বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫

তার কথা আর মনে পড়ে না 
ভেজা চুলে দৌড়ে আসা শীতের বাতিক,
কবিতাগুলো আবছা
গানগুলো উড়ে গেছে  
পাখনা মেলে,ওই আকাশে আক্ষরিক
আরষ্টতা আরষ্ট 
লজ্জা কোথায় উবে গেছে 
চাহিদার জগতে আত্মবিশ্বাস অলীক 
নিখোঁজ স্বপ্নে ভীত
ছিল,স্মৃতিনাশ অবধারিত 
জানতাম,দিন রাত মাস বছর 
তার অকালমৃত্যুর প্রতীক 
কিন্তু তাও সে বেঁচে থাকে,মরেও মরে না
কিন্তু,
তার কথা আর মনে পড়ে না 
শেষবার যখন তাকে দেখেছি,
ভেজা বালি ছিল অশ্রুধারায়,
কেঁদেছি,শুধু কেঁদেছি
এক মুঠো কৌতুক ভিজিয়ে রেখেছি,
কুড়োনো কাগজের ছবিতে,
পুরনো টিভির ভাঙ্গা পর্দায়,
যদি বেঁচে থাকে এতটুকু প্রাণ,
যদি ফিরে যায় ছোট ছোট পা ফেলে,
কোবানি শহরে,নির্বাসিত পাড়ায়
হাত ধরে কারো,আমার 
স্মিত হাসির মাঝে,শুয়ে থাকে নিষ্প্রাণ 
আমি আসব তোকে নিতে,
অপেক্ষা করিস,প্রিয় আয়্লান...........


সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫

আজকাল লিখি না 
কাগজ হাতে নিয়ে বসি উদাসীন 
কলম নিয়ে কান খোঁচাই মাঝে মাঝে  
পুরনো কয়েক পাতা রঙ্গীন 
খাপছাড়া প্লটের আনাচে কানাচে  
সদ্যফোটা কবিতার কলি,
ছন্দ খুঁজে খুঁজে অবিরাম
শহর,মাঠ,নদী,গলি 
ডিঙ্গি ভাসিয়ে চলে গেছে কবে 
আজও ফিরে আসেনি,
সাড়া দিই নীরবে,
'ফিরবে না?কথা দিয়েছিলে'
সে কথা রাখেনি 
তুমি চলে গেছ অভিমানে 
অথচ কলম তোমার জন্যেই রাখা থাকত 
হাতের তুলির টানে 
বিষন্ন আঁকিবুঁকিগুলোও ছবি হত 
অম্লানে 
ভুলে যাওয়ার উপহার 
তোমাকে কাছাকাছি দেখি না 
তাই,আজকাল আর লিখি না 

মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

ফুরিয়ে যাওয়া কথায়
হারিয়ে যাওয়া চিঠি 
কয়েক আঙ্গুল পথে
বদলে যাওয়াই রীতি 



বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০১৫


আমার বাড়িতে একটা হাতি ছিল। আসল নয়,খেলনা হাতি। আমার মাসি কিনে দিয়েছিল আমাকে। আমি তো তখন ছোট ছিলাম। হাতিটার রং ছিল গোলাপী,আমি সারাক্ষণ হাতিটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। হাতিটাকে খাইয়ে দিতাম,চান করিয়ে দিতাম। মা যখন আমার মুখে খাবার তুলে দিত,হাতিটা আমাকে দেখে হাসত।হাতিটার আমি একটা নামও দিয়েছিলাম।হাজুগুজু। হাজুগুজু কে আমি রোজ বিকেলে সাজুগুজু করে আমার বইপত্রের ওপর রেখে দিতাম।যখন পড়তে গিয়ে আমার ঘুম পেত,হাই উঠত,হাজুগুজুর দিকে চোখ চলে যেত। দেখতাম,সে শুঁড় তুলে হাসছে মুচকি মুচকি।আমি তখন তার কান মলে দিতাম।হাজুগুজুর পায়ের তলায় একটা বোতাম ছিল। ওতে ফু দিলে সিটি বাজত। হাজুগুজু যখন দুষ্টুমি করত,আমি ওই সিটিটা বাজিয়ে দিতাম। আমার মনে হত,ঐখানে ফু দিলে হাতিদের কাতুকুতু লাগে।হাতির কাতুকুতু।কি মজা।হাজুগুজু আমার সাথে থাকত সারাদিন।আমি যখন স্কুলে যেতাম মা ওকে শোকেসে রেখে দিত।একদিন আমি হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম। সবার অলক্ষ্যে আমার হাজুগুজু,আমার সারাক্ষণের খেলার সঙ্গী ছোট্ট গোলাপী হাতিটা কোথায় হারিয়ে গেল।
আমার বাড়িতে একটা ছাদ ছিল। খুব বড় ছড়ানো ছাদ।মাঝখানে ছিল একটা জালতি।সেখান থেকে একতলায় দেখতে পাওয়া যেত। আমি দুপুরবেলায় ছাদে গিয়ে পেয়ারা খেতে খেতে জালতি দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতাম।আমার মা নীচের কলতলায় বাসন মাজত,জেঠিমনিরা তোষক রোদে দিত। মাঝে মাঝে পোস্টম্যান এসে চিঠি দিয়ে যেত। সব দেখতে পাওয়া যেত জালতির ওপর থেকে। বিকেল বেলায় আমি প্লাস্টিকের বল আর ব্যাট নিয়ে দাদার সঙ্গে খেলতাম ছাদের ওপরে। দাদা আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল। প্রায় ৬ বছরের বড়,কিন্তু সে আমার সঙ্গে খেলতে ভালবাসত।একটু এদিকদিক হলেই জালতি দিয়ে গলে বলটা নিচে চলে যেত,তখন আমাদের তিনতলা সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে হত।দাদা আমাকে বার বার যেতে দিত না,নিজেই বল নিয়ে আসত। অন্যদের ছাদে বল চলে গেলেও সে গিয়ে উদ্ধার করত বল। আমি মাঝে মাঝেই ছয় চার মারতাম আর আনন্দে নাচানাচি করতাম। পরে বুঝেছি ,আমাকে দাদা ইচ্ছে করেই লোপ্পা বল দিত। আমাকে সামলে রাখত,ঘুরতে নিয়ে যেত রথের মেলায়,আমাকে সঙ্গে করে ঝুলনে জন্মাষ্টমী সাজাত। বাজি পোড়াত।আমার বুড়োদাদা (যাকে বুড়ো বললে রেগে যেত),তাই আমি বলতাম বুরাদা। একদিন বুরাদা খুব বড় হয়ে গেল,পড়ার চাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভীষণ।আমিও ভুলে গেলাম ওকে। আস্তে আস্তে আমার অজান্তে আমার পুরনো বাড়ির ছোটবেলার ছাত,জালতি,ব্যাট বল,জন্মাষ্টমী সাজানো ,বাজি পোড়ানো সব হারিয়ে গেল। চিরকালের মত।
আমার কয়েকটা বন্ধু ছিল আমরা একসঙ্গে ঘুরতাম,একসঙ্গে দুষ্টুমি করতাম,একসঙ্গে স্কুল যেতামভাবতাম আর যাই হোক,আমরা একসঙ্গেই থাকব তারাও হারিয়ে গেলহারিয়ে গেল একে একে আমার আঁকার খাতা,আমার ক্যাসেটের তোরঙ্গ ,আমার কমিকসের বাক্স,স্কুল,গলি,খেলা ঠাকুমা,ভাইবোন,মাসিপিসি,পুজোর উল্লাস,ছুটির উৎসাহ ছোট বেলাটাই হারিয়ে গেল কেটে যেতে লাগলো বছরের পর বছর এই নাকি বড় হওয়া সকলে হারিয়ে যাবে,চলে যাবে একে একে,কিন্তু তোমার আর তাদের জন্য মন কেমন করবে না অনেক রাগ জমেছে যে,সবার ওপর,কেন এত বাঁধন?জীবনের বন্দীদশার রাগে স্মৃতির মূল্য কমে গেছে

অনেকদিন পর বাড়ি গেলামবন্ধুদের সঙ্গে দেখা করাটাই আসল তাও খানিকটা সময় থাকি বাবা মায়ের সাথেবেশিক্ষণ ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে নাকাগজ নড়াচড়া করতে গিয়ে দেখি,সেখানে উল্টে পড়ে আছে আমার হাজুগুজু কি ময়লা হয়ে গেছে কত বছর ধরে পড়ে আছে কে জানে,মার কাছে নিয়ে গেলাম ওকে বললাম,এটা খুঁজে পেলাম,আমার পুরনো খেলার সঙ্গী ,হারিয়ে গিয়েছিলমা একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে তারপর বলল,' হারিয়ে গেছিল না  তুই হারিয়ে  গেছিলি?'

পঁচিশ বছরের স্মৃতি এক লহমায় ঘুরে গেল আমার চোখের সামনে দিয়ে হাজুগুজু,বুরাদা,তিনতলার ছাদ,ক্রিকেট,ছোটবেলার বন্ধু,গল্প,আড্ডা,সাইকেল,স্কুল,পুজো,গরমের ছুটি,আমার ছোটবেলাআমার কৈশোরবুঝতে পারলাম,কেউই হারিয়ে যায়নি,আমাকে ছাড়া আমিই আমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম হারিয়ে ফেলেছি আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না

মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০১৫

(দানিশ সিদ্দিকির কাজ নিয়ে একটা লেখার কথা ভেবেছিলাম। হয়তো কয়েক বছর পর হত, আবার হয়তো কোনওদিনই হত না। স্বাধীন ভারতের একমাত্র পুলিৎজার জয়ী ফোটো জার্নালিস্ট, তাঁর কথা দেশের মানুষ জানল তালিবানের হাতে মারা যাওয়ার পর। দানিশের কেরিয়ার আর ছবি নিয়ে বিশেষ আলোচনাও হল না, ন্যারেটিভ ঘুরিয়ে দেওয়া হল অন্যদিকে। আমি যারাপনাই হতাশ! তবে আজকাল দেশের অবস্থা দেখে সর্বক্ষণই হতাশায় ডুবে থাকি, একধরনের নির্লিপ্তি এসে গেছে। উই ডোন্ট ডিজার্ভ পিপল লাইক হিম।

ফটোজার্নালিজম নিয়ে আমার আগ্রহ বহুদিন ধরে। চিত্র সাংবাদিকদের নিয়ে গল্পও লিখেছি, ভালো আর্টিকেল পেলে পড়ে ফেলি। কলেজ জীবন থেকেই আমি রবার্ট কাপার একনিষ্ঠ ভক্ত, ওর বায়োগ্রাফি আর ওয়ার রিপোর্টাজ পড়েছিলাম যখন, ইংরেজি প্রায় বুঝতামই না। তাও শেষ করেছিলাম, মাঝপথে থেমে যাইনি। 

একসময় ভেবেছিলাম, কাপাকে নিয়ে বাংলায় একটা দীর্ঘ উপন্যাস লিখব। সহজ ভাষায়। ওয়ার করেসপন্ডেন্টদের বিস্তারিত কথা থাকবে তাতে, ছবিও থাকবে। সে লেখার নোট এখনও পড়ে আছে। হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। সে সময় লেখার কিছুই জানতাম না, এখনও জানি না যদিও। তাও নিজের জন্য ব্লগে একটু আধটু লিখে রেখেছিলাম আনাড়ি হাতে। লেখাটা নীচে দিয়ে দিলাম। যারা আগ্রহী, রবার্ট কাপার লেখা রিপোর্টাজগুলো পড়তে পারেন বরং। আর গ্রাফিক বায়োগ্রাফিটাও নাকি খুব ভালো। আমি পড়িনি, কিন্তু ছবিটা দিলাম। সত্যি বলছি, নতুন একটা দিগন্ত খুলে যাবে।)

৬ জুন ১৯৪৪। ইংলিশ চ্যানেলের উপকূল। বাইশটা আমেরিকান, বারোটি ব্রিটিশ, তিনটে কানাডিয়ান, একটা পোলিশ আর একটা ফরাসি। মোট উনচল্লিশটা ট্রুপ। দশ লক্ষ সৈন্য একসঙ্গে ঝাঁপিয়েছে নাজী ট্রুপদের ওপর। উদ্দেশ্য হিটলার অধিকৃত জার্মানির হাত থেকে ফ্রান্সের এই অঞ্চলকে মুক্ত করা। উভচর আক্রমণের ইতিহাসে সব চেয়ে বড় আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছে আজ। নরম্যান্ডির সমুদ্র সৈকত থেকে শুরু হয়েছে এই অ্যাকশন। জলপথ ধরে গোপনে এখানকার বেলাভূমিতে নেমে এসেছে কয়েক লক্ষ্য সৈন্য। সেই একই সময়ে আকাশে মিত্রশক্তির ফাইটার প্লেনরা  বম্বিং করবে বলে ঠিক করা আছে। দ্রাম দ্রাম করে গর্জাচ্ছে কার্তুস, বাতাসে ভাসছে বারুদের গন্ধ। নিমেষে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে হাজার হাজার লোক। দু'দিক থেকেই চলছে প্রবল ফায়ারিং। বন্ধুর আর্তনাদ আর রক্তপাতে ফিরে তাকাচ্ছে না আর কেউ। দরকার হলে এগিয়ে যেতে হবে লাশের ওপর পা রেখে। 

এই যুদ্ধের কোড নেম অপারেশন নেপচুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের 'গেমটার্নার' বলে মনে করা হচ্ছে এই পরিকল্পনাকে, এখানে ব্যর্থ হলে হিটলারকে আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। যারা এই অভিযানে নাম লিখিয়েছে, তাদের ফেরার কোনো পথ নেই। হয় জিততে হবে নয় মরতে হবে।

হিউস্টান রিলিও আছে এই দলে। ব্রিটিশ সৈন্যের  ফার্স্ট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিজনের সিক্সটিনথ রেজিমেন্টের সদস্য সে। তীরবেগে সে এগিয়ে চলেছে ফায়ারিং করতে করতে। এরকম 'সাডেন মুভমেন্ট' হলে কভারিং ফায়ার পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সবটাই ভাগ্য। ভাগ্যে থাকলে জীবন না হলে মৃত্যু। জীবন হাতে নিয়ে তাদের ওমাহা বিচের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেইখানে কব্জা করতে পারলেই জার্মানদের কোমর ভেঙ্গে যাবে।

হিউস্টান ভেবেই রেখেছে, যুদ্ধ শেষ হলে সে ক'দিনের অন্যে বাড়ি যাবে ছুটিতে। কিন্তু সে কথা এখন নয়। হঠাৎ করে এলোপাথারি ফায়ারিং আরম্ভ হয়ে গেল সামনে থেকে। পরিত্যক্ত বাঙ্কারের মধ্যে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল নাজী সৈন্যদের দল। সাঁ করে একটা গুলি এসে বিঁধল রিলির কাঁধে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। নিমেষের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লেও চটপট নিজেকে সামলে নিল সে। ফায়ারিং শুরু করতে করতে আড়চোখে দেখল, তার পাশে বছর কুড়ির ছেলে অ্যালেক্স গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল। তাদের আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। একের পর এক সৈনিক নিহত হচ্ছে। বম্বিং স্কোয়াড এখনও আসেনি। বাঁচার কোনো উপায় নেই আর। শেল ফাটার কানফাটা শব্দে অসাড় হয়ে গেছে তার শরীর। বন্দুক আর তুলতে পারছে না সে। হিউস্টান বিস্ফারিত চোখে দেখল, সামনে থেকে তার দিকে  ছুটে আসছে মৃত্যুবাণ। অন্ধকার ভেদ করে আসা গুলিগুলো জ্বলন্ত উল্কার মতো এসে আঘাত করছে প্রতিপক্ষকে। সঙ্গীদের বুক ফুঁড়ে দিচ্ছে একটা না একটা গুলি, যে কোনও মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে হিউস্টনের দেহ। শেষবারের মতো সে তাকাল সামনে। বিদায়! 

হঠাৎ কে যেন এক ধাক্কায় তাকে মাটিতে ফেলে দিল। শেল ফায়ার এড়িয়ে অদৃশ্য দু'টো হাত তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে পিঠে করে। কোনওমতে চোখ খুলে সে তাকাল তার উদ্ধারকারীর দিকে।আরে!এ কে?এ তো তাদের ট্রুপের কেউ নয়। তাকে আড়ালে নামিয়ে লোকটা ফিরে গেছে গোলাগুলির মাঝে। হতবাক হয়ে হিউস্টন দেখল তার দিকে। লোকটার হাতে মেশিনগান নেই, আছে একটা ক্যামেরা।

***

ডিয়ার গেরটা,

অনেকদিন হয়ে গেছে তুমি আমাকে কোনও চিঠি লেখোনি। আমাকে চিঠি না লিখলেও অবশ্য আমি তোমায় ভুলতে পারি না। তোমার আমার গল্প এক বলেই কি? জানি না। স্তাতগ্রাতের মেয়রের অফিসে একজনের সঙ্গে দেখা হতে আমি তোমার পরিবারের খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারল না। লিপজিগ থেকে তাদের কোথায় পাঠানো হয়েছে কেউ জানে না। প্রিয়জনদের সঙ্গে আর বোধহয় দেখা হবে না এ জীবনে। আমাকেই দেখো! ঘর ছাড়লাম, দেশ ছাড়লাম, এমনকি নিজের নামটাও ছেড়ে দিতে হলো। কী দোষ ছিল?না! আমরা জিউস, সেটাই কি একমাত্র দোষ? এই বোধহয় আমাদের নিয়তি। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে? ভ্যালেন্সিয়া বম্বিংসে তোলা ছবিগুলো দেখলাম। দেখে মনে হল সম্ভবত তোমার প্রিয় 'রলেই ক্যামেরা' ব্যবহার করেই ছবিগুলো তুলেছো। ইতিমধ্যে আমার আর প্যারিস যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু খবর পেয়েছি, তুমি ভালোই কাজকর্ম করছ সেখানে। মার্ক্সিস্ট খবরের কাগজের মাধ্যমে যে তোমার সঙ্গে হেমিংওয়ে আর ওরয়েলের পরিচয় হয়েছে সেটাও জানি। আমি যদিও কট্টরপন্থীদের কাছ থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসি কিন্তু হেমিংওয়ের লেখা যে চমৎকার সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যাকগে, কাজের কথা শোনো। Regards, Life, Illustrated London News আর Volks-Illustrierte-তে ছাপা ফটোগুলো দেখে তোমার কাজের তারিফ না করে থাকতে পারলাম না। বলতে নেই, আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তুমি ভালোই করেছ।আমাদের জীবনের কীই বা ভরসা? তুমি সে দিন ঠিকই বলেছিলে, আমাদের মতো ইহুদিদের পক্ষে সারা জীবন একজায়গায় শান্তিতে কাটানো সম্ভব নয়। যাই হোক, আশা করি তোমার কাজের মধ্যে দিয়েই তুমি সুখী হয়েছো। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় কর্ডোবাতে আমরা একসঙ্গে কত ভালো সময় কাটিয়েছি, সে কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায়। প্রফেশনাল পার্টনার হিসেবেই হোক আর বন্ধু হিসেবে, সেই দিনগুলি আমার স্মৃতিতে উজ্জল হয়ে থাকবে। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। কিন্তু গেরটা, সত্যি বলতে তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসি আমার ক্যামেরাকে। পরের সপ্তাহে চায়না যাচ্ছি। কয়েকটা ভালো শট নেওয়ার ইচ্ছে আছে সামরিক অনুপ্রবেশের। লোকে এই ছবিগুলো দেখেই অন্তত যুদ্ধের সত্য বুঝুক। আমরা তো যুদ্ধেই রইলাম সারা জীবন। বেস্ট পিকচারের খোঁজ করে গেলাম। সত্যি বলতে সত্যিটা তুলে ধরাই হয়তো বেস্ট পিকচার। The truth is the best picture and the best propaganda। যাই হোক, সারা জীবন ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হিসেবেই বেকার থাকতে চাই। সেদিন একজন আবার জিগ্গেস করল, কেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গোলাগুলির মাঝে যাই? তাকে হেসে বলেছিলাম, "For a war correspondent to miss an invasion is like refusing a date with Lana Turner." ভালো থেকো গেরটা। ফিরে এসে একবার প্যারিস যাওয়ার ইচ্ছে রইল।

তোমার বন্ধু
এনদ্রে ফ্রাইডম্যান

***

১৯৪৪। লাইফ ম্যাগাজিনের দপ্তরে বসে আছেন এডিটর থমসন। ডেকে পাঠিয়েছেন ফটোগ্রাফার রালফ মারসোকে। 'The Magnificent Eleven' নামের ছবিগুলো প্রচন্ড আলোড়ন তুলেছে সারা আমেরিকা আর ইউরোপে। অনেকে বলেছে এরকম ছবি নাকি ওয়ারফ্রন্টে গিয়ে তুলতে পারা অসম্ভব। ফোটোগ্রাফগুলো আসলে জাল। জুন মাসেই অপারেশন নেপচুন করে ফ্রান্সকে ছাড়িয়ে নিয়েছে মিত্রশক্তি। সেই যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝামাঝি গিয়ে তোলা ছবিগুলো। প্রতিটা ছবিই এককথায় মাস্টারপিস। কিন্তু তাও একটা সন্দেহ থেকেই যায়। নরম্যান্ডি ল্যান্ডিংস এর ছবিগুলোতে মোট আছে ৯৫টি ছবি। এতগুলো ছবি তুলতে গেলে তো পুরো যুদ্ধটাই কভার করতে হবে। সেটা কি সম্ভব?

দরজা ঠেলে মারসো ঢুকল ভিতরে। তার দিকে তাকিয়ে থমসন প্রশ্ন করলেন, "কী মনে হয়?"

মারসো বলল, "কোনও সন্দেহের প্রশ্নই ওঠে না। কাপা ছবি জাল করার লোক নয়।"

থমসন খেঁকিয়ে উঠে বললেন, "আরে ও যুদ্ধ কভার করবে কখন? এই তো খবরে দেখলাম অভিনেতা জন জাস্টিনের স্ত্রীর সাথে অ্যাফেয়ার চালাচ্ছে।কিছুদিন আগেই ব্যাটা লন্ডন আর প্যারিসের জুয়াঘরে গোছা গোছা টাকা নিয়ে ফুর্তি করছিল।"

মারসো শান্ত স্বরে বলল, "রবার্ট কাপাকে চেনা দুস্কর স্যার। সে কখন কী করবে তা আগে থেকে বলা যায় না। কিন্তু আমি যতটা ওকে চিনি, সে মরে গেলেও যুদ্ধের ছবি জাল করবে না। দেখতে গেলে ওয়ার ফোটোগ্রাফি তো ওই শিখিয়েছে আমাদের।"

"একটু ডিটেলস দিতে পারো?"থমসন উৎসুকভাবে জিগ্গেস করলেন। মারসো একটা চেয়ার টেনে নিল। তারপর শুরু করল, "রবার্ট কাপা ওর আসল নাম নয় স্যার,আসল নাম হল এনদ্রে ফ্রাইডম্যান। জাতে ইহুদি। আঠেরো বছর বয়সে যখন ঘর ছাড়ে,  হাংরিতে ইহুদিদের জেনোসাইড চলছে। সে প্রাণ বাঁচিয়ে পালায়। ফটোগ্রাফিতে অবশ্য সে দক্ষতা অর্জন করেছিল আগেই। নিজের নাম বদলে ফ্রাঙ্ক কাপা করে যাতে শুনতে আমেরিকানদের মতো লাগে। তখন তো আমেরিকানদের ছাড়া কাজের সুযোগ পাওয়া যেত না। তারপর থেকেই সে ওয়ার জোনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্লোভাকিয়া,স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার, চাইনিজ ইনভেশন, যুদ্ধের খবর পেলেই কাপা ফ্রন্টে ছুটে যায়। ওর মৃত্যুভয় নেই স্যার, বরং আমার মানে হয় সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে সে এরকম কোনো যুদ্ধ কভার করতে গিয়েই মরবে।"

"মানে? পাগল না হলে কেউ এরকম করতে পারে?"থমসন অবাকভাবে জিগ্গেস করলেন।

মারসো করুণভাবে একটু হাসে। থমসন তাকিয়ে রইলেন।

"পারে স্যার। ভালোবাসার জন্যে এরকম পাগলামি অনেকেই করে।"

"ভালোবাসা আবার এল কোত্থেকে? কী বলছ বাপু?একটু খোলসা করে বলবে?" থমসন রেগে গেলেন।

মারসো হেসে বলল," আপনি বলছিলেন না স্যার কাপার অ্যাফেয়ারের কথা। ওই সব কাপার খেলা মাত্র। সত্যি মিথ্যের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। কিন্তু আমার মানে হয় কাপা যদি কাউকে ভালোবেসে থাকে সে হলো গেরদা তারো। গেরদা আর কাপার জীবনে অনেক মিল। দু'জনেই জিউস, দু'জনেকেই ঘরছাড়া হতে হয় নাজী জার্মানির অত্যাচারে। গেরদার আসল নাম আসলে গেরটা ফরাইল। গেরদা প্রথম মহিলা যে ওয়ার করেসপনডেন্ট হয়ে ফ্রন্টিয়ারে গিয়েছিল। কাপা আর গেরদা পার্টনার ছিল, দু'জনে একসঙ্গে কাজও করেছে বহুদিন। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে ওদের তোলা কয়েকটি ছবি অসাধারণ। সেখান থেকে ফিরে গেরদা প্যারিসে গিয়ে কাজ শুরু করে।"

"তারপর?" থমসন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেন।

"গেরদা স্প্যানিশ ওয়ারের ব্রুনেটে চলে যায় নিউজ কভার করতে। সেখানে ওয়ার ফ্রন্টে গেরদা মারা যায়...কী করে হয়েছিল সেটা ঠিক জানা যায়নি। কাপা তখনও খবর পায়নি। পরে গেরদার মৃত্যসংবাদ শুনে সে প্রচন্ড শক পায়। কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। আমি তখন বেশ কয়েকবার কথা বলেছি ওর সঙ্গে। সে একবারও গেরদার কথা তোলেনি। খালি বলেছে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা। বার বার সে ছুটে গেছে যুদ্ধের মধ্যে, কারো বারণ শোনেনি। কোনো প্রটেকশন নেয়নি, নিরাপত্তার কথা বললে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। একবার জিগ্গেস করাতে সে বলেছিল, ছবি আরও ভালো করতে হবে। আমি না থাকলেও ছবিগুলো থাকবে। জানো, If your pictures aren't good enough, you aren't close enough."

মারসো কথা শেষ করে। দু'জনেই চুপ। একসময় নীরবতা ভেদ করে থমসন বললেন,"১৯ জুনের এডিসানে ছবিগুলো পাঠিয়ে দাও। নাম দাও BEACHHEADS OF NORMANDY".

***

রবার্ট কাপা জুয়া খেলে গেছে সারাজীবন। জীবন নিয়ে। হেসেখেলে, আমোদ করে,বলাইমলাইটে রয়েছে,সব সময়। সে নিউজ করেছে তার ক্যামেরা দিয়ে নয়, তার জীবন দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কাপা চিত্র সাংবাদিকদের আইকন হয়ে ওঠে। কোথায় যায়নি সে? ইউরোপ, আমেরিকা, চাইনা, ইজরায়েল! প্রতিষ্ঠিত হলিউড অভিনেত্রী ইনগ্রিড বার্গমানের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ১৯৪৫ এ,তার অনুরোধে কাপা কিছুদিনের জন্যে কাজ করে American International Pictures এ,কিন্তু সে জীবন কাপার পছন্দ হয় না। তুরস্ক থেকে ডাক পেয়ে সে চলে যায় ১৯৪৬ এ। লাইফ ম্যাগাজিনের কাজ হাতে নিয়ে সে চলে আসে সাউথ ইস্ট এশিয়াতে ১৯৫০ সালে। ফার্স্ট ইনডো চায়না ওয়ারে তার তোলা প্রচুর ফটো ছাপা হয় লাইফ ম্যাগাজিনে। ভিয়েতনামে ১৯৫৪ সালে ওয়ারফ্রন্টে কাপা মারা যায় ল্যান্ডমাইন ব্লাস্টে। তার যোগ্য এবং আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু।

শনিবার, ২ মে, ২০১৫

এক পা-এক পা করে এগিয়ে চলেছে মিছিলটা।সামনে  McCormick Harvesting Machine কোম্পানির মস্ত গেট দেখা যাচ্ছে।স্লোগান দিতে দিতে গলা চিরে গেলেও কেউ শান্ত হয়নি।শ্রমিকের  দল তারা,এত সহজে ক্লান্ত হয় না।
ভিতরের  ড্রয়িং রুমে বসে টিভির স্ক্রিনএ সবই  দেখতে পাচ্ছেন ম্যানেজমেন্ট  এর লোকেরা।কিন্তু তাদের তেমন কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।পুলিশ  আর  সিকিউরিটির  কড়া  ব্যবস্থা  আছে।শ্রমিকদের দাবির কোনো ভিত্তিই  নেই।লাটসাহেবের  দল!ওদের দিয়ে নাকি বেশি কাজ করানো হচ্ছে।সেই মতো টাকাপয়সা,সুযোগসুবিধে দেওয়া হচ্ছে না।কোনোমতেই তারা দিনে ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করবে না।গত পরশু ১মে শিকাগো শহরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শ্রমিক মিছিলে একসঙ্গে যোগ দিয়েছে Federation of Organized Trades and Labor Unions এর প্রথম শ্রেণীর সব নেতারা।পারসন,ফিল্ডেনদের মতো anarchist খবরের কাগজের লোকেদের উস্কানিতে শিকাগো,নিউইয়র্ক সহ আরও নানা জায়গায় মে ডে প্যারেড করেছে শ্রমিকেরা।৪০০০০ এর বেশি লোক এরই মধ্যে strike করেছে।এদের তোল দিলে আরও বিপদ। দরকার পড়লে এদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।
ধীরে ধীরে বাইরের গন্ডগোলটা বাড়তে লাগলো।শ্রমিকদের সংখ্যায় ক্রমশই বৃদ্ধি হচ্ছে।গেটের  কাছ থেকে সার্জেন্ট এসে কোম্পানি ডিরেক্টর এর কানে কানে কিছু বলল ।তিনি সায় দিলেন।৫ মিনিটের মধ্যেই বাইরে থেকে শোনা গেল ফায়ারিংএর  আওআজ।পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে ত্রাস তৈরী হলো শ্রমিকদের মধ্যে।নেতা স্পাইস এর কথামত তারা সম্পূর্ণ অহিংসভাবে বিরোধ করছিল।দুএকজন অবশ্য বলেছিল হিংস্র বোমাবাজি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করার কথা,সবাই তাদের ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।এরকমভাবে যে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে পুলিশ,তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে সবাই।আড়াল ঠেলে বৃদ্ধ সায়মন দেখল,কিশোর ছেলে অগাস্টিন এর মৃতদেহ কোলে করে বসে আছে তাদের দলনেতা অগাস্ট স্পাইস।এক চোখে জল,অন্য চোখে আগুন।
পরের দিন। ৪ মে ১৮৮৬।শিকাগো শহরের হেমারকেট স্কয়ার।অগাস্ট স্পাইস,আলবার্ট পারসন আর স্যামুয়েল ফিল্ডেন এর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে প্রায় ৬০০০ মানুষ।শিকাগো পুলিশ আর ক্যাপাটিলিস্টদের অন্যায় আর মেনে নেওয়া হবে না।দেখতে দেখতে হেমারকেট স্কয়ার গমগম করে উঠলো হাজার হাজার লোকের উদঘোষে।স্পাইস মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল,""পুলিশএর দিক থেকে প্রচার করা হচ্ছে,এই সভাটা একটি দাঙ্গার শামিল,আর সামরিক ভাবে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি হিসেবে আমরা এতে যোগ দিয়েছি।কিন্তু এই প্রচার মিথ্যে! শুরুতেই  আপনাকে বলছি,এই সভার উদ্দেশ্য আপনাদের জানানো যে চারপাশে কি হচ্ছে?আমাদের জীবন আর আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে কে ছিনিমিনি খেলছে?"ধীরে ধীরে জনস্রোত বেড়ে চলে। রাত ১০টা বেজে গেছে।চারপাশ থেকে খবর আসছে আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার এর পক্ষে জনসাধারণের সমর্থন বেড়েই চলেছে। রাত ১০টা বাজতেই সামনের জনতার ওপর চড়াও হল পুলিশ।শুরু হলো লাঠিচার্জ। কিন্তু লেবাররাও আজ ছাড়বে না ঠিক করেছে।কেউ একচুল নড়ল না জায়গা থেকে।লাঠিচার্জএর সামনে পড়েও কেউ পালাচ্ছে না। এমন সময় বিকট শব্দ করে ফেটে উঠলো কয়েকটা বোম। চারিদিকে ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে গেছে।লোকে দৌড়ে যাচ্ছে।কে যেন বোমাবাজি করেছে,অথচ শ্রমিকরা কিছুই জানে না।পুলিশ এবার ফায়ারিং করছে।একঘন্টা পর হেমারকেট স্কয়ার এর রাস্তায় পরে রইলো ৭৭টি মৃতদেহ।সাতটি পুলিশম্যান আর ৭০জন সাধারণ মানুষ।প্রচুর মানুষ আহত।
পরের দিন খবরের কাগজে বিস্তারে ছাপা হলো এই ঘটনা।শ্রমিকদের তরফ থকে করা বোমাবাজি আর ফায়ারিঙে নিহত ১০জন।আনার্কিস্ট নেতারাই এর জন্যে দায়ী।কিছু সংবাদপত্রে মিনমিন করে বলা হলো,পুলিশ গুলি চালিয়েছে সাধারণ পালাতে থাকা জনতার ওপর,শাষনপক্ষের শাসানিতে তারাও চুপ করে গেল। এরতরফা জুডিশিয়াল সিস্টামে দোষী হলো,অগাস্ট স্পাইস,আলবার্ট পারসন আর স্যামুয়েল ফিল্ডেন।এদের জন্য বরাদ্দ মৃত্যদন্ড।বাকিদের আজীবন সশ্রম কারাবাস। ফাঁসির কাঠের সামনে এসে স্পাইস  চেঁচিয়ে উঠলো,"the day will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today."
হেমারকেট স্কয়ার ম্যাসাকার এর পরের দিনই লেবার ইউনিয়ন দের মেম্বারশিপ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই ঘটনা আগুনে ঘি দেয় সারা আমেরিকার শ্রমিকদের ক্রোধে। স্ট্রাইক,প্রতিরোধ  আর কথাবার্তা চলতে থাকে বছরের পর বছর। অতঃপর ১৮৯০ সালে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয় সরকার।দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার জন্যে পুরো বেতন দেওয়া হবে তাদের।শ্রমিকদের  অধিকার আছে বেঁচে থাকার,আনন্দ করার,প্রতিরোধ করার,কথা বলার।
১মে  ১৮৮৬ সালের মে প্যারেডের দিনটাকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকার করা হয়।
লোকে আজ ভুলে গেছে লেবার লিডারদের।anarchist  লিডারদেই বা কে চেনে।anarchist  বলতে লোকে অরাজকতাবাদীই বোঝে।কিন্তু anarchist লিডারদের আসল উদ্দেশ্য ছিল,without  archons.আমাদের শাসনকর্তা আমরাই,অন্য কেউ নয়। হেমারকেট স্কয়ার আজও রয়ে গেছে।রয়ে গেছে অগাস্ট স্পাইস এর বলা সেই শেষ কথা....The day will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today..



বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৫

প্রজেক্ট সাবমিসান এর কাল শেষ দিন।তিন রাত ধরে ঘুম হয়নি।অফিস যাইনি।বাড়ি থেকে কাজ করলে অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয় কাজ।মাঝে মাঝে কেউ এসে বিরক্ত করতে পারে না।একটানা সারা দিন কাজ করে বিকেল বেলায় বারান্দায় চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম।ল্যাপটপ খুলতে হবে।আকাশ মেঘলা।কালোসাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় নীল আকাশের উঁকিঝুঁকি।পশ্চিমের দিক থেকে আসা উড়াল হাওয়ায় মেঘের দল বয়ে চলেছে।ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন।সামনের রেলিং এর ওপারে দেখা যাচ্ছে একটানা ভিজতে থাকা গাছ।প্রবল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে পাখিদের যত্ন করে তৈরী করা গেরস্থালি।কার্নিশে এসে বসেছে পায়রার দল।বৃষ্টিভেজা সরু পিচের রাস্তাটা চকচকে মনে হচ্ছে দূর থেকে।সামনের ছাদে একটা কিশোরী মেয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে নাচানাচি করছিল,আমায় দেখে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল।অজান্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল,ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি উঁকি দিল।টুপ..চায়ের কাপে বৃষ্টির জল পড়ছে।টুপ টাপ টুপ..ল্যাপটপের খোলা স্ক্রীনের ওপর দুফোঁটা জল..আস্তে করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলাম.....চশমার কাঁচের মাঝ দিয়ে হারিয়ে যেতে...কিছু চেনা অচেনা আদরের গন্ধ বুকে মেখে...ডেডলাইন মিস করেছি...কিন্তু  ডেডলাইন মিস করিনি...

বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৫

হোসে হুলিয়ান মার্তি পারেজ জন্মেছিলেন ১৮৫৩ সালে, আজ থেকে প্রায় একশ সত্তর বছর আগে। কিউবান রেভোলিউশনারি মুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন পারেজ, স্প্যানিশ শাসনের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ক্রাউসিস্ট লিবরেলিজমের প্রবল সমর্থক এই নেতা নিম্নবর্গের অধিকারের জন্য আজীবন কাজ করেছেন, দাসপ্রথা উন্মূলনের জন্য আন্দোলন করেছেন, অল্পবয়সীদের বৌদ্ধিক ক্ষমতার বিকাসের জন্যও একাধিক প্রকল্প শুরু করেছিলেন তিনি। পারেজ একইসঙ্গে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, শিক্ষক, দার্শনিক ও প্রকাশক ছিলেন, কিন্তু নিজের একটা লেখাও গ্রন্ধবদ্ধ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে কিউবান ন্যাশনাল হিরোর তকমা দেওয়া হয়, তাঁর লেখা প্রবন্ধ, কবিতা ও বক্তৃতা অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশেও। দ্রুত তিনি ল্যাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হয়ে ওঠেন। 

কথা হচ্ছে একশ সত্তর বছর আগের এই নেতা কী লিখেছেন, সেটা কি এখনকার প্রজন্মকে, এখনকার বাস্তবকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে? বিশেষ করে এমন কোনও ব্যাক্তির জীবনকে, যিনি স্প্যানিশ সাহিত্য বা মার্ক্সবাদী দর্শন নিয়ে আগ্রহী নন!

প্রায় আট বছর আগে দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখতে গিয়েছিলাম। মনে আছে সেখানে পরিবেশ বিষয়ক সিনেমা দেখানো হচ্ছিল, বসুধা পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি 'নিয়মাগিরি ইউ আর স্টিল অ্যালাইভ' দেখতে গিয়ে একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। নতুন মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হওয়ার জন্য ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চমৎকার জায়গা। ডেলিগেট ব্যাজ লাগিয়ে একসঙ্গে সিনেমা দেখো, তারপর সিনেমার ভালো মন্দ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করো। মাঝে মাঝে চা বা লাঞ্চ ব্রেকে যাওয়া অথবা একটা স্ক্রিনিং স্কিপ করে আড্ডা দেওয়া। নিজেদের মতো সিনেমা পাগল দর্শক তো বটেই, ক্যামেরার পিছনে কাজ করা মানুষদের সঙ্গেও চেনাজানা হয় যায় এই ফাঁকে। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে। তা সেইবার যার সঙ্গে পরিচয় হল, তিনি নিজে একজন সমাজকর্মী ও ডকু ফিল্মমেকার। ভদ্রলোক বহুদিন হল ছত্তিসগড় আর উড়িষ্যাতে কাজ করছেন, কয়েকটা ছবিও করেছেন। চা খেতে খেতে আড্ডা জমে উঠল আমাদের। কথায় কথায় আলোচনা ঘুরে গেল সিনেমা ও বাস্তব জীবনে সাহিত্যের ভূমিকার দিকে। আমি একসময় বললাম, "আপনার মনে হয় সাহিত্য লং টার্মে বাস্তব জীবনে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে?" তাতে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "একটা গল্প শুনবেন? গল্প বললেও এটা সত্যি ঘটনা। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা।" সম্মতি দিলাম। ভদ্রলোকের গল্পটা নামধাম বদলে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

***

হাতে উল্কি আঁকা, গায়ে চে গুয়েভারার ছাপ মারা টি শার্ট। লম্বা চুলদাড়ি উশকোখুসকো, চোখে সানগ্লাস। রয়্যাল এনফিল্ড থেকে নেমেই লোকটা হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল।

"লং লিভ রেভোলিউশন।"

সামনের জায়গায় সার দিয়ে বসা জনা দশেক লোক। তাদের কেউই উত্তর দিল না।।শান্ত স্বরে কথা বলছিল সুবিনয়, সে আড়চোখে একবার দেখল মাত্র। সবাই বিহ্বল মুখে বসে আছে। এই গলাবাজি শুনে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো অবস্থা তাদের নয়। আজ ছয়দিন হল তাদের কারো পেটে অন্নের একটা দানাও পড়েনি। নিছক উপোস নয়, এটা তাদের প্রতিরোধের ভাষা।

জায়গাটার নাম জরান্দুল। গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ছোট একটা গ্রাম। দিন কয়েক হল খানিক চর্চায় এসেছে এই গ্রামের প্রান্তিক মানুষরা। নাহ! তেমন কৌতূহলোদ্রেককারী কিছুই ঘটেনি। আদ্যিকাল ধরে চলে আসা সেই এক পুরোনো গল্প আবার অভিনীত হচ্ছে। 

সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে এই ছোট্ট গ্রামের চাষাদের জমি নিয়ে নিচ্ছে সরকার। মাত্র সাত দিনের নোটিসে কয়েক হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে ঘরছাড়া করছে গরীব মানুষগুলোকে। রয়্যাল এন্ড শাতো গ্রুপের সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে সরকারের, এমওইউ-ও সাক্ষরিত হয়ে গেছে মাসখানেক আগে। এই পার্বত্য গ্রাম আর আশেপাশের জায়গা জুড়ে কটেজ রিসোর্ট নির্মাণ করার জন্যে বহুজাতিক কোম্পানিদের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি করার অনেক আগে থেকেই চলছে, এতদিনে সেই পরিকল্পনায় সীলমোহর পড়ল। এখানকার স্থানীয় লোকেদের কথা কেউ ভাবে না, কোনোদিন ভাবেওনি।

সুবিনয়রা অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছে সমর্থন জোগাড় করার, আন্তর্জাতিক সংগঠনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হয়তো কিছুটা সময় পাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি তারা আদালতে বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান ও সাক্ষ্য সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে প্রয়োজনীয় রিহ্যাবিলিটেশন এর ব্যবস্থা না হলে এখানকার লোকেদের জোর করে সরানো আইনসংগত তো নয়ই, যুক্তিসম্মতও নয়। পরিবেশবিদরা প্রথম থেকেই সাবধান করছে, 'প্রিকশনারি মেজার্স' না নিলে বিপর্যয় হতে পারে। এত তাড়াহুড়ো করে কাজ করা মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু এ সব যুক্তি কেউই শোনেনি। বলা ভালো শুনতে চায়নি। 

যখন সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, শেষ অস্ত্র হিসেবে এই পন্থা বেছে নিয়েছে সুবিনয়রা। আমরণ অনশন। ফাস্ট টিল ডেথ। সরকারের কাছে তাদের দাবি, গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষের জন্যে লিখিত ভাবে সরকারের পক্ষ থেকে রোজগার ও পুনর্বাসনের স্বীকৃতি দিতে হবে। সেটা না হওয়া পর্যন্ত এই অনশন চলবে।

সুবিনয় ভেবেছিল এই মরিয়া সিদ্ধান্তের পর অন্তত টনক নড়বে সরকারের। একটা মধ্যপন্থী পথ বের করতে আগ্রহী হবে প্রশাসন, মিডিয়ার চাপে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে সরকারি পক্ষের লোকজন। কিন্তু একের পর এক দিন কেটে গেছে। একটা মানুষও কথা বলতে এগোয়নি সরকারের তরফ থেকে, মিডিয়াও চুপ। সুবিনয়ের সঙ্গীরা হতাশ হয়ে পড়েছে, এমনটা তারা আশা করেনি। সরকার কি কালা? বিন্দুমাত্র দায়িত্ব বা সহানুভূতি নেই তাদের? মানুষের জীবনেরও দাম নেই?

তাহলে কি কিছুই করা যাবে না? এই প্রানপণ খাটুনি, দীর্ঘ দিন ধরে চালানো এই অমানুষিক পরিশ্রম-- ফিল্ড ওয়ার্ক, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, ক্যাম্পেনিং-- এ সমস্ত কাজ বৃথা যাবে? শেষমেশ রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করবে এই সবুজ, সুন্দর গ্রামের সাদাসিধা মানুষরা? প্রতিদিন কেউ না কেউ আশা হারিয়ে সরে পড়ছে, এই যুদ্ধের পরিণাম তাদের জানা। কয়েকজন অবশ্য এখনও মাটি কামড়ে পড়ে আছে। সুবিনয় কিন্তু অনড়। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা জিতবেই।

চোখ থেকে চশমা খুলে লোকটা সোজা হেঁটে এল সুবিনয়ের দিকে। তার মুখে একচিলতে হাসি। সুবিনয়ের কাছে এসে সে বলল, "Its not necessary to introduce myself.Just know what I do. I am a terrorist."

সুবিনয় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। কালো চশমা বলল, "Whatever I do, I have a respect for brave people like you. You are obviously very brave. But you are foolish my friend."

সুবিনয় বলল, "কেন বলুন তো?"

কালো চশমা তার প্রশ্নে কান দিল না। কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে একটা ভিডিও ক্যামেরা বার করে সামনে রাখল সে। সুবিনয় ধীর স্বরে জিগ্গেস করল, "হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?"

লোকটি হাসল। বলল, "পারেজ। হোসে হুলিয়ান মার্তি পারেজ।"

এর ঠিক পনেরো মিনিট পর সুবিনয় দাঁড়িয়ে ছিল পারেজের সঙ্গে। পারেজ তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, "It does not matter the way you choose my brother. What matters  that the way should take you to the destination...not to your destiny!"

পরদিন সকালেই মিডিয়াতে হইচই পড়ে গেল।প্রখ্যাত সমাজসেবী সুবিনয় রায় সহ বারোজনকে অপহরণ করা হয়েছে। সুবিনয় রায় বেশ কিছুদিন ধরে ওই অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে গ্রামের মানুষদের উন্নয়নের জন্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ইউটিউবে ইতিমধ্যেই একটা টেররিস্ট গ্রুপের ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে।নতুন এক জঙ্গি সংগঠন থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, জরান্দুল রেঞ্জের জঙ্গলে কোনো রকম সরকারি দখল বরদাস্ত করা হবে না। সেরকম কিছু হলেই তারা সারা রাজ্য জুড়ে সিরিয়াল ব্লাস্ট করবে। সারা জরান্দুল রেঞ্জকে তারা নিজেদের স্বাধীন রাজ্য বলে ঘোষনা করেছে এই জঙ্গি সংগঠন। সঙ্গে এও বলেছে যে, কোনও বহুজাতিক কোম্পানি এখানে কারখানা বা রিসোর্ট করতে এলে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মাস্ক পরা একজন মানুষ হাতে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাজ্য সরকারের কাছে তাদের দাবি খুব স্পষ্ট। আগামী তিন দিনের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে পাঁচ কোটি টাকা না পেলে তারা সুবিনয় সহ বারো জনকে হত্যা করবে। 

বিকেলের মধ্যেই খবরটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্যে। ইউটিউবের ভিডিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু রাজ্য সরকারের ওপর প্রশ্নবাণ ছোঁড়া নিরন্তর চলছে। 

ফেসবুক, ,ইউটিউব, স্থানীয় নিউজ চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধে। রাজ্য সরকারের নাকের সামনে দিয়ে এত গুণী একজন মানুষকে ধরে নিয়ে গেল? সঙ্গে দেশের বারোজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তি। বুদ্ধিজীবী সমাজে সুবিনয় রায় একটা সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিত্ব। তাঁকে যে করে হোক উদ্ধার করতেই হবে, নাহলে কেন্দ্র সরকার তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহলেও রাজ্যের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। দেড় দিনের মাথায় সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হল, দ্বিতীয় দিন দিল্লি থেকে সরকারি কর্তারা উড়ে এলেন। ইন্টেলিজেন্স তেমন কিছু সাহায্য করতে পারেনি, জরান্দুল অঞ্চলে মিলিটারি নামানাও বিপদ। লোকজন ক্ষেপে আছে, হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। এদিকে মিডিয়া প্রায় মাথা খেয়ে ফেলছে। শত চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক মহলে খবর লিক হয়ে গেছে, প্রসাশনিক ভবনে ফোন বেজেই চলেছে। উপায়ান্তর না দেখে তৃতীয় দিন শেষ হওয়ার আগেই সরকারকে জঙ্গিদের দাবি মেনে নিতে হল। 

তিন সপ্তাহ পরের কথা। সুবিনয় বাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। একটা খবরের ওপর তার চোখ আটকে গেল। নিরাপত্তা জনিত কারণে রয়াল অ্যান্ড শাতো গ্রুপ রাজ্য থেকে রিসর্ট বানানোর পরিকল্পনা তুলে নিচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, তারা  সরকারকে জানিয়েছে যে মাফিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাবসা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তারা প্রোজেক্ট অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। সুবিনয়ের মুখে একটা হাসি খেলে গেল।

(বলা বাহুল্য কাহিনির বক্তা নিজেই সুবিনয়)

***

গল্প শেষ হতে ভদ্রলোক বললেন, "হোসে মার্তি পারেজ মারা গিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর আগেই।।মাত্র ৪২ বছর বয়সে দোজ রিওজের যুদ্ধে গিয়ে মারা যান তিনি। তখন তার একটা লেখাও বই হয়নি। তার মৃত্যুর এতদিন পর ভারতবর্ষের এক প্রান্তিক অঞ্চলে হুট করে কয়েকজন যুবকের আবির্ভাব হল, যারা নিজেদের 'পারেজ' বলে পরিচয় দিতে শুরু করল। যার কথা বললাম, সেই ভারতের একমাত্র পারেজ নয়। ছত্তিসগড়ে
বেশ কিছু অঞ্চলে এদের কথা শোনা গেছে, যদিও মিডিয়াতে পাঁচকান হয়নি বিশেষ। এরা অনেকেই উচ্চবিত্ত, কিন্তু প্রয়োজনের সময় নাকি এরা ঠিক পৌঁছে যায় মানুষকে সাহায্য করতে। এই রবিনহুড হওয়ার চেষ্টা করে লাভ হয়তো কিছুই হয় না, হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তাও ঘটনাটা হচ্ছে। নিজে গিয়ে খোঁজ করলে জানতে পারবে। জরান্দুল পুলিশের পক্ষ থেকে ভিজিল্যান্টে অ্যাকশন নেওয়া চলছে, সরকার নজর রাখছে। সে না হয় হল! কিন্তু ভেবে দেখো, লোকগুলো পারেজ নামটা নিয়েছে কেন? পপ কালচারে পারেজ কোনও আইকন হয়ে ওঠেননি, তিনি তো আর চে নন। তাহলে? কেন এই ছেলেগুলো তাঁর নাম ব্যবহার করছে? সাহিত্য কি তাহলে কিছুটা হলেও বাস্তবকে প্রভাবিত করে?"

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, "ঘটনাটা সত্যি?"

ভদ্রলোক হেসে বললেন, "মিথ্যে। ওই সমাজকর্মী যে আমি সেটা তো বুঝতেই পারছ। পারেজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঠিকই। স্থানীয় ক্রিশ্চান। হিন্দিতে একটা কথাও বলেনি। ইংরেজি উচ্চারণ শুনে মনে হয় কনভেন্ট এডুকেটেড। বাপের পয়সাও আছে হয়তো। সে আমাকে ওই বুদ্ধিও দিয়েছিল। আমার সাহস হয়নি। বিশ্বাস করতে পারিনি। এই ভিজিল্যান্টেদের কথা আগেই শুনেছিলাম, ভয় ছিল এদের সঙ্গে যোগসূত্র পেলে আমার সম্মানহানি হবে।"

আমি মুখ গোঁজ করে বললাম, "তাহলে?"

"তাহলে আর কী! চোদ্দদিনের মাথায় অনশন ভেঙে দিলাম। সরকার এক মাসের মাথায় গ্রামের মানুষকে ঘরছাড়া করল। কেউ কিচ্ছু করতে পারল না। যা হয়! নতুন ল্যান্ড বিল আসছে, যদি কিছু বদল আসে! অনেকদিন পর সে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার ডকু শুট করার সময় নিজেই এসেছিল একদিন। রায়পুরে বাড়ি। তোমাকে একটা ছবি দেখাই।"

ভদ্রলোক ঝোলা থেকে একটা ফাইল বের করলেন। তার ডকু ফিল্মের কিছু স্টিল, মিডিয়া কাটিং, এইগুলো ডিজিটাল আর্কাইভে জমা দেওয়ার জন্য এনেছেন। একটা ছবি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। তাতে দেখলাম ফিল্ম ইউনিটের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। অবিকল সেই চেহারা। লম্বা চুলদাড়ি, চোখে সানগ্লাস। একটা বই সে এগিয়ে দিচ্ছে সেই ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক ছবি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, "বইটা আমাকে গিফট করেছিল ছেলেটা। সবসময় সঙ্গে রাখি। এই দেখো!"

তার হাতে উঠে এসেছে একটা বই। পুরোনো বই, কিন্তু বাইন্ডিং করা আছে বলে ভালো অবস্থাতেই আছে। খুলে দেখলাম নামটা-- Selected Writings By José Martí. 

ভদ্রলোক বাঙালি নন। নাম বদলে তাঁর বলা গল্পটা লিখে রেখেছিলাম। বইটা পড়িনি। তবে হোসে মার্তির কিছু কবিতা পড়েছিলাম পরে ছাড়া ছাড়া ভাবে। আজ আমাজনে সাজেশনে দেখে ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেল।

সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০১৫

দুপুরে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল.বিকেলবেলা ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ কচলে আকাশের দিকে তাকাতেই নানা খেয়াল ভিড় করে এলো মাথায়.দুই সপ্তাহ আগে এইরকমই এক শেষ বিকেলের আলোয় বসে ছিলাম সুদুর আসামে,মানস নদীর তীরে,হেঁটে গেছিলাম শুকনো পাতার ওপর দিয়ে জঙ্গলের পথে.পরের দিন কাজে যাওয়ার চিন্তা ছিল না,ফোন রিসিভ করার ব্যস্ততাও ছিল না.খালি মরা বিকেলের আলোয় দেখা নদীর জল আর জঙ্গলের গাছপালা.আজও সেই রকমই বসে আছি বিকেলের পড়ন্ত আলোয়.সব কিছুই একরকম.সূর্য সেখানে আজও এক ভাবে ডোবে,আকাশে লালিমা ছড়িয়ে যায় চারপাশে.এখানের মত ট্রাফিকের শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয় না,বনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় না এত অগুন্তি মানুষ.আকাশ সম্পূর্ণ ভাবে ধরা দেয় চোখে,এখানের মত manmade obstacles আটকে যায় না তার রূপের সৌন্দর্য.সূর্য ডুবে যাচ্ছে বাঙ্গালোরে কিন্তু আমি আজও বসে মানসের তীরে.ভারাক্রান্ত মনে এক কাপ চা খেতে উঠলাম.চায়ে চুমুক দিতেই কয়েকটি দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পর্দায়.মাজুলি থেকে ফিরছি.লঞ্চ ভর্তি লোক.নদীর জল কেটে লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছে.ধারের সিটে বসে আমি.কানে বাজছে 'বইজুয়া'.আমার নেশা হয়েছিল.হাতে এক কাপ চা.যখন ঘুরতে বেরোই,হুহু করে কেটে যায় সময়.একই দেশ,কিন্তু কত অন্তর লোকেদের রোজকার জীবনযাত্রায়,আশাআকাঙ্খায়.সময় কম হওয়ার দরুন আগে থেকে ঠিক করা থাকে পরের ঠিকানা.ভালো লাগা-খারাপ লাগার মুহূর্ত,নতুন স্বাদ,গন্ধ,দৃশ্য,অপরিচিত লোকের ব্যবহারে পাওয়া উষ্ণতা.. দ্রুত চলতে থাকে একের পর এক.তার মূল্য বোঝার সময় তখন থাকে না.পরে হঠাৎ করে একটিন মনে পড়ে সেই সব কথা.ফিরে আসার পর.চিরব্যস্ততার মাঝে চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে যায় পথে পাওয়া সেই দিনগুলির স্মৃতি.বুকের ভেতর ভারী হয়ে আসে.কত কিছু ছেড়ে এলাম পিছনে.মানসের নদীর বুকে আজও ঠিক তেমন ভাবেই হচ্ছে সুর্যাস্ত,কিন্তু আজ আমি নেই সেখানে.জ্যোত্স্না আজও ছড়িয়ে পড়বে মাজুলির ধানক্ষেতের ওপর,কিন্তু ব্রিজের ওপর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে কেউ চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকবে না সেই দিকে.হারপ্রীত হয়ত গিটার বাজাবে বিটের সঙ্গে বসে,কিন্তু তাদের হাসিতে আজ আমি যোগ দিতে পারব না.এলিজাবেথ এতদিনে ফিরে গেছে নিউইয়র্ক.সিপ আর ক্লায়ের হয়ত নেপালের পথে.বায়রন বোধহয় নতুন অতিথিদের জন্যে রান্না করছে.সইকিয়া সাহেব অন্য কয়েকজনকে নিয়ে গেছেন মথানগুরিতে,শর্মাবাবুর হাতের রান্না খাবেন আজ.আরও কত মানুষ যাদের সঙ্গে ভাগ করেছি কয়েক টুকরো কথা,কয়েক চিলতে হাসি,এদের সবার জীবন চলবে নিজের মতন করে.হয়ত জীবনে আর কোনদিন এদের সঙ্গে দেখা হবে না.কোথাও পড়েছিলাম প্রত্যেক মুহূর্তই বেঁচে থাকে পৃথিবীতে.পৃথিবীর প্রত্যেক কণার মেমরি আছে নিজের নিজের.কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না চিরতরের জন্য.এই স্মৃতিগুলোও বেঁচে রইলো অদৃশ্য কোনো ড্রাইবে.কয়েকটি মুহূর্তই সই,জঙ্গলের কিছু রাত,সূর্যের শেষ রশ্মিতে মানস নদীর চিকচিক করে ওঠা জল,এই দৃশ্য আমারই রইলো.ঝিঝির অবিরাম শব্দে জীবন্ত গারো হিলসের বনও আমি সযত্নে রেখে দিলাম মনের কোন কোনে.অন্ধকার রাতে সাইকেল চালাতে চালাতে দেখা জ্যোত্স্নাও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না আমার কাছ থেকে.কোনদিন কি ফেরা হবে?যদি বছর কয়েক বাদে এক রাতে পৌঁছে যাই বাই দা ওয়েতে,অথবা বায়রনএর হোমস্টেতে,মথনাগুড়ির বাংলায়,আনন্দে কি মন উৎফুল্ল হয়ে উঠবে না চোখের কোন ভিজে যাবে?জানা নেই.সূর্য ডুবে গেছে.শেষ পনেরোটা দিনের অপেক্ষায় কেটেছিল নটা মাস.কত পরিকল্পনা.অপেক্ষা শেষ.সফর শেষে ফিরে এসেছি রোজকার বাস্তব জীবনে.ট্রাফিকে আটকে,বাসকন্ডাকটারের গালাগালি খেয়ে,ধুলো মেখে,অফিস যাওয়ার চিন্তা করে কাটানো আরেকটি সন্ধ্যে.বাস্তব!চূড়ান্ত অবাস্তব!পরিকল্পনার আর দরকার নেই.বেঁচে থাকার তাগিদ খুঁজে নিতে হবে.গলাটা ভারী হয়েই রইলো.বাস্তবের হিসেব নিকেশ কে কলা দেখিয়ে,রোজকার জীবন অস্বীকার করে যদি জীবন আরেকবার ফিরে যায় মানস নদীর ধারে!হারিয়ে যেতে!....সূর্যাস্তের আগে!সূর্যাস্তের সময়!