Barcelona |
আমি ইতিহাসকে করবো ধুলো—
ধুলোকে করব আরও ধুলোময়।
এই মুহূর্তে আমি শেষ সূর্যাস্ত দেখছি
আমি শুনছি শেষ পাখির গান
কেউ পাবে না আমার শূন্যতার উত্তরাধিকার।
~হোর্হে লুই বোর্হেস
বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লির হৌজ খাসের বিখ্যাত ট্রাভেল ক্যাফেতে বসে কয়েকজন সাংবাদিক এবং হিন্দি সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক আর নাট্যকারদের সঙ্গে আড্ডা মারার সুযোগ হয়েছিল। কথাবার্তা চলতে চলতে আলোচনা ঘুরে গেল দেশে চলতে থাকা রাজনৈতিক এবং জঙ্গি আন্দোলনের দিকে। ভাষা এবং সংস্কৃতির অন্তর থাকলেই কি পৃথক রাষ্ট্রের আন্দোলনকে সমর্থন করা যায়? কয়েকজন সভ্য নিশ্চিত ভাবে রায় জাহির করলেন যে এই অপরিণত ব্যবহার মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই এই রকমের অসহিষ্ণু আন্দোলনকে পাত্তা দেওয়া হয় না, পশ্চিমে এইরকম আন্দোলন কোনোদিন হবেই না।
এই অনভিজ্ঞ বিশ্লেষণ যে কতটা ভুল, ২০১৭ সালের কাতালোনিয়া আন্দোলনে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার ধারণা ভারত ছাড়া অন্য সব দেশই সংস্কৃতি, ভাষা আর সাহিত্যের এই বাহুল্য আর বৈচিত্র নিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে হিমশিম খেয়ে যেত। পশ্চিমের বেশিরভাগ দেশে একটি ভাষা, ডায়ালেক্ট খানিকটা ভিন্ন হলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি-উৎসব দেশের প্রতি প্রান্তে অনেকটাই একরকম। স্পেনের মত লক্ষণীয় বহুসাংস্কৃতিক সভ্যতাও খুব বেশি জায়গায় নেই। তাই বার্সেলোনা আর কাতালোনিয়ার জন আন্দোলনে সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গিয়েছে।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি হাউমে মেট্রো স্টেশনের সামনে। উনোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। নেদরল্যান্ডসের ছেলে, উচ্চতায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। ডাচরা এমনিতেই লম্বা হয়। উনোর সঙ্গে ঘোরাঘুরির কথা আছে এখানকার গথিক কোয়ার্টারে, তার আগে বার্সেলোনার সার্বিক ইতিহাসের খানিকটা আভাস দিচ্ছিল সে। এমন সময় একজন অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে তাকে সটান জিগ্গেস করে বসল, “বার্সেলোনায় স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবী নিয়ে যে আন্দোলন চলছে, সেই নিয়ে তোমার কী বক্তব্য?"
২০১৭ সালে প্রায় মাস চারেক ধরে অবিরাম বিক্ষোভ এবং জনপ্রদর্শন চলেছে বার্সেলোনা এবং কাতালোনিয়ার অন্যান্য জায়গায়। বহু জায়গায় অবস্থা সামাল দিতে পুলিশকে জেরবার হতে হয়েছে। রাস্তায় রোজ হাজার হাজার মানুষ ‘প্রোটেস্ট মার্চ’ করেছে, অনেকেই ছোটখাটো ঘটনায় আহত হয়েছে। এই টানাপোড়নের মধ্যে টুরিস্টরা বার্সেলোনায় আসতেও চায়নি।
এই সমস্যার মূল আসলে বহু প্রাচীন। স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলের মত এখানে স্প্যানিশভাষী রাজাদের সাম্রাজ্য বিস্তার হয়নি। বরং হাপ্সবুর্গ বংশের রাজাদের অধীনে থাকা কাতালান ভাষায় ফরাসি ভাষার সাদৃশ্যই লক্ষ করা যায়। এখানকার মানুষের খাদ্য, সাহিত্য সংস্কৃতি তো স্বতন্ত্র বটেই, মানসিকতাও অনেকটাই আলাদা। ১৭০১ সালে স্প্যানিশ সাকসেশন যুদ্ধে কাস্তিয়ার সম্রাটের হাতে স্বাধীনতা হারানোর পর থেকেই কাতালোনিয়া স্প্যানিশ আভিজাত্যের তলায় নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সংগ্রাম চালাচ্ছে। ফ্রাঙ্কোইস্ট কালে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর আদেশে ১৯৭৫ সাল অব্দি সার্বজনীন জায়গায় কাতালান ভাষার ব্যবহার পর্যন্ত নিষেধ ছিল। রাজ্যের পরম্পরাগত অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল বহু বছর। আধুনিক যুগে সেই নিয়ম উঠে গেলেও কাতালান নাগরিকেরা চিরকালই স্বাধীন রাজ্য ও অধিকারের জন্যে গণভোট অথবা রেফারেন্ডামের দাবী করে এসেছে মাদ্রিদের কাছে।
উনো অবশ্য এই উড়ো প্রশ্নে অপ্রতিভ হল না। অপ্রিয় ঘটনা নিয়ে কথা বলতে এখানে লোকজন দ্বিধাবোধ করে না। উনো কাতালোনিয়া আর বাকি স্পেনের ইতিহাসের বিবরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা।
আমি জিগ্গেস করলাম, “যা শুনেছি, সরকারের পক্ষ থেকে সহমতি না পেয়েই রেফারেন্ডাম করা হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় এবং তাদের মধ্যে নব্বই শতাংশই স্বাধীন রাজ্যের পক্ষে। কিন্তু সে নিয়ে আলোচনা না করে মাদ্রিদ থেকে হুট করে সেনা পাঠিয়ে কাতালান নেতাদের গ্রেপ্তার করা হল কেন সেটা বুঝলাম না।”
উনো চোখ নচিয়ে বলল, “মাদ্রিদের মতে সংবিধানে নাকি রেফারেন্ডাম ব্যাপারটাই বেআইনি। বোঝো ঠেলা! এমনিতেই বার্সেলোনার লোকজন ক্ষেপে ছিল। আন্দোলনে থাকা জনতার ওপরে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। সেনা পাঠিয়ে দেওয়ার পর জায়গায় জায়গায় বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়।”
মারিয়া বলে ফিগেরেসের একজন মেয়ে বলল, “আমি কাতালোনিয়াতেই বড় হয়েছি। কিন্তু এরকম ব্যাপার কোনোদিন দেখিনি। রেফারেন্ডাম যদি বেআইনি হয় তাহলে গণতন্ত্রের বাকি কী রইল? এ আবার কেমনধারা কথা? কোনও পক্ষপাত না করেই বলছি, স্বাধীন রাজ্য হোক না হোক তাতে ব্যক্তিগত ভাবে অনেক লোকেরই কিছু এসে যায় না। কিন্তু মাদ্রিদের কেন্দ্র সরকারের এরকম কাণ্ড দেখে অনেক শান্ত মানুষজনও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।”
অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটি বলল, “এত বছর ধরে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নির্দেশে বহু শিল্পী, কবি, লেখক প্রকাশ্যে কাজ করতে পারেননি। কাতালান ভাষার ব্যবহারই করা সম্ভব ছিল না। তাই হয়তো একটা চাপা আক্রোশ লোকেদের মধ্যে ছিলই।
মারিয়া বলল, “তুমি দেখবে কাতালোনিয়ার লোকে অনেক উন্নত মনস্ক। বুলফাইটিঙ বেআইনি করতে কাতালোনিয়ার জননেতারা দু’বার ভাবেননি, কিন্তু সরকার সেই নৃশংস খেলা আবার আরম্ভ করেছে। তারপর ধর সাহিত্য! কাতালান সাহিত্যর মতো ভিজ্যুয়াল পোয়েট্রি অথবা শিল্প নিয়ে দেশে কোথাও কাজ হয়নি। আলবের্ত রাফোল কাসামাদা, জোয়ান ব্রোসাদের লেখা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু স্প্যানিশ সংস্কৃতির একচেটিয়া অধিকারের ফলে আমাদের দেশেই কাতালান সাহিত্য, গান ইত্যাদি নিয়ে কোনও কথা হয় না।"
উনো গলা খাঁকড়ে বলল, “মোদ্দা কথা হল এই যে রাজ্যের অনেক নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কাজকর্ম চলছে ঠিকই কিন্তু সব সরকারি অফিসেই হলুদ রঙের ‘প্রোটেস্ট ফ্ল্যাগ’ দেখতে পাবে তোমরা। তবে আশা করা যায় শীঘ্রই অবস্থার উন্নতি হবে।”
আমার অবশ্য সেটা মনে হল না। প্রতিরোধের অনেকটাই অর্থনীতি সম্পর্কিত। আর্থিক ভাবে দুর্বল কোনও রাজ্য হলে পৃথিবীর লোকে সেই আন্দোলনের কথা হয়তো সেভাবে জানতেও পারত না। বিষয়টা নিয়ে কয়েকদিন আগে একটা প্রতিবেদন দেখেছি, ব্যাপারটা নিয়ে আমরা দু’জন আলোচনা করতে করতে চললাম।
১৯৯২ সালের পর কাতালোনিয়া রাজ্য আর্থিক ভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। স্পেনের প্রায় এক চতুর্থাংশ রাজস্ব কাতালোনিয়া থেকে পেলেও সরকার যে এখানে প্রয়োজনীয় অর্থ লগ্নি করে না, সেই কথা বার বার বলে চলেছেন কাতালান নেতারা। ২০০৯ সালের মন্দা অথবা রিসেশনের পর কর্মহীনতা বেড়ে ওঠায় এই দাবী তুঙ্গে ওঠে। মাদ্রিদ থেকে অবশ্য আমল দেওয়া হয়নি। এখানে বলা দরকার স্পেনের বাস্ক অঞ্চলেও বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটা দল গড়ে উঠেছিল মাঝে, তাদের কঠোর ভাবে দমন করে দেওয়া হয়। কিন্তু কাতালোনিয়ার ব্যাপার আলাদা। আর্থিক প্রতিপত্তি ও জনসমর্থন থাকলে যে পৃথিবীর মিডিয়া কথা শুনতে বাধ্য, সেই প্রবাদকে সত্যি করে সারা পৃথিবীর মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে বার্সেলোনায়। এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছে, নতুন দেশ পেয়ে গেলেও কাতালোনিয়াকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যতা পেতে গেলে আবেদন করতে হবে। তাতে বেশ কয়েক বছর লাগবে। ইতিমধ্যে স্বাধীন দেশ হলে বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের কী হবে, সেই নিয়ে প্রবল বাকবিতন্ডা চলছে। এখানকার অনেক নামকরা ব্যক্তিত্বই স্বাধীন দেশের বিপক্ষে।
আমরা পায়ে পায়ে কিং মার্টিন ওয়াচটাওয়ারের দিকে চলেছি। সিউদাদ ভেইয়া অঞ্চলের কেন্দ্রে থাকা গথিক কোয়ার্টার লা রাম্বলা থেকে ভিয়া লাইয়েতেনা পর্যন্ত বিস্তৃত। বার্সেলোনা গির্জা, ইদুদি পাড়া, সান্তা মারিয়া ডেল মার গির্জা, রোমান নেক্রোপলিস ছাড়াও বহু প্রাচীন এবং ঐতিহ্যশালী স্থাপত্য ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। মধ্যযুগের গথিক স্থাপত্য আছে ঠিকই, কিন্তু অনেক বাড়িঘরই বিংশ শতাব্দীতে তৈরি। বিশ্বমেলার জন্যে এই অঞ্চলটা ঢেলে সাজানো হয়েছিল সেই সময়ে, রোমান কালের কিছু চিহ্ন তাও রেখে দেওয়া হয়েছে।
গ্রানাদায় কয়েকদিন কাটানোর ফলে আমাদের স্থাপত্যের জ্ঞান ভালই হয়েছে। কোনটা গথিক, কোনটা রেনেসাঁ, কোনটা ত্রাম্পানেকো বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু এ ছাড়াও বহু শাখা আছে। ফ্রেঞ্চ গথিক আর স্প্যানিশ গথিক মোটেই এক নয়, সুক্ষ্ম তফাৎ আছে প্রতিটা দেশের রেনেসাঁ শৈলীতেও। তার ওপর একটা নির্মাণ করতে গিয়ে বহু জায়গায় একাধিক শৈলীর ব্যবহার হয়েছে, তাতে সব স্টাইল ঘেঁটে ঘ। আমরা তাও হাল ছাড়তে রাজি নই। তার ওপর বার্সেলোনায় এসে স্থাপত্য দর্শনে নতুন জিনিস যোগ হয়েছে। মডার্নিজম। অ্যান্টনি গাউদি বার্সেলোনাকে মডার্নিজম এর পূণ্যতীর্থ বানিয়ে গেছেন। হাজারে হাজারে মানুষ গাউদির তৈরি বাড়িগুলোকে নিয়ে প্রায় গবেষণা করে ফেলছে বার্সেলোনায় ঘুরতে এসে। ‘মডার্ন আর্কিটেকচার’-এর নানা শৈলী ব্যবহার করেছেন গাউদি, আমাদের নাগালের একেবারেই বাইরে।
আপাতত উনোর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা চলছে। কারের দেল বিসবের সরু গলিগুলো মাঝেমাঝেই এক একটা প্লাজায় শেষ হয়েছে। বসন্ত কালের নানা অনুষ্ঠানে এই প্লাজায় মানুষজন একে অপরের মাথায় চড়ে নানা রকম ‘মানব পিরামিড' তৈরি করে। এখানের বহু প্রাচীন রীতি এই 'কাস্তেল' তৈরি করা। অনেক ছোটবড় ক্যাফে আছে গলির মধ্যে, অনেকে গলিতেই ক্যানভাস টাঙিয়ে ছবি এঁকে চলেছে। পাবলো পিকাসোও শেষ জীবনে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছেন এই শহরে, সেই বাড়িটা আজকাল জাদুঘর করে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছে করলেই সেখানে গিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত সেই শিল্পীর সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসা যায়। আছেন সুরিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদোর দালিও। বার্সেলোনা থেকে ঘন্টাখানেক দূরে ফিগারেস শহরে দালির নিবাসকেও মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সুরিয়ালিস্ট কাজ দেখলে মনে অনেকরকম গল্পের বীজ উড়ে এসে বাসা বাঁধে। দালি মিউজিয়ামে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আমার কিন্তু সময় আর অর্থাভাবের কারণে যাওয়া হবে বলে মনে হয় না।
এল বর্ন অঞ্চলের গলিগুলোর মধ্যে দিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে মুখ তুলে তাকাতে হয়। এই সরু গলিতে দু’দিকের বাড়িগুলোর তিনতলা অথবা চারতলায় অনেক জায়গায় একটা সেতুর মতো আকৃতি তৈরি করা থাকে। অনায়াসে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু সেই ছোট্ট গলি পেরোনোর জন্যে তৈরি সেতুর কারুকাজ দেখলে মাথা ঘুরে যায়। গলির গায়ে সাজের লন্ঠন লাগানো আছে, লন্ঠনের ঝাপসা কমলা আলোয় রাতের বেলা গলিগুলোতে মায়াবী এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
ঘুরতে ঘুরতে এক সময় গির্জার সামনে চলে এলাম। প্রত্যেকটা শহরের মতন গির্জার সামনে সুবিশাল চত্বর, অজস্র মানুষের সমাবেশ হয়েছে গ্রীষ্মের সকালে। কর্পাস ক্রিস্টি উৎসবের সময় গির্জা চত্বরের নানা জায়গা 'ডান্সিং এগ' অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। একটা ডিম খালি করে জায়গাটা মোম দিয়ে বুজিয়ে ফোয়ারার জলের ওপর রেখে দেওয়া হয়, ফলে ডিমের খোলাটা জলের ওপর নাচতে থাকে। এই উদ্ভট কাণ্ড দেখতেও কাতারে কাতারে লোকজন সমবেত হয় এখানে।
গথিক শৈলীর গির্জা। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি করা অনেক গির্জার সৌন্দর্য আর নির্মাণের খুঁটিনাটি বার্সেলোনার গির্জাকে ছাপিয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখতে গেলে এত বড় গথিক গির্জা স্পেনে অন্তত খুব বেশি নেই। আজকাল সারা বছরেই বার্সেলোনায় টুরিস্ট থিকথিক করছে, আগের দশকে উডি অ্যালেন 'ভিকি ক্রিস্টিনা বার্সেলোনা' বলে একটা জনপ্রিয় ছায়াছবি পরিচালনা করার পর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আমেরিকান টুরিস্ট আসছে। লা রাম্ব্লার জমজমাট রাস্তার দু’পাশের ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, স্যুভেনিরের দোকানগুলো সারা বছরই ভর্তি। এই রাস্তার ওপরেই অবস্থিত লা বোকারিয়ার বাজার।
বার্সেলোনায় আসলে প্রত্যেকেই একবার না একবার এসে এখানে ঘুরে যায়। কোনও বাজারে যে রঙের এরকম ঘনঘটা হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মাছ, মাংস, সি ফুড, ফল, সবজির পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে নানা মুখরোচক স্থানীয় খাবার, পানীয়, আইসক্রিম। স্বদে রঙ্গে গন্ধে ভরপুর একেই বলে। আমাদেরও যথারীতি মাথা ঘুরে গেল সেখানকার কাণ্ডকারখানা দেখে।
প্লাজা নোভার দিকে এগোনোর সময় উনোর কাছ থেকে এই অঞ্চলের কয়েকটা রুদ্ধশ্বাস ঘটনার কথা জানতে পারলাম, যা গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে বার্সেলোনার মানুষজনকে রীতিমত আতঙ্কিত করে তুলেছিল। আজকাল গথিক কোয়ার্টারের শোভা দেখে বোঝার উপায় নেই যে একশ বছর আগে এখানে কী ভয়াবহ অবস্থা ছিল। ইউরোপের সবচেয়ে বড় গণিকালয় ছিল এই অঞ্চলেই। অপরিচ্ছন্ন বাড়িঘর আর নোংরা ছড়িয়ে থাকত শহর জুড়ে, স্বাস্থ্যসচেতনতার কোনও বালাই ছিল না বলে একের পর এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে প্রাণ হারাত শহরের মানুষ। চল্লিশ বছরের বেশি লোকে কদাচিৎ বেঁচে থাকত। প্লেগ আর ইয়ালো ফিভারের ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে স্পেনে। এতসংখ্যক মানুষ এখানে প্রাণ হারিয়েছে যে বার্সেলোনাকে মৃত্যুর শহর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল লাল কালিতে।
ইহুদিরা কিন্তু খুব পরিষ্কার পরিছন্ন ভাবে থাকত বলে ইহুদি পাড়ায় সাধারণত এই সব রোগ ব্যাধি ছড়াত কম। তাতে অবশ্য তাদের সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। নির্বোধ মানুষেরা ইহুদিদের স্বাস্থ্যসচেতনতার তোয়াক্কা না করে তাদের জাদুকর ঠাউরে বসল এবং নানা ভাবে অত্যাচার করতে শুরু করল।
স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের কারণে বার্সেলোনা থেকে কিশোরদের দলে দলে ধরে সেনাদলে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এমনিতেও বহু শিশু জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই মারা যেত রোগে ভুগে, তার ওপর যুদ্ধের ফলে ছোট ছোট ছেলেদের সংখ্যা একেবারেই কমে এল। অনেকে ছেলেমেয়েদের চোরাকুঠুরিতে লুকিয়ে রেখে দিত। এমন সময় রহস্যময় ভাবে এক এক করে বাচ্চারা নিখোঁজ হতে শুরু করল। কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা হল দিন কয়েক পর। এনরিকে মার্তি বলে একজন মহিলাকে গ্রেপ্তার করা হল সন্দেহের বশে কিন্তু প্রমাণ না থাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হল কিছুদিন পরেই। শহরে রটে গেল মার্তি আসলে একজন জাদুগরী আর ভ্যাম্পায়ার। অন্ধকার হলে সে আসল রূপ নিয়ে বার্সেলোনার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় শিকারের সন্ধানে। ততদিনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এ অঞ্চলে। শত সতর্কতা অবলম্বন করেও একের পর এক বাচ্চা নিখোঁজ হয়ে চলেছে। এই আতঙ্কের জের ক্রমেই বাড়তে লাগল। অনেক খোঁজাখুঁজি করে মার্তিকে আবার গ্রেপ্তার করল পুলিশ কিন্তু অনেক জিজ্ঞাসাবাদ আর তদন্তের পরেও বেশিরভাগ মামলার কোনও নিস্পত্তি হল না।
মার্তি ছাড়াও স্পেনের ইতিহাসে বহু সিরিয়াল কিলারদের আগমন হয়েছে। ফ্রান্সিসকা ব্যালাসতেরস, ম্যানুয়েল রোমান্সান্তা, হুয়ান ডিয়াজ দে গারায়ও প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে পুলিশের ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল একসময়। কিন্তু এনরিকে মার্তির গল্প কিংবদন্তি হয়ে বছরের পর বছর ধরে ঘুরে বেড়াতে লাগল বার্সেলোনায়। এই মহিলা ভ্যাম্পায়ারের অর্ধসত্য কাহিনি যে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এখানকার মানুষের স্মৃতিতে ভীতির সঞ্চার করেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
প্লাজা নোভার কাছাকাছি এসে খানিটা ব্রেক নেওয়া হল একটা ক্যাফেতে বসে। টুকটাক কফি খাওয়া হচ্ছে। অনেকে আবার স্থানীয় কেক আর শরবত চেখে দেখছে। মাইকেল আর বেনজির সঙ্গে আলাপ হল আমার। দুজনেই মালেশিয়া থেকে এসেছে, বেশ কয়েকদিন ধরে বার্সেলোনায় ঘুরছে। তাপাস খেয়ে তারা মুগ্ধ, এখানকার নাইটলাইফেরও নাকি কোনও তুলনা হয় না। পকেট থেকে বেশ টাকা বেরিয়ে গেছে, একদিন পরেই তারা ফিরে যাবে। কোনও মিউজিয়ামেই যায়নি তারা। দুজনেই বেশ মজার মজার কথা বলে, পরের বছর মেক্সিকতে ঘুরতে যাবে, সেই নিয়ে কথা চলতে লাগল।
বেনজিদের মত অনেক লোকের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে যারা পকেটে পয়সা থাকলেও মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালেরি ইত্যাদি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। পৃথিবীর অনেক জায়গাই ‘পার্টি টাউন’ বলে বিখ্যাত হয়েছে, কম পয়সায় খাবারদাবার পানীয় সবই পাওয়া যায়। স্পেনে তাপাস আছে বলে সুবিধেই হয়েছে গরীব ব্যাকপ্যাকারদের। পয়সা খরচ করে মিউজিয়ামে গিয়ে ইতিহাস বোঝার চেয়ে স্থানীয় মানুষজনদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে অনেকেই বেশি আগ্রহী। তাতে স্থানীয় পানাহারের সঙ্গে অনেক মজার মজার গল্প শুনতে পাওয়া যায়, অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হয়।
আমাদের ব্যাপার অবশ্য খানিক আলাদা। স্থানীয় লোকের সঙ্গে আড্ডা দিতেও আমরা সানন্দে রাজি, বলা যায় একপায়ে খাড়া, আবার মিউজিয়ামে গিয়ে শিল্পচর্চা করতেও আগ্রহ আছে পুরোদমে। কিন্তু দু’ জায়গাতেই টাকা থুড়ি ইউরো খসবে। পকেট আগেই আত্মসমর্পণ করেছে। অতএব আমরা বিনি পয়সার অভিজ্ঞতা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি। দিন কয়েকের ব্যাপার নয়, দীর্ঘ দিন কাটাতে হবে দেশে দেশে, টিপে টিপে খরচ করা ছাড়া উপায় নেই। তাতে খুব খারাপ কাটছে বলে মনে হচ্ছে না। সুপারস্টোর থেকে সবজি নিয়ে রান্না করে খেলে সস্তাই পড়ে, একান্তই না গেলে চলবে না, এমন জায়গা ছাড়া মিউজিয়াম অথবা দ্রষ্টব্যের টিকিট কাটি না। বিনি পয়সার যাওয়ারও কত জায়গা আছে, অনেক জায়গায় শেষমেশ আমাদের যাওয়াও হয় না।
উনোর সঙ্গে গথিক কোয়ার্টারের নানান জায়গা দেখে একসময় তাকে বিদায় জানালাম। লা রাম্বলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে একসময় সান্তা কাটারিনা মার্কেটে উঁকি মেরে বাসে চড়ে কাসা বাতিওর দিকে চললাম। বার্সেলোনায় প্রায় চল্লিশটার কাছাকাছি মডার্নিস্ট বিল্ডিং আছে, বেশিরভাগই অবশ্য গাউদি তৈরি করে গেছেন। এর মধ্যে এখানকার অপেরা হাউস, কাসা বাটিও, পার্ক গুয়েল আর কাসা মিয়া বিপুল জনপ্রিয়। সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া গির্জাকেও আধুনিক স্থাপত্যের আওতায় ধরতে হবে। এছাড়াও গলিঘুঁজিতে বহু আনকোরা আধুনিক বাড়িঘরের সমাবেশ হয়েছে।
মডার্নিজম কথাটা অবশ্য স্থাপত্য জগতের একচেটিয়া নয়। পৃথিবীর বহু জানা অজানা শিল্প আন্দোলনকে মডার্নিজম নাম দেওয়া হয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। সেইসবের প্রত্যেকটাই যে খুব আধুনিক, সেটা অবশ্য মনে হয় না। নিকারাগুয়ান কবি রুবেন দারিও উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে 'স্প্যানিশ মডার্নিজম'-এর প্রতিষ্ঠা করে খ্যাত হন। আধুনিক স্প্যানিশ কবিতায় তাঁকে প্রায় পিতামহের আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে তিনি অনেকটাই ফ্রেঞ্চ রোমান্টিক আর প্রতীকবাদী কবিদের অনুকরণ করে গেছেন। তাঁর নিজের কথাতেই— “Modernism is nothing more than Spanish verse and prose passed through the fine sieve of the good French verse and the good French prose."
বাসে করে কাসা বাতিও আসতে বেশিক্ষণ লাগল না। বাইরে যা গরম পড়ছে, বাসের শীততাপনিয়ন্ত্রিত সিটে বসে থাকতেই ভালো লাগে। ইউরোপে এসে যে এইরকম হতচ্ছাড়া গরমের কবলে পড়ব সেটা আমি ভাবতে পারিনি। প্যাসেজ দে গ্রাসিয়ার রাস্তায় নেমে নেমে গুটি গুটি এগোলাম কাসা বাতিওর দিকে। কাসা বাতিওতে এককালে গাউদির পরিবার বসবাস করেছে। ‘হাউস অফ স্কেলিটন’ বলে এই বাড়ির ছবি এত জায়গাতে দেখেছি যে চিনতে অসুবিধে হয় না। না দেখলেও কেউ একবার দেখেই ব্যাপারটা বুঝে যাবে। বাড়ি বানানোর সময় সরল রেখা ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে দরজা, জানলা, উঠোন সবকিছুই এঁকেবেঁকে মানুষের খুলির মতন কিম্ভূতাকার আকার নিয়েছে। টাইলের রংবেরঙের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে করা তৈরি করা বিভিন্ন আকৃতি আর নকশা দেখলে চোখ আর সরতে চায় না। কাতালান স্থাপত্যে এই শৈলী 'ট্রান্সেডিস' নামে প্রচলিত। পার্ক গুয়েলের নানা অবিস্মরনীয় শিল্পাকৃতিও এই ট্রান্সেডিস ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
Work from Picasso |
Park Guell |
প্যাসেজ দে গ্রাসিয়ার অন্য দিকেই অবস্থিত কাসা মিয়া। গাউদির আরেক নাম করা শিল্পনির্মাণ। চুনাপাথর দিয়ে বাড়ির ভিতরটা প্রায় গুহার মত করে ফেলা হয়েছে। গাউডির একান্ত ইচ্ছা ছিল কাসা মিয়ার বাসিন্দারা যেন পরস্পরের সঙ্গে আলাপচারিতা করে প্রতিদিন, তাই এখানে লিফট আছে প্রতি একতলা অন্তর অন্তর, যাতে এক তলার লোক অন্য তলায় যেয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অন্য তলার বাসিন্দাদের সঙ্গে মোলাকাতের সুযোগ পায়। এককালে বসবাসের জন্যে নির্মিত হলেও আজকাল প্রতিটা নির্মাণই হেরিটেজ সাইট। নিজের কাজ নিয়ে এত মাতামাতি হতে দেখলে সম্ভবত খোদ গাউদিও একটু অবাকই হতেন। জীবনকালে তিনি প্রবল ধার্মিক, মুখচোরা আর একাকী ব্যক্তি ছিলেন। ট্রামে কাটা পড়ে মারা যাওয়ার সময় তার সাধারণ পোশাক দেখে লোকে তাঁকে ভিখারী ভেবে বসেছিল, কেউই রাস্তায় পড়ে থাকা এই শিল্পীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।
পৃথিবীর সব জায়গাতেই লক্ষ লক্ষ শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতারা জীবনকালে কোনও পরিচিতিই পাননি। গাউদি বরং সেই দিক থেকে ভাগ্যবান ছিলেন। মুখচেনা না হলেও বহু লোকে তাঁর নাম জানত, তাঁর কাজ সমাদৃত হয়েছিল জীবনকালেই। বরঞ্চ স্পেন আর বিশেষ করে কাতালোনিয়ার বহু শিল্পী আর কবিরা গৃহযুদ্ধ আর ফাসিস্ট শাসনের সময় দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে গেছে, মৃত্যুর পরেও তাঁদের লেখা, তাঁদের চিন্তাধারা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। উনবিংশ শতাব্দীর বহু স্পানিয়ার্ড কলম কালের গর্ভে পড়ে আত্মসমর্পণ করেছে, হোয়ান রামোন হিমেনেথ আর গার্সিয়া লোরকার মতো কয়েকজন ছাড়া পৃথিবীর মানুষ অন্যদের কথা তেমন করে জানতেও পারেনি। যদিও স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলা কালে অনেকের মত হিমেনেথও দেশ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশত্যাগ করার এই যন্ত্রণা তার কবিতার দর্শনেও আলোড়িত হয়। এই সময় থেকে তাঁর কবিতায় গভীর এক দর্শনের চিহ্ন পরিস্ফুটিত হয়, যেখানে তিনি বার বার আন্দালুসিয়ার প্রিয় পরিবেশকে চরিতার্থ করে তোলেন। হিমেনেথের নিজের কথায়...
ঘুম যেন সেতু
যোগাযোগ আজ আর আগামী কালের।
নিচে তার, স্বপ্নের মতন,
বয়ে যায় জলধারা, ভেসে যায় হৃদয় আমার।
এই ভেসে যাওয়া হৃদয়ের পুনরুদ্ধার করার জন্যে যদি সেই কালে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম থাকত, হয়তো অনেক কিছুই সঞ্চয় করে রাখতেন তাঁরা। আজকাল বহু শিল্পী শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে এগিয়ে আসছেন। বার্সেলোনা নিবাসী ইলাস্ট্রেটর কনরাড রসেদ, গায়ক জোসেপ জোর্ত, জ্যাজ সঙ্গীতকার অক্টাভিও বুগনি প্রভৃতি শিল্পীদের জনপ্রিয়তার অনেকটাই সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে।
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে শিল্প থেকে বিপ্লব, সাহিত্য থেকে রাজনীতি সব কিছুর বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাতে ভালো ও মন্দ, দুইই আছে। আজকাল দিনে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক আর টুইটারের হাত ধরে। এককালে বার্সেলোনা বিপ্লবের আখড়া ছিল। যত আন্দোলন আর বিদ্রোহ এখানে হয়েছে, এত শ্রমিক আন্দোলন আর কোনও শহরেই হয়নি। বার্সেলোনায় রিপাবলিকান বিপ্লবীদের ঝটিকা আক্রমণের মোকাবিলা করতে ফ্রাঙ্কোকে হিমশিম খেতে হয়েছিল সেই সময় অথচ স্পেনের বিপ্লব কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও ফ্রাঙ্কোর শাসনকালে সোশালিস্ট আর অ্যানার্কিস্ট দলের গুপ্তযুদ্ধের কথা আর ক’টা লোকেই জানতে পেরেছে?
কাসা মিয়া দর্শন করে টুক করে আবার বাসে উঠে পড়লাম। বাসে চেপে বসে থাকব দিব্যি, ফ্রি পাস নেওয়াই আছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, মানুষজন হুড়মুড় করে পিছনে দৌড় লাগবে, বসে বসে দেখো! সস্তায় এর চেয়ে ভালো বিলাসভ্রমণ হয় না।
স্পেনের দিন প্রায় শেষ হয়ে এল। একটা দেশকে ভালো করে বুঝতে গেলে কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েক মাস কিছুই নয়। এক জীবনে তো নয়ই। একটা মফস্বলি টাউন বা কুড়ি ঘর মানুষের গ্রামকেও নয়, শহর বা দেশ তো অনেক দূরের কথা। যেটুকু সম্ভব, সেটা হল সেখানকার মানুষের সঙ্গে জীবনের কিছুটা সময় ভাগ করে নেওয়া। চেনা-অচেনা কিছু মানুষকে নিজের যাপনের সঙ্গী করে নেওয়া। কয়েকটা মুহূর্ত, কিছু উপলব্ধি আর একরাশ স্মৃতি সঞ্চয় করা! অর্থহীন আলাপচারিতা আর নির্বোধ কথোপকথনের নেপথ্যে অবচেতনে চলতে থাকা এই অনুসন্ধানটুকুই শুধু আমরা করে যেতে পারি...একটা শহর বা দেশের বর্তমান, ইতিহাস বা ভবিষ্যৎ যে শুধুমাত্র সেখানকার মানুষ, এই অনুভূতিটা যতদিন না ভিতর থেকে উমড়ে আসবে, এই যাত্রা অবিরত থাকবে।
সেই যাত্রাই চলছে। বাইরে আর ভিতরে। জীবন ও মননে। অবিরাম এক শহর থেকে অন্য শহরে চলেছি। হয়তো এক কণা বোঝা গেল, বাকিটা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে গেল। কিছু সমুদ্রের বালি লেগে রইল, কিছু আন্দালুসিয়ার সুবাস পিছু নিল। স্মৃতিতে জায়গা করে নিল কয়েক চামচ গ্রীষ্মের মুহূর্ত। ভিড় করে রইল কিছু স্বাদ, ছবি, কবিতার ছন্দ। আর অনেক বন্ধু। এইটুকুই তো সঞ্চয়।
গ্রীষ্মে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই লোকে শর্ট আর টি শার্ট পরেই থাকে। ব্যাকপ্যাকিং এর নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দুটো শর্ট আর দুটো জিন্স নিয়ে এসেছি, কিন্তু গরমের চোটে জিন্স ব্যাগেই রয়ে গেছে। প্রাইমার্কের সুপারস্টোরে সস্তায় প্রচুর জামাকাপড় পাওয়া যায়, গুগল ম্যাপে দেখে একটা প্রাইমার্কের সামনে নেমে পড়লাম। সস্তায় একটা শর্ট পেলে নিয়ে নেব, এই মতলব! এই আইরিশ ব্র্যান্ড ইউরোপে প্রায় প্রতিটা বাড়িতে জায়গা করে নিয়েছে। এত ভালো আর সস্তার জামাকাপড় আমাদের দেশেও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ! বেশিরভাগ জিনিসই অবশ্য ভারত, বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি হয়।
পেল্লায় শপিং মল, তার দুটো তলা জুড়ে প্রাইমার্কের দোকান। এ অবশ্য কিছুই নয়, মাদ্রিদে ছয়তলা প্রাইমার্কের রাক্ষুসে প্রাসাদপম দোকান দেখে এসেছি। দেখে সত্যি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম। জামাকাপড়ের তেমন শখ নেই যদিও, রোদ থেকে শীততাপনিয়ন্ত্রিত জায়গায় এসে উল্টেপাল্টে জিনিসপত্র দেখতে খানিকক্ষণ খারাপ লাগে না। তারপর অবশ্য বিরক্তি এসে যায়, বহু লোকে ঘন্টার পর ঘন্টা এই জামা ওই জুতো নিয়ে ট্রায়াল রুমে দৌড়াদৌড়ি করে, তাদের ধৈর্য আর উৎসাহ দেখে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বাড়ন্তের হেতু বোঝা যায়।
প্রাইমার্কে অবশ্য শর্টস পাওয়া গেল না। ঠিকঠাক মাপের সস্তার জিনিস আগেই বিক্রি হয়ে গেছে, অতএব হাঁটতে হাঁটতে মল থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়লাম। শহরের এইদিকে ট্রাম লাইন আছে খানিকটা। স্পেনে সব জায়গায় ট্রামের চলন নেই, বার্সেলোনাতে ট্রাম দেখে বেশ লাগল। ইউরোপের অধিকাংশ শহরেই ট্রাম চলে মেট্রো আর বাসের পাশাপাশি, ট্রামে বসলে বেশ একটা অন্যরকম আমেজ তৈরি হয় মনে। ট্রামে করে খানিকটা দূরে গিয়ে আবার বাস পাল্টাতে হবে। কাল রাতে সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার গির্জা ভালো করে দেখা হয়নি, দিনের আলোয় সেটা না দেখলে লোকজন বক দেখাতে পারে। সুতরাং দিনের আলো থাকতে থাকতে গাউদির শ্রেষ্ঠ সৌধের উদ্দেশে চললাম।
সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার কাছেই একটা সুপারব্লক থাকার ফলে অনেকটা জায়গা পথচারীদের জন্যে নির্দিষ্ট। গির্জার কাছেই মেট্রো স্টেশন আছে, মাটির নিচে দিয়ে মেট্রো চললে কম্পনে ঐতিহ্যশালী এই গির্জার কোনও ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না, এই নিয়ে একসময় বহু তর্ক বিতর্ক হয়েছে। বর্তমানে গির্জার গেটের একশ মিটারের মধ্যেই মেট্রো স্টেশন অবস্থিত, যন্ত্রপাতির সাহায্যে কম্পনের তীব্রতা গণনা করা হয়ে নিয়মিত ভাবে। হিসেব কষে বার্সেলোনার অন্য অনেক ভূমিগত মেট্রো স্টেশন একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে একই আশঙ্কায়, পরিত্যাক্ত এই স্টেশনগুলো নিয়ে শহরের অলিগলিতে অনেক ভৌতিক ঘটনার কথাও কানে আসে।
মাটির নিচের পরিত্যাক্ত স্টেশনগুলো ছাড়াও অলৌকিক কাহিনী চালু আছে মন্টজুইক পাহাড়ের দুর্গ নিয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ফ্রাঙ্কোইস্ট যুগ পর্যন্ত বহু মানুষকে বন্দী করে নির্যাতন করা হয়েছে এই দুর্গে। তাদের অতৃপ্ত আত্মা আজও নাকি দুর্গের ভিতরে ঘুরে ঘুরে মরে।
আপাতত অলৌকিক কাহিনী ভুলে আমরা গির্জার দিকে মনযোগ দিয়েছি। দিনের বেলায় সদর দরজার বহির্ভাগের অলঙ্করণগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। স্তম্ভগুলোর সোনালি ছাদগুলোতে নাকি আসল সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। যীশুর আধুনিক শিল্পাকৃতি গড়ে তোলা হয়েছে গাউদির নকশা অনুযায়ী। তিনটে ‘façade’ অথবা সদর দরজার প্রত্যেকটিতে খোদাই করা আছে বাইবেলের নানা বিষয়ভিত্তিক কাহিনী! স্তম্ভের মাথায় খেয়াল করলে স্যালাম্যান্ডারদের আকৃতি দেখতে পাওয়া যায়। গির্জার জানলাগুলোর কাঁচের ওপর অসামান্য চিত্রকলার নিদর্শন আছে, যদিও টিকিট না থাকলে ভিতরে ঢোকা যায় না। টিকিটের যত চাহিদা, তত টিকিট নেই। অতএব মাস কয়েক আগে থেকেই টিকিট না কিনে রাখলে ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়বে কি না বলা মুশকিল!
দু’ চোখ ভরে গির্জা দর্শন করে আমরা উদরপূর্তি করতে কেএফসিতে ঢুকে পড়লাম। সকাল থেকে হেঁটে হেঁটে পায়ে ব্যথা হয়ে গেছে, মন্টজুইক দুর্গ অথবা বাঙ্কার দেল কারমেলের সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়া সম্ভব নয়, মাথার ওপর সূর্য চকচক করলেও ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। পার্ক গুয়েলে খোঁজ করে দেখা গেছে কালকের টিকিট আছে, আজকের সব শেষ, সুতরাং সেখানেও যাওয়া হবে না।
ব্যাকপ্যাকিং-এর নেশায় মশগুল বাঙালি মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা অবিরাম 'ওয়াক এন্ড টক' করে চলেছে, নিদেনপক্ষে খানিকটা মুড়ি তেলেভাজা পেলেও না হয় হত! রেগে মেগে পা দুটো আত্মসমর্পণ করেছে, কী আর করা! অতএব আকাশের রং দেখতে শেষমেশ বালুকাবেলার দিকে রওয়া হওয়া গেল। লক্ষ লক্ষ ইউরো খর্চা করে দীর্ঘ সৈকত তৈরি করেছে এরা, অন্তত কয়েকটা বিচ আরো না দেখলে চলছে না।
বার্সেলোনেটা বিচের খানিকটা জায়গা জুড়ে পঞ্চাশের বেশি পাথরের তৈরি বসার জায়গা বানানো হয়েছে। সমুদ্র সৈকতের হইচই থেকে কিছুটা দূরে এই জায়গাটায় অনেকে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারে। আমার পাশের চেয়ারে এক বয়স্ক মহিলা বসে এখনকার জনপ্রিয় স্প্যানিশ লেখক হাভিয়ের মার্তেসের লেখা একটা বই পড়ছেন, কয়েকজন জামা খুলে রোদ লাগাচ্ছে গায়ে, বাকিরা শুয়ে বসে আছে। বসে বসে সমুদ্রের সঙ্গে নিঃশব্দ বার্তালাপ চলতে লাগল। সমুদ্রের বুকে চোখ রেখে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে একসময় চোখ জুড়িয়ে আসে। সূর্যের পড়ন্ত আলোর গালে টোকা দিয়ে যায়, তারপর আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় দিগন্তে...ঠিক যেন হিমেনেথের কবিতা..
হারিয়ে ফেলছি, হারিয়ে ফেলছি, হারিয়ে ফেলছি তাকে !
… সে তো চলে গেল !
আর ক্ষণিকের সঙ্গে
হারিয়ে ফেলেছি অনন্তকাল আমি।
অনেক বছর আগে ইংরেজ লেখক জর্জ ওরওয়েলের লেখা 'হোমেজ টু কাতালোনিয়ার' খানিকটা অংশ পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল স্পেনে বুঝি এখনও গৃহযুদ্ধ চলছে। ফ্রাঙ্কো মারা গেছেন বটে কিন্তু অব্যবস্থা আর যুদ্ধের আবহাওয়া একই রকম আছে। সেই ছবিটা বদলাতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। জর্জ ওরওয়েল '১৯৮৪' লিখে ক্লাসিক লেখকের তকমা পেয়ে গেছেন, অ্যানিম্যাল ফার্ম আর ১৯৮৪-এ ডিস্টোপিয়ান সমাজ নিয়ে এখনও উত্তপ্ত আলোচনা হয়ে বইপোকাদের আড্ডায়। এই লেখাগুলো যে অন্য এক যুগে লেখা হয়েছিল সেই কথা আর তখন মনে থাকে না। আগেকার পাঠকরা নামকরা বই অথবা কবিতা পড়ে অচেনা দেশ বা শহর সম্পর্কে একটা ছবি তৈরি করে নিত মনে, আদতে বর্তমান চরিত্রের সঙ্গে সেই ছবির কোনও মিলই থাকত না। টিভি আর ইন্টারনেটের যুগে অবশ্য আর সেই উপায় নেই, আজকাল সারা পৃথিবীর সিনেমা আর ডকুমেন্টারি ইন্টারনেটে দেখে নেওয়া যায়, মোবাইল ফোন নোটিফিকেশনে দুনিয়া রাজ্যের খবর এসে ধাক্কা দিচ্ছে নিমেষের মধ্যে, আগেকার মত কল্পনার ছবি আর মনে আঁকা হয় না। তিরিশ বছরে যেইভাবে বার্সেলোনা বিশ্ব মানচিত্রে উঠে এসেছে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, সেরকম নজির খুব বেশি নেই।
পরের দিন সকালে সেজেগুজে শহর অভিযানে বেরিয়ে প্রথমেই এসে জুটলাম পার্ক দে লা সিউতেদেলাতে। বার্সেলোনা শহরে এবং স্পেনে আজই আমাদের শেষ দিন, আবার পথে বেরিয়ে পড়ব অন্য দেশের উদ্দেশে। আমার চেয়েও বেশি মন খারাপ আমার সঙ্গিনী এবং স্প্যানিশ দিদিমণির, এর পর তার ভাষাচর্চা কতটা হবে কে জানে? কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্পেনের জীবনচর্চার সঙ্গে আমাদের সদ্ভাব হয়েছে। নতুন কোনও জায়গায় গিয়ে পড়লে অপরিচিত বলে মনে হয় না। বিরামহীন ভ্রমণের মধ্যেও স্পেনের সংস্কৃতির মধ্যে স্বস্তিতে দিন কাটিয়েছি। মানুষের মন স্থিতিশীল হতে চায়, ট্রেনের দুদিনের যাত্রায় সেই জায়গার সঙ্গেই তার মায়ার টান জন্মে যায়। কলেজ অথবা হস্টেল ছেড়ে যাওয়ার সময় আমি বহু ছাত্রছাত্রীকে কান্নাকাটি করতে দেখেছি। মন খারাপ যে করবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে? মায়া! অবুঝ, অবিচ্ছেদ্য মায়া জড়িয়ে আছে আমাদের প্রত্যেককে। একদিন সব কিছুই ছেড়ে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হয়।
বার্সেলোনার নামকরা পার্কের একটি প্রধান পার্ক লা সিউতেদেলা। ওয়ার অফ সাকসেশন যুদ্ধে জয়প্রাপ্তির পর স্পেনের রাজা ফিলিপ পঞ্চম এইখানে এক দুর্গের নির্মাণ করেন। সেকালে ইউরোপে এত বড় দুর্গ আর ছিল না। এর পর বহু বার ভাংচুর আর পুনঃসংস্কার হলেও সেই দুর্গ আজও বহাল তবিয়তে আছে। পার্কের প্রায় কেন্দ্রে এখানকার নামকরা 'কাস্কাদা' বা ফোয়ারার সৌধ অবস্থিত। সেই সোনালি রথ আর অশ্বের ছবি তুলতে লোকের লাইন পড়েছে। বৃহৎ এলাকা নিয়ে তৈরি এই পার্কের এক প্রান্তে বার্সেলোনা শহরের চিড়িয়াখানাও অবস্থিত। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এইখানেই থাকত পৃথিবীর বহুচর্চিত অ্যালবিনো অর্থাৎ সাদা গোরিলা 'স্নোফ্লেক'। তাকে নিয়ে কত ডকু আর ছায়াছবি হয়েছে সেই সময়ে, তার কোনও হিসেব নেই।
সিউতেদেলা পার্ক থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লা রাম্বলার দিকে এগোলাম। নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য না ভেবে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলেও অনেক কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইউরোপের শহরগুলোতে গাদা গাদা স্মৃতিসৌধ, জাদুঘর, গির্জা ছড়িয়ে থাকে শহর জুড়ে। প্রত্যেকটার সঙ্গেই ইতিহাসের কোনও এক বিশেষ অধ্যায় জড়িয়ে আছে। প্যাসেজ দে পিকাসো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিকাসো মিউজিয়াম ছাড়িয়ে, প্লাজা দে কাতালোনিয়াকে পাশ কাটিয়ে একসময় গুয়েল প্যালেসের সামনে চলে এলাম। ইউসেবি গুয়েলের এই বাড়িও অ্যান্টনি গাউদির কাজের এক নমুনা। ইউসেবি গুয়েল সে সময় বার্সেলোনার অন্যতম ব্যবসায়ী হওয়া ছাড়াও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গাউদির কাজ দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে নিজের বাড়িও গাউদির আধুনিক নকশার অনুকরণে নির্মিত করেছিলেন। বার্সেলোনার মাথায় আধুনিক এক আবাসন সমিতি নির্মাণ করার শখ তাঁর বহুকালের ছিল। সেই আবাসন সমিতি তৈরি হয়েছিল ঠিকই, যদিও সাধারণ মানুষের বসবাস সম্ভব হয়নি। গাউদির তৈরি রূপকথার সেই জগৎই আজ পার্ক গুয়েল।
দুপুরবেলা এক পাকিস্তানি দোকান থেকে খেয়ে গির্জার সামনে এসে পড়েছি। দুপুরবেলা এই অঞ্চলে মডার্নিজম নিয়ে অনেক ওয়াকিং ট্যুর হয়ে থাকে, একটা ট্যুরে ঢুকে পড়লাম আমরাও।
আমাদের গাইড মার্কো তার গতানুগতিক চাকরি ছেড়ে গাইডের কাজ নিয়েছে, সে আমাদের গথিক কোয়ার্টারের অভ্যন্তরে থাকা অপেক্ষাকৃত অজানা বাড়িগুলোতে নিয়ে যাচ্ছে এক এক করে। গলির মধ্যে কোথাও ড্রাগন এসে বাড়ির মাথায় বসেছে, কোথাও আবার পাথরের তৈরি পুষ্পবীথিকা ক্যাফের দেওয়াল বেয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কত কত সুন্দর বাড়ি যে লুকিয়ে আছে এই জায়গায় তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
এখানকার অনেক ক্যাফেই এককালে শিল্পীদের আড্ডা ছিল। ১৯০১ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে এসে পিকাসো এই ক্যাফেগুলোতে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন। মাদ্রিদের ‘সান ফার্নান্দো রয়্যাল একাডেমি’ ছেড়ে প্রাণের বন্ধু কাসাজেমাসকে সঙ্গে নিয়ে ফরাসি দেশে গিয়েছিলেন বহু আশা নিয়ে, কিন্তু কাসাজেমাস প্রেমিকার কাছে আঘাত পেয়ে আত্মহত্যা করায় পিকাসো ভয়ানক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে সেই দুঃখ প্রতিফলিত হচ্ছে তখন। বার্সেলোনায় ফিরে এসে উজ্জ্বল রং পরিহার করে বেছে নিলেন অনুজ্জ্বল নীল রঙ। এর সঙ্গে ঘন এবং প্রায় কালো রঙ ব্যবহার শুরু করলেন। এটাই পিকাসোর জীবনে নতুন বা বিশেষ অধ্যায় বলে পরিচিত। এককালে রোমান্টিক ছবি তাঁকে টানত, সেই সব কোথায় হারিয়ে গেছে। ক্যানভাসে শুধু ফুটে উঠছে বেদনা ও বিষন্নতার ছবি। ভিক্ষুক, অপুষ্টির কবলে থাকা পথচারী, পরাজিত মানুষদের ছবি আঁকতে শুরু করেছেন নিজের মনে। বাস্তববাদী রেখাগুলো গেছে হারিয়ে, শরীরগুলো বিচিত্র ভাবে বেঁকেচুরে গেছে, শীর্ণ দেহের ছবিগুলো দেখে মুগ্ধতা পরে আসে, আগে অসহজ হয়ে ওঠে মন। কোমলতার লেশমাত্র পিকাসোর জীবনের এই অধ্যায়ে, শুধু আছে সমাজের নিম্নশ্রেনীর মানুষের বাস্তব জীবনের কাহিনী।
ঘন্টাদুয়েক মার্কোর সঙ্গে ইতিহাসের নানা গল্পকাহিনী আর গাউদির জীবনের কয়েকটা অধ্যায়ে উঁকি মেরে আমরা চললুম পার্ক গুয়েলের দিকে। টিকিট কাটাই ছিল। পার্ক গুয়েল শহরের বেশ উচ্চতায় অবস্থিত, প্রায় সারা শহরটা আর সমুদ্রের অপূর্ব শোভা দেখা যায় সেখান থেকে।
১৯০০ সালে যাত্রা শুরু হওয়া নয়নাভিরাম এই পার্কের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯১৪ সালে, এবং এইখানেরই গাউডি কাটিয়েছেন জীবনে শেষ বছরগুলো। পার্ক গুয়েল এককথায় রূপকথার রাজ্যই, সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া অথবা কাসা বাতির মত স্থাপত্যের জটিলতা এখানে অনুভব হয় না বরং রঙের প্রাচুর্য চোখকে মুগ্ধ করে। টাইল্সের ভাঙ্গা টুকরো দিয়ে অলংকৃত স্যালাম্যান্ডারের আকৃতি, এমনকি গাছের আদলের দেওয়ালগুলোতে পাখির বাসাও তৈরি করেছেন গাউদি। কাঠ আর পাথর দিয়ে নির্মিত গ্রীক থিয়েটারের আদলে তৈরি দালান দেখলেও ধাঁধা লেগে যায়। এস্কালিন্তা ডেল দ্রাক বা ড্রাগনের আদলের সিঁড়িতে বহু মানুষের ছবি তোলার উন্মাদনা, ছাদের সালা হিপস্তিলা অংশ থেকে কাসা দেল গুয়ের্দার আর বহুদূরে থাকা সমুদ্রের অনবদ্য শট পাওয়া যায়, সেখানে যেতে লোকে লাইন দিচ্ছে।
সময় নিয়ে সব কিছুই দেখা হল। এত ভিড় আমার নাপসন্দ, তার ওপর আমাদের এই দেশে আজকেই শেষ সূর্যাস্ত দর্শন। ম্যাপে দেখেছিলাম পার্ক গুয়েলের পিছনে পাহাড়ের ওপর বেশ খানিকটা চড়াই হেঁটে গেলে একটা ক্রস আছে, বেশ নিরিবিলি জায়গাটা। সেটার উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। পিছনের পাহাড়ের অনেকটা জুড়ে খানকতক মিউজিয়াম আছে, হেঁটে হেঁটে সেগুলোতে যাওয়া যায় হাতে সময় থাকলে। প্রায় সারা বার্সেলোনা শহরটাই নিচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে এখান থেকে, একদম শেষে সমুদ্রের নীল বিস্তার।
প্রায় মিনিট তিরিশ চড়াই হেঁটে ক্রসের কাছে পৌঁছালাম। এই জায়গাটার নাম তুরো দে লেস ট্রেস ক্রেউস। পাথরের ঘোরানো সিঁড়ি ভেঙ্গে একটা গোল পাথরের ওপরে ক্রস টা বসানো আছে। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে সেখানে।
বার্সেলোনা শহরের বাড়িঘর, রাস্তাপাট, বন্দরের নৌকো, জাহাজগুলো খেলনার মত লাগছে। আর সমুদ্রের নীল রঙের ওপর আলোতে করে ছড়িয়ে পড়ছে সূর্যাস্তের সিঁদূরে লাল রং। এই বিচিত্র রঙের প্রদর্শনী ছুঁয়ে যাচ্ছে বার্সেলোনা শহরকে। অস্তমিত সূর্যের আলোর এই বিচ্ছুরণ আমাদের কপালেও এসে লেগেছে। চুল উড়ছে। চোখের পলক ঢেকে দিতে চাইছে দামাল হাওয়া। তাও জোর করে চেয়ে আছি সামনের দিকে। এই মুহুর্ত দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকুক স্মৃতির ভাঁড়ারে, যেখানে সঞ্চয় করা আছে পড়ন্ত সূর্যের আরো অনেক অমলিন মুহূর্ত। এইবারের মতো বিদায় জানানোর পালা এসেছে। হয়তো ফিরে আসব, হয়তো নয়, কিন্তু স্পেনের ছবি চোখে লেগে থাকবে চিরকাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন