বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৫

প্রজেক্ট সাবমিসান এর কাল শেষ দিন।তিন রাত ধরে ঘুম হয়নি।অফিস যাইনি।বাড়ি থেকে কাজ করলে অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয় কাজ।মাঝে মাঝে কেউ এসে বিরক্ত করতে পারে না।একটানা সারা দিন কাজ করে বিকেল বেলায় বারান্দায় চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম।ল্যাপটপ খুলতে হবে।আকাশ মেঘলা।কালোসাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় নীল আকাশের উঁকিঝুঁকি।পশ্চিমের দিক থেকে আসা উড়াল হাওয়ায় মেঘের দল বয়ে চলেছে।ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন।সামনের রেলিং এর ওপারে দেখা যাচ্ছে একটানা ভিজতে থাকা গাছ।প্রবল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে পাখিদের যত্ন করে তৈরী করা গেরস্থালি।কার্নিশে এসে বসেছে পায়রার দল।বৃষ্টিভেজা সরু পিচের রাস্তাটা চকচকে মনে হচ্ছে দূর থেকে।সামনের ছাদে একটা কিশোরী মেয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে নাচানাচি করছিল,আমায় দেখে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল।অজান্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল,ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি উঁকি দিল।টুপ..চায়ের কাপে বৃষ্টির জল পড়ছে।টুপ টাপ টুপ..ল্যাপটপের খোলা স্ক্রীনের ওপর দুফোঁটা জল..আস্তে করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলাম.....চশমার কাঁচের মাঝ দিয়ে হারিয়ে যেতে...কিছু চেনা অচেনা আদরের গন্ধ বুকে মেখে...ডেডলাইন মিস করেছি...কিন্তু  ডেডলাইন মিস করিনি...

বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৫

হোসে হুলিয়ান মার্তি পারেজ জন্মেছিলেন ১৮৫৩ সালে, আজ থেকে প্রায় একশ সত্তর বছর আগে। কিউবান রেভোলিউশনারি মুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন পারেজ, স্প্যানিশ শাসনের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ক্রাউসিস্ট লিবরেলিজমের প্রবল সমর্থক এই নেতা নিম্নবর্গের অধিকারের জন্য আজীবন কাজ করেছেন, দাসপ্রথা উন্মূলনের জন্য আন্দোলন করেছেন, অল্পবয়সীদের বৌদ্ধিক ক্ষমতার বিকাসের জন্যও একাধিক প্রকল্প শুরু করেছিলেন তিনি। পারেজ একইসঙ্গে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, শিক্ষক, দার্শনিক ও প্রকাশক ছিলেন, কিন্তু নিজের একটা লেখাও গ্রন্ধবদ্ধ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে কিউবান ন্যাশনাল হিরোর তকমা দেওয়া হয়, তাঁর লেখা প্রবন্ধ, কবিতা ও বক্তৃতা অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশেও। দ্রুত তিনি ল্যাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হয়ে ওঠেন। 

কথা হচ্ছে একশ সত্তর বছর আগের এই নেতা কী লিখেছেন, সেটা কি এখনকার প্রজন্মকে, এখনকার বাস্তবকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে? বিশেষ করে এমন কোনও ব্যাক্তির জীবনকে, যিনি স্প্যানিশ সাহিত্য বা মার্ক্সবাদী দর্শন নিয়ে আগ্রহী নন!

প্রায় আট বছর আগে দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখতে গিয়েছিলাম। মনে আছে সেখানে পরিবেশ বিষয়ক সিনেমা দেখানো হচ্ছিল, বসুধা পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি 'নিয়মাগিরি ইউ আর স্টিল অ্যালাইভ' দেখতে গিয়ে একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। নতুন মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হওয়ার জন্য ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চমৎকার জায়গা। ডেলিগেট ব্যাজ লাগিয়ে একসঙ্গে সিনেমা দেখো, তারপর সিনেমার ভালো মন্দ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করো। মাঝে মাঝে চা বা লাঞ্চ ব্রেকে যাওয়া অথবা একটা স্ক্রিনিং স্কিপ করে আড্ডা দেওয়া। নিজেদের মতো সিনেমা পাগল দর্শক তো বটেই, ক্যামেরার পিছনে কাজ করা মানুষদের সঙ্গেও চেনাজানা হয় যায় এই ফাঁকে। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে। তা সেইবার যার সঙ্গে পরিচয় হল, তিনি নিজে একজন সমাজকর্মী ও ডকু ফিল্মমেকার। ভদ্রলোক বহুদিন হল ছত্তিসগড় আর উড়িষ্যাতে কাজ করছেন, কয়েকটা ছবিও করেছেন। চা খেতে খেতে আড্ডা জমে উঠল আমাদের। কথায় কথায় আলোচনা ঘুরে গেল সিনেমা ও বাস্তব জীবনে সাহিত্যের ভূমিকার দিকে। আমি একসময় বললাম, "আপনার মনে হয় সাহিত্য লং টার্মে বাস্তব জীবনে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে?" তাতে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "একটা গল্প শুনবেন? গল্প বললেও এটা সত্যি ঘটনা। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা।" সম্মতি দিলাম। ভদ্রলোকের গল্পটা নামধাম বদলে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

***

হাতে উল্কি আঁকা, গায়ে চে গুয়েভারার ছাপ মারা টি শার্ট। লম্বা চুলদাড়ি উশকোখুসকো, চোখে সানগ্লাস। রয়্যাল এনফিল্ড থেকে নেমেই লোকটা হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল।

"লং লিভ রেভোলিউশন।"

সামনের জায়গায় সার দিয়ে বসা জনা দশেক লোক। তাদের কেউই উত্তর দিল না।।শান্ত স্বরে কথা বলছিল সুবিনয়, সে আড়চোখে একবার দেখল মাত্র। সবাই বিহ্বল মুখে বসে আছে। এই গলাবাজি শুনে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো অবস্থা তাদের নয়। আজ ছয়দিন হল তাদের কারো পেটে অন্নের একটা দানাও পড়েনি। নিছক উপোস নয়, এটা তাদের প্রতিরোধের ভাষা।

জায়গাটার নাম জরান্দুল। গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ছোট একটা গ্রাম। দিন কয়েক হল খানিক চর্চায় এসেছে এই গ্রামের প্রান্তিক মানুষরা। নাহ! তেমন কৌতূহলোদ্রেককারী কিছুই ঘটেনি। আদ্যিকাল ধরে চলে আসা সেই এক পুরোনো গল্প আবার অভিনীত হচ্ছে। 

সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে এই ছোট্ট গ্রামের চাষাদের জমি নিয়ে নিচ্ছে সরকার। মাত্র সাত দিনের নোটিসে কয়েক হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে ঘরছাড়া করছে গরীব মানুষগুলোকে। রয়্যাল এন্ড শাতো গ্রুপের সঙ্গে কথা পাকা হয়ে গেছে সরকারের, এমওইউ-ও সাক্ষরিত হয়ে গেছে মাসখানেক আগে। এই পার্বত্য গ্রাম আর আশেপাশের জায়গা জুড়ে কটেজ রিসোর্ট নির্মাণ করার জন্যে বহুজাতিক কোম্পানিদের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি করার অনেক আগে থেকেই চলছে, এতদিনে সেই পরিকল্পনায় সীলমোহর পড়ল। এখানকার স্থানীয় লোকেদের কথা কেউ ভাবে না, কোনোদিন ভাবেওনি।

সুবিনয়রা অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছে সমর্থন জোগাড় করার, আন্তর্জাতিক সংগঠনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হয়তো কিছুটা সময় পাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি তারা আদালতে বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান ও সাক্ষ্য সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে প্রয়োজনীয় রিহ্যাবিলিটেশন এর ব্যবস্থা না হলে এখানকার লোকেদের জোর করে সরানো আইনসংগত তো নয়ই, যুক্তিসম্মতও নয়। পরিবেশবিদরা প্রথম থেকেই সাবধান করছে, 'প্রিকশনারি মেজার্স' না নিলে বিপর্যয় হতে পারে। এত তাড়াহুড়ো করে কাজ করা মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু এ সব যুক্তি কেউই শোনেনি। বলা ভালো শুনতে চায়নি। 

যখন সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, শেষ অস্ত্র হিসেবে এই পন্থা বেছে নিয়েছে সুবিনয়রা। আমরণ অনশন। ফাস্ট টিল ডেথ। সরকারের কাছে তাদের দাবি, গ্রামের প্রত্যেকটি মানুষের জন্যে লিখিত ভাবে সরকারের পক্ষ থেকে রোজগার ও পুনর্বাসনের স্বীকৃতি দিতে হবে। সেটা না হওয়া পর্যন্ত এই অনশন চলবে।

সুবিনয় ভেবেছিল এই মরিয়া সিদ্ধান্তের পর অন্তত টনক নড়বে সরকারের। একটা মধ্যপন্থী পথ বের করতে আগ্রহী হবে প্রশাসন, মিডিয়ার চাপে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে সরকারি পক্ষের লোকজন। কিন্তু একের পর এক দিন কেটে গেছে। একটা মানুষও কথা বলতে এগোয়নি সরকারের তরফ থেকে, মিডিয়াও চুপ। সুবিনয়ের সঙ্গীরা হতাশ হয়ে পড়েছে, এমনটা তারা আশা করেনি। সরকার কি কালা? বিন্দুমাত্র দায়িত্ব বা সহানুভূতি নেই তাদের? মানুষের জীবনেরও দাম নেই?

তাহলে কি কিছুই করা যাবে না? এই প্রানপণ খাটুনি, দীর্ঘ দিন ধরে চালানো এই অমানুষিক পরিশ্রম-- ফিল্ড ওয়ার্ক, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, ক্যাম্পেনিং-- এ সমস্ত কাজ বৃথা যাবে? শেষমেশ রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করবে এই সবুজ, সুন্দর গ্রামের সাদাসিধা মানুষরা? প্রতিদিন কেউ না কেউ আশা হারিয়ে সরে পড়ছে, এই যুদ্ধের পরিণাম তাদের জানা। কয়েকজন অবশ্য এখনও মাটি কামড়ে পড়ে আছে। সুবিনয় কিন্তু অনড়। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা জিতবেই।

চোখ থেকে চশমা খুলে লোকটা সোজা হেঁটে এল সুবিনয়ের দিকে। তার মুখে একচিলতে হাসি। সুবিনয়ের কাছে এসে সে বলল, "Its not necessary to introduce myself.Just know what I do. I am a terrorist."

সুবিনয় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। কালো চশমা বলল, "Whatever I do, I have a respect for brave people like you. You are obviously very brave. But you are foolish my friend."

সুবিনয় বলল, "কেন বলুন তো?"

কালো চশমা তার প্রশ্নে কান দিল না। কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে একটা ভিডিও ক্যামেরা বার করে সামনে রাখল সে। সুবিনয় ধীর স্বরে জিগ্গেস করল, "হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?"

লোকটি হাসল। বলল, "পারেজ। হোসে হুলিয়ান মার্তি পারেজ।"

এর ঠিক পনেরো মিনিট পর সুবিনয় দাঁড়িয়ে ছিল পারেজের সঙ্গে। পারেজ তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, "It does not matter the way you choose my brother. What matters  that the way should take you to the destination...not to your destiny!"

পরদিন সকালেই মিডিয়াতে হইচই পড়ে গেল।প্রখ্যাত সমাজসেবী সুবিনয় রায় সহ বারোজনকে অপহরণ করা হয়েছে। সুবিনয় রায় বেশ কিছুদিন ধরে ওই অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে গ্রামের মানুষদের উন্নয়নের জন্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ইউটিউবে ইতিমধ্যেই একটা টেররিস্ট গ্রুপের ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে।নতুন এক জঙ্গি সংগঠন থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, জরান্দুল রেঞ্জের জঙ্গলে কোনো রকম সরকারি দখল বরদাস্ত করা হবে না। সেরকম কিছু হলেই তারা সারা রাজ্য জুড়ে সিরিয়াল ব্লাস্ট করবে। সারা জরান্দুল রেঞ্জকে তারা নিজেদের স্বাধীন রাজ্য বলে ঘোষনা করেছে এই জঙ্গি সংগঠন। সঙ্গে এও বলেছে যে, কোনও বহুজাতিক কোম্পানি এখানে কারখানা বা রিসোর্ট করতে এলে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মাস্ক পরা একজন মানুষ হাতে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাজ্য সরকারের কাছে তাদের দাবি খুব স্পষ্ট। আগামী তিন দিনের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে পাঁচ কোটি টাকা না পেলে তারা সুবিনয় সহ বারো জনকে হত্যা করবে। 

বিকেলের মধ্যেই খবরটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্যে। ইউটিউবের ভিডিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু রাজ্য সরকারের ওপর প্রশ্নবাণ ছোঁড়া নিরন্তর চলছে। 

ফেসবুক, ,ইউটিউব, স্থানীয় নিউজ চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধে। রাজ্য সরকারের নাকের সামনে দিয়ে এত গুণী একজন মানুষকে ধরে নিয়ে গেল? সঙ্গে দেশের বারোজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তি। বুদ্ধিজীবী সমাজে সুবিনয় রায় একটা সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিত্ব। তাঁকে যে করে হোক উদ্ধার করতেই হবে, নাহলে কেন্দ্র সরকার তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহলেও রাজ্যের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। দেড় দিনের মাথায় সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হল, দ্বিতীয় দিন দিল্লি থেকে সরকারি কর্তারা উড়ে এলেন। ইন্টেলিজেন্স তেমন কিছু সাহায্য করতে পারেনি, জরান্দুল অঞ্চলে মিলিটারি নামানাও বিপদ। লোকজন ক্ষেপে আছে, হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। এদিকে মিডিয়া প্রায় মাথা খেয়ে ফেলছে। শত চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক মহলে খবর লিক হয়ে গেছে, প্রসাশনিক ভবনে ফোন বেজেই চলেছে। উপায়ান্তর না দেখে তৃতীয় দিন শেষ হওয়ার আগেই সরকারকে জঙ্গিদের দাবি মেনে নিতে হল। 

তিন সপ্তাহ পরের কথা। সুবিনয় বাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। একটা খবরের ওপর তার চোখ আটকে গেল। নিরাপত্তা জনিত কারণে রয়াল অ্যান্ড শাতো গ্রুপ রাজ্য থেকে রিসর্ট বানানোর পরিকল্পনা তুলে নিচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, তারা  সরকারকে জানিয়েছে যে মাফিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাবসা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তারা প্রোজেক্ট অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। সুবিনয়ের মুখে একটা হাসি খেলে গেল।

(বলা বাহুল্য কাহিনির বক্তা নিজেই সুবিনয়)

***

গল্প শেষ হতে ভদ্রলোক বললেন, "হোসে মার্তি পারেজ মারা গিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর আগেই।।মাত্র ৪২ বছর বয়সে দোজ রিওজের যুদ্ধে গিয়ে মারা যান তিনি। তখন তার একটা লেখাও বই হয়নি। তার মৃত্যুর এতদিন পর ভারতবর্ষের এক প্রান্তিক অঞ্চলে হুট করে কয়েকজন যুবকের আবির্ভাব হল, যারা নিজেদের 'পারেজ' বলে পরিচয় দিতে শুরু করল। যার কথা বললাম, সেই ভারতের একমাত্র পারেজ নয়। ছত্তিসগড়ে
বেশ কিছু অঞ্চলে এদের কথা শোনা গেছে, যদিও মিডিয়াতে পাঁচকান হয়নি বিশেষ। এরা অনেকেই উচ্চবিত্ত, কিন্তু প্রয়োজনের সময় নাকি এরা ঠিক পৌঁছে যায় মানুষকে সাহায্য করতে। এই রবিনহুড হওয়ার চেষ্টা করে লাভ হয়তো কিছুই হয় না, হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তাও ঘটনাটা হচ্ছে। নিজে গিয়ে খোঁজ করলে জানতে পারবে। জরান্দুল পুলিশের পক্ষ থেকে ভিজিল্যান্টে অ্যাকশন নেওয়া চলছে, সরকার নজর রাখছে। সে না হয় হল! কিন্তু ভেবে দেখো, লোকগুলো পারেজ নামটা নিয়েছে কেন? পপ কালচারে পারেজ কোনও আইকন হয়ে ওঠেননি, তিনি তো আর চে নন। তাহলে? কেন এই ছেলেগুলো তাঁর নাম ব্যবহার করছে? সাহিত্য কি তাহলে কিছুটা হলেও বাস্তবকে প্রভাবিত করে?"

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, "ঘটনাটা সত্যি?"

ভদ্রলোক হেসে বললেন, "মিথ্যে। ওই সমাজকর্মী যে আমি সেটা তো বুঝতেই পারছ। পারেজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঠিকই। স্থানীয় ক্রিশ্চান। হিন্দিতে একটা কথাও বলেনি। ইংরেজি উচ্চারণ শুনে মনে হয় কনভেন্ট এডুকেটেড। বাপের পয়সাও আছে হয়তো। সে আমাকে ওই বুদ্ধিও দিয়েছিল। আমার সাহস হয়নি। বিশ্বাস করতে পারিনি। এই ভিজিল্যান্টেদের কথা আগেই শুনেছিলাম, ভয় ছিল এদের সঙ্গে যোগসূত্র পেলে আমার সম্মানহানি হবে।"

আমি মুখ গোঁজ করে বললাম, "তাহলে?"

"তাহলে আর কী! চোদ্দদিনের মাথায় অনশন ভেঙে দিলাম। সরকার এক মাসের মাথায় গ্রামের মানুষকে ঘরছাড়া করল। কেউ কিচ্ছু করতে পারল না। যা হয়! নতুন ল্যান্ড বিল আসছে, যদি কিছু বদল আসে! অনেকদিন পর সে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমার ডকু শুট করার সময় নিজেই এসেছিল একদিন। রায়পুরে বাড়ি। তোমাকে একটা ছবি দেখাই।"

ভদ্রলোক ঝোলা থেকে একটা ফাইল বের করলেন। তার ডকু ফিল্মের কিছু স্টিল, মিডিয়া কাটিং, এইগুলো ডিজিটাল আর্কাইভে জমা দেওয়ার জন্য এনেছেন। একটা ছবি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। তাতে দেখলাম ফিল্ম ইউনিটের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। অবিকল সেই চেহারা। লম্বা চুলদাড়ি, চোখে সানগ্লাস। একটা বই সে এগিয়ে দিচ্ছে সেই ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক ছবি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, "বইটা আমাকে গিফট করেছিল ছেলেটা। সবসময় সঙ্গে রাখি। এই দেখো!"

তার হাতে উঠে এসেছে একটা বই। পুরোনো বই, কিন্তু বাইন্ডিং করা আছে বলে ভালো অবস্থাতেই আছে। খুলে দেখলাম নামটা-- Selected Writings By José Martí. 

ভদ্রলোক বাঙালি নন। নাম বদলে তাঁর বলা গল্পটা লিখে রেখেছিলাম। বইটা পড়িনি। তবে হোসে মার্তির কিছু কবিতা পড়েছিলাম পরে ছাড়া ছাড়া ভাবে। আজ আমাজনে সাজেশনে দেখে ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেল।