মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬

ভেবেছিলাম ডানা মেলে উড়ে যাব স্বাধীনভাবে,কিন্তু আবিষ্কার করলাম স্বাধীনতা একটি প্রকল্পিত ধারণা মাত্র।কেউ স্বাধীন হতে পারে না,পাখিরাও আকাশের অদৃশ্য় শিকলে বন্দী সারাজীবনের মত।যতই ছাড়ানোর চেষ্টা কর,তত চেপে বসে প্রত্যয়ের গভীরে। এই বন্দিদশা আর কিছুই নয়,নিজেকে  চিনতে না পারার ইতিহাস।বিশৃঙ্খলা কে সঙ্গী করে পরিপূর্ণতা পাওয়ার অবুঝ প্রচেষ্টা।নিজের স্বরূপ অস্বীকার করার হঠকারিতা।বিশ্বাস থাক অথবা না থাক,ডানা ছড়ানোর জন্যে প্রশস্ত আকাশ খুঁজি,যেখানে আর কেউ নেই আমায় ভয় দেখানোর,আমার জায়গা নেওয়ার।পরিবর্তন যে জীবনে সবচেয়ে স্থিতিশীল,এই সহজ সত্যের উপর যদি বিশ্বাস থাকত,স্বাধীন হতে বাধা ছিল না কোনো।স্বাধীন যারা,তারা এগিয়ে গেছে নিজের কাছে অসঙ্গত থেকেও।এই স্বীকোরোক্তি বেদনা দেয়,কিন্তু নিজস্বতার সম্মান অক্ষুণ রাখে,সে যতই বেমানান হোক না কেন।বৃষ্টি কিন্তু আজও হয়।তফাৎ শুধু এই,তারা উপলব্ধি করে,আমি সম্বেদন করি...বৃষ্টির জল বিশ্বাস কে ভেজায় না,মুক্ত করে.....
যদি নৌকাডুবি না হত,হয়ত অনেকদিন বেঁচে থাকত ভালবাসার রসদ,গাছে ফুল ফুটত স্বকীয় বিস্মৃতির।জীবন চলত,নৌকোরই মত।ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে।কয়েককলি পিছুটান সঙ্গে থাকত,বাকিগুলো ভেসে যেত বেহতা জীবনের হিল্লোলে।কয়েকফোঁটা বৃষ্টির উষ্ণতায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ত গাল বেয়ে,আর থেমেথাকা দৃষ্টি কখনো জ্যোৎস্না মেলে দেখত পূর্ণিমা রাতের আয়না।যদি  নৌকাডুবি  না হত,বিপ্লবের শিকড় ছড়িয়ে যেত অজানা নিশ্বাসে  আর জোয়ারে বয়ে আসত স্নিগ্ধ মননের পুজোর ফুল।চিঠির আদলে হয়ত ধরা পড়ত আরো একটি কবিতা,অথবা দেখা যেত আরেকফালি আকাশ,কারো চোখে।নৌকাডুবি হয়নি  .....একচিলতে না থাকা জঙ্গল শুধু স্বপ্ন ভাঙ্গার ছবি....আর নিয়তির লেখা শুধু প্রাণের গল্পই বলে।বেহতা জীবন আর নৌকার দাঁড়ে হাল ধরে বসে কাটে অনন্তকাল।মাঝে মাঝে ভাবি  ....যদি নৌকাডুবি হত....

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

যোগাযোগ এর পুরনো সূত্রগুলি রয়ে গেছে ডায়রির পাতায়,পুরনো ল্যান্ডফোনের পাশে রাখা থাকে যেটা গত দশ বছর ধরে।সেইদিন,যেইদিন মোবাইল এসেছিল বাড়িতে,যোগাযোগ কথাটায় একটা বিশেষণ যোগ করতে।ইনস্ট্যান্ট ফোন করতে,নাম্বার সেভ করতে,এসএমএস করতে।তারপর থেকে যোগাযোগের সুবিধে বেড়ে চলেছে,নিত্যনতুন পন্থায় যোগ হচ্ছে দুরত্ব কম করার উপায়,কিন্তু এত সত্ত্বেও ব্যবধান বেড়ে চলেছে দিনদিন। দিনদুপুরে মোবাইলের নাম করে নিজেকে চার্জ দিই,ডাটাকেবিলে গুঁজে রাখি চিন্তার সকেট।মাথার চারিপাশে কিলবিল করে নম্বর,হাতে বাঁধা আইসির যোগাবিয়োগের ফর্মুলা,প্রতি মুহুর্তে বদলে যায় ডেটার কবলে থাকা স্মৃতিচারণের প্রণালী,আরো নির্ভুল ক্যালকুলেশনএ।সম্পর্কের কোনো মিসিং লিংক থাকে না স্টোরেজএ ,প্রতিটা নম্বর জায়গা বদল করে গতিশীল ভাবনার আবেগ মেপে।কিন্তু ব্যবধান কমে না,রাজ্যের নোটিফিকেশনএর বন্যায় বয়ে চলে যায় পুরনো সম্পর্কের নামগুলো।স্টোরেজএ জমতে থাকা নামের পাশের ছবিগুলো শুধু হিসেবরক্ষা করে চলে তালাবন্ধ স্মৃতি কুঠুরির,যদি কোনদিন কেউ বাঁকা ঠোঁটে ঠুকরে লাল রক্ত বের করে,সেই আশায়...

শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬

ঘন হয়ে আসা ঢেউএর  গায়ে দিগন্ত বিস্তৃত জলছবি।মেঘের ছায়ায় সন্ধ্যে রঙের ক্ষণস্থায়ী রূপে সমুদ্রকে মনে হয় সুরিয়াল ক্যানভাসের মতো।পেরেসা বীচ আর ফিরার খোয়ার রাস্তায় এসে পড়েছে শেষ বিকেলের আবেশ।স্যানটোরিনি শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত টাভের্না ক্যাফে তে বসে অপেক্ষা করছি সীর্সার জন্যে।এখানে চারদিকে টাভের্না ক্যাফের ছড়াছড়ি,গ্রিক ডিশ সার্ভ করা এই ছোট বড় ক্যফে স্যানটোরিনি শহরের অন্যতম আকর্ষণ,প্রতিটা ক্যাফে থেকেই প্রায় দেখতে পাওয়া যায় সমুদ্র।ক্লিফ এরিয়ার টাভের্নাগুলো তে তো জায়গা পাওয়াই যায় না,শুধু সমুদ্র আর আকাশ দেখেই যে কিভাবে সারা-সারা দিন কেটে যেতে পারে অনায়াসে,স্যানটোরিনি এলে বুঝতে পারা যায়।মেডিটেরেনিয়ানের তীরে গ্রীসের এই দ্বীপে নোঙ্গর করে থাকে প্রচুর জাহাজ,বেশিরভাগ অবশ্য ক্রুজ শিপ।বহু বিছর আগে ভূমিকম্প হয়ে আগের ভূভাগ বিভাজিত হয়ে জেগে ওঠে ১০০০ ফিট উঁচু এই দ্বীপের প্রাচীর আর তার চারপাশে গভীর জলের লেগুন।সামনে ধপধপে সাদা বাড়িঘরের  পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে রঙচঙে পোশাক পরা টুরিস্টদের দল,টাভের্না তে বাজতে শুরু করেছে এখানকার প্রিয় বৌজৌকি অর্কেস্ট্রা।আকাশের রং গাড় লাল হয়ে যেন গলানো লাভা ঢেলে দিয়েছে সমুদ্রের বুকে,দিগন্তের কোনায় উঁকি দিচ্ছে অজানা আকৃতির মেঘবলাকার সারি।একটা একটা করে আলো জ্বলছে স্যানটোরিনি শহরে।কিছুক্ষণেই রাস্তাঘাট ঝলমলে হয়ে উঠবে,আর অন্ধকার গ্রাস করবে আকাশকে।শুধু জেগে থাকা তারাদের দল প্রতিশ্রুতি দেবে,কাল ফিরে আসার।হঠাৎআমার নাম শুনে বুঝলাম,সীর্সা এসে গেছে।এগিয়ে গিয়ে দেখি সাদা স্কার্ট এর ওপর গোলাপী টপ পরে দাঁড়িয়ে আছে সীর্সা ক্যাফের সামনে।আমায় দেখে ঠোঁটের কোন দিয়ে হাসল। 

"তাহলে সত্যিই ফিরলে?"
"কেন?তোমার মনে কি সন্দেহ ছিল?"
"তোমার মনে কি সন্দেহ ছিল না?"
"সন্দেহ ফেরা নিয়ে ছিল না সীর্সা,ফেরার সময় নিয়ে ছিল।ভাবতাম বেঁচে থাকতে ফিরব না মৃত্যুর পর?"
"ঝড়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছ তুমি?"
"ঝড়?না ঢেউ?"
"ঝড়।বৌজোকিতে "কাতিয়েইগা" বাজছে।কাতিয়েইগা মানে ঝড় জান তো?"
"তোমাদের স্বাধীনতার সুর।"
"স্বাধীনতা নয়,মুক্তি।মুক্তির সুর।তোমার জন্যে।"
"কেউ কি মুক্ত হতে পারে?চিরকালের জন্যে?"
"মনকে আটকায় কার সাধ্য?"
"কিন্তু বছর যে পেরিয়ে গেছে!"
"জীবন কি পেরিয়ে গেছে!"
"তুমি আছ তো?থাকবে তো?আমার জন্যে?"
"আমি তো ছিলাম না কোনদিন,আমি যে সীর্সা।সীর্সারা কারো জন্যে থাকে না,তুমি তো জান।"
"হ্যাঁ।সীর্সা মানেই তো লিবার্টি।"
"কিন্তু তুমি তো আছ।তোমার জন্যে।"
"আমি কি সত্যি ফিরতে পেরেছি?জীবনের জন্যে?"
"তুমি আসলে যাওইনি কোনদিন,যারা চলে যায় তারা কোনদিনই ফেরে না।ফেরে তারাই যারা আসলে যেতেই পারেনি"

বৌজৌকি বাজতে থাকলো।তারারা জ্বলছে।ঢেউয়ের ওপর ভাসছে জাহাজ।রাত নামছে।ভেসে আসছে গান।স্যানটোরিনি বেঁচে আছে আজও,যেমন বেঁচে ছিল ৪০ বছর আগে,যখন দেখা হয়েছিল সীর্সার সঙ্গে প্রথমবার এরকম এক রাতে।স্যানটোরিনি বেঁচে রইলো।বেঁচে রইলাম আমরা।মুক্তি কি একেই বলে?