সবাই একা দাঁড়িয়ে আছে, পৃথিবীর অন্তরে
সূর্যালোকের রশ্মি অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, অভ্যন্তরে
আচমকা বোঝা যায়, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।
~সালভাতোর কোয়াসিমোদো
১) কোনো কোনো দিন মনে হয় চুপ করে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে। কোথাও যাব না, কিচ্ছু করব না! শুধু চুপ করে বসে নদী অথবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব। পরিকল্পিত ভ্রমণপথ গোল্লায় যাক, নির্জনে কালভার্টের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে পাখিদের কথা শুনব। শহরতলির কোনও কফিশপে বসে চেয়ে থাকব রাস্তার দিকে। কিন্তু ইউরোপের পথে এই ভাবনা বাস্তব হয়ে ওঠে না কিছুতেই। দেশের সীমানাগুলো আমাদের স্বাধীন ইচ্ছেগুলোর গলা চেপে ধরে। গন্তব্য ভুলে পথের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দেওয়া যায় না ইচ্ছে থাকলেও। বাস্তবে আমাদের পথ বাঁধা হয়ে আছে কতগুলো কাগজের লেখায়, সেই বাঁধন আলগা করা সম্ভব নয়।
একমাত্র দীর্ঘ কোনও কোন বাসযাত্রায় পথের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ অনুভব করি মনে মনে। আট ঘন্টা, দশ ঘন্টা, বারো ঘন্টা বাসের জানলায় চোখ রেখে থাকি। বদলে যাওয়া গাছের রঙ, আকাশের মেঘ, জমির বৈচিত্র্য এসে জানান দেয় তাদের উপস্থিতি। এই গতিশীল জীবনে পথের সঙ্গে যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সে অনুভূতি প্রমাণসাপেক্ষ চেতনার নিরিখে ধরা দেয় না। কিন্তু যারা পথের নেশায় জীবন কাটিয়ে দেয়, তারা এই ভাষা সহজেই বুঝতে পারে।
চলেছি ফ্লোরেন্স-এর পথে। ইউরোপের শিল্প ও রেনেসাঁর অন্যতম কেন্দ্র, খাশ ইতালিয়ান ভাষায় যার নাম ফিরেঞ্জা। সুইটজারল্যান্ডের লুজার্ন থেকে প্রায় দশ ঘন্টার পথ, আল্পসের সবুজ পাহাড় ছাড়িয়ে বাস অনেকক্ষণ নেমে এসেছে সমতলে। মিলান, বোলগোনা হয়ে ফ্লোরেন্স পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। পথের দু'ধারের দৃশ্য দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মাঝে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। জলে ভিজে শস্যক্ষেতগুলো আরো সবুজ দেখাচ্ছে।
ইতালির কথা বললেই রোমের কলোসিয়াম, ভেনিসের জলপথ এবং ফ্লোরেন্সের শিল্পনগরীর কথা স্বভাবতই আমাদের মনে চলে আসে। রোম থেকেই রোমানদের উৎপত্তি এবং রোমানদের সাম্রাজ্য বিস্তার থেকেই ইউরোপের ইতিহাসের সূত্রপাত, সেই কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। রোমান সাম্রাজ্যের প্রখ্যাত সম্রাট জুলিয়াস সিজার, অগাস্টস সিজার এবং হেরাক্লিয়াসদের অনেক আগে রোমান রিপাবলিকের সর্বেসর্বা ছিলেন প্রতিনিধি অথবা সেনেটরা। তাঁদের এমনই প্রতিপত্তি ছিল যে রোমান সম্রাটরাও তাঁদের না জিগ্গেস করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস করতেন না। প্রজাতন্ত্রের সেই যুগ যদিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তী কালে রাজতন্ত্র স্থাপিত হয়ে এবং দীর্ঘ পনেরোশ বছর ধরে রোমান সাম্রাজ্য শত শত যুদ্ধ বিগ্রহ, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্রমে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
জুলিয়াস সিজারের পরাক্রমে রোমানরা সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ওপর অধিকার করে নিয়েছিল এক সময়। মিশর জয় করার ফলে পরবর্তী কয়েকশ বছরে রোমান সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি এতটাই বেড়ে যায় যে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেখাশোনা করার জন্যে রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান তুরস্কের বাইজেন্টিয়াম শহরে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের। নাম অবশ্য দেওয়া হয় বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্য। এই বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যের রাজধানীই ছিল কন্সট্যান্টিপোল। সেই সময়ে ফিলিস্তিনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে খ্রিস্টধর্ম। আশ্চর্যের বিষয় এই যে কয়েক যুগ ধরে খ্রিস্টধর্মের সমার্থক মনে করা রোমান সাম্রাজ্য সেই সময়ে এই অঞ্চলের খ্রিস্টানদের নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর ছিল। রোমান সাম্রাজ্যে সে যুগে গ্রিকদের মতনই বহু ঈশ্বরবাদ প্রচলিত ছিল। প্রধান দেবতা জুপিটার ও অন্যান্য গ্রীক দেবতাদের মন্দির আধুনিক যুগেও ইতালির বহু জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। ক্রমে খ্রিস্টধর্ম প্রসারিত হতে থাকে ইউরোপেও। চতুর্থ শতকের শুরুর দিকে রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন নিজে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর কথায় আস্থা রেখে খ্রিস্টধর্মের প্রতি সহনশীল মনোভাব গ্রহণ করেন উচ্চবর্গের মানুষজন। প্রায় সত্তর বছর পর সম্রাট থিওডোসিয়াসের সময় দেখা যায়, খ্রিস্টধর্মই রাজধর্ম হয়ে উঠেছে।
ফ্লোরেন্স অবশ্য বহুকাল ধরে রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক উত্থান-পতন থেকে বহু দূরে সাধাসিধে একটি ব্যবসায়িক নগরী হয়ে বেঁচেছিল। লোম্বার্ড, হান, গথ ও ভ্যান্ডালদের ক্রমাগত আক্রমণ এবং যুদ্ধের ফলে তাদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের বিভাজনের ফলে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই ধুলোয় মিশে গেল। সপ্তম শতাব্দীতে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও পূর্বে বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্য টিকে রইল কোনোভাবে। অবশেষে ১৪৫৩ সালে ওসমান সাম্রাজ্যের সুলতান মুহম্মদ বিন ফতেহ কনস্ট্যান্টিপোলও দখল করে নেন। এই শহরের আধুনিক নামই হল ইস্তাম্বুল।
মধ্যযুগে যখন জার্মান আর ইতালির সৈন্য সম্মিলিত শক্তিতে একের পর এক সম্রাট রাজ্য সঞ্চালনা করছেন, ফ্লোরেন্স, ভেনিস এবং আমালফি অর্থব্যবস্থার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। গয়না, দামি পাথর, পোশাক, রেশম এর মতো নানাবিধ জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়ে যায় ফ্লোরেন্সে। সে যুগে ফিরেঞ্জা ছিল ব্যাংকারদের শহর। অর্থ, প্রতিপত্তি এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিণতির ফলে ক্রমে ফ্লোরেনটিয়ানরা শিল্প ও সাহিত্যের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে একসময়। এমন সময় ইতালিতে তিনজন ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল, যারা ইতালির সাহিত্যজগৎ-এ প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। 'থ্রি ফাউন্টেনস' নামে পরিচিত এই তিনজন হলেন কবি দান্তে, বোকাচিও এবং পেত্রাচ। নানা ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিজস্ব রচনায় নিয়ে আসতে শুরু করেন তাঁরা। 'ডিভাইন কমেডি' লিখে দান্তে তখন সারা ইতালিতে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য অর্থবান ফ্লোরেনটাইনরাও শিল্প, সাহিত্য নিয়ে চর্চা শুরু করে দিয়েছেন।
সেই অগ্নিস্ফুলিং থেকেই পঞ্চদশ শতাব্দীর রেনেসাঁ অর্থাৎ পুনর্জাগরণ-এর সূত্রপাত। ফ্লোরেন্সের অভাবনীয় শিল্প ও শিল্পীদের নিয়ে পরবর্তী পাঁচশ বছর ধরে আলোচনা হয়ে চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি থেকে শুরু করে মিকেল এঞ্জেলো, বতিচেল্লি থেকে শুরু করে ব্রুনেলেস্কি, রেনেসাঁর যুগের শিল্পরচনা ফ্লোরেন্সকে খ্যাতির শীর্ষে তুলে দিয়েছে।
আমাদের ফ্লোরেন্সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে যথারীতি রাত হয়ে গেল। বাস স্টপ শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে। জনবসতির চিহ্ন নেই। ট্রামে করে যেতে হবে, মেশিনে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি খুচরো পয়সা না থাকলে টিকিট পাওয়া যাবে না। ইউরোপে সর্বত্র কার্ডে কাজ হয়, খুচরো পয়সার দরকার পড়ে না। কিন্তু আশেপাশে কোনও এটিএম খুঁজে পেলাম না। মহাফাঁপরে পড়লাম। অনেক কষ্টে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে থেকে টাকা খুচরো করে নিয়ে ট্রামে চাপতে আমাদের প্রায় আধ ঘন্টা দেরি হয়ে গেল।
অভয় দিলে বলি, ফ্লোরেন্স কিন্তু খুব একটা জমাটি শহর নয়। কয়েকটা অঞ্চল ছাড়া বাকি শহরটা নেহাৎই সাদামাঠা। ইতালিয়ানরা সুইসদের মত ধোপদুরস্ত নয়, সুইটজারল্যান্ড থেকে ইতালিতে এলে স্বভাবতই সবকিছু ম্যাড়ম্যাড়ে বলে মনে হয়। অন্যান্য দেশের বড় শহরগুলো আলোতে স্নান করে যায় রাত হলে, তুলনায় এখানের রাস্তা অন্ধকার। মাঝে মাঝে স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে, সেইটুকুই। হালফিলে ইতালির অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়, সেটাও হয়তো একটা কারণ হতে পারে। যদিও রোম, মিলান বা রিভিয়েরার কোস্ট টাউনগুলোয় গেলে এই ধারণা বিলকুল ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তুলনায় টুস্কানিকে ব্যতিক্রমই ধরা যায়।
ট্রাম থেকে শহরের প্রধান প্লাজা ভিলা কোস্টাঞ্জায় এসে সেখান থেকে ঠিকঠাক বাস ধরে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছাতে আমরা হিমশিম খেয়ে গেলাম। সে কী গেরো! গুগল ম্যাপ হাত জোড় করে বলছে, "আমায় মাপ কর। এই ইতালিয়ানগুলো মহাপাজি।" এতদিন সুইটজারল্যান্ডে অক্ষরে অক্ষরে ম্যাপে দেখানো জায়গা থেকে বাস, ট্রাম ধরে চলেছি। জায়গা, সময় কিছুরই হেরফের হয় না। একদিন ট্রেন সাড়ে তিন মিনিট লেট করেছিল কোনও সমস্যা হওয়ায়, যাত্রীদের সে কী রাগ! এখন ফ্লোরেন্সে এসে দেখি কেলেঙ্কারিয়াস অবস্থা! নির্দেশিত বাস স্টপ থেকে বাস চলছে না, বাসের রুট বদলে যাচ্ছে কোনও পূর্বনির্দেশ ছাড়াই। স্থানীয় মানুষেরা কেউ কিছু বলতে পারে না। দৌড়ঝাঁপ করে যখন আমাদের হোমস্টেটে পৌঁছালাম, ঘড়িতে প্রায় রাত বারোটা বাজে।
আদ্যিকালের বাড়ি, দরজায় কলিং বেলের কোনও ব্যবস্থা নেই। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে, বাড়ির মালিককে ফোন করাও অসম্ভব। ভাগ্যিস আমাদের হোস্ট ফ্রানসেস্কো জেগেছিল। জানলা দিয়ে পিঠে রুকস্যাক হাতে দুজনকে লাফালাফি করতে দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে সে নিজেই এসে দরজা খুলে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল।
পুরোনো ধাঁচের বাড়িটার অন্দরমহল দেখে ফিদা হয়ে গেলাম প্রথম নজরেই। উঁচু সিলিং-এর বিশাল বিশাল ঘর। সাদা রঙের প্রকাণ্ড দুটো খাট। আসবাবপত্র সবই ধপধপে সাদা রঙের। বেশ একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে। আমাদের ঘরটা তিনতলায়, জানলার বাইরেই প্রধান রাস্তা। রান্নাঘর সংলগ্ন একটা ছোট্ট বসার বালকনি আছে—ওপেন টেরেস বলা যায়— সেখান থেকে নিচের বাগান চোখে পড়ে। ফ্রানসেস্কো আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করে ছিল, আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়ে সে নিজের বাড়ি ফিরে গেল। অনেক রাত হয়ে গেছে, আমরাও খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে একটু দেরি করেই বেরোনো হল। ফ্রানসেস্কোর বাড়িতে রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত আছে, বেশ ভালো করে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া হল। এতদিন পাহাড়ে আরামে ছিলাম, গরম একটুও ছিল না। এখানে আবার প্রচন্ড গরম। আগস্ট মাস, এখানকার অনেক বাসিন্দাই গরমের চোটে পাহাড়ে পালিয়ে গেছে। আর আমরা এসেছি এখান। গ্রীষ্মকালে ফ্লোরেন্সে যাওয়ার প্ল্যান থাকলে আগেভাগে সাবধান করে দিলাম, পকেটে লেবু-পেঁয়াজ আর বোতলে ঘোলের শরবত নিয়ে ঘুরবেন। নর্থ কলকাতার গরম হার মেনে যায়, এইসা রোদ্দুর। দু' পা হেঁটেই নোরা ফাতেহী স্টাইলে বলতে ইচ্ছে হয়, "হায় গর্মী! কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, সহজে হার মানছি না। অন্য সব কথা ভাবতে হবে যাতে গরম না লাগে। নিরিবিলি গলি দিয়ে যেতে যেতে সঙ্গিনীকে জিগ্গেস করলাম, "কী বুঝছিস? রেনেসাঁর কেন্দ্রে যে হেঁটে বেড়াচ্ছিস, কী কী মনে পড়ছে?"
কালচার টকের আশায় জল ঢেকে সঙ্গিনী মুখ ভেংচে উত্তর দিলেন, "কী বিচ্ছিরি গরম রে বাবা! সুইটজারল্যান্ডে কী সুন্দর ঠান্ডা ঠান্ডা ছিল। গরমে সেদ্ধ হয়ে গেলাম পুরো!"
কী আর বলি! কথাটা সত্যিই। মনে হয় রোদের হাত থেকে রক্ষা পেতেই এখানকার শিল্পীরা ঘরে বসে বসে রেনেসাঁ যুগের ভালো ভালো সব পেইন্টিং এঁকেছিল। যারা বাইরে ছিল তারা জেলাতো আইসক্রীম খেয়ে নদীতে হুটোপুটি করত বোধহয়। এমনিতেও যা বুঝছি, ইতালিয়ানগুলো মহাকুঁড়ে। কুঁড়ের চেয়েও বেশি ক্ষ্যাপা। সব তালগোল পাকিয়ে রাখে। বাসস্টপে বাস আসে না, টোবাকো শপ থেকে বাসের টিকিট কাটতে হয়, দরজায় কলিং বেল নেই, মেট্রোও বানায়নি একটা। টুরিস্টদের অবশ্য ওতে কিছু আসে যায় না। গুচ্ছের জেলাতো শপ চারিদিকে, আইসক্রীম খাচ্ছে আর গ্রাম কে গ্রাম লোক লোটাকম্বল বেঁধে সান্দ্রো বতিচেল্লির 'বার্থ অফ ভিনাস' দেখতে উফিজি গ্যালারিতে ছুটছে। সে ছবি আজকাল জনপ্রিয়তায় প্রায় মোনালিসার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, "উফিজি গ্যালারিতে টিকিট পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না! কয়েক ঘন্টা ধরে লাইন দিয়ে চেষ্টা করবি নাকি?"
আমার প্রশ্নকে উড়িয়ে দিয়ে সঙ্গিনী উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন, "কত আইসক্রিমের দোকান দেখেছিস! আমি আইসক্রিম খাব।"
বতিচেল্লিকে আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে আসা হয়েছে দেখে বুঝলাম, ভাগ্যে নেই! অবশ্য ছবি আর মূর্তি দেখার চেয়ে মানুষ দেখতে আমার উৎসাহ মোটেও কম নেই। সারি সারি ইতালিয়ান 'জেলাতো' আইসক্রিমের দোকান আমাদের ঘিরে। নানা রঙের নানা স্বাদের আইসক্রিম পাওয়া যাচ্ছে। টুরিস্টদের ভিড়ে প্রতিটা দোকান ঠাসা। গন্ধে জিভে জল এসে যায়! ধুত্তোর বতিচেল্লি আর রেনেসাঁ! বড্ড গরম! ঠিকই বলেছে! আগে আইসক্রিম খাওয়া যাক।
দেড় ইউরো, দুই ইউরোতে এক কাপ করে আইসক্রিম পাওয়া যায়। সফেদা থেকে দই, কলা থেকে নারকেল, ব্লু বেরি থেকে কোলা...কী নেই? টেন্ডার কোকোনাট আইসক্রিম খেয়ে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। দারুণ স্বাদ! আইসক্রিম চাটতে চাটতে পা বাড়ালাম ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত গির্জার দিকে।
ফ্লোরেন্সের গির্জা সান্তা মারিয়া দেল ফিয়োরে তার অসাধারণ স্থাপত্য এবং অসামান্য গম্বুজ(dome)-এর জন্যে যত না বিখ্যাত, তার চেয়েও বেশি বিখ্যাত এই গম্বুজ তৈরির গল্পের জন্য। স্থাপত্যের ইতিহাসে এই বিস্ময়কারী নির্মাণের অভিনব কাহিনীর মত চমকপ্রদ কাহিনি খুব বেশি নেই। রস কিংয়ের লেখা অসামান্য বই 'ব্রুনেলেস্কিজ ডোম' পড়লে রীতিমত গায়ে কাঁটা দেয়। ততক্ষণে আইসক্রিম খেয়ে সঙ্গিনীর মাথা ঠান্ডা হয়েছে। জ্ঞান ফলানোর সুযোগ পেয়ে সঙ্গিনীকে বললাম, "জানিস, এখানকার গির্জার যে ডোম সারা বিশ্বে বিখ্যাত, সেটা আসলে তৈরি করেছিল একটা আনাড়ি?"
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্লোরেনটাইনরা নতুন একটি গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু করে। তখন ফ্লোরেন্স ইতালির স্বর্ণনগরী, অর্থ ও সমৃদ্ধিতে তার কোনও জুড়িদার নেই। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন একটি তাক লাগানো গির্জা বানানোর জন্যে প্রতিপত্তিশালীরা উঠেপড়ে লাগলেন। উল ব্যবসায়ীদের সংগঠন আর্তে ডেলা লানার তত্বাবধানে কাজ শুরুও হল। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশকে 'ব্ল্যাক ডেথ'-এর কবলে পড়ে অর্ধেক স্থাপতকর আর শিল্পীরাই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। একশ বছর পর দেখা গেল, গির্জার খানিকটা নির্মাণ হলেও গম্বুজটাই তৈরি করা যায়নি। ১৪১২ সালে গির্জা নির্মাণকারী সংগঠন গম্বুজের নির্মাণের জন্যে প্রতিযোগিতার আহ্বান করলেন। যেই স্থাপত্যকর সর্বশ্রেষ্ঠ নকশা তৈরি করে দিতে পারবেন তাকেই গম্বুজ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হবে। বহু লোকের সঙ্গে ফিলিপ ব্রুনেলেস্কি বলে একজন শিল্পীও তার নকশা নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল ব্রুনেলেস্কি কস্মিনকালেও স্থাপত্যকর নয়, ঘড়ি সারাইয়ের কারিগর বলেই তাঁকে লোকে চেনে। আগে একটা বাড়ি অব্দি তৈরি করেননি তিনি, কোন সাহসে ফ্লোরেন্সের গির্জার নির্মাণকার্যে গিয়েছিলেন এই ব্যাক্তি? তাঁর কথা লোকে শুনবেই বা কেন? এই কথার উত্তর দিতে গেলে আগে কসিমো দে মেদিচি আর ফ্লোরেন্সের মেদিচি পরিবারের সম্পর্কে জানতে হবে।
মেদিচি পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা সকলেই ছিলেন ব্যাঙ্কার। ফ্লোরেন্সের অর্থনীতির সাড়ে পনেরো আনার গুরুদায়িত্ব মেদিচি পরিবারের ব্যবসাবুদ্ধির ওপর নির্ভর করত। ভ্যাটিকান-এর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার সুবাদে পোপের টাকাও গচ্ছিত থাকত তাঁদের কাছে। অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাঁরা। প্রায় তিন শতক ধরে মেদিচি পরিবারের প্রতাপ এতটাই বেশি ছিল যে গোটা ফ্লোরেন্সে তাঁদের কথার খেলাপ কেউ করত না। অর্থ আর প্রতাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেদিচি পরিবার বিখ্যাত ছিল শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্যেও। কত শিল্পী যে তাঁদের অনুগ্রহ পেয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। ফিলিপ ব্রুনেলেস্কিও তার ব্যতিক্রম নয়। হাতে কলমে স্থপতি না থাকলেও ব্রুনেলেস্কি আসলে আনাড়ি ছিলেন না মোটেও। তাঁর প্রতিভার ওপর অগাধ আস্থা ছিল মেদিচি পরিবারের কর্তা কসিমো দে মেদিচির। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও বিজ্ঞান আর স্থাপত্য সম্পর্কে জ্ঞান ব্রুনেলেস্কির ছিল, মেদিচি পরিবারের কর্তার কথায় সেই গির্জার গম্বুজ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়ে যান তিনি। ব্রুনেলেস্কি সেই সুযোগ হারাননি। গতানুগতিক শৈলীর ধারেকাছে না গিয়ে তিনি এমন এক অভিনব গম্বুজ নির্মাণ করলেন বিজ্ঞান ও জ্যামিতির সাহায্য নিয়ে, যে লোকে ধন্য ধন্য করতে শুরু করে দিল। এটা অবশ্য সংক্ষিপ্ত ভার্সন, আসল কাহিনি থ্রিলারকেও হার মানিয়ে দেবে।
আপাতত আমাদের চোখের সামনেই সেই পৃথিবী বিখ্যাত গির্জা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ উঁচু করে কপাল কুঁচকে সেইকালের সর্বোচ্চ গম্বুজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকলে ব্রুলেস্কির প্রতিভাকে স্যালুট না জানালে চলে না। গম্বুজের মাথার ওপরের গোল বারান্দা থেকে ফ্লোরেন্স শহরের অসামান্য দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে ওঠার জন্যে লম্বা লাইন পড়েছে। গির্জা চত্বরেই মধ্যকালের বহু ঐতিহাসিক ইমারত ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে, যার বেশিরভাগই সেই সময় মেদিচি পরিবারের সম্পত্তি ছিল। ফ্লোরেন্সের শিল্পকলার অন্যতম কেন্দ্র উফিজি গ্যালারিও মেদিচিদের নিজস্ব প্রাসাদ ছিল, সেই প্রাসাদের শোভা দেখে আজও স্তম্ভিত হতে হয়।
ঐতিহাসিক বাড়ি, ঘর, গির্জার মাঝ দিয়ে গলি চলে গেছে। মাথা খারাপ করা গরমেও এত টুরিস্ট এসেছে যে ভিড়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা। গয়নার দোকান, ফ্যাশন ব্র্যান্ডের বিপণন কেন্দ্র, ক্যাফে সহ সব জায়গাতেই জনসমারোহ। রোদের তেজ এমন বেড়েছে যে খোলা জায়গায় না গিয়ে সকলেই এই গলি সেই গলির ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইসক্রিমের দোকানগুলোর সত্যি পোয়াবারো। তাদের বিক্রি এমনই বেড়ে গেছে যে প্রায় প্রতিটা মানুষের হাতেই জেলাতোর কাপ দেখতে পাচ্ছি। কোনো কোনো গলির মোড়ে ট্র্যাডিশনাল বাদ্যযন্ত্র নিয়ে রীতিমত অনুষ্ঠান চলছে, কোথাও চেলো, কোথাও গিটার, কোথাও বেহালার সুর কানে এসে লাগে।
আমাদের সামনেই একটা প্লাজা। সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্লোরেন্সের টাউন হল পালাজো ভেকিও। এই চত্বরের সামনে এসে হাজিরা দিয়ে ছবি তোলাতে যে পর্যটকেরা ভালোবাসে, তার একটা বিশেষ কারণ হল পালাজো ভেকিওর সামনেই মিকেল এঞ্জেলোর 'ডেভিড'-এর একটা প্রতিকৃতি দাঁড় করানো আছে। আসলটা অবশ্য আছে মেদিচি প্যালেসের কাছে অবস্তিত গ্যালারি দে আকাদেমিয়াতে। সেখানে অনেকেই যেতে পারে না, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে এসে হাজির হয় এই চত্বরে। তাই বলে হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। ডেভিদের প্রতিকৃতিটা আসল না হলেও পালাজো ভেকিওর অন্যান্য অনেক নিদর্শনই খোদ মিকেল এঞ্জেলোর হাতে নির্মিত। সিটি কাউন্সিলের অনুরোধে যখন এই টাউন হল তৈরি হয়, মেডিচি পরিবারের অনুরোধ রক্ষার্থে মিকেল এঞ্জেলো নিজে হাতে সাজিয়ে তোলেন এই প্রাসাদ। এই প্রকাণ্ড টাউন হলের অন্দরমহলে প্রায় দশটা আর্ট গ্যালারি, প্রাসাদ, আর উদ্যান করা হয়েছিল। রাফায়েল, রুবেন্স, ফিলিপো লিপ্পি, কারাভাজ্জিও... হেন শিল্পী নেই যাদের কাজ সংরক্ষিত নেই পালাজো ভেকিওতে। ভিতরে ঢোকবার মুখেই সোনালি ঘোড়াদের অসাধারণ প্রতিকৃতিতে চোখ আটকে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে পিয়াজিও দে সান্তা সিসিলিয়া আর পিয়াজিও দে সাল্তেরেলি ছাড়িয়ে চলে এলাম উফিজি প্রাসাদের কাছে। নদীর ধারেই মেদিচি পরিবারের এই প্রাসাদ, তার সামনেই ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে নামকরা পাথরের সেতু পন্টে ভেকিও। প্যারিসের সঙ্গে ফ্লোরেন্সের একটা প্রধান তফাৎ যে আরনো নদী আর তার সেতুগুলো সব জায়গা থেকে দেখা যায় না। এখানেও মধ্যযুগের বহু পাথরের সেতু আছে, যাদের শোভা দেখতে মাথা ঘুরে যায়। রোদের উত্তাপকে কাঁচকলা দেখিয়ে অনেক দোকানদার হাতের তৈরি গয়না আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে পন্টে ভেকিওর ওপর। রাস্তার ধারের এই দোকানেও দাম বেশ চড়া। ফ্লোরেন্স বিলাসভ্রমণের জন্যে বিখ্যাত, গয়না আর ইতালিয়ান পোশাকের জন্যে পর্যটকেরা কয়েক মিলিয়ন খরচ করতেও পিছপা হয় না। ফুটপাথের দোকানদাররাও ক্রেতার পকেট বুঝে দর হাঁকে, এক সে বড়কর এক সেয়ানা।
সেতুর ওপর বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে সেতু পেরিয়ে অন্যদিকে চলে এলাম। একেবারে কাছেই পালাজিও পিত্তি। ফ্লোরেন্সের আরেক ব্যাঙ্কার লুকা পিত্তির এই বিশাল প্রাসাদ পড়ে মেদিচি পরিবার কিনে নেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নেপোলিয়ান যখন এখানে আক্রমণ করে, পালাজিও পিত্তি তার সৈন্যেদের বিশ্রাম গৃহে পরিণত হয়েছিল। আজকাল অবশ্য প্রাসাদটাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তবে জাদুঘরে গিয়েও খুব একটা লাভ হবে না, যদি না ফ্লোরেন্সের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতি থাকে। একঘেয়ে উইকিপিডিয়া আর নীরস নন ফিকশন ছেড়ে বরং রস কিংয়ের কলমে লেখা ফ্লোরেন্স সম্পর্কিত বইগুলো পড়ে ফেলুন, তাতে লাভ হবে অনেক বেশি।
পালাজিও পিত্তির পিছন দিয়ে চড়াই রাস্তা উঠে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অনেকদূর। অনেক শিল্পীদের বাড়ি আছে এই রাস্তায়, কয়েকটা নিজস্ব আর্ট গ্যালারি, একটা গোরস্থানও চোখে পড়ল। এদিকে এই চরম গরমে চোখমুখের যা দশা হয়েছে তাতে শরম লাগছে রীতিমত। ঘেমেনেয়ে 'গরম গোরিলা'-র মতো দশা। ঠিক করা হল বাড়ি ফিরে গিয়ে বিকেলে বেরনোই ভালো। ফিরতি পথ ধরলাম। পথে একটা সুপারমার্কেট থেকে খানিক জিনিসপত্রও কিনতে হল। ইতালিতে অন্য দেশের তুলনায় জিনিসপত্র খানিকটা সস্তাই। ভারতীয় মশলাপাতিও পাওয়া যায়। আমরা সুপারমার্কেটে খুঁজে খুঁজে সার্ডিন মাছের একটা টিন আবিষ্কার করেছিলাম কয়েক সপ্তাহ আগে, মাত্র এক না দেড় ইউরো দাম। দিব্যি মাছের ঝোল করে নেওয়া যায়। বেশ কাজের জিনিস।
বাড়িতে ফিরে এসে শান্তি হল। বাইরে এমন রোদ্দুর পড়েছে যে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা 'জেলাতো' আইসক্রিমের দোকান, বেশ কয়েকবার সেখানে ঢুঁ মারতে হবে মনে হচ্ছে। আপাতত খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম।
বিকেল পড়ে এলে আবার বেরিয়ে পড়া হল পিয়াজালে মিকেল এঞ্জেলোর উদ্দেশে। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই চত্বর থেকে সূর্যাস্ত দেখব বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি। তেরো নম্বর বাস সোজা পাহাড়ের মাথায় পিয়াজালেতে আমাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই বাসের স্টপ খুঁজতে গিয়ে আমরা ঘেমেনেয়ে গেলাম। কোনও কারণে ফ্লোরেন্সের যাতাযাত ব্যবস্থা একেবারে উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে কয়েকদিন ধরে। অনেক বাসস্টপ বাতিল করে নতুন জায়গায় নতুন রুটের বাস চলছে, ইন্টারনেটে সেই সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। শেষে বাস ধরে যখন আমরা পিয়াজালে মিকেলএঞ্জেলোর মাথায় পৌঁছালাম, সূর্যাস্ত হব হব করছে। পিয়াজার ধারে পা রাখার জায়গা নেই। কোনও রকমে একটা জায়গায় গিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
এখান থেকে গোটা শহরটাই চোখে পড়ছে। গরম, ঘাম, বাসের ঝামেলা, ইতালিয়ানদের বেয়াড়াপনা... সব কিছুই তুচ্ছ মনে হচ্ছে এখন। কোনো অদৃশ্য জাদুঘর ম্যাজিক ওয়ান্ড ঘুরিয়ে শহরটাকে পিছিয়ে নিয়ে গেছে পাঁচশো বছর। ফ্লোরেন্সের গির্জা, প্রাসাদ, সেতু, বাড়িঘর নিয়ে এই সমগ্র ভাস্কর্য যেন ছাপিয়ে গেছে আধুনিক যুগে ব্যাখা করা শহরের সংজ্ঞাকে। সূর্যের সোনালি আলোতে যেন রেনেসাঁর সেই প্রাচীন নগরীর দীপ্যমান ধমনিগুলো স্বরূপ উদঘাটন করেছে একেএকে। শহরটার মাঝা বরাবর আরনো নদী চলে গিয়েছে। নদীর ওপর অবস্থিত অসংখ্য পাথরের সেতুর ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্তের রেণু এসে পড়েছে আরনো নদীর সোনাজলের ওপর। জল নয়, যেন গলিত সোনাই বয়ে চলেছে আরনো নদী দিয়ে। শেষ বিকেলের নরম আলোয় আভাসিত হয়েছে চরাচর, কানে ভেসে আসছে চেলোর সুর, জোয়ানেস মার্টিনির ব্যারিটোন সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে মিকেল পিয়াজার চত্বরে। সমগ্র ওল্ড টাউনে। গোটা ফিরেঞ্জা আর টুস্কানিতেও।
কতক্ষণ যে এই অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, আক্ষরিক অর্থেই কথা বন্ধ হয়ে যায়। সম্বিত ফিরতে দেখলাম সূর্যাস্তের শেষে অন্ধকার নেমে এসেছে ফ্লোরেন্সে। নদীর দু' পাড়ে শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। এত দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে সোনালি মোড়কে মোড়া একটা রহস্যনগরী হয়তো কোনও সন্দেশবাহক আগন্তুকের অপেক্ষা করে আছে।
সেই মুহুর্তে, রেনেসাঁর পাঁচশ বছর পর, আরনো নদীর জলে প্রতিফলিত আলোর দিকে তাকিয়ে থাকার সময় সালভাতোর কোয়াসিমোদোর কবিতার লাইনগুলো আমাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিল, ফিরেঞ্জায় সন্ধ্যে নেমেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন