বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

আজ জানে কী জীদ না করো

 


সৈকতদা মানে সাহিত্যিক সৈকত মুখোপাধ্যায় একটা পোস্ট দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে, তাতে একটা লোকের কথা ছিল। মাঝেমাঝে রাতের একান্তে বারান্দায় একা চেয়ার টেনে বসেন। কানে হেডফোন, দুই আঙুলের মধ্যে সিগারেট নিয়ে একটা গান শুনে যান... একটাই গান।
আজ যানে কি জীদ না করো...
সৈকতদার অনেক লেখা পড়েই মনের ভিতর আবেগী বাতাস উমড়ে আসে, মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতি। কিন্তু এই পোস্টটা আমার কাছে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে রইল। কারণ, এই পোস্টটা পড়ার কিছুক্ষণ আগেই আমি আবিষ্কার করেছি, এই গানটার পিছনে থাকা অনেক কথা। এই গান, এই কম্পোজিশন তৈরি হওয়ার পিছনে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা আছে, ঐশ্বরিক কোনও উপায়ে বহু মানুষের জীবনও জড়িয়ে গিয়েছে এই গানের সৃষ্টির সঙ্গে। ঘটনাগুলো হয়তো অনেকের কাছে গুরুত্ব পাবে না, কিন্তু যে দু'জন এই গানটাকে ম্যাজিকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, যাদের দৌলতে একজন মানুষ সারা জীবন এই একটা গান শুনেই কাটিয়ে দিতে পারে, সেই ফরিদা খানম আর ফাইয়াজ হাশমি যখন এই কথা বলেন, তখন অস্বীকার করার উপায় থাকে না।
ইতিহাসের একটা আশ্চর্য দিক হল, যতদিন না তুমি সেটা জানছ, সেটা তোমার কাছে নতুন বলেই মনে হয়। দিন কয়েক আগে আমি একটা হিন্দি বই পড়ে শেষ করেছি—রাজকুমার কেশওয়ানির লেখা 'কশকোল'—তাতে মন্টো সহ সে যুগের বহু আফসানা-গর, শায়র আর শিল্পীদের কথা আছে। বোম্বাইয়ের ফিল্ম জগতের কিছু কিছু প্রসঙ্গও এসেছে। ইন্টারেস্টিং বই। এমনিতেও প্রাক স্বাধীনতা যুগের শিল্পী সমাজ ও সিনেমা নিয়ে আমার খানিকটা আগ্রহ আছে, বিশেষ করে ১৯১০ সাল থেকে ১৯৫০-এর সময়টা... নানান চিত্তাকর্ষক কিসসা কাহিনি আছে, অনেক কিছু জানা যায়। তাই মাঝেমধ্যে সময় পেলে ইউটিউব আর স্পটিফাই নেড়েচেড়ে দেখি, যদি কিছু পাওয়া যায়। সেইদিন সন্ধ্যেবেলাও এই মতলবে ইউটিউব খুলেছি, পাকিস্তানের গায়ক আলি শেঠির সঙ্গে ফরিদা খানমের একটা পুরোনো ইন্টারভিউ দেখছি। দেখতে দেখতে মনে হল আমি স্ট্রেট একশো বছর পিছিয়ে গিয়েছি। আমার চোখের সামনে একটা সিনেমা চলছে। এই সিনেমায় প্রচুর চরিত্র আছে, তাদের অনেকের সঙ্গে আমাদের আলাপও আছে। ফরিদা খানম আর ফাইয়াজ হাশমিও আছেন, কিন্তু গল্প শুরু হয়েছে আরো আগে। বিংশ শতাব্দীর প্রায় গোড়ায়, কলকাতায়।
১৯০২ সালে মদন বলে একজন পারসি ভদ্রলোক ময়দানে বায়েস্কোপ দেখানোর ব্যবসা শুরু করেন। ট্রাভেলিং সিনেমার সে যুগে রমরমা ছিল, যদিও আধুনিক চলচ্চিত্র তৈরি হতে তখন অনেক দেরি। ময়দানে স্টেজও তৈরি করা হত, বিনোদনের জন্য গাইয়ে-বাজিয়েরাও থাকত। একদিকে সিনেমা, অন্যদিকে নাটক। কম্বো অফার। ভিড় উপচে পড়ত। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবসায় কিছুটা আকাল পড়লেও পরে সেটা পুষিয়ে যায়। ১৯১৭ সালে 'রাজা হরিশচন্দ্র'-এর গল্পের উপর নির্ভর স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করে হইচই ফেলে দেয় তারা। ১৯১৯ সালে স্থাপনা করা হয় মদন থিয়েটার লিমিটেড। সেই সালেই তৈরি হয় বাংল ছবি 'বিল্লমঙ্গল', রিলিজ করা হয় কর্নওয়ালিস থিয়েটারে। পরের বছর আসে 'নল দময়ন্তী', তার পরের বছর 'ধ্রুব চরিত্র'। আশ্চর্যের কথা হল এই ছায়াছবিগুলো পরিচালনা করতেন বিদেশিরা। কেউ ইটালিয়ান, কেউ ব্রিটিশ। ইউজিনিও দে লিগুওরো তো ভারতীয় ছবি পরিচালনা করে কীসব পুরস্কার ফুরস্কারও পেয়েছেন। বাংলা নাটকের দুনিয়াতেও অগ্রসর হয় মদন থিয়েটার, বোম্বাইয়ের ভিক্টোরিয়া ফিল্ম কোম্পানিকেও কিনে নেয়। বর্মা, সিলোন আর লন্ডনেও তাদের সিনেমার প্রিন্ট রপ্তানি করা হয়। ক্রমে মদন থিয়েটারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯২৩ সালে এই ফিল্ম কোম্পানির দায়িত্ব নেন জমশেদজি ফ্রামজি মদন ওরফে জে যে মদন। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যায়, সারা ভারতে মদন থিয়েটারের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। একশো সাতাশটা থিয়েটার নির্মাণ করেছে এই কোম্পানি, পাশাপাশি সারা ভারতের শিল্পী-অভিনেতা-গায়ক- চিত্রকর-লেখকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে।
মদন থিয়েটারকে কেন্দ্র করেই একটা গোটা বই লিখে ফেলা যায়, তার ঐতিহাসিক মূল্য বড় কম হবে না। কিন্তু এখানে সে নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ নেই। বরং আমরা এইবার গল্প এগিয়ে নিয়ে যাই। ফিরে আসি সেখানে, যেখান থেকে গল্প শুরু হয়েছিল। কলকাতায়।
একশো বছর আগের কলকাতা মানে শিল্পীদের স্বপ্নের জায়গা। একে তো কলকাতা ছিল সাহেবদের পছন্দের জায়গা, তারপর শিল্প-সঙ্গীতের সমঝদার এখানে কম ছিল না। আর ধ্রুপদ সঙ্গীতের দুনিয়ায় তো কলকাতার নাম রোশন অনেক আগে থেকেই। গৌহর জান সে যুগেও স্টেজ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন, মানদাসুন্দরী দাসীর কদরদানও কম নেই। মলিকা জান আর জোহরা বাই আগ্রা থেকে প্রোগ্রাম করতে আসছেন, বেনারস থেকে আসছেন হুসন জান, ওয়াজিরি জান... দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে শায়র, শিল্পী, কবি, লেখক, স্থপতি, গায়ক, বাজিয়ে, যাদুকররা ভিড় করছেন এখানে। সবাই জানে, শিল্পের পরখ করতে হলে, দর্শকদের চোখে নিজের প্রমাণ করতে হলে আসতে হবে কলকাতায়। একবার যদি কলকাতায় গুণী মহলে ইজ্জত মেলে, তাহলে আর কিছুই চাই না। (কিন্তু কলকাতা যত তাড়াতাড়ি শিল্পীকে মাথায় বসায়, ততই তাড়াতাড়ি তাদের বিস্মৃতির আঙিনায় ঠেলে দেয়। বহু প্রতিভাবান শিল্পী এই শহরে নিজেকে এস্ট্যাবলিশ করে শেষ জীবনে বিস্মৃতির গর্তে হারিয়ে গিয়েছেন। সে কথা এখন থাক।) মদন থিয়েটার আসার পর এই 'ক্রেজ' আরো বেড়ে উঠল। দলে দলে লোক আসতে শুরু করল কলকাতায়। বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকজন এসে জুটল এই শহরে। কলকাতার কারিগরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠল পারসী বিজনেসম্যানদের, লাহোরের শায়রের সঙ্গে ভাব হল হিন্দুস্থানী গায়িকার, চিনা পাড়ার ডাক্তার আর ইহুদী বেকাররা জোট বাঁধলেন একসঙ্গে, উচ্চবিত্ত সমাজের চায়ের আসরে ঢুকে পড়ল কসমোপলিটান কেওস। কলহ ও বিবাদও হল, কিন্তু তাই বলে প্রেমালাপও কম হল না। ক্রস কালচারাল কনফারেন্সের এই সমারোহ যে ভবিষ্যতে কত কত গুণী মানুষকে পৃথিবীতে এনেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ঠিক এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল আগা হশ্র কাশ্মিরী আর মুখতার বেগমের মধ্যে। আগা হশ্র কাশ্মিরী সে যুগে ভারতের শেক্সপিয়ার বলে জনপ্রিয় ছিলেন, পারসী নাটককে যে উচ্চতায় তিনি নিয়ে গিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না। পাশাপাশি শেক্সপিয়ারের বহু নাটকের হিন্দি ও পারসী রূপান্তরণ করেছেন, লিখেছেন অজস্র শেরোশায়রী। প্রথমে বেনারস, তারপর বোম্বাইয়ে তার জীবন কাটলেও সারা ভারতে তিনি এক পরিচিত নাম। মন্টো, কৃশ্নচন্দর, ইসমত চুগতাই সহ অনেকেই তার প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, আগা সাহেবও অনুজদের স্নেহ করতেন প্রাণ দিয়ে। একবার কে যেন বলেছিল, সিনেমায় কাজ করে আর বোম্বাইতে থেকেও ভদ্রলোক শুধু উর্দুতে লেখেন কেন? উত্তরে আগা সাহেব হিন্দি লিখে ফেললেন এক নাটক, নাম দিলেন 'সীতা বনবাস'। এই নাটক প্রকাশ্যে আসতেই হইচই পড়ে গেল দর্শকদের মধ্যে। আগা সাহেব এ কী লিখেছেন? এই নাটকে রাম সেই সমস্ত জনতাকেই অভিযুক্ত করছেন, উল্টে প্রশ্ন করছেন যারা সীতার পবিত্রতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। আগা হশ্র কাশ্মিরী নির্বিকার।
অন্যদিকে মুখতার বেগম তখন প্রবল জনপ্রিয়। দাদরা, ঠুমরির পাশাপাশি গজল গায়েকিতেও তার খ্যাতি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মুখতার তখন ভাইবোনদের নিয়ে অমৃতসর থেকে কলকাতায় চলে এসেছেন, তাদের মুখ চেয়েই গজলের দিকে মনযোগী হয়েছেন। এতগুলো পেট চালাতে হবে, টাকা তো চাই! দর্শকদের রুচি বদলাচ্ছে, সিনেমার আকর্ষণ বেড়েছে, কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চাহিদা আগের চেয়ে কমেছে। জনপ্রিয়তা বেড়েছে গজলের। মুখতার এই বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন আগেই, কিন্তু তখন গজল খুব একটা গাইতেন না। কিন্তু এখন কলকাতার আয়োজকেরা গজলের অনুষ্ঠান করতেই ইচ্ছুক। আয়ও মন্দ নয়। মুখতার সারা দেশে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করতে লাগলেন, শ্রোতারা তার গলা শুনে সম্মোহিত হয়ে পড়ে। তাঁর কাছে একের পর এক ফিল্মের অফার আসছে, কিন্তু মুখতার বেগম কলকাতা ছেড়ে যাবেন না।
এমন সময় মদন থিয়েটার আগা হশ্র কাশ্মিরীর বোম্বাইয়ের থিয়েটার কোম্পানিকে কিনে নেন। ফলে আগাসাহেব কাজ নিয়ে আলোচনা করতে এসে উপস্থিত হন কলকাতায়। এখানে এসে তো তিনি তাজ্জব। এ এক আজব শহর! যত দেখেন, ততো চমকে যান। ঘুরে ঘুরে বেড়ান অলিগলিতে, মুশায়রা আর সঙ্গীতের মহফিলে। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত এই শহরেও কম নেই। যেখানে যান, লোকজন ছেঁকে ধরেন। যেতে চাইলেই তারা বলে ওঠে, "জীদ মত কিজিয়ে আগাসাহেব। আজ আপ নেহি যা সকতে!"
এরকম ঘুরতে ঘুরতে একটা মেহফিলে আগা সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মুখতার বেগমের। ব্যাস! প্রথমে চাউনিতেই যে ইশক হল, সারা জীবন সেই ইশক তার পিছু ছাড়ল না। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে মুখতারকে ভালোবেসে ফেললেন আগাসাহেব, তার সমস্ত জীবন মুখতার বেগমের চারপাশে ঘুরতে লাগল। মুখতারের চেয়ে বয়সে প্রায় আঠাশ বছরের বড় ছিলেন আগাসাহেব, কিন্তু বয়সের ফারাক তাদের নিকাহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মুখতার বুঝেছিলেন, এই মানুষটার মতো কেউই তাকে ভালোবাসতে পারবে না। আগাসাহেব নিকাহের আগে মুখতারের কাছে আসতেন, মুখতার তাকে যেতে দিতেন না। বার বার বলতেন, "আজ জানে কি জীদ না কিজিয়ে! আগাসাহেব ফিরতেন না, মুখতারের কোলে শুয়ে রাত কেটে যেত। প্রায় প্রতিদিন এই হত।
নিকাহের পর যখন তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলেন, এই ভালোবাসা একটুও কমেনি। দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে জিনিয়াস, কিন্তু বাড়িতে থাকার সময় সে কথা বোঝা যেত না। আগাসাহেব এমনিতে বেশ বদমেজাজি ছিলেন, কিন্তু মুখতারের সামনে তিনি শিশুর মতো হয়ে যেতেন। এমনকি মদের নেশাও ত্যাগ করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে। মন্টো তাঁর স্মৃতিকথায় মজা করে লিখেছেন, " বুড়াপে কা ইশক কাতিল হোতা হ্যায়।" তাঁর ধারণা, মদ না ছাড়লে তিনি আরো বহুদিন বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকতেন। সে অন্য কথা।
এইবার কাহিনিতে প্রধান চরিত্রের প্রবেশ হবে। আর কেউ নয়, মুখতার বেগমের ছোট বোন ফরিদা খানম। ফরিদা মুখতারের সঙ্গেই থাকতেন আর গান গাওয়ায় তার সহজাত প্রতিভা ছিল। তারপর আগাসাহেব- মুখতার বেগমের বাড়িটাই তো সাহিত্য আর সঙ্গীতের তীর্থস্থান ছিল, সারা দেশের তাবড় তাবড় লেখক আর সঙ্গীতশিল্পীরা আসতেন সেখানে। এই কালচার কিছুটা তো প্রতিফলিত হবেই। হয়েওছিল। ফরিদা সাত বছরে পড়তে মুখতার বুঝলেন, অসামান্য গায়িকা হয়ে ওঠার সব গুণই ফরিদার আছে। একদিন বেগম আখতার বাড়িতে এসেছেন, ফরিদার গলা শুনে তো তিনি ফিদা হয়ে গেলেন। মুখতার বুঝলেন বেশি দেরি করা উচিত হবে না। তড়িঘড়ি তিনি বড়ে গুলাম আলির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ফরিদাকে গান শেখানোর জন্য। গুলাম আলি সাহেব শুনেটুনে বললেন, ফরিদার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক হবেন ওস্তাদ আশিক আলি খাঁ। আশিক অলি খাঁ তখন পটিয়ালা ঘরানার নামী গায়ক, বয়স খুব বেশি না হলেও তার চালচলন দরবেশের মতো। তার কাছেই ফরিদার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হল।
ফরিদা খানমের কথা শুনে বোঝা যায়, কাজটা খুব সহজ হয়নি। ওস্তাদ আশিক আলি খাঁ বড্ড কঠিন শিক্ষক ছিলেন, গাফিলতি দেখলে বেতের বাড়িও খেতে হয়েছে। সাত বছরের ফরিদার যে কী করে এত কঠিন নিয়ম মেনে গান শেখা চালিয়ে গেছেন, সেটাই আশ্চর্য। প্রথমেই দাদরা, ঠুমরি আর খেয়ালে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ভোরবেলায় ভৈরবীর অভ্যেস করতে হত, বিকেলে ভীমপলাশি। সুরে একচুল এদিক ওদিক হলেই বকা খেতে হত, যদিও পরে তাকে ডেকে আদর করে দিতেন ওস্তাদ সাহেব। ফরিদার ইচ্ছে করত অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতে, ছুটোছুটি করতে, কিন্তু তার কোনও উপায় ছিল না। ফরিদা পরে বলেছেন তার গায়কির সমস্ত ক্রেডিত ওস্তাদ আশিক আলি খাঁয়ের। সঙ্গীত প্রতিভা থাকলেই হয় না, অনেক সাধনা, অনেক পরিশ্রম দিয়ে তাকে আয়ত্তে আনতে হয়। প্রতিভা হয়তো একটা দীঘির জল, কিন্তু সাধনা হল পাথর কেটে সেই জলকে নদীতে রুপান্তরিত করা। তাই হয়তো ফরিদা খানমের গায়েকি শুনলে মনে হয়, অবাধে জল বয়ে চলেছে নদী দিয়ে।
হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকে প্রধানত চারটে ধারায় বিভাজিত করা হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ( ধ্রুপদ, ধমার, খেয়াল), উপ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ( ঠুমরি, কজরি, চৈতি, হোরি ইত্যাদি), সুগম সঙ্গীত ( গজল, ভজন, গীত ইত্যাদি) আর লোক সঙ্গীত। প্রতিটা ধারার নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্য আছে, গায়ক আর কদরদানও কম নেই। ফরিদা যে কোনও ধারাতেই গাইতে পারতেন, কিন্তু শেষে তিনি বেছে নিয়েছিলেন গজলকেই। এর জন্য অবশ্য দায়ী মুখতার বেগম আর বেগম আখতার। এদের নিজের গান শুনে তিনি বড় হয়েছেন, তাছাড়া কলকাতায় থাকতে গজল গায়েকির সেরা শিল্পীদের শোনার ও দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল তার। এমনিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বাদে অন্য ধারায় গায়েকির গুরুত্ব একটু একটু করে কমতে আসে, লিরিক্সের উপর নজর দেওয়া হয় বেশি। কিন্তু ফরিদা তার জীবনে এই মান্যতাকে চুরমার করে দিয়েছেন। গজল যে গায়েকি আর শায়রির যুগলবন্দি, একটা ছাড়া অন্যটা বাঁচে না, সেই কথাটা বারে বারে প্রমাণ করেছেন। ফারিদা খানম, বেগম আখতার, মেহদি হাসান, জগজীত সিং প্রভৃতি আর্টিস্টরা শব্দের ভিতর নিবদ্ধ ভাবটাকে আত্মস্থ করতে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তাতে গজল গায়েকির চেহারাই পাল্টে গেছে। কিন্তু সে অনেক পরের কথা! তখনও ফরিদা গজল গায়িকা ফরিদা খানম হননি, বাচ্চা মেয়েটি তখন ওস্তাদজির কাছে সুরের সাধনা করে চলেছেন।
ফরিদা জানতেন না, তার জীবন কোনদিকে মোড় নিতে চলেছে। সঙ্গীত সাধনাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন পুরোপুরি। এদিকে ১৯৩৫ সালে আগা হশ্র কাশ্মিরী মারা গিয়েছেন, মুখতার বেগম একা হয়ে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। সুরের দুনিয়া অবশ্য থেমে নেই। বেগম আখতার 'কুইন অফ গজল'-এর শিরাপো পেয়ে গিয়েছেন, টকি সিনেমার যুগে ফিল্ম মিউজিকের জনপ্রিয়তা হুড়হুড় করে বাড়ছে। হলিউডের একটা স্টুডিওর সঙ্গে চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার ফলে মদন থিয়েটার দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে ১৯৩৭ সালে, তার জায়গায় জাঁকিয়ে বসেছে অন্যান্য কোম্পানি। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছে বলে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন, আবার কেউ কেউ সর্বস্ব হারাচ্ছেন। তেতাল্লিশের মতন্ত্বরের পর কলকাতার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে, বম্বে ইন্ডাস্ট্রির রোশনাই তখনও নিভে যায়নি। কেউ জানত না, এর পর কী হতে চলেছে!
চার বছর পর ভারতের শিল্পী সমাজ উপলব্ধি করল, তাদের অনেকেই অস্তিত্বহীন অবস্থায় দেশছাড়া হয়েছেন। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব, শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি ছেড়ে তারা যেখানে এসে উঠেছেন, সেই জায়গাটাই নাকি তাদের নতুন দেশ! কিন্তু, এ কেমন দেশ? এই দেশের কিছুই তো তাদের চেনা নয়। ধর্মের বামে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নাম যে দুটো ভুখন্ড ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারদের কাছ থেকে স্বদেশ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেশভাগের এই আগুন স্পর্শ করল ফরিদাকেও। অমৃতসর ছেড়ে আসার সময় মন খারাপ হলেও ধীরে ধীরে কলকাতাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন, কিন্তু এইবার লাহোর যাওয়ার সময়ে ফরিদার চোখ ফেটে জল এল। এ তো আর এক শহর থেকে অন্য শহর যাওয়া নয়, এতদিন যে জীবনটাকে নিয়ে সে বেঁচেছিল, সেটাকেই এখানে ফেলে রেখে যাচ্ছে সে। আর কোনোদিন কলকাতা বা অমৃতসরে কি ফিরতে পারবে সে?
ফরিদা পারেননি ফিরতে। মন্টোও না। একান্তে সারাজীবন স্মৃতিচারণা করে গেছেন। বহুদিন পর যখন পুরোনো বাড়ির খোঁজে ফিরে আসেন অমৃতসরের গলিতে, তখন তিনি আর ছোটটি নন। একা একা শহরে ঘুরে বেরিয়েছেন, নিভৃতে চোখের জল ফেলেছেন। কিন্তু হারানো সময় ফিরে আসে না।
পাকিস্তানে গিয়েও ফরিদার পরিবার প্রথমে থিতু হতে পারেনি। একটা ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াত, বাড়ির ছেলেমেয়েরা দুঃস্বপ্ন দেখত। করাচি, পেশাওয়ার, রাওয়ালপিন্ডি হয়ে অবশেষ লাহোরে গিয়ে পড়লেন ফরিদা। সময় কাটতে লাগল। তখন তিনি পূর্ণ যুবতী। ছোটবেলায় আগাসাহেব আর মুখতার আপাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, তার নিজেরও একটা গোপন বাসনা ছিল, এমন একজন প্রেমিক পাবেন। যাকে আটকে রাখবেন, যাকে সঙ্গে করে হারিয়ে যাওয়া ঘরে ফিরবেন। যার কাছে আবদার করবেন। দিদির মতো করে বলবেন, "আজ জানে কী জীদ মত কিজিয়ে।"
একসময় বিয়ে হল ফরিদার। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি বুঝে গেলেন, সব শৌহর আগাসাহেব নন। একঘেয়ে জীবন কাটতে লাগল। সংসারের কাজে গানের কথা ভুলেই গেলেন। রিয়াজও করতেন না। তখন মেহদি হসন আর ইকবাল বেগম গজলে নাম করতে শুরু করেছেন, কিন্তু ফরিদা তখনও আড়ালে। বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর করাচিতে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাকে জোর করে মঞ্চে তুলে দিলেন কয়েকজন। ফরিদা গাইলেন। মন উজাড় করে গাইলেন। শ্রোতারা শুনল। তাদের মুখে কথা নেই। গান শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারল না। তারপর হাততালির বন্যা বয়ে গেল।
এরপর থেকে ফরিদাকে রেহাই দেয়নি গজল। চাপে পড়ে একটু একটু করে রেডিও প্রোগ্রাম করতে শুরু করলেন। শায়র অতর নফীসের এই গজল দারুণ জনপ্রিয় হল...
"উও ইশক যো হমসে রুঠ গয়া অব উসকা হাল বাতায়ে
কোই মেহর নেহি, কোই কহর নেহি ফির সচ্চা শের শুনায়ে কেয়া!"
ধীরে ধীরে তিনি গজল গায়েকির পরিচিত চেহারা হয়ে উঠলেন। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি আসতে আসতে ফরিদা খানমের শ্রোতারা তাকে মন দিয়ে বসেছে। এমন সময় ফরিদার সঙ্গে আলাপ হল হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর। তার চেয়ে নয় বছর বড় একটি ছেলে, যে শৈশবে তাদের বাড়িতে আসত মাঝে মাঝে। তিনিও যেতেন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ইনিই হলেন গল্পের দ্বিতীয় নায়ক শায়র ফাইয়াজ হাশমী।
ফাইয়াজ হাশমীর বাড়ি ছিল কলকাতায়। আর কলকাতার কোথায়? সেই আগা হশ্র কাশ্মিরীর বাড়ির ঠিক পাশে। যেখানে বুলবুলে পাঞ্জাব মুখতার বেগম রিয়াজ করতেন, ফরিদা কচি গলায় হাসত। বয়সে খানিকটা বড় হলেও তার সঙ্গে ফরিদার ভাব ছিল। আগাসাহেব আর আপার কিসসা তাকে গল্পের মতো করে বলতেন ছোট্ট ফরিদা। ফাইয়াজ কবি মন নিয়েই জন্মেছিলেন, সেই গল্প তার কিশোর মনে ঘর করে থাকত। এই স্মৃতিগুলোই পরে নজম হয়ে কাগজে ফুটে বেরিয়েছিল। হিন্দি ও উর্দু ফিল্ম জগতের বহু গায়ক ফাইয়াজ হাশমীর লিরিক্সে গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার অন্যতম হলেন একজন নায়কোচিত চেহারার যুবক, যার কাঁপা কাঁপা গলায় গান দেখে প্রথম প্রথম হাসির রোল উঠত। পরে সেই যুবক শ্রোতাদের হার্টথ্রব হয়ে ওঠেন। তার নাম তলত মেহমুদ।
কিন্তু ফাইয়াজ হাশমী আগা হশ্র কাশ্মিরীর লাগোয়া বাড়িতে থাকতেন কেন? দেখতে গেলে আগাসাহেব আর মুখতার সে যুগের টপ সেলেব, তাদের লাগোয়া বাড়ি কেনা সকলের কম্মো নয়। একেই বোধহয় কসমিক কানেকশন বলে। ফাইয়াজ হাশমীর বাবাও মদন থিয়েটারে কাজ করতেন, আগাসাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা থাকত তার। ফলে আগাসাহেবই বাসাটা ঠিক করে দিয়েছিলেন। দেশভাগের সময় ফরিদার মতো ফাইয়াজ হাশমীও ছিটকে যান তার শিকড় থেকে, চলে আসেন পাকিস্তানে। সিনেমার জগতের সঙ্গে সম্পর্ক কিন্তু ছিন্ন হয়নি, গানের কথা লিখে জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। কিন্তু ফাইয়াজ মনে মনে জানতেন, তার সেরা কাজ এখনও বাকি। একটা গান, যাতে তিনি নিজের গল্প বলে যাবেন। তার শৈশব, তার যৌবন, তার দেশভাগের হতাশা, তার আজীবন খুঁজে চলা 'ঘর'-এর প্রতীক হিসেবে এই গানটা রয়ে যাবে... কিন্তু তিনি যদি লেখেনও, কে গাইবে এই গান? কে বুঝবে শব্দের অন্তরালে থাকা সেই অব্যাক্ত কাহিনি? এমন তো কেউই নেই।
এমন সময় ফরিদার সঙ্গে ফাইয়াজ হাশমীর দেখা। ফরিদা দেখলেন, সেই কিশোর ছেলেটা আজ নামকরা শায়র। তিনি অবুঝের মতো যে সব কথা বলে যেতেন অনর্গল, ছেলেটা কাগজে লিখে রাখত সে সব কথা। ফাইয়াজ দেখলেন, তার অতীত জীবন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সারাজীবন যা লিখেছেন, তার সূত্রপাত হয়তো হয়েছিল ফরিদার গল্প শুনেই। সেই কচি মেয়েটা এখন আর কচি নেই, তার সংসার আছে। আর আছে গান।
ফরিদার সঙ্গে গল্প হল, আড্ডা গড়াল বহুদূর। ফরিদা গান গেয়ে শোনালেন, ফাইয়াজ মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন, তার গায়িকাকে তিনি পেয়ে গেছেন। ফরিদাকে তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন তক্ষুনি। তার জন্য একটা গান লিখবেন তিনি। একটা গজল। ফরিদাকে গাইতে হবে সেটা। কাগজে নতুন করে লেখা হবে ঠিকই, কিন্তু আসলে এই গজল অনেক আগেই লেখা হয়ে গেছে। ফরিদাও জানেন,ফাইয়াজও। ফরিদা শুনলেন কয়েকটা লাইন। তার চোখ বেয়ে জল নেমে এল।
১৯৭৩ সালে প্রকাশ্যে এল সেই গান। বাকিটা ইতিহাস।
"ওয়াক্ত কি ক্যায়েদ মে জিন্দেগী হ্যায় মগর,
চন্দ ঘড়িয়াঁ য়েহি হ্যায় জো আজাদ হ্যায়
ইনকো খো কে মেরি জাঁ
উম্র ভর না তরসতে রহো...
ফির ভি পেহলু মে ব্যায়ঠে রহো
আজ যানে কি জীদ না করো..."
এই সেই গান, যা লেখার আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে থাকার জন্য জরুরি একটাই গান, যা বার বার শুনে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।

ইম্যাজিন- আ লাভ স্টোরি



সম্প্রতি বিবিসি ওয়ান 'ইম্যাজিন' বলে একটা সিরিজ করেছে, তার একটা এপিসোড দেখতে গিয়ে একজন শিল্পীর কথা জানতে পারলাম। শুধু জানতে পারলাম না, বলা উচিত জেনে বোমকে গেলাম। বর্তমান সময়ে পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পী ও তারকাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মারিনা আব্রামভিচ। গত পঞ্চাশ বছরে তিনি শিল্প জগতে যে ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করছেন, তার হিসেব করতে হলে ইয়া মোটকা বই হবে। এমনিতেও পারফরম্যান্স আর্ট বিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা খুবই সীমিত, মঞ্চানুষ্ঠান বা থার্ড থিয়েটার (সেটা পারফর্মিং আর্ট) বাদেও যে শিল্পের একাধিক ফর্ম হতে পারে, এক্সপ্রেশনকে ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন মাত্রায় গিয়ে সেলিব্রেট করা যায়, সেরকম কোনও শিক্ষা আমরা পাইনি। মোমা বা অন্যান্য দেশের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে গিলে কিছুক্ষণের জন্য চক্ষু উন্মোচন হয় ঠিকই, কিন্তু সার্বিকভাবে দেখতে গেলে অনেকটাই না জানা থেকে যায়।

ভাগ্য ভালো বলতে হবে, লন্ডনে থাকাকালীন আমার এ বিষয়ে খানিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইউকের সরকারকে আমার শত কোটি প্রণাম, যারা আমাহেন দরিদ্র কিন্তু উৎসাহী জনতার জন্য সমস্ত মিউজিয়ামে দ্বার অবারিত ভাবে খুলে রেখেছেন। ফলে একদিন পর পর গিয়ে উপস্থিত হতাম টেমসপাথের কাছে অবস্থিত টেট মডার্ন মিউজিয়ামে। প্রায় রোজই এক একটা ওয়াকিং ট্যুর করানো হত বিনামূল্য, একমাসে প্রায় আঠেরো-কুড়িটা ট্যুর করার ফলে একটা ধারণা হয়েছিল ঠিকই। তখনই জানতে পেরেছিলাম পারফরম্যান্স আর্ট নিয়ে কী দারুণ দারুণ কাজ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে।
ওয়াফা বিলাল মিসাইল অ্যাটাকের ফলে তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে টানা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নিজের পিঠে ট্যাটু করায়। সবাই দেখে, তার পিঠে ফুটে উঠেছে একটা সীমানাহীন ইরাকের ম্যাপ। প্রতিটা রক্তবিন্দু এক একজন মার্কিন সৈনিকের মৃত্যুর প্রতীক। গুনে দেখা যায়, ৫০০০টা লাল বিন্দু আছে তার ট্যাটুতে। কিন্তু আসল খেলা শুরু হয় রাত গড়ালে। বিলাল বসে আছে, তার পিঠে ব্ল্যাকলাইট ফ্ল্যাশ করছে একজন। মিডিয়ার লোকেরা অবাক হয়ে দেখে, সেখানে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে অজস্র সোনালি বিন্দু। সেগুলো এমনিতে অদৃশ্য। দেখা যায়, সারা পিঠ জুড়ে সোনালি ফুলের মতো একটা আকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রায় এক লক্ষ অগ্নিবিন্দু জ্বলজ্বল করছে। তারা সবাই আসলে ইরাকের নিরীহ মানুষ, যারা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।
মারিনার কথাই ধরুন। 'রিদম জিরো' বলে একটা পারফরম্যান্স করার সময়ে তিনি ঠিক করলেন, একটা জীবিত বা মৃত বস্তুর সামনে চুপ করে 'প্যাসিভলি' বসে থাকবেন। এই অব্জেক্ট মানুষ হোক, গোলাপফুল হোক, আনারস হোক, যা খুশি হোক! তিনি নড়বেন না। ব্যাপারটা হবে ওপেন স্পেসে। দেখা গেল দর্শকরা কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই তার গায়ে চিমটি কেটে দেখছে, মাথায় চাঁটি মারছে। মেয়েটা নড়ছে না কেন? সময় যত কাটতে লাগল, লোকজন তত আগ্রাসী হয়ে উঠল। একজন মারিনার গায়ে পিন ফোটাল, একজন তার জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল, একজন ছুরি দিয়ে আঘাত করল তাকে। মারিনা তাও অনড়। একসময় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, চড় লাথি ঘুষি পড়তে লাগল। একজন কোত্থেকে একটা লোডেড বন্দুক নিয়ে তার মাথায় ঠেকাল। বেগতিক দেখে পুলিশ ও প্রসাশনকে পদক্ষেপ নিতে হয়। বোঝা গেল, সাধারণ মানুষ কোনও 'প্যাসিভ হিউমান বিইং'-কে সহ্য করতে পারে না বেশিক্ষণ। একসময় তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন, ব্যাপারটাকে শুধু আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশনের দিক থেকে ভেবে দেখলে চমকে উঠতে হয়। যদিও এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা চিরকালই শিল্পকে ব্যবহার করেছেন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে নানারকম হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, সমাজের দ্বিচারিতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে শিল্পের মাধ্যমে। সে নিয়ে লিখতে গেলে জল অনেক দূর গড়াবে। যাই হোক, মারিনার কথায় ফিরি।
ব্যাপারটা হল, পারফরম্যান্স আর্টের কথা বলার জন্য এই পোস্টটা করার দরকার ছিল না। আসল কথা হল মারিনার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এমন একটা আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান পেলাম, যা আমাকে নাড়িয়ে দিল। না, রোমাঞ্চ বা বিস্ময়কর কিছু নয়। এই গল্পও প্রেমের। নিখাদ প্রেমের। ওয়ান অফ দ্য অ্যামেজিং স্টোরি আই এভার কাম থ্রু। দু'জন শিল্পীর লাভ স্টোরি। মারিনা আর উলে। হয়তো অনেকেই জানেন। আমিই জানতাম না আগে।
মারিনা যেখানে ছিলেন সার্বিয়ার শিল্পী, উলে ছিলেন জার্মানির। তাঁর আসল নাম অবশ্য ফ্র্যাঙ্ক উওয়ে লাইজপিন, কিন্তু পারফরম্যান্স আর্ট এর জগতে লোকে তাকে উলে বলেই চিনত। পোলেরয়েড আর্ট আর কোলাবরেটিভ আর্ট প্রোজেক্ট করার ফলে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। মারিনাও সেই সময়ে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট করছেন। কাকতালীয় কিনা জানি না, কিন্তু দু'জনের জন্মদিনও ছিল এক। ৩০ নভেম্বর।
১৯৭৬ সালে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয় উলে আর মারিনার। প্রথম সাক্ষাতেই ম্যাজিক। উলের মনে হয়, মারিনা আসলে এক কুহকিনী মহিলা, এই জগতের বাসিন্দা সে নয়। মারিনার মনে হয়, এই আধপাগলা সুন্দর বোহেমিয়ান যুবকের জন্যই তিনি পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন। তারপর আর কি! ইয়ে দিল বেচারা, পেয়ার কা মারা! নতুন প্রেমের স্ফুলিঙ্গ যখন স্তিমিত হল, একে অপরের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তারা। ভাগ্যিস হয়েছিলেন। পরবর্তী দেড় দশকে মারিনা-উলে জুটি শিল্প জগতে যা করেছেন, তা ইতিহাস তৈরি করেছে। একের পর এক যুগান্তকারী প্রজেক্ট, একের পর এক অসামান্য এক্সপেরিমেন্ট... মারিনা আর উলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। পরস্পরের প্রতি অসীম স্নেহ ও বিশ্বাস ছিল তাদের, এই পারস্পরিক বিশ্বাস তাদের পারফর্ম্যান্স আর্টেও ফুটে বেরোত।
'রিলেশন ওয়ার্ক' বলে তাদের যে প্রজেক্ট ছিল, সে নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। মারিনা আর উলে নিজেদের বলত 'টু হেডেড বডি'। কাজের সূত্রে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত তাদের, একটা ভ্যান নিয়ে সমস্ত ইউরোপ চষে বেরিয়েছে তারা। দর্শকদের কাছে এই জুটির 'ফ্যান্টম আইডেন্টিটি' ছিল বিস্ময়কর। তার একটা কারণ তাদের রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টও বটে। 'আর্ট ভাইটাল' অর্থাৎ নিরন্তর গতি অথবা স্থিতিকে কেন্দ্র করে এক একটা পরীক্ষা করত তারা। এই ধরুন গোটা এক দিন একে অপরের চুল বেঁধে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, অথবা মুখোমুখি ধনুষে তীর পরিয়ে ছিলা টেনে প্রস্তুত রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একজনের মনসংয়োগ যদি এক চুল নড়ে যায়, তীর যদি বেরিয়ে যায় ধনুষ থেকে, অপরজনের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তেমনটা হত না। তাদের নিজের কথায় বলতে গেলে এর রহস্য হল--
'উই বিকম দ্য আদার!'
পারফর্ম্যান্সের সময়ে উলে মারিনা হয়ে উঠত, মারিনা হয়ে উঠত উলে। উভয়ের শরীর দিয়ে একটাই শক্তি স্রোত বয়ে যেত, দু'জন ভিন্ন মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে যেত সেই সময়ে। মারিনার কথায়, "Our individual identities became less accessible. It revealed a way of having the artistic self made available for self scrutiny."
মারিনা-উলে জুটি নিয়ে তখন শিল্প জগত উত্তাল। সবাই বার বার একই প্রশ্ন করে, বিয়ে করছ কবে? মারিনা আগে বিবাহিতা ছিলেন, যদিও উলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আগের সম্পর্ক টেকেনি। দীর্ঘ সাত বছর একসঙ্গে থাকার পর আর একের পর এক আর্ট প্রজেক্ট করার পর তারা সিদ্ধান্ত নিল, বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেলা যাক। কিন্তু সাধারণ বিয়ে! ছোঃ! ওইসব হবে না! বিয়ের জন্য যে ভাবনা তাদের মাথা থেকে বেরোল, সেরকম কেউ কোনোদিন শোনেনি। মারিনা আর উলে ঠিক করল তার গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা অর্থাৎ চিনের দেওয়ালের দুই প্রান্ত থেকে হাঁটতে শুরু করবে। মাঝামাঝি দেখা হবে, তারপর হবে বিয়ে। মাস তিনেক লাগবে। এই অতিমানবিক আর্ট প্রজেক্টে তারা নিজেরাই প্রেমিক, নিজেরাই দর্শক, নিজেরাই শিল্পী। মিডিয়ার লোকজন তো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এরকম কেউ কস্মিনকালেও দেখেনি।
যাই হোক, ১৯৮৩ সালে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হল না। হবেও বা কী করে, চিনের আধিকারিকরা তো ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারেনি। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনার উপর দিয়ে ক্যাবলা কাত্তিকের মতো হেঁটে যাবে, এ আবার কেমন ধারা আর্ট প্রজেক্ট? নিশ্চয়ই অন্য কোনও ব্যাপার আছে! অনেক কাণ্ড করে যখন অনুমতি পাওয়া গেল, পাঁচ বছর কেটে গেছে। ১৯৮৮ সাল। যাই হোক, ৩০শে মার্চ মারিনা আর উলে হাঁটা শুরু করল। মারিনা ইয়েলো সি-র কাছ থেকে হাঁটবে, উলে শুরু করেছে গোবি মরুভূমি থেকে। প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর তারা মিলিত হবে। যাত্রা শুরু হল।
মারিনা আর উলে হাঁটছে। চিনের প্রাচীন শহর, দুর্গম গিরিপ্রান্তর, ছোট ছোট গ্রাম। গ্রেট ওয়ালের অনেকটাই গিয়েছে লোকালয়হীন জনপ্রান্তর দিয়ে। রোজ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার করে হাঁটে তারা, মাঝে মাঝে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ইতিহাসের কথা ভাবে, ভাবে পরস্পরের কথা। কোনোদিন ঝোপঝাড়, কোনোদিন গুহা বা কন্দরে শুয়ে কাটাতে হয়। মাঝেমাঝে অবশ্য গ্রামে আশ্রয় পায়। একদম ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর মার্কা গ্রাম, আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন। সেখানে অশীতিপর বৃদ্ধরা তাদের গল্প বলে। ড্রাগনের গল্প। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা আসলে তাদের কাছে ঘুমন্ত ড্রাগন। আগুনের আঁচের কাছে বসে এই গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। দিন কাটতে লাগল এইভাবেই। বিপদও কম হয়নি। শরীর খারাপ হয়েছে, দুর্ঘটনা হয়েছে, ডাকাতের পাল্লায় পড়েছে। একজায়গায় এসে মারিনা দেখে যতদূর চোখ যায় নরকঙ্কাল। মারিনাকে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে আসতে হল সেই অস্থিসড়কের উপর দিয়েই।
একসময় এই দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হল। মিং বংশের সময়ে নির্মিত মন্দির প্রাঙ্গণেই এসে একে অপরকে দেখতে পেল তারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুজনে। মারিনা বলল, "এইবার?"
উলে বলল, "তুমি বলো!"
মারিনা বলল, "আমি এক্ষুনি বাড়ি যেতে চাই। "
উলে হেসে বলল, "আমি কিন্তু অনন্তকাল ধরে এই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম।"
মারিনা কাঁদতে শুরু করে। ব্যাপার আর কিছুই নয়, এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে, তাদের জীবনে নতুন মানুষ এসেছে। উলে একটু প্রাচীনপন্থী ছিল, অন্যদিকে মারিনা ছিল প্রবল ভাবে বিপ্লবী আর্টিস্ট। কিন্তু সব জেনেশুনেও এই যাত্রাটা করতে বদ্ধপরিকর ছিল দুজনেই। একসময় যে যাত্রা তাদের মিলনের প্রতীক হওয়ার জন্য ঠিক হয়েছিল, সেটা না হয় তাদের বিচ্ছেদের প্রতীক হয়েই থাকুক। কিন্তু, থাকুক।
প্রেসের লোক কিছুই জানত না। তারা বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিল নিজেরাই। সে সব রইল পড়ে। দু'জনে সংক্ষেপে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল। ম্লান হেসে একে অপরকে বিদায় জানাল, তারপর স্বতন্ত্র ভাবে ফিরে গেল নিজের নিজের দেশে।
সেই ঘটনার পর বাইশ বছর কেটে গেছে। উলে মারিনার মতো বিপ্লবী আর্টিস্ট হতে পারেননি, তিনি হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টের কথা কেউই ভোলেনি। এদিকে মারিনা পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে বড় নাম হয়ে উঠেছেন দু' দশকে।
২০১০ সালে নিউয়র্কের মোমা মানে মিউজিয়াম অড মডার্ন আর্টস-এ একটা অনুষ্ঠান করছিলেন মারিনা। অনেকটা রিদম-এর মতোই, কিন্তু ফরম্যাটে সামান্য তফাত আছে। এতে মারিনা একটা চেয়ারে বসে থাকবেন, তার সামনে থাকবে একটা টেবিল। টেবিলের অপর প্রান্তে এসে বসত একটা অপরিচিত ব্যক্তি। দু'জনের মাঝে দুই মিটারের দূরত্ব। মারিনা অপলক তাকে দেখতেন যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি নিজেই উঠে যাচ্ছে। নিয়ম হল, কেউ কাউকে স্পর্শ করবে না, কেউ কথা বলবে না। নতুন কেউ আসার আগে মারিনা কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতেন, তারপর আবার অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত নবাগন্তুকের চোখের দিকে। এই অনুষ্ঠান চলেছিল প্রায় চার মাস। সাড়ে সাতশো ঘণ্টা মারিনা কাটিয়েছিলেন এই চেয়ারে বসে। এই আর্ট প্রজেক্টের নাম ছিল -- 'দ্য আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট।"
সেইদিনও সব নিয়ম মতো চলছিল। একজন অতিথি উঠে চলে গিয়েছেন, মারিনা ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করেছেন। চোখ খুলে দেখেন, তার সামনে বসে আছেন উলে। কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখে বলিরেখা। কিন্তু মারিনার চোখে সে সব অদৃশ্য। তিনি দেখছেন তার পুরোনো সঙ্গীকেই। ঠিক যেন বাইশ বছর আগের সেই চেহারা। উলের চোখে দুষ্টুমির হাসি। মারিনার মুখেও আবছা এক হাসির রেখা ফুটে উঠল, তার চোখ ভিজে গেছে। চোখের কোল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে পড়বে করেও পড়েনি। সহসা প্রবল পেশাদার শিল্পী বলে খ্যাত মারিনা নিজের নিয়ম নিজেই ভুলে গেলেন, একটু ঝুঁকে উলের হাতটা জড়িয়ে ধরলেন তিনি। দু'জনের চোখের আড়ালে অনেক না বলা কথা। কিন্তু কেউই কথা বলছে না। বাইশ বছর পর দেড় মিনিটের জন্য পৃথিবীর মানুষ আবারও দেখল এই 'টু হেডেড বডি'-কে। এত বছরের দূরত্বও যাদের আলাদা করতে পারেনি।
এই দেড় মিনিটে ঠিক কী হল, সেটা বোঝানোর ক্ষমতা পৃথিবীর সেরা কলমের কাছেও নেই। ইচ্ছে হলে ভিডিওটা কমেন্ট বক্সের লিংক থেকে দেখে নিন।
উলে মারা গিয়েছেন ২০২০ সালে। শেষ জীবনে মারিনা তার সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন।
কৃতজ্ঞতা:- বিবিসি ওয়ান, অশোক পান্ডে, গার্ডিয়ানসম্প্রতি বিবিসি ওয়ান 'ইম্যাজিন' বলে একটা সিরিজ করেছে, তার একটা এপিসোড দেখতে গিয়ে একজন শিল্পীর কথা জানতে পারলাম। শুধু জানতে পারলাম না, বলা উচিত জেনে বোমকে গেলাম। বর্তমান সময়ে পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পী ও তারকাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মারিনা আব্রামভিচ। গত পঞ্চাশ বছরে তিনি শিল্প জগতে যে ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করছেন, তার হিসেব করতে হলে ইয়া মোটকা বই হবে। এমনিতেও পারফরম্যান্স আর্ট বিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা খুবই সীমিত, মঞ্চানুষ্ঠান বা থার্ড থিয়েটার (সেটা পারফর্মিং আর্ট) বাদেও যে শিল্পের একাধিক ফর্ম হতে পারে, এক্সপ্রেশনকে ভিন্ন মাত্রায়, ভিন্ন মাত্রায় গিয়ে সেলিব্রেট করা যায়, সেরকম কোনও শিক্ষা আমরা পাইনি। মোমা বা অন্যান্য দেশের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে গিলে কিছুক্ষণের জন্য চক্ষু উন্মোচন হয় ঠিকই, কিন্তু সার্বিকভাবে দেখতে গেলে অনেকটাই না জানা থেকে যায়।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে, লন্ডনে থাকাকালীন আমার এ বিষয়ে খানিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইউকের সরকারকে আমার শত কোটি প্রণাম, যারা আমাহেন দরিদ্র কিন্তু উৎসাহী জনতার জন্য সমস্ত মিউজিয়ামে দ্বার অবারিত ভাবে খুলে রেখেছেন। ফলে একদিন পর পর গিয়ে উপস্থিত হতাম টেমসপাথের কাছে অবস্থিত টেট মডার্ন মিউজিয়ামে। প্রায় রোজই এক একটা ওয়াকিং ট্যুর করানো হত বিনামূল্য, একমাসে প্রায় আঠেরো-কুড়িটা ট্যুর করার ফলে একটা ধারণা হয়েছিল ঠিকই। তখনই জানতে পেরেছিলাম পারফরম্যান্স আর্ট নিয়ে কী দারুণ দারুণ কাজ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে।
ওয়াফা বিলাল মিসাইল অ্যাটাকের ফলে তার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে টানা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নিজের পিঠে ট্যাটু করায়। সবাই দেখে, তার পিঠে ফুটে উঠেছে একটা সীমানাহীন ইরাকের ম্যাপ। প্রতিটা রক্তবিন্দু এক একজন মার্কিন সৈনিকের মৃত্যুর প্রতীক। গুনে দেখা যায়, ৫০০০টা লাল বিন্দু আছে তার ট্যাটুতে। কিন্তু আসল খেলা শুরু হয় রাত গড়ালে। বিলাল বসে আছে, তার পিঠে ব্ল্যাকলাইট ফ্ল্যাশ করছে একজন। মিডিয়ার লোকেরা অবাক হয়ে দেখে, সেখানে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে অজস্র সোনালি বিন্দু। সেগুলো এমনিতে অদৃশ্য। দেখা যায়, সারা পিঠ জুড়ে সোনালি ফুলের মতো একটা আকৃতি ফুটে উঠেছে। প্রায় এক লক্ষ অগ্নিবিন্দু জ্বলজ্বল করছে। তারা সবাই আসলে ইরাকের নিরীহ মানুষ, যারা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।
মারিনার কথাই ধরুন। 'রিদম জিরো' বলে একটা পারফরম্যান্স করার সময়ে তিনি ঠিক করলেন, একটা জীবিত বা মৃত বস্তুর সামনে চুপ করে 'প্যাসিভলি' বসে থাকবেন। এই অব্জেক্ট মানুষ হোক, গোলাপফুল হোক, আনারস হোক, যা খুশি হোক! তিনি নড়বেন না। ব্যাপারটা হবে ওপেন স্পেসে। দেখা গেল দর্শকরা কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই তার গায়ে চিমটি কেটে দেখছে, মাথায় চাঁটি মারছে। মেয়েটা নড়ছে না কেন? সময় যত কাটতে লাগল, লোকজন তত আগ্রাসী হয়ে উঠল। একজন মারিনার গায়ে পিন ফোটাল, একজন তার জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল, একজন ছুরি দিয়ে আঘাত করল তাকে। মারিনা তাও অনড়। একসময় মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, চড় লাথি ঘুষি পড়তে লাগল। একজন কোত্থেকে একটা লোডেড বন্দুক নিয়ে তার মাথায় ঠেকাল। বেগতিক দেখে পুলিশ ও প্রসাশনকে পদক্ষেপ নিতে হয়। বোঝা গেল, সাধারণ মানুষ কোনও 'প্যাসিভ হিউমান বিইং'-কে সহ্য করতে পারে না বেশিক্ষণ। একসময় তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন, ব্যাপারটাকে শুধু আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশনের দিক থেকে ভেবে দেখলে চমকে উঠতে হয়। যদিও এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা চিরকালই শিল্পকে ব্যবহার করেছেন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে নানারকম হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, সমাজের দ্বিচারিতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে শিল্পের মাধ্যমে। সে নিয়ে লিখতে গেলে জল অনেক দূর গড়াবে। যাই হোক, মারিনার কথায় ফিরি।
ব্যাপারটা হল, পারফরম্যান্স আর্টের কথা বলার জন্য এই পোস্টটা করার দরকার ছিল না। আসল কথা হল মারিনার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এমন একটা আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান পেলাম, যা আমাকে নাড়িয়ে দিল। না, রোমাঞ্চ বা বিস্ময়কর কিছু নয়। এই গল্পও প্রেমের। নিখাদ প্রেমের। ওয়ান অফ দ্য অ্যামেজিং স্টোরি আই এভার কাম থ্রু। দু'জন শিল্পীর লাভ স্টোরি। মারিনা আর উলে। হয়তো অনেকেই জানেন। আমিই জানতাম না আগে।
মারিনা যেখানে ছিলেন সার্বিয়ার শিল্পী, উলে ছিলেন জার্মানির। তাঁর আসল নাম অবশ্য ফ্র্যাঙ্ক উওয়ে লাইজপিন, কিন্তু পারফরম্যান্স আর্ট এর জগতে লোকে তাকে উলে বলেই চিনত। পোলেরয়েড আর্ট আর কোলাবরেটিভ আর্ট প্রোজেক্ট করার ফলে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। মারিনাও সেই সময়ে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট করছেন। কাকতালীয় কিনা জানি না, কিন্তু দু'জনের জন্মদিনও ছিল এক। ৩০ নভেম্বর।
১৯৭৬ সালে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয় উলে আর মারিনার। প্রথম সাক্ষাতেই ম্যাজিক। উলের মনে হয়, মারিনা আসলে এক কুহকিনী মহিলা, এই জগতের বাসিন্দা সে নয়। মারিনার মনে হয়, এই আধপাগলা সুন্দর বোহেমিয়ান যুবকের জন্যই তিনি পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন। তারপর আর কি! ইয়ে দিল বেচারা, পেয়ার কা মারা! নতুন প্রেমের স্ফুলিঙ্গ যখন স্তিমিত হল, একে অপরের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হলেন তারা। ভাগ্যিস হয়েছিলেন। পরবর্তী দেড় দশকে মারিনা-উলে জুটি শিল্প জগতে যা করেছেন, তা ইতিহাস তৈরি করেছে। একের পর এক যুগান্তকারী প্রজেক্ট, একের পর এক অসামান্য এক্সপেরিমেন্ট... মারিনা আর উলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। পরস্পরের প্রতি অসীম স্নেহ ও বিশ্বাস ছিল তাদের, এই পারস্পরিক বিশ্বাস তাদের পারফর্ম্যান্স আর্টেও ফুটে বেরোত।
'রিলেশন ওয়ার্ক' বলে তাদের যে প্রজেক্ট ছিল, সে নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। মারিনা আর উলে নিজেদের বলত 'টু হেডেড বডি'। কাজের সূত্রে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত তাদের, একটা ভ্যান নিয়ে সমস্ত ইউরোপ চষে বেরিয়েছে তারা। দর্শকদের কাছে এই জুটির 'ফ্যান্টম আইডেন্টিটি' ছিল বিস্ময়কর। তার একটা কারণ তাদের রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টও বটে। 'আর্ট ভাইটাল' অর্থাৎ নিরন্তর গতি অথবা স্থিতিকে কেন্দ্র করে এক একটা পরীক্ষা করত তারা। এই ধরুন গোটা এক দিন একে অপরের চুল বেঁধে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, অথবা মুখোমুখি ধনুষে তীর পরিয়ে ছিলা টেনে প্রস্তুত রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একজনের মনসংয়োগ যদি এক চুল নড়ে যায়, তীর যদি বেরিয়ে যায় ধনুষ থেকে, অপরজনের মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু তেমনটা হত না। তাদের নিজের কথায় বলতে গেলে এর রহস্য হল--
'উই বিকম দ্য আদার!'
পারফর্ম্যান্সের সময়ে উলে মারিনা হয়ে উঠত, মারিনা হয়ে উঠত উলে। উভয়ের শরীর দিয়ে একটাই শক্তি স্রোত বয়ে যেত, দু'জন ভিন্ন মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে যেত সেই সময়ে। মারিনার কথায়, "Our individual identities became less accessible. It revealed a way of having the artistic self made available for self scrutiny."
মারিনা-উলে জুটি নিয়ে তখন শিল্প জগত উত্তাল। সবাই বার বার একই প্রশ্ন করে, বিয়ে করছ কবে? মারিনা আগে বিবাহিতা ছিলেন, যদিও উলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আগের সম্পর্ক টেকেনি। দীর্ঘ সাত বছর একসঙ্গে থাকার পর আর একের পর এক আর্ট প্রজেক্ট করার পর তারা সিদ্ধান্ত নিল, বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেলা যাক। কিন্তু সাধারণ বিয়ে! ছোঃ! ওইসব হবে না! বিয়ের জন্য যে ভাবনা তাদের মাথা থেকে বেরোল, সেরকম কেউ কোনোদিন শোনেনি। মারিনা আর উলে ঠিক করল তার গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা অর্থাৎ চিনের দেওয়ালের দুই প্রান্ত থেকে হাঁটতে শুরু করবে। মাঝামাঝি দেখা হবে, তারপর হবে বিয়ে। মাস তিনেক লাগবে। এই অতিমানবিক আর্ট প্রজেক্টে তারা নিজেরাই প্রেমিক, নিজেরাই দর্শক, নিজেরাই শিল্পী। মিডিয়ার লোকজন তো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এরকম কেউ কস্মিনকালেও দেখেনি।
যাই হোক, ১৯৮৩ সালে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হল না। হবেও বা কী করে, চিনের আধিকারিকরা তো ব্যাপারটা বুঝেই উঠতে পারেনি। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনার উপর দিয়ে ক্যাবলা কাত্তিকের মতো হেঁটে যাবে, এ আবার কেমন ধারা আর্ট প্রজেক্ট? নিশ্চয়ই অন্য কোনও ব্যাপার আছে! অনেক কাণ্ড করে যখন অনুমতি পাওয়া গেল, পাঁচ বছর কেটে গেছে। ১৯৮৮ সাল। যাই হোক, ৩০শে মার্চ মারিনা আর উলে হাঁটা শুরু করল। মারিনা ইয়েলো সি-র কাছ থেকে হাঁটবে, উলে শুরু করেছে গোবি মরুভূমি থেকে। প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর তারা মিলিত হবে। যাত্রা শুরু হল।
মারিনা আর উলে হাঁটছে। চিনের প্রাচীন শহর, দুর্গম গিরিপ্রান্তর, ছোট ছোট গ্রাম। গ্রেট ওয়ালের অনেকটাই গিয়েছে লোকালয়হীন জনপ্রান্তর দিয়ে। রোজ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার করে হাঁটে তারা, মাঝে মাঝে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ইতিহাসের কথা ভাবে, ভাবে পরস্পরের কথা। কোনোদিন ঝোপঝাড়, কোনোদিন গুহা বা কন্দরে শুয়ে কাটাতে হয়। মাঝেমাঝে অবশ্য গ্রামে আশ্রয় পায়। একদম ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুর মার্কা গ্রাম, আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন। সেখানে অশীতিপর বৃদ্ধরা তাদের গল্প বলে। ড্রাগনের গল্প। গ্রেট ওয়াল অফ চাইনা আসলে তাদের কাছে ঘুমন্ত ড্রাগন। আগুনের আঁচের কাছে বসে এই গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। দিন কাটতে লাগল এইভাবেই। বিপদও কম হয়নি। শরীর খারাপ হয়েছে, দুর্ঘটনা হয়েছে, ডাকাতের পাল্লায় পড়েছে। একজায়গায় এসে মারিনা দেখে যতদূর চোখ যায় নরকঙ্কাল। মারিনাকে বেশ কিছুটা রাস্তা হেঁটে আসতে হল সেই অস্থিসড়কের উপর দিয়েই।
একসময় এই দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি হল। মিং বংশের সময়ে নির্মিত মন্দির প্রাঙ্গণেই এসে একে অপরকে দেখতে পেল তারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুজনে। মারিনা বলল, "এইবার?"
উলে বলল, "তুমি বলো!"
মারিনা বলল, "আমি এক্ষুনি বাড়ি যেতে চাই। "
উলে হেসে বলল, "আমি কিন্তু অনন্তকাল ধরে এই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে চেয়েছিলাম।"
মারিনা কাঁদতে শুরু করে। ব্যাপার আর কিছুই নয়, এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে, তাদের জীবনে নতুন মানুষ এসেছে। উলে একটু প্রাচীনপন্থী ছিল, অন্যদিকে মারিনা ছিল প্রবল ভাবে বিপ্লবী আর্টিস্ট। কিন্তু সব জেনেশুনেও এই যাত্রাটা করতে বদ্ধপরিকর ছিল দুজনেই। একসময় যে যাত্রা তাদের মিলনের প্রতীক হওয়ার জন্য ঠিক হয়েছিল, সেটা না হয় তাদের বিচ্ছেদের প্রতীক হয়েই থাকুক। কিন্তু, থাকুক।
প্রেসের লোক কিছুই জানত না। তারা বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিল নিজেরাই। সে সব রইল পড়ে। দু'জনে সংক্ষেপে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল। ম্লান হেসে একে অপরকে বিদায় জানাল, তারপর স্বতন্ত্র ভাবে ফিরে গেল নিজের নিজের দেশে।
সেই ঘটনার পর বাইশ বছর কেটে গেছে। উলে মারিনার মতো বিপ্লবী আর্টিস্ট হতে পারেননি, তিনি হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু রিলেশন ওয়ার্ক প্রজেক্টের কথা কেউই ভোলেনি। এদিকে মারিনা পারফরম্যান্স আর্ট জগতের সবচেয়ে বড় নাম হয়ে উঠেছেন দু' দশকে।
২০১০ সালে নিউয়র্কের মোমা মানে মিউজিয়াম অড মডার্ন আর্টস-এ একটা অনুষ্ঠান করছিলেন মারিনা। অনেকটা রিদম-এর মতোই, কিন্তু ফরম্যাটে সামান্য তফাত আছে। এতে মারিনা একটা চেয়ারে বসে থাকবেন, তার সামনে থাকবে একটা টেবিল। টেবিলের অপর প্রান্তে এসে বসত একটা অপরিচিত ব্যক্তি। দু'জনের মাঝে দুই মিটারের দূরত্ব। মারিনা অপলক তাকে দেখতেন যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি নিজেই উঠে যাচ্ছে। নিয়ম হল, কেউ কাউকে স্পর্শ করবে না, কেউ কথা বলবে না। নতুন কেউ আসার আগে মারিনা কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতেন, তারপর আবার অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত নবাগন্তুকের চোখের দিকে। এই অনুষ্ঠান চলেছিল প্রায় চার মাস। সাড়ে সাতশো ঘণ্টা মারিনা কাটিয়েছিলেন এই চেয়ারে বসে। এই আর্ট প্রজেক্টের নাম ছিল -- 'দ্য আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট।"
সেইদিনও সব নিয়ম মতো চলছিল। একজন অতিথি উঠে চলে গিয়েছেন, মারিনা ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করেছেন। চোখ খুলে দেখেন, তার সামনে বসে আছেন উলে। কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখে বলিরেখা। কিন্তু মারিনার চোখে সে সব অদৃশ্য। তিনি দেখছেন তার পুরোনো সঙ্গীকেই। ঠিক যেন বাইশ বছর আগের সেই চেহারা। উলের চোখে দুষ্টুমির হাসি। মারিনার মুখেও আবছা এক হাসির রেখা ফুটে উঠল, তার চোখ ভিজে গেছে। চোখের কোল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে পড়বে করেও পড়েনি। সহসা প্রবল পেশাদার শিল্পী বলে খ্যাত মারিনা নিজের নিয়ম নিজেই ভুলে গেলেন, একটু ঝুঁকে উলের হাতটা জড়িয়ে ধরলেন তিনি। দু'জনের চোখের আড়ালে অনেক না বলা কথা। কিন্তু কেউই কথা বলছে না। বাইশ বছর পর দেড় মিনিটের জন্য পৃথিবীর মানুষ আবারও দেখল এই 'টু হেডেড বডি'-কে। এত বছরের দূরত্বও যাদের আলাদা করতে পারেনি।
এই দেড় মিনিটে ঠিক কী হল, সেটা বোঝানোর ক্ষমতা পৃথিবীর সেরা কলমের কাছেও নেই। ইচ্ছে হলে ভিডিওটা দেখে নিন।

উলে মারা গিয়েছেন ২০২০ সালে। শেষ জীবনে মারিনা তার সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন।
কৃতজ্ঞতা:- বিবিসি ওয়ান, অশোক পান্ডে, গার্ডিয়ান