আমি এত পার্থক্য লক্ষ্য করি
আমার অনুভবে এবং চাক্ষুষ দেখায়,
যে আচমকা যদি মনে পড়ে যায়
ব্যক্তিগত কোনও ট্র্যাজেডির কথা,
আমি ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরাই
এবং কবিতাটিকে বিদায় জানাই
~হোয়ান ব্রোসা
১) গ্রানাদার ফ্রেদরিকো গার্সিয়া লোরকা এয়ারপোর্ট থেকে বার্সেলোনার ফ্লাইট ধরতে গিয়ে শুনলাম যে বিমান আসতে অন্তত দেড় ঘন্টা দেরি হবে। শুনে যে খুব একটা মন খারাপ হল তা নয়। দেশে এইসব হামেশাই দেখছি, সুদূর ইউরোপেও যে আবহাওয়ার খারাপ হলে ফ্লাইট লেট হয়, সেটা জেনে খুব একটা মন্দ লাগল না। ছিমছাম ছোট্ট এয়ারপোর্ট। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সময় কাটানো হল। ভ্রমণ ছাড়া আমার একমাত্র নেশা, চা। ওই গ্রিন টি বা লাল চা চলে মোটামুটি, কিন্তু আদা আর কম দুধ দিয়ে ফোটানো হরিদ্বারের ভাঁড়ের চায়ের সঙ্গে কিছুরই তুলনা হয় না। আর রেলগাড়ির চা? আহা! বিদেশে দশ টাকার খুচরো চা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, সুতরাং কফি দিয়েই কাজ চালাচ্ছি। পাক্কা আড়াই ইউরো খরচ করে কফি কিনে চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় জানা গেল প্লেন আসতে আরো দেরি হবে।
যাচ্চলে! এইবার মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এক-দেড় ঘন্টা দেরি তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ইউরোপে এসে বিমানের জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হলে তো মহামুশকিল। তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো যাবে বলে ট্রেন অথবা বাসের টিকিট না কিনে উড়োজাহাজের ওপর ভরসা করেছিলাম। দূরত্ব তো কম নয়। ফ্লাইট খুব বেশি দেরি করলে দিনটাই নষ্ট। ভেবেছিলাম বিকেল বিকেল পৌঁছে গেলে কয়েকটা জায়গায় ঢুঁ মেরে নেওয়া যাবে, সেই আশায় ছাই পড়বে। সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে দেখি বিরক্তিতে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেছে। এই বুঝি স্প্যানিশে গালমন্দ শুরু হল। সেটা হল না বটে , কিন্তু মুখটা আগামী কয়েক ঘন্টা হুতুম প্যাঁচার মতো হয়েই রইল। শেষমেশ সওয়া তিন ঘন্টা পর বিমান এল। বার বার ক্ষমা চেয়ে প্লেন উড়ল শেষে। তখনও আকাশযাত্রার অভিজ্ঞতা শেষ হয়নি।
বার্সেলোনা ইবেরিয়ান উপদ্বীপের একেবারে উত্তর পূর্বে অবস্থিত। কাতালোনিয়া রাজ্যের চারটে জেলার প্রধান এবং স্পেনের আর্থিক কেন্দ্র বলে বার্সেলোনায় নানা দেশের নানা বর্ণের লোকের বাস। ভূমধ্য সাগরের পাড়ে অবস্থিত এই শহরটি ঘিরে আছে কাইসারাওয়া পর্বতশ্রেণী। দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ইয়ব্রেগাৎ এবং উত্তর দিকে বেসোস নদী বয়ে গেছে।
ঘন্টা দুয়েক ওড়ার পর প্লেনটা যখন নামতে শুরু করল, নীল সমুদ্রের পাড়ে বার্সেলোনা শহরের রূপ দেখে তারিফ না করে থাকতে পারলাম না। ভূমধ্য সাগরের ঘন নীল জল এসে ধাক্কা দিচ্ছে বার্সেলোনার সমুদ্র সৈকতে। বেলাভূমির শোভা যেরকম দেখতে পাচ্ছি, সেরকমই দেখতে পাচ্ছি শহর জুড়ে থাকা পাহাড়ের দিগন্ত রেখা। সাধারণত মহানগরীয় অঞ্চলে এয়ারপোর্টগুলো শহর থেকে বেশ দূরত্বে থাকে বলে আকাশ থেকে শহরের চরিত্র ঠিক বুঝতে পারা যায় না। এই অভাবনীয় সুযোগ পেয়ে ফ্লাইট দেরি করার দুঃখ প্রায় ভুলেই গেলাম। এই আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাটার প্রয়োজন ছিল। কেননা এর পরের অভিজ্ঞতাটা মোটেই সুখকর বলা চলে না।
এল প্রাট বিমানবন্দরে নেমে গেছি প্রায় মিনিট পনেরো। টাক্সিওয়েতে বিমান দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। বাস আসার কোনও নাম নেই। পাইলট বার বার চেষ্টা করছেন যোগাযোগ করার, কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। এদিকে যাত্রীরা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এমনিতে এখানে মিনিটের মধ্যে কাজ হয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্লেন পৌঁছানোর মিনিট পনেরোর মধ্যে ইম্মিগ্রেশন ক্লিয়ার করে, ব্যাগেজ কাউন্টার থেকে ব্যাগ নেওয়া সবই হয়ে যায়। এরকম ঘটনা কেউই দেখেনি। যাত্রীদের অনেকের কাছেই কুকুর ছিল, সেটা আগে বুঝতে পারিনি। এতক্ষণ তারা চুপ করে ছিল, এবার তাদের হাঁকডাক শুরু হয়েছে। কুকুরের ভৌ ভৌ, বাচ্চারা সুর করে কাঁদছে, লোকজন হয়রান করে গাল দিচ্ছে। এদিকে পাইলট বার বার ক্ষমা চাইছেন। কী হচ্ছে ব্যাপার তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। কেলোর কাণ্ড আর কাকে বলে?
প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমরা বিমান থেকে নামতে পারলাম। যতদূর সম্ভব লাইনে কিছু গন্ডগোল হয়েছিল, যার ফলে কন্ট্রোল সেন্টারের লোকজন কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে বেশ দেরি হয়ে গেছে। আমাদের যেতে হবে এল কারমেলে। সেখানে যেতে ঘন্টাখানেক আরো লাগবে।
বিশাল এয়ারপোর্ট। রকমারি আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের শয়ে শয়ে দোকান। আলোয় আলোকিত করে রাখা টার্মিনাল। কাতালান আর স্প্যানিশের পাশাপাশি ইংরেজিতেও সব লেখা আছে ঠিকই তবে প্রথম প্রথম ভড়কে যাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়। আমাদের অবশ্য অভ্যেস হয়ে গেছে ব্যাপার স্যাপার। গটমট করে চিহ্ন দেখে মেট্রো টার্মিনালের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, পিঠে রুকস্যাক। বার্সেলোনায় লক্ষ লক্ষ টুরিস্ট আসে প্রতি বছরই, টুরিস্ট ডিপার্টমেন্ট চব্বিশ ঘন্টা, আটচল্লিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘন্টার কার্ডের ব্যবস্থা করেছে চলাফেরার জন্যে। একবার কিনলে মেট্রো, বাস সব পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই ওঠা যায়। অন্যান্য ইউরোপীয় শহরের মত নামকরা দ্রষ্টব্যগুলো দেখার জন্যে বার্সেলোনা কার্ডও বিক্রি করা হয়। তাতে পৃথক ভাবে টিকিট কাটার দরকার পড়ে না।
আমরা অবশ্য গতানুগতিক ‘টুরিস্ট ট্র্যাপ’ এড়িয়েই চলি। পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে নামকরা দর্শনীয় স্থানগুলো দেখলেই যে শহরের সংস্কৃতি ও সেখানকার মানুষের মানসিকতা বোঝা যাবে তাতে আমাদের মোটেই বিশ্বাস নেই। না দেখলেই নয়, এরকম কয়েকটা জায়গায় টিকিট কাটতে আমার আপত্তি নেই ঠিকই, কিন্তু সূচিপত্রে থাকা প্রতিটা জায়গায় গিয়ে হামলে পড়তে মোটেও পছন্দ করি না। বিশ্বায়নের যুগে ইউরোপের প্রতিটি শহরে গাদা গাদা জাদুঘর, গির্জা, গ্যালেরি, আর ঐতিহাসিক নিদর্শন খুলে দেওয়া হয়েছে সাধারণ টুরিস্টদের জন্যে। সব জায়গাতেই মোটা টিকিট আছে, পর্যটন শিল্পে প্রচুর আয় হয় সেই দিয়ে। কিন্তু সব জায়গায় যেতেই হবে, সেটা জরুরি নয়। টাকা না থাকলেও খুব সহজেই শহরের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো যায়।
আজকাল হাজার হাজার ব্যাকপ্যাকার সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে। এদের অনেকেই ছাত্র, পয়সাকড়ি বিশেষ কারো কাছেই থাকে না। রাস্তাঘাটে পায়ে হেঁটে, নতুন লোকেদের সঙ্গে গল্পগুজব করে এবং অপ্রচলিত স্থানীয় জায়গাগুলোতে গেলে বরং নানান মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। দ্রষ্টব্য ছেড়ে বেপথে গিয়ে পড়লেই সে সুযোগ থাকে বেশি। এক একটা শহরের ভিতর শত শত স্তর থাকে, থাকে নানা ধরনের মানুষ। কসমোপলিটান নগরীতে যে কত দেশ থেকে মানুষ এসে বাসা বাঁধে। কেউ ছাত্র, কেউ চাকুরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। আবার শিল্পী, বোহেমিয়ান, শরণার্থী, সমাজকর্মী, পলাতক আসামীও আছে। সকলের জীবন আলাদা, দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, গল্প আলাদা। কিন্তু তারাও সেই শহরের অভিন্ন অংশ। এদের সঙ্গে মন খুলে কথা না বলতে পারলে, ভাববিনিময় না হলে ভ্রমণের কোনও মানেই হয় না। ভাষা ও সময়ের সীমাবদ্ধতার জন্য সবসময় সে সুযোগ পাওয়া যায় না ঠিক, কিন্তু এলোমেলো ভ্রমণের দরুণ শহরের আসল চরিত্র ঠিকই বোঝা যায় কিছুটা।
মেট্রো করে এল কারমেলে গিয়ে পৌঁছাতে আমাদের লাগল পঞ্চাশ মিনিট। বার্সেলোনা পুরোপুরি আধুনিক শহর। বেশিরভাগ মেট্রোপলিটন শহরের মতনই ভালো, খারাপ, সুন্দর, অসুন্দর সব মিলে মিশে আছে। এই পাড়ায় মধ্যবিত্ত মানুষের বসবাস, অনেক সস্তার দোকানপাট নজরে পড়ল।
আমাদের থাকার কথা ক্যারেনের বাড়িতে। সে মেয়েটি আবার এক বর্ণ ইংরেজি বলতে পারে না। তাতে অবশ্য আমাদের কথা চালাতে অসুবিধে হল না। ক্যারেন ও তার স্বামী দুজনেই কলোম্বিয়া থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছে, ফরফরিয়ে স্প্যানিশ বলে, তাদের ছেলে তিয়াগোর বয়স এক বছর। তিয়াগো মহা চঞ্চল, সারা বাড়ি টলমলে পায়ে হেঁটে আর হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ড্রয়িং রুমে বেয়াল্লিশ ইঞ্চি টিভি, সেখানে নেটফ্লিক্সে একটা স্প্যানিশ সিরিজ চলছে। খেয়াল করেছি এখানে অনেকের বাড়িতেই বড় বড় টিভি থাকে। ইদানিং কালে স্প্যানিশ ভাষায় দারুণ দারুণ ছবি হচ্ছে। নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম ইত্যাদি জনপ্রিয় ইন্টারনেট স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনেক সিনেমা এবং সিরিজের দেশের বাইরেও বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ল্যাটিন আমেরিকার কলোম্বিয়া, মেক্সিকো আর আর্জেন্টিনার বহু পরিচালক স্পেনে এসে কাজ করছেন। গত কয়েক বছরে মেক্সিকোর পরিচালক আলফানসো কুয়ারোন, আলহেন্দ্র গন্জালেজ ইনারিতু, গিয়েরমো দেল তোরো প্রভৃতি পরিচালকেরা একাধিক অস্কার পেয়েছেন। পাকো প্লাজা, হাউমে বালাখুয়েরো, আলেক্স দে লে ইগলেশিয়া, জে এ বাওনা প্রভৃতি স্প্যানিশ পরিচালকেরা হলিউডেও কাজ করে চলেছেন।
বার্সেলোনায় এত কিছু আছে যে এক মাস থাকলেও দেখে শেষ করা যাবে না। গথিক কোয়ার্টার মধ্যযুগীয় স্থাপত্য থেকে আধুনিককালের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর অ্যান্টোনি গাউডির সাড়াজাগানো নির্মাণের নমুনা ছাড়াও আছে অসংখ্য মিউজিয়াম, অপেরা হাউস ও সমুদ্র সৈকত। বার্সেলোনার প্রতীক গাউডির নকশায় নির্মিত লা সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া দেখতেই বহু মানুষ এসে উপস্থিত হয় এই শহরে।
আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে করে এখনকার মতো রওনা হলাম লা বার্সেলোনেতার সমুদ্র সৈকতের অভিমুখে। কাছেই সান সেবাস্টিয়ান, সান মিগেলের মতো অন্যান্য সি বিচও আছে। সূর্য অস্ত যেতে রাত ন’টা বাজবে, সমুদ্রের ওপর সেই দৃশ্য দেখতে ভালই লাগবে আশা করি।
বাস চলেছে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। খানিক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম সমুদ্র সৈকত থেকে শহরটা ধাপে ধাপে পাহাড়ের ওপর উঠে এসেছে। শহরের কেন্দ্রে অনেকটা জায়গা সমতল ঠিকই, কিন্তু অনেক জায়গাতেই উচ্চতা এতই বেশি যে সামনে তাকালে ঢালু রাস্তার ওপারে সমুদ্রের বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড় আর সমুদ্র অন্যান্য অনেক শহরেই আছে ঠিকই, কিন্তু এক ফ্রেমে এই অবস্থান চাক্ষুষ করার ব্যাপারটা আমি সে সময় অন্তত অন্য কোথাও দেখিনি।
বাস চলেছে ছোট ছোট পাড়ারের ওপর দিয়ে। জামাকাপড়, ফলসবজির দোকানের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র, ট্যাটু শপ আর স্কেট বোর্ডের দোকানও চোখে পড়ে। অনেকেই এখানে সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ায়, সেগওয়ে অথবা প্যাডল স্কুটার করেও মানুষজন দিব্যি অফিসে যাতাযাত করে। সেগওয়ে বা ইবাইকের চল নেই ভারতে, অনেকটা ইলেকট্রিক স্কুটারের মতন, মোটর লাগানো থাকে বলে পা দিয়ে ঠেলতে হয় না, হ্যান্ডল ধরে দিক বদলানো যায় সহজেই। এইখানে বলা দরকার যে পরিবহন বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টের নিরিখে ইউরোপ আর আমেরিকায় যে বিপ্লব হয়েছে, সেটা চাক্ষুষ করলে বাহবা দিতেই হয়। শুধুমাত্র ইন্টারস্টেট হাইওয়ে আর বাস, মেট্রো, ট্রেনের পরিকাঠামো আর বিস্তারের কথা বলছি না, বরং সাধারণ মানুষের মানসিকতার কথাই বোঝানোর চেষ্টা করছি।
শুধু বার্সেলোনার কথাই ধরা যাক। ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা ওলম্পিকের আগে পর্যন্ত বার্সেলোনা নেহাৎই একটা বড় শহর ছিল। ওলম্পিকের জন্যে বার্সেলোনার পরিবহন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা হয়। মিশর থেকে বালি এনে সমুদ্রসৈকতের বিস্তার করা হয় কয়েক মাইল। মেট্রো টেনে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের প্রতিটি প্রান্তে। বার্সেলোনায় মেট্রো দেখলে বোঝা যায় যে মাটির নিচে প্রায় দশ তলা জুড়ে লাইনের জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার গাছ লাগিয়ে আর উদ্যান তৈরি হয় দুষণের মাত্র হ্রাস করার জন্যে। ফলে ১৯৯২ সালের পর থেকেই বার্সেলোনায় টুরিস্টের আগমন শুরু হয় উল্লেখযোগ্যভাবে। বিপণন কৌশল আর আর্থিক স্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী পনেরো বছরের মধ্যে বার্সেলোনা স্পেনের পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে বিশ্বায়নের ফলে শয়ে শয়ে বহুজাতিক কোম্পানির অফিস খুলে গেছে। সারা পৃথিবীর থেকে কর্মসংস্থানের জন্যে মানুষ এসে থাকতে শুরু করেছে বার্সেলোনায়।
২০১৪ সালে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে দূষণের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে শহরে। ইউরোপে প্রতিটা শহরে 'এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স'-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের কড়া আদেশ— বাতাস, জল এবং শব্দদূষন যাতে নিম্নতম স্তরে থাকে। সেই জন্যে প্রতিটা দেশকেই জবাবদিহি করতে হয় বছর বছর। ২০১৪ সালের এই গণনার পর সারা দেশের বিশেষজ্ঞরা কাজে নেমে পড়ে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় বদল আনার জন্যে তাঁরা 'সুপারব্লক' বলে একটা প্রজেক্ট শুরু করেন। বার্সেলোনার পাড়াগুলো গ্রিডের আদলে তৈরি। প্রতিটা ব্লক অথবা পাড়া বর্গাকার, মাঝে একটা খালি জায়গা আছে। সেই ব্লকের চারিধার দিয়ে রাস্তা। তার পর আরেকটা বর্গাকার ব্লক। সুপারব্লক প্রজেক্টে ন’টা বর্গাকার ব্লক বেছে একটা বড় বর্গাকার সুপারব্লক বলে চিহ্নিত করা হয় এবং নিয়ম করে দেওয়া হয় যে সুপারব্লকের ভিতরে কোনও বাস অথবা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলবে না। নিজস্ব গাড়ি চালালেও তার গতি ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার কম হতে হবে।
শহর জুড়ে এরকম অনেকগুলো সুপারব্লক তৈরি করা হয়েছে। ফলে লোকেরা কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার জন্যে গাড়ি না বের করে পায়ে হেঁটে অথবা সাইকিল ব্যবহার করে যাতাযাত শুরু করে। এই সুপারব্লকের অঞ্চলে নানান অনুষ্ঠান, কালচারাল কনসার্ট করতে জেলা দপ্তর উৎসাহ দেয়। যেহেতু অনেকখানি জায়গা জুড়ে গাড়ি চলে না, এই অনুষ্ঠানের সময় ভিড় হলেও পরিবহনে কোনও সমস্যা হয় না। লোকজন সাদরে এই নিয়ম মানতে শুরু করে। এক বছরের মধ্যেই দূষণ কমে এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স অভাবনীয় ভাবে উন্নত হয়ে ওঠে। আজকাল বহু লোকে সাইকেল অথবা স্কেটবোর্ড নিয়ে চলাফেরা করে। স্কুল, কলেজ, অফিসেও সাইকেল বা স্কেটবোর্ড চালাতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
বার্সেলোনেতা সমুদ্র সৈকতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা লাগল। ইতিমধ্যে শহরের বেশ খানিকটা অংশ দেখে ফেলেছি বাসেই বসে বসে। অনেক জায়গাতেই পেল্লায় সাইজের সব তোরণদ্বার। প্রাসাদের মত দেখতে নানা সরকারি দপ্তরের সামনে কারুকাজ করা ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে। সমুদ্র থেকে একটা খাঁড়ি টেনে আনা হয়েছে সমুদ্রসৈকতের পাশে। সেখানে সার দিয়ে দাঁড়ানো শয়ে শয়ে মাছ ধরার ও সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়ার নৌকো। নৌকো করে টুরিস্টদের সমুদ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। অনেকে দুদিন তিনদিনের জন্যে বড় ‘ইয়াট’ ভাড়া করে সমুদ্রের বুকে ভেসে পড়ে। অনেকের নিজস্ব বোটও এখানে নোঙর করা থাকে।
বার্সেলোনেতা বিচে গিয়ে ইউরোপিয়ান সামারের আরেক নমুনা দেখতে পাওয়া গেল। বেশ দীর্ঘ বালুকাবেলা, বহু লোকে সমুদ্রে স্নান করছে অথবা বালিতে বসে রোদ পোয়াচ্ছে। যুবক যুবতীদের দল বিচ ভলিবলে মেতেছে, অনেকে সমুদ্রের বুকে প্যারাসেইলিং করছে। বালুকাভূমির কাছেই রেস্তোরাঁর সারি, লোকে লোকে ছয়লাপ। নারীপুরুষ। শিশুকিশোর। অবসরহীন ও অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ। বাহারি টুপি পরিহিতা বৃদ্ধা। বালির সোনালি রঙের ওপর শেষ বিকেলের কমলা ছাপ পড়েছে, দূরে সমুদ্রের জলে দেখা যাচ্ছে ছোট বড় জাহাজ। বার্সেলোনেতা বিচের পাশ দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার অপর দিকে অনেকটা খোলা জায়গা, সেখানে অনেকে স্কেট করছে, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে। বীচ বলিবল। বাতিল বিয়ারের ক্যান। পোষ্যকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যা যাপন। আছে দৌড়। জগিং। স্কিপিং। যোগ। ওয়াটর বটল। গ্রিন টি। স্বাস্থ্য সচেতন জীবনযাত্রার নমুনা। পাশাপাশি অস্বাস্থ্যও আছে ষোলআনা। ডোন্ট কেয়ার মনোভাব নিয়ে বিকেল উপভোগ করা মানুষ। ফিচকে ফ্রাই আর পেটুক পিজ্জার দল। বেসামাল বার্গার। বেমানান বুরিতোজ। হাত বাড়ালেই কফি। উইথ ডবল সুগার। আইসক্রিম থেকে হটডগ, গ্রিলড করা ভেড়ার মাংস থেকে সি ফুড প্ল্যাটার। অ্যাসপ্যারাগস স্যুপ সহকারে নোনতা হাসিবিনিময়। ওয়াইনের গ্লাসের আড়ালে নীরব প্রেম।
এক জায়গায় গানের সঙ্গে সালসা চলছে পুরোদমে। বাচ্চা বুড়ো ছেলে মেয়ে সবাই গানের তালে তালে কোমর নাচাচ্ছে। জমাটি আয়োজন। বেশ লাগে। আমারও যে ইচ্ছে করছিল না তা নয় কিন্তু সঙ্গের ভদ্রমহিলা যদি নির্বিকার চিত্তে চেয়ে থাকেন তাহলে কি আর সাহস হয়? আমার কপালই খারাপ।
কী আর করি, হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ওপর দিয়ে এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে চোখ রাখছি। আলতার শিশি খানিক উল্টে পড়েছে আকাশে, সেখান থেকে লাল রঙ চুইয়ে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। এত লোকের মধ্যেও একটা নীরব স্তুতি অনুভব করা যায় সমুদ্রের তীরে এলে, সেই জন্যেই হয়তো সমুদ্রপ্রেমিকরা ফিরে ফিরে আসে। আবার অনেক সময় এই মুহুর্তগুলো এমনিই বয়ে যায় চোখের সামনে থেকে, মনে দাগ কাটে না। বহুদিন পর যখন স্মৃতি হাতড়ে দেখি, সোনালি অক্ষরে খোদাই করা সেই সন্ধ্যের সান্ধ্যক্ষণ উজ্জ্বল হয়ে থাকে হৃদয়ের কোনও কোনে। অমলিন হয় না এক যুগ পরেও।
বার্সেলোনাতে এশীয় মূলের লোকেদের বাড়বাড়ন্ত। পাকিস্তানের প্রচুর মানুষ এসে ঘর বেঁধেছে এখানে, প্রত্যেকেই কাতালান, স্প্যানিশ গড়গড় করে বলে যেতে পারে। আমাদের সামনেই একজন বাংলাদেশের ভদ্রলোক স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেটি আধো আধো গলায় চিপসের প্যাকেট হাতে বায়না করছে, বাংলা শুনেই আমরা বুঝতে পেরে গেছি। হয়তো বেশিদিন হয়নি, ছেলেটির বাংলায় এদেশীয় টান নেই। হয়তো স্প্যানিশ শিখতে পারেনি এখনও।
ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ন’টা। লাস রাম্বলাস রাস্তার দু’ ধারের ফোয়ারাগুলো থেকে সুরের তালে তালে জল পড়তে থাকে, সঙ্গে চলে আলোর খেলা। ঠিক চিরাচরিত মিউজিকাল ফাউন্টেনের মতন নয়। গান বাজনা বাস্কিং-এর সেরা অভিজ্ঞতা নিতে হলে এখানে কিছুটা সময় দেওয়া যেতেই পারে। আমাদের উদ্দেশ্যহীন ‘ওয়ান্ডারিং’। কয়েক কিলোমিটার হাঁটি, তারপর বাসে উঠে পড়ি। যেখানে ভালো লাগে নেমে আবার হাঁটি। পা ব্যাথা হলে আবার বাস। বাসে বসে থেকেই অনেকটা শহর দেখা হয়ে যায়। আমাদের কাছে আনলিমিটেড ট্রাভেল পাস আছে তিন দিনের জন্যে, এই সুযোগ ছাড়ব কেন?
সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আলো জ্বলে উঠছে এক এক করে। এই সময়ে শহরের রূপ বদলে যায়। যেন উদাসী চোখে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে, মাঝে মাঝে ছোট এক একটা খুশির ঝলকানি খেলে যাচ্ছে তার চোখে। যে বোঝে, সে বোঝে। লা সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার কাছাকাছি গিয়ে নেমে পড়লাম বাস থেকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়ার বিশাল উঁচু চূড়া দেখতে পেলাম। মাথা উঁচু করেও যদিও উচ্চতা বোঝার কোনও উপায় নেই, কিন্তু প্রায়ান্ধকারের প্রথম দর্শনেই এই ঐতিহাসিক আর সম্ভবত স্পেনের সবচেয়ে বৈপ্লবিক সৌধের গুরুত্বটা বুঝে ফেলতে আমাদের কোনও অসুবিধেই হল না।
১৮৮২ সালে যখন এই গির্জার নির্মাণ শুরু হয়, তখন থেকেই জানা ছিল যে খুব তাড়াতাড়ি এই নির্মাণ শেষ হওয়ার নয়। অ্যান্টনি গাউদি যখন এই নির্মাণের দায়িত্ব নেন, তখনও তিনি খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছাননি। মডার্ন স্থাপত্যের প্রতিভূ হিসেবে আজ গাউদিকে সারা পৃথিবীর লোকে চেনে বটে কিন্তু গথিক স্থাপত্যকে শ্রেষ্ঠতার মর্যাদা না দেওয়ার জন্যে প্রথমে তাঁকে কম নিন্দে শুনতে হয়নি। গাউদি আগেই জানতেন যে তাঁর জীবনকালে এই নির্মাণ শেষ হবে না, কিন্তু তিনি সম্ভবত এটাও অনুমান করেছিলেন যে এই স্মৃতিসৌধ আর গির্জা ইতিহাসে তাঁকে অমর করে রাখবে চিরকালের মত।
স্প্যানিশ লাতে গথিক, কাতালান মর্ডানিজ্ম, আর আর্ট নোভু স্থাপত্যের সাহায্যে যেই নকশা গাউদি তৈরি করেছিলেন তাতে প্রথান গির্জার চূড়ার উচ্চতা দাঁড়ায় পাঁচশ ষাট ফুট। এই উচ্চতা বার্সেলোনার কাছেই থাকা সর্বোচ্চ পাহাড়ের উচ্চতার সামিল। গাউদি ইচ্ছে করেই এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মতে ইশ্বরের হাতে তৈরি কোনো জিনিসের উচ্চতাকে ছাপিয়ে যাওয়া মোটেই উচিৎ ছিল না। ১৯২৬ সালে কাজ চলাকালীন গাউদি যখন মারা যান, গির্জার চার আনা কাজও হয়নি। এরপর স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় দীর্ঘ সময় কাজ বন্ধ থাকে। পরে আবার কাজ শুরু হয় এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ত্বরিৎ গতিতে এগোতে থাকে।
বলা বাহুল্য কাজ এখনও চলছে। বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য অনুযায়ী প্রধান গির্জার কাজ ২০২৬ সাল নাগাদ শেষ হলেও খুঁটিনাটি কাজ শেষ হতে আরো বছর ছয় সাত লাগবে। তাতে অবশ্য আমাদের মত লোকেদের কিছুই আসে যায় না। আশির দশকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যা পাওয়া এই অসম্পূর্ণ নির্মাণ সকলকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। জ্যামিতি থেকে প্রতীকবাদ, উচ্চতা থেকে গির্জার রঙিন কাঁচের আঁকা নকশা, প্রতিটা মাপদন্ডেই এই গির্জা পৃথিবীতে এক এবং অনন্য। প্রথমবার এরকম কিছু দেখলে চমক লাগবেই। সম্বিত ফিরতে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। রাতের অন্ধকারে অনেক কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, পরে দিনের আলোয় আসতে হবে। এর মধ্যে টের পেয়েছি বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছে। কাছেই অনেকগুলো খাবারের দোকান। বার্গার খেয়ে সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া মেট্রো স্টেশন থেকে মেট্রো নিয়ে এল কারমেলে পৌঁছাতে আরো মিনিট পঞ্চাশ লাগল।
মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে কাছেই একটা পাকিস্তানি দোকানদারের কাছ থেকে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেরিই হয়ে গেল। বাড়িতে যথারীতি তিয়াগো ঘরময় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। এক গাল হেসে তার সঙ্গে বাংলায় কথা বলা আরম্ভ করে দিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন