Strasbourg |
আমরা বলি বিদ্যুতের নেই ডানা, উল্টোপাল্টা ঘরে ঢুকে আসা যুক্তি
বিষন্নতাকে কবর দেওয়ার কৌশল, আমরা বলি বিচ্ছেদ শুধু চুক্তি
আমরা বলি হাতের রক্ত ওয়াইন, পাসপোর্ট আর কত আমদানি পণ্য
বদলে আমরা আগেই গিয়েছি সবটাই, পরিচয়হীন বাস্তব স্মৃতিচিহ্ন
আমাদের নেই নির্দিষ্ট কোনও পদবি, আমাদের নেই জীবনের অধিকার,
আমাদের নেই ফিরে যাওয়ার কোনও উপবন, আমাদের নেই কোনও শেক্সপিয়ার
আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, আমাদের পাঁজরে ভয় বেড়ে চলে
আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, সংখ্যা খোদাই করা আছে জিহ্বাতলে
~ন্যাটালি হান্দল
১) যুদ্ধ চাই। মৃত্যু চাই। চাই প্রতিশোধ। মানব ইতিহাসের অধিকাংশ শুধু যুদ্ধ আর প্রতিশোধের কাহিনি। কখনও রাজসিংহাসন নিয়ে, আবার কখনও ধর্ম নিয়ে। তুচ্ছ বচসা এবং কলহের ফলে রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে কোনও গোষ্ঠী অথবা মানুষ হিংস্রতার পরিচয় না দিলেই অন্য গোষ্ঠী কিংবা মানুষের হাতে প্রাণ খুইয়েছে। কয়েক শতাব্দী আগে পর্যন্ত পাশ্চাত্য দেশগুলোতে শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্যের মূলে ছিল ধর্ম ও রাজনীতি। স্বাধীন ভাবে শিল্পের চর্চা ও অধ্যয়ন ছিল ব্যক্তিক্রমী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। জার্মানি অথবা ফ্রান্স, ইতালি অথবা ব্রিটেন সব জায়গায় ইতিহাসের ছবি কমবেশি এক। জার্মানির সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই অবধারিত ভাবে দু'টো বিশ্বযুদ্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বর্তমানে জার্মানি উদারবাদী এক রাষ্ট্র, অতীতের ঘটনা এবং দুর্ঘটনার চিহ্ন থাকলেও সেই উন্মাদ সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব বিদায় নিয়েছে। আমরা তো সেই অর্থে বহিরাগত। এই মহাদেশে যা ঘটেছে, তার সিকিভাগও আমরা চাক্ষুষ করিনি, অনুভব করতে হয়নি সেই যুদ্ধের অসহায়তা। তবু জার্মানিতে ঢোকা মাত্র সেই অভিশপ্ত সময়ের কথা মনে পড়ে যায় কেন?
নেদারল্যান্ডস থেকে ফরাসি দেশে ফিরে চলেছি। কিন্তু এইবার গন্তব্য মায়াবী প্যারিস নয়, বরং জার্মানি ও সুইটজারল্যান্ডের সীমানায় অবস্থিত ফ্রান্সের পূর্ব অঞ্চল। আমরা চলেছি আলসেস প্রদেশের রাজধানী স্ট্রাসবুর্গে, যা গত কয়েক দশকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের মিলনস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে বাসে বসে। সঙ্গিনী বুদ্ধি করে কিছু খাবার নিয়েছিলেন, সেই সবই খাওয়া হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস ছাড়িয়ে এখন আমরা ছুটে চলেছি জার্মানির ভিতর দিয়ে। জার্মানরা রোদ্দুর দেখে অভ্যস্ত নয়, গ্রীষ্মের এই মরশুমেও সেখানে মেঘলা, এরপর শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ঝাপসা কাঁচের ওপর ফ্লিক্সবাসের ওয়াইপার অনবরত নড়ছে। আমাদের জানলা দিয়ে বাইরে যতটা দেখা যাচ্ছে, তাতে আমাদের আশ মিটছে না। সবুজের অমলিন প্রাচুর্যে ঢাকা ঘন বনপাহাড়ের মাঝে ঢেউখেলানো মখমলের গালচে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। একের পর এক সুউচ্চ ওভারসেতুর ওপর দিয়ে বাস যাওয়ার সময় দেখা যায় হাজার ফুট উঁচু গাছেদের সমষ্টি। গাঢ় সবুজের আলোছায়ায় এই ঘন অরণ্যের বিস্তার দেখে ইচ্ছে করে সেখানেই নেমে যাই! হঠাৎ করে বহুদূরে মাঝে মাঝে দেখা যায় একটা কালো মসৃণ সর্পিল রাস্তা, যা এগিয়ে চলেছে কোনও নির্জন পাহাড়ি গ্রামের দিকে। প্রকৃতির ভিজে সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অজান্তেই চোখে জল আসে, আসতেই থাকে। বার বার চোখ মুছি, আবার চোখ জলে ভরে ওঠে। কান্না? কে জানে?
এ আমার বহু পুরোনো অসুখ। পারিবারিক বিপর্যয় আর সংকটে চোখ পাথর হয়ে থাকে, কিন্তু পাহাড় বা সমুদ্রে ঘুরতে গেলে আকছার চোখের জল বাঁধ মানে না। গঙ্গার ঘাট, কালো মেঘের সারি আর অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালেও গলার কাছে রুদ্ধ হয়ে আসে। কখন এ রোগ বাসা বাঁধল কে জানে? এমনিতে কিছুই হয় না, হঠাৎ এক একদিন আবার দেখা যায় এই ব্যাধি। উত্তরাখণ্ডে একবার বাসসফর করতে গিয়ে মনে আছে, চোখের জলে ব্যাগ ভিজে গিয়েছিল। বাইরে ছোট ছোট গ্রাম, ছাগল চরাতে থাকা ছেলেমেয়ে, কুঁড়েঘর, বেগুন বা মটরের ক্ষেত, দূরে হিমালয়ের পাহাড়চূড়া দেখা যায়। কনডাক্টর এসে জিজ্ঞেস করছে, "রো কিয়ুঁ রহে হো বেটা?" কী বলব? কে বিশ্বাস করবে, সবুজে মোড়া দেশের গ্রাম দেখে আমার কান্না পাচ্ছে? এই আমার দেশ! মুগ্ধচোখে দেখে যাচ্ছি, এদিকে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক। বিদেশে এলেও যে সে ব্যাধি পিছু ছাড়েনি, বুঝতে পারলাম। সঙ্গিনীর কাছে লজ্জা ঢাকতে 'চোখে কী পড়েছে' বলতে বলতে মনে হল, আমি আর মানুষ হলাম না!
দূরপাল্লার বাসে মাঝে কোনও এক জায়গায় চালক বদল হয়। বাস কোলোন, ডুসেলডার্ফ হয়ে এগিয়ে চলে আলসেস অঞ্চলের দিকে, রাস্তায় ছোট ছোট বৃষ্টি ভেজা জনপদ চোখে পড়ে। সেরকম একটা ছোট্ট শহরে অপরূপ এক প্রাসাদ চোখে পড়ল, আবার হারিয়ে গেল। এককালে জার্মানি বলে কোনও দেশই ছিল না, বর্তমান জার্মানি অঞ্চলের অনেকটাই ছিল প্রূশিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও ছোট ছোট অনেক রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল জার্মান আর অস্ট্রিয়ানরা। ফরাসি বিপ্লবের পর যখন নেপোলিয়ান যখন প্রুসিয়া আক্রমণ করে, অন্যান্য রাজ্যরাও নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে যোগ দেয়। ১৮৪৮ সালে সংযুক্ত জার্মানি রাজ্যের কল্পনা করা হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট অধিবেশনে। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই ভিন্ন ভিন্ন শাসকেরা বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ের মাথায় মায়াবী সব কেল্লা আর প্রাসাদ তৈরি করেছে। চাক্ষুষ না দেখতে বিশ্বাস হতে চায় না, মনে হয় রূপকথার জগতের কোনও মায়া।
অবশেষে যখন স্ট্রাসবুর্গে এসে বাস থেকে নামলাম, বিকেল হয়ে গেছে। জার্মানি ছাড়িয়ে ফ্রান্সের সীমানায় ঢুকেছি অনেকক্ষণ আগেই, কিন্তু এখানেও আজকে বাদলা হয়ে আছে। বৃষ্টি হবে মনে হয়! এমনিতে আমি বৃষ্টিপাগল। জল পড়লেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়, তবে রুকস্যাক পিঠে বৃষ্টিতে ভিজতে খুব একটা সুবিধে হবে বলে মনে হয় না। অটোমেটিক মেশিন থেকে টিকিট কিনে ট্রামে উঠে পড়লাম। গুগল ম্যাপ বলছে হোমে দে ফ্যা স্টেশনে নেমে ট্রাম বদল করে সি লাইনের ট্রামে উঠতে হবে, সেইমতো ট্রাম বদলে অবজারভেটারি স্টেশনে এসে নেমে পড়লাম। সেখান থেকে হাঁটা।
ইতিমধ্যে যতটা শহরের দৃশ্য চোখে পড়েছে, তাতে বুঝতে পেরেছি জায়গাটার নিজস্ব একটা মেজাজ আছে। রাইন নদী বয়ে গেছে খানিক দূর দিয়ে, নদীর অনেকগুলো শাখা চলে গেছে স্ট্রাসবুর্গের মধ্যে দিয়ে। শহরের 'ওল্ড টাউন' বা কেন্দ্রে এই নদীর শাখাগুলো কাটাকুটি করে এগিয়ে গেছে, কিন্তু ব্রূগ্স অথবা অ্যামস্টারডামের চেয়ে আমেজটা একেবারেই আলাদা। ট্রামে করে আসতে আসতে চোখে পড়েছে একটা গির্জা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, সুন্দর রাস্তাপাট।
আবার সুন্দর? আমার দেখছি শিক্ষা হয় না! মহা মুশকিল! কিন্তু কী করব, ইউরোপের শতকরা নিরানব্বই ভাগ অঞ্চলই তো সুন্দর। গ্রাম হোক অথবা জনপদ, অথবা কসমোপলিটান কোনও শহর। শুধু সুন্দর বললে কিছুই বোঝা যায় না, প্রতিটা জায়গাই স্বতন্ত্র ভাবে সৌন্দর্যের চরিত্র রক্ষা করেছে। বাংলা ভাষার জ্ঞ্যানও খুব সীমিত, তাই বারবার 'সুন্দর' শব্দের পুনরাবৃত্তি। একঘেয়ে মনে হতেই পারে। আবার না বলেও পারা যায় না।
কেভিন বাড়িতে ছিল না। তার বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা, অতএব অপেক্ষা করতে হল। বাড়ির পিছন দিকেই নদীর একটা প্রশস্ত ধারা বয়ে গেছে। ভারী মনোরম জায়গা। কিছুক্ষণ পর কেভিন এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। মাঝারি অ্যাপার্টমেন্ট কিন্তু বেশ গুছোনো। কেভিন আসলে ইরানের বাসিন্দা, বেশ কয়েক বছর ধরে ফ্রান্সে বসবাস করছে। সে গাড়ির ব্যবসা করে এখানে।
কথার ফাঁকে জিগ্গেস করলাম, “তুমি কি ফ্রেঞ্চ বলতে পারো? ভাষা না জানলে ব্যবসা করা তো কঠিন।”
কেভিন বলল, “সেটা ঠিক, আমি ফ্রেঞ্চ খুব একটা ভালো বলতে পারি না। মোটামুটি কাজ চলে যায় আর কি! তবে জার্মান খানিকটা পারি, বেশিরভাগ গ্রাহকই তো জার্মানি অথবা সুইটজারল্যান্ড থেকে যোগাযোগ করে। সীমানা তো খুব দূরে নয় এখান থেকে।”
সীমানা যে খুব কাছেই, সেটা আমরাও জানি। জার্মানরা বহুদিন এই অঞ্চল অধিকার করে ছিল, আলসেস-লোরেন বলে খ্যাত এই অঞ্চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও বার বার যুদ্ধ হয়েছে ফরাসি আর জার্মান সৈন্যদের মধ্যে। জার্মানির সীমানা দিয়ে আল্পস পর্বতমালা চলে গেছে, সেই জন্যে লড়াইয়ের বারো আনাই হয়েছিল বরফ ঢাকা পাহাড়ের ওপর। চড়াই ভেঙ্গে দশ হাজার ফুটের ওপরের পাহাড়চূড়ায় যুদ্ধ করার জন্যে বিশেষ সেনা ইউনিট গঠন করেছিল ফ্রান্স, যাদের পোশাকি নাম ছিল 'ব্লু ডেভিলস'। তাদের কেউ স্কি করতে পারদর্শী, কেউ স্নোফ্লেয়ার বোমা তৈরি করতে ওস্তাদ। তাতেও সুবিধে হয়নি, প্রথমদিকে জার্মান সৈন্যরা অসম্ভব দক্ষতায় হার্টসম্যানউইলারকোফের শৃঙ্গ অধিকার করে নেয়। 'মাউন্টেন কম্ব্যাট’ অর্থাৎ পাহাড়ের যুদ্ধে উচ্চতায় থাকা সৈন্যের স্বাভাবিক কারণেই সুবিধে থাকে, তাদের পরাজিত করা কঠিন।
১৯১৫ সালে ফরাসিরা বেপরোয়া হয়ে একের পর এক আর্টিলারী ফায়ার করতে থাকে পাহাড়ের মাথায়। আল্পসের ঘন সবুজ অরণ্য মুছে গাছেদের গোরস্থানে পরিণত হয় সারা অঞ্চল। এর মধ্যেই চড়াই করতে শুরু করে দিয়েছে ব্লু ডেভিলসরা। জোসেফ বেলমন্টের নেতৃত্ত্বে একসময় তারা হার্টসম্যানউইলারকোফ অধিকার করে ঠিকই কিন্তু সেই সাফল্য বেশিদিন টেকেনি। বরফ খুঁড়ে বাঙ্কার তৈরি করে সাপ্লাই লাইনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দিনের পর দিন কাটতে থাকে, কিন্তু অত বরফে কিছুতেই জিনিসপত্র আসতে পারছে না। কয়েকজন অনুসন্ধান করতে গিয়ে বরফের ঝড়ে প্রাণ খোয়ায়। একসময় ব্লু ডেভিলস এর অবশিষ্ট সৈন্যরা জার্মানিদের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত জার্মানির সেনার অধিকারে ছিল এই অঞ্চল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল এবং আমেরিকার হস্তক্ষেপে যখন যুদ্ধে জার্মানি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, আলসেস লোরেন অঞ্চল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় তারা।
ফ্রান্সের অংশ হয়ে গেলেও দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এখানকার মানুষজনের জীবনযাত্রায় জার্মানির ভাষা ও সংস্কৃতির যে প্রভাব পড়েছিল, সেটা একইরকম রয়ে গেছে। আধুনিক যুগে জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়েছে, বিশেষ করে আলসেস অঞ্চলে জার্মান ভাষা না জানা থাকে কাজকর্মে বিস্তর অসুবিধে হয়। মাঝে এখানকার স্কুল কলেজে জার্মান ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা ছিল না, কয়েকবছর ধরে ব্যবসায় জার্মানভাষীদের চাহিদা দেখে আবার জার্মান শেখানো শুরু করা হয়েছে।
ভেবেছিলাম কেভিনের সঙ্গে খানিক গল্প করে গির্জার দিকটা ঘুরে আসব, কিন্তু সেই আশায় ছাই দিয়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। আমাদের কাছে ছাতা আছে কিন্তু বৃষ্টির তেজের সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে দেখে সেই পরিকল্পনা ভুলে যেতে হল। ইউরোপে আসা পর্যন্ত বৃষ্টির এই রূপ দেখিনি। বৃষ্টির এমন শব্দ হচ্ছে যেন কোটি কোটি আর্টিলারি চার্জ করা হয়েছে, সামনের গাছগুলো উপড়ে যায় আর কি? পিছনে নদী দিয়ে ভয়ঙ্কর শব্দে জল বয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ল্যাম্পশেডের কমলা আলো এসে পড়ছে বৃষ্টিধারা থেকে জন্মানো অসংখ্য প্রজাপতির ওপরে। বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণই নেই, অবিরাম বারিধারা ঝরে পড়ছে আকাশের বুক চিরে।
এমন বৃষ্টির দিনেই খিচুড়ি জমে। আমরা দেশে না থাকলে কী হবে, দেশ আমাদের মধ্যে গ্যাট হয়ে বসে আছে। কেভিন ইরানের ছেলে, রান্নাঘরে চাল ডাল মশলা তো আছেই, তার ওপর ফ্রিজ থেকে বেরোলো খাঁটি ইরান থেকে আনা এক বস্তা কিসমিস। সাধারণত হোমস্টেতে রান্নাঘরের সবকিছুই ব্যবহার করা যায়, আগপাঁচ না ভেবে একমুঠো কিসমিস তুলে নিলাম।
সেই দেখে স্প্যানিশ দিদিমণি হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, “শেষে চুরি করছিস?”
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “ব্যাকপ্যাকিংয়ে ‘বেগ-বরো-স্টিল’ বলে একটা কথা আছে, সেটা কি দয়াময়ীর জানা নেই?”
এর পর তিনি আর কোনও কথা বলেননি। নিছক মজা, কেভিন তো বলেইছে যা যা লাগবে সব ব্যবহার করে নিতে।
বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কাজ চলল। পাক্কা ভারতীয় মতে রাঁধা হল খিচুড়ি আর ডিমভাজা। খাওয়ার সময়ে ইউটিউবে চালানো হল সানডে সাসপেন্স এর রোমহর্ষক কাহিনি। মনে মনে বললাম, “ভগওয়ান যব দেতা হ্যায় সেনোরিতা, ছাপ্পর ফাড় কে দেতা হ্যায়।”
যে সব চেনাজানা শহরে ভর্তি চাইনিজ টুরিস্ট দেখা যায়, স্ট্রাসবুর্গ সেরকম জায়গা নয়। কয়েক বছর ধরে 'ওয়ার্ল্ড ক্রিসমাস ক্যাপিটাল' বলে নাম করেছে ঠিকই, বড়দিনের সময়ে শহর জুড়ে উৎসব হয়। কিন্তু বড়দিনের মেলায় নানা দেশ থেকে লোকজন এলেও অন্যসময়ে ইউরোপিয়ান ছাড়া অন্য দেশের মানুষ বড় একটা থাকে না। কাছেপিঠে অবশ্য প্রচুর ইন্টারেস্টিং জায়গা আছে। জার্মানি, ফ্রান্স এবং সুইটজারল্যান্ডের সীমানার কাছাকাছি হওয়ার দরুণ এখান থেকে বহু জায়গায় যাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রধান হল আলসেসের স্বপ্ন নগরী কোলমার, জার্মানির রহস্যময় ব্ল্যাক ফরেস্ট এবং বাদেন-বাদেন শহর। এছাড়াও বহু মন ভালো করে ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর জনপদ, প্রাসাদ, অরণ্য ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে, গাড়ি নিয়ে বেরোলেই প্রকৃতির শোভা দেখে মন ভালো হয়ে যায়।
কেভিনের সঙ্গে কথা বলে একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছে। আমরা ব্যাকপ্যাকিং করতে এসেছি, গাড়ি নেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। কিন্তু এটাও ঠিক যে কয়েকজন মিলে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভ করলে অনেক ছোট ছোট গ্রামে রাত্রিবাস করা যায়, যেখানে খুশি সেখানে নেমে পড়া যায়। প্রধান রাজপথ থেকে অনেকটা ভিতর ভিতর গিয়ে দেশের গ্রাম আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাসিন্দারা গাড়ি নিয়ে অনাযাসে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যেতে পারে, উইকেন্ডে অনেকেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
২) পরের দিন সকালে স্ট্রাসবুর্গের ওল্ড টাউনটা ঘুরে দেখব ভেবেই রেখেছিলাম। কেভিন আমাদের তার বাড়িতেই ব্রেকফাস্ট করতে বলেছে, নানা রকম ব্রেড, মারম্যালেড, জেলি, মধু, মুসেলি ইত্যাদি সাজিয়ে রেখেছে টেবিলের ওপরে। বেশ ভালই খাওয়াদাওয়া হল। কেভিনকে বিদায় জানিয়ে, তার দেওয়া ম্যাপ সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
অবজারভেটারি স্টেশন থেকে ট্রামে করে ওল্ড টাউনের কেন্দ্রে আসতে মিনিট পনেরো মতন লাগে। ছিমছাম বাড়িঘর, শৌখিন দোকানপাট, সকালের কফির আসর তখনও শেষ হয়নি ক্যাফেগুলোয়। আমরা সকালের নরম রোদ পিঠে নিয়ে হেঁটে চললাম।
এই অঞ্চলের বাড়িঘরের বিশেষত্ব হল বাঁশের কাজ। বারোক শৈলীর খানিকটা প্রভাব আছে ঠিকই, কিন্তু হালকা রঙের বাড়ি রংবেরঙের জানলার ওপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে চলে গেছে চকলেট রঙের বাঁশের নকশা, দেখে মনে হয় জ্যামিতিক নকশা করা হয়েছে হলুদ বা গোলাপির ওপর চকলেট রঙ দিয়ে। এই বিশেষ ধরনের বাঁশের কাজের প্রচলিত নাম হল 'হাফ টিম্বারিং'। বাঁশের আড়াআড়ি তক্তা দিয়ে টিম্বার ফ্রেমের আদল গড়ে তোলা হয়, তাতে দুটো বাঁশের কাঠামোর মাঝের ফাঁক স্থাপত্যকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে।
আমরা গির্জার দিকে এগোচ্ছি পায়ে পায়ে। স্ট্রাসবুর্গের গির্জার ইউরোপ জোড়া নাম, কিন্তু আমাদের মনে একটা দোনামনা ভাব। গির্জা বড় কম দেখিনি এই সফরে, সেভিয়া গ্রানাদা প্যারিস নানা জায়গায় গির্জা দেখে দেখে স্থাপত্যের মান সম্পর্কে একটা ধারণা হয়েছে। বহুবার বিস্মিত হয়েছি, আবার কয়েকটা গির্জা দেখে আহামরি তেমন কিছু মনে হয়নি। স্ট্রাসবুর্গের গির্জার বিশেষত্বটা কী?
অবশেষে সংকীর্ণ গলি দিয়ে এঁকে বেঁকে গির্জার সামনে উপস্থিত হলাম। পরমুহুর্তেই মুগ্ধতায় প্রায় মিনিটখানেকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ৪৬৬ ফুট উচ্চতার এই বিস্ময়কারী স্থাপত্যের অলঙ্করণ এত সুক্ষ্ম ও নান্দনিক যে প্রথম দৃষ্টিতেই এই গির্জার আবেশবন্ধনে জড়িয়ে পড়তে হয়। গির্জার তিনটি 'ফ্যাসাড' অর্থাৎ প্রধান দরজা আছে তিন দিকে, প্রত্যেকটা দিকেই অসম্ভব সুন্দর 'রোমান্সক' শৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে সাজিয়ে তোলা হয়েছে গির্জার ভিন্ন ভিন্ন অংশ। সবচেয়ে উঁচুতে দৃশ্যমান মিনারের রঙিন জানলায় আলোর খেলা নিচে থেকেই অনুভব করা যাচ্ছে। পৃথিবীর ষষ্ঠ সর্বোচ্চ এই গির্জা সম্পর্কে বিস্ময় ব্যক্ত করে গেছেন ভিক্টর হিউগো থেকে গোয়েথ। কয়েক শতাব্দী পূর্বে যারা এই গির্জা দেখেছেন তাদের মনের অবস্থা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।যত মন দিয়ে শিল্পের খুঁটিনাটি গুলো তলিয়ে দেখি, ততই অবাক হয়ে যাই। না দেখেই আন্ডারএস্টিমেট করছিলাম বলে নিজেকেই ধমক দিলাম। এ সফরে স্ট্রাসবুর্গের গির্জা আমার কাছে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম স্থান অধিকার করল।
গির্জার সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, সেখানে অনেক ধরনের অনুষ্ঠান হয়। অনেকক্ষণ ধরে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অফিস দে তুরিজ্ম- এর কাছেই নানাবিধ মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, পাব, আইসক্রিমের দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। (রেস্তোরাঁর কথা বলব না ভেবে রেখেছি, কিন্তু তারা বাই ডিফল্ট সমস্ত জায়গায় উপস্থিত।) গলিপথ আর রাইন নদীর অসংখ্য জলপ্রণালীর সন্ধিস্থল নিয়ে নির্মিত ওল্ড টাউনের এই অঞ্চলে ছোট বড় নানা সেতুও আছে। প্রতিটাই পুষ্পশোভিত, নান্দনিক। এছাড়াও উদ্যান, পুষ্পবীথিকা, ক্যাফে আর গ্রসারি শপে সজ্জিত ফুল আর লতাপাতার বাহারে গোটা অঞ্চলটা নন্দন কাননের চেহারা ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে ভাবি, এখানে শৈশব কাটালে মন কীভাবে গড়ে ওঠে? এত সবুজ, এত খোলা জায়গা, এত সৌন্দর্য... আমি তো ছোটবেলায় একটা পার্কও পাইনি। এখানকার শিশু কিশোররা এই দৃশ্য প্রতিদিনই দেখে, তাদের চোখে মুগ্ধতার লেশমাত্র নেই। অথচ আমরা ছোট বাচ্চাদের মত লাফালাফি করছি এই শোভা দেখে। কি কাণ্ড!
বেশ খানিকক্ষণ অলিগলি টহল দিয়ে শেষে চললুম সেন্ট পল চার্চের দিকে। গালিয়া স্টেশনের কাছে নদীর একটি শাখা চলে গেছে, সেখানে একটা ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত এই প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ। এই অঞ্চলে প্রটেস্ট্যান্টদের বাহুল্য চিরকালই ছিল। মধ্যযুগে গুটেনবার্গের কাঠের ব্লক দিয়ে বই ছাপানোর পন্থা আবিষ্কার করার পর এদের অনেকেই স্ট্রাসবুর্গে সফল প্রকাশনা খুলে বসেছিল, প্রকাশনা জগতে স্ট্রাসবুর্গের একচেটিয়া অধিকার ছিল বললে খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না।
স্ট্রাসবুর্গে মেট্রো নেই, কিন্তু ট্রাম চলে সর্বত্র। ইউরোপের অনেক শহরে মেট্রো, ট্রাম, বাস সবই চলে, এই জায়গাটা তুলনাসাপেক্ষে খানিকটা ছোট বলেই হয়তো মেট্রোর দরকার পড়েনি। এখানকার জনসংখ্যাও অনেক কম। আলসেস অঞ্চলের ওয়াইন বিখ্যাত, অনেক বিত্তবান ব্যক্তিরাই 'ওয়াইন মেকিং' শিল্পে যুক্ত, তারা শহরে না থেকে ছোট ছোট গ্রামে থাকতেই ভালবাসেন।
সেন্ট পলের গথিক গির্জা দেখলে মোহিত না হয়ে উপায় নেই। স্থাপত্যের দিক থেকে এই গির্জার নামডাক থাকলেও প্রধান গির্জার সামনে সে কিছুই নয়। এখানে প্রধানত নিও গথিক শৈলীই ব্যবহার করা হয়েছে সর্বত্র। কিন্তু অবস্থানটাই এর সৌন্দর্য্য দ্বিগুণ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যবিমানের বোমায় এই গির্জার বেশ ক্ষতি হয়েছিল, পরবর্তী কালে মেরামত করে ক্ষতিগ্রস্ত চ্যাপেলটা পুনর্নির্মিত করা হয়েছে। শীতকালে যখন সারা শহর বরফের চাদরে ঢেকে যায় তখন যে এই সৌন্দর্য অতুলনীয় হয়ে উঠবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
Saint Paul Church |
European Parliament |
এলোমেলো কিছুক্ষণ ঘুরে বাস ধরলাম। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দপ্তর দেখে আসি। পাসপোর্ট দেখিয়ে ভিতরেও যাওয়া যায় কিন্তু পাসপোর্ট নিয়ে বেরোইনি। বাইরে থেকেই দেখে নিলাম যা দেখার। গ্রীষ্ম কালের রোদে রাইন নদীর শাখাগুলোতে স্কুলের ছেলেমেয়েদের কায়াকিং শেখানো হচ্ছে, অনেকে সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে, বেশ লাগে। রোদ এদিকে বেশ চড়া হয়েছে, আমরাও হাঁটাহাটি করে হাঁফিয়ে গেছি। অবশেষে ওরাংগারি পার্কে গিয়ে গাছের তলায় ঘাসের কার্পেটে বসে পড়লাম। এই উদ্যানে বহু রাজহাঁস, পেলিকান ঘোরাঘুরি করে। তাদের কয়েকটা কৌতূহলী হয়ে আমাদের একেবারে কাছে এসে পড়ছে, আবার দূরে চলে যাচ্ছে। পার্কের মধ্যেই একটা ছোট্ট চিড়িয়াখানাও আছে।
ঘন্টাখানেক জিরিয়ে উঠে পড়লাম ফের। এত রোদে ঘোরাফেরা করা যাবে না। বরং কেভিনের বাড়ি ফিরে গিয়ে চা সহযোগে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বেলা বেরোনোই ভালো। এখানে বলা দরকার যে দীর্ঘ সময় এক শহর থেকে অন্য শহরে যাত্রা করতে থাকলে মানসিক ও শারীরিক বিশ্রামও প্রয়োজন। একদিন নগর পরিদর্শনে বেরিয়ে অবিরাম বারো চোদ্দ ঘন্টা হেঁটে হেঁটে বেড়ানো সহজ, কিন্তু যদি প্রতিদিন এরকম করলে শরীর খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক। স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা বোঝার দিকে আমাদের ঝোঁক বেশি, সেইসব বুঝতে গেলে পায়ে হাঁটা ছাড়া গতি নেই। এছাড়া সুযোগ পেলেই বিভিন্ন মিট-আপ অনুষ্ঠানেও গিয়ে উপস্থিত হই, সেখানে স্থানীয় এবং ভিনদেশি...সব রকম মানুষের সঙ্গেই আড্ডা হয়।
সুপারমার্কেট থেকে কয়েকটা জিনিস কিনে বাড়ি ফিরে এলাম। বাইরে রোদের তাপে হাত পা একেবারে ঝলসে যাচ্ছে। এখান থেকে আল্পসের পাহাড় এত কাছে, শীতের সময় মাসের পর মাস সারা অঞ্চল বরফে ঢেকে যায়, কাজকর্ম বন্ধ করতে হয়। সেখানে এই বিচ্ছিরি গরম দেখলে অবাক হতে হয় বইকি।
ঘন্টা দুয়েক জিরিয়ে, চা পান করে আবার বেরিয়ে পড়া হল। বিকেল হয়ে গেছে, রোদের তাপ খানিকটা কমেছে। অন্ধকার হতে অবশ্য দেরি আছে, রাতে স্ট্রাসবুর্গ গির্জার আলোকসজ্জা না দেখলে আফসোস করতে হবে, কেভিন আমাদের বার বার বলে দিয়েছে। দশটার আগে গির্জার আলোকসজ্জা দেখা যাবে না, অতএব আমাদের রাতে ফিরতে দেরি হবে। সেই ভেবে রান্নাবান্না করে নেওয়া হয়েছে আগেই। ওল্ড টাউনে নেমে আমরা চললুম পেতিত ফ্রান্সের দিকে।
'পেতিত ফ্রান্স' স্ট্রাসবুর্গের রূপকথার চত্বর। নদীর প্রধান শাখা ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে নানা দিকে। এই ছোট ছোট খালগুলির ধারে 'হাফ টিম্বারিং' শৈলীর বহু ক্যাফে, হোমস্টে। উত্তর দিকের সবুজ খালটা ঘুরে ঘুরে চলে গেছে বহুদূর, সেখানে বোট ট্যুরে করে টুরিস্টদের নিয়ে যাওয়া হয়। এই অঞ্চলে একটা ব্যারাজ তৈরি হয়েছিল, সেই জায়গাটি আজও আছে। ব্যারাজের জলের ওপর রাতে লেজার শো হবে, অনেকে সেই অপেক্ষায় বসে আছে পাশের উদ্যানে। ব্যারাজের হ্রদের চারিধারে খেয়াবাঁধানো পথ, রামধনু সেতু। সার দিয়ে সাজানো টবে উপচে থাকা বসন্ত। অফুরন্ত বেগুনি-সাদা-হলুদ-কমলা ফুলের ওপরে পড়ন্ত সূর্যের ঘোলাটে সোনালি আলো। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সেই সোনালি আবরণে আক্রমণ করছে লাল প্রজাপতির দল। জলের ধারে ঘাসের ওপর বসে এক যুবক বেহালা বাজাচ্ছে আপন মনে। অনেকে আলো ঝলমল রেস্তোরাঁর বাইরের ওপেন এয়ার ডিনারে-পানাহারে ব্যস্ত, বাকিরা অলস সময় কাটাচ্ছে সবুজের সান্নিধ্যে।
আলো কমতে কমতে একসময় অন্ধকার নেমে এল পেতিত ফ্রান্সের ওপর। লেজার লাইটের নীল সবুজ লাল আলোর ছররা নাচানাচি করতে শুরু করেছে ব্যারাজের জলের ওপর। সাবেকি যুগের কমলা আলোর ল্যাম্প পোস্টের আলোয় গলিপথগুলো স্বপ্নের মতো মনে হয়। একসময় এগোই খালের পাশ দিয়ে। ব্যারাজের ওপর দিয়ে বাঁশের সেতু, অন্ধকার রাস্তা। মাঝে মাঝে পাব আর রেস্তোরাঁর আলো পথ দেখায়। জলের শব্দ আর জ্যোৎস্নার হাত ধরে এগিয়ে চলি।
Sunset |
গির্জার সামনে জনসমুদ্র নেমেছে। আইসক্রিমের দোকানে লম্বা লাইন। সোনালি আলোয় গির্জার স্বাভাবিক রেখাচিত্র হারিয়ে গেছে, শুধু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শিল্প। অলঙ্করণগুলো যেন অপার্থিব কোনও শক্তি এসে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছে। আলোর প্রাচুর্য্য নেই এই সজ্জায়, বরং আপাদমস্তক এক সোনালি রহস্যের মোড়কে ঘেরা এই বিশাল গির্জা। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। গির্জা চত্বরে প্রজেক্টরের আলো ফেলা হয়েছে আকাশ জুড়ে থাকা প্রকাণ্ড পর্দায়। থ্রি ডি অ্যানিমেশনের সাহায্যে দেখানো হচ্ছে গির্জার নির্মাণ।শয়ে শয়ে মানুষ মাটিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরাও শুয়ে পড়লাম সটান। মুহুর্তে হারিয়ে গেলাম আবহমান সেই ইতিহাসের স্রোতে। শেষটুকু পড়ে রইল স্মৃতির আয়নায় ...
Cathedral |
কোলমার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন