আমরা আজও একইভাবে বেঁচে আছি
ব্যবধান আর অন্তরালের বাড়ি
গাছ ছেড়ে মন পাখিদের কাছাকাছি
পাখিদের ছেড়ে তারাদের দেশে পাড়ি
সেখান থেকে শান্ত প্রেমের কটেজ
অনুরাগলতা বেড়ে ওঠে বাঁকে-বাঁকে
চিন্তার অনুজীবী যত্নের ভ্রমে সতেজ
এক হাতে যেন লন্ঠন ধরে রাখে
~ফিলিপ জাকতে
১) 'সুইটজারল্যান্ড! ওহ্! সে এক স্বপ্নের দেশ! সেখানে দুধের নদী বয়ে যায়। অপূর্ব দৃশ্যাবলী, পাহাড়গুলো যেন সোনা-রুপো দিয়ে বাঁধানো। গাছে গাছে ফল। ফুলের চাদর বিছোনো রাস্তাঘাট। সেই দেশে কেউ গরীব নেই, সকলেই রাজা। সুইটজারল্যান্ড আসলে এই পৃথিবীর দেশ নয়, সে এক স্বর্গরাজ্য। বহু পুণ্য করলে সেখানে যাওয়া যায়।"
কয়েক দশক আগে সুইটজারল্যান্ড নিয়ে আমার চেনা পরিচিত মানুষের মনে যে ভাবনা ছিল, সেটা অনেকটা এরকমই। তারপর হঠাৎ করে যশ চোপড়ার হিন্দি সিনেমা এসে দেশের মানুষের মনে সুইটজারল্যান্ড-এর যে ছবি আঁকতে শুরু করল, তাতে এই স্বপ্নরাজ্যের প্রতি আগ্রহ একটুও কমেনি। কিন্তু সুইটজারল্যান্ড নিয়ে যে শুধু ভারতীয়রা মাতামাতি করে তা মোটেই নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের মনে সুইটজারল্যান্ড-এর প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ আছে সেটা মানতেই হবে। তার একমাত্র কারণ সুইটজারল্যান্ড সত্যিই এক স্বপ্নরাজ্য। পৃথিবীর অন্য কোনও জায়গার সঙ্গেই তার তুলনা চলে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে এরকম 'ল্যান্ডস্কেপ' কোনও দেশেই নেই।
সুইটজারল্যান্ড যেতে গেলে অনেক পুণ্য দরকার সেটা ঠিক নয় যদিও, তবে টাকাপয়সা যে ভালোই দরকার তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভারতীয়দের কথা ছেড়েই দিলাম, পাশ্চাত্য দেশের বহু মানুষকে এই যাত্রাতেই আমরা সুইটজারল্যান্ডের নাম চোখ কপালে তুলতে দেখেছি।
মেক্সিকোর মেয়ে মারিয়া আমাদের বলেছিল, "ওই দেশের কথা আর জিগ্গেস কোরো না হে! চার দিনে যে আমার কত টাকা খরচ হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। কিন্তু সেই কথা আমি আর মনে করতে চাই না। যা দেখেছি, সেইটাই মনে রাখতে চাই। ওহ! কী অসামান্য!"
ইতালির ছেলে দিয়েগো বলেছিল, "ও বাবা! সুইটজারল্যান্ড গিয়ে আমার সাত বছরের রোজগারের টাকা সাতদিনে উড়ে গেছে। ওখানে যেতে হলে বুকের পাটা চাই। ও সাংঘাতিক জায়গা। লোভে পড়ে গিয়েছ কি মরেছ!"
তা আমরা হলাম গরীব দেশের মানুষ। কড়ি নেই পকেটে ঠিকই, কিন্তু বুকের পাটা যথেষ্ট আছে। ভেবেছিলাম উপোস করেই না হয় কাটিয়ে দেব কয়েকদিন, কিন্তু সুইটজারল্যান্ড হাম যায়েগা জরুর। পাহাড়পাগল বলে বন্ধুমহলে কিঞ্চিত পরিচিতি আছে, পাহাড়ে টানা এক মাস থাকার লোভেই মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করতেও ছুটে গেছিলাম। আর ইউরোপে এসে আল্পসের দেশে যাব না! হতেই পারে না।
সব আশায় ছাই পড়ল খোঁজখবর করতে গিয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় খোঁজ করলে সস্তার থাকা-খাওয়ার জায়গা পাওয়া যায় ঠিকই। সেই বিশ্বাসে কোনও দিন চিড় ধরেনি, দেশে-বিদেশে খাঁটি ব্যাকপ্যাকারদের জন্যে তুলে রাখা সস্তার ঠেক ঠিক খুঁজে বার করেছি। কিন্তু সুইটজারল্যান্ডের ব্যাপারই অন্য। থাকা খাওয়ার কথা ছেড়েই দিলাম, ট্রেনে-বাসে-মাউন্টেন রেলওয়ে-কেবল কার-এর খরচ দেখেই আমাদের চোখ কপালে উঠে গেছে। হয়তো আধ ঘন্টার জন্যে ট্রেনে বসলে ইউরোপের অন্যান্য দেশে খুব বেশি হলে কুড়ি ইউরো খরচ হচ্ছে, সেখানে সুইটজারল্যান্ডে ওই দূরত্বের টিকিটের দাম প্রায় দুশ ইউরো। সব জায়গায় কুড়ি-তিরিশ ইউরোতে ভালো করে হোটেলে খাওয়া হয়ে যায়, সেখানে সুইটজারল্যান্ডে খরচ প্রায় আড়াইশ সুইস ফ্রাঁ, অর্থাৎ দুশ কুড়ি ইউরোর কাছাকাছি। দেড় ইউরোর কফি দশ ইউরো, এক প্লেট নুডল্স বারো ইউরো। সুপারমার্কেটে জিনিসপত্র খানিকটা সস্তা হলেও অন্যান্য দেশের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশি দাম।
খোঁজখবর করে জানা গেল সুইসরা নানারকম কার্ড ব্যবহার করে। হাফ ফেয়ার কার্ড, স্টুডেন্ট কার্ড, পয়েন্ট টু পয়েন্ট কার্ড, রিজিনাল কার্ড ইত্যাদি আছে, তাতে টিকিটের পয়সা বার বার দিতে হয় না। ব্যাকপ্যাকারদের জন্যে সুইস পাস আছে তিন দিন, পাঁচ দিন. আঠ দিন ও পনেরো দিনের। সেটা নিলে বাস, ট্রেনে টাকা দিতে হবে না। অনেক জায়গার দ্রষ্টব্য, কেবল কার এবং মাউন্টেন রেলের টিকিটও কাটতে হবে না। এমনিতে অন্য সব দেশে এরকম ট্রাভেল কার্ড নিতে আমরা পছন্দ করি না, কিন্তু সুইটজারল্যান্ডের খরচের হিসেব করে দেখা গেল সুইস পাস নেওয়াই বরং মন্দের ভালো। একজনের তিনদিনের সুইস পাস প্রায় দুশ সত্তর ইউরো করে, কয়েকমাসের মাইনের সমান। আল্লা! দুজনের পাস কিনতে যত টাকা খরচ হবে, তত টাকা আমাদের এক মাসেও খরচ হয়নি। দেশে ঘুরতে গেলে তো কথাই নেই। কলেজে পড়ার সময় একমাসের জন্য কেরল গেছিলাম চারবন্ধু মিলে, মাথাপিছু খরচ হয়েছিল চার হাজার টাকা। আর এখন? হায় হায়! কিন্তু বুকের পাটা বলে কথা! ভাঙব তবু মচকাব না প্রতিজ্ঞা করে এসেছি। বুকের পাটা দেখিয়ে ছাড়ব। এসপার কিংবা ওসপার।
আসন্ন অভিযানের জন্য স্ট্রাসবুর্গের দোকান থেকেই সস্তার খাওয়াদাওয়ার সব জিনিস কিনে নেওয়া হল দিন চারেকের জন্যে। সুইটজারল্যান্ডে গিয়ে এক কাপ কফিও বাইরে খাব না, দরকার পড়লে ফ্লাস্কে করে চা কফি করে নিয়ে যাব বাইরে। জোগাড়-যন্ত্র শেষ। আমাদের উত্তেজনাও চরমে। অবশেষে একদিন সকালবেলা কেভিনকে বিদায় জানিয়ে স্ট্রাসবুর্গ থেকে সুইটজারল্যান্ডের বাসেলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম।
বাসেলে আমাদের থাকার কথা নয়। মোটামুটি সস্তার একটা ভালো হোমস্টে পাওয়া গেছে সুইটজারল্যান্ডের দক্ষিণে, জেনেগেন বলে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে। সেখানে যেতে হলে আমাদের বেশ কয়েকবার ট্রেন বদল করতে হবে। বাসেল প্রায় সুইটজারল্যান্ডের সীমানায়, সেখান থেকে সুইস পাস নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হবে।
সুইটজারল্যান্ডের সীমানায় বর্ডার পুলিসের কাছে পাসপোর্ট-ভিসা দেখাতে হল। বহুদিন পর্যন্ত সুইটজারল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়নি, সেনগেন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তও হয়েছে অনেক পরে। এই দেশের ইতিহাস এবং রাজনৈতিক গতিবিধি অন্যান্য দেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। মধ্যযুগের পর থেকেই আস্তে আস্তে সুইটজারল্যান্ড যুদ্ধ এবং বিবাদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে। বাস্তবে সুইটজারল্যান্ড কোনও দেশ নয়, ছাব্বিশটি 'ক্যান্টন' অর্থাৎ স্বাধীন অঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলা একটা কনফেডারেশন। জার্মান, ফ্রান্স, ইতালিয়ান এবং রোমান্জ ছাড়াও নানা ভাষায় কথা বলে এখানকার মানুষজন। এই ছাব্বিশটি অঞ্চলের নাগরিকদের এক রাষ্ট্রের সুত্রে বাঁধার জন্যে কোনোদিনই একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি অথবা রাজনৈতিক ভাবধারাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি বরং সকলকে একসঙ্গে নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত করার চেষ্টা করা হয়েছে প্রথম থেকেই। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সুইটজারল্যান্ড পুরোপুরি নিরপেক্ষ থেকে গেছে। অন্যান্য দেশে যখন রক্তারক্তি চলছে, রেডক্রস নিয়ে এখানকার বহু মানুষ অসুস্থ এবং আহতদের সেবায় মনোনিবেশ করেছে। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি হয়তো বেলজিয়ামের মত সুইটজারল্যান্ডকে আক্রমণ করত, কিন্তু সারা সীমানা জুড়ে থাকা আল্পসের দুর্গম পাহাড়ের সীমানাই সেটা হতে দেয়নি। বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে বহু লেখক, কবি, শিল্পী, রাজনৈতিক শরনার্থী, অ্যাকটিভিস্ট, হুইসলব্লোয়াররা এখানে এসে আশ্রয় পেয়েছে এখানে। সেই ধারা আজও বজায় আছে।
সীমানা পেরোতেই বাসেলে পৌঁছে গেলাম। সামনেই অত্যাধুনিক কায়দায় নির্মিত বিশাল ট্রেন স্টেশন। সুইস কার্ডের অফিসে গিয়ে দুটো সুইস পাস নিতে গিয়ে হাত কড়কড় করছিল। এতগুলো টাকা! পরক্ষণেই মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিলাম। ধ্যুত! টাকা নিয়ে হবেটা কী? অভিজ্ঞতাই যদি না হয়? টাকা মাটি, মাটি টাকা।
ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। তিনটে উনষাটের ট্রেন ধরে আমরা বার্ন পৌঁছব চারটে এক্কান্ন। টাইম টেবিলে দেখাচ্ছে চারটে পঞ্চান্নয় সেখান থেকে বৃগ এর গাড়ি ধরতে হবে। সেই গাড়ি আমাদের ভিস্প স্টেশনে নামাবে সাড়ে পাঁচটা। সেখান থেকে জেনেগেন কী করে যেতে হবে জানা নেই। সেখানে গিয়েই জিগ্গেস করা হবে। ট্যাক্সি যদি করতে হয়, আমরা শ্যাষ। তাছাড়া চার মিনিটের ব্যবধানে এক ট্রেন থেকে নেমে অন্য ট্রেন ধরব কী করে সেই নিয়েও আমাদের খানিক চিন্তা ছিল, পাঁচ মিনিট লেট হলেই হয়েছে আর কি! তখনও আমাদের জানা নেই যে ট্রেন এক মিনিট লেট হওয়াই এই দেশে বিশাল ব্যাপার, পাঁচ মিনিট লেট তো ভাবাই যায় না।
কাঁটায় কাঁটায় চারটে এক্কান্নতে বার্নগামী ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে উঠে বসলাম। সামনাসামনি সিটের মাঝে টেবিলের ব্যবস্থা করা আছে, অনেকেই সেখানে কাজ করছে ল্যাপটপ খুলে। ট্রেন চলতে শুরু করল। আমরাও হুমড়ি খেয়ে পড়লাম জানলাম ওপর।
সবুজ দেশ। ছিমছাম বাড়িঘর। বেশি কিছু দেখা যায় না। ট্রেন বার বার পাহাড়ের মধ্যের টানেলে ঢুকে পড়ে দীর্ঘক্ষণের জন্যে। পাহাড় কেটেই রেললাইন করা হয়েছে। অনেকটাই সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে গেছে সেই লাইন।
বার্নে এসে দেখি কাঁটায় কাঁটায় চারটে এক্কান্ন। হুড়মুড় করে নেমে প্ল্যাটফর্ম বদলে আইসি-৮ লেখা বৃগগামী ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেন বার্ন ছেড়ে বেরোতেই একটা পাহাড়ের সেতুর ওপর এসে পড়ল, সেখান থেকে বহু নিচে দেখা যাচ্ছে রাইন নদীর স্বচ্ছ নীল সবুজ জল। সেখানে ছেলেমেয়ের দল সাঁতার কাটছে, কয়েকজন কায়াক নৌকো দিয়ে দাঁড় বাইছে। নদীর জল এতটাই স্বচ্ছ যে এত ওপর থেকেও আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জলের তলায় থাকা নুড়ি পাথর।
এর পর থেকেই জানলার বাইরে ঢালু পাহাড় শুরু হল। জানলার কাঁচে নাক লাগিয়ে বসে আছি। একের পর এক উঁচু নীচু সবুজ ঢালু পাহাড়। সবুজ ঘাসের গালচের ওপর ছোট্ট ছোট্ট কাঠের কটেজ। কী সবুজ! কী সবুজ! এমন মারকাটারি সবুজ দিগন্ত আমরা জিন্দেগীতে কোনোদিন দেখিনি। অন্য কোনও দেশে এই দৃশ্য দেখাও যায় না। এদিকে ট্রেন সাঁই-সাঁই করে ছুটে চলেছে। আমাদের আর মন ভরছে না, ইচ্ছে করছে টুক করে ট্রেন নেমে নেমে যাই। দু' চোখ ভরে দেখে নিই। তারপর নিজেই নিজেকে বোঝাচ্ছি। এই তো সবে শুরু!
স্পিজ স্টেশনে আসার আগেই ইন্টারলেকেনের বিশাল থুন হৃদ দেখে আমরা বাক্যহারা হয়ে গেলাম। জল না আয়না বোঝা দায়! প্রথম বার মনে হয় যেন আকাশটাই উল্টে দেওয়া হয়েছে মাটিতে, সেই স্বচ্ছ জলে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ঘন সবুজ প্রতিফলিত হচ্ছে। হ্রদের জলের ধার দিয়ে একটা লাইন চলে গেছে ইন্টারলেকেন ওয়েস্টের দিকে। ব্রিঞ্জ আর থুন হ্রদের অন্তর্বর্তী অঞ্চল বলেই ইন্টারলেকেন নাম। ইন্টারলেকেন ইদানীং কালে ইউরোপের অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল বলে বিখ্যাত হয়েছে। বাঞ্জি জাম্পিং থেকে শুরু করে প্যারাগ্লাইডিং, সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে এখানে। আকাশেচোখ যেতে দেখি রঙ-বেরঙের হ্যান্ড-গ্লাইডার পাখির মতনই ওড়াউড়ি করছে। হ্রদ ছাড়িয়ে আবার ঢালু পাহাড়ের সারিও দেখতে পাচ্ছি। যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজের ঢেউ। আঙুর বাগান আর মসৃণ ভাবে কাটা সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে চওড়া জানলা আর ফুল গাছের কেয়ারি দিয়ে তৈরি কটেজগুলো বাদামি আর লাল রঙা। এদের পোশাকি সুইস নাম শ্যালে।
আমাদের ট্রেন ততক্ষণে স্পিজ স্টেশন ছাড়িয়ে একটা টানেলে ঢুকে গেছে। বাইরের দৃশ্য আড়াল হতে মাথা চাপড়ে নিজেকে শান্ত করলাম। মনে মনে বললাম, "সেনোরিতা, বড়ে বড়ে দেশো মে অ্যায়েসি ছোটি ছোটি বাতেঁ হোতি রেহতি হ্যায়।" সেনোরিতা অবশ্য দিব্যি খোশমেজাজে আছেন, তাঁকে আলাদা করে ডায়ালগ দিতে গেলে ঝাড় খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এখানে সব ট্রেনই দোতলা, প্যানট্রির ব্যবস্থাও আছে মাঝে কোনও কোন ট্রেনে। ভিস্প আসতে বেশিক্ষণ দেরি নেই, রুকস্যাক নিয়ে তৈরি হয়েই আছি। আমাদের অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করে কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটা উনত্রিশে আমরা ভিস্প স্টেশনে নেমে পড়লাম। 'সময়ের মূল্য' কথাটা এতদিনে হাতেকলমে বুঝতে পারলাম।
ভিস্প আসলে ছোট্ট একটা টাউন। টাউন না বলে পাহাড়তলির গ্রাম বলাই ঠিক হবে। বাইরে আসতেই দেখা গেল স্টেশনের চারিদিকে ঘিরে থাকা পাহাড়। এখান থেকে দক্ষিণ আল্পসের ম্যাটারহর্ন শৃঙ্গ খুব কাছেই, জেরম্যাট বলে একটা পাহাড়ি গ্রামের দোরগোড়া থেকে সেখানে যেতে হয়। সুইটজারল্যান্ডের বহু মানুষ ছোটবেলা থেকেই পাহাড়ে চড়ছে, পর্বতারোহণ এখানে ক্রিকেট অথবা ফুটবলের মতনই জনপ্রিয়। আমার মত পাহাড় পাগলদের মনে যে এরকম জায়গায় এলে কি অবস্থা হয়, সেটা শুধুমাত্র তারাই বুঝবেন যারা নিজেরা কোনও না কোনও সময়ে পাহাড়ে চড়েছেন অথবা সেই স্বপ্ন দেখেছেন। স্টেশনের বাইরেই মাউন্টেন বাইক, ক্লাইম্বিং গিয়ার, ট্রেকিং-হাইকিং গিয়ার্সের বড় একটা দোকান। সেখানে চামড়ার জ্যাকেট পড়া কয়েকজন ছেলে মেয়ে মোটরসাইকিল থামিয়ে কেনাকাটা করতে নেমেছে। বোঝাই যায় এইদিকের পাহাড়গুলো বাইকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাত নিশপিশ করছিল, ইচ্ছে করছিল ছুটে চলে যাই দোকানে। হার্নেস, ক্যারাবিনার, দড়ি কিনে এক্ষুনি রওনা দিই পাহাড়ে। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল জেনেগেন এখান থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার। প্রতি ঘন্টায় একটা বাস যায়। শেষ বাস ছটা কুড়িতে। এখন ঘড়িতে ছটাও বাজেনি। এর পরের ট্রেন ধরলেই আমাদের দফারফা হয়ে যেত। বাস না পেলে অবশ্য হিচ হাইকিংয়ের পথ খোলাই থাকে। সে ফিল্ডেও কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে, লড়াই চালিয়ে যেতাম ঠিকই। যাকগে! সে টেনশন নেই আপাতত। খানিকক্ষণ টহল দিয়ে নির্দিষ্ট বাসের কাছে গিয়ে দেখি একটা যাত্রীও নেই। প্রমাদ গুনলাম। মরেছে! বাস যাবে তো? চালককে জেনেগেন-এর কথা বলতেই হেসে আমাদের বাসে উঠে যেতে বলল। শুধুমাত্র আমাদের দুজনকে নিয়ে ঠিক ছটা কুড়িতে বাস চলতে শুরু করল। আমরা ক্যাবলার মতো পরস্পরের দিকে চাইলাম। দুজনের জন্য একটা এসি বাস চালানো? স্বর্গরাজ্যই বটে! বিশ্বসংসারের আমরা কীই বা জানি?
ঘুরে ঘুরে বাস পাহাড়ের ওপরে উঠছে। বনপাহাড়ের দেশ। ছায়াহিন্দোল। উন্মুক্ত আকাশরেখা। আসমানি মেঘের ছায়া। দূরের পাহাড়গুলো থেকে পুঞ্জীভূত কালো মেঘের দল উড়ে আসছে। আমরা যত ওপরে উঠছি, মেঘবালিকারা ততোই নিচে নামছে। কিন্তু, কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই। নেই কোনও অন্তরায়। বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ভিস্প শহরের দৃশ্য ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ। চারিদিকে সবুজে সবুজ, কিন্তু কোনও গ্রাম চোখে পড়ছে না তো? কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আচমকা বাসটা একটা মোড় নিতেই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। রাস্তার পাশে ঢালু পাহাড়ের ওপর একটা দুটো করে শ্যালে কটেজ দেখা যাচ্ছে। দশটা বারোটা বাড়ি। খানিকক্ষণ সঙ্গ দেয় তারপর আবার মিলিয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ পর নজরে পড়ে একইরকমের আরেকটা গ্রাম। আলাপী বিকেলের আবেশে এই নির্জন শান্ত গ্রামগুলো দেখলেই মন সেতারের সুর বাজতে শুরু করে। পিয়া কে মিলনে কি আস... শুনতে পাই আচমকাই। এই সফর যেন শেষ না হয়!
কিন্তু সে হওয়ার নয়। আধঘণ্টাও লাগল না। জেনেগেনের শ্যাননবার্গ স্টপে আমাদের নামিয়ে বাস চলে গেল সামনের দিকে। ঘুরে ঘুরে এই পথ পাহাড়ের অনেক ওপরে উঠে গেছে। পথে এরকম অনেক দু' দশটা শ্যালে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়ি গ্রামের ওপর দিয়ে বাস চলে ঘন্টায় ঘন্টায়। শীতকালে পুরো অঞ্চলটাই বরফে ঢেকে যায়, তখনও এই বাসে করে পাহাড়ের ওপর থাকা নানা স্কিইং পয়েন্ট অথবা হাইকিং ট্রেইলে যায় এখানকার বাসিন্দারা।
আমাদের ডানদিকের শ্যালেতেই আমাদের যাওয়ার কথা। নামেই কটেজ, আসলে তিনতলা বাড়ি। বিশাল বিশাল বালকনি, বড় বড় ঘর। সামনে ঢালু সতেজ ঘাসের গালচের ওপর সুন্দর বাগান, রকমারি ফুলের গাছ, বসে থাকার জন্যে কাঠের রকিং চেয়ার। এই বাড়ির মালিক এবং এই হোমস্টের তত্ত্বাবধায়ক দানিয়েলা। তার স্বামী পিটার। পিটার সামনেই চেয়ারে বসে বই পড়ছিল, আমাদের দেখে খাতির করে ভিতরে নিয়ে গেল। ততক্ষণে দানিয়েলা এসে পড়েছে। মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা, তার ব্যবহার এতটাই আন্তরিক যে মনে হয় দূর সম্পর্কের কোনও মাসিমা বা কাকিমার বাড়িতে এসেছি। প্রথম থেকেই দানিয়েলাকে আমাদের বেজায় ভালো লেগে গেল। দানিয়েলা আপ্যায়ন করে আমাদের দুতলায় আমাদের থাকার ঘর দেখাতে নিয়ে চলল। তার প্রাণবন্ত হাসি দেখে আমার বড়পিসির কথা মনে পড়ে গেল।
সারা বাড়িটাই কাঠের। কাঠের সিঁড়ির ওপর কার্পেট পাতা থাকলেও কিঁচ-কিঁচ করে শব্দ হয়। আমাদের ঘরটা বেশ বড়, যত্ন করে সাজানো। সারা দেশের সবচেয়ে সস্তা হোমস্টে বুক করেছি খুঁজে, ভেবেছিলাম মাথা গুঁজে কাটানোর মতো একটা কিছু হবে। এ তো দেখছি জন্নত। সাদা ধপধপে চাদর, বালিশ, কম্বল। কাঠের ওয়ার্ডরোব। ডাইনিং রুমে কাঠের টেবিলে সাজানো চকলেট, ওয়েফল, আখরোট, কলা, আপেল। চা কফির সরঞ্জাম। রান্নাঘরের ফ্রিজে ডিম, পাঁউরুটি, মাখন, জ্যাম, জেলি, দুধ সব সাজিয়ে রাখা আছে। দানিয়েলা আমাদের বুঝিয়ে বলল, "এই সব তোমাদের জন্যে এনে রেখেছি। এই গ্রামে কোনও রেস্তোরাঁ নেই। জানোই তো এখানে সব জিনিসের দাম বেশি। শুধু শুধু বাইরে খেয়ে পয়সা খরচ করতে যাবেই কেন? আমরা যতটা সম্ভব রান্না করার ব্যবস্থা করে রেখেছি, অনেক ফল আছে। আরামে রান্না করে খেতে পারবে।"
ইচ্ছে হল দানিয়েলাকে জাপ্টে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলি, "মাসি গো, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?" তা না করে কৃতজ্ঞ চোখে দানিয়েলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘোর কাটতে নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। শুধু শুধুই এত কিছু আনতে গেলাম! এত সব খাবার দেওয়ার কোনও কথাই লেখা ছিল না হোমস্টে বুক করার সময়ে। দানিয়েলারা এত ভালো যে নিজে থেকেই অতিথিদের জন্যে এইসবের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ধন্যবাদ জানিয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে আসতে দানিয়েলা এসে আমাদের ঘরের চাবি দিয়ে বলল," তোমরা তো বালকনিটাই দেখোনি। দেখে যাও।" পর্দা সরিয়ে কাঠের বালকনিতে গিয়েই আরেকদফা চমক।
চারিদিকে সবুজ ভিজে ঘাসের তরঙ্গের ওপর খেলনার মত ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। প্রতিটা বাড়ির বারান্দা এবং জানলায় এত ফুল সাজানো আছে যেন ফুল দিয়েই বাড়িগুলো তৈরি। সেই বাড়ির সামনে দিয়ে অজগর সাঁপের মত এঁকেবেঁকে পাকা রাস্তা চলে গেছে ভিস্প শহরে। একটা ছোট্ট গির্জা আছে, তার উঁচু টাওয়ারটা দেখতে পাচ্ছি। সবুজ মাঠে গরু চরছে, তাদের গলায় বাঁধা ঘন্টির টুং-টাং শব্দ যেন সন্তুরের সুর। পাহাড়ের গায়ে ঘন আলপাইন গাছের জঙ্গলে খেলা করছে বিকেলের মেঘ আর কুয়াশার দল। দূরে পাহাড়ের চূড়াগুলো বরফঢাকা। সেখানে সূর্যাস্তের কমলা রঙ এসে উঁকি মারছে। বাধা দেওয়ার আগেই মন ছুটে পালাল সর্বগ্রাসী সবুজের কোলে। হায়! প্রেম করতে হলে এখানেই করতে হয়। পকেট খালি না হলে ট্রেন মিস করার এই হল বেস্ট জায়গা। শাহরুখ রে, তুইই বুঝেছিলি! না জানে মেরে দিল কো কেয়া হো গেয়া...
দানিয়েলা আমাদের বিদায় জানিয়ে নিচে চলে গেল। বলে গেল আবার সন্ধ্যের পর গিয়ে আমরা গল্প করতে পারি ইচ্ছে করলে। সানন্দে মাথা নোয়ালাম। এইবার? নিশ্চিন্তে আমরা বালকনিতে চা-কফি খেতে খেতে পাহাড়ের মাথায় রঙের খেলা দেখতে পারি, কিন্তু তার আগে খানিকটা হেঁটে আসা দরকার।
হাত পা ধুয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। এই দেশে ধুলো নেই, বালি নেই। সেসব প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার। থাকবে কী করে, খালি মাটি পেলেই সেখানে ঘাসের গালচে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ ধরনের লনমোয়ার দিয়ে পাহাড়ের বুগিয়ালের ঘাসও নিয়মিত ভাবে সমান করে কেটে রাখা হয়। আমরা গরুর গলার ঘন্টির শব্দ শুনতে শুনতে হাঁটছি, মাঝে মাঝে ঘাসের জমিতে শুয়ে পড়ছি। টিলার ওপর বসে একমনে দেখছি দূরের পাহাড়। কোনও যান্ত্রিক শব্দ নেই, গাড়ির হর্ন নেই, মানুষজনের কোলাহল নেই। শুধু শান্ত হয়ে থাকা প্রকৃতি ঘিরে আছে এই গ্রামকে। নৈর্ব্যক্তিক জলধারার প্রবহমান বিন্যাসের মতোই প্রকৃতি এখানে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। এই নির্জনতা মিঠে রোদ্দুরের মতোই নরম। আশ্বস্তি দেয়। দেয় নিশ্চিন্তি। এত্ত সুন্দর! যেন পশমিনা শালের নরম আদর জড়িয়ে রাখে আমাদের। ভালোলাগার সে আবেশ আমাদেরও এমন করে ঘিরে ধরেছে, যে কথা বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের। আবার আমার চোখে ভিড় করে এসেছে বেহিসেবি জলধারা। অকারণ। দিগন্তব্যাপী সবুজ আর কমলালেবু আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না চাপি। চোখ মুছতে মুছতে দেখি, পাশেই একটা পুঁচকে ভেড়ার বাচ্চা। মিষ্টি চোখে তাকিয়ে আছে, কান লটপট করছে চঞ্চলভাবে। ওর নাম দিলাম শাহরুখ। কী শান্তি এখানে!কোথাও না গিয়ে এখানে বসে থাকলেই তিনদিন কেটে যেত দিব্যি, কোনোরকম আক্ষেপও থাকত না আমাদের।
ঘন্টাখানেক পর ফিরলাম। কিছুক্ষণ দানিয়েলার সঙ্গে গল্পগুজব করে আমাদের তিনদিনের পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল। এখনও অন্ধকার হতে দেরি আছে, চুপচাপ দুকাপ চা আর কেক নিয়ে বালকনিতে চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম। সুইটজারল্যান্ডের প্রথম সন্ধ্যের এই স্মৃতি অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল, এই বিশ্বাস নিয়ে।
২) পরদিন সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়া হল। সাড়ে ছটার মধ্যে না ফিরলে বাসও পাওয়া যাবে না, ট্যাক্সিতে উঠলেই নিদেনপক্ষে সত্তর সুইস ফ্রাঁ দিতে হবে। সে ইচ্ছে আমাদের মোটেও নেই। ব্রেকফাস্টের জন্যে টিফিন ভরে পাউরুটি, জ্যাম, ফল নিয়েছি। কফি বানিয়ে চুমুক দিলাম, টিফিন বক্সে লাঞ্চের জন্যে নুডলস নিয়ে নিলাম। ব্যস। রেডি। ঘন্টায় ঘন্টায় বাস চলে, সাড়ে সাতটার বাস ধরে সোজা ভিস্প স্টেশন।
আমাদের আজকের গন্তব্য ইন্টারলেকেনের পার্শ্ববর্তী কিছু পাহাড়ি গ্রাম। ইন্টারলেকেন অঞ্চলের পাহাড়ের শোভা অতুলনীয়, গ্রামগুলো যেন ছবি। হাতে খুব একটা বেশি সময়ও নেই। যতটা সম্ভব একদিনে দেখে নিতে হবে। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সাতটা পঞ্চান্নতে ট্রেন চলে এল, আমরা উঠে পড়লাম। নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে ট্রেনবদলের পালা। নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে ট্রেনবদলের পালা। ইন্টারলেকেন ওয়েস্টের ট্রেনে উঠেছি। কালকের মতই হ্রদের স্বচ্ছ নীল সবুজ জল। সকালের ঝকঝকে রোদ প্রতিফলিত হচ্ছে। ট্রেন চলেছে হ্রদের একেবারে গা ঘেঁসে। মনে হয় যেন জলের ওপর দিয়েই চলেছে। থুন আর ব্রিঞ্জ লেকের মাঝে ছোট্ট একটা সেতু, সেটা পার করেই ইন্টারলেকেন শহর। আমরা সেখানে না নেমে আরো এগিয়ে যাব পূর্ব দিকে। আমাদের নামতে হবে ইন্টারলেকেন ওএসটি স্টেশনে।
খুব বেশিক্ষণ লাগল না। ইন্টারলেকেন ওএসটি স্টেশনটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এখান থেকে ছোট লাইনের গাড়ি পাহাড়ের ওপর নানা জায়গায় যায়। আমাদের গন্তব্য লাউটারব্রুনেন। 'আর' লাইনের গাড়িতে উঠে দেখি জনারণ্য। সামার্স ক্রাউড। বহু মানুষ ট্রেকিং পোল, ব্যাকপ্যাক, ফোল্ডিং সাইকেল নিয়ে পাহাড়ে চলেছে। সুযোগ পেলেই এরা পাহাড়ে ছুটে যায়। পাহাড়ি রাস্তায় হাইকিং করলে দেখা যায় তিন বছরের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ, সকলেই মহা উৎসাহে চলেছে হাতে ট্রেকিং পোল নিয়ে। আর টুরিস্ট তো আছেই। এই সব পাহাড়ি অঞ্চল অনেকের কাছেই স্বপ্নের জায়গা। কিছু কিছু জায়গার বিকল্প হয় না কিনা! ভারতীয় জুটিও আছে দু-একজন।
ইন্টারলেকেন থেকে ছোট লাইনের ট্রেন যখন চলতে শুরু করল, দু'দিকের দৃশ্য দেখে আমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। মানে, আক্ষরিক অর্থেই কথাটা বললাম। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এরকম দৃশ্যপট আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বর্ণনা দিতে হলে সত্যিই বলতে হয়, ব্রেথটেকিংলি বিউটিফুল। পাহাড় জঙ্গলে সবুজের মেলা দেশে কম দেখিনি, হিমালয়ের অনেক ছোট ছোট গ্রামে সময় কাটানোর সুযোগও হয়েছে। কিন্তু এইখানকার সৌন্দর্য যেন সর্বগ্রাসী। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, অপার্থিব কোনও জগতে ঢুকে পড়েছি। ট্রেন এগিয়ে চলল, আর আমাদের মোহাবেশও বেড়ে চলল পাল্লা দিয়ে। সবুজের ব্ল্যাকহোলে ঝাঁপ দিয়েছি আমরা! সর্বত্র সবুজের প্রলেপ। তিরতিরে পাহাড়ি নদীর দুধসাদা জলেও যেন সবুজের অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে। এরই মাঝে একলা দোকলা কাঠের বাড়ি, সেখানে বাগানে বসে আছে হয়তো বা এক বৃদ্ধ পরম মমতায় কুকুরের গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে সত্যিই এমন জায়গা থাকতে পারে? এই বাস্তবটা কিছুতেই মানতে চায় না মন।
লাউটারব্রুনানে নেমে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। পাহাড়ি গ্রাম। একটাই রাস্তা পাক খেয়ে এগিয়ে গেছে। হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা বরফ থেকে রোদ্দুর প্রতিফলিত হয়ে রুপোলি আমেজ তৈরি করেছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কাঠের দোতলা বাড়ি। তার সামনে দিয়ে কেবল-কার করে আরো উঁচুর গ্রামে চলেছে মানুষ। হাঁ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। তারপর পা চালালাম। এতক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছি। কাঁহাতক আর ভোঁদাই হয়ে বসে থাকব?
বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আছে। ঘড়িতে এখন ন'টা। পাহাড়ি রাস্তায় খানিকটা হাঁটাহাটি করে নিলাম। শহর থেকেই স্টাবাখ ঝরনার উচ্ছ্বল জলরাশি দেখতে পাওয়া যায়। অনেক উঁচু থেকে সেই জলের ধারা এসে মিশছে বার্নিশ তৃণভূমিতে। তবে কিনা সুইটজারল্যান্ডে কোনও জায়গাই শুধু দূর থেকে দেখার নয়, পাহাড় কেটে ঝরনার জলের পিছন অব্দি সিঁড়ি চলে গেছে মানবনির্মিত সুরঙ্গ দিয়ে। আমরাও হেঁটে হেঁটে সেই দিকেই চললাম।
চড়াই রাস্তা উঠে গেছে ধাপে ধাপে পাথরের গুহাপথে । বছরের অধিকাংশ সময়েই বরফের কারণে এই রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়, যেখানে সেখানে বরফ জমে রাস্তা এত পিছল হয়ে যায় যে পা পিছলে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ঝরনার জল চুঁইয়ে আসছে এখানে সেখানে, জলের তোড়ে কিছু শোনাও যায় না। সেই ঘোরানো পাথুরে পথ বেয়ে সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে ঝরনার ঠিক পিছনে। সেখানে পৌঁছে দেখি আমাদের সামনেই ঝরনার জল পড়ছে প্রচন্ড জোরে। জলের কণা ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে উড়ে আসছে আমাদের চোখে মুখে। জলের পারদর্শী পর্দার পিছন দিয়ে লাউটারব্রুনেনের অসাধারণ প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে।
ফিরে এসে লাউটারব্রুনানের টুরিস্ট অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করলাম। আমাদের কাছে সুইস পাস আছে, কোন কোন জায়গায় পাস চলবে সেটা জেনে নিয়ে মোটামুটি একটা প্ল্যান হল। সুইটজারল্যান্ডের অনেক পাহাড় পর্বতের তুষারাবৃত শৃঙ্গ অব্দি কেবল কার আর মাউন্টেন রেল করে চলে যাওয়া যায়। সেরকম কয়েকটা জায়গা এই অঞ্চলেই আছে। ইয়ুন্গ্ফ্রা ( Jungfrau) রেঞ্জের চূড়ায় উঠে যাওয়া যায় অনায়াসে। কিন্তু সেখানে গ্রীষ্মকালেও বরফের রাজত্ব। সুইস পাস থাকলেও টিকিটের অর্ধেক টাকা দিতে হবে। তার চেয়ে মাউন্ট সিলথর্ন ভালো বিকল্প, আমাদের এক পয়সাও খরচ হবে না। জনপ্রিয় পাহাড়ি গ্রাম গিম্মেলওয়াল্ড, মুরেইন, ওয়েনগেন ও দেখা হয়ে যাবে এই সুযোগে। হাতে আরো খানিক সময় থাকলে গ্রিনডেলওয়াল্ডও ঘুরে আসা যেত কিন্তু মাউন্ট সিলথর্ন এবং অন্যান্য জায়গা দেখতেই আমাদের সারা দিন লেগে যাবে।
বাসস্টপ থেকে বাস ধরা হল কেবল-কার স্টেশনে যাওয়ার জন্যে। কেবল-কার স্টেশন যেতে প্রায় মিনিট পঁচিশ লাগে। জানলায় নাক লাগিয়ে বসে রইলাম, কোথা থেকে সময় কেটে গেল! নেমে দেখি লোকে লোকারণ্য। কেবল-কার করে একসঙ্গে পঞ্চাশ থেকে সত্তর জন যেতে পারে। ওজন মেপে লোক বসানো হয়। লম্বা লাইন। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। একসময় আমাদের পালা আসতে উঠে পড়লাম। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেবল-কার তারের ওপর দিয়ে উঠতে শুরু করল। যত উঁচুতে যাচ্ছি, নিচের দৃশ্য তত সুন্দর হয়ে উঠছে। বরফের পাহাড়গুলো আরো কাছাকাছি চলে আসছে। বহু চাইনিজ টুরিস্ট এসেছে দলে-দলে, ছবি তোলার জন্যে তাদের ঠেলাঠেলি দেখে হাসিই পায়।
মাউন্ট সিলথর্ন-এর চূড়ায় যাওয়ার পথে প্রথম স্টপই গিমেলওয়াল্ড। পাহাড়ি গ্রাম। স্বপ্নের মত সুন্দর। তার পর মুরেন, বির্গ। এই প্রতিটা গ্রাম থেকেই প্রচুর মাউন্টেন ট্রেল আর পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে। ছোট ছোট লগ কেবিন, তাঁবু, হোমস্টেও আছে। মাউন্টেন ডিভিজনের হস্টেলও আছে ছড়িয়েছিটিয়ে। অনেকেই হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। শীতকালে অবশ্য স্কিইংয়ের জন্যেই লোকে আসে বেশি।
প্রতিটা স্টেশনেই নেমে আমাদের অন্য কেবল-কারে চড়তে হয়েছে। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার ফুট উঠে এসেছি। বির্গ থেকে এগোনোর পর সবুজের মাত্রা কমে এল। ট্রিলাইন শেষ। অনেক, অনেক নিচে লাউটারব্রুনেন গ্রামকে দেখে পুতুলের মতো মনে হচ্ছে এখন। পাহাড়ের ঢালু জমিতে এবার বরফ শুরু হল। এখানে সেখানে সাদা বরফ জমে আছে। কোথাও কোথাও বরফের নিচে ঢেকে গেছে বড় বড় পাথর। আল্পসের পাহাড়ের চূড়াগুলো এখন ঠিক আমাদের চোখের সামনে, যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে। মাউন্ট সিলথর্নে কেবল-কার থেকে নামতেই একটা হিমেল হাওয়া এসে আমাদের কাঁপিয়ে দিল। দশ হাজার ফুটের ওপর চলে এসেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই। ঠান্ডা তো হবেই।
মাউন্ট সিলথর্নের চূড়ায় একটা বিশাল অবজারভেটারি আর রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে জেমস বন্ডের সিনেমার বেশ খানিকটা অংশ এখানে তোলা হয়েছিল। তার একটা ভিডিও চালানো আছে। অবজারভেটারির কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়েই আরেকপ্রস্থ বিস্ময়। সাদা বরফে ঢাকা অসংখ্য চূড়া এখান থেকে বিলকুল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চূড়াগুলোর নামও লেখা আছে ছবি সহকারে। ইনফর্মেশন ডেস্ক থেকে জানাল যে কয়েক মাস পরেই সমস্ত অঞ্চলটাই বরফের রাজত্ব হয়ে যাবে। প্রতি বছর আল্পসের দীর্ঘতম স্কিইং প্রতিযোগিতা শুরু হয় এখান থেকে। নাম 'ইনফারনো'। সারা দুনিয়া থেকে প্রতিযোগীরা এসে জড় হয় এইখানে।
ঘন্টাখানেক পর আমরা আবার কেবল-কার করে নিচে নেমে গেলাম মুরেনে। মুরেন ঘুরে ন্যারো গেজের মাউন্টেন রেল ধরে গ্রুসাপ (Grütschalp) স্টেশনে গিয়ে সেখান থেকে কেবল-কার ধরে আবার নেমে যাব লাউটারব্রুনেনে। সেখান থেকে আমাদের গ্রাম জেনেগেন ফিরে যেতেও কম সময় লাগবে না।
গ্রাম তো নয়, যেন এক একটা পিকচার পোস্টকার্ড। মুরেনে একটা উৎসব চলছে, মিছিল বেরিয়েছে। নানা বাদ্যযন্ত্র সহকারে রঙিন পোশাক পরে ছেলেমেয়ে বাচ্চারা চলেছে চকোলেট আর ওয়াইন বিলি করতে করতে। আমাদের হাতেও এসে পড়ল সেই চকোলেট। এরকম গ্রাম দেখলে ইচ্ছে করে সেখানেই থেকে যেতে। রেসিডেন্সি পারমিট আর পকেটে টাকা থাকলে বাড়িঘড় করা কোনও ব্যাপারই নয়। জায়গার অভাব নেই, মুরেনের এই দেশে পাহাড়ের মাথায় এরকম অজস্র গ্রাম আছে। কিন্তু মনে মনে জানি, এখানে আমি কোনোদিন থাকতে পারব না। আমার পিছুটান নেই ঠিকই, কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে আছে। সুইস রেসিডেন্ট হতে গেলে ব্যাংক খাতায় যে পরিমাণ অর্থ চাই, সে অর্থ উপার্জন করার মানসিকতাই আমার নেই। বদ্ধ কর্পোরেট জগতের ঊর্ধ্বে গিয়ে যদি বা কিছু উপার্জন হয়, সে অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাবে পথে পথে ঘুরেই। বেশিদিন একজায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলেই আমার হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে।
আবার বেপথে চলে গিয়েছিলাম। মুরেনের কথায় ফিরি। এই সব পাহাড়ি গ্রাম এমন সব জায়গায় গড়ে উঠেছে, মাউন্টেন রেল আর কেবল-কার না থাকলে সেখানে কেউ পৌঁছাতেই পারত না। গত দুশ বছর ধরে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়ে থাকার সুবাদে সুইটজারল্যান্ডকে কোনোদিনই আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়নি, অন্যান্য দেশের মতো 'পোস্ট ওয়ার রিবিল্ডিং' এর জন্য অর্থও খরচ হয়নি। সে অর্থ ঢেলে এই অভূতপূর্ব যাতাযাত ব্যবস্থা নির্মাণ করেছে এখানকার প্রযুক্তিবিদরা। একজন অক্ষম মানুষও হুইলচেয়ারে বসে ইয়ুন্গ্ফ্রা অথবা সিলথর্ন-এর চূড়ায় উঠে যেতে পারে, গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসে বসে দিগন্ত অব্দি বরফ ঢাকা নিসর্গের শোভা দেখে অভিভূত হতে পারে, বরফের গুহায় আর গ্লেসিয়ারের রাজত্বে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে।
শুধু নিরপেক্ষ মতবাদ নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও সুইটজারল্যান্ড নিজস্ব একটা আদর্শ স্থাপিত করেছে। 'ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি'— অর্থাৎ দেশের প্রতিটা নাগরিক দেশের প্রতিটা সিদ্ধান্তে মতামত দিতে পারে। এখানে কোনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি নেই। জনসাধারণ যে প্রতিনিধিদের সংসদে পাঠায়, তাদের মধ্যে সাতজন নির্বাচিত হয় সাধারণ মানুষের কথা শুনে কাজ করার জন্যে। প্রতি চার মাসে একটা করে রেফারেন্ডাম অর্থাৎ মতসংগ্রহ করা হয় দেশের প্রতিটা মানুষের কাছ থেকে। যাতাযাত থেকে শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে বিদেশনীতি সব কিছুই ঠিক হয় সেই রেফারেন্ডামের ভিত্তিতে। নতুন ব্যবসা শুরু করতে হলে যৎসামান্য ট্যাক্স দিতে হয় বলে সারা পৃথিবীর কোম্পানিরা এখানে অফিস খোলার চেষ্টা করে। ওপেন বিজনেস পলিসি এবং স্থানীয় মানুষের স্বভাব-সংস্কৃতিকে স্বাধীনতা দেওয়ায় এখানকার অর্থনীতির তরতর করে উন্নতি করেছে, এখনও করছে।
মুরেন ঘুরে নিয়ে ন্যারোগেজের রেলগাড়ি ধরলাম। উইন্টারএগ হয়ে গ্রুসাপ পৌঁছাতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগল না। আশ্চর্যের কথা হল এই অভাবনীয় সৌন্দর্যের সঙ্গেও আমাদের মস্তিস্ক মানিয়ে নিয়েছে একদিনের মধ্যেই। পাহাড়-জঙ্গল এবং পাটভাঙা সবুজ-আসমানি শাড়ির রঙের সঙ্গেও আমাদের আত্মীয়তা হয়ে গেছে। এই যেন স্বাভাবিক, এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?
গ্রুসাপে এসে টিফিন বক্স খোলা হল। লাউটারব্রুনেনে এসে সকালের জলখাবার খাওয়া হয়েছিল। তারপর এতক্ষণ ঘুরে ঘুরে বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছে। সবুজ পাহাড় দেখতে দেখতে বাড়ি থেকে আনা নুডলস খেতে যে কী মজা আমরা ছাড়া কেউই বুঝতে পারবে না এখানে। আকাশের দিকে চোখ যেতে দেখলাম প্যারাগ্লাইডিং শুরু হয়ে গিয়েছে। ঝকমকে, উজ্জ্বল দিন। দূরের ঘাসজমিতে ভেড়ার জল নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। বোকা চোখের চাহনিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে তুলোমেঘের দল বহমান নদীর সঙ্গে তাল রেখে ভেসে চলেছে।
আমাদের নুডলসও শেষ। এদিকে ঘড়ির কাঁটা তরতর করে এগোচ্ছে। দূরের রাস্তা। জেনেগেনের শেষ বাস চলে গেলে আর দেখতে হবে না। গ্রুসাপ থেকেই কেবল-কার নেমে যাচ্ছে লাউটারব্রুনানের দিকে। উঠে পড়লাম। হাওয়ায় ঝুলতে ঝুলতে আবার যখন নেমে এলাম মাটিতে, চড়া রোদের অবাধ্যতা ঠাহর করা গেল। ছায়ায় আশ্রয় নিতে হলে ক্যাফেটেরিয়াতে বসতে হয়, সে আমাদের নাগালের বাইরে। শেষে ঢুকে পড়লাম সুপারমার্কেটে। সুইস ঘড়ি কেনার টাকা নেই, কিন্তু চকোলেট কেনা যেতেই পারে। খুঁজে খুঁজে চকলেট কিনে আবার স্টেশনের দিকে হাঁটা।
ন্যারো গেজের ট্রেন ধরে ইন্টারলেকেন। সেখান থেকে স্পিজ। স্পিজে নেমে আমরা আরেকপ্রস্থ থুন হ্রদের সায়াহ্ন স্মৃতি সঞ্চয় করে নিলাম যতটা পারি। আবার ট্রেনে করে স্পিজ থেকে ভিস্প। সেখান থেকে বাসে করে জেনেগেন। আমাদের বাড়ি। না হয় দু'দিনের জন্য। কিন্তু বাড়ি ভাবতেই ভালো লাগে। অবুঝ, কিন্তু এই সব ভাবনা স্বতঃফূর্ত। আটকানো উচিত নয়। সেন্স অফ বিলংগিং বোধহয় একেই বলে। সম্পর্ক তৈরি হয় মনে, বিচ্ছেদও হয় মনেই। বাকি সবটাই লোকদেখানি।
বিকেল হলেই দেখেছি এই অঞ্চলে মেঘ জমে। বেপাড়া থেকে সারি সারি মেঘ ছুটে আসে, অবাধ্য আলোয় নাচানাচি করে। গ্রীষ্মকালীন নির্জনতাকে মুড়ে দিয়ে যায় সমস্ত কিছু। মনকেমনিয়া বাতাস বয়, মেঘের আড়াল থেকে ইতস্তত উঁকি দেয় সূর্যের পড়ন্ত আলো। চা করে এনে বালকনিতে বসেছি, এমন সময় ভেজা বাতাস উড়ে আসে। চকোলেটের কৌটো উল্টে পড়ে, উড়ে যায় হাতে লেখা কাগজ। নির্লজ্জ মেঘের সঙ্গে চক্রান্ত করে শুরু হয় বৃষ্টি।
বৃষ্টি! আমার নাকি বৃষ্টিলগ্নে জন্ম! বৃষ্টি হলে আমার কী যেন হয়! কী হয়? কী করে বোঝাব? আচ্ছা, চেষ্টা করি। এই লাইনগুলো পড়েছেন তো?
বৃষ্টি যখন নামল, আমি উঠোনপানে একা দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা কিন্তু তুমি নেই বাহিরে, অন্তরে মেঘ করে
ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে
নাহ। পুরোপুরি বোঝানো গেল না। কবি রাকা দাশগুপ্তের সাহায্য নিয়ে আরেকবার চেষ্টা করি।
কোনও দূর দেশে আজ খুব জোরে বৃষ্টি নেমে গেছে
এখানেও হাওয়া দিচ্ছে
ঠান্ডা ভিজে হাওয়া
সে ভারী অঝোর বৃষ্টি
দিকচিহ্নহীন
ধুয়ে মুছে যাচ্ছে সব রাস্তাঘাট
বিস্মৃতিপ্রবণ
মাটি ফুঁড়ে গন্ধ উঠছে কৈশোরের
বাংলা টিনটিন,
শঙ্কুর শনির দশা, কাকাবাবু-সন্তু কিংবা এনিড ব্লাইটন...
এত তীব্র অসময়ে কী করে বর্ষা এল, বলো!
ওই! এইবার খানিকটা হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হতেই মুহুর্তের মধ্যে আমাদের গ্রামটা যেন একটা রূপকথার জগৎ হয়ে উঠল। ভেজা মাটির গন্ধের সঙ্গে এসে মিশে গেল আল্পসের পাহাড়ি কুয়াশা। শ্যালোর ফুলের সুবাস উড়ে এল চায়ের কাপে। গানের কথা আর সুরের মাঝে এই আলো ছায়া মেঘ বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে একসময় সত্যি মনে হল, এ স্বপ্ন। বাস্তব এত সুন্দর হয় না। এত পরিপাটি, এত নিঁখুত হয় না। এ নিশ্চয়ই স্বপ্ন। হয়তো স্বপ্নই...
Grütschalp from Mürren train |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন