শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০

ভিন্নমুখী ভিয়েনা

সৌধ, সত্ত্বা ও সঙ্গীত— কফি কালচার এবং অন্যান্য
Vienna

কিছুতেই না,

লিখবেই না সে

আত্মকথা


জীবন যতটা 

তার কাছে শুধু

—অশ্লীলতা


ঘেঁটে পাওয়া কিছু 

কথা মনে মনে

রেখে দেয় খালি

দ্বিধা নেই 

তবু হাতড়াতে যায়

যত ধুলোবালি


খুঁজে খুঁজে যায়  

ছন্দ সমানে

কত অনুতাপ  


কবিতায় লিখে

করে চলে শুধু

জীবনের পাপ


~আর্নস্ট জ্যানডল



১) পুরোটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল তো? হবে না? একে তো এমন উদ্ভট কবিতা! তারপর আমার মত অকর্মার ঢেঁকি যদি সেই কবিতার অনুবাদ  করতে যায়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অথবা এখনকার কবি অনিমিখ পাত্র বা শৌভিক দে সরকারের মতো সুযোগ্য অনুবাদকের হাতে পড়লে এই কবিতার অনুবাদ পড়েই হয়তো আহা-উহু করতাম (যেখানে যেখানে স্মৃতি কাজ করেছে অম্লানবদনে গুণীজনদের অনুবাদ ব্যবহার করতে মোটেও পিছপা হইনি। আশা করি তাঁরা অধমের দোষ ধরবেন না) এখন সেই অনুবাদ আমার মত অকবির হাতে পড়ে পরিত্রাণ চাইছে। সে যাকগে! সাহিত্যের মানের বিচারের জন্যে এই কবিতা নয়, এখানে লাইনগুলো ব্যবহার করার অন্যতম কারণ হল আর্নস্ট জ্যানডল-এর (জার্মান উচ্চারণ করতে অক্ষম বলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী) লেখার অভিনব ক্ষমতা এবং আধুনিক ভিয়েনা এবং ইউরোপের কবিতার জগতে কবিতাকে শ্রবণযোগ্য করে তোলার কৃতিত্ব। আমাদের দেশের মত ইউরোপে শ্রুতিনাটক অথবা 'রেডিও প্লে' শুধু গল্প আর উপন্যাসের ওপর নির্ভর হয়ে থাকে না। শ্রুতিনাটকের শ্রবণযোগ্যতা যে একটি বিশেষ গুণ, সেই বিশ্বাসে ভর দিয়ে বহু সাহিত্যিক সারা জীবন শুধুমাত্র রেডিওর জন্যে শ্রুতিনাটক লিখে গেছেন। কবি জ্যানডলও রেডিওতে শ্রুতিনাটক লিখতেন এবং সেখানেই তাঁর দেখা হয় ফ্রেদেরিকে মেয়োরিকেরের সঙ্গে। পরবর্তী কালে ফ্রেদেরিকেকেই বিয়ে করেন জ্যানডল এবং এরপর দুজনেই সারাজীবন ধরে একসঙ্গে শ্রুতিনাটক নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। 

ফ্রেদেরিকে স্বভাবে প্রচন্ড সংবেদনশীল ছিলেন। একবার কবিতা প্রসঙ্গে কথা উঠতে তিনি বলেছিলেন, "আমি বেঁচে থাকি ছবিতে। ছবির ভিতরেই আমার জীবন। আমার ভালো মন্দ, স্মৃতি, বর্তমান সবকিছুই আমি ছবিতে দেখি।"ফ্রেদেরিকের ছবি সর্বস্ব কবিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্যানডল লিখতে শুরু করলেন শ্রুতিনির্ভর কাব্য। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা কিছু চিত্র, যা পড়তে যতটা উদ্ভট, শুনতে ততটাই প্রভাবশালী। তার লেখার ধরনও অন্যরকম। যেমন এই লেখাটা...


দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা আমার কস্মিনকালেও মনে ছিল না

 তৃতীয় স্ত্রীর কথাও মনে ছিল না কোনোকালে

 একটা কথাই আমি মনে রাখি, মনে রেখেছি চিরকাল

 আমার কোনোকালেই  কোনও প্রথম স্ত্রী ছিল না।


আস্তে আস্তে জ্যানডল অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপের কাব্যজগতে শ্রুতিনির্ভর, এক্সপেরিমেন্টাল কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করে তুললেন। আমেরিকা ও এশিয়ার নানান দেশে তাঁর লেখা নিয়ে চর্চা হতে লাগল। তাঁর কয়েকটি লেখা গভীর অর্থবহনকারী, আবার কয়েকটি শুনলে ঠোঁটে হাসি খেলে যায়। 'ভিয়েনিস ফক্কড়'-এর উপাধি পাওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল তাঁর। এই ধরুন, তাঁর লেখা কবিতা 'ওত্তোস মোস'-এ ইংরেজি স্বরবর্ণের 'O' ছাড়া কোনও স্বরই ব্যবহার করেননি। এই লেখা অনুবাদ করতে গেলে হাবুডুবু খেতে হয় ঠিকই, কিন্তু এর প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। জ্যানডলের লেখা পড়ে অন্যান্য ভাষার কবিরাও এই ধরনের কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন সে সময়।

এইবার মোদ্দা কথা হল আর্নস্ট জ্যানডলের কথা হঠাৎ আমার মনে পড়ল কেন? ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে বসে আনাড়ির মতো সাহিত্যের ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছি, এদিকে পেটে বিদ্যা নেই কিছুই। কবিতা নিয়ে আলোচনা করাও আমার সাজে না। ভিয়েনিস ফক্কড়ের কথা ওঠার একমাত্র কারণ হল ভিয়েনা। ভাবলে অবাক হতে হয় যে একশ বছর আগেও ভিয়েনা এবং অস্ট্রিয়ার স্বাধীন শিল্পসত্তার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। রাষ্ট্রই তো তৈরি হয়নি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রো-হাংরি রাজ্যের অধিকাংশ শিল্পী অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক পরাজয়ের পর কচ্ছপের গতিতে নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু কাব্যচর্চার কামাল হোক বা কিসমত কা খেল, পঞ্চাশের দশকের পর সেই দেশেই একের পর এক শিল্প, সাহিত্য ও রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে। এই সাহিত্য বিপ্লবগুলো কিছুটা হলেও দেশের মানসিকতাকে প্রাপ্তবয়স্ক করে তুলেছে।

আমরা সালজবুর্গ থেকে ট্রেনে করে এসে নেমেছি ভিয়েনায়। তথ্যপ্রযুক্তি এবং সুযোগসুবিধের ব্যবস্থা একইরকম, তফাতের মধ্যে সালজবুর্গ ছিল একাধারে পাহাড় আর হ্রদ ঘেরা একটা শান্ত শহর, আর ভিয়েনা পুরোদস্তুর ইউরোপিয়ান মেট্রোপলিটান। মেট্রো করে হের্বসট্রাসে বলে একটা জায়গায় গিয়ে নামলাম। দু' রাত্তিরের ব্যাপার, কাছাকাছি একটা এয়ার বিএনবি পাওয়া গেছে। খুব বেশি খুঁজতে হল না, রাস্তার ধারেই গেয়র্গের বাড়ি। গেয়র্গ এই হোমস্টের কর্তা, বেশ কয়েকজনকে ঘর ভাড়া দেয়। বাড়িতে সব ব্যবস্থাই আছে, শুধু ঘরগুলো ছোট ছোট। বেশ আমুদে মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, কাঁচাপাকা দাড়ি নিয়ে হাসলে অনেকটা ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মত দেখতে লাগে। কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিলাম। ভেনিসে আমরা মাত্র একদিনের জন্যে এসেছি শুনে অবিকল ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মত করে মাথা নেড়ে বললেন, "হাতে খুব কম সময়, কিন্তু ভালো কথা হল কম দিনের জন্যে এলে আবার ফিরে আসার প্রত্যাশাটা বেড়ে যায়।"


কে জানত কয়েক বছর পর এই শহরে ফিরে আসতে হবে? তাও আবার দু' এক দিন বা সপ্তাহ নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য। 

দুপুরে চললাম স্কনবার্ন প্যালেসের দিকে। হাপ্সবুর্গ সম্রাটদের বিশ্রামগৃহ ছিল এই প্রকাণ্ড প্রাসাদ। ভালো করে দেখতে গেলে যতটা সময় ও অর্থ প্রয়োজন, তার সিকিভাগও আমাদের কাছে নেই। বাইরে থেকে দেখলে তবু খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। প্রাসাদের চেয়েও বিশাল তাকে ঘিরে রাখা উদ্যান। গাছের পাতা ছেঁটে নানারকমের আকার দেওয়া হয়েছে, ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালোই লাগে। হলুদ রঙের প্রাসাদের মহলগুলো দেখলে সম্ভ্রম তো জাগেই, হাপ্সবুর্গ বংশের কতটা প্রতিপত্তি ছিল, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। একসময় ওল্ড টাউনের দিকে এগোনো হল ধীরেসুস্থে। মনটা তখনও সবুজে মাখামাখি হয়ে আছে, আল্পসের পাহাড় থেকে নগরজীবনে ফিরে খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছি না। ওল্ড টাউন নিয়েও যে খুব একটা যে আগ্রহ ছিল তা নয়। আহে বহু ইউরোপিয়ান শহরের ওল্ড টাউন দেখে একটা ধারণা করে নিয়েছি মনে মনে। স্বভাবতই অনেক জায়গায় মতন এখানকার ওল্ড টাউনও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ, সে আর এমন কী! সেই তো গির্জা আর ক্যাফে-রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমার কথা শুনে মোটেও অবাক হইনি।

কিন্তু ওই যে বলে, বেশি চালাকের গলায় দড়ি! ভিয়েনার স্টিফেনপ্লাৎজ অঞ্চল যেন আমাদের অহংকার দূর করতেই অপেক্ষা করেছিল। মেট্রো করে উপরে উঠতেই মনে হল গালে কেউ 'ঠাস-ঠাস' করে চড় কষিয়েছে।  হ্যারি পটারের দিব্যি, স্পেন থেকে শুরু করে ইতালি, কোনও শহরেই এরকম রাজকীয় বৈভব আর আভিজাত্য আমাদের নজরে পড়েনি। যা পড়েছে, তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে ভিয়েনার ওল্ড টাউন। ভিয়েনার কথা উঠলে যেই শব্দটা আমার সারা জীবন মনে পড়বে, সেটা হল 'ওপেন এয়ার মিউজিয়াম'। শুধু আমার মন নয়, একই বক্তব্য প্রায় সকলেরই, এমনকি উইকিপিডিয়া খুলেও দেখি সেই একই কথা লেখা আছে।

সত্যিই যেন সমস্ত জাদুঘরটাই নেমে এসেছে রাস্তায়। অপূর্ব শৈলীর সব প্রতিকৃতি, শ্বেতপাথরের প্রতিমা, চমকপ্রদ ফোয়ারা, ঝর্ণাবাতি ছড়িয়ে আছে দিগ্বিদিকে। যেদিকেই তাকাই মনে হয় অবিকল কোনও বৈভবশালী রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল। জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্মিত রাস্তায় যে এমন বৈভবশালী শিল্পদ্রব্য সাজিয়ে রাখা যায়, সে আমাদের কল্পনার ঊর্ধ্বে ছিল। প্রাসাদ, উদ্যান, জাদুঘর নিয়ে ভিয়েনার ওল্ড টাউন আমাদের পুরো ভোম্বল করে দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

ওল্ড টাউনে ঠিক কোন দ্রষ্টব্য দেখেছিলাম আর মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ এখানে লিখব না। তবে এটুকু বলা যায় যে গোটা অঞ্চলটা জুড়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও অজস্র সরকারি ইমারত, দপ্তর, জাদুঘরের অস্তিত্ব আছে। এখানকার বাসিন্দারা রীতিমত এই দপ্তরে চাকরি করতেও আসে। ওল্ড টাউনকে বেষ্টন করে রিং রোড চলে গিয়েছে, ট্রাম নম্বর এক আর দুই সর্বক্ষণ চলছে সেখান দিয়ে। একটা ট্রামে উঠে পড়লেই হল। আমরাও পরের দিন ট্রামে করে বেড়ানোর পরিকল্পনাই নিয়েছি। 

মধ্যযুগে হাপ্সবুর্গ রাজাদের আদালত বসত এই অঞ্চলেই, সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে বলেই হয়তো ভিয়েনিজদের ব্যবহার অনেকটা সংযত, পরিশীলিত। সাধারণ মানুষ গতানুগতিক ফ্যাশন পছন্দ করে, বিনয়ী কন্ঠে মৃদু হেসে কথা বলে। ইংরেজির চেয়ে ডয়েচে বলতেই পছন্দ করে বেশি, যদিও শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার ভূমিকা আছে। পরবর্তী কালে ভিয়েনার অনেকের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাঁদেরকে দেখেও এই সিদ্ধান্তের পুষ্টি হয়েছে। ভিয়েনার সংস্কৃতির অভিন্ন অঙ্গ হল এখানকার 'কফি কালচার'। বৈঠকি আড্ডা থেকে শুরু করে প্রেমে পড়া, রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে কবিতা পাঠ, কোনও  কিছুই কফি ছাড়া করতে ভিয়েনিজরা নারাজ। শুধু কফি অবশ্য নয়, সঙ্গে এখানকার নাম করা অ্যাপলস্টুডেল এবং চকেলেট কেক আছে, যার ভিয়েনিস নাম হল 'সাখে তোর্তে'। ঘরে বসে কাজ করার চেয়ে খাতা কলম ল্যাপটপ নিয়ে কফিশপে চলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। ফ্লাস্কে কফি নিয়ে পার্কে গিয়ে শুয়েবসে বই পড়া বা আড্ডা দেওয়ার মতো দৃশ্যও সর্বদাই চোখে পড়ে। 

ওল্ড টাউনের রাস্তায় চক্কর মেরে মেরে যতটা সম্ভব স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে আমরা চললুম নদীর দিকে। ড্যানিয়ুব নদীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত হবে ভিয়েনাটএই। সেই ড্যানিয়ুব... যাকে নিয়ে ভুরি-ভুরি কবিতা আর গান লেখা হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটা দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া এই সুদীর্ঘ নদী যে কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে! শহরে নদী না থাকলে এমনিতেই আমাদের মন খারাপ হয়, ড্যানিয়ুব দেখার জন্যে যে মন অধীর হয়ে থাকবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

অনেকক্ষণ আগেই অন্ধকার হয়েছে। আমরা ড্যানিয়ুব নদীর ব্রিজের ওপর গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, নদীর বুকে আলোর রোশনাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ড্যানিয়ুব নদী এখানে প্রকাণ্ড চওড়া। এতটাই চওড়া যে নদীর সেতুর মাঝামাঝি একটা মেট্রো স্টেশন করতে হয়েছে। নদীর মধ্যে দীর্ঘ একটা দ্বীপ নির্মাণ করা হয়েছে। ডোনাউইঞ্জে(Donauinsel) নামের এই দ্বীপ সংস্কার করার পিছনে যদিও বন্যা এড়ানোই প্রধান কারণ ছিল, কিন্তু এখন জায়গাটা আমোদকাননে রূপান্তরিত হয়েছে। সবুজে সবুজ হয়ে থাকে ডোনাউইঞ্জে। সাইকেল, স্কেট, প্যাডলবোর্ড, সাঁতার, দৌড়ের জন্য আদর্শ জায়গা, অলস দুপুর কাটাতেও এর জুড়ি মেলা ভার। মেলা বসে থাকে বছরের আট মাস। এখনও সেই উৎসবের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। বিশাল বিশাল দোলনা আর রেস্তোরাঁর লাল, নীল, সবুজ আলোর প্রতিফলন হচ্ছে নদীর কালো জলে। অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্ধকার হয়ে গেছে বলে 'ব্লু ড্যানিয়ুব' দেখা হল না ঠিক, কিন্তু যা দেখলাম তাও মনকে আবিষ্ট করে রাখার ক্ষমতা রাখে।

ড্যানিয়ুব নদীর একটি শাখা শহরে ঢুকে এসেছে খানিকটা। সেই খালের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকদূর যাওয়া যায়। বেশ  জমকালো এই ক্যানাল পাথ, সমসাময়িক ভিয়েনিজ স্ট্রিট আর্টের নানান নিদর্শন চাক্ষুষ দেখার সুযোগ মেলে। 'ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল'-এর জন্যে ভিয়েনার নামডাক থাকলেও গত কয়েক দশকে নতুন ঘরানার বহু শিল্পী উঠে এসেছেন এই শহর থেকে। এদের প্রচলিত নাম 'আন্ডারগ্রাউন্ড আর্টিস্ট'। চেনা পরিধির বাইরে বেরোলে চোখে পড়ে অদ্ভুত গরণের রেকর্ড-এর দোকান, রংচঙে দেওয়াল লিখন আর সাংকেতিক সব ছবি। 

অন্য ধারার শিল্প-আন্দোলন নিয়ে অবশ্য ভিয়েনার মাতামাতি এই প্রথম নয়। ভিয়েনা সাকসেশন মুভমেন্টের কথা তো প্রায় প্রত্যেকে জানে। এই শহরের অন্যতম শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট অর্থ-প্রতিপত্তি বিসর্জন নিয়ে অন্য পথ বেছে নিয়েছিলেন, বিত্তবান মহিলাদের অন্যধারার পোর্ট্রেট করার জন্য অশ্লীলতার অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল তাঁর ওপর। আশ্চর্যের কথা, আজ ক্লিম্ট-এর এক একটা ছবি ইতিহাস তৈরি করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি সৈনিকরা তাঁর অনেক ছবিই বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, অনেক ছবির খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও। কিন্তু যে সব ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, সে সবের চাহিদা অভাবনীয় জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। 'উম্যান ইন গোল্ড'-এর অধিকার নিয়ে তো ছবির মালিক অল্টম্যান পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ আইনি যুদ্ধ হয়েছে অস্ট্রিয়া সরকারের, সে নিয়ে চলচিত্রও হয়েছে। ক্লিম্ট অবশ্য এসব দেখে দেখে যেতে পারেননি। তবে ক্লিম্ট একা নন, শিল্প বিপ্লবে তাঁর উত্তরসূরিরাও কম যান না।  ভিয়েনার প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ইগোন শীল, অস্কার কোকস্কার প্রভৃতির হাত ধরে এগিয়ে চলা শিল্পের জগৎ ষাট ও সত্তরের দশকে'অ্যাকশনিজম'-এর স্রোতে দীক্ষিত হয়েছিল। ফলে সমান্তরাল শিল্পের একটা ধারা সে যুগেও সক্রিয় ছিল। সময়ের সঙ্গে শিল্পচেতনা আরো বেশি অভিনব ও প্রাপ্তমনস্ক হয়ে ওঠে। অ্যাকশনিজমের মূলমন্ত্র ছিল যাবতীয় বুর্জোয়া মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শিল্পকে 'অ্যাকশন'-এর মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা। ওটো মিউল আর গুন্তুর গ্রাসের নেতৃত্বে অ্যাকশনিস্টরা তুমুল সাড়া ফেলেন। ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিক জগৎ থেকে বেরিয়ে তাঁরা তুলি চালানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন মানবশরীরকে। এই ছকভাঙ্গা শিল্পের মাধ্যমে শুরু হয় আন্দোলন। শাসকবর্গের দ্বিচারিতা ও মানবতাবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যত বিক্ষোভ আর উত্তেজনা ছিল, সে সব বডি পেইন্টিং, ফোটোগ্রাফি, ও ফিল্মের মাধ্যমে ধরা দিতে শুরু করে। কেউ রক্ত দিয়ে গির্জার বুকে ক্রস এঁকে দিচ্ছেন, কেউ সারা শরীরে সাদা কালো প্লাস্টার মেখে হাঁটছেন ভিয়েনার রাস্তা দিয়ে, কেউ ভিডিওতে তুলে ধরছেন পশুবলির নৃশংসতা। 'পাবলিক ডিসপ্লে অফ ইনডিসেন্সি' অর্থাৎ অশালীন আচরণ করার ফলে এদের অনেককেই সে কালে হাজতবাস করতে হয়েছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আন্দোলন থিতিয়ে এলেও সেই মনোভাব ধরে সমসাময়িক শিল্পের নানা রূপ প্রকাশ পেতে থাকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে। ধীরে ধীরে পারফরম্যান্স আর্ট সারা পৃথিবীতে নিজস্ব একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। 

রাতে গেয়র্গের বাড়ি এসে দুজন ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। একজন কানাডার ক্যালগিরি থেকে ইউরোপ ঘুরতে এসেছে, অন্যজন থাকে স্লোভাকিয়ায়। দুজনেই প্রাগ থেকে ভিয়েনা এসেছে, উল্টোদিকে আমরা যাব ভিয়েনা থেকে প্রাগ। কিছুক্ষণ গল্পগাছা হল। পথের বন্ধু, ফলে পথের গল্পই হয় বেশি। কার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে সব ভাগাভাগি করে নেওয়া। সেই সূত্রেই এসে পড়ে ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা। পরিবার, কেরিয়ার, অর্থসমস্যা, রাজনীতি… আমি নাম দিয়েছি পাঁচফোড়ন পাঁচালি। খেয়াল করে দেখেছি, এসব আড্ডা দীর্ঘায়িত হয় অচিরেই। সময়ের জ্ঞান থাকে না। অনেক রাতে আড্ডা ভাঙল। তাড়াহুড়ো করে রান্না চাপানো হল। সুপারস্টোর থেকে টিনের মাছ কিনে আনা হয়েছে, ডিনারে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে ঘুম।


২) পরের দিন সকালে পরিকল্পনা মাফিক রিং রোড থেকে ট্রামে উঠে পড়েছি। ট্রাম চলছে, আমরা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বসে আছি। ইচ্ছে ছিল কোথাও নামব না, সোজা স্টিফেনপ্লাৎজ চলে যাব। খামোখা রোদ্দূরে হাঁটাহাঁটি করে কী হবে? কিন্তু সেটা আর সম্ভব হল না। টাউন হলের সামনে আসতেই জায়গাটা দেখে মন চনমন করে উঠলো। ট্রামে বসে আর কোনটুকু দেখা যায়? 'ধুত্তোর' বলে নেমে পড়লাম। বিরক্ত লাগে! এমন করে শহর সাজাতে আছে? শুধু শুধু আমাদের মত লোকজনদের হীনমন্যতায় ভোগানো! হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে যায় কিন্তু তাও কিছুই দেখা হয় না। তারপর এমন সবুজের মেলা। গণ্ডায় গণ্ডায় পার্ক। পার্ক তো নামেই, আসলে বলা উচিত ন্যাশনাল পার্ক। ড্যানিউব আইল্যান্ডটাই তো প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দীর্ঘ এক পার্কের শামিল। তারপর প্রাটার বলে একটা পার্ক আছে, সেখানে দিনদুপুরে হরিণ আর শেয়াল ঘুরে বেড়ায়। এমন গহীন অরণ্য দেখতে আমদের দিন সাতেকের ছুটি নিতে হয়। কিন্তু শহরের যে কোনও প্রান্ত থেকে প্রাতারে পৌঁছতে বড়জোর আধ ঘণ্টা লাগে। জঙ্গলের মধ্যে হর্সরাইডিং ট্র্যাক আছে, ছায়াঘন দীঘি আছে, মাছ ধরার সুযোগ আছে, আবার গল্ফ কোর্স বা বেসবল গ্রাউন্ডও আছে নাগালের মধ্যেই।   

টাউন হলের কাছে গিয়ে দেখি ভিতরে রীতিমত সরকারি দপ্তর আছে। এরকম প্রাসাদপ্রতিম দপ্তরে কাজ করতে এসে লোকজনদের মনে কী ভাব হয় সেটা কে বলতে পারে? হয়তো সকলেই নিজেকে রাজাগজা ভাবতে শুরু করে। সুবিশাল চত্বর। প্রায় চার মাস ধরে প্রতি রাতে টাউন হলের সামনে খোলা জায়গায় মঞ্চের ওপর বিনামূল্যে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সিনেমা, নাচ, গান, কমেডি, নাটক কিছুই বাদ যায় না। শীতের দিনে চলে আইস স্কেটিং। আজ সন্ধ্যের সময়ও গানের অনুষ্ঠান আছে। তাছাড়া আজকাল গ্লোবাল ফুড ভিলেজ ফেস্টিভ্যাল চলছে, সারা পৃথিবীর খাবার পাওয়া যায় সস্তায়। ভিয়েনিজ থেকে ভিয়েতনামিজ, আমেরিকান থেকে আফ্রিকান... যা ইচ্ছে খেতে পারো। ঠিক হল বিকেলেই এখানে চলে আসা হবে। বিনামূল্যে এরকম অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে, এমন সুযোগ কে হারায়?

টাউন হলের কাছেই ন্যাচুরাল হিস্টোরি মিউজিয়াম। খানিকটা হাঁটলেই মিউজিয়াম কোয়ার্টার, সেখানে অজস্র মিউজিয়াম আর আর্ট গ্যালারির ছড়াছড়ি। সমসাময়িক শিল্প আর সিনেমা থেকে শুরু করে সিগমন্ড ফ্রয়েড আর কফিনের মিউজিয়াম ইস্তক সব কিছু মজুদ। প্রত্যেকটা স্থাপত্য যত্ন নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, মিউজিয়ামে না গিয়ে শুধু শুধু বাইরে বসে থাকতেও ভালো লাগে। খোলা চত্বরে নানা রকমের শিল্পাকৃতি আর বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, শুয়েবসে থাকায় যায়। সিজন টাইম বলে অনেক লোকে ঘোরাঘুরি করছে, নাহলে এসব জায়গা নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য আদর্শ।

দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর আমরা এগোলাম। কালেনবার্গ বলে একটা জায়গায় যাব বলে ঠিক করেছি, বাসে উঠতে হবে। কালেনবার্গ আর লিওপোল্ডস্ট্যাট আসলে ভিয়েনার ওল্ড টাউন থেকে বেশ খনিক দূরে অবস্থিত দুই পাহাড়। প্রতিবেশীও বলা যায়। ডে ট্রিপ বা কয়েক ঘন্টার জন্য হাইকিং করতে হলে এমন জায়গা আর হয় না। আঙুরের চাষ হয় এই অঞ্চলে, ওয়াইনারিও আছে। পাহাড়চুড়োয় একটি গির্জা আছে বলে শুনেছি, সেখান থেকে ভিয়েনা শহর তো বটেই, ড্যানিউব নদীর বিস্তারও দেখা যায়। এই যাত্রায় হাইকিং করার সময় নেই বটে, কিন্তু বাস তো চলছেই। আমরা প্রথমেই 'ডে পাস' কিনে নিয়েছ দু' দিনের, অতএব বাসে চড়তে আলাদা করে টিকিট কাটার দরকার নেই।

প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে। ঘুরে ঘুরে রাস্তা। ভিয়েনা শহরের অপেক্ষাকৃত অজানা পাড়াগুলো দেখতে দেখতে এক সময় বাসটা পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। এইদিকটা ফাঁকা ফাঁকা, জনবসতি নেই বললেই চলে। দুদিকে জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝ দিয়ে হাইকিং ট্রেল উঠে গেছে। পাহাড়ের মাথায় একটা রেস্তোরাঁ করা হয়েছে, সেখান থেকে অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ল। নীল ড্যানিয়ুব নদী এঁকে বেঁকে চলে গেছে, তার দু'দিকে ভিয়েনা শহর। নদীর ওপরে কত সেতু! ডোনাউইঞ্জে দ্বীপটাও দেখা যায়। হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে তাও সরতে ইচ্ছে করে না। অবশেষে সত্যি আমাদের 'ব্লু ড্যানিয়ুব' দেখা হল, এই প্রথম। আলাপচারিতা হল না সেভাবে, সে না হয় পরে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। অত অভিমানী চোখে তাকানোর কী আছে বাপু?

সন্ধ্যেবেলা আবার ব্যাক টু ওল্ড টাউন। আলো জ্বললে স্টিফেনপ্লাৎজের আনাচে কানাচে অবস্থিত পাড়াগুলো আরো মোহময়ী হয়ে ওঠে, ঠিক যেন আরব্যরজনীর  কোনও শহর। মায়া বুনে চলে মায়ের হাতের সোয়েটারের মতোই। উলগোল্লার রঙিন সুতো আলোর রূপ নিয়ে শহরে ছড়িয়ে থাকে। এই মায়ার বুননে জড়িয়েমড়িয়ে যাই বারেবারে। রাস্তার মাঝ দিয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলে যায়, আমরা বেঞ্চিতে বসে হলদে চাঁদের রূপ দেখি। প্রসাধিত উদ্যান, আলোকিত গির্জা, গির্জার ওপর বিরাজমান ধুসর চাঁদের আলো। আদুরে আলোয় গা এলিয়ে আলাপচারিতা চলে। 

ক্যাফেগুলোয় পা রাখার জায়গা নেই, প্রায় সকলেই দোকানের সামনের চত্বরে টেবিল চেয়ারে বসে আছে। এখানকার বিখ্যাত জায়গা ক্যাফে মোৎসার্ট, সেখানে দেখি দীর্ঘ লাইন পড়েছে। আমরাও বাদ যাই কেন? এক জায়গায় বসে অ্যাপলস্টুডেল এবং সাখে তোর্তের সঙ্গে কফি অর্ডার করা হল। মুখে দিতেই ম্যাজিকের মত মিলিয়ে যাওয়া হালকা মিষ্টির অসামান্য সেই চকোলেট কেক। আহা! সেই স্বাদ মনে করেই জিভে জল আসে এতদিন পরেও। ভাগ্যে না থাকলে সেরকম সাখে তোর্তে জোটে না। বেশিরভাগ দোকানে ভেজাল কেকই থাকে। 

রাত ন'টার কাছাকাছি টাউন হলের সামনে ওপেন মিউজিক কনসার্টে গিয়ে দেখি বেশিরভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। অন্য  কোনও  জায়গার অনুষ্ঠান ব্রডকাস্ট করা হচ্ছে বিশাল পর্দায়, অন্ধকারের মধ্যে মঞ্চে ঝিলিক দিয়ে যায় চকমকে ডিস্কো লাইট। বাইরের চত্বর থেকে নানা ধরনের খাবারদাবারের সুবাস ভেসে আসছে, সেই সঙ্গে কানে আসছে উদাত্ত গলার গান। অনেকক্ষণ বসে বসে শুনলাম।  

Related image
Museum Quarter
Related image
Old Town

রাত দিনের  কোনও  তফাৎ নেই। ওল্ড টাউনের শিল্পাকৃতিগুলো সোনালি আলোয় এখনও ঝকঝক করছে। আমরা এই গলি সেই গলি দিয়ে হেঁটে চলি। দিক ভুল হয়, আবার ম্যাপ দেখে ঠিক রাস্তায় ফিরে আসি। কত ধরনের দোকানপাট, রাস্তাঘাট, মানুষজন রাতে ঘুরতে বেরিয়েছে সেজেগুজে। যেন দুর্গাপুজোর আমেজ। আমরা এগিয়ে চলি। আজই তো শেষ রাত এই শহরে। 

এমন করেই চলে। এক একটা শহর তার নিজস্বতা নিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে। কয়েকদিন সেখানে রয়ে যাই, তাদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি জীবন, তুলনা টেনে আনি পূর্বঅভিজ্ঞতার। হাসিঠাট্টার অন্তরালে নিঃসঙ্গ মুহুর্তগুলো জড়িয়ে থাকে আঙ্গুল। তখন দুজনে পাশাপাশি বসে থাকি চুপচাপ,  কোনও  কথা না বলে। অনুভবগুলো জীবন্ত হয়ে ভাসে পরদেশী বাতাসে। তারপর একদিন আবার বেরিয়ে পড়ি। কখনও বিচ্ছেদের বেদনা হয়, কখনও পরবর্তী পদক্ষেপের জন্যে আকুল হয়ে থাকি। যাত্রা থামে না। ভিয়েনার রাতে হেঁটে চলে দুই পথচারী... পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে।

Image result for vienna
Random Shot at Night
ক্রমশঃ
পরের পর্ব এখানে পড়ুন

আগের পর্ব এখানে পড়ুন 


যাত্রার শুরু থেকে পড়তে হলে 
যাত্রা শুরু-মাদ্রিদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন