শনিবার, ৪ মে, ২০২৪

সাঞ্চেজের দুনিয়ায়

 


সব দিন একরকম যায় না। কোনো কোনোদিন কত ছোটবেলার কথা, কত অবান্তর চিন্তা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে, সেসব লেখা যায় না, শেয়ার করাও যায় না। পেঁজা তুলোর মতো চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে ভাসে, ভেসেই যায়। 

চিন্তামেঘ...

নামটা মনে আসতে এক শিল্পীর কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম যে ছবিটা, তার নামও এক। চিন্তামেঘ। থট ক্লাউড। একটা নয় আসলে, একগুচ্ছ ছবি আছে এই সিরিজে।

থট ক্লাউডের স্রষ্টা আধুনিক কিউবার কিংবদন্তি শিল্পী তোমাস সাঞ্চেজ। নীল নদী, সাদা মেঘ, ঘন সবুজ বন যাঁর সিগনেচার। প্রায় তিন দশক ধরে নিউইয়র্কের মার্লবোরো গ্যালারি তাঁর 'ইনার ল্যান্ডস্কেপ' সিরিজের এক্সিবিশন করছিল, গত মাসেই সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। সাঞ্চেজের অনুরাগীদের মন খারাপ, অনেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য করা বিক্ষোভে তাঁর আঁকা থট ক্লাউডের ছবি নিয়ে গিয়েছেন। কিউবার সবচেয়ে নাম করা এই শিল্পীর ছবির যাদু এমনই যে গ্যালারি বা আর্ট ক্লাসের কয়েক ঘণ্টা নয়, এই শিল্পীর কাজ বহু মানুষের জীবনের অভিন্ন অংশ হয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। 

এমন সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ডিটেলিং ল্যান্ডস্কেপ ছবিতে করা সহজ কাজ নয়। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না যে এই ছবিগুলো হাতে আঁকা। এখন তো আবার গত কয়েক মাস ধরে সাঞ্চেজ স্টুডিওকে এআই প্রুফ সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হচ্ছে। অ্যানিমে আর্টিস্টদের যে ছবি মুহুর্তে ইন্সটার পর্দায় চলে আসে, সাঞ্চেজ কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরে সেরকম এক একটা ছবি এঁকেছেন, আঁকছেন। কিন্তু, যন্ত্রের সঙ্গে রক্তমাংসের শিল্পীর পার্থক্য হল, সাঞ্চেজের ছবি শুধু দেখতে সুন্দর নয়, তার একটা ভাষা আছে, একটা দর্শন আছে। এক একটা ছবিতে দেখা যায়, দিগন্তের দিকে তাকিয়ে এক পুরুষ বসে আছেন। ঘাসবনের ওপর দিয়ে একলা মেঘ বয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন বৃক্ষের সমষ্টির মাঝ দিয়ে একটা আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে। মন অস্থির থাকলে যদি কেউ মন দিয়ে কিছুক্ষণ সাঞ্চেজের ছবি দেখে, মনে হয় জীবনটা এখনও সুন্দর। যতদিন বেঁচে আছি, এই প্রকৃতিকে দেখছি, গাছপালা মেঘ নদী রোদ্দুরকে সঙ্গে নিয়ে এক একটা মুহুর্ত কাটাচ্ছি, এসবের মূল্য চোকানো যাবে না কোনোদিন। এমন হতেই পারত, যে এই পৃথিবীতে আসার মতো ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটত না, তাহলে এসব দেখার সুযোগও হত না। এই মেডিটেটিভ অনুভূতির জন্য আসলে শিল্পীকেই দায়ী করতে হয়, কারণ
সাঞ্চেজ তুলি হাতে ছবি আঁকতে বসে নিজেই সব ভুলে যান, তারপর তিনি ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর সামনে একটা কল্পনার বাগানের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটা ছবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তিনি নিজেই বলেছিলেন, “When I enter a state of meditation it’s as if I’m in a jungle or a forest; the mind enters into a great exhilarated state, like an exuberant jungle where you can experience fear, desire, anguish—all types of emotions and feelings. When I begin to feel that there’s a point of inner consciousness everything goes toward that inner space, that inner river. Everything goes toward that place of quiet, that realm of tranquility within the forest where there is a lake."

আসলে সাঞ্চেজের অধিকাংশ ছবিই প্রেমের ছবি। ছবি না বলে চিঠিও বলা যায়। তাঁর এক একটা ছবি যেন প্রকৃতিকে লেখা প্রেমপত্র। সেখানে নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা আছে, সমর্পণ আছে, কিন্তু কোনও স্বার্থ নেই। এই নিঃস্বার্থ প্রেমের সিগনেচর দেখে খোদ গার্সিয়া মার্কেজ সাঞ্চেজের প্রেমে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, "মানুষ যেভাবে এই দুনিয়াকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করছে, ফের যদি কোনোদিন আমাদের এই পৃথিবীটাকে প্রথম থেকে সাজানো হয়, তাকে সাঞ্চেজের ছবির মতো হতে হবে।"

মন খারাপ থাকলে ইন্টারনেটে খুঁজে খুঁজে তোমাস সাঞ্চেজের ছবি দেখুন। হয়তো মন ভালো হবে। হয়তো মনে হবে, সব দুঃখ কষ্ট বিচ্ছেদ সহ্য করেও বেঁচে থাকাটা আসলে মন্দ নয়।