Granada Landscape গাছ, শুধু গাছ। শুষ্ক ও সবুজ। মেয়েটি অলিভ তুলছে, সুন্দর মুখখানি তার মিনার থেকে ধেয়ে আসে ফুর্তিবাজ হাওয়া কোমর জড়িয়ে ধরে মেয়েটির চারটে ঘোড়সওয়ার এসে ডাক দেয় এই মেয়ে, কর্ডোবায় চল মেয়েটি শোনে না ..... দুপুর গড়িয়ে রাত হয়, জোছনা ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, সেই জোছনা মেখে হাতে গোলাপ নিয়ে একজন আসে এই মেয়ে, গ্রানাদায় যাবে চল মেয়েটি শোনে না, তুলে চলে অলিভ সুন্দর মুখখানি তার বাতাসের ছাইরঙা হাত জড়িয়ে রাখে তার কোমর গাছ, শুধু গাছ। শুষ্ক ও সবুজ। ~ ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা |
১) পৃথিবীতে এমন অনেক শহর অথবা গ্রাম আছে, যাদের সঙ্গে হয়তো আমাদের আত্মার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, কিন্তু সেখানে আমরা কোনোদিন যাইনি। কয়েকটা জায়গার ছবি হয়তো বা ইন্টারনেট অথবা চলচিত্রের সৌজন্যে আমাদের চোখে পড়েছে, কয়েকটি আবার একেবারেই অপরিচিত। অনেক জায়গার নামও আমরা জানি না। কিন্তু অদ্ভুত কোনও কারণে কোনো কোনো শহরের সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাতেই এক অপ্রতিম যোগাযোগ তৈরি হয়। ঠিক যেভাবে প্রথম দেখাতেই কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে সারজীবনের জন্য। শহরের ক্ষেত্রেও তাই। এই ব্যাখ্যাতীত আত্মীয়তা অনেকের হয়তো কাকতালীয় বলে মনে হতে পারে কিন্তু প্যারাসাইকলোজিস্টদের মতে এর পিছনে গভীর তত্ত্ব আছে।
প্রতিটা মানুষের আত্মার জন্য কিছু স্থান নির্ধারিত আছে পৃথিবীতে। এই জায়গাগুলোতে গিয়ে পড়লে সেখানকার কসমিক এনার্জির সঙ্গে মানুষের মানসিক তরঙ্গের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়, যার ফলে সেই স্থানটি আমাদের খুব আপন বলে মনে হয়। আষাঢ়ে গল্প শুনতে মনে হলেও এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলছে। ‘সোউল প্লেস’ আর ‘পাওয়ার প্লেস’ নিয়ে একের পর এক তত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে আন্তর্জাতিক জার্নাল আর সম্মেলনে। সে সমস্ত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নিয়ে কথা খরচ না করে আপাতত আসল কথায় ফিরি। আসল কথা হল, গ্রানাদাতে পৌঁছানো মাত্র আমার মনে যে ভাবের উদয় হল তাতে আগাগোড়া আরব ঘরানার খাস ইউরোপীয় এই শহরটার সঙ্গে আমার আত্মিক যোগ থাকা নিশ্চিত।
সেভিয়া থেকে সাতসকালেই বাস ছিল গ্রানাদার জন্যে। খুব একটা সময় লাগে না, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সিয়েরা নেভাদার পাহাড় দেখা যায়। কিছুটা এগিয়ে পাথুরে প্রান্তর পেরোলেই গ্রানাদার সীমানা শুরু হয়ে যায়। এই শহরের মাহাত্ম্য নিয়ে আর কী বলি? শুধুমাত্র 'আলহাম্বরা প্যালেস' দেখতেই লক্ষ লক্ষ লোকের আগমন হয়ে গ্রানাদায়, শহর থেকে মাইল বিশ দূরে একটা এয়ারপোর্টও আছে সেই জন্যে।
একটা কথা অবশ্য বলা দরকার। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে গ্রানাদা আসলে ইউরোপের বুকে এক টুকরো আরবীয় মরুদ্যানের সামিল। মুরদের রাজত্ব শেষ মুহূর্ত অব্দি টিকে ছিল এই গ্রানাদাতেই। ১৪৯২ সালে ক্রিশ্চানরা শহর অধিকার করে পুনঃসংস্কার শুরু করল ঠিকই, কিন্তু আরবীয় জীবনযাত্রা এখানে জনমানসের এত গভীর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়েছিল যে অন্যান্য শহরের চেয়ে গ্রানাদার চরিত্র একেবারেই অন্যরকম হয়ে রইল।
Granada City |
গ্রানাদার বৈচিত্র্য আর চরিত্র আর পাঁচটা সাজানো ইউরোপীয় নগরীর চেয়ে এতটাই ভিন্ন যে মনের ভাবপ্রকাশ করতে গেলে হাবুডুবু খেতেই হয়। ইংরেজিতে ‘treat of the senses’ বলে একটা কথা আছে, এই শহরের জন্যে এর চেয়ে ভালো উক্তি আর হয় না।
যতটা চমকপ্রদ গ্রানাদার ভৌগলিক অবস্থান, ততটাই ব্যতিক্রমী এখানকার ইতিহাসও। প্রাচীন কালে খানিকটা রোমান আর ভিসিগথ সাম্রাজ্যের ছোঁয়া পেলেও গ্রানাদার উত্থান শুরু হয় মুরদের আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে। প্রাচীন রোমান নির্মাণের রুপান্তরের সঙ্গেই স্থাপত্য, কৃষিকার্য আর হস্তশিল্পে নানাধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে। খুবানি আর লেবুর গাছ রোপণ করা হয় রাজ্য জুড়ে, জলসেচন আর রসদ সরবরাহের জন্যে নতুন পদ্ধতির ব্যবহারও শুরু হয়। প্রায় সাতশ বছর ধরে মুরদের শাসনকালে একাধিক বংশের সুলতানরা গ্রানাদার সিংহাসনে বসেছেন। খলিফা উমায়াদ থেকে তাইফা জাওই বেন জিরি...সকলেই নিজের মতো করে সাজিয়ে তুলেছেন আন্দালুসের এই মনোরম মহানগরীকে। কিন্তু গ্রানাদার অদৃষ্টবদলে লেখা ছিল নাসরেদ বংশের আমিরাত রাজাদের হাতে। তারা সিংহাসনে বসতেই এই শহরের বরাত খুলে যায়।
Old Spanish Kingdoms |
গ্রানাদাকে নিয়ে বহু উপন্যাস লেখা হয়েছে, অনেক ভালো টিভি সিরিজও হয়েছে, কাজেই এখানকার কাহিনি আমার খানিকটা জানা ছিল। বই আর সিনেমার দৌলতে পাওয়া তথ্যের ‘নলেজ ট্রান্সফার’ করছি সঙ্গিনীকে। শ্রোতার যে খুব একটা উৎসাহ আছে সেটা যদিও মনে হচ্ছে না, কারণ মাঝে মাঝেই তিনি হাই তুলতে তুলতে ফোন খুলে উঁকি মারছেন। তাতে আমি দমে যাওয়ার পাত্র নই। যতটা জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছে উগরে না দিলে পেটে ব্যথা হবে। তাছাড়া পরে প্রশ্ন করলেও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে বলতে পারব, “যখন গল্পটা বলছিলাম ফেসবুক চালাতে কে বলেছিল শুনি? আজকালকার জেনারেশনের কিস্যু হবে না।’’
নাসরেদ বংশের সম্রাটদের রাজনীতিক বুদ্ধি তুখোড় ছিল। শুধুমাত্র বাহুবলে যে স্পেনে অবস্থিত খ্রিস্টধর্ম অনুগামী অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না, এই বাস্তব বুঝতে তাদের বেশি সময় নিতে হয়নি। ১২৩৬ সালে লেওন আর কাস্তিয়ার রাজা ফার্দিনান্দ তৃতীয় মুরদের কাছ থেকে সাম্রাজ্য পুনর্দখলের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, কার্ডোবা আবার ফার্দিনান্দের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। গ্রানাদায় তায়ফা আর অন্যান্য বংশের রাজাদের মধ্যে অসদ্ভাব এবং মতবিরোধ থাকায় গ্রানাদা অধিকার করতেও তাদের বেশি বেগ পেতে হবে না।
Nasred Kingdom Timeline |
এমন সময় নাসরেদ বংশের রাজারা দাবার অকাট্য চালে ভবিষ্যৎ-এর ফয়সালা করে ফেলল। ফার্দিনান্দের সঙ্গে চুক্তি করা হল যে গ্রানাদা কাস্তিয়ার করদ রাজ্য হয়ে থাকবে। নাসরেদ বংশ নিজের মতন করে শাসন করবে সেখানে, ফার্দিনান্দের সৈন্য গ্রানাদায় যুদ্ধ করতে আসবে না। পরিবর্তে মধ্য আফ্রিকা এবং আরবের সঙ্গে ব্যবসার জন্যে প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র বলে প্রতিষ্ঠা করা হবে গ্রানাদা রাজ্যভুক্ত কয়েকটি বিশেষ স্থানকে। সেখান থেকে খেজুর, আখরোট প্রভৃতি শুকনো মেওয়া জাতীয় ফল, মশলা এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে কাস্তিয়ার ব্যবসায়ীরা যাতাযাত করবে। মধ্য আফ্রিকার সাহারা অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলো থেকে রেশম, সোনা ছাড়াও দরকার পড়লে সৈনিক পাঠিয়ে নাসরেদ বংশের রাজারা কাস্তিয়ার সম্রাটদের সাহায্য করবে।
এই সন্ধির ফলে গ্রানাদার মাথায় ঝুলে থাকা 'রিকনকোয়েস্ট'-এর খাঁড়া সরে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই এই শহর অর্থ এবং প্রতিপত্তির কেন্দ্র হয়ে উঠল। আলহাম্বরা প্যালেসের নির্মাণকার্য শুরু হল আমির মহম্মদ বেন আল-আহমর এর তত্ত্বাবধানে। পূর্বের ছোট কেল্লার সংস্কার করে পাহাড়ের মাথায় গড়ে উঠল বিশাল এক নগরী যার স্থাপত্যের সুক্ষ অলঙ্করণ দেখলে লোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। 'আলহাম্বরার' আক্ষরিক অর্থ 'লাল'। এই দুর্গের প্রাঙ্গণে নির্মিত মহল, রাজদরবার, আদালত, উদ্যানের স্থাপত্যের আরব নির্মাণকৌশলের প্রাচুর্য থাকলেও অনেক জায়গায় বারোক এবং রেনেসাঁর শৈলীও ব্যবহার করা হয়েছে।
Alhambra Interior |
এই বিপুলাকার রাজপ্রাসাদ এবং আন্দালুসিয়ার ব্যবসায়িক কেন্দ্র হওয়ার দরুণ মরক্কো, আরব, মাঘরেব থেকে প্রচুর লোকের আগমন হতে থাকে। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত ভ্রমনকারী ইব্ন বতুতা এখান এসে গ্রানাদার অর্থপ্রাচুর্য এবং সৌন্দর্য দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সব যুগেরই পরিসমাপ্তি লেখা থাকে নিয়তির বিধানে। ১৪৯২ সালের গ্রানাদার যুদ্ধে নাসরেদ রাজা বোয়াবদিল কাস্তিয়া এবং আরাগনের মিলিত শক্তির সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। মাঝের আড়াইশ বছরে খ্রিষ্টধর্ম অনুগামী সাম্রাজ্যগুলিতে অনেক জল বয়ে গেছে। আগেকার সন্ধি স্বীকার করে মুসলমানদের রাজ্য শাসনের অধিকার দেওয়া ক্যাথলিক পাদ্রীদের মোটেই পছন্দ নয়।
স্প্যানিশ রিকনকোয়েস্ট-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই সন্ধির পর ঠিক কী হয়েছিল সে কথা আগেই বলেছি। সন্ধির সমস্ত শর্ত ধুলিসাৎ করে কয়েক বছরের মধ্যেই মুসলমান আর ইহুদিদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। বহু লোকের প্রাণহানি আর বর্বর অত্যাচারের সাক্ষী হয় দাঁড়িয়ে থাকে আলহাম্বরা প্যালেস।
দশটার কাছাকাছি শহরে পৌঁছে বাস ধরে চললাম ওল্ড টাউনের দিকে। গির্জার কাছাকাছিই আমাদের থাকার ব্যবস্থা যদিও আমরা সময়ের অনেক আগেই চলে এসেছি। পিঠের রুকস্যাক রেখেই বেরিয়ে পড়ব। দুপুরবেলায় এখানে রোদ্দূরের যা অবস্থা, শুধু শুধু আগুন মাথায় দিয়ে না ঘুরে দু এক ঘন্টা সিয়েস্তা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
রাস্তা ঘাট পরিচ্ছন্ন, কিন্তু চরিত্রটা মোটেও মেট্রোপলিটান শহরের মতো নয়। দু’দিকের বাড়িগুলো রাজার বাড়ির মতন বারোক-রেনেসাঁ-মুদেহার শৈলীর মিশ্রণে নির্মিত। মনে হয় আগেকার কোনও রাজার রাজত্বে এসে হাজির হয়েছি। আধুনিক যুগের বাস-গাড়ি-দোকানগুলো বাদ দিলে সহজেই সময়টা পিছিয়ে যেতে পারে চারশ বছর।
Old town Streets |
গির্জার সামনের লোক গিজগিজ করা সরু গলি দিয়ে খানিকটা হেঁটে গেলেই আমাদের নির্দিষ্ট থাকার জায়গা। চারতলা বাড়িটা বহু প্রাচীন, একেবারে গির্জার কাছেই। বাড়ির মালিকের নাম ভেলান্তিন, তাকে আগে থেকেই ফোন করা হয়েছিল ব্যাগগুলো রাখতে দেওয়ার অনুরোধ করে। ভেলান্তিন দুটোর আগে আসবে না, অতএব বাড়ির দরজার চাবি নেওয়ার জন্যে ইলেক্ট্রনিক লকের কোড নাম্বার আমাদের জানিয়ে দিয়েছে।
দরজার বাঁদিকে নম্বর লেখা চাবি রাখার জায়গা। নির্দিষ্ট নম্বর টিপে খুপরি খুলে দেখা গেল দুটো চাবি রাখা আছে। আমাদের জন্যে রাখা M লেখা চাবিটা দিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে দেখি দরজা খুলছে না। কোনও কারণে চাবিটা কাজ করছে না। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে টানা হেঁচড়া করেও যখন দরজা খুলল না, তখন বাধ্য হয়েই ভেলান্তিনকে ফোন করা হল। ব্যাপার শুনে সে বলল হয়তো তালাটা আটকে গেছে, চেষ্টা করলে ঠিকই খুলবে। কিছুই করার নেই আমাদের। শেষমেশ কি ভেবে দ্বিতীয় চাবিটা দিয়ে চেষ্টা করতেই দরজার তালা খুলে গেল। যাহ কেলো! আমরা একে অপরের দিকে চাইলাম। আমাদের চাবিটাই কাজ করছে না। যাই হোক, দরজা খুলতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আমরা রুকস্যাক নামিয়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে আবার ইলেক্ট্রনিক লকে চাবি বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম।
কাছাকাছি নানাধরনের খাবার জায়গা, দোকানপাট। আরব রান্নার সুবাসের সঙ্গে ভেসে আসছে গলির দু’ধারে সাজানো কাঁচা মশলার গন্ধ। বিজাতীয় সব মশলা বিক্রি হচ্ছে, বেশিরভাগই আরব থেকে আনা। সঙ্গে অনেক রকম আয়ুর্বেদিক চা, তেল, শুকনো ফল, গাছড়া ইত্যাদিও আছে। ইউরোপে এরকম ঢেলে মশলা বিক্রির রেওয়াজ নেই। বুঝলাম এও এখানকার ঐতিহ্যের নমুনা।
মিনিট পাঁচেক ঘোরাঘুরি করেই এখানকার পরিবেশ আমাদের আবিষ্ট করে ফেলল। সরু গলি, প্লাজা আর স্কোয়ারে জায়গাটার অবস্থান সেভিয়ার মত হলেও প্রাথমিক ভাবে চরিত্রের তফাৎ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গলিগুলো এখানে চওড়ায় কম, দুদিকের বাড়িগুলো উচ্চতায় বেশি আর দেওয়ালের রঙ হলদেটে বাদামী। কয়েকটা বাড়ি সাদা অথবা পাথুরে গোলাপী রঙেরও আছে। রাস্তার দু’ধারে বিক্রিবাটা চলছে ইজপ্সিয় আতর, হাতপাখা আর তামাকের হুঁকোদানের। অনেক দোকানদারের চেহারাতেই মধ্যপুর্বের ছাপ দৃষ্টিগত, যদিও তাদের স্প্যানিশ শুনলে কিছুই বোঝা যায় না।
Spice shops |
এখানের স্থানীয় স্প্যানিশ ভাষাতেও অন্যরকম টান আছে, যদিও বাইরের লোকেদের সঙ্গে খাস স্প্যানিশেই কথা হয়। গির্জার সামনে প্রধান পথ কাইয়ে গ্রান দে ভিয়া কোলন দিয়ে এগোলুম প্লাজা ইসাবেল দা কাতোলিকার দিকে। সামনেই আরবের কাবাব রোল বিক্রি হচ্ছে। স্যান্ডউইচ আর বার্গার খেয়ে অরুচি হয়েছে, দুরুম কাবাব রোলের অর্ডার দেওয়া হল। বিরাট সেঁকা পরোটার মধ্যে জিভে জল আনা মাংসের কিমা দিয়ে একের পর এক জিনিস দেওয়া হচ্ছে। টমেটোকুচি, গাজর, স্যালাদ, হুমাস, বাঁধাকপি, দই, চাটনি ইত্যাদি দিয়ে যেই জিনিসটা হাতে এসে পৌঁছাল সেটা আমাদের চেনা রোলের তিনগুন। ঝপাঝপ কামড়ে দুরুম রোল শেষ করে প্লাজা ইসাবেল থেকে স্যাক্রামন্টেগামী ছোট লাল বাসে উঠে পড়লাম।
গ্রানাদার ওল্ড টাউনে প্রচুর জনবসতি, পাহাড়ি শহর বলে উঁচুনিচু রাস্তা। প্রস্থে কম বলে এই রাস্তায় বড় বাস চালানো যায় না। পায়ে হেঁটে এত চড়াই ওঠা নামা করাও যায় না, নয় নয় করেও অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে ওল্ড টাউন অঞ্চল। তাই ছোট ছোট বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১, ২ আর ৩ নম্বর বাস চলে পাহাড়ি রাস্তার গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে।
প্লাজা ইসাবেল থেকে বাঁদিকে এগিয়ে চলল বাস। দারো নদীর সরু জলধারা ডান দিক দিয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে ভূমিগত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় চোখের সামনে থেকে। ডান দিকে রাস্তার অপর প্রান্তে পাহাড়ের গায়ে সারি সারি প্রাচীন বাড়ি উঠে গেছে। বাঁদিকে উঁচু বাড়িগুলোতে আলবাইজিন কোয়ার্টার্স। মুসলমানদের কলোনি থাকা এই অঞ্চলের নানান জায়গা দিয়ে আলহাম্বরার অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়।
আপাপাত আমরা চলেছি স্যাক্রামন্টের দিকে। প্রধান শহর থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই ছড়িয়ে থাকা অঞ্চলে এককালে জিপসিদের নিবাস ছিল। লোককথায় বিশ্বাস করতে হলে নাসরেদ সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রাণ বাঁচাতে অনেক ইহুদি আর মুসলমানেরা জিপসিদের দলে ভিড়ে গিয়ে তাদের মতন করে জীবনযাপন শুরু করে। দারো নদীতে এককালে সোনার রেণু পাওয়া যেত বলে জানা যায়। নাসরেদের শাসনকালে অনেকেই সেই সোনার রেণু কুড়িয়ে লুকিয়ে রেখেছিল স্যাক্রামন্টের পাহাড়ে। খ্রিষ্টধর্মী সৈন্যদের নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষ শহরের চৌহদ্দির বাইরে থাকা এই জিপসিদের কাছে আশ্রয় চায় ও তাদের লুকোনো সোনার খবর দিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে জিপসিরা এই পাহাড়ে গুহা বানিয়ে থাকতে শুরু করে। সাদা রঙের সেই গুহা অথবা কেভহাউসগুলো দেখতেই আজকাল সবাই স্যাক্রামন্টে যায় বটে, কিন্তু এছাড়াও জায়গাটার প্রাকৃতিক শোভা অনন্য।
Sacramonte |
বাস আমাদের নামিয়ে দিতে ডানদিকের পাহাড়ের চড়াই ভেঙ্গে উঠতে শুরু করলাম। দূরে আলহাম্বরার প্রাসাদ দেখতে পাচ্ছি। ভ্যালপারাইসো উপত্যকায় অবস্থিত স্যাক্রামন্টের বাড়িঘরগুলোও নজরে পড়ছে। পাথর দিয়ে গড়া সাদা চুনকাম করা বাড়িগুলো প্রধান রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। চড়াই ভেঙ্গে পৌঁছাতে হয় পাহাড়ের কোলে থাকা এই জনবসতির। আমরা অবশ্য চলেছি গুহাগুলোর দিকে। জিপসিরা বহুদিন এই অঞ্চলে থেকে তাদের যাবতীয় সংস্কার, গান, রান্নাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ফ্লামেংকো নাচের মূল অধিষ্ঠাতাও এই জিপসিরাই। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সাক্রামন্টেতে বিশাল কার্নিভাল হয়। পাহাড়ের চড়াই ভেঙ্গে একসময় চলে এলাম শ্বেতবর্ণরঞ্জিত গুহাগুলোর সামনে। একটা ছোট্ট মিউজিয়াম করে দেওয়া হয়েছে কাছেই। সস্তাই। টিকিট কেটে এগিয়ে চললুম ভিতরে।
গোল গোল সাদা পাথরের গুহা। ভিতরে মোটামুটি দুটো ঘরের মতন জায়গা আছে। বাইরে থেকে ভিতরটা বেশ ঠান্ডা। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে জিপসিদের জীবনযাত্রার যাবতীয় জিনিস। রান্নার বাসনকোসন, উনুন, জামাকাপড়, জুতো। কয়েকটা গুহার ভিতরে ইতিহাস বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে অডিও ভিজ্যুয়াল দিয়ে। রোম হয়ে এসেছিল বলে এদের রোমানিও বলা হয়। এই জিপসিদের পূর্বপুরুষরা নাকি ভারতবর্ষ থেকেই পাড়ি দিয়েছিল পশ্চিমে। জিপসিদের আদিভাষা 'কা-লো' আজকাল লুপ্ত হয়ে গেছে। আকাশ, চাঁদ, মৃত্যু, রাত... প্রকৃতির মূল অবয়বদের নিয়েই রোমানিদের সংসার চলত। জীবনধারার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল উন্মুক্ত আকাশ আর নক্ষত্রমালার আলো। রোমানিদের এই সংস্কার আর রীতি নিয়ে 'রোমান্সেরো গিতানো' বলে একটি অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ লিখে গেছেন ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক স্যাক্রামন্টের গুহাশহর আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে থাকা চিরন্তন ইতিহাসের বুনোটের মধ্যে ঘুরে বেড়ালাম। কোনো কোনো পাথরের বুক থেকে নেওয়া চিরায়ত নিঃশ্বাসের ওঠানামা যেন অনুভব করা যায় এক ঝলকেই। কোনও পক্ষের লিখিত কলমে রচিত নেই এখানকার ইতিবৃত্ত, এই ইতিহাসের সাক্ষী শুধু এখানকার পাথর।
দুপুরবেলায় বাড়িতে ফিরে দেখি ভেলান্তিন ফিরে এসেছে। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, লম্বা চুল দাড়ি সহ ভেলান্তিনের চেহারায় একটা বেশ ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ ভাব আছে। সাদরে আমাদের সে ভিতরে নিয়ে গেল। বাড়ি দেখেই বুঝতে পারলাম বহু পুরোনো বাড়ি। প্রায় আমাদের বেনারসের বাড়ির সমান। অথবা তার চেয়েও প্রাচীন হতে পারে। কিন্তু ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে অতিথিদের জন্যে। আমাদের ঘর তিনতলায়। জানলা দিয়েই গির্জা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একটা ছোট্ট বারান্দা আছে, আছে খড়খড়ি টেনে রোদ আটকানোর ব্যবস্থা। দু’তলায় রান্নাঘর, খাওয়ার জন্যে একটা ছোট্ট ঘর। সেখানে বিস্তর বই সাজিয়ে রাখা। রঙবেরঙের টুপি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে দেওয়ালে। তোহফা ব্যবস্থা।
খানিকক্ষণ গল্পগাছা হল ভেলান্তিনের সঙ্গে। সে আর তার স্ত্রী গেমা এই হোমস্টেটা চালায়। দুটো ছোট ছোট মেয়ে আছে তাদের, সময় পেলেই সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। গ্রানাদা সম্পর্কে সে আমাদের নানা তথ্য দিয়ে দিল। গ্রানাদায় তাপাস বিখ্যাত, কম টাকায় পানীয়ের সঙ্গে মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়। কোন তাপাস বার কোন রান্নার জন্যে বিখ্যাত, কোথায় সস্তায় কি পাওয়া যায়... সব বুঝিয়ে দিয়ে ম্যাপে জায়গাগুলো চিনিয়ে দিল ভেলান্তিন। বাইরে ততক্ষণে কড়া রোদে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। ভেলান্তিনের ফিরে যাওয়ার পর একটা ঘন্টা দেড়েকের 'সিয়েস্তা' দিয়ে আমরা খানিক তরতাজা হয়ে নিলাম। জুতোজামা পড়ে, ফুলবাবুটি হয়ে, আবার সন্ধ্যেবেলায় বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বৈকালিক ভ্রমণে কী আবিষ্কার করা যায় দেখা যাক!
২) রোদ পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটা শহরের অন্য একটা চরিত্র সামনে আসে। সকালের রাজকীয় বাড়িঘরগুলো যে রাতে রঙিন আলো দিয়ে সাজানো থাকবে সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা ছিল না। রাস্তায় মনে হচ্ছে আলোর ফুলঝুরি ছুটছে, কিন্তু এই আলোও কিন্তু আধুনিক আলোর মতো নয়। শতাব্দীপ্রাচীন দীপদান আর লণ্ঠন দিয়ে সাজালে যেমন হতে পারে, তেমন একটা আলোআঁধারি ‘তিলিস্মি’ আমেজ। রেস্তোরাঁয় যথারীতি মানুষের ভিড়, অনেকেই চলেছে ভালো তাপাসের সন্ধানে। ইসাবেল প্লাজার সামনে দেখি রানি ইসাবেলার প্রতিমাকে ঘিরে রঙিন আলোর ফোয়ারা জল ছিটোচ্ছে। এদিকে গ্রান ভিয়ার দু’দিকের অট্টালিকারূপী বাড়িগুলো এমন সাজানো হয়েছে যে মনে হচ্ছে রাজপুত্র বা রাজকন্যের বিয়ের তোড়জোড় চলছে বুঝি। প্লাজার অন্যপ্রান্তে অবস্থিত বাড়িটার সাজ দেখে আমার মনে হল নিশ্চয়ই কোনও মিউজিয়াম অথবা মহল হবে! কাছে গিয়ে দেখি, ও হরি! একটা ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির অফিস।
আমাদের বাইরে তাপাস ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার সাধ্য নেই। অতএব সুপারমার্কেট থেকে কেনাকাটা করে বাড়িতে ফ্রিজে ঢুকিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া হল। কাইয়ে নাভাস বলে এখানে নামকরা এক ফুড স্ট্রিট আছে, সেখানে এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় আর পুরোনো তাপাস বার 'লোস দিয়ামান্তেস'-এর ঠিকানা আমাদের ধরিয়ে দিয়েছে ভেলান্তিন। প্লাজা ইসাবেল থেকে ডান দিকে বেঁকে কাইয়ে মরিনো দে লা কর্তেজা ডেল কারমেনের সরু গলি ধরে খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিক ডান দিক ঘুরে কাইয়ে নাভাসে পৌঁছাতে আমাদের লাগল সাত মিনিট। ততক্ষণে সেখানে মেলা লোক। ঠেলেঠুলে এগোতে থাকি। দু’দিকে সার দিয়ে ছোট বড় তাপাস বার আর রেস্তোরাঁর সারি, গ্রীষ্মের রাত্রে পানাহার চলছে পুরোদমে। কেউ বিয়ারের মগ হাতে উচ্চহাস্য করছে, কেউ খিলখিলিয়ে গড়িয়ে পড়ছে প্রেমিকের কোলে। টুংটাং চিয়ার্স-এর পবিত্রধ্বনি, হিস্প্যানিক লোকসঙ্গীতের আবহসঙ্গীত, মজলিশি আড্ডায় উল্লাসের ছোঁয়া। নেশা লেগে যায়। কোথায় এলাম রে ভাই?
লোস দিয়ামান্তেসে এমন ভিড় হয়েছে যে দু’পাত্র ওয়াইন সহ তাপাসের প্লেট পেতে বেশ সময় লেগে গেল। তাপাসের পরিমাণ বেশ ভালই, স্বাদও জবরদস্ত। চিংড়ি থেকে মুরগি, সব মজুদ। রেড ওয়াইনে চুমুক দিয়ে বাজপাখির নজরে পরিবেশের খুঁটিনাটি লক্ষ করতে লাগলাম। পাশের লোকটি সেই কখন থেকে আমাকে অনর্গল জ্ঞান দিচ্ছে এর পরে কোনও ড্রিংক নেব সেই নিয়ে! কী আর করা! মনোযোগ সহকারে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে এক গাল হেসে আবার চাকুম চুকুম মুখ চালাতে লাগলাম। এরই মধ্যে কয়েকজন একেবারে ড্রাফট বিয়ারের পিপের সামনে বসে পড়েছে বড় বড় গেলাস নিয়ে। নিমেষে গেলাস খালি হয়ে যাচ্ছে, আবার ভরেও নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। জোর তর্ক চলছে নানা বিষয় নিয়ে। স্পেনের লোকজন ডেসিবেলের ধার ধারে না, সুতরাং সকারের আলোচনার মাথার ওপর দিয়ে গানের আলোচনা বইছে, আবার গানের আলোচনার দুদিক দিয়ে শোনা যাচ্ছে রাজনৈতিক মতভেদের বর্ণনা। হঠাৎ একজন দেখি টেবিলে লাফিয়ে উঠে চেঁচাতে চেঁচাতে বলছে, “তোদোস কোদিসিওসোস। পুতা…’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে আর কিছুই নয়, মাতৃভাষায় গালমন্দ করা চলছে অনেককে উদ্দেশ্য করে। সব নেতা শালা ধান্ধাবাজ, বিশ্বকাপেও জিততে পারে না, হ্যানাত্যানা... এই অপূর্ব সম্ভাষণ শুনে কান একদম জুড়িয়ে গেল।
এইদিকে আমার পাশের ব্যক্তি আরেক গেলাস হুইস্কি অর্ডার করে আমার যাবতীয় নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি ভদ্রতা করে জিগ্গেস করলাম, “নাম কী তোমার? এখানে বহুদিন ধরে আসছ বুঝি?" ভদ্রলোক ঢক ঢক করে অর্ধেক গেলাস খালি করে দিয়ে বললেন, “আমি লুকাস। আজকেই প্রথম এলাম এখানে। গ্রানাদা কেন, স্পেনেই আগে আসিনি হে! হাহাহাহা...” ব্যাটাচ্ছেলের কাণ্ড দেখে আমি পুরো হাঁ হয়ে গেলাম। এতক্ষণ ধরে স্থানীয় ব্যক্তি ভেবে লোকটার উপদেশ শুনে চলেছি। রেগেমেগে ঠক করে টেবিলে ওয়াইনের গ্লাস নামিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লোকটা হাঁ হাঁ করে “আরে আরে কোথায় চললে?" বলতেই আমি বললাম, “রোজ রোজ এক জায়গায় কে আসে? পরের পাত্র অন্য জায়গায় খাব।” পাজির পাঝাড়া যত!
পরের পাত্র খাওয়ার জন্য পকেটে মালকড়ি নেই, ইচ্ছেও নেই। অভিজ্ঞতার ভাঁড় পূর্ণ করতে গিয়ে ফতুর হব নাকি? অনেক জায়গা বাকি। সামনে পিছনে জরিপ করে আশেপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আমার হাতে ম্যাপ, সঙ্গিনীর হাতে ক্যামেরা। গ্রানাডা জয় করতে বেরিয়েছি দু’জনে। জয় বজরংবলি!
গ্রীষ্মের রাত্রে কয়েকটি প্লাজায় কনসার্ট হচ্ছে। লাইভ স্টেজে গান চলছে। জোড়ায় জোড়ায় নেচে চলছে বহু লোকে, অনেকেই বয়সে প্রবীণ। অনেকে গলা মিলিয়েছে গানের কথায়। দেখে আমার মনও ভালো হয়ে গেল। এই না হলে উৎসব। ফুর্তি আর উল্লাস তো অনেকেই করে, কিন্তু সার্বজনীন চত্বরে এরকম অংশগ্রহণমূলক নাচ গানের আসর দেখার সৌভাগ্য আমার অন্তত ইউরোপে আসার আগে হয়নি। বেজায় মজা লাগছে কনসার্ট দেখে।
এই গলি সেই গলি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গির্জার চত্বরে হাজির হলাম। সেভিয়ার চাইতে এখানকার গলিরাস্তাগুলো অনেক কম আলোকিত, কয়েকটি পথ একেবারেই শুনশান। কিন্তু সেই কারণেই ল্যাম্পশেডের আলোয় এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন এক নগরীর বুকে রাতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কোনো কোনো মুহুর্তে মনে হয় হয়তো পঞ্চদশ শতাব্দীতে পৌঁছে গেছি, পরের মুহুর্তেই আবার একটা প্লাজা বা স্কোয়ারে এসে পড়তেই ম্যাজিকের মত পর্দা ঠেলে একবিংশ শতাব্দী সামনে এসে দাঁড়ায়। এই অভিজ্ঞতা একেবারেই অনন্য।
গির্জা চত্বরে বহু লোকে বসে শুয়ে গল্প করছে। হালকা কমলা আলোয় গথিক-রেনেসাঁ ঘরানার প্রকাণ্ড গির্জাটি আমাদের সামনে দৃশ্যমান। আমরাও বসে রইলাম সেখানে। রাত গভীর হচ্ছে গ্রানাদায়।
গির্জার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার খেয়াল হল, একসময় এখানেই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। তারপর সেই মসজিদেরই পুনর্নির্মাণ করা হল গির্জার রূপ দিয়ে। অনেক জায়গায় নতুন পাথর বসানো হল, নতুন কারুকার্য করা হল, কয়েকটি জায়গা আবার একই থেকে গেল। মানুষের হস্তক্ষেপে ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় ঠিকই, কিন্তু শ্বাশ্বত থাকে ইতিহাসের সাক্ষী থাকা পাথরেরা। এই মুহূর্তেও হয়তো কোনও ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। আমরা সকলেই এগিয়ে যাব, কিন্তু গ্রানাদার চিরন্তন ইতিহাসের সাক্ষী কয়েকজন এখানেই থাকবে। প্রতিদিন। প্রতি রাত। নীরব। অমোঘ। অনড়। চিরঅম্লান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন