের প্রত্যকের একচেটিয়া, তাই ফেমিনিজম নিয়ে কথা না বলাই ভালো। কিন্তু যে কথাটা বইটায় ভালো লাগল, সেটা হল প্রতিটা স্টেটমেন্টই এসেছে যুক্তিনির্ভর হয়ে, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। পাশাপাশি হার্ড স্ট্যাটিস্টিক্স-এর পরিসংখ্যানও আছে। তাতে গল্পের লাভ হয়েছে না ক্ষতি বলতে পারব না, কিন্তু সেই জন্যই এই বইটা এত এত পাঠকের সঙ্গে কানেক্ট করতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস।

যখন তার বড় বোন কিম এনুয়োং জন্মাচ্ছে, তার ঠাকুমা তার মাকে কর্নার করছে না, কিন্তু তার আন্তরিক কথাবার্তার ধরন দেখে আমার মাথা গুবলেট হয়ে গেল।

When Kim Eunyoung was born, Oh Misook held the infant in her arms and wept. ‘I’m sorry, Mother,’ she’d said, hanging her head.

Koh Boonsoon said warmly to her daughter-in-law, ‘It’s okay. The second will be a boy.’

When Kim Jiyoung was born, Oh Misook held the infant in her arms and wept. ‘I’m sorry, little girl,’ she’d said, hanging her head.

Koh Boonsoon repeated warmly to her daughter-in-law, ‘It’s okay. The third will be a boy.’

'থার্ড' কে কিমের মা আগেই স্কিপ করতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু চার নম্বর অবশ্যই ছেলে ছিল। এর বহু বছর পর কিম যখন কন্যাসন্তানকে জন্ম দেয় তার মাও একই রকম ভাবে বলে, "It’s okay. The second will be a boy.’

ঋতুমতী হওয়ার পর যখন কিম ব্যাথায় কাতরাচ্ছে, লেখা আছে-

As Jiyoung lay on her stomach on the floor to do homework, she clutched her cramping lower abdomen and repeated to herself, ‘I don’t understand. Half the population in the world goes through this every month. If a pharmaceutical company were to develop an effective pill specifically for menstrual cramps, not the “pain medication” that makes you sick, they would make a fortune.’

Her sister filled a plastic bottle with hot water, wrapped it in a towel and passed it to her. ‘You’re right. In a world where doctors can cure cancer and do heart transplants, there isn’t a single pill to treat menstrual cramps.’ Her sister pointed at her own stomach. ‘The world wants our uterus to be drug-free. Like sacred grounds in a virgin forest.’

এরকম নানা জায়গায় নানা ছোটখাটো ঘটনা আছে, ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগই আমার কাছে আরোপিত বলে মনে হয়নি। কোরিয়ার সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়েও কিছু কথা জানা যায় মাঝে মধ্যে, যদিও মেয়েদের কথাই প্রধান। লেখিকা জানিয়েছেন বেশিরভাগ অভিজ্ঞতাই তাঁর নিজের জীবনের, সে নিয়েও প্রচুর জলঘোলা হয়েছে। বিয়ের একমাস পর কিম বাড়ি ফিরে দেখে তার বর বিয়ে রেজিস্টার করার আইনি কাগজ নিয়ে বসে আছে। জিওয়ুং হেসে ফেলে। তার পরের অনুচ্ছেদ এখানে তুলে দিলাম।

‘What’s the rush? We had a wedding and we live together. Nothing will change because of one document.’

‘It changes how we feel.’

Jiyoung had been oddly moved that he was in a rush to make the marriage legal. She’d felt good, good and elated and buoyant, like something lighter than air was filling her up in the lungs or stomach. Daehyun’s answer to her question pricked her heart like a short, fine needle and made a microscopic hole. The air escaped slowly, little by little, and brought her back down. She didn’t think legal procedures changed how she felt. Was Daehyun more committed for wanting to make the marriage legally binding, or was she more dedicated for thinking she’d always feel the same whether they were official or not? Jiyoung saw her husband in a new light – more dependable, yet oddly more alien.

জিয়োয়ুং জানত না ফর্ম ভরতে গিয়ে সে বার বার আটকে পড়বে। কী হয় সেটা না জানিয়ে লাস্ট কয়েকটা লাইন এখানে দিলাম-

The world had changed a great deal, but the little rules, contracts and customs had not, which meant the world hadn’t actually changed at all. She mulled over Daehyun’s idea that registering as legally married changes the way you feel about each other. Do laws and institutions change values, or do values drive laws and institutions?

আর কিছু বলছি না। শুধু বলব, বইটা পড়ুন। ভালো সাহিত্য হোক না হোক, কিছু বই পড়া দরকার। মাত্র ঘন্টা তিনেক লাগবে। এইটুকু দেওয়াই যায়।





পাহাড়যাপন ৬

 #পাহাড়যাপন


আতরের দোকান করে যারা, তাদের কাছে দোকানের বাইরের পৃথিবীটা বাসি বলেই মনে হয়। পুষ্পের সৌরভ পেলেও যেন মনে হয় জোলো, ভালো মিষ্টির সুবাসও মনে ধরে না। সব কিছুই বড় অপরিশোধিত। আতরের দোকানটা যেন আরেক জগত, গন্ধের হাট বসেছে সেখানে। কোনওটা পারস্যের ফুলের আতর, কোনটা হিমালয়ের আয়ুর্বেদিক শিকড়ের গন্ধ। প্রতিটি ফুল নিজের ইতিহাস জানায়, বলতে চায় নিজের গল্প।কয়েকজন কারিগর বছরের পর বছরের ধরে এক্সপেরিমেন্ট করে যায় নতুন সুগন্ধের আশায়। দক্ষ হাতে গন্ধ তৈরি করে ওস্তাদ তারা। কিন্তু যে গন্ধ শেষমেশ তৈরি করা যায় না, সেই আতরের কারিগররা হীনমন্যতায় ভোগে। ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না। মাথার চুল খামচে ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায় কিন্তু...পারে না।

পুরনো দেরাজের ভিতরেও একরকম গন্ধ থাকে। গন্ধটা খুব পরিচিত হলেও কিন্তু ঠাহর করা যায় না। কখনও বা মনে হয় গন্ধটা প্রাচীন আসবাবের, আবার কখনও মনে হয় নতুন বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ।বেশ কয়েক বছর পর যখন দেরাজ খোলে, গন্ধটা ছড়িয়ে থাকে বইয়ে, ছোটবেলার ডায়রিতে, জমানো স্টিকারের কৌটোয়, রঙিন পেনসিলে। একটুক্ষণ বসে থাকলে আস্তে আস্তে অন্যান্য প্রতিযোগিরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে চেনানোর জন্য। লক্ষীপুজোর গন্ধ, সন্ধ্যেবেলায় হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসার গন্ধ, মাদুরে বসে খেতে বসার সময় হারিকেনের সলতের গন্ধ, মরাঘাসের ওপর ভিজে ফুলের অপেক্ষার গন্ধ, আরো কত...

রঙের ও নিজস্ব এক একটা গন্ধ থাকে, যেমন থাকে ইতিহাসের। স্মৃতির গন্ধ অবশ্য লুকিয়ে থাকে নুড়ি নুড়ি গল্পের পিছনে,আড়াল দিয়ে হাসে। কিন্তু বর্তমানের কোনো গন্ধ থাকে না, কারণ বর্তমানের কোনো গল্প থাকে না। গল্প বুনে ওঠে অতীতের তারে। তাই গল্পের গন্ধ তৈরি করা যায় না।

উপরের লাইনগুলো বেশ কয়েক বছর আগে অফিসের টিম মিটিংয়ে বসে লিখেছিলাম। টিম লীড ভ্যাজর ভ্যাজর করে যাচ্ছিল, আমি গম্ভীর মুখে ল্যাপটপে ডেটা দেখার ভান করে নোটপ্যাডে টাইপ করছিলাম। বছরদুয়েক পর ট্রেনে করে ব্যাঙ্গালোরে ফিরছি, আকস্মিকভাবে আলাপ হয়ে গেল সামনের সিটে থাকা এক মাঝবয়সী দম্পতির সঙ্গে। কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোক পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক ও কবি, নাম উজ্জ্বল সিংহ। নিজেও 'ঘোড়সওয়ার' বলে একটা পত্রিকা বের করেন। আমি তখন উজ্জ্বলদাকে চিনতাম না, কবিতা টবিতা নিয়েও আমার ধারণা নেই। দু' একবার ন্যাকাবোকা অন্তমিল দিয়ে কয়েক লাইন লিখতে গিয়েছি, তারপর বকুনি শুনে আর ও পথ মাড়াইনি। ছন্দ বোঝা নাকি আমার কম্ম নয়! যাই হোক, আমিও টুকিটাকি লেখার চেষ্টা করি সেটা যেন কোত্থেকে জেনে ফেললেন, বললেন শুনি কী লিখেছো? এসি কামরা না হলে নির্ঘাত জানলা থেকে ঝাঁপ-টাপ দিতাম। কুকুলকানের সন্ধানে তো আর শোনানো যায় না, বাধ্য হয়েই এই কয়েকটা লাইন পড়লাম। উজ্জ্বলদা এক মুহুর্তও না ভেবে বললেন, "এ তো কবিতা। পাঠিয়ে দিও। আমি ঘোড়সওয়ারে ছাপব।" কথার কথা নয়, লেখাটা সত্যি উনি বইমেলা সংখ্যায় ছেপে দিলেন। ভাবতেও লজ্জা করে।

আজ এত বছর পর এই লেখাটার কথা মনে পড়ে গেল একটাই কারণে। আমারও নিজেকে আজ সেই আতরের দোকানদারির মতোই মনে হচ্ছে। সে মনেপ্রাণে চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনের একটা ছবি গড়ে তোলার-- সে ছবিতে শুধুই পাহাড়, মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর, সবুজের আচ্ছাদন আর বনের পাখি। নগরজীবনের ব্যস্ততা নেই, দায়িত্ব নেই, উচ্চাশা নেই, আছে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি। অঢেল সময়। কিন্তু বাস্তবে সেই ছবি গড়া তার পক্ষে অসম্ভব। আর সম্ভব নয় বলেই আমার অবস্থাও আজ আতরের ব্যর্থ কারিগরদের মতো। হয়তো একদিন হলেও হতে পারে, কিন্তু এই মুহুর্তে নয়। আমার পাহাড়যাপন পর্ব এখানেই শেষ।

গত তিন মাসে আমি পাহাড়কে যেভাবে দেখলাম, সেভাবে আগে দেখিনি। দেখা সম্ভবও ছিল না। হাড় কাঁপানো শীত আর তুষারপাত যেমন দেখা হল, বসন্তের আগমনেরও সাক্ষী হয়ে রইলাম। দেখলাম, ঋতুর সঙ্গে সবুজের রঙ কীভাবে বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে পাহাড়িয়া জীবনের রোজনামচা। বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গাওয়া যেমন হল, নতুন বন্ধুদের আনন্দ অনুষ্ঠানের ডাকও পেলাম। গাছগুলো পাতা মেলল, চুড়ার বরফ গলে গেল আস্তে আস্তে। খরস্রোতা পাহাড়ি নদী এখন আরো ক্ষিপ্ত। বাগানের আপেলেও লাল রঙ ধরছে। কালো বলের মতো দেখতে একটা কুকুর ধীরে ধীরে পরিণত আর তাগড়াই হয়ে উঠছে, যার নাম সাইচু। দেখলাম, প্রত্যন্ত এক গ্রামেও দুই মেয়ে টিকটক স্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, বিশাল ছেত্রীর গানের কলি আঁকড়ে তারা ভিডিও করছে রোজ। সুজুকা বলে একরত্তি পুঁচকে মেয়েটা, যার আসল নাম গরিমা, তাকে খুব মিস করব। মিস করব গ্রামের অন্য বাচ্চাদেরও। গীতা, অনু, ঋশু, পরিধি। পরিধির কচি গলায় 'সচিন ভাইয়া' যা শুনে মাথাখারাপ হওয়ার জোগাড় হত, সেটাও মিস করব। অনুর কাঁদো কাঁদো মুখে বলা 'পালক তো নাহি হ্যায় আজ' কথাটা মনে করে হাসব হয়তো। প্রকৃতির কথা আর কী বলি, আকাশের নীল রং আর সবুজের কথা ভাবলেই কান্না পাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি আর টুকরোটাকরা মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে, যার মূল্য আগে বুঝতে পারিনি। সত্যি, গল্প তো বুনে ওঠে অতীতে। বর্তমানের কোনও গল্প হয় না।

রঙের গন্ধ আর পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে আজ আমরা চলে যাব। কিন্তু ফিরে যে আসব, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ততদিনের জন্য, বিদায়। সবাই ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। আর থাকুক সবুজে।