সংকীর্ণ সুঁড়িপথে আমার আবেগের অবলম্বন
উচ্চহাস্যের প্রতিধ্বনি আর শোকের ক্রন্দন
আধখোলা চোখের বিষন্নতা, অসুখে ছেয়ে চাওয়া
ঝরাপাতার ওপর দিয়ে আমার হেঁটে যাওয়া
~মরিস মেটারলিঙ্ক
১) ঝটপট জামা, জুতো ঢুকিয়ে ঘুঁসি মেরে মেরে রুকস্যাকের ভিতর বন্দী করা। তারপর জিপ টেনে রুকস্যাক পিঠে নেওয়া। কোমরের আর বুকের ওপর স্ট্র্যাপ লাগানো। পায়ে পরা জুতোর ফিতে শক্ত করে বাঁধা। গায়ে হালকা টি শার্ট। শর্টসের পকেটে মানিব্যাগ। সঙ্গের ছোট্ট ব্যাগের ভিতর পাসপোর্ট, বই, ফোন। ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে ঠিকানাগুলো বুঝে নেওয়া। তারপর তৈরি হয়ে পথে নেমে হাঁটতে শুরু করা। পিঠে ব্যাগ, চোখে চশমা। মাথার ওপর মেঘমুক্ত গ্রীষ্মের আকাশ। হাঁটা, হাঁটা, হাঁটা। এরপর মেট্রো অথবা ট্রামে করে বাস স্টেশন। আবার হাঁটা। খুঁজে বের করা নির্দিষ্ট বাসের প্ল্যাটফর্ম। তারপর একসময় রওনা দেওয়া। এই রুটিনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
প্যারিসের চার্লস দে গাউয়ে আন্তর্জাতিক বাস স্টেশন থেকে ফ্লিক্সবাস ধরে আপাতত আমরা ব্রাসেল্সের অভিমুখে। পাঁচ ঘন্টার যাত্রা। কোনও ব্যাপারই নয়। প্যারিস ছেড়ে যেতে যতটা মন খারাপ হয়েছে, সেটা ভুলে থাকতে ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসা কফিতে চুমুক দিচ্ছি। বাইরে সবুজ প্রান্তর দৃষ্টি থেকে পিছলে যাচ্ছে দ্রুত। সেইদিকে তাকিয়ে থাকলে দেখা যায় সবুজের প্রলেপ মেখে থাকা কাঠের ছিমছাম রঙিন বাড়িঘর, হাওয়াকল আর দিগন্তবিস্তার করে থাকা তৃণভূমি।
কফি খেয়েই পাশের সিট থেকে মা দুর্গা বলে উঠলেন, “হোমওয়ার্ক করেছিস?”
খাইসে! আবার কোনও হোমওয়ার্ক রে বাপ! স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে গেছি, মাথা গুঁজে পড়াশুনা করে কাঁচকলা হয়েছে। এককালে কোচিং-এ এমন হোমওয়ার্ক দিত যে সপ্তাহে একটা করে খাতা শেষ হয়ে যেত। হোমওয়ার্কের কথা শুনলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়।
“কীসের হোমওয়ার্ক?” তেড়েমেড়ে উঠে বললাম, “ফরাসি কফি খেয়ে নেশা হয়েছে বুঝি?”
শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এইবার মা দুর্গা মা কালীতে রূপান্তরিত হলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “বেটা, তুমসে না হো পাওয়েগা।”
ওমনি আমার মনে পড়ে গেল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, কয়েকটা জায়গায় বুকিং ক্যানসেল হয়ে গিয়েছিল বলে আবার নতুন জায়গা দেখতে হবে সাধ্যের মধ্যে। পাশাপাশি ব্রাসেল্সে আমাদের হোস্টের সঙ্গে কথা বলে রাখতে হবে। এ তো হোটেল নয়, আগে থেকে না বলে রাখলে সেখানে গিয়ে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। এই সব টুকিটাকি কাজই নাকি আমায় হোমওয়ার্ক দিয়েছিলেন দয়াময়ী, আমি ভুলে মেরে দেব সেই ভয় পেয়ে। যথারীতি কিছুই করা হয়নি। ‘ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’... এই বিশ্বাসেই চলি, একটা কিছু হয়ে যাবে ভেবে নিয়ে। এ যে দেখছি হান্টারবাই হয়ে আমার দফারফা করে দেবে। কিন্তু চটিয়ে লাভ নেই। বোকার মতো হেসে বললাম, “মনে পড়েছে। সব ঠিক হয়ে গেছে।” বাসে যেতে যেতে ফ্লিক্সবাসের ওয়াইফাই নিয়ে কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। কথাটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে তাঁকে আমি বেলজিয়ামের কথা বলতে শুরু করলাম। অকিঞ্চিতকর অভিজ্ঞতা হোক বা ইতিহাসের ক্র্যাশ কোর্স, এক সময়ের পর সবকিছুই ভালো লাগে।
ইউরোপের চোদ্দ আনা জমিতেই একসময় দুই জাতির বসবাস ছিল। কেল্ট আর জার্মানের পারস্পরিক যুদ্ধ ও সন্ধির যুগলবন্দীতেই গড়ে ওঠে সাম্রাজ্য, দেশ, রাজা ও রাজনীতি। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক না কেন, বর্তমান বেলজিয়ামের সুন্দর অঞ্চলটি নজর এড়িয়ে গিয়েছিল যুদ্ধবাজদের নজর থেকে। পরবর্তীকালে অবশ্য বহু যুদ্ধ আর বহিরাক্রণের ফলে এখানকার মানুষ দিশেহারা বোধ করেছে। বেলজিয়াম যখন রাষ্ট্ররূপে গড়ে ওঠে, নিজস্বতার কোনও বোধই ছিল না দেশ বাসীদের। অনেকেই ফরাসি ভাষায় কথা বলে, বাকিরা ব্যবহার করে ডাচ ভাষা।
আধুনিক যুগে গণতন্ত্র ও অর্থনীতি দুই ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে প্রায়ই ঠোকাঠুকি লেগে যায় দুই দলের মধ্যে। উত্তরে ফ্ল্যানডার অঞ্চলে ডাচদের অনুকরণে ব্যবহৃত হয় ফ্লেমিশ, দক্ষিণের মানুষরা আবার ফরাসি এবং উয়ালান ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। এছাড়াও কয়েকটা জায়গায় জার্মান ভাষা বলে থাকে মানুষজন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি দখল নিয়েছিল বেলজিয়ামের, সেই সূত্রে পূর্বের কয়েকটা জায়গায় জার্মান সংস্কৃতির প্রভাব রয়ে গেছে। প্রযুক্তিগত ও অর্থনীতির দিক থেকে ফ্ল্যানডার অঞ্চল দ্রুত গতিতে প্রভাব বিস্তার করছে, তুলনায় দক্ষিণাঞ্চল খানিকটা প্রাচীনপন্থী। রাজধানী ব্রাসেল্স আবার উত্তরে অবস্থিত হলেও সেখানে বেশিরভাগ মানুষজন কথা বলে ফরাসি ভাষায়, এই নিয়ে ছোটখাট মতবিরোধ আর বিবাদ লেগেই থাকে। ঘটনাচক্রে একই দেশে দুই দলের জন্যে দুটো সরকার, একই শহরে একাধিক মেয়র, এরকম আশ্চর্য ঘটনাও আকছার দেখা যায় বেলজিয়ামে। অদূর ভবিষ্যতে যদি পৃথক দেশের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়, খুব একটা আশ্চর্য না হওয়াই স্বাভাবিক।
ভারতীয় হিসেবে এই দ্বন্দ দেখলে আমার অবাকই লাগে। ভাষার দিক থেকে আমাদের দেশ অসম্ভব সমৃদ্ধ। শতাধিক ভাষা, বহু উপভাষা। কিন্তু শুধুমাত্র সেই জন্যেই কি বিচ্ছিন্নমত হয়েছে মানুষ? মত পার্থক্য এবং ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সামগ্রিক ভাবে দেশের মঙ্গল সবসময়েই প্রাধান্য পেয়েছে। আর এখানে এইটুকু পুঁচকে দেশ, লোকজন কম, আর্থিক স্বচ্ছলতাও আছে দিব্যি। তা সত্ত্বেও এক সূত্রে বাঁধা পড়েনি দেশবাসীরা। (হয়তো বা ফুটবল ম্যাচ হলে সেটা হয়ে থাকে) শুধুমাত্র ভাষার ব্যবধান বলেই কি একে অপরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগতে হবে?
বেলজিয়ামের সীমানাতে কোনও রক্ষীর দেখা পাওয়া গেল না। কোনও বাধা বা চেকিং ছাড়াই বাস ঢুকে গেল ফ্রান্স থেকে বেলজিয়ামে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সবুজ রঙের আধিক্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে, সঙ্গে বেড়ে চলেছে নির্জনতা। জনবসতি যা আছে, সবই দূরে দূরে, ছাড়া ছাড়া। নিরিবিলি কটেজ। দোতলা বাগানবাড়ি। একা পেট্রলপাম্প।
ব্রাসেল্সের নর্থ স্টেশনে যখন বাস এসে দাঁড়াল, বিকেল সাতটা। আকাশে আলো আছে ঠিকই কিন্তু অন্যান্য শহরের তুলনায় খানিকটা হলেও সন্ধ্যের একটা প্রচ্ছন্ন আভাস আছে। চললুম এয়ারবিএনবির দিকে। ট্রামের ডিপো থেকে ট্রাম নেওয়া হল। ট্রাম চলল শহরের মধ্যে দিয়ে।
ছবির মতো সুন্দর শহর। খয়েরি ইঁটের বাড়ি। টালির ছাদ। দেওয়ালে আঁকা কার্টুনের ছবি। মাঝে মাঝে দু’দিকে ঘন গাছের সমষ্টি অরণ্যের মতন হয়ে আছে, ট্রাম চলেছে সেই বনবীথিকার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু লোকজন কই? ব্রাসেল্স না রাজধানী? আমার ধারণা ছিল বিকেলবেলায় প্রচুর ভিড় হবে, এ তো জনমানস চোখেই পড়ছে না। নির্জন রাস্তায় একটা দুটো খালি বাস, তিন চার জন পথচারী, কয়েকটা টুং টুং করে ঘন্টি বাজিয়ে যাওয়া কিশোর কিশোরীদের সাইকেল। মনে হচ্ছে পঞ্চাশ বছর পূর্বের কোনও ইউরোপিয়ান গ্রাম। এই নির্জন সৌন্দর্যের আবেশ মন শান্ত করে দেয়, স্থিতিশীল করে যাত্রীর গতিশীল আবেগকে।
ট্রাম স্টেশন থেকে একটা পায়ে হেঁটে চলা সবুজ গলিপথ চলে গেছে। হেঁটে এগিয়ে চলেছি। সরু গলিটা এসে মিলিত হয়েছে একটা পাকা রাস্তায়। এই অঞ্চলটি হল উলে সাঁ পিয়ায়ে। চারিদিকে অজস্র গাছপালা। খেয়াল করলে দেখা যায় চৌকো অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বেশিরভাগই খয়েরি রঙের, কয়েকটি অবশ্য সাদা কালো অথবা ছাই রঙের। কাঁচের শার্শি দেওয়া চওড়া বর্গাকার জানলার সবগুলোতেই ভারী পর্দা টানা। একটা সুপারমার্কেট পড়ল। কার্রে ফ্লু। পিছনে সবুজ মাঠ। রাস্তায় গাড়ি না থাকলেও ট্রাফিক সিগনাল আছে এবং লাল আলো জ্বললে মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে অভ্যেসবশত। জেব্রাক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হয় না।
ডান দিকে একটা মুদিখানা। এপিসেলা পাল্মিওন। তার সামনে একটা পাব কাম ক্যাফে কাম রেস্তোরাঁ। এদিকে ফোনে ইন্টারনেট চলছে না ঠিক করে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সঙ্গিনীকে জিগ্গেস করলাম, “এইবার কোনদিকে?"
পরক্ষণেই পরিচিত টানে কানে এল, “মে আই হেল্প? মুখ তুলে দেখি মধ্যবযস্ক একজন ভদ্রলোক। হয়তো প্রবাসী ভারতীয়। হেসে 'নো থ্যাঙ্কস' বলতে যাব ততক্ষণে আমাদের অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “বাঙালি তো? কোনও ঠিকানা খুঁজতাছেন?"
বহুদিন পর অপরিচিত দেশে অপরিচিত মানুষের মুখে মাতৃভাষা শুনলে যে প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনের ভাব কীরকম হয় সেটা বোঝানো কঠিন! কানে মনে হল মধু ঢালল কেউ। ততক্ষণে সঙ্গিনীর কাছ থেকে ঠিকানা শুনে ভদ্রলোক ঠিক পথ বাতলে দিয়েছেন। ডানদিকে যেতে হবে। কাছেই। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। হানিফ ভাই। বাংলাদেশের সন্তান। প্রবাসে প্রায় তিরিশ বছর। আমাদের কাছে পেয়ে মহা খুশি। বার বার করে বললেন, জিনিসপত্র রেখে যেন চলে আসি। গল্প হবে। আমরাও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
আগে থেকে বুক করে রাখা এয়ার বিএনবির হোমস্টেতে পৌঁছে আলাপ হল হার্মিয়নির সঙ্গে। বেশ হাসিখুশি, মিশুকে মেয়ে। তার বাড়িটাও বিশাল। আমাদের ঘর এবং রান্নাঘর দেখিয়ে দিয়েছে সে, বুঝিয়ে দিয়েছে ব্রাসেল্সের দরকারি তথ্য। ম্যাপ, বই, নোট সব যত্ন করে রেখে দিয়েছে ঘরের টেবিলে। হার্মিয়নি পশ্চিম আফ্রিকান বংশোদদ্ভুত, ছেলেবেলা আফ্রিকার বেনিনে কাটলেও বহুবছর সে বেলজিয়ামেই আছে। তার বাবা কনস্যুলেটে ছিলেন, ছোটবেলা থেকেই ফ্রেঞ্চ বলতে পারে গড়গড় করে। আপাতত সে ব্যাঙ্কে চাকরি করার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষার ক্লাস নেয়, সঙ্গে আফ্রিকা থেকে ইমিটেশনের গয়না এবং অন্যান্য হস্তশিল্প এনে একটা ছোট্ট ব্যবসাও করে। এছাড়াও একটা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সারাক্ষণই সে ব্যস্ত, যদিও তার মুখের হাসি দেখলে সেটা বোঝার উপায় নেই। আফ্রিকান মূলের মানুষদের বয়স বুঝতে খানিকটা অসুবিধে হয়, তবে আন্দাজ করলাম সে বয়সে আমাদের চেয়ে বছর দুই তিন বেশি হতে পারে। আমরা জিনিসপত্র রেখে ঘাড়ে গলায় জল দিয়ে হাঁটতে বেরোনোর সময়েও দেখলাম হার্মিয়নি কাজ করছে। তার অ্যাপার্টমেন্টর তালা খোলাটা একটু চাপের, কাজ ছেড়ে উঠে সে আমাদের চাবি খোলাটা শিখিয়ে দিল।
বাইরে এসে আকাশের রঙ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। সোনারঙা জামার ওপরে কমলা শাল মুড়ি দিয়ে বসে আছে আকাশ আর সন্ধ্যাগ্নির শিখায় পুড়িয়ে ফেলছে একের পর এক চোখ কাড়াকাড়ি করে লেখা প্রেমের চিঠি। ক্যাফেতে সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে। কফিকাপ আর বেলজিয়ামের বিখ্যাত বিয়ারের গ্লাস ওঠানামা করছে মুহুর্মুহু। গল্পচ্ছল। অচেনা পরিখায় চেনা আমেজের আড্ডা।
হানিফ ভাইয়ের দোকানে আসতেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। কোল্ডড্রিংক, বিয়ার, জুস কিছু একটা না খাইয়ে ছাড়বেন না। শেষে তুলে নিলাম ঠান্ডা পানীয়ের একটা বোতল। রান্নার জন্যে কেনা জিনিসপত্র। দাম নিতে চান না কিছুতেই, প্রায় কুড়ি ইউরোর জিনিস দিয়ে দিলেন পাঁচ ইউরোতে। ঢাকায় তাঁর তিনতলা বাড়ি, দুই মেয়ে, স্ত্রী আছে। মেয়ে দুটো স্কুলে পড়ে। ছবি দেখালেন। কিন্তু দেশে থাকতে পারেন না হানিফ ভাই। তিরিশ বত্রিশ বছর আগে এসেছিলেন ইউরোপে ব্যবসা করবেন বলে, জীবনে নানা ধরনের ব্যবসা করেছেন। চাকরিও করেছেন একসময়। অভিজ্ঞতার ঝুলি উপচে পড়ছে। সব দেশ ঘোরা। ইতালি, জার্মানি, লিচেন্সটাইন। ইউরোপের জীবনযাত্রার অভ্যেস। একা থাকেন একটা অ্যাপার্টমেন্টে যদিও বন্ধু প্রচুর। সকলেই তাঁকে চেনে, দোস্তিও আছে।
দুজন ছেলে সিগারেট নিতে এল দোকানে। সিগারেট দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সঙ্গে। জিগ্গেস করলেন, “কতদিন থাকবে?"
আমি বললাম, "ওই দু’ আড়াই দিন। তারপর আবার পথে।”
মনে মনে হিসেব করে বললেন, “দেখি কবে তোমাদের খাওয়াতে পারি? সকালের দিকে জিনিসপত্র আনতে যাই। একটা ছেলে দোকানে বসে সকালে। বিকেলের দিকে আমি বসি। সময় করে তোমাদের জানিয়ে দেব।”
সঙ্গিনী ব্যস্ত হয়ে বললেন, “না না। কোনও দরকার নেই। আপনাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না।” সে কথা আমলই দিলেন না হানিফ ভাই। দেশের কথা বলছেন তোড়ে, কুড়ি বছর আগেরকার ইউরোপের কথা। আমাদের জিগ্গেস করলেন, “ইউরোপে থাকতে ইচ্ছে করে না? এত সুন্দর সুন্দর জায়গা, পরিচ্ছন্ন শহর, আমুদে লোকজন।”
এই উত্তর আগেও দিতে হয়েছে কয়েকবার। সঙ্গিনী ফস করে বলে ফেললেন, “কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, বড়জোর কয়েক বছর ঠিক আছে। তার থেকে বেশি আমি কাটাতে পারব না। নিজের দেশই আমার ভালো। আমার অত ঠান্ডা পোষায় না।”
হানিফ ভাই হেসে বললেন, “আমাদের দেশের সঙ্গে কি এদের তুলনা? যৌবনে আমোদ করে বেড়ায় বেশিরভাগ লোক, বয়সকালে এরা একা একা থাকে। বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টে একজন করে মানুষ। দেখছ না কেমন নির্জন শহর? ঢাকাতে গেলে এদের পিলে চমকে যাবে। নিজের দেশে থাকার মতন আর কিছু হয় না।”
"তাহলে আপনি এখানে পড়ে আছেন কেন? ফিরে গেলেই তো পারেন। মেয়ে বড় হচ্ছে, তার সঙ্গে থাকবেন।” আমি না জিগ্গেস করে পারলাম না।
হানিফ ভাই বললেন, “চেষ্টা কি করিনি ভাই? ঢাকা গিয়ে বছর দুয়েক ছিলাম। ব্যবসা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখানকার স্বভাব। এত বছর ধরে নানা দেশে কাজ করেছি, ওখানে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারব কেন? এখানে দোকান ছেড়ে চলে গেলেও লোকে একটা জিনিসেও হাত দেবে না। লোক ঠকানোর স্বভাব নেই বললেই চলে, কিন্তু বাংলাদেশে ভালো মানুষ যেমন আছে, বদ মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারিনি। যত না উপার্জন হয়েছে, তার চেয়ে খুইয়েছি বেশি। আমার খরচের হাত। শেষে ফিরতে বাধ্য হলাম।”
প্রায় ঘন্টাখানেক গল্প করলাম হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে। কাল একসঙ্গে কফি খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার পরিকল্পনা করে আমরা হার্মিয়নির বাড়িতে ফিরে এলাম।
রাত্রে খাওয়ার জোগাড় করতে গিয়ে দেখি কিনে রাখা বাগেত রুটিগুলো খারাপ হয়ে গেছে। সবজির স্যুপের সঙ্গে বাগেত খেয়ে কাজ চালানোর কথা ভাবা হয়েছিল, সেই আশায় ছাই পড়ল। খানিকটা ভাতেভাত ফুটোনো হয়েছে বটে কিন্তু তাতে দুজনের কুলোবে না। শেষে হার্মিয়নি এসে বেলজিয়ান পাউরুটি দিয়ে আমাদের উদ্ধার করল। খাওয়াদাওয়ার পর হার্মিয়নির সঙ্গে গল্পগুজব করে যখন শুতে গেলাম বেশ রাত হয়েছে।
২) পরের দিন নগর পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়তে অবশ্য দেরি হয়নি। ব্রাসেল্সের প্রধান দর্শনীয় স্থান-এর কেন্দ্র অথবা সিটি সেন্টার। যাবতীয় শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সেইখানে, সঙ্গে যোগ দিয়েছে এখানকার নামকরা চকলেট, ওয়েফল আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দোকান। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে এখানকার মানুষের আদিখ্যেতা আছে, সেটা দেখলে আমাদের হাসিই পায়। আলুর কুড়মুড়ে ঝুরিভাজা খেলে বেচারাদের যে কী অবস্থা হবে? আলুভাজা নিয়ে এরকম উন্মাদনা ভাবাই যায় না। বড় বড় কাট আউটে আলুভাজা মুচকি হাসছে, আলুভাজার মিউজিয়াম, হেরিটেজ রেস্তোরাঁ, কী নেই? আলুভাজার দোকানের বহর দেখে নিরামিশ মানুষেরা আকৃষ্ট হতে পারে, তাদের জেনে রাখা ভালো সব দোকানেই ভাজার জন্যে খাঁটি চর্বি অর্থাৎ বিফ অয়েলের ব্যবহার করা হয়।
বেলজিয়ামের অন্যান্য শহরের চেয়ে ব্রাসেল্স পর্যটনের দিক থেকে পিছিয়েই আছে বলা চলে। বিংশ শতাব্দীতে অনেক প্রাচীন নির্মাণ ভেঙে আধুনিক ধাঁচের বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছিল, তুলনায় ঘেন্ট, অ্যান্টওয়ার্প, ব্রূগস প্রাচীন ঐতিহ্যকে পরম যত্নে সংরক্ষিত করেছে। তা সত্ত্বেও টুরিস্টের সংখ্যা বড় কম নয়, তার একটা প্রধান কারণ হল এখানকার বিয়ার। বেলজিয়ান বিয়ারের জগৎজোড়া নাম, প্রায় চার হাজার রকমের বিয়ার তৈরি হয় বেলজিয়ামের ভাঁটিখানা বা ব্রিউয়ারিতে। তার অনেকগুলোই ব্রাসেল্সে অবস্থিত। আমাদের স্যান্ডম্যান ওয়াকিং ট্যুরের ছোকরা গাইড টম বিয়ার সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছিল, “বেলজিয়ামে অনেক মানুষ সারা জীবন জলই খায়নি। তুমি যদি বিয়ার পছন্দ না কর, তাহলে বাস্তবে তুমি তোমার জন্যে নির্দিষ্ট বিয়ারটা খুঁজে পাওনি। মনুষ্যজন্মে কোনও ব্যক্তি বিয়ার অপছন্দ করতে পারে সেটা আমরা মানি না। তবে ভাবনা কীসের? ব্রাসেল্সে এসে গেছ, এবার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট বিয়ারটা খুঁজে বের করো দেখি!"
টমের সঙ্গে দেখা হয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে সেন্ট্রাল স্কোয়ারে। এখানেই অবস্থিত এখানকার বিখ্যাত গ্র্যান্ড প্যালেস বা গ্রতে মার্কট। বহু প্রাচীন এই স্কোয়ার, এর চারদিক ঘিরে আছে ব্রাসেল্সের টাউন হল, সিটি মিউজিয়াম আর রাজাদের বসবাসের জন্যে করা 'ব্রেডহাউস' অর্থাৎ রাজভবনের বিস্ময়কারী নির্মাণ। আক্রমণকারীদের হাতে পড়ে যে কতবার এই স্কোয়ার তছনছ হয়েছে আর আবার নতুন করে নির্মিত হয়েছে, তার কোনও শেষ নেই। এই স্কোয়ারের লাগোয়া গলিতে আগে ক্রয় বিক্রয় হত ফুল, কয়লা, পাউঁরুটি ইত্যাদি। রাস্তাগুলোর নামও দেওয়া হয়েছিল সেই নামেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জার্মানরা বেলজিয়াম অধিকার করে, আহত সৈনিক এবং উদ্বাস্তুদের চিকিৎসার জন্যে টাউন হলকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল সামরিক হাসপাতালে।
জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর আর মনোগ্রাহী। গথিক আর বারোক শৈলীর মিশেলে তৈরি স্থাপত্যের সোনালি বাহার চোখ ঝলসে দেয়। এখানকার টাউন হলটায় আবার ভারসাম্যের একটা অভাব আছে, পরিকল্পনা মতো জায়গা না পেয়ে আসল নির্মাণের নকশা বাস্তবায়িত করা যায়নি। ফলে প্রধান মিনারের বাঁদিকে আর ডানদিকের তোরণের সংখায় তফাৎ আছে যথেষ্ট। ইদানীং কালে এই স্কোয়ার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তো হয়েছেই, তাছাড়াও ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর স্কোয়ারের একটা বলে বিবেচিত হয়েছে নানা প্রতিযোগিতায়। একেক সময় সারা স্কোয়ার ঢেকে দেওয়া হয় রঙবেরঙের বেগুনিয়া ফুলের গালচে দিয়ে, সেই ছবিটা কল্পনা করেই রোমাঞ্চিত হতে হয়।
রুয়ে দে এতুভের গলি দিয়ে হাঁটছি। সরু গলির দুপাশের বাড়িগুলো সবই তিন চার তলা উঁচু, কোনো কোনোটায় আধুনিকতার ছাপ লক্ষ করা যায়। বেশিরভাগই পুরোনো, খয়েরি ইঁটের গাঁথুনি দেওয়া দেওয়াল। অনেক বাড়িতে নিচের তলায় ব্যাঙ্ক, দোকান অথবা কফিশপ গজিয়ে উঠেছে। দু’পাশের চকোলেট আর ওয়েফেলের সৌরভ। সামনে একটা ইয়াবড় লিকার শপ পড়ল। টম মহানন্দে আমাদের চেনাতে লাগল বিয়ারগুলো। স্টাউট বিয়ার, ওয়ালুনিয়ান বুশ বিয়ার, ট্র্যাপড বিয়ার, লাল বিয়ার, সাদা বিয়ার, আরো কতো কী...একেই চকোলেট, কেক, ফ্রাই, ওয়েফেলের গন্ধে মন মাতোয়ারা হয়ে আছে, তারপর এমন বিয়ার পুরাণ শুনে আমাদের পুরো আক্কেল গুড়ুম। মনে মনে ভাবি, এদের কোলেস্ট্রল-টল বাড়ে না নাকি? স্বাস্থ্যসচেতনার নামে দৌড়ঝাঁপ অবশ্য কম করে না, কিন্তু খাবারের দিক থেকে দেখতে গেলে তো কার্ব, সুগার আর ফ্যাটের আধিক্যই দেখলাম। কিন্তু দেখেশুনে তো এদের বেশ স্বাস্থ্যবান বলেই মনে হয়। পরে বুঝেছিলাম, ইউরোপের সাধারণ মানুষ এইসব মোটেও খায় না। যেটুকু খায়, তার পুরোটাই ঝরিয়ে দেয় ছুটোছুটি করে। যে কোনো ইউরোপিয়ান ছেলেমেয়ে বয়সকালে ভারতীয়দের থেকে ফিটনেসে শত যোজন এগিয়ে থাকবে। ব্যতিক্রম বাদে এটাই সত্যি, শুনতে যত খারাপই লাগুক না কেন?
"তোমাদের জন্যে একটা ধাঁধা আছে। বলতে পারলে ব্রাউনি পয়েন্ট পাবে। বল তো ব্রাসেল্সে সবচেয়ে বেশি লোকে কী দেখতে আসে?" টমের কথা শুনে আমি মনে মনে হাসলাম। আমার এইটা খুব ভালোই জানা আছে, বলা যেতে পারে আমাদের আগমনের কারণও একই। ততক্ষণে লোকে আন্দাজের তুবড়ি মারতে শুরু করেছে।
"প্যালেস অফ জাস্টিস? না, হল না। ম্যানেকুইন পিস...ওহ ভুলে যাও...কী বললে...বিয়ার খেতে..কী সাংঘাতিক ছেলে বাবা তুমি...সারাক্ষণ মনে মনে ওই কথাই চলছে...ফ্রেঞ্চ ফ্রাই? হাহাহা...বুদ্ধিটাই ভাজা হয়ে গেছে দেখছি..." কেউই বলেনি দেখে আমিই আগ বাড়িয়ে বলে দিলাম, “কমিক স্ট্রিপ রুট আর টিনটিন।”
"এই তো।” টম খোশমেজাজে বলে উঠলো, “ইক্কেবারে ঠিক। টিনটিন ছাড়া ব্রাসেল্স অসম্পূর্ণ। আমার বাবাকে পর্যন্ত একসময় টিনটিনের প্রমাণ সাইজের মূর্তি নিয়ে পাগলামি করতে দেখেছি। পঞ্চাশ বছর বয়সে ওর কমিক্স পড়ার ধুম দেখে সত্যি বলতে আমিই লজ্জা পেয়ে যেতাম। আর এই যে তোমাদের সামনেই কমিক স্ট্রিপ রুটের সবচাইতে জনপ্রিয় ছবি..."
সামনেই দেওয়ালের ওপর মহানন্দে বিরাজ করছে আমাদের প্রিয় ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর টিনটিন। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে দেওয়ালের ওপর থেকে। বিংশ শতাব্দীতেই বেলজিয়াম সারা দুনিয়ার কমিক্স চাহিদাদের পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে, তার প্রধান শ্রেয়ই হার্জের ( হ্যাঁ, আসলে অ্যার্জে সেটা জানি। তবে হার্জ বললেও কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে আর?) চরিত্র টিনটিন আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের। টিনটিন ছাড়াও বেলজিয়ামের কমিক্স জগৎ থেকে নানান চরিত্র এসে মন জয় করে নেয় পাঠকদের। সারা ব্রাসেল্স শহর জুড়ে থাকা দেওয়ালের মুরালে কমিকসের চরিত্ররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এদের নিয়ে তৈরি হয়েছে কমিক স্ট্রিপ রুট। অনেকেই শুধুমাত্র মুরালের ছবি দেখতে আর ছবি তুলতেই একদিন থেকে যায় ব্রাসেল্সে। অনেকে আবার টিনটিনের মিউজিয়ামেও উঁকি মারে।
টমের সঙ্গে গল্প করতে করতে তাকে জিগ্গেস করে ফেললাম এখানকার জগাখিচুড়ি রাজনৈতিক অবস্থার কথা। জিওপলিটিক্স নিয়ে আমার খানিকটা আগ্রহ আছে। ফিচেল হেসে বললাম, “কিছু মনে কোরো না। বেলজিয়ামের রাজনীতিতেও কার্টুন চলছে বলে যে একটা গুজব আছে সেটা নিয়ে তোমার কী ধারণা?" ছেলে হয়তো রেগেও যেতে পারে, এই ভেবে একটু আশঙ্কিতই ছিলাম। ওমা! টম বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলল, “বিয়েন সুর। অবশ্যই। আমাদের সংস্কৃতিটাই কার্টুন। ভালো ভাষায় বলতে গেলে আমুদে। তবে কিনা ওই রাজনীতির খেলা আর বিবাদ কয়েকজন ধান্ধাবাজ নেতারাই করে থাকে। সাধারণ মানুষেরা দিব্যি বই পড়ছে, বিয়ার আর ফ্রাই খাচ্ছে, অলস জীবন কাটাচ্ছে মজা করে। সেই জন্যেই দেখবে আমাদের নিয়ে অনেকেই মজা করে। আমরা কোনও দলেই নেই। পাগল ফরাসি আর ডাচরা যুদ্ধ আর ব্যবসা করে মরুকগে যাক, আমরা মস্তি করেই খুশি। এইজন্যেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাজধানী করা হয়েছিল ব্রাসেল্সকে।”
আমি চোখ টিপে বললাম, “বটে? অতই যদি শান্তিপ্রিয় দেশ তাহলে কঙ্গোর ওপরে অধিকার করতে গিয়েছিল কেন? স্টেট অফ কঙ্গোতে লক্ষ লক্ষ যে মানুষ মারা গেছে বেলজিয়ামের উপনিবেশ করার সময়ে..."
টম সঙ্গে সঙ্গে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “সেটা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। ওই পাগলা রাজা লিওপোল্ড দ্বিতীয় কঙ্গোতে উপনিবেশ করতে চাননি, সেখান থেকে হাতির দাঁত ও মূল্যবান ধনসম্পদ লুট করে আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। দেশটাকে পৈত্রিক ব্যবসার মতো করে চালিয়েছেন। আধুনিক যুগে তুমি দেখো, কত ভালো ভালো ফরাসি আর ডাচ সাহিত্য বেরিয়েছে এখানের লেখকদের হাত থেকে, ডোমিনিক পিরে শান্তির জন্যে নোবেল পেয়েছিলেন। কিন্তু পৃথিবীর লোকে আর কতজনের কথা জেনেছে?"
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, “সেটা ঠিক বলা যায় না। বহু মানুষ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। অ্যানে মাগ্রিত সুরিয়ালিস্ট শিল্পী হিসেবে খুব বিখ্যাত, জর্জ সিমোনের ভক্ত তো সারা পৃথিবীতে, ভিকটর হোরতার কথাও সকলেই জানে। হার্জের কথা তো ছেড়েই দিলাম। মরিস মেটারলিঙ্ক নোবেল পেয়েছিলেন। নায়িকা অড্রে হেপবর্ন, নায়ক জিন ক্লদ ভ্যান ড্যাম। আরো অনেকেই হয়তো আছেন, আমি নিজেও সকলের কথা জানি না।”
টম মুচকি হেসে বলল, “এদের অনেকেই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন দেশের বাইরে। বহু মানুষ আছে যাঁরা সারা জীবন বেলজিয়ামে থেকে সাহিত্য, শিল্প, অর্থনীতি, ইতিহাস নানা ক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন। সুরিয়ালিস্ট আন্দোলনের প্রভাব যতটা না প্যারিসে হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া ফেলেছিল এখানে। ১৯২৪ সালে আন্দ্রে ব্রেঁতো যখন সুরিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো ছাপান, সেই বছরেই অ্যানে মাগ্রিত একই ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ক্যামিল গোয়েম্যান্স, মাসেল লুকোম্ত, পঁল লুঁজেরা যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের শিল্পীরা সুরিয়ালিস্ট কাজ করে গেছেন কাউকে না বলে। স্প্যানিশ শিল্পীদের মতন করে ঢাকঢোল না পিটিয়ে। হয়তো জানো না, ব্রাসেল্সকে সুরিয়ালিস্ট শহরের পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে। দুই পিটার, অর্থাৎ পিটার ব্রুগেল থেকে শুরু করে এখনকার পিটার ক্রুগাল, প্রায় পাঁচশ বছরের অন্তর। কেউ তাঁদের চেনে না, কিন্তু একবার তাঁদের কাজ দেখলে লোকে ফিরে ফিরে আসে। তারপর ধরো সিনেমা! ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা নিয়ে প্রায় একটা বিপ্লব চলছে এখানে। পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট থিয়েটার খোলা হয়েছে তাদের জন্যে, একগাদা ফিল্ম স্কুল চলছে রমরমিয়ে। 'ম্যান বাইটস ডগ'অথবা 'লফোঁ'(L’enfant) সিনেমাগুলো প্রায় কাল্ট ক্লাসিক হয়ে গেছে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কত লেখক লিখে চলেছেন নিজের নিজের ভাষায়। কিন্তু লোকে হার্জ আর জর্জ সিমোন ছাড়া কাউকে চেনে কি?"
"আজকাল কারা ভালো লিখছে এখানে?" এই ফাঁকে আমার সঙ্গিনী জিগ্গেস করে ফেললেন টমকে।
"অনেকেই আছে। দিমিত্রি ভেরহুলস্ত লিখছেন ফ্লেমিশে, অ্যামেলি নথম্ব লিখছেন ওয়ালুনে, পিটার টেরিন, স্টিফেন হার্টম্যান, টম ল্যানয়ে। হিউগো ক্লাউস এই কয়েক বছর আগে মারা গেলেন। কী ভালো যে লিখতেন! কয়েক বছর আগে ‘ওয়ার এন্ড টারপেনটাইন’ বলে একটা বই বেরিয়েছিল, পারলে পড়ে দেখো। তবে, অনুবাদ না জমলে ঠিক মেজাজ আসে না। আসল কথা কী জানো, প্রচারের পন্থাটাই আমরা শিখে উঠতে পারিনি। মনের সুখে কাজ করব, তারপর বিয়ার খাব। তুমুল হাসিঠাট্টা করব। কে কী ভাববে তাতে কিছু আসে যায় না।”
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আমরা দেখে নিয়েছি ঐতিহাসিক রয়্যাল গ্যালারির ইতালিয়ান শৈলীতে তৈরি অভূতপূর্ব প্যাসেজ, আগাগোড়া কাঁচ দিয়ে মোড়া। চকোলেটের দোকান, হাল ফ্যাশনের জামাকাপড়ের দোকান সব নিয়ে রাজকীয় আয়োজন। 'ম্যানেকুইন পিস'-এর মজাদার ফোয়ারামূর্তি, গির্জা, প্যালেস অফ জাস্টিস আর উদ্যান দেখে আমরা এসে হাজির হয়েছি বাদ্যযন্ত্র মিউজিয়ামের সামনে। এই মিউজিয়ামের সুনাম আছে, জ্যাজ থেকে শুরু করে ক্লাসিকাল, সব ধরনের সঙ্গীতে ব্যবহার হওয়া বাদ্যযন্ত্রের লোভনীয় সংগ্রহও আছে এখানে। কিন্তু এখন আর কারোরই সেদিকে মন নেই। রোদের প্রচন্ড তাপে চাঁদি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। সামনেই মন্ত দেস আর্টের উদ্যান। গত কয়েক ঘন্টাতে ইতিহাসের পাশাপাশি নানা স্থানীয় সংস্কৃতির সন্ধান দিয়েছে টম, অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তাকে বিদায় জানালাম।
রাস্তার ধারে গরম গরম ওয়েফল বিক্রি হচ্ছে। আইসক্রিমও আছে। দুটো ওয়েফল কিনে খাওয়া হল। বেশ স্বাদু, মুচমুচে, গরম, মিষ্টি। এইবার কী করা যায়? ফোনে দেখছি প্রায় উনচল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রা। বেলজিয়ামে পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি তাপমাত্রা কোনদিন হয় না, সকলেই এমন গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর কাকে বলে? ‘আওয়ারাপন, বান্জারাপন’ গাইতে গাইতে প্রতিদিনের মতো ঘুরে বেড়ানো অসম্ভব। বিকেলের আগে রোদ কমবে না। আপাতত ছায়ায় আশ্রয় নিতে হবে। কাছেই কমিক বুক মিউজিয়াম, ম্যাগ্রিত মিউজিয়াম। সেখানে গলাকাটা টিকিট, সে কেটে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব আমরা হাঁটতে হাঁটতে আবার গ্রতে মার্কেটের আলোছায়া মাখা গলিতে চলে এলাম। সূর্য সোজা মাথার ওপর উঠে গেছে। এই গলি সেই গলি করে ঢুকে পড়লাম একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয়।
বেলজিয়ামের রন্ধনশৈলীরও নামডাক আছে, এখানের রান্নাবান্নাও নাকি আকর্ষণীয়(এবং আনহেলদিও), কিন্তু পয়সার আকাল থাকলে পেট ভরাতে ভারতীয় রেস্তোরাঁই ভালো। রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবারের সঙ্গে ড্রিংক নেওয়া একটা অলিখিত নিয়ম, দুজনে ভালো করে খেতে গেলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ইউরোও খসে যেতে পারে।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ঘড়িতে সাড়ে তিনটে, সূর্য খানিকটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। এরাস্মে মেট্রো স্টেশনে গিয়ে আমরা 'অটোমিয়ামের' উদ্দেশে হেইজেলের মেট্রো ধরব। এহেন স্টেশনে গিয়ে দেখি পকেট থেকে 'ডে পাস' অদৃশ্য হয়েছে। সাড়ে সাত ইউরোর পাস। মাত্র আড়াই ইউরো খরচা করেছি। বেশ মুষড়ে পড়লাম। তার ওপর বার কয়েক ‘তুই একটা কী রে?’ শুনতে হয়েছে। কী আর করি? ব্যাজার মুখে আবার টিকিট কেটে মেট্রোতে উঠে পড়লাম।
দিনে তাও অনেক লোকজনের সাক্ষাত পেয়েছি। যতদূর বোঝা গেছে শহরের ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছাড়া এগোলেই লোকজন কমে আসে। বেকাঁত স্টেশনে নেমে অন্য লাইনের ট্রাম ধরলাম। হেইজেলে যখন নামলাম তখন ঘড়িতে চারটে বেজে গেছে।
'অটোমিয়াম' আজকাল অনেকের কাছেই ব্রাসেল্সের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। ৩৩৫ ফুট উঁচু এই অ্যাটমের ইস্পাত নির্মিত আকৃতির নকশা করেছিলেন আন্দ্রে ওয়াটারকেইন। ১৯৫৮ সালে পরমাণু যুগের স্মৃতিস্বরূপ এই সৌধটির নির্মাণ করা হয়েছিল। হেইজেল পার্কের মধ্যবিন্দুতে থাকা এই অতিকায় পরমাণু দেখলে সম্ভ্রম জাগে ঠিকই। জায়গাটা বেশ খোলামেলা। অনেক লোক এখানে অলস সময় কাটায়। তবে অটোমিয়ামের চেয়ে শহরের হাল-হকিকত বুঝতেই আমাদের আগ্রহ বেশি, এক একটা দ্রষ্টব্য দেখার নামে বেরোলে নতুন এক একটা পাড়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা আবার ফিরতি পথে চললাম। বিকেলের দিকে গ্র্যান্ড প্যালেসের পাড়াগুলো এক্সপ্লোর করা দরকার। গলির গোলকধাঁধার ভিতর ভিতর অনেক পুরোনো বাড়ি আর কমিক মুরাল আছে, সেগুলো না দেখলে আফসোস থেকে যাবে।
ট্রামে যেতে যেতে আমি টমের সঙ্গে আলোচনার কথা ভাবছিলাম। বেলজিয়ামের স্বাধীনতার পূর্বে দেশের প্রধান নেতারা ব্যক্তিগত বিলাসিতা বা রাজনীতির সঙ্গে বড় একটা পরিচিত ছিলেন না। নেদ্যারল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই মানসিক ভাবে দেশের শাসকবর্গ এতটা হৃদয়হীন হয়ে উঠল কী করে? প্রতিবেশী দেশের শক্তির ওপর হিংসে আর উপনিবেশের পরিকল্পনা দেখেই কি রাজা লিওপোল্ড দ্বিতীয় কঙ্গোর ওপর আক্রমণ করেছিলেন?
ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় যে যেই মহাদেশের শিল্প আর সাহিত্য পৃথিবীর মানুষকে ধর্ম আর জাতির উর্ধ্বে গিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে শিখিয়েছে, সেখানকার শাসকবর্গই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে আফ্রিকা, এশিয়া আর আমেরিকাতে। প্রায় ষাট বছর ধরে বেলজিয়ান কঙ্গোকে প্রায় ছিবড়ে করে ফেলা হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকে স্বাধীনতার পর মোবুটু কঙ্গোর নিরঙ্কুশ নেতা হয়ে দেশের সর্বনাশ করেছেন কয়েক দশক ধরে। লিওপোল্ডের যুগে হওয়া নির্যাতন আর কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা বেদনাদায়ক জীবন ক্রমে কঙ্গোর লোকদের অবচেতন থেকে সুস্থ জীবনের ধারণাকেই ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার লোকে মারা গেছে কঙ্গো আর অন্যান্য দেশগুলোতে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাতে অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে খনি মাফিয়াদের রাজত্ব। এর পিছনে অনেকটাই দায়ী বেলজিয়ান কঙ্গোর হৃদয়বিদারক ইতিহাস। সম্প্রতি চিন সরকার ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো অর্থাৎ বর্তমানের জায়রেতে সুস্থ জীবনের সুযোগ সুবিধে দিতে নয় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্যে চুক্তি করেছে সেখানকার সরকারের সঙ্গে, বিনিময়ে পরবর্তী কালে সেখানের নানা খনিজ ও আকরীয় সম্পদের মালিকানা হবে চীনের। একবিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনা নতুন যুগের উপনিবেশবাদের আরেক নমুনা।
আমরা মেট্রো থেকে নামতেই হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি এল। মুহুর্তের মধ্যে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে এল। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিতে শুরু করেছে। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। যা গরম পড়েছিল, বৃষ্টি না হলে চলছিল না। খুব বেশিক্ষণ অবশ্য বৃষ্টি চলল না। কয়েক পশলা বৃষ্টিতেই জায়গাটার রূপ আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। চকচকে গলির ভেজা পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা এদিকে সেদিকে টহল দিচ্ছি। এখানকার পাবগুলো বিকেল হতেই টুরিস্টের ভিড়ে ভর্তি হয়ে গেছে। চলছে গান বাজনা। সেন্ট্রাল স্কোয়ারের চত্বরে ভেসে বেড়াচ্ছে মুখরোচক খাবারের সুবাস। আমরা গলি দিয়ে এগিয়ে চললাম কমিক রুটের কয়েকটা মুরালের দিকে। বেশ রঙচংয়ে ছবিগুলো। বেশ লাগে। তাছাড়াও কমিক্স আর বইয়ের বহু দোকান আছে, সেখানেও ঢুঁ মারা হল। ম্যানেকিস পিসের প্রস্রাবের ফোয়ারা বের করা ছোটকু ছেলের মূর্তির আরেক জুড়ি বোন হল জিনেক্কে পিস। তার সামনেই ডেলিরিয়ামের জনপ্রিয় বিয়ারের দোকান আর পাব। প্রায় বত্রিশশো রকমের বিয়ার পাওয়া যায়। হলুদ, সবুজ, গোলাপি বিয়ার দেখে আমরা অবাক। ঘন্টাখানেক আরো ঘোরাঘুরি করে আমরা বাড়িমুখো হলাম।
যথারীতি বাড়িতে যাওয়ার পথে হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। আজকে কফি না খাইয়ে ছাড়বেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। জামাকাপড় বদলে এসে দোকানের সামনের ক্যাফেতে বসলাম আমরা। দুটো কফি বললেন হানিফ ভাই, নিজের জন্যে একটা বিয়ার নিলেন। কথা চলতে লাগল। নানা দেশের অভিজ্ঞতার গল্প। একফাঁকে আমি জিগ্গেস করলাম, “এইখানে ভালো আছেন না আবার অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকলনা করছেন?"
হানিফ ভাই বিয়ারে এক চুমুক দিয়ে বললেন, “এইখানে ঠিক জমছে না ভাই। প্রায় সাতশো ইউরো ঘরভাড়া। দোকানের খরচ। খাওয়াপরা চলে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সঞ্চয় হচ্ছে না কিচ্ছু। ইউরোপে যেখানে খুশি গিয়ে ব্যবসা করতেই পারি, আমার কাগজপত্র সবই আছে। তবে ভাবছি এইবারে দুবাইতে গিয়ে চেষ্টা করব। ওখানে ট্যাক্সের ঝামেলা নেই। হয়তো দাঁড়িয়ে যাব।”
হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প চলল রাত এগারোটা অব্দি। পরের দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে লাঞ্চ করব বলে কথা দিতেই হল। বাংলাদেশী আতিথেয়তার সুনাম আছে, কিন্তু দেশের বাইরেও যে অচেনা মানুষের সঙ্গে এমন আন্তরিক হয়ে জোরাজুরি করা যায় খাওয়ানোর জন্যে, সেটা আমি আন্দাজ করিনি। বুঝলাম তিনি বাংলাদেশ ছাড়লেও দেশ তাঁকে ছাড়েনি।
বিদায় নেওয়ার আগে হানিফ ভাই বললেন, “তোমরা নতুন দেশে এসেছ। পথে দেখা হল। আমিও নতুন জীবনের পথে। তোমাদের পেয়ে গেলাম। এই দুদিনের গল্প, আড্ডা। এইটুকুই তো জীবন। বাকি আর কী আছে বল তো?"
বাড়িতে খাওয়াদাওয়া সেরে আরেকপ্রস্থ আড্ডা হল হার্মিয়নির সঙ্গেও। আজ সে কাজে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি গল্প করছে। এই শহরে আমরা আড্ডা দিয়েছি বেশি, ঘুরেছি কম। তাতে বরং লাভই হয়েছে। কথায় কথায় হার্মিয়নি জানাল, “এমন গরম জীবনে দেখিনি এখানে। কাল আমার এক বন্ধু আসবে বেলারুস থেকে, সে পাগল না হয়ে যায়!”
আমি জিগ্গেস করলাম, “তুমি আজকাল আফ্রিকাতে যাও না? ছোটবেলায় যেখানে থাকতে?"
সে মাথা নেড়ে বলল, “মাঝে মাঝে যাই ঠিকই কিন্তু অনেক কিছুর সঙ্গে আমিও খাপ খাওয়াতে পারি না। ওখানের ভাষাগুলো অন্যরকম। বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা হয়। ওইটুকুই। আমার ভারতে যাওয়ারও এত ইচ্ছে। সময়ই হয় না।”
আমাদের দিকে চেয়ে সে বলল, “ভারতে তো ভুরি ভুরি ভালো ইঞ্জিনিয়ার আছে বলে জানি! তোমরা দুজনেও নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ার। এখানকার কোম্পানিরা তো বেশিরভাগ কাজই ভারতে আউটসোর্স করে দেয়।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমরা অবশ্য নামেই ইঞ্জিনিয়ার। আসল কথা হল প্রতিস্পর্ধা এত বেশি যে খুব কম আয়ে কাজ করতে তৈরি হয়ে যায় ভারতের ইঞ্জিনিয়াররা। ভালো কাজ না করলে ছাঁটাই হয়ে যাবে। এখানে বেকার ভাতা প্রায় নশো ইউরো, অত টাকা বড় বড় চাকুরেরাও পায় না। অতঃপর আউটসোর্স করলে সস্তায় প্রজেক্ট করে নেওয়া যায় আর কি! বহু ইঞ্জিনিয়ার ভারতেও বেকার অবস্থায় বসে আছে। আমি তো পাঁড় বেকার। ঘন ঘন ছুটি নিই বলে কেউ আমাকে কাজই দিতে চায় না।”
তাকে আমাদের দেশের যাবতীয় তথ্য দিয়ে দিলাম। বার বার বললাম যাতে অবশ্যই ভারতে এলে যোগাযোগ করতে। হার্মিয়নি নানা কথা বলে যেতে লাগল, তার বাড়ি, পড়াশুনা, ব্যবসা, ভাইয়ের কথা, ফ্রেঞ্চ ভাষার খুঁটিনাটি। এদিকে আমার সঙ্গিনী কাগজ কলম হাতে ছাত্রী সেজে বসে পড়েছেন একেবারে হার্মিয়নির কাছে। পারেও বটে! হার্মিয়নিও দিব্যি পড়াতে শুরু করেছে তাকে।
আমি 'বঁ নুই' বলে কেটে পড়লাম। ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে। সেদিন ফরাসি ভাষার ক্লাস আর আড্ডা নাকি চলেছিল রাত তিনটে পর্যন্ত।
৩) সকালে এলভিরার সঙ্গে আলাপ হল। হার্মিয়নির বেলারুসের বন্ধু। হার্মিয়নি হেসে জানাল আমাদের মতনই এলভিরা প্রথম হোমস্টেটে থাকতে এসেছিল তার কাছে, তখন থেকেই তারা সই পাতিয়েছে। ঠিক যেমন আমাদের সঙ্গে বন্ধু হয়ে গেছে মারিয়া, দাভিদ অথবা হার্মিয়নি নিজে।
বাইরে আজকেও প্রচন্ড গরম। খুব দূরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। বিকেলে বাস ধরতে হবে। দুপুরে আবার নেমন্তন্ন আছে হানিফ ভাইয়ের বাড়িতে। এলভিরা আর হার্মিয়নি খানিকক্ষণ গল্প করে বেরিয়ে পড়ল। আমরা টুক টুক করে পাড়ার পিছন দিক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পার্ক দে সোর্সের কাছে। ইউরোপের পার্ক মানেই আস্ত একটা সুব্যবস্থিত অরণ্য। এখানেও তার অন্যথা হল না। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা পার্ক আর গল্ফ ক্লাব গিয়ে মিশেছে গোটা এলাকা জুড়ে থাকা ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ে। ছায়াঘন পাথুরে রাস্তার দু' ধারে ছোট বড় হৃদ, তাতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের দল। ঘাসগুলো মসৃণ করে কাটা, মাঝে মাঝে বসার জায়গাও আছে। বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, রোদ থেকে এসে বেশ কয়েকজন বিশ্রাম করছে এখানে। একটা বই নিয়ে বসলেই সময় কেটে যাবে।
অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু হানিফ ভাই অপেক্ষা করবেন বলে উঠতে হল। প্রায় দু' কিলোমিটার রোদে হেঁটে যখন তাঁর বাড়ি পৌঁছালাম, ঘেমে নেয়ে এক্কাকার।
একজনের পক্ষে বেশ বড় ফ্ল্যাট। হানিফ ভাই তাড়াতাড়ি কোল্ড ড্রিংক ধরিয়ে দিলেন। কয়েক চুমুক খেয়ে ধড়ে প্রাণ এল। খাবারে ভাত, মাংস, ডিম, স্যালাদ। ছিমছাম, হাতে তৈরি। যত্ন করে খাওয়ালেন। আন্তরিকতার অভাব নেই তাঁর ব্যবহারে। খাওয়া শেষে সুইটজারল্যান্ডের চকোলেট উপহার দিলেন হানিফ ভাই। ঘন্টাখানেক পর বিদায় জানানোর সময়ে বললাম, “ভারতে আসবেন একবার।” হানিফ ভাই বললেন, “সুযোগ পেলে অবশ্যই যাব ভাই।”
বাড়ি ফিরে এক রুটিন। অভ্যসের বশে ঝপাঝপ ব্যাগ গোছানো। রুকস্যাক পিঠে নেওয়া। হাতে ফোন, পকেটে পার্স। স্ট্র্যাপ টেনে জুতোর ফিতে বাঁধা। আমরা আবার পথে। মাথার ওপর মেঘমুক্ত গ্রীষ্মের আকাশ। হাঁটা, হাঁটা, হাঁটা...
এরকম করেই চলে। মাঝে কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়, বন্ধুত্ব হয়, সম্পর্ক তৈরি হয়... দু'দিনের গল্প, আড্ডা। এইটুকুই তো জীবন। বাকি আর জীবনে কী আছে বলুন তো?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন