Paris |
প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে
সেই দিন, আমার স্মৃতিতে গাঁথা আছে
প্যারিসেই মরব আমি— এ কথায় ভয় পাইনি কোনও—
শরৎকালের এক বৃহস্পতিবারে ঠিক আজকেরই মত
~সেজার ভালেখো
১) আঠাশ বছর বয়সে পেরুতে বসে এই কবিতা লেখার সময় ভালেখো কী ভাবছিলেন সেটা কারোরই জানা নেই, শুধু জানা আছে যে পনেরো বছর পর ভালেখো সত্যি সত্যিই প্যারিসে তাঁর ঘরে মারা যান। সেইদিন প্রবল বৃষ্টি নেমেছিল প্যারিসে।
স্পেন ছেড়ে প্যারিস যাওয়ার সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদে পড়া এই কবিতাটা গোটা রাস্তা আমার মাথায় ভর করে রইল। ভালেখোর জীবন কেটেছে প্রবল দারিদ্র্যে। সারা জীবনে মাত্র তিনটে বই লিখেছেন তিনি। পেরুর যেই অঞ্চলে তার জন্ম হয়েছিল, সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভালেখো বিশ্বসাহিত্যের কতটা স্বাদ পেয়েছিলেন বলা মুশকিল! কিন্তু মৃত্যুর পর ভালেখো সাহিত্যজগতের ‘আইকন’ হয়ে উঠেছেন। সমসাময়িক কবিদের থেকে যে তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন এই কথা তাবড় তাবড় বিশ্লেষকরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। অনেকের মতে নিজের কবিতার প্রতি তাঁর সততাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। সে না হয় হল। কিন্তু আমাকে অন্য একটা কথা ভাবায়। ভীষণ ভাবে ভাবায়। ভালেখো তার কবিতাতে এই লাইনগুলি কেন লিখেছিলেন?
"প্রবল বর্ষার দিনে ‘প্যারিসে’ আমার মৃত্যু হবে..."
প্যারিসেই কেন? ভালেখো তো ফরাসি ছিলেন না। বুয়েনাস আইরস, কারাকাস অথবা লন্ডন হতে পারত! কলকাতা বা লা পাজ হতে পারত! কিন্তু প্যারিস কেন?
এর উত্তর আমাদের জানা নেই। আবার হয়তো আছেও। উত্তর লুকিয়ে আছে একটি উক্তিতে। বার্সেলোনার জনপ্রিয় সাহিত্যিক কার্লোজ লুইস প্যারিস সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, সেটাই সারসত্য। কয়েক বছর আগে হাফোন তাঁর উপন্যাসে লিখেছিলেন, “পৃথিবীতে প্যারিসই একমাত্র শহর যেখানে না খেয়ে মরে যাওয়াটাও শিল্প হয়ে উঠতে পারে।”
কী আছে প্যারিসে? পাঁচশ বছর ধরে কোন মায়ায় বশবর্তী হয়ে হাজার হাজার কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা এই শহরে যাওয়ার জন্যে আকুলি বিকুলি করে? কেন? কোনোদিন পারির রহস্যভেদ হবে কি? এই প্রশ্নের উত্তর কি মিলবে?
উত্তর পাওয়া যাক অথবা না যাক, আপাতত আমরা প্যারিসের পথে এগিয়ে চলেছি। বার্সেলোনা থেকে ‘রেনফে’ নামের ট্রেন নেওয়া যায়, ফ্লাইট তো আছেই। কিন্তু আমরা ইচ্ছে করেই টিকিট কেটেছি বাসের। এই দীর্ঘ সফরে ফ্রান্সের দক্ষিণ অঞ্চলের বেশ খানিকটা বাসে বসেই দেখা হয়ে যাবে আমাদের। ফরাসি প্রান্তরের বিস্তার বুঝতে আর ছোট্ট ছোট্ট জনপদের ওপর চোখ বুলোতে হলে কুড়ি ঘন্টার এই যাত্রার চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।
১৯৪৭ সালের পর থেকেই সারা ইউরোপ আর আমেরিকা জুড়ে ইন্টারস্টেট হাইওয়ের পরিকাঠামো উন্নত করে তোলা হয়েছে একটু একটু করে। আন্তর্জাতিক ই-রোড নেটওয়ার্কের নিয়ম অনুযায়ী সারা ইউরোপ জুড়ে নির্মাণ হয়েছে 'রেফারেন্স রোড' আর 'ইন্টারমিডিয়েট রোড'। এই ক্লাস 'এ' হাইওয়ে দিয়ে সারাক্ষণ এক দেশ থেকে অন্য দেশে গাড়ি, বাস, ট্রাক চলাচল করছে। মাঝের বিভিন্ন গ্রাম থেকে 'লিংক রোড' আর 'কানেক্টিং রোড' এসে মিশেছে আন্তর্জাতিক রাজপথে। মসৃণ কালো পথ, মাখনসদৃশ পরিবহন ব্যবস্থা। যাত্রীদের কোনও অসুবিধেই হয় না। তারপর গত এক দশকে ফ্লিক্সবাস আর মেগাবাস এসে ইউরোপের যাতাযাতে প্রায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। বাসের বাড়াবাড়ি রকমের সস্তা টিকিট আর দীর্ঘ যাত্রার জন্যে উপযুক্ত সুবিধাযুক্ত এই বাসে বহু মানুষ সফর করে আজকাল। ক্রমে প্রতিস্পর্ধা বেড়েছে, আরো নানা কোম্পানি খুলেছে আজকাল। আমাদের টিকিট করা আছে ‘ঔই’ বাসে। বার্সেলোনা সিটি সেন্টার থেকে সোজা মোন্টেপিলার অব্দি যেতে হবে। সেখানে কয়েকঘন্টা বিরতি নিয়ে বাস বদলে প্যারিস।
গিরোনা আর ফিগেরেস পেরিয়ে খানিকটা যেতেই ফ্রান্সে আর স্পেনের সীমান্ত। বর্ডার কন্ট্রোলের বাড়াবাড়ি নেই। বাসে এসে রক্ষীরা একবার পাসপোর্ট আর ভিসায় চোখ বুলিয়ে গেল। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। আমরাও বিশাল বিশাল কাঁচের জানলার ওপর নাক ঠেকিয়ে ফরাসি দেশের ভূখন্ডের বৈশিষ্ট বোঝার চেষ্টা করছি।
ঝাঁ চকচকে রাস্তা। মাঝে মাঝে ছোট বড় নদী, নালা, ক্ষেতখামার। স্পেন থেকে যত দূরে চলে যাচ্ছি, সবুজের মাত্রাও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। আসমানি শামিয়ানার নীচে আঙুরক্ষেত, উইনইয়ার্ড। মাঝে মাঝে দূরের ছোট ছোট গ্রামগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমাদের ড্রাইভার এদিকে কোনও কথা বলতে গেলে এইসা গাঁক গাঁক করে ফরাসি কপচাচ্ছে, যার বিন্দুবিসর্গ আমাদের মাথায় ঢুকছে না। মাঝে একটা পেট্রলপাম্পে দাঁড়ানো হল। পাশেই একটা সুপারস্টোরের মধ্যে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে কয়েকজন ফরাসি সে দেশের বিখ্যাত ক্রোয়াশে আর চিজ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারছে।
বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু। সালসেসের দুর্গ পেরিয়ে, লিউকাতে বন্দর সংলগ্ন প্রকাণ্ড হৃদ পেরিয়ে, নার্বোনিস ন্যাচুরাল পার্কের জঙ্গল আর লেগুন পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি মোন্টেপিলারের দিকে। আমার নাক জানলার কাঁচে ঠেকানো, সঙ্গিনী বই খুলে বসে গেছেন। মাঝে মাঝেই অবশ্য দেখছি মুখ হাঁ করে ঘুম দিচ্ছেন, তবে একেবারেই যে পড়া হচ্ছে না সেটা বলা চলে না। আমি অবশ্য জানলার কাচে নাক দিয়ে ড্রয়িং আঁকব বলে ঠিক করে ফেলেছি। জানলা দিয়ে ফরাসি দেশের দক্ষিণাঞ্চল দেখতে দেখতে একেকবার প্যারিসের কল্পিত ছবি উঁকি দিচ্ছে চোখে, আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে যাচ্ছে স্পেন আর পর্তুগালে কাটানো গত কয়েক সপ্তাহের কথা।
প্রায় দুপুর দুটোর কাছাকাছি আমরা মোন্টেপিলারে গিয়ে পৌঁছালাম। বাস আমাদের নামিয়ে রেখে চলে গেছে যেখানে, সেখানে বাস স্টপ নয়। প্যারিসের বাস আসতে প্রায় ঘন্টা চারেক দেরি, হাঁটতে হাঁটতে ট্রামলাইন পেরিয়ে সামনের বিশাল শপিং মলে ঢুকে পড়লাম। দুপুরের খাওয়া সারতে হবে, তাই খুঁজে খুঁজে ম্যাকডোনাল্ড বের করা হল। ফ্রান্সে জিনিসপত্রের দাম স্পেন আর পর্তুগাল থেকে যে ঢের বেশি, মেশিনে অর্ডার করতে গিয়ে এই কথার সত্যতা আবিষ্কার করলাম।
এতদিন স্পেনের খাবার খেতে আমাদের কোনও অসুবিধেই হয়নি। একে সঙ্গিনী স্প্যানিশ বিশারদ, স্প্যানিশ ব্যঞ্জন সম্পর্কে খানিকটা ধারণা আমাদের আগে থেকেই ছিল। চোস্ত স্প্যানিশে সঙ্গিনী ঠিকঠাক জিনিস অর্ডার করে দিতেন, আমি তারিয়ে তারিয়ে খেতাম। কিন্তু ফরাসি দেশের প্রথম খাদ্যদ্রব্য আমার মুখে মোটেই রুচল না। ভেড়ার মাংসগুলো খানিকটা যেন শুকনো শুকনো, মশলাপাতিগুলোও অন্যরকম। কী আর করা! যস্মিন দেশে যদাচার! সোনা হেন মুখ করে সেগুলোই চিবোতে হল।
মোন্টেপিলার বেশ আধুনিক শহর। অনেক স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলে বহু ছাত্রছাত্রী থাকে এখানে। মধ্যযুগীয় অনেক স্থাপত্যের নিদর্শনও আছে ইউরোপের প্রতিটা শহরের মতনই, কিন্তু ভ্রমণার্থীদের কাছে তেমন করে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি মোন্টেপিলার। শীতের ছুটিতে অনেকেই ফ্রান্সের দক্ষিণে চলে যায়, কিন্তু বেশিরভাগ লোকে মার্সেই, কান্স অথবা মোন্টেকার্লোর দিকে যেতেই পছন্দ করে। দক্ষিণ পশ্চিমের এলাকাগুলো তুলনামূলক ভাবে নিরিবিলিতে কয়েকদিন কাটানোর জন্যেই পরিচিতি লাভ করেছে।
দু’কাপ কফি নিয়েই কাটিয়ে দেওয়া হল তিন ঘন্টা। এক কাপ চা বা কফি নিয়ে বসলেও এখানে কেউ উঠে যেতে বলে না। আমাদের পাশের কয়েকটা টেবিল জুড়ে ছেলেমেয়ের দল হল্লা করে চলেছে সমানে, কয়েকটা কোকাকোলা ছাড়া কিছুই নেয়নি তারা।
বাস এল নির্ধারিত সময়ে। মোন্টেপিলার ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি এ নাইন রাজপথ ধরে। ঘন্টা দুয়েক কেটে যাওয়ার পর সূর্যের আলো মরে এল। রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট ট্রেন স্টেশনের ধারে দাঁড় করানো হল খানিকক্ষণ ইঞ্জিনকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে। দুরপাল্লার বাস চালানোতে চালকদের নানা নিয়ম মানতে হয় এখানে। নির্দিষ্ট দূরত্বের বেশি একজন চালক বাস চালাবে না কোনও মতেই। শুধু বাস চালানো নয়, বাথরুম পরিস্কার রাখা থেকে শুরু করে বাসের রক্ষনাবেক্ষণ কিংবা জলের পাইপের সাহায্যে উইন্ডস্ক্রিন ধোওয়া মোছা সবকিছুই চালকের কাজের আওতায় পড়ে।
বাস চলছে অবিরাম। সরে সরে যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য। ছোট্ট ছোট্ট নিরিবিলি শহর। ফুটবল মাঠ। স্কুল। কমিউনিটি সেন্টার। ঘাসবন। দীঘি। বাসটা শান্ত রাস্তা দিয়ে গিয়ে এক একটা ছোট্ট স্টপে দাঁড়াচ্ছে, একজন দুজন করে যাত্রী উঠছে অথবা নামছে। অনেকেই 'পাহ্বী' মানে পারি অর্থাৎ প্যারিস যাবে, কয়েকজন নেমে যাবে লিওনে। ঘন সবুজ রোন উপত্যকার মাঝে অবস্থিত ভ্য়ালেন্সে শহরটি দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ভ্য়ালেন্সের কাছাকাছি আসার পর থেকেই রোন নদী আমাদের সঙ্গ দিয়ে চলেছে। ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘ নদীর একটি হল রোন। ফরাসি দেশের প্রথম সূর্যাস্ত আমরা গতিশীল অবস্থাতেই দেখতে পেলাম। নদীর নীল সবুজাভ জলে সূর্যের পড়ন্ত আলো পড়ে এক অপরূপ মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। শহরের মধ্যে দিয়ে নদীর একটা ধারা চলে গেছে। তার ওপর সূর্যের রক্তাভ আলোক এসে হারিয়ে যাচ্ছে।
রাত এগারোটার কাছাকাছি বাস লিওনে পৌঁছল। নদীর ওপরে শহরের নীল সবুজ আলোগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে যাত্রীদের। লিওন ফ্রান্সের তৃতীয় বৃহত্তম শহর, এই সুন্দর শহরকে বলা হয় দ্বিতীয় প্যারিস। একগাদা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ নিদর্শন আছে, এ ছাড়া আছে নদীর ধারে অবস্তিত প্রচুর নামকরা রেস্তোরাঁ। লিওনের রাঁধুনিদের সুনাম আছে, সম্প্রতি 'বেস্ট প্লেস টু ডাইন'-এর খেতাবও পেয়েছে তাঁরা। শহরের আলোকসজ্জা ছাড়িয়ে ততক্ষণে বাস গন্তব্যের অভিমুখে। রাত হয়ে গেলে বাইরে তেমন কিছু দেখার থাকে না। আগে থেকে কিনে রাখা শুকনো খাবার খেয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় বাস এসে দাঁড়াল প্যারিসের বার্সি বাসস্টপে। স্পেনের তুলনায় গরম নেই বললেই চলে, বরং একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। তার ওপর ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বাস থেকে নামতে নামতেই মনে একটা দোলা দিল ঠিকই, অস্বীকার করব কী করে? পারি! প্যারিস! অবশেষে এলাম তোমার কাছে! স্বপ্ন নয় তো?
ভোরের আলো তখনও ফুটতে শুরু করেনি। আমাদের অ্যাভেনিউ দে ফ্লান্দ্রেতে যেতে হবে, তাই আগে বার্সির মেট্রো স্টেশনে গিয়ে আগে ট্রান্সপোর্ট পাস কাটা হল। একদিনের 'আনলিমিটেড ট্রাভেল পাস' বারো ইউরো, দু’দিন নিলে উনিশ। পাঁচ দিন, সাত দিনেরও নেওয়া যায়। আমরা আপাতত দু’দিনের পাস নিয়ে 'পার্পল লাইন'-এর গাড়িতে উঠে পড়লাম। পিরামিদেস থেকে মেট্রো বদলে করেন্তিন কারিয়তে যখন নেমেছি, ভোরের আলোয় প্যারিস প্রথম দর্শন দিল। রুকস্যাক পিঠে হাঁটছি ম্যাপ দেখতে দেখতে, পথের ধারের গাছ থেকে গুচ্ছের সাদা ফুল মাটিতে ঝরে পড়ে আছে। রাস্তার ধারগুলো ফুলে বোঝাই, দরজার সামনে ফুল। রোয়াকে ফুল, বেঞ্চিতে ফুল, ময়লা ফেলার ড্রামগুলোও ফুলে ফুলটুস। পথে বিছিয়ে রাখা পুষ্পশোভিত সাদা কার্পেট। বৃষ্টির জলে ভিজে থাকা শহরের বাড়িঘরগুলো অভিবাদন জানাচ্ছে আমাদের। প্রথম দেখাতেই এই মায়াবিনী শহরের প্রেমে পড়ে গেছি আমরা।
ডনিক, মানে যার বাড়িতে আমাদের থাকার কথা, পেশায় একজন এম এম এ ফাইটার। প্যারিস থেকে বাইরে গেছে বলে বাড়িতে ঢোকার যাবতীয় তথ্য জানিয়ে দিয়েছিল আগেভাগে, ফটকের কাছেই শাটারের ভিতর থেকে চাবি নিয়ে দুটো দরজা, তারপর ছয়তলায় গিয়ে অমুক বাড়ি...সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। শুধু একটাই গলদ রয়ে গিয়েছে। তার অবর্তমানে যে একটা ঘরে তার গার্লফ্রেন্ড থাকছে, সেটা জানায়নি ডনিক। সাতসকালে চাবি দিয়ে দরজা খুলে একটা জলজ্যান্ত মেয়েকে চিৎপাত হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ভড়কেই গেছিলাম, শেষে মেসেজে ডনিকের সঙ্গে কথা বলে শান্তি হল। মেয়েটিকে না জাগিয়ে চুপচাপ নিজেদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে চলে এলাম। জানলা দিয়ে তখন প্যারিসের সকাল দেখা যাচ্ছে।
ঘন্টাতিনেক জিরিয়ে নিয়ে স্নান করে বেরিয়ে 'ফ্রানপ্রিক্স' সুপারমার্কেট থেকে লম্বা লম্বা বাগেত পাউরুটি আর ডিম, দুধ, জুস ইত্যাদি কেনা হল। যতটা সম্ভব বাড়িতেই রান্না করে খাওয়া হবে। রান্নাঘরে গিয়ে ঘুমন্ত রাজকন্যা থুড়ি ডনিকের গার্লফ্রেন্ড বার্বারার সঙ্গে আলাপও হল। এতক্ষণে সে ঘুম থেকে উঠেছে। সাঁজে লিজের একটা রেস্তোরাঁয় বিকেলে কাজ করতে যায় বার্বারা, আসতে বেশ রাত হয় তার। ডনিকের ফ্রিজে খাবারদাবার ভালই রাখা ছিল, কিন্তু আইসক্রিম ছাড়া বার্বারাকে কিছু খেতে দেখিনি এক সপ্তাহে। না সকালে, না দুপুরে, না রাতে। মেয়েটা যে কী খেয়ে থাকে সেটাই একটা রহস্য। সেদিনের মতো তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে, ডিম পাউরুটি রান্না করে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
মেট্রো করে শ্যাতলে স্টেশন কিছুক্ষণের পথ। রাস্তায় নেমে সেইন নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে আবার বললাম, “সত্যিই এসেছি। স্বপ্ন নয়।”
বাড়িঘর, অফিস, দোকান সব স্থাপত্যেই একটা আভিজাত্য লেগে আছে। রঙের আধিক্য নেই, বরং ফ্রেঞ্চ গথিক ও বারোক শৈলীর উৎকৃষ্ট অলঙ্করণ বার বার এই শহরের ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। সেইন নদী শহরের মাঝ বরাবর চলে গেছে এঁকে বেঁকে। নদীর ওপরের সেতুগুলো এই শহরের প্রাণকেন্দ্র। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালেই মনে হয় এক ধাপে অনেকটা সময় পিছিয়ে গেছে। এখনও ফরাসি বিপ্লব চলছে, ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের যুগ বর্তমান, শার্ল বোদলেয়ার আর জাঁ আর্তুর র্যাঁবো হয়তো কালই নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গেছেন নতুন মাথায় আসা কবিতার লাইন আওড়াতে আওড়াতে। মোপাসাঁ গল্প লিখছেন, ফ্রেঞ্চ ওয়েভ সিনেমার পরিচালকেরা তুমুল বিতর্ক করছেন ক্যাফেতে বসে। গত তিনশ বছর ধরে যে এই নগরী যে প্রায় শিল্পীদের স্বর্গভূমি হয়ে উঠেছে, তার চোদ্দআনা কৃতিত্ব কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের প্রাপ্য।
রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা আর অভিজাত বর্গের অত্যাচারে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে থাকা সমাজব্যবস্থার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে পৃথিবীর ইতিহাসে, কিন্তু শুধুমাত্র শ্রেণী সংঘাতের ভিত আরো গভীরে ছিল এই বিপ্লবে। ইতালির রেনেসাঁর পর শিল্প-সাহিত্য সাধারণ মানুষের ভাবনাকে আলোড়িত করেছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু বিশ্বাসভিত্তিক জীবনধারণের দর্শন তাদের দ্বন্দে রেখেছে প্রায় একশ বছরেরও বেশি। বস্যুয়ে, মঁতেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, কন্ডসেটের মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদরা এই সংস্কারকে তীব্র আঘাত হেনেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফরাসি শাসকেরা অভিজাত বর্গ ছাড়া সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করে গেছেন। রাজকার্য পরিচালনা শিকেয় তুলে বিলাসব্যসনে ব্যস্ত ছিলেন রাজবংশীরা। রাজা ষোড়শ লুই-এর সময়ে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজকোষ প্রায় শুন্য হয়ে যায়, কিন্তু তাতেও বিলাসের ত্রুটি হয়নি রাজামশাইয়ের। একদিনে লোকেরা খেতে পাচ্ছে না, অন্যদিকে আমোদ চলছে ভার্সেই প্রাসাদে। আগুনে ঘিয়ের কাজ করল আমেরিকার বিপ্লব। বহু ফরাসি যারা এই বিপ্লবে আমেরিকার পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, যুদ্ধের শেষে দেশে ফিরে আসেন বিপ্লবী মনোভাব নিয়ে। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে থাকা মানুষদের চেতনা বিপ্লবের রূপ নিয়ে রোমান ক্যাথোলিক চার্চের চিরাচরিত ক্ষমতা আর রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে।
১৪ জুলাই ১৭৮৯ সালের বিক্ষোভ মিছিলে উত্তপ্ত মানুষের ভিড় উপচে পড়ে প্যারিসে। সশস্ত্র সৈন্যদল, অশ্বারোহী পুলিশ, ব্যারিকেড কিছুই তাদের আটকাতে পারেনি। উত্তেজিত জনতা বাস্তিল দুর্গের কারাগারে আক্রমণ করে বন্দিদের মুক্তি দেয় এবং কারাগারের অধিকর্তা দ্যলুনেকে হত্যা করে। ষোড়শ লুই ও তার স্ত্রী মারি অ্যান্তনেকে বন্দী করা হয় এবং বিচারের পর গিলোটিনের ব্যবহার করে শিরচ্ছেদ করা হয়। বিপ্লব অবশ্য এইখানেই থামেনি। “Liberté, Egalité, Fraternité" অর্থাৎ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্র নিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় ফ্রান্স এবং সারা ইউরোপে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। সাধারণ নাগরিকদের জীবনধারণের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নেপোলিয়ানের শাসনকালে ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নাকচ করে দেওয়া হয়। “Liberté, Egalité, Fraternité" এর বাণী আজও প্যারিসে সর্বত্র দৃশ্যমান।
সেইন নদীর সেতু পার করে নত্রেদাম গির্জার সামনে এসে পৌঁছালাম। বহুবার পর্দায় দেখা হয়ে গেছে, ছবিও দেখেছি আগে কতবার! কিন্তু চাক্ষুষ দেখলে যে রোমাঞ্চ হয় তার কোনও তুলনা নেই। (আমরা সৌভাগ্যশালী। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নত্রেদাম গির্জায় আগুন লেগেছিল। অনেকটা অংশ চিরতরে পুড়ে গিয়েছে। নতুন করে সংস্কার করা হলেও অকৃত্রিম স্থাপত্যের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ আর নেই) ফ্রেঞ্চ গথিক শৈলীর অন্যতম নমুনা এই গির্জা। গথিক শব্দের শাব্দিক অর্থ হল 'আলো’। গির্জার ভিতরে যেন সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে, সেই জন্যে বড় বড় থাম আর সমান্তরাল পরিকাঠামোর পাশাপাশি বিশাল বিশাল কাঁচের রঙিন জানলা তৈরি করা হয়। জানলার ওপর আঁকা গ্লাস পেইন্টিংগুলো দেখলে সত্যি মন ভালো হয়ে যায়। ফ্রেঞ্চ গথিকের আরেক নিদর্শন হল 'গর্গয়েল'। পাথরের খিলানে আর টাওয়ারের বিভিন্ন জায়গায় এই জানোয়ারদের হাঁ করা মুখ আসলে বৃষ্টির সময়ে জল বের করার নালির মতো করে কাজ করে।
গির্জার সামনে ভর্তি টুরিস্ট। অনেকের হাতেই সেলফি স্টিক। বিশ্ববিখ্যাত এই ঐতিহাসিক গির্জা দেখার উন্মাদনা যতটা, ছবি তোলার উন্মাদনা তার চেয়ে শতগুণ বেশি। সেল্ফি টানার ধুম দেখে সত্যিই দেখে মাথা গরম হয়ে যায়। খুব বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে আমরা নত্রেদাম গির্জার দ্বীপ থেকে বেরিয়ে পন্ত সাঁ লুই সেতু পেরিয়ে সেইন নদীর অন্য পাড়ে চলে এলাম।
প্যারিসে হাঁটতে গেলে গন্তব্য ঠিক করার দরকার নেই। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় ইতিহাসের প্রতিটা পাতাই জীবন্ত। গির্জা, সেতু, মিউজিয়াম, ক্যাফে, আর্ট গ্যালারি, টাওয়ার, বইয়ের দোকান...সব একে অপরের সঙ্গে গল্প করছে সেইন নদীর ধারে বসে, আমরা তাদের মাঝে অনাহুত আগন্তুক। মিনিট পনেরো হাঁটতেই সেই পরিবেশ আমাদের পুরোপুরি গ্রাস করল। শুধু দু’ চোখ ভরে দেখি আর ভাবি। যদি অন্তত এক বছর থাকা যেত এই শহরে!
প্যারিসের অভিজ্ঞতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইতে লিখে গিয়েছেন। অনেকের মতো আমারও অতি প্রিয় বই, ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ বইটাও আমি বহুবার পড়েছি, এক কপি এখনও আমার ব্যাগে। সেখানে এক জায়গায় বলা আছে যে প্রতিটা শিল্পীরই প্যারিসে আসা উচিৎ। অন্তত একবার। আমার ধারণা, যাঁরা শিল্পের অনুরাগী কিন্তু নিজে ছবি আঁকেন না অথবা কবিতা লেখেন না, তাঁদেরও একবার প্যারিসে আসা উচিৎ। সাধারণ মানুষের শিল্পমনস্কতা না থাকলে তো কোনও শিল্পেরই কদর হত না। আজকাল ইনফরমেশন ফ্লাডিং-এর যুগ, বিষয়বস্তুর বন্যা বয়ে যাচ্ছে, শিল্পের নানা ফর্ম উপচে পড়ছে 'কনটেন্ট'-এর চাদর জড়িয়ে। সব কিছুই পণ্য। সিনেমা, উপন্যাস, কবিতা, ওয়েব সিরিজ, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য, নানা আঙ্গিকে এসে উপস্থিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। প্রতিটা শিল্পের অন্তরে অসংখ্য শাখাপ্রশাখা, ইন্টারনেট বিপ্লব এসে চিরাচরিত শিল্পের আকৃতি ভেঙ্গে নতুন শিল্পকে আকার দিচ্ছে।
ধরুন, একজন লেখক হয়তো বিশ্বসাহিত্য গুলে খেয়েছেন, কিন্তু বহুপ্রশংসিত সিনেমাগুলো দেখা হয়নি তার। আবার হয়তো কোনও সঙ্গীত শিল্পী সঙ্গীতের নানা বিভাগ নিয়ে সারা জীবন কাজ করে গেছেন, কিন্তু ইম্প্রেশনিস্ট ও সুরিয়ালিজ্ম সম্পর্কে জানার সময় করে উঠতে পারেননি। হতেই পারে! সাধারণ শিল্পমনস্ক ব্যক্তিরা কিন্তু শিল্পের একাধিক শাখা নিয়ে চর্চা করেন নিয়মিত, কোনও একটি ফর্মে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ না করলেও সব শিল্পের প্রতি সামগ্রিক ভালোবাসাই তাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সমকক্ষ করে তোলে। ব্যক্তিগতভাবে ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস, মাস্টার অফ নান’ হতে পারলে আমি দিব্যি আনন্দে থাকব।
সেইন নদীর ধারে হাতে আঁকা ছবি, পোস্টার, পোস্টকার্ড বিক্রি করেন অনেকেই। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের আঁকা ছবিও পাওয়া যায়। সঙ্গে থাকে প্রচুর নতুন-পুরোনো বই ও স্যুভেনির। কিছুটা এগোতেই শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানির বিখ্যাত বইয়ের দোকান। দু’তলা জুড়ে অবস্তিত এই দোকানে এককালে লেখকেরা তক্তপোষে রাত কাটিয়ে যেতেন, সেই চিহ্ন এখনও বিদ্যমান। ভিতরে ঢুকলেই বইয়ের গন্ধে মন ভালো হয়ে যায়। পুরোনো বই, নতুন বই, বাতিল বই, অপ্রকাশিত বই। কাঠের মরচে ধরা সিড়ির ওপরেও বইয়ের রাজত্ব। এক একটা তুলে হাত বুলোই। এক একটা পুরোনো বইয়ের হলদে পাতার ভাঁজে এক একটা ফুল, পাতা, ছেঁড়া চিরকুট দেখা যায়। কত কত গল্পের সাক্ষী এই বইগুলো। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে। কতকাল কেটে গিয়েছে, কিন্তু দোকানের ভিতরটা ঠিক একই রকম ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নানা ধরনের, নানা ভাষার বই আছে... আর সঙ্গে আছে মোটকা এক হুলো বেড়াল। পড়ুয়া বেড়ালের মতোই তাঁর হাবভাব। নেশা লেগে যায়।
আকাশ মেঘলা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিভেজা শহরে হাঁটতে থাকি। কাছেই মঁসিয়ে দে উর্সে মিউজিয়াম, বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম। সেইন নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে থাকলেই পৌঁছে যাওয়া যায় আইফেল টাওয়ারের কাছে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে মাথায়, গালে, মুখে। আমরা রাস্তা ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নদীর ধারে নেমে পন্ত দে আর্টস সেতুর নিচে শান বাঁধানো চত্বরে বসে পড়লাম।
ফরাসি দেশের ইতিহাস নিয়ে এত চর্চা হয়েছে যে নতুন করে বলার মতো কিছুই নেই, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দেশের ইতিহাসের সূচনা যাযাবর আর ভবঘুরে সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে। রোমানরা এসে একে একে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে একের পর এক রাজ্য নির্মাণ করেছে। এককালে জার্মানি আর ফ্রান্স সংযুক্ত ভাবে ফ্রানকিয়া রাজ্যের অংশ ছিল। পশ্চিম ফ্রানকিয়া অঞ্চলই আজকের ফরাসি দেশ। প্যারিসের পত্তনও হয়েছে প্যারিসি বলে এক উপজাতির হাতেই। প্রতিটা অঞ্চলে ডিউক আর রানীদের রমরমা, ফ্রানকিয়া রাজ্যের রাজাদের আদতে কোনও ক্ষমতাই ছিল না। এরপর নর্মান্ডি উপকূলের সম্রাট কিং উইলিয়াম ব্রিটেন অধিকার করে সেখানকার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং বাকি ফরাসি রাজ্যের ওপর দখলের জন্যে যুদ্ধ করতে থাকেন। ইংরেজ সৈন্যের সঙ্গে ফরাসি সৈন্যদের সংঘাত চলতে থাকে বেশ কয়েক বছর ধরে। শেষমেশ রাজা ফিলিপ যখন ইংরেজদের পরাজিত করেন, বস্তুত তখন থেকেই ফ্রান্সের ইতিহাসের শুরু। লড়াই অবশ্য থামেনি। জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার হাপ্স্বুর্গ বংশের শাসকদের সঙ্গে যুদ্ধ হতেই থাকে রাজ্য বিস্তারের জন্য।
ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ানের নেতৃত্বে পুনরায় আক্রমণ করা হয় হাপ্স্বুর্গ রাজ্যে। ওয়াটারলু যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার আগে অব্দি নেপোলিয়ান প্রতিটা রাজ্যকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছেন, দেশের রাজনৈতিক গুরুত্ব ততদিনে আকাশ ছোঁয়া। জার্মানরা সেই ইতিহাস ভোলেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল ফ্রান্সকে।
যুগ পাল্টে গেছে। দেশে দেশে সেই বৈষম্যও নেই। থাকলেও অন্তত জনতার সম্মুখে সে সব আড়াল করেই রাখা হয়। ফ্রান্স আর জার্মানি দুই দেশই আজকাল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রধান সদস্য। কয়েকজন ফ্রেঞ্চ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি যে জার্মান সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তারা বরং বেশ আগ্রহী, বরং ইংরেজদের সঙ্গে চাপা একটা প্রতিযোগিতার ভাব আজও আছে ফরাসিদের।
বৃষ্টি খানিকটা কমলে আমরা ব্রিজ পেরিয়ে অন্যপাড়ে লুভ্যর মিউজিয়ামের বাইরের চত্বরে ঢুকে পড়লাম। জগৎজোড়া খ্যাতি এই প্রকাণ্ড মিউজিয়ামের, হাজার হাজার লোক প্রতিদিন টিকিট কাটে। একসময় রাজপ্রাসাদ থাকা এই বিপুলাকার ভবনের শোভা বাইরে থেকেও ততটাই মনোমুগ্ধকর। লুভ্যর মিউজিয়ামের কাছাকাছি মেট্রো থেকে ট্রেন ধরে আমরা আর্ক দে ত্রায়াম্ফের কাছে চলে এলাম। প্যারিসের কেন্দ্র অবস্থিত এই আর্কের সামনেই ফরাসি বিপ্লবের ১৪ জুলাই দিনটি পালন করা হয় প্রতি বছর। দশ দিকে রাস্তা চলে গেছে। রঁদ্যা, মোনে থেকে আরম্ভ করে বহু শিল্পীর একক মিউজিয়াম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার সঙ্গে আগে মডার্ন আর্ট, কন্টেমপোরারি আর্টের নানা চিত্রকলা ভবন। সব বাড়িই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের চিহ্ন ও আভিজাত্য বহন করছে, তাই কোনটা প্রাসাদ আর কোনটা সরকারি দপ্তর বুঝতে অসুবিধেই হয়। তার দরকারও নেই। যাই দেখি চোখে ভালো লাগে। উজবুকের মতন আমরা দাঁড়িয়ে থাকি খানিকক্ষণ, তারপর আবার এগোতে থাকি।
হঠাৎ গলায় জোরসে টান। উরিবাবা! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দূরে আমাদের চেনা আইফেল টাওয়ারের মাথা দেখা যাচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখাতেই অতি উত্তেজিত হয়ে সঙ্গিনী হ্যাঁচকা টান মেরেছেন। ছবি না তুলে তিনি এক পা এগোবেন না, অগত্যা হাতে মোবাইল তুলে বললাম, “তথাস্তু।” সেতু পেরিয়ে নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখ তুলে চেয়ে দেখছি বার বার। একসময় সত্যি সত্যি আইফেল টাওয়ারের সামনে চলে এলাম।
কী মনে হল? সত্যি কথা বলতে প্রথমেই মনে হল গুস্তাভ আইফেলের কথা যিনি মাত্র কুড়ি বছরের জন্যে এই নির্মাণ করতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বমেলার কুড়ি বছর পর চুক্তি অনুযায়ী এই টাওয়ার ভেঙ্গে দেওয়াও হয়নি আর আইফেল টাওয়ার ক্রমে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে।
আইফেল টাওয়ার, লুভ্য়র মিউজিয়াম, আর্ক দে ট্র্যায়াম্ফ প্রভৃতি প্যারিসের নিদর্শন চাক্ষুষ দেখার বিস্তারিত বর্ণনা আগে বহু শক্তিশালী কলম করে গেছেন। সে সব না বললেও চলবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এইটুকুই বলতে পারি চেনা সৌন্দর্যের ধারেকাছেই বহু সুন্দর দৃশ্য অপেক্ষা করে থাকে, কিন্তু সেই সব দেখাগুলো না দেখাই থেকে যায় অনেক সময়।
বিকেলের পর সন্ধ্যে নেমে আসছে প্যারিসের বুকে। মেঘলা আকাশে সূর্যের দেখা নেই কিন্তু ছাই রঙা মেঘের পিছন থেকে ঝাপসা সবুজ গোলাপি আলো এসে মিশে গেছে জলের আয়নায়। পন্ত দে লিনা সেতুর নিচেই নদীর জলে দাঁড়িয়ে আছে বহু যাত্রীবাহী নৌকো, সূর্যাস্তের সময় লাইন দিয়ে নৌকোয় উঠছে পর্যটকরা। আইফেল টাওয়ারের সামনে টুরিস্টের মেলা, বাচ্চাদের ঘোড়ার দোলনা, খুচরো দোকান, চাদর পেতে বিক্রি হচ্ছে রঙিন আলোর টর্চ, চাবির গোছা, চশমা। 'পারফেক্ট শট'-এর জন্যে ক্যামেরা শিকারিদের নিরন্তর প্রয়াস। এর মধ্যেই সেইন নদীর বেখায়ালি জল তুলি হাতে তৈরি করে চলেছে এক মাস্টারপিস ছবি, ঠিক যেন ইম্প্রেশনিস্ট যুগের কোনও শিল্পী। একা। এই একাকিত্বের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মুহুর্তটুকুও সঞ্চয়ে রাখলাম, যেমন রাখলাম প্যারিসের প্রথম সূর্যাস্তকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন