মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭

অক্সফোর্ড

লন্ডন থেকে অক্সফোর্ডে যেতে গেলে বিনা দ্বিধায় চড়ে পড়া যায় অক্সফোর্ড টিউবে,চমৎকার ইন্টারসিটি বাস সার্ভিস।সাত পাউন্ড করে টিকিট।চোদ্দ পাউন্ডে দিব্যি ডে ট্রিপ করে নেওয়া যায়।কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।আমার হাতে শুধু একটা খালি উইকেন্ড।এতো জায়গা আছে লন্ডনের আশেপাশে,কোথায় যাবো আর কোনটা বাদ দেব?কেমব্রিজ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ষোলআনা কিন্তু টিকিটের দাম একটু বেশিই পড়ে যাচ্ছে।স্টোনহেঞ্জ গেলে অন্য কিছু দেখা হবে না।বাক আর উইন্ডসর ক্যাসলও দেখা হয়নি।শেষমেশ অক্সফোর্ড যাওয়া ঠিক হলো।রবিবার সকালে ভিক্টরিয়া অব্দি টিউবে গিয়ে নির্দিষ্ট বাস স্টপ থেকে উঠে চড়ে বসলাম বাসে।দিনে প্রায় দশ পনেরোটা করে বাস ছাড়ে অক্সফোর্ডের জন্যে।শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস।ভালো ব্যবস্থা।কিন্তু সর্বসাকুল্যে লোক মাত্র পাঁচজন।এতো কম লোক নিয়ে এতো বিলাসবহুল বাস চালিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে কি করে সেটা আমার মাথায় ঢুকলো না।

লন্ডন ছাড়াতেই চারদিকে চোখে পড়তে লাগলো সবুজের মেলা।যেখানে দেখো পাহাড়ের মত উঁচুনিচু জমিতে দিগন্ত অব্দি ছড়ানো সবুজ ভেলভেটের চাদর।তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছিমছাম ঘর,ফার্মহাউস,গ্রাম চোখে পড়ে।শান্ত জীবনযাত্রা।হাইওয়ে দিয়ে বাস চলেছে হু হু করে একের পর এক কিন্তু কোনো রকম শব্দ নেই।শেফার্ড বুশ পেরোনোর পর থেকেই রাস্তার দু ধারে সারি সারি হাওয়াকল বা উইন্ডমিল দেখতে পেলাম।সাঁই সাঁই করে হাওয়াকলের পাখাগুলো ঘুরছে।জোরে হাওয়া দিচ্ছে বাইরে।এমনিতেই যা শীত পড়েছে এরকম হাওয়া দিলে অক্সফোর্ডে কোনো ক্যাফেতে ঢুকে হি হি করতে করতে বসে থাকতে হবে।হেঁটে হেঁটে ঘোরার সাধ সাধই থেকে যাবে। হিলিংটন আসতে আসতে আমার চোখ  ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগলো।চারিদিকে এতো ভালো ভালো দৃশ্য,তা না দেখে ঘুমোনো মোটেও কাজের কাজ নয়।কিন্তু সাতসকালে উঠে আসতে হয়েছে,তার ওপর এমন আরামদায়ক বসার জায়গা।অতঃপর ঘুম না আসাই আশ্চর্য।যাই হোক,বেশিক্ষণ দিবানিদ্রা দেওয়ার সুযোগ হলো না।প্রায় একশো কিলোমিটার বেগে চালিয়ে দেড় ঘন্টার মধ্যেই অক্সফোর্ডের বাড়িঘর,নদী,খাল,খামার চোখে পড়তে লাগলো।বাস থেকে নেমে যখনা দাঁড়ালাম তখন ঘড়িতে পৌনে এগারোটা। 

অক্সফোর্ড শহরের পত্তন হয় অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি,কিন্তু প্রায় চারশো বছর পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তৈরী হওয়ার পর থেকেই এর খ্যাতি 
ছড়াতে থাকে আস্তে আস্তে।কেমব্রিজের মতন এখানেও কোনো সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং নেই বরং চল্লিশের ওপর কলেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা শহর জুড়ে।প্রতিটা কলেজেই আসলে স্থাপত্যের এক একটা নির্দেশন।আগেই আমরা চললাম অ্যাশমলিয়ান মিউজিয়াম দেখতে।মিউজিয়াম হলেও আসলে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের নিবিড় যোগাযোগ আছে।আর্ট আর আর্কিওলজির ছাত্ররা মিউজিয়ামে এসে প্রজেক্ট তৈরী করে,নোটস নেয়।








১৬৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও প্রত্নতত্ত্বের যাদুঘর হিসেবে অ্যাশমলিয়ানের সুখ্যাতি সারা পৃথিবী জুড়ে।মিশরীয় মমি থেকে সমসাময়িক শিল্প অব্দি নানা জিনিস সভ্যতা ও সংস্কৃতির গল্প বলে চলেছে অ্যাশমলিয়ান মিউজিয়াম।এই সংগ্রহ বিশেষভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ।ব্রিটেনের একমাত্র এইখানে দেখতে পাওয়া যায় কায়রোর বাইরে  মিশরীয় প্রাক-রাজবংশের ভাস্কর্য।এছাড়া এংলো স্যাক্সন আর্ট,আধুনিক চীনা আর্ট এবং সিরামিকের এতো বড় সংগ্রহ আর কোথাও নেই।ঘন্টাদুয়েক দেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।একদিনে সব কিছু দেখে ফেলতে হবে।বিকেল সাতটার সময়ে ফেরার বাস ঠিক করা আছে।ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও পড়ছে টুপ টুপ করে।তাতে অবশ্য মাথা ভেজে না।

 Ashmolean Museum
 Radcliff Camera

অক্সফোর্ডের বেশিরভাগটাই হেঁটে ঘুরে ফেলা যায়।ছোট শহর।বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী সাইকেল নিয়ে চলাফেরা করে।অনেক রাস্তাতেই গাড়ি চলে না।এই পুরোনো শহরের বাড়ি ঘর এ সুন্দর যে মনে হয় সিনেমার মধ্যে চলে এসেছি।পাঁচশো বছরের আগের আর্কিটেকচার এর সঙ্গে নতুন যুগের দোকানপত্র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এখানে হাঁটতে হাঁটতেই সময় কেটে যায় দিব্যি।অক্সফোর্ডের প্রধান দ্রষ্টব্য হলো এর কলেজগুলো ভিতর থেকে দেখা কিন্তু সে অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার।তাই আমরা বাইরে থেকেই দেখে নিলাম একে একে ক্রাইস্ট কলেজ,এক্সেটার কলেজ,কুইন্স কলেজ,অল সোলস কলেজ,অর্কেস্টার কলেজ।ক্রাইস্ট কলেজের ক্যাম্পাস দেখতে লম্বা লাইন পড়েছে রবিবারের দুপুরে।এই কলেজের অনেক জায়গাতেই হ্যারি পটারের শুটিং হয়েছে।হগওয়ার্টসের একটা মেজাজ ঠিকই বুঝতে পৰ যায় এখানে এলে।সেই উঁচু উঁচু পেল্লায় চিমনি,ক্যাম্পাসের মধ্যে সবুজ ঘাসের বাগান আর ইতিহাসের ছোঁয়া।একসময় আমরা গিয়ে পৌঁছলাম কভার্ড মার্কেটে।সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বাজার।অনেক রকম ফুলের দোকান সামনেই,তার সঙ্গে নানা ধরণের খাবার,ফল,ফ্যাশনের জিনিসপত্র।এটা খাবো সেটা খাবো করে কিছুই ঠিক হলো না,তাই শেষ মেশ আবার ম্যাকডোনাল্ডে গিয়েই লাঞ্চ সারতে হলো। 

লাঞ্চের পর চললুম বোডালিয়েন লাইব্রেরি দেখতে।এতো বিশাল লাইব্রেরি খুব কমই আছে।

Bodleian library
১৬০০ শতাব্দীতে তৈরী করা এই লাইব্রেরি আসলে শুরু হয়ে থেমস বোডালিয়েনের নিজের সংগ্রহের বই দিয়ে।একজন মানুষের কাছে কত বই থাকলে এরকম একটা লাইব্রেরি শুরু করা যায় এই কথাটাই আমার মাথায় ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো।এরপর ব্রড স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে চলে এলাম হার্টফোর্ড ব্রিজের কাছে। অনেকে বলে থাকে ভেনিসে থাকা ব্রিজ অফ সাইস এর সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে,তা যদিও ঠিক নয়।১৯১৪ সালে এই ব্রিজ তৈরী হয়েছিল হার্টফোর্ড কলেজের নতুন আর পুরোনো দুটো সেকশনের মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরী করার জন্যে।অনেক লোকে এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায়।আমরাও কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে নিলাম।
Bridge of Sighs
সামনেই আছে সেলডোনিয়ান থিয়েটার যেখানে ইউনিভার্সিটি সব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।এই সেলডোনিয়ান থিয়েটার নিয়েও একটা গল্প আছে।ষষ্টদশ শতাব্দীর এই থিয়েটার তৈরী হয় রোমের মার্সেলাস থিয়েটারের অনুকরণে,কিন্তু সেই সময়ে রোমের কোনো থিয়েটারেই ছাদের ব্যবস্থা থাকতো না।সকলকে বৃষ্টিতে ভিজে,রোদে পুড়েই অনুষ্ঠান দেখতে হত।কিন্তু প্রথম শতাব্দীর রোম আর  ষষ্টদশ শতাব্দীর অক্সফোর্ড তো এক নয়,এটা হলো গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।ছাত্ররা বললো ছাদ বানাতেই হবে।একদল লোক তার বিরোধিতা করলো নানা ছুতো দেখিয়ে।অনেক কাণ্ডের পর শেষ পর্যন্ত ছাদের ব্যবস্থা করা হলো।আর্কিটেক্ট ক্রিস্টোফার রেন অক্সফোর্ডের প্রফেসর জন ওয়েলসের 'জিওমেট্রিক ফ্ল্যাট রুফ' এর ওপর ভিত্তি করে এমন এক গোথিক ডিজাইন তৈরী করলেন যে নিন্দুকরা ধন্য ধন্য করতে লাগলো।যারা বলেছিলো ছাদ ভেঙে যাওয়ার ভয় আমরা বেলেডোনিয়ান থিয়েটারে পা রাখবো না,তারা ছাদের অপূর্ব ফ্রেস্কো দেখতেই বার বার আসতে লাগলেন। 

Sheldonian Theatre
সামনেই রেডক্লিফ স্কয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল রেডক্লিফ ক্যামেরা।যা দেখছি তার থেকেই চোখ সরছে না।এতো সুন্দর আর প্রাচীন ঐতিহ্যের একের পর এক বিল্ডিং কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।খানিকটা হেঁটে গেলেই পরে সেন্ট ম্যারিস চার্চ।হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখে নিলাম ম্যাগডালেন কলেজ,বোট হাউস,অক্সফোর্ড বোটানিক্যাল গ্রাউন্ড।এখানে কেমব্রিজের মতনই  'পান্টিং' করার চল আছে।ছোট ছোট নৌকোতে অনেকেই পান্টিং করতে বেরিয়ে পরে সময় পেলেই টেমস(অনেকে আইসিস ও বলে) নদীতে।সময় দ্রুত পেরোচ্ছে।বিকেল শেষের দিকে। 


Punting
অবশেষে হাঁটতে হাঁটতে আমরা হাজির হলাম পিট রিভার মিউজিয়ামে।ভিক্টরিয়া স্টাইলে তৈরী করা এই মিউজিয়ামে ঢুকলে একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়।অন্যান্য মিউজিয়ামের মত একদমই নয়।ছবিগুলো দেখলে খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।একসময় যখন আমরা লন্ডন গামী বসে উঠে বসেছি,মাথার মধ্যে অক্সফোর্ড গিজগিজ করছে।এতো কিছু কি একদিনে দেখা যায়!পরের বার এসে এখানে ঘাঁটি গাড়তে হবে।প্রিসন হোস্টেলে এসে উঠব,পান্টিং করবো আর কভার্ড মার্কেটে গিয়ে ব্রেকফাস্ট খাব।তারপর বিকেলে অনুষ্ঠান শুনতে যাবো সেলেডোনিয়ান থিয়েটারে।এই সব ভাবতে ভাবতে বাস ছেড়ে দিলো।শহরের বুকে আলো জ্বলে উঠেছে কিন্তু লন্ডনের মত আলোর রোশনাই আর বাড়াবাড়ি নেই।দিনের শেষে অক্সফোর্ড মনে করিয়ে দিলো আদপে এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে আজও তিরিশ হাজার ছাত্র ছাত্রী শিক্ষালাভ করছে।    
 All souls College


Pitt River Museum

Magdelene College

Christ College






শুক্রবার, ৯ জুন, ২০১৭

হ্যামস্টেড হিথ 

লন্ডনের সীমানার মধ্যে থাকা হ্যামস্টেড গ্রামটি নিয়ে আমার কৌতুহল প্রথম থেকেই ছিল।শান্ত,সবুজ,একলা গ্রাম।হ্যাম্পস্টেড গ্রামটি ঘেরা আছে সবুজ উঁচুনিচু প্রান্তর বা গ্রাসল্যান্ড দিয়ে,যার নাম হ্যামস্টেড হিথ।প্রায় ৮০০ acre এ ছড়িয়ে থাকা এই সবুজের সমারোহে বেশ কয়েকটা পুকুর,উঁচু পাহাড়ের টিলা,আর প্রাচীন গাছের জঙ্গল দেখতে পাওয়া যায়।হিথের একদিকের টিলার নাম পার্লামেন্ট হিলস।যেখান থেকে প্রায় সারা লন্ডনটাই দেখতে পাওয়া যায়।অন্যদিকে কেনউড হাউস ও গ্রামের জনপদ।লন্ডনের ব্যস্তসমস্ত জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় এখানে।লন্ডন শহরে নয়,সবচেয়ে বেশি মিলেনিয়ারদের বাস এই ছোট্ট গ্রামে।প্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে নানা আর্টিস্ট,লেখক,কবি,অভিনেতা এখানে এসে বাস করছেন।এলিয়ট,আগাথা ক্রিস্টি,ইয়ান ফ্লেমিং,কিটস,হাক্সলি,জন কনস্টেবল,স্ল্যাশ,জুডি ডেঞ্চ থেকে হালের শার্লক হোমস বেনেডিক্ট কুম্বারবাক পর্যন্ত সকলেই হ্যামস্টেডের নিবাসী।হ্যামস্টেডকে ইন্টেলেকচুয়াল গ্রাম বললে মোটেই বাড়াবাড়ি হয় না।নাজি শাসনের সময় যখন একের পর এক আভ্যান্ট গার্ডে আর্টিস্টরা এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে,এখানকার লোকেরা সাগ্রহে তাদের অভিবাদন করেছে।'হ্যাম্পস্টেড লিবেরিসম' সাড়া ফেলেছে লন্ডনের বাইরেও।ক্রমে নানা দেশের নানা লোকে এসে এখানে থাকতে শুরু করেছে কিন্তু গ্রামটা এখনো সেই একই রকম ভাবে শান্ত ও সুন্দর রয়ে গেছে।কোলাহলের রেশমাত্র নেই। 




হাইগেট থেকে হ্যাম্পস্টেড হিথ পৌঁছতে সময় লাগলো আধ ঘন্টা।ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।গা ভেজে না এইরকম বৃষ্টিতে।যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ।বৃষ্টির পরোয়া না করে নানা লোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।পোষা কুকুররা দৌড়াদৌড়ি করছে।এ এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা।গাছের তলায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়।কাঁচাপাকা রাস্তা চলে গেছে হোয়াটসস্টোন পণ্ডের দিকে।সেখানে সুন্দর একটা ব্রিজ তৈরী হয়েছে।আমরা ঘুরতে ঘুরতে পার্লামেন্টারি হিলের ওপর চলে এলাম।একধার দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে লন্ডন আই,ওয়্যারলেস টাওয়ার,কুকুম্বার টাওয়ার নিয়ে লন্ডন শহরটা।ঝিরঝিরে বৃষ্টি মেখে,ভেজা ঘাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টাখানেক পর কিট্স হাউসের দিকে এগোলাম।বাড়িটা সুন্দর।সামনে পিছনে ফুলের বাগান।এখানে থাকলে কবিতা নিজেই নিজেকে লিখিয়ে নেবে।হ্যাম্পস্টেড থেকে ফেরার সময় মনে হলো,লন্ডন না এলেও ক্ষতি নেই।শুধু এই ছোট্ট গ্রামটার জন্যেই এখানে ফিরে আসা যায়। 









লিটল ভেনিস ও প্রিমরোস হিলস 

বাজারে যাওয়ার মজাই আলাদা।এই কদিনে যত লোকাল বাজার ছিল চষে ফেলেছি।স্পেটলফিল্ড মার্কেট,ব্রিক লেনের বাংলা বাজার,গ্রিনউইচ মার্কেট,ফ্লিট স্ট্রিট,নটিংহিল মার্কেট সবগুলোর নিজস্ব একেকটা বিশেষত্ব আছে,কিন্তু ক্যামডেন লক মার্কেটের মতন আর একটাও নয়।ক্যামডেন মার্কেট একেবারে অন্য চরিত্র মেলে ধরে চোখের সামনে।কালো দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতি,লেদার জ্যাকেট আর হিপিদের বাজনা,ফুটপাথের জিভে জল আনা সারা পৃথিবীর খাবার আর উদ্ভট এবং আনকমন জিনিসের দোকানপাট এখানকার ভোল পাল্টে দিয়েছে।







প্রায় ঘন্টাদুয়েক ধরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরোনো বইয়ের দোকান।ট্যাটুর কারিগরি,নতুন ধরণের বাইক তৈরির ওয়ার্কশপ,বিস্তর জিনিসপত্রের নামও জানি না।সাড়ে চার পাউন্ডে পাওয়া গেলো একবাক্স খাবার।থাই নুডল্স,চিকেন,পোর্ক,সবজি,সস মিশিয়ে তৈরী একটা দারুণ জিনিস।(শেষ করতে পারিনি,এত বেশি ছিল)



তারপর সন্ধ্যে হব হব করছে,আমি আবিষ্কার করলাম পাশের ক্যানালটার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে লন্ডন জুয়ের দিকে।ব্যাস।চললুম সেইদিকে।

এই দিকের খবর বিশেষ কেউ জানে না।টেমস যদি থেকে বেরোনো এই শাখানদী বা খালে দিব্যি নৌকো করে ঘুরে বেড়ানো যায় ইচ্ছে করলে। ভেনিসের গন্ডোলার মতন দেখতে নৌকাগুলো বেশ রংচঙে।এই জন্যে এই জায়গাটাকে বলা হয় লিটল ভেনিস।খালটা বেশ গভীর।পাশ দিয়ে রাস্তাটা উঁচু নিচু হয়ে এগিয়ে চলেছে।মাথার ওপরে একটা ব্রিজ পড়লো।সেই ব্রিজের তলা দিয়ে মিনিট পনেরো এগিয়ে গিয়ে দেখি ক্যানাল বেশ চওড়া হয়ে ডানদিকে বেঁকেছে।বাঁদিকে পুরোনো একটা চার্চ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অন্য পাড়ে।খানিকটা এগিয়ে এই ক্যানাল চলে গেছে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে।পাশের সিঁড়ি দিয়ে মেন রাস্তায় উঠে এলাম। খানিকটা এগোতেই দেখি প্রিমরোস হিলের বিশাল পার্কটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।লন্ডনের পার্কগুলো নামেই পার্ক।একেকটা ছোট শহর ঢুকে যাবে এক একটা পার্কে।চললুম সেখানে।সবুজ ভেলভেটের চাদর পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে গাছের পাশ দিয়ে।যখন পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌঁছলাম সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।লন্ডন শহরের আলো জ্বলে উঠেছে।রঙ্গীন আলোয় মায়াময় দেখাচ্ছে দূরের সাউথব্যাংকের এলাকাগুলোয়।ঘোর লেগে যায়।ঘন্টাখানেক পর নামতে শুরু করলাম।প্রিমরোস হিলের সেই সন্ধ্যে মনে বাসা বেঁধে রইলো চিরকালের মত। 













সাউথব্যাংকসে একটা বিকেল 

টেমস নদীর দক্ষিণ প্রান্তে নদীর ধার দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে টাওয়ার ব্রিজ থেকে বিগ বেন আর হাউস অফ পার্লিয়ামেন্ট পর্যন্ত।ডান দিকে নদীর ওপর একের পর এক ব্রিজ।টাওয়ার ব্রিজের পর পড়ে লন্ডন ব্রিজ,সাউথওয়াক ব্রিজ,মিলেনিয়াম ফুট ব্রিজ,ব্ল্যাকফ্র্যায়ার্স ব্রিজ,ওয়াটারলু ব্রিজ,ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজ।গোটা সাউথব্যাংকে নদীর ধারটা সাজিয়ে তোলা হয়েছে রং বেরঙের  ক্যাফে,তাভার্না শপ আর মিউজিয়াম দিয়ে।কাছাকাছির মধ্যেই প্রাচীন আমল থেকে বিখ্যাত বরো মার্কেট,যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত লোভনীয় খাবারদাবারের দোকান বসে।টাওয়ার ব্রিজের কাছেই নানা ব্যাংকের অফিস,অনীশ কাপুরের ডিজাইন দিয়ে সাজানো চত্ত্বর।সেখান থেকে একটু এগোলেই শেক্সপিয়ার গ্লোব থিয়েটার।




সেদিন সন্ধ্যেবেলায় শেক্সপিয়ার গ্লোব থেকে হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম ওয়েস্টমিনিস্টারের দিকে।এর চেয়ে ভালো সন্ধ্যাযাপন আর হয় না।দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার।এখানে বৃহস্পতিবার রাত্তির থেকেই উইকএন্ডের আমেজ চলে আসে।নানা লোকে বসে আছে টেমসের কাছাকাছি ক্যাফেগুলোতে।চলছে খাদ্য ও পানীয় সহ খোশগল্প।টেট ব্রিটেন ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম ব্যাংকসাইড গ্যালারিকে পাশ কাটিয়ে।রঙিন আলোয় সাজানো গাছগুলো আরো মায়াময় করে তুলেছে টেমস পাথ কে।দূরে সূর্য ডুবে আকাশে লাল রং ছড়িয়ে গেছে।নদীর দিক থেকে বেশ ফুরফুরে হওয়া দিচ্ছে।আমরা খোশমেজাজে হেঁটে চলেছি।মাঝে মাঝে এক একেকজনের দেখা পাচ্ছি।নিজের মনে গিটার বাজিয়ে গান করছে।অনেকে সেই গান শুনে হাততালি দিচ্ছে।এই আমুদে জীবনযাত্রা চলছে কয়েকশো বছর ধরে।যতই বড় বিপদ আসুক না কেন,সাউথব্যাংকস ঠিক নিজের চরিত্রে ফিরে আসে গান,বাজনা,হইহুল্লোড় আর টেমসের ভেজা বাতাস নিয়ে।



ন্যাশনাল থিয়েটারের কাছে পৌঁছে দেখলাম বহুলোকে এসেছে প্লে দেখতে।লন্ডন শহরে নাটক দেখার উৎসাহ সিনেমা দেখার চেয়ে অনেক বেশি।উজ্জ্বল আলোয় ন্যাশনাল থিয়েটার জগমগ করছে।অনেক দূর থেকেই দেখতে পাওয়া গেলো লন্ডন আইর নাগরদোলার লাল আলো।হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম এম্ব্যাঙ্কমেন্ট ছাড়িয়ে লন্ডন একোয়ারিয়াম এর কাছে।জুবিলী গার্ডেনে কত লোকে বসে আছে খাবার দাবার নিয়ে।আলোয় আলো চারদিকে।কতক্ষণ বসে থাকা হলো খেয়াল নেই।বিগবেনের ঘড়ির টিক টিক কাঁটা একসময় মনে করিয়ে দিলো ফেরার কথা।এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না,কিন্তু ফিরতে হবে।পা দুটো ফিরে গেলো আমাদের,মনটা সেখানেই রয়ে গেলো।

                        
                        
                        
-------------------------------------------------------------------------------

ছবির কথা