একটি সংবাদপত্র নিন, কাঁচি নিন
তা থেকে একটুকরো আপনার কবিতার মাপের প্রবন্ধ বাছুন
প্রবন্ধটিকে কেটে নিন
তারপর ওই প্রবন্ধ থেকে প্রতিটি শব্দ কেটে একটা থলেতে পুরুন
আস্তে-আস্তে নাড়ান
তারপর এক-এক করে প্রতিটি টুকরোকে বের করুন
যে অনুক্রমে থলে থেকে বেরিয়েছে তা বুদ্ধি খাটিয়ে সাজান
কবিতাটি দেখতে ঠিক আপনার মত হবে
আর ব্যস হয়ে গেল— মায়াবী সংবেদনের একজন অমর মৌলিক লেখক
হয়তো একপাল অশিক্ষিতের প্রশংসা থেকে বঞ্চিত
~ত্রিস্তান জারা
যারা সাহিত্য আন্দোলনের খবর রাখেন, তাঁরা অবশ্যই মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদে ত্রিস্তান জারার এই বিদঘুটে কবিতা কোনও না কোনও সময়ে পড়ে থাকবেন। বিশ্বে নানা সময় নানা দেশে শিল্প আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু 'ডাডাইজম'-এর মত বিতর্কিত, উদ্ভট এবং যৌক্তিকতাবিরোধী আন্দোলন আর একটাও হয়নি। সবচেয়ে মজার ঘটনা হল, যুক্তিহীনতাই যে মানবজাতির কল্যাণের একমাত্র রাস্তা, সেটা বোঝাতে তাবড় তাবড় যুক্তি দিয়েছেন ডাডাবাদের নেতারা। ভণিতাহীন, আবেগবর্জিত, চাঁচাছোলা ভঙ্গিতে করা সেই বিশ্লেষণ শুনলে একদিকে যেমন চমকে উঠতে হয়, অন্যদিকে হাসিও পায় তুমুল।
জুরিক থেকে লুজার্নে ফিরে এসে হস্টেলের ডরমিটরিতে পৌঁছাতেই দেখি সেখানে ধুন্ধুমার কাণ্ড লেগে গেছে। পাঁচ-ছয় জন ছেলে জোর আলোচনা করছে সুইটজারল্যান্ডের আধুনিক শিল্পকলা নিয়ে। একদল মডার্ন আর্টের পক্ষে, অন্যেরা জোর গলায় মডার্ন আর্টের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দিচ্ছে। এই আলোচনার মাঝে পড়ে আমি খানিকট থতমত খেয়ে গেছি, এমন সময় বাঙ্ক বেডের ওপর থেকে এক লাফে নিচে নেমে বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক বলল, "তুমি ভারতীয় না? তোমার দেশে তো প্রাচীন কাল থেকে শিল্পের চর্চা হয়ে আসছে। তুমি কোনোদিন কোনও ভারতীয় শিল্পীকে মডার্ন আর্ট করতে দেখেছ নাকি?"
সর্বনাশ! এই এক ঝামেলা! ভারতীয় হলেই আমাকে ভারতবর্ষের নাড়িনক্ষত্র জানতে হবে নাকি? ভারতীয় শিল্পের সমসাময়িক ধারা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। যতদূর মনে পড়ে মডার্ন আর্টের বহু শিল্পী আমাদের দেশেও আছে, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁদের শিল্পের কদরও আছে। আমতা-আমতা করে বললাম, "আমি দেখিনি বটে, কিন্তু যতদূর মনে হয় অনেকেই এই ধারা নিয়ে চর্চা করে।"
মুহুর্তের মধ্যে আবার তুমুল শোরগোল লেগে গেল। স্কট বলে যেই ছেলেটা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তার মতে মডার্ন আর্ট মানে শুধু বুজরুকি। বড় বড় নাম দিয়ে আজেবাজে শিল্পকর্ম লক্ষ লক্ষ ডলারে বিক্রি হচ্ছে, ওতে শিল্প বলে কিছুই নেই। অন্যদলের মতে মডার্ন আর্টই হল সেরা শিল্প, যুক্তিবোধ আর বিশ্লেষণের উর্ধ্বে এই শিল্প আসলে ডাডাবাদ আর সুরিয়েলিজম-এর উত্তরসূরি।
কিছুক্ষণ এই তপ্ত আলোচনার নীরব অংশীদার হয়ে বুঝতে পারলাম এরা প্রত্যেকেই রোমানিয়া থেকে এসেছে। বাসেলে একটি মডার্ন আর্ট গ্যালারি দেখতে গিয়েছিল তারা, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এই কথা-কাটাকাটির শুরু। কয়েকজন সেই শিল্পের মাথামুণ্ডু বোঝেনি, কয়েকজন আবার ওই সব দেখেই মুগ্ধ। বাসেল যে ইদানিং কালে 'মডার্ন আর্ট'-এর সমঝদারদের পুণ্যতীর্থের স্থান পেয়েছে সেই কথা আমি জানতাম, সেখানে অকশন-এ মাঝে মাঝেই চড়া দামে নানান আধুনিক শিল্পের নমুনা বিক্রি হয়ে চালান হয়ে যায় নানা দেশে।
আলোচনায় যোগ দেওয়ার আস্পর্ধা দেখালাম না ঠিকই, কিন্তু এই সূত্রেই ডাডাবাদের আন্দোলনের কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে, হিউগো বেল, এমি হেমিংস, ত্রিস্তান জারা, মার্সেল জানকো, সোফি টাওবেররা এসে দল বেঁধেছেন জুরিকে। এদের অনেকেই ছিলেন রোমানিয়ার অধিবাসী। বিশ্বযুদ্ধে সুইটজারল্যান্ড যোগ দেয়নি ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য দেশের অবস্থা মর্মান্তিক। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে, বহু মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছেন। এতদিন ইউরোপের যে দেশগুলো শিল্প আর সভ্যতার যুক্তি দিয়ে বিশ্বশান্তির বুলি কপচাতো, তারাই ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে সমস্ত মানবিক চিন্তাভাবনা বিসর্জন নিয়ে এই মারণযুদ্ধে মেতেছেন। তার মানে যুক্তি আর শিল্পের দর্শন… সবই ছিল লোকদেখানি ভড়ং? এই মনোবিশ্লেষণ থেকেই এল যুক্তিবিরোধী সেই আন্দোলন, যার নাম ডাডাবাদ। জুরিকের নাইট ক্লাব 'ক্যাবারে ভলতেয়ার’-এ বিমূর্ত শিল্পের চেতনার জাগরণের জন্যে প্রথম ম্যানিফেস্টো পাঠ করা হল ১৯১৬ সালে।
শব্দ, ছন্দ, আর অর্থ ছাড়া কবিতার সৃষ্টি, শিল্পের উপাদান নাট, বল্টু, সাইকেলের চাকা, ময়লার বাক্স। গিটারের সঙ্গে পিয়ানোর তালে গেয়ে যাওয়া অশ্লীল গানের মাথামুন্ডুহীন লাইন। কেউই আশা করেনি এই আন্দোলনের কোনও ভবিষ্যৎ আছে! কিন্তু যুক্তিবাদীদের মুখে ছাই দিয়ে ডাডাবাদ হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপের অন্যান্য দেশে। বাঁধাধরা শিল্পচেতনা থেকে সৃজনশীলতাকে মুক্তি দেওয়া এই আন্দোলনের মেয়াদ ছিল প্রায় তিরিশ বছর। মার্সেল দুশ্যার মতন কেউ কেউ মোনালিসার গোঁফে ডাডাবাদকে দেখেছেন, আবার রিচার্ড হিউয়েলসেনবেক তাকে খুঁজে পেয়েছেন কবিতার ছন্দের অবাস্তবতায়। ব্যক্তিগতভাবে মডার্ন আর্ট নিয়ে আমার খানিকটা আগ্রহ আছে, লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়ামে মাসখানেক ধরে চষে বেড়ানোর সময় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগও হয়েছিল।
পরের দিন সকালে উঠে দেখি আর্টের বিজ্ঞজনেরা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ভালোই হয়েছে! চটপট তৈরি হয়ে নিচে গিয়ে দেখি ব্রেকফাস্টে যেই জিনিসটা বিনামূল্যে ফ্রায়েড রাইস বলে দেওয়া হয়েছে, সেটা খাওয়া অসম্ভব। দু' কাপ কফি খেয়েই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। লুজার্নে এলে বেশিরভাগ লোকেই মাউন্ট পিলাটস অথবা মাউন্ট টিটলিসের পাহাড়ে যাওয়ার কথা ভাবে বরফ দেখবে বলে। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা এই সব তথাকথিত টুরিস্ট স্পট এড়িয়েই চলে। আমাদেরও ভিড়ের মধ্যে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। সিদ্ধার্থের সঙ্গে কথা বলে আমরা ঠিক করেছি আমরা বরং যাব রিগি মাউন্টেনে। লুজার্ন-এর জেটি থেকে যাত্রীবাহী ফেরি ধরে লুজার্ন হ্রদ ধরে গেলে মিনিট চল্লিশ পর পড়বে ভিট্জনাউ। সেখান থেকে মাউন্টেন রেল ধরে পাহাড়ের ওপর উঠে যেতে হবে আরো মিনিট তিরিশ। রিগি পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে লুজার্ন লেকের বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়, দূরের সুগা হৃদের জলরেখাও চোখে পড়ে।
পরিকল্পনা মাফিক বাসে করে লুজার্ন হ্রদের ধারে জেটিতে চলে এলাম। প্রকাণ্ড হ্রদ, হ্রদ না বলে সমুদ্র বললেও কিছু আসে-যায় না। বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের পাদদেশে অবস্তিত এই বিশাল লেক বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। প্রায় একশ পনেরো বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে ছড়ানো এই হ্রদের পাশে বেশ কিছু জনপদ গড়ে উঠেছে। যাত্রীবাহী জাহাজ আর বড় বড় নৌকো করে হ্রদের ধরে গড়ে ওঠা এই পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিয়ে আসা যাওয়া করে মানুষজনদের।
সুইস পাস থাকার সুবাদে আমাদের টিকিট কাটতে হবে না। নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজে উঠে বসলাম। হ্রদের ঘন নীল জল কেটে ফেরি চলল গন্তব্যের উদ্দেশে। লিডো, হার্টেন্সটাইন, ওয়েগিস হয়ে ভিট্জনাউ পৌঁছাতে মিনিট পঞ্চাশ মতো লাগল। সেখান থেকে মাউন্টেন রেল ধরে রিগি পাহাড়ের মাথায় উঠে যেতে হবে। ছোট্ট ট্রেন। তিনটে মাত্র কামরা। সব জায়গাই ভর্তি। সকলেরই দৃষ্টি জানলার বাইরে। ট্রেন যত ওপরে উঠছে, হ্রদ আর সবুজ পাহাড়ের দিগন্তবিস্তৃত সৌন্দর্য্য ততই আমাদের মোহিত করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট স্টেশন পড়ে। সেখান থেকে 'হাইকিং ট্রেল' চলে গিয়েছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। একশটারও বেশি পয়েন্ট আছে হেঁটে হেঁটে গিয়ে ক্যাম্প করার জন্যে। কেউ কেউ ট্রেকিং পোল নিয়ে নেমে যায়। কয়েক মিনিটের জন্যে হল্ট স্টেশনে থামে, তারপর আবার চলতে শুরু করে ট্রেন।
পাহাড়ের মাথায় ট্রেন পৌঁছাতে নেমে পড়লাম। সেখান থেকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আলপাইন জঙ্গল ছাড়িয়ে সবুজ উপত্যকা, দূরের ঘন পাহাড়-জঙ্গল ভেদ করে মাথা উঁচু করে থাকা বরফ মাখানো চূড়া। সুগা হ্রদ আর লুজার্ন হ্রদের ঘন নীল জলের ধারের জনপদগুলো পিঁপড়ের মতো লাগছে। সত্যি বলতে এই সৌন্দর্য্যের বর্ণনা করা সম্ভবও নয়, একমাত্র চাক্ষুষ দেখলেই প্রকৃতির এই অতুলনীয় শোভা আত্মসাৎ করা যায়।
পাহাড়ের মাথা থেকে ঢেউ খেলানো ঘাসের জমি নিচের জঙ্গলের দিকে চলে গেছে, সেখানে ঢালু ঘাসজমিতে ভেড়ার দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। শীতকালে স্কিইং হয়, কিন্তু এখন প্যারাগ্লাইডিং করছে কয়েকজন। লাল-নীল-কমলা গ্লাইডারগুলো রঙিন পাখির মতনই ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে। আমরা চড়াই রাস্তা বেয়ে পাহাড়ের ওপর তৈরি করা গোল চত্বরে এসে পড়লাম। দূরে লুজার্ন শহরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে। অনেক, অনেক নিচে তিনটে হ্রদের জলে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে।
একটি ভারতীয় দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হল। হায়দ্রাবাদ থেকে এসেছে, মধ্য ইউরোপে সপ্তাহ দেড়েকের প্ল্যান। দুজনেই আইটি কোম্পানিতে কাজ করে, কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। পথে বেরোলে এরকম কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, ক্ষণস্থায়ী বন্ধুত্ব পাতানো হয়, ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। সবাই নিজের নিজের পথে ফিরে যায়। জীবনের নিয়মও প্রায় একই।
ঘন্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে ট্রেনে করে ফেরার সময় টুক করে নেমে পড়লাম রিগি-কাল্টবাড স্টেশনে। হল্ট স্টেশনে নামার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকি, দেশেও সুযোগ পেলে প্রচুর অজানা স্টেশনে নেমে গিয়েছি। কিছু কিছু জায়গায় রাতও কাটিয়েছি। কৈশোরে দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ে লেখা গল্প 'হল্ট স্টেশনের প্যাসেঞ্জার' পড়ার পর আমার এই রোগ হয়েছে, সব জায়গাতেই আমি জিয়ালমুড়ি বলে সেই গল্পের স্টেশনটা খুঁজে বেড়াই। যাই হোক, এখানে অবশ্য নামার কারণ আছে। আকাশে মেঘ গুমরে উঠেছে, ঘন কালো কিউমালো নিম্বাসের দল ছুটে আসছে তেজি ঘোড়ার মতোই। অন্ধকার নেমে এসেছে। কাছেই হাইকিং ট্রেল-এর একটা পয়েন্ট আছে, সেখান থেকে ঘুরে এসে আমরা বরং ট্রেনে না চেপে কেবল-কার করে ওয়েগিস-এ নেমে যাব।
সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে সুড়িপথ। মাঝে মাঝে হাইকারদের বিশ্রামের জন্যে গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো বেঞ্চি। ক্যাম্পিং স্পট, আগুন জ্বালানোর জন্যে রাখা কাঠের স্তুপ। একা, শুনশান। জাদুআলোয় আলোয় রহস্যময় লাগছে সে সব। আচমকা এক জোড়া নীল রঙের প্রজাপতি উড়ে এসে বসে কাঠের স্তূপে। তাদের দেখেই ধাঁ করে একটা স্মৃতি ভেসে আসে আমার মনে। সেবার ট্রেন থেকে ফুলপৌরি গ্রামে নেমে গিয়েছিলাম। শতশত কাঠের গুঁড়ি রাখা ছিল স্টেশনে, কাঠ চালাইয়ের ব্যবসা হত সে গাঁয়ে। ঝুলকালি মাখা দোকানে চা খেয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম গাঁয়ের রাস্তায়। শুধু কাঠ আর কাঠ। মরা কাঠের শহর। হাঁটতে হাঁটতে বনের প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম। দেখি কিছু কাঠ রঙ করা হয়েছে। এগিয়ে যেতেই ভুল ভেঙ্গেছিল। রঙ নয়, হাজার হাজার প্রজাপতি বসে আছে কাঠের গুঁড়িতে । নীল, লাল, হলুদ গায়ে ফুটিফুটি নকশা নিয়ে সেগুলো উড়তে শুরু করেছিল আমাকে ঘিরে। আমার হাতে এসে বসেছিল একজোড়া নীল প্রজাপতি। সে কী অদ্ভুত রোমাঞ্চ! গা শিরশির করে উঠেছিল। হঠাৎ মনে হল, আমি সেই দিনটায় ফিরে গিয়েছি। এই সেই প্রজাপতি! ভাবতে না ভাবতেই যেন রজনীগন্ধার গন্ধ পেলাম। বয়সটা কমে গিয়েছে, কৈশোরের লাবণ্য টলটল করছে শরীরে। জীবনটা আচমকাই খুব সুন্দর মনে হল। এই ছোটছোট রহস্যগুলো আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা এত সুন্দর!
অবশেষে মিনিট কুড়ি হাঁটার পর নির্দিষ্ট পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। নীল মেঘের সারি ততক্ষণে দূরের পাহাড়গুলোকে ছায়াচিত্রে পরিণত করেছে। অবাধ্য হাওয়ায় চুল এলোমেলো। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমি মহানন্দে লাফাচ্ছি, সঙ্গিনী ঘুরেঘুরে নাচছেন। কী আনন্দ! হ্রদের ঝকঝকে নীল রঙের ওপর ঘন সবুজ ছায়া পড়ে অসামান্য এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যেই টুপ টুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে আলপাইন বনে। গাছের পাতার ওপর জলের ফোঁটার লাপ-টুপ-লক শব্দ চলছে একনাগাড়ে। চোখের পলক পড়তে চায় না। কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল জানি না। সময়ের খেয়াল হতে কাল্টবাডের কেবল-কার স্টেশনে চলে এলাম। সেই স্বচ্ছ কাঁচের ঘরে ঝুলতে ঝুলে ওয়েগিস-এ নেমে এলাম। হ্রদের ধারের ছোট্ট গ্রাম। ঢেউ খেলানো ঘাসজমির মাঝে এঁকে বেঁকে চলা গাড়ির রাস্তা। খানিকক্ষণ আপনমনে শহরে ঘোরাঘুরি। তারপর জেটিঘাট। ফেরি ধরে লুজার্ন ফিরতে হবে এখান থেকেই।
লুজার্ন ফিরে আগে ম্যাকডোনান্ডের সন্ধান করতে হল। সুইটজারল্যান্ডে এই আমাদের প্রথম বাইরে খেতে হচ্ছে, ম্যাকডোনাল্ডেও সব জিনিসের প্রায় তিন গুণ দাম। কী আর করা যাবে! লুজার্ন ফেরিঘাটের কাছেই শহরের ওল্ড টাউন। চ্যাপেল ব্রিজ নামে সুন্দর একটা ঢাকা দেওয়া কাঠের সেতু আছে এইখানে। এই ঐতিহাসিক সেতু লুজার্নের প্রতীক হয়ে গেছে। কাছাকাছি নানা মিউজিয়াম, ঝলমলে দোকানপাট, ক্যাফে আর পাব। সাদা পাথর দিয়ে তৈরি সিংহের বিশাল প্রতিমা 'লায়ন অফ লুক্রিন' দেখতেও বহু মানুষ জটলা করে। হেঁটে হেঁটে ওল্ড টাউনের দ্রষ্টব্যগুলো দেখে নেওয়া হল যতটা সম্ভব! সূর্যাস্তের সময় জেটি থেকে বার্গেনস্টক এর উদ্দেশে ফেরি ছাড়বে, এইবার ওই গ্রামে হানা দিতে হবে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। বার্গেনস্টকও ওয়েগিসের মতন হ্রদের ধারের একটি ছোট্ট গ্রাম। ফার্নেকুলারের সাহায্যে এখানেও মুহুর্তের মধ্যে পাহাড়ের মাথায় চলে যাওয়া যায়। আমরা অবশ্য বার্গেনস্টকে নামব না, সেখানে গিয়ে ফিরে আসব সূর্যাস্তের সময়। জলের ওপর থেকে লুজার্নের শহরের সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাটাই প্রধান আকর্ষণ।
একসময় ফেরি ছাড়ল। বাইরে সূর্যের আলো অনেকটা মরে এসেছে। কিন্তু সূর্যাস্ত হতে খানিকটা দেরি আছে। ডেকের ওপর হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া চলছে। হ্রদের জলে বড় বড় ঢেউ উঠতে শুরু করেছে, সেই ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের ফেরি লাফাতে লাফাতে এগোচ্ছে বার্গেনস্টক-এর দিকে। ঢেউ আর হাওয়ার চোটে অনেকেই ভয় পেয়ে কাঁচের কেবিনে সেঁধিয়ে গেছে। মিনিট কুড়ি পর জেটি চলে এল। আমরা নামব না। কয়েকজন বার্গেনস্টক থেকে ফেরিতে চড়ল শুধু। ফেরি আবার লুজার্নের উদ্দেশে ফিরে চলল।
ততক্ষণে মেঘের পিছন থেকে পড়ন্ত সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে হ্রদের জলে। কমলা আলোর সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে বৃষ্টির রঙ। কোথায় হ্রদ শেষ হয়ে আকাশ শুরু হয়েছে বোঝা যায় না। হ্রদের চারদিকে অবস্থিত লুজার্ন শহরের রং বেরঙের আলোর বাড়িগুলো দেখে মনে হয় গোটা শহরটাই জলের ওপর ভাসছে। বিস্ময়মাখা চোখে তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। প্রতিদিন গোধুলিবেলায় আকাশের মঞ্চের এই ম্যাজিক অনুষ্ঠান কোনদিন পুরোনো হয় না। বার বার আমাদের বাক্যহারা করতেই যেন এই মুহূর্তগুলো যত্ন করে ভবিষ্যতের সন্দুকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ফেরি তখন এগিয়ে চলেছে আলোর শহরের দিকে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন