শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

“ম্যায় রাত কা আখিরী জাজিরা”


“ম্যায় রহা তে নেহি তুরদা

ম্যায় তুরদা হাঁ তান রাহ বন্দে”

প্রবাদপ্রতিম পাঞ্জাবি কবি ডক্টর সুরজিৎ পাতর মারা গেলেন। আধুনিক ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিদের মধ্যে একজন তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি কথা হল, সম্ভবত এ যুগের সবচেয়ে আদরের জনকবি, ‘দ্য পিপলস পোয়েট অফ পাঞ্জাব’ বলে খ্যাত এই মানুষটি গত এগারো মে সকালে দেহ রাখলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন পাঞ্জাবের মাটির গন্ধ আর সেই গন্ধে বেড়ে ওঠা লোককথা আর লোকগানের সেই সমস্ত অজস্র কাহিনি, যা তাঁকে লিখিয়ে নিয়েছে গত ষাট বছর ধরে। মাত্র একদিন আগেই ডক্টর পাতর বারনালা জেলার একটা সাহিত্য সভায় কবিতা পাঠ করছিলেন, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর আবৃতি শুনছিল। এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার কথাগুলো হয়তো তাঁদের কিছুটা আশার আলো দেখাতে পেরেছিল। ‘জগা দে মোমবাতিয়াঁ’ শিরোনামের এই কবিতার আক্ষরিক অর্থ ‘মোমবাতি জ্বেলে দাও’, কবিতার কয়েক লাইন হল...

“হানেরা না সমঝে কি চাণন ডর গয়া হ্যায়

চাঁদ না সোচে কি সুরজ মর গয়া হ্যায়

বাল জোতে জিন্দেগি দে মান মাট্টিয়াঁ

উঠ জগা দে মোমবাতিয়াঁ

তু জগা দে মোমবাতিয়াঁ”

অর্থও কঠিন কিছু নয়, যদিও পাতরজি এখানেও কিছুটা স্বভাবসিদ্ধ ভাবে রূপক এনে ফেলেছেন। অন্ধকার আর আলোর যুদ্ধে আমাদেরকেই মোমবাতি জ্বালাতে হবে, জ্বালাতে হবে জীবনের গৌরবের জন্যই। আদ্যন্ত রাজনৈতিক কবিতা, অন্ধকার বলতে দেশের অবস্থার কথাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পঞ্জাবের জনপ্রিয় জনকবি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেও সেই কাজই করে গিয়েছেন, মোমবাতি জ্বালিয়ে গিয়েছেন, কবিতার মধ্যে দিয়ে আলোর সন্ধান দিয়েছেন হতাশ, বিরক্ত, পরাজিত জনতাকে, তাদের সাহস দিয়েছেন।       

সুরজিৎ পাতর সেই ব্যতিক্রমী কবিদের একজন, যিনি শিক্ষাজগতে প্রণম্য, বিনোদন জগতে প্রভাবশালী, লাটিয়েন্স দিল্লির ব্যক্তিত্বরা তাঁকে রাজ্যসভা সদস্য করে রাখার জন্য সাধাসাধি করে গিয়েছে, কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষের কবি হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। আজীবন মানুষের সংগ্রাম, তাঁদের জীবন ও যাতনার কথা লিখেছেন, লিখেছেন অমর হয়ে যাওয়া কিছু গজল, এমনকি ‘উধম সিং’ এর মতো সিনেমায় সংলাপ ও গানও লিখেছেন, কিন্তু জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেও প্রয়োজনে পথে নেমে মাটির ঋণ শোধ করতে দু’বার ভাবেননি। নক্সাল আন্দোলন হোক বা চুরাশি পরবর্তী উত্তাল সময়, পাঞ্জাবি ডায়াস্পোরার নানাবিধ সমস্যা হোক বা হালের কৃষক আন্দোলন, সুরজিৎ পাতরের কবিতা সবসময় মানুষের পক্ষে অনড় থেকেছে। সরকারের চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে অসহিষ্ণুতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র ধাবোলকর, গোবিন্দ পান্সারে আর এম এম কালবুর্গির হত্যাকাণ্ডের পর অন্যান্য সাহিত্যিকদের নিয়ে বিরোধ মিছিল করেছেন, সেই ২০১৫ সালেই ফিরিয়ে দিয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। গত বছর কৃষক আইন বা ‘ফার্ম ল’-এর বিরুদ্ধে যখন পাঞ্জাবের কৃষকরা আন্দোলন শুরু করেন, তাঁদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন বারবার, কবিতা লিখেছেন মিছিলের জন্য, সরকারের যুক্তিহীন ও অসংবেদী পদক্ষেপের বিরোধ করতে পদ্মশ্রী সম্মানও ফিরিয়ে দিতে দু'বার ভাবেননি। কৃষকরা দিল্লির বর্ডারে গিয়ে তাঁর কবিতা পড়ছে, এমন দৃশ্য বার বার দেখা গেছে। 


“অসি হুন মুড় নেহি সকতে

অসি হুন মুড় গয়ে ফির তা সমঝো মুড় গয়া ইতিহাস

জিত গয়ি নফরত দি সিয়াসত

অসি হুন মুড় নেহি সকতে…”

(আমরা পিছু ফিরতে পারি না। পিছিয়ে গেলে তো ইতিহাসও মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে, ঘৃণার রাজনীতিই তাহলে জিতে যাবে, আমরা পিছু ফিরতে পারি না) 


এই সব কথা নতুন কিছুই নয়। যাঁরা পাতর সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও কলমের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানতেন, এই সদাহাস্যময়, মিশুকে, গুণী মানুষটার মনের ভিতর একটা বিপ্লবী ছেলে বাস করে, মানুষের পক্ষ টেনে কথা বলতে হলে তাঁকে ভাবতে হয় না। কিন্তু তাঁর এই মানসিকতাকে যদি হিসেবে নাও ধরা হয়, শুধু একজন কবি হিসেবেও তাঁর গুরুত্ব কিছু কম ছিল না। মুক্তছন্দ আর গদ্যে নানক বাণীর ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ রিসার্চ করেছেন সুরজিৎ পতার, পাঞ্জাবি সাহিত্যের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার সাহিত্য নিয়েও তাঁর অসীম জ্ঞান ছিল, লোরকা, নেরুদা, গিরিশ কার্নাডদের বইপত্র পাঞ্জাবিতে অনুবাদও করেছেন, এখনও করছিলেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি একদম সহজ ভাষায়, সহজ চালে, দেশ ও দশের জীবন নিয়ে কঠিন কথা, জটিল কথা বলে ফেলতে পারতেন। 

যে সাবলীলতায় সুরজিৎ পাতর প্রেম আর রুহানিয়াতের কবিতা লিখেছেন, সেই সাবলীলতায় বৈরাগ্য আর বিদ্রোহের কবিতাও লিখেছেন। তাঁর কবিতায় পাঞ্জাবের মানুষের সংগ্রাম, আশা, নস্টালজিয়া এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আবেগ প্রতিফলিত হত, মিলিটেন্সি আর রাজনৈতিক অস্থিরতার সমস্যাকে সূক্ষ্ম ভাবে ছুঁয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু তাঁর হাতিয়ার ছিল মানুষ। লোকোক্তি আর চলতি ভাষার ব্যবহার করতে তিনি দক্ষ ছিলেন, কবিতার প্রয়োজনে লেখার শৈলী পাল্টে ফেলতেন অনায়াসে। কোথাও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও ছন্দপতন মিলবে না, আবার কোথাও ইচ্ছে করেই মুক্তছন্দ রেখে গজগামিনী চালে এগিয়ে গিয়েছেন। অলংকার, রূপক আর দৃশ্যকল্প ব্যবহারের তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর কবিতায় কিন্তু প্রকৃতি আর পশুপাখিও মানুষের রূপ নিয়েই ধরা দেয়, তাদের সঙ্গে পাঠকের একটা নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়ে অজান্তেই। মূলত পাঞ্জাবিতেই লিখতেন পাতর সাহেব, কিন্তু তাঁর পাঠক ছড়িয়ে ছিল সারা দুনিয়ায়। 

তাঁর মৃত্যুতে গোটা ভারতবর্ষ স্তব্ধ। চতুর্থ ধাপের নির্বাচন ভুলে শত শত মানুষ তাদের প্রিয় কবি সাহিবের স্মৃতিচারণ করে চোখের জল ফেলছেন, পাঞ্জাবি হিন্দি উর্দু তামিল তেলুগু কন্নড়া কাশ্মিরী মনিপুরী ভাষার সাহিত্যিকরা দীর্ঘ পোস্ট করছেন, অস্ট্রেলিয়া ইউরোপ ইউ এস থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটা ন্যাশনাল কাগজ তাকে নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছে। দ্য ওয়্যার, দ্য হিন্দু, টিওআই ইত্যাদি তো আছেই, হিন্দির পত্রপত্রিকাতেও আন্তরিক সব স্মৃতিচারণ দেখতে পেলাম। এখনকার পাঞ্জাবি গায়করা বিশেষ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। 


যাঁরা মনে করেন, এ যুগে আঞ্চলিক ভাষার কবিদের তেমন পাঠক নেই, প্রভাবও নেই, তাদের সুরজিৎ পতার ওরফে কবি সাহিবের শেষকৃত্য দেখা উচিত ছিল। অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটল এই কবির বিদায়পর্বে। একটা ভিডিওতে দেখলাম, শয়ে শয়ে লোক সমবেত হয়েছে, অনেকের হাতেই তাঁর লেখা পাঞ্জাবি কবিতার বই, মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান নিজে একের পর এক কবিতা পাঠ করছিলেন, তাঁর চোখেও জল। নিজে মৃতদেহকে কাঁধ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এগিয়ে গেছেন, অনুসরণ করেছেন শহরের মানুষ। তাঁর নামে পাঞ্জাবি কবিতায় পাতর সম্মান ঘোষণা করা হয়েছে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। গোটা জলন্ধর শোকাকুল, কেউ কেউ তাঁর লেখা গজলের সিডি লাউডস্পিকারে বাজাচ্ছে। বোঝা যায়, সুরজিৎ পাতর পাঞ্জাবের জনমানসকে ঠিক কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, কতটা জড়িয়ে ছিলেন তাদের জীবনের গভীরে। তাদের শৈশব ও কৈশোরে, তাঁদের প্রেম ও বিপ্লবে।

২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে, সমসাময়িক কালে আর কোন ভারতীয় কবিকে এইভাবে বিদায় জানানো হয়েছে আমার মনে নেই। হিন্দি কবি কৃষ্ণ কল্পিত বলেছেন, সত্যিকারের কবিকে এভাবেই বিদায় জানানো দরকার। মংলেশ দাবরালের মতো এপিক কবি চুপিসাড়ে চলে গেছিলেন, অনেকে জানতেও পারেনি। কিন্তু সুরজিৎ পাতারের পাঠকরা তাঁকে যে সম্মান দিয়ে ‘বিদা’ করল, সে কথা ভাবলে চোখে জল চলে আসে। হয়তো এই ভালোবাসা তাঁর প্রাপ্যই ছিল। কবি সাহিব অবশ্য তাঁর বিদায়ের অনেক আগেই এই লাইনগুলো লিখে গেছিলেন...

এক লফজ বিদা লিখনা

এক সুলগতা সফা লিখনা

দুখদায়ী হ্যায় নাম তেরা

খুদ সে জুদা লিখনা


সীনে মে সুলগতা হ্যায়

ইয়ে গীত জরা লিখনা

ওয়রক জল জায়েঙ্গে

কিসসা না মিরা লিখনা


সাগর কি লেহেরোঁ পে

মেরে থল কা পতা লিখনা

এক জর্দ সফে পর

কোই হর্ফ হরা লিখনা

মরমর কে বুতোঁ কো

আখির তো হওয়া লিখনা

বাংলায় অনুবাদ না হলেও আশা করি কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হবে না। এই ‘ইমোশন’ অনুবাদে ধরা সম্ভবও নয়, আর আমি যে লাইনগুলো ব্যবহার করছি, তার অধিকাংশ তো আগেই একদফা পাঞ্জাবি থেকে হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে। 

দেখে খুবই অবাক লাগল, বাংলা সাহিত্য জগতে কেউউ সুরজিৎ পাতরকে নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করল না। ব্যতিক্রম থাকতেই পারেন, কিন্তু সংবাদমাধ্যমেও কিছু চোখে পড়ল না। আমি কবিতার বিদগ্ধ পাঠক কোনোকালেই নই, কিন্তু সুরজিৎ পাতরের মতো নামকরা কবির কথা আলাদা করে জানতে লাগে না। নন-পাঞ্জাবি পাঠককূলও যেভাবে তাঁকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, ভালোবেসেছে, পাঞ্জাবি কবিদের মধ্যে একমাত্র পাশ আর শিব প্রসাদ বাটালবীই তেমনটা অর্জন করতে পেরেছেন। যাঁরা জানেন না, চমকীলা সিনেমার ‘বিদা করো’, উড়তা পঞ্জাবের ‘এক কুড়ি জিদা নাম মোহাব্বত’, লভ আজকল এর ‘আজ দিন চাড়েয়া’ সহ অনেক বলিউডি অ্যাডাপ্টেশনও শিব প্রসাদ বাটালবীর গান নিয়েই হয়েছে, তাঁকে বলা হত ‘কিটস অফ পাঞ্জাব'। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মারা যান তিনি। এদিকে ‘পাশ’ ছিলেন পঞ্জাবের বিদ্রোহী জনকবি, অমর সিং চমকীলার মতো অশ্লীল গান নয়, তিনি কবিতা লিখতেন সরকারকে চোখ রাঙিয়ে, রাজ্যের অরাজক ব্যবস্থা আর ধার্মিক রাজনৈতিক নেতাদেরও কেয়ার করতেন না, তাঁর কলম ছিল তীক্ষ্ণ, তাঁর কবিতায় একটা আগুন ছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। দুষ্কৃতীদের হাতে ‘চমকীলা’র মতোই খুন হয়েছিলেন পাশ, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।

এই তিনজন অসম্ভব জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে একমাত্র সুরজিৎ পাতরই দীর্ঘজীবী হয়েছেন, কারণ তাঁর সংবেদী কলম ও আন্তরিক ব্যবহার পাষাণহৃদয় টেররিস্ট থেকে শুরু করে ক্ষমতালোভী নেতাদেরও কাঁদিয়ে দিত বলে জানা যায়। তাঁর মিরাকুলাস জীবন, জনকবি শিক্ষক বুদ্ধিজীবী তকমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তাই আমাকে তাঁর কিছু কবিতা পড়িয়ে নিয়েছে। আলাদা করে খুব আমার তাঁর বই বিশেষ পড়া নেই, আর আমি কবিতা তেমন বুঝিও না। তবুও, তাঁর কলমের সততা, তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু আমাকে মুগ্ধ করেছিল। 

সুরজিৎ পাতর জন্মেছিলেন জালন্ধরের পাতার গ্রামে। এখন অনেকেই জেনে গেছেন, পাঞ্জাবের শিল্পীরা অনেক সময়েই নামের সঙ্গে গ্রামের নাম লিখে থাকে, তাই সুরজিৎ সিং হয়ে গেলেন সুরজিৎ ‘পাতর’। তাঁর বাবা কেনিয়ায় কাজ করতেন, ছুটিছাটা ছাড়া বিশেষ আসতেন না, চার দিদির সঙ্গেই ছোটবেলা কেটেছিল তাঁর। বড় হয়ে কপুরথলায় সায়েন্স পড়তে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সায়েন্স ছেড়ে আর্টসে চলে যান তিনি। এরপর দীর্ঘ দিন পাঞ্জাবি লিটারেচার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, পি এইচ ডি করার সময় থিসিস লিখেছিলেন ‘Transformation of Folklore in Guru Nanak Vani’ বিষয়ে, পরবর্তীতেও সারাজীবন এই নিয়ে চর্চা করে গেছেন।


ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পদ্য লেখার সূত্রপাত, আর প্রথম থেকেই পাতর সাহেব নিজস্ব একটা শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। সহজ, কিন্তু ইম্প্যাক্টফুল। তাঁর কবিতা পড়লে পাঠক ততোটা চমকায় না, যতটা চমকায় কবিতা পড়ার পর। তাঁর লেখার একটা দীর্ঘস্থায়ী জাদু ছিল, যা পাঠকের অবচেতনে রেশ রেখে যেত। 


বরাবরই তিনি সাহসী কবি, কলমের সঙ্গে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভয় পেতেন না, কিন্তু সাধারণ মানুষকে দুঃখে দেখলে তাঁর কলম আগুন জ্বেলে দিত, সে কোভিড কাল হোক বা খালিস্তান সমস্যা। কিন্তু তবু, এই বিপ্লবীর কবির কলমে একটা অদ্ভুত মায়া, একটা অদ্ভুত মাধুর্য ছিল, যা পড়লে মনে হত, এই কবিতায় হিংস্রতার আহ্বান নেই, টক্সিক সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য নেই, কিন্তু মুক্তির একটা পথ আছে। লড়াই আছে, কিন্তু সে লড়াই মানুষকে পিষ্ট করে না, বরং তাঁর কাঁধে হাত রেখে তাঁকে চাগিয়ে তোলে। মুক্তগদ্য হোক বা ছন্দবদ্ধ কবিতা, কবি সাহিবের কবিতায় এই জিনিসটাই ‘কমন’ ছিল, সাধারণ মানুষের ‘স্ট্রাগল’, তাঁদের নিত্য সংগ্রাম। সে প্রেমের স্ট্রাগল/বিরহ হোক, সমাজের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজের স্বপ্নপূরণ হোক, রাজনৈতিক বা বেসিক এমিনিটির জন্য জনতার স্ট্রাগল হোক। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বলতেন, "কবিতার কাজই তো মানুষের জীবনের স্ট্রাগলের কথা জানানো। নেরুদা বা লোরকা, যে কোনও বড় কবিকে দেখুন, তিনি যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, তিনি জনগণের কবি তখনই হয়েছেন, যখন তাদের জীবনকে সাহিত্যতে ধরতে পেরেছেন। এই নীরব স্ট্রাগলের ভাষাকে শব্দ দেওয়া, ভাব দেওয়া, ছন্দে ধরা, এটাই তো কবির কাজ।”

সুরজিৎ প্রাজী নিজে যে সেটা খুব ভালো করে পারতেন সে বলাই বাহুল্য। এই আদর্শ নিয়েই হয়তো লিখেছিলেন--

“মেরে দিল মে কোই দুয়া করে

য়ে জমিন হো সুরময়ী

য়ে দরখত হো হরে ভরে

সব পরিন্দে হি

ইয়াঁহ সে উড় গয়ে...

**

ম্যায় শুনু জো রাত খামোশ কো

কি মিট্টি সে মুঝে পেয়ার নেহি

গর ম্যায় কহুঁ কি আজ ইয়ে তপতি হ্যায়

গর কহুঁ কি প্যায়ের জ্বলতে হ্যায়

উয়ো ভি লেখক হ্যায় তপতী রেত পে জো

রোজ লিখতে হ্যায় হর্ফ চাপো কে

উয়ো ভি পাঠক হ্যায় সর্দ রাতোঁ মে জো

তারো কি কিতাব পড়তে হ্যায়।

পঞ্চাশ বছরের কবি জীবনে যে জায়গা সুরজিৎ পাতর অর্জন করেছিলেন, তা আমাকে সত্যিই বিস্মিত করে। এগারো তারিখে তাঁর মৃত্যুর খবর আসতেই পাঞ্জাবের উত্তপ্ত রাজনীতিকে কেউ এক বালতি ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে মনে হল, চায়ের দোকানে, রাস্তাঘাটে, সভা-সমিতিতে পক্ষ বিপক্ষ ভুলে পার্টির ক্যাডাররা প্রিয় কবির কবিতা আর গান নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, জলন্ধর এর কয়েকটা  বইয়ের দোকানের সামনে ভিড় জমে গেছিল। সবাই কবি সাহিবের বই চায়। কেউ 'পতঝড় দি পাঞ্জেব' চায়, কেউ রিভিজিট করতে চায় ‘হওয়া উইচ লিখে হর্ফ’! সুরজিৎ পাতর জীবন নিয়ে আর কিছু লিখব না, বরং তাঁর দু একটা কবিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। অনুবাদ না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হবে না।


১) 

ম্যায় পেহলি পংক্তি লিখতা হুঁ

অউর ডর জাতা হুঁ রাজা কে সিপাহিয়োঁ সে

পংক্তি কাট দেতা হুঁ


ম্যায় দুসরি পংক্তি লিখতা হুঁ

অউর ডর জাতা হুঁ বাগি গুরিল্লো সে

পংক্তি কাট দেতা হুঁ


ম্যায়নে অপনে প্রাণো কে খাতির

অপনি হজার পংক্তিও কো

অ্যায়সে কি কতল কিয়া হ্যায়

উন পংক্তিয়োঁ কি আত্মায়েঁ

অকসর মেরে আসপাস হি রেহতি হ্যায়

অউর মুঝসে কেহতি হ্যায়


কবি সাহিব

কবি হ্যায় ইয়া কবিতা কে কাতিল হ্যায় আপ?


শুনে মুন্সিফ বহুত ইন্সাফ কে কাতিল

বড়ে ধর্ম কে রাখওয়ালে

খুদ ধর্ম কি পবিত্র আত্মা কো

কতল করতে ভি শুনে থে


সির্ফ ইয়েহি শুননা বাকি থা

কি হমারে ওয়াক্ত মে খৌফ কে মারে

কবি ভি বন গয়ে

কবিতা কে হত্যারে!


২) 

তুমহারে দিওয়ার পর টঙ্গি চমকদার ঘড়ি

মেরা সুরজ নেহি

ন তুমহারে কমরে কি ছত মেরা আসমান

অউর ম্যায় সির্ফ য়েহি নেহি


জো তুমহারে সামনে হ্যায় এক ওয়জুদ

তুম নেহি জানতে

ম্যায় আকেলা নেহি

ইস দরওয়াজে সে বাহর খড়ি হ্যায়


উদাস নসলো কে খুন পর পলি

মেরি গেয়ারহ হজার জহর ভরি রাতেঁ

খুঁখার অত্যাচারী

মেরি কালী ফৌজ

মেরি তারিখ কা আক্রোশ


৩)

ম্যায় রাত কা আখিরী জাজিরা

ঘুল রহা, বিলাপ করতা হুঁ

ম্যায় মারে গয়ে ওয়াক্তো কা আখিরী টুকড়া হুঁ


জখমী হুঁ

অপনে বাকয়োঁ কে জঙ্গল মে

ছিপা করাহতা হুঁ

তমাম মর গয়ে পিতরো কে নাখুন

মেরি ছাতী মে ঘোঁপে পড়ে হ্যায়

জরা দেখো তো সেহি

মর চুকো কো ভি জিন্দা রহনে কি কিতনি লালসা হ্যায়


৪) 

মাতম

হিংসা

খৌফ

বেবসী

অউর অন্যায়


ইয়ে হ্যায় আজকল মেরি নদিয়োঁ কে নাম


৫) 

মেরি শুলী বানায়েঁঙ্গে

ইয়া রবাব

জনাব

ইয়াকি ম্যায় ইউহিঁ খড়া রহুঁ তাউম্র

করতা রহুঁ পত্তো পর

মৌসমো কা হিসাব কিতাব

জনাব

কোই জবাব


মুঝে কেয়া পতা- মুঝে কাহাঁ ভেদ

ম্যায় তো খুদ এক বৃক্ষ হুঁ তুমহারি তরহ

তুম অ্যায়সা করো

আজ কা অখবার দেখো

অখবার মে কুছ নেহি

ঝরে হুয়ে পত্তে হ্যায়


ফির কোই কিতাব দেখো

কিতাবো মে বীজ হ্যায়


তো ফির সোচো

সোচো মে জখম হ্যায়

দাতোঁ কে নিশান হ্যায়

রাহগীরো কে পদচিহ্ন হ্যায়


ইয়া মেরে নাখুন

জো ম্যায়নে বচনে কে লিয়ে

ধরতী কে সিনে মে ঘোঁপ দিয়ে হ্যায়


সোচো সোচো অউর সোচো

সোচ মে ক্যায়েদ হ্যায়

সোচ মে খৌফ হ্যায়

লগতা হ্যায় ধরতী সে বঁধা হুয়া হুঁ


জাও ফির টুট জাও

টুটকর কেয়া হোগা

বৃক্ষ নেহি তো রাখ সেহি

রাখ নেহি তো রেত সেহি

রেত নেহি তো ভাপ সেহি


অচ্ছা ফির চুপ হো জাও

ম্যায় কব বোলতা হুঁ

মেরে তো পত্তে হ্যায়।

হওয়া মে ডোলতে হুয়ে


****


সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪

গোয়ালিয়র ঘরানা- সিটি অফ মিউজিক (২)

জিওয়াজি রাজ সিন্ধিয়া

দিন কয়েক আগে গোয়ালিয়র ঘরানা নিয়ে একটা ছোট পোস্ট করেছিলাম। গান গাইতে গিয়ে (বলা উচিত তান টানতে গিয়ে) কীভাবে হসসু খান মারা গেলেন আর তারপর তাঁর ভাই হদ্দু খান আর বড় জ্যাঠা বড়ে মুহম্মদ খানের পরিবার গোয়ালিয়র ঘরানাকে একটু একটু করে মজবুত করে ফেলল, এই সব আর কি! সেটা পড়ে আমার এক প্রিয় বন্ধু জিগালো, এরপর হদ্দু খানের কী হল? সে অনেক কথা, আর সব গল্প মিলেমিশে ঘ্যাঁট হয়ে গেছে বলে আলাদা করে একজনের গল্প বলা মুশকিল। তবে কিনা সংক্ষেপে গোয়ালিয়র ঘরানার ইন্টারেস্টিং গল্পগুলো লেখাই যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাতেই কুমারপ্রসাদবাবু প্রায় সবই লিখে গিয়েছেন, আর বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন, সে সুসাহিত্য পড়ে অনেকেই মার্গ সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন, তারপর আর কিছু লিখে লাভ আছে কী?

ব্যক্তিগতভাবে, আমার যদিও কুদরত রঙবিরঙ্গী পড়তে অসুবিধা হয়েছে, (মারবেন না প্লিজ, বলছি) বই হিসেবে পড়তে আমার চমৎকার লেগেছে, কিন্তু বিষয়বস্তু প্রায় সবটাই মাথার ওপর দিয়ে গেছে। সেটা হওয়ারই ছিল, কারণ এই গ্রন্থ লেম্যানদের জন্য নয়। যারা কিছুটা জানেন, কিছুটা শুনেছেন, আরো অনেকটা জানতে চান, তাদের জন্য অবশ্য লেখাটা অসম্ভব মূল্যবান। কিন্তু আমাদের মতো পাবলিক, যারা এ বি সি ডি জানে না, তারা ইংরেজি শর্ট স্টোরি রাইটিং এর কেরামতি কী বুঝবে? প্রথমেই এই বই তুললে ঝামেলা হতে পারে! বই থেকেই একটা উদাহরণ দিচ্ছি--

"আমি সামান্য বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা নিয়ে যা মনে করি, তা বলতে গেলে গোয়ালিয়র এর বৃদ্ধ গায়ক শরতচন্দ্র আরোলকরের উক্তি আগে শোনাতে হয়। তাঁর বক্তব্য, আমাদের বারো শ্রুতিও নেই, আমাদের সুর নদীর মতো প্রবাহিত ধারা, তার জায়গায় জায়গায় আমরা ঘাট বেঁধে দিয়েছি। এটা কোমল রেখাব, এটা ভৈঁরোর অতি কোমল রেখাব, এটা কাফির কোমল গান্ধার, এটা জয়জয়ন্তীর, এটা নায়কীর এবং এটা দরবারীর ইত্যাদি। এইটাই থান কথা। আমরা ভারতবাসী, হিন্দু হই, মুসলমান হই, আমরা চাই সিস্টেমাইজ করতে, পুঁথিতে লিখে শাস্ত্র অকাট্য বলে বাক্সবন্দী করতে চাই আমাদের ঐতিহ্য। 

আসলে আমাদের মার্গসঙ্গীত অন্যান্য সঙ্গীত থেকে ভিন্ন। কারণ আমাদের গানে মীড় আছে, সুত আছে, ঘসিট আছে। আমরা এক সুর থেকে অন্য সুরে যেতে হলে লাফিয়ে যাই না, ভেসে যাই। তারই ফলে ভীমপলশ্রীর মতো রাগে আরোহণে কোমল গান্ধার ও কোমল নিখাত চড়ে যায়। অবরোহণে সেই পর্দাই নেমে যায়, তাদের স্থান ভিন্ন!"

পড়তে চমৎকার লাগল। তাই না? আমাদের সুর নদীর মতো, সেই সুরের দরিয়ায় ঘাট বেঁধেছে ভারতের শিল্পীরা। কিন্তু এরপর তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন, সবকিছু আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাবে। বারো শ্রুতি, কোমল রেখাব, মীড়, ঘসিট, কোমল গান্ধার, আরোহণ অবরোহণ, রাগরাগিণী, ভাইব্রেশন, বাদ্যযন্ত্র, ভূপালির গান্ধার, হাম্বীর এর ধৈবত...আমাদের মতো এক শ্রেণীর বোকা পাঠক আছে যারা কিচ্ছুটি জানে না। এসব খায় না মাথায় দেয় কেউ আমাদের আঙুল ধরে শিখিয়ে দেয়নি। যে সময় প্রথম আমি বইটা পড়েছি, আমার মিনিমাম পসিবল আইডিয়াও ছিল না। তাহলে আর বইয়ের রস উপভোগ করা হবে কী করে? 

আমার ধারণা, একদম ক অক্ষর গোমাংসের জন্যও অবশ্য লেখা যায়, যদি আগে থেকে অব্জেক্টিভ ক্লিয়ার করে দেওয়া হয়। ফোকাস হল, তানসেন চাই না, চাই বাচ্চা লেভেলের কানসেন। 'ফনকার' চাই না, 'শুনকার'-এর প্রাইমারি লেভেল পৌঁছাতে পারলেই হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল ঠাট বজায় রেখে ঘুরতে পারবে। কিন্তু ওই লেভেলে পৌঁছাতে গেলেও আগে পাঠককে ধরে রাখা দরকার, তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আগে গান না শুনিয়ে গানের গল্প শোনানো হোক। গানের গল্পের মধ্যেই মাঝেমাঝে গানও আসে, ঠিক যেমন কল্পবিজ্ঞানে বাস্তব বিজ্ঞানও আসে, স্পাই গল্পে রাজনীতি আর অর্থনীতিও ঢুকে পড়ে, তখন সেটা গল্পের খাতিরেই জেনে নিতে হয়। গানও শুনে ফেলতে হবে, আর গল্পের খাতিরেই মন দিয়ে শুনতে হবে। কী করে? আরো কয়েকটা গল্প বলে বোঝানোর চেষ্টা করি।

আগেই বলেছি ভাইয়ের মৃত্যুর  পর বেশ কয়েক বছর হদ্দু খান একা একা সঙ্গীত সাধনা করেছেন, গোয়ালিয়র এর খেয়াল (খেয়াল মানে আসলে ইম্যাজিনেশনই, এ হল ধ্রুপদের নেক্সট ভার্সন আর কি! কিছুটা ডাম্ব ডাউন করে বন্দিশ মানে লিরিক্সে জোর দেওয়া, যদিও আগ্রার মতো অনেক ঘরানায় খেয়ালকে ধ্রুপদের মতো গাওয়া হত। সোজা কথায়, আপনার যদি ক্লাসিকাল শুনে ঘুম পায়, তাহলে যেটা শুনে কম ঘুম পাবে, সেটা সম্ভবত খেয়াল। ব্যতিক্রম বাদে!) গায়েকিকে আরো স্ট্রং করেছেন। তাঁর ছেলেগুলোও ছিল এক একটা জিনিস। তাঁর ছোট ছেলে ছোটে মুহম্মদ খান নাম করেছিলেন, কিন্তু গোয়ালিয়র ঘরানার মিস্ট্রি ম্যান হল তাঁর বড় ছেলে রেহমত খান। এই আধপাগলা, নেশাখোর, পথপাগল লোকটা সারা দেশে ঘুরেছেন, কখনও বেনারস কখনও নেপাল কখনও বা মহারাষ্ট্রের সাংলি গিয়ে ডেরা বেঁধেছেন, গেয়েছেন তুলনায় কমই। কিন্তু যাঁরা সেই গান শুনেছেন, তাঁরা সবাই রেহমত খানের নাম শুনলে চোখ বন্ধ করে কানে হাত দেন। প্রায় একশো বছর আগের একটা রেকর্ডিং আছে, কিন্তু ইটুকু শুনলেই ভদ্রলোকের গলার জোর বুঝতে পারবেন!

https://www.youtube.com/watch?v=PR_NyQ4AyM4

যাই হোক, হদ্দু খান  ভাইয়ের মৃত্যুর ট্রমা কাটিয়ে গোয়ালিয়র মহারাজ জিওয়াজি মহারাজ সিন্ধিয়ার দরবারে গায়ক হিসেবে যোগ দেন, কিন্তু দুই ছেলের চেয়েও তাঁর বেশি সফট কর্নার ছিল চচা বড়ে মুহম্মদ খান (যাঁর সামনে গাইতে গিয়ে ভাই হাসসু প্রাণ হারিয়েছেন) এর ছেলে মুবারক আলি খানকে নিয়ে। ইনি অলওয়ারের রাজার কাছে গাইতেন, কিন্তু বড্ড মুডি ছিলেন। ইচ্ছে না হলে তাঁর গান জমত না, সে সামনে রাজাই থাকুক আর জিবেগজাই থাকুক। তা সেবার জিওয়াজি রাজ সিন্ধিয়াকে ভাইয়ের গান শোনাবেন বলে জোর করে নিয়ে এসেছেন, তা মুবারক খান দরবারে বসে বিশাল বিশাল হাই তুলে এমন এক গান ধরলেন যে সবাই হুটিং করতে লাগল, হদ্দু খান লজ্জায় মাটিতে মিশে যান আর কি। জিওয়াজি রাও চোখ নাচিয়ে বললেন, "এ কোন রোদ্দুর রায়কে ধরে আনলে হে? এর চেয়ে ভালো তো আমিই গেয়ে দেব!"

হদ্দু খান মুখচুন করে ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এর এক সপ্তাহ পরেই একজনের বাড়িতে রাবড়ি জিলিপি খেতে গিয়েছেন মুবারক খান, সেখানে কথায় কথায় গানের আসর জমে উঠল। মুবারক খান মুডে এসে গেলেন আর এমন গাইতে লাগলেন যে পাড়াপড়শিরা এসে ভিড় করে দাঁড়াল। রাস্তাঘাট ফাঁকা, গরুতে সবজি খাচ্ছে, বেড়াল কুকুর এসে পেঠা খেয়ে নিচ্ছে, কারো হুঁশ নেই। সেই গান কানে আসতেই হদ্দু খান পড়িকিমরি করে ছুটলেন, রাজার কাছে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, "চলুন স্যার। উস্তাদ কো মুড আ গয়া!"

রাজাগজা বলে কথা, বললেই পাড়ার মজলিশে যাওয়া যায় না। কিন্তু এই রাজাও ছিলেন তেমন গানের ভক্ত। মাহুতকে চার লাত্থি মেরে ওঠালেন, বেচারির আফিমের নেশা ছিটকে গেল। হাতিতে করে রাজা চললেন গান শুনতে। কিন্তু তাঁকে দেখে ওস্তাদের মুড যদি বিগড়ে যায়? হদ্দু খান নিজে আগেভাগে দৌড়ে গেলেন, সবাইকে কানে কানে বললেন কেউ টুঁ শব্দ করবে না রাজাকে দেখে। আসর বসেছিল একতলার ছাদের ঘরে, রাজার হাতি এসে হাজির হল গলির মধ্যে, মাহুত হাতিকে একদম বাড়ির কাছে নিয়ে গেল, রাজামশাই চুপিচুপি জানলায় কান লাগিয়ে মুবারক খানের তান শুনতে লাগলেন। মুবারক চোখ বন্ধ করে তান লাগাচ্ছেন, জিওয়াজি রাও চোখ বন্ধ করে শুনছেন। হাতিটাও নাকি চোখ বন্ধ করে  কান নাড়িয়ে তারিফ করছিল। কয়েক ঘণ্টা এরম চলল। গান শেষ হলে রাজামশাইকে দেখে মুবারক খান থ। তিনি লজ্জায় কিছু বলতে পারছেন না। রাজামশাই ইনামের বরসাত করে বললেন, "আপনিই শিল্পী স্যার। সবাই রাজাদের জন্য গান, আপনি নিজের জন্য গান। মিঁয়া তানসেনের গুরু স্বামী হরিদাসের মতোই আপনি অমর হয়ে থাকবেন!"

রাজাগজাদের আর্ট আর কালচার নিয়ে এই প্যাশন শুধু গোয়ালিয়রেই ছিল না। সময় বদলায়। একসময় জিওয়াজিরাজ সিন্ধিয়া মারা গেলেন, রাজকুমার ছোট, গোয়ালিয়র এস্টেট কস্ট কাটিং করতে গিয়ে গায়কদের  বেতন কমিয়ে দিলেন। অনেক সাধারণ মানুষ দশ টাকাও পায় না, এদিকে গাইয়েরা দু একজন হাজার টাকাও মাইনে পাচ্ছেন, এস্টেটকে দোষ দেওয়াও যায় না। হদ্দু খান বা গোয়ালিয়রের তাঁর ভাইপো নত্থে খান (যিনি তাঁদের প্রথম গোয়ালিয়রে ডেকে পাঠিয়েছিলেন) তারা পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। এরা দুনিয়াদারি কিছুই বুঝতেন না, সের সের জিলিপি খেতেন, মালাই খেতেন, পোলাও কালিয়া খেয়ে রেয়াজ করতেন, বখশিশের টাকা সাধারণ মানুষকে দিয়ে দিতেন! অনেকে ভাবল, গোয়ালিয়র গায়েকির এই শেষ! এরা এবার যাবে কোথায়, খাবে কী? কিন্তু এই ঘটনার কিছু বছর আগেই হদ্দু খান এমন এক কাজ শুরু করেছিলেন যা এই ঘরানার ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

মহারাষ্ট্র থেকে আসা বেশ কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার তখন গোয়ালিয়রে থিতু হয়েছিল। এরা অনেকেই ফাটাফাটি কীর্তন গাইতেন, কিন্তু ক্লাসিকালের বেস ছিল না। প্রথমে হদ্দু খান আর তারপএ নত্থে খানের দত্তক পুত্র নিসার হুসেইন খান এদেরকে গান শেখাতে শুরু করলেন। আমি যতটা সহজে লিখে দিলাম, ব্যাপারটা ততোটাও সহজ নয়। প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা, গানবাজনা পরিবারের বাইরে যাওয়া মানে বিশাল ব্যাপার, উপযুক্ত মনে না হলে বাপ ছেলেকেও শেখাত না, সেখানে মুসলমান ওস্তাদরা অন্য মুলুক থেকে আসা হিন্দু পণ্ডিতদের তালিম দিচ্ছেন মানে কেলেংকেরিয়াস ব্যাপার। মারাঠি ব্রাহ্মণদেরও কুর্নিশ, তারা জেঁচে মুসলমান ওস্তাদজীর কাছে শিখতে এসেছিলেন। হদ্দু খানের প্রথম শিষ্য ছিলেন বাসুদেও রাও জোষী, এদিকে নিসার অলি খান তালিম দিচ্ছেন রামচন্দ্র চিচবড়করকে। এই দুই মারাঠি মানুষ 'আতা মাঝি সাটাকলি' বলে এইসা গান শিখলেন যে গোয়ালিয়র ঘরানার একটা শাখা পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রের পার্মানেন্ট সিটিজেন হয়ে গেল। 

সে কথা পরে, কিন্তু এস্টেট মাইনে কমিয়ে দেওয়ার সময় বাসস্থান আর খাওয়াপরার যে অভাব দেখা দিল, তার সুরাহা করতেও এগিয়ে এলেন এই হিন্দু পরিবারের মানুষ। হদ্দু খান নিজে বেশিদিন বাঁচেননি, বড় ছেলে রেহমত খান তো ভবঘুরেই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিসার হুসেইন খান আজীবন শংকর রাও পণ্ডিতের পরিবারের কাছে অতিথি হয়ে থেকেছেন। (ভবিষ্যতে এই রাও ফ্যামিলি গোয়ালিয়র ঘরানার গায়েকিকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নিয়ে গেছে। কৃষ্ণরাও শংকর রাও পণ্ডিত গোয়ালিয়রে শংকর গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয় নির্মাণ করেছেন, একগাদা বই লিখেছেন, রেডিওতে কাজ করার সময় অসংখ্য বন্দিশ রেকর্ড করেছেন, পদ্মভূষণও পেয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরিরাও কম যান না। লছমন রাও পন্ডিত এই সেদিন অব্দি গোয়ালিয়রের সবচেয়ে সিনিয়ার গায়ক ছিলেন, ইউটিউবে তাঁর প্রচুর রেকর্ডিং আছে। তাঁর মেয়ে মিতাও প্রতিভাবান শিল্পী, মিতা পণ্ডিতের লেখা বই পড়ে অনেকেই এইসব গল্প জেনেছেন) একজন মাংহখেকো মুসলমানকে মারাঠি ব্রাহ্মণ ফ্যামিলি ঘরে এনে অতিথি করেছেন মানে কল্পনা করতে হলে গানবাজনা নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ ঠিক কতটা সেন্সিটিভ ছিলেন! গঙ্গা জমুনি তেহজিব কথাটা হাওয়া থেকে আসেনি! তাই বলে নিসার হুসেইন এর মেজাজ কম ছিল না, শংকর রাও এর পরিবারে তিনি রাজার মতো থাকতেন।

সকালবেলা কুয়োর কাছে গিয়ে বসে আলাপ ধরতেন, সবাই মিলে তখন কুয়ো থেকে বালতি করে জল তুলে তাঁকে স্নান করাত। এই স্নানের কোনও সময় ছিল না, যতক্ষণ না স্যার থামতে বলছেন, গান চলবে, স্নানও চলবে। তারপর আহার। সেই মেওয়া মিষ্টি মালাই দেওয়া খাবার, গোস্তও রাঁধতে হত ওস্তাদের জন্য, অনেক সময় শংকর রাওয়ের ঘরের লোকজন না খেয়ে আগে ওস্তাদজিকে খাওয়াত, টাকাপয়সা ধার নিয়ে আসত, কিন্তু মুখ খুলে একবারের জন্যও কমপ্লেন করত না। বহুবছর এরকম চলেছে। বিনিময়ে নিসার হুসেইন শিষ্যদের প্রাণ দিয়ে শিখিয়ে গেছেন। সেই যুগে অনেক নামী নামী ওস্তাদ শংকর রাও এর বাড়িতে এসে আসর জমাত, এমনকি একবার (সম্ভবত ১৮৯২ সালে) নাকি স্বামী বিবেকানন্দও এসেছিলেন। তিনি পাখোয়াজ বাজিয়ে গানও গেয়েছিলেন বলে  জানা যায়। 

নিসার হুসেইন ছিলেন মেজাজি লোক, ট্রেনে করে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বেরোতেন। এদিকে ট্রেনে উঠলে গাড়ির শব্দ শুনে তাঁর গানের ইচ্ছে হত। অনেকবার নাকি প্ল্যাটফর্মে বসেই গান গাইতেন, ট্রেন হয়ে যেত লেট। একবার কলকাতায় এসেছেন, ফোর্ট উইলিয়ামে নাকি পার্টি চলছে, ওস্তাদজি গটমট করে ঢুকে গেলেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে সবাই অনুরোধ জানাল, একটা গান হয়ে যাক। আর যায় কোথায়, নাসির হুসেইন হিন্দুস্তানি রাগের ওপর 'লং লিভ দ্য কুইন' গানটা গেয়ে দিলেন, সবাই তাজ্জব। ভারতীয় রাগে ইংরেজি গান, কেউ এমনটা কস্মিনকালেও ভাবেনি। লাটসাহেব অনুরোধ করলেন, "আরেকটা হোক!"

নিসার হুসেইন ট্রেনে করে এসেছেন, ট্রেনের দুলুনি তাঁর মাথায় ছিল। তিনি রেলের সিটি আর ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তালবদ্ধ তরানা গাইতে লাগলেন, সবাই ধন্য ধন্য করে উঠল। লাটসাহেব খুশি হয়ে বললেন, আপনার আর কোনোদিন ট্রেনে টিকিট কাটতে হবে না। 

(লছমন রাওরা এই গানটা শুনিয়েওছেন কয়েকবার। একটা রেকর্ডিং পেয়েছি খুঁজে। তেইশ মিনিট থেকে শুনুন। 

https://www.youtube.com/watch?v=YLSWmS8EZus) 

নিসার হুসেইন খান আর হদ্দু খানের শিষ্যরা শিখেপড়ে নিয়ে গোয়ালিয়রেই থেকে গেছিলেন। কিন্তু একজন ছিল, সে গান শেখার জন্য মহারাষ্ট্র থেকে গোয়ালিয়র এসেছিল। খালি পায়ে। হেঁটে।  প্রায় চারমাস পর গোয়ালিয়র আসার পর তাঁকে দেখে পুরো আধপাগলা ভিখারির মতো লাগছে, তাঁকে দেখেই সবাই দুরছাই করছে। অবশ্য তাঁর পরিবারের অনেকেই সত্যিই মাধুকরী করে দিন চালাত, ব্রাহ্মণ হয়ে তাঁদের জন্য সেটা অস্বাভাবিক ছিল না, অস্বাভাবিক ছিল মুসলমান ওস্তাদদের কাছে গিয়ে গান শেখা। কিন্তু এই মানুষটি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। 

কে জানত, এই ছেলেই আগামীতে গোয়ালিয়র ঘরানার পার্ফেকশনিস্ট হয়ে উঠবে। হদ্দু খান তাঁকে শুনে বলেছিলেন, আমার ভাই হসসু যেন ফিরে এসেছে। এইবার বলুন, কার কথা হচ্ছে?

(১. যারা এইসব শুনে ঠিক রস পাচ্ছেন না, বা এখনকার মতো এক্স ফ্যাক্টর পাচ্ছেন না, তাঁরা ওঙ্কার দাদরকরকে শুনতে পারেন, এই ছেলেকে শুনে নাকি এখনকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলেরাও সিগারেটে টান দিতে ভুলে যায়

https://www.youtube.com/watch?v=oACbmNkih0I 

২.যদি আগ্রহ থাকে আর হাতে সময় থাকে, ইউটিউবে রাগা কোয়েস্ট চ্যানেলে ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল বোঝানোর জন্য একটা ছোট ক্র‍্যাশ কোর্স আছে চৌঁতিরিশটা ভিডিওর, একদম স্বর সপ্তক কোমল স্বর থেকে রাগ অব্দি সব কিছু আছে, শুনে নিলে একটা ভাসাভাসা আইডিয়া থাকবে। কোনও একটা স্পেসিফিক টার্ম বুঝতে হলে গোপা চক্রবর্তীর চ্যানেলে একেবারে লেম্যান টার্মে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে ঠিকাই হোক বা লয় আর লয়কারির অন্তর

বলাবাহুল্য, এসব কথাই একদম আমার মতো টোটাল আনাড়িরদের জন্য। বাকিরা ইগ্নোর মারি!)

কৃষ্ণ শংকর রাও পণ্ডিত
লছমন রাও পণ্ডিত
রেহমত খান, হদ্দু খানর ছেলে
বংশতালিকা ও গোয়ালিয়র ঘরানা

বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

প্রকৃতির ধারাভাষ্যকার

 


থ্রি বডি প্রবলেম সিরিজের দ্বিতীয় বইয়ে ওয়ালফেসার প্রজেক্ট বলে একটা প্রজেক্টের উল্লেখ আছে। ভিনগ্রহী আক্রমণ ঠেকানোর জন্য মানবজাতি যে স্ট্র‍্যাটেজি ভাবছে, ট্রাইসোলারিস থেকে পাঠানো সোফোন সে সব আগেই জেনে যাচ্ছে। তাই ঠিক করা হয়, পৃথিবীর কয়েকজন মানুষকে ওয়ালফেসার করা হবে। সবাই তাদের সব কথা শুনবে,  যা বলবে তাই করবে, কিন্তু তাদের কোনও জবাব দিতে হবে না। কারণ, ওয়ালফেসাররা দুনিয়া বাঁচানোর জন্য গোপনে কাজ করবেন। এলিয়েন আক্রমণ ঠেকানোর জন্য স্ট্র‍্যাটেজি ভাববেন, কিন্তু মনে মনে। কী ভাবছেন, কেন ভাবছেন, এসব নিয়ে কোনও জবাবদিহি থাকবে না।

সত্যিই কি একজন ওয়ালফেসার হতে পারে? এমন একজন মানুষ, যাকে আমি চোখ বন্ধ করে ভরসা করব, তার কোনও অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করব না, তার ওপর বিশ্বাস রেখে নিজের জীবন, পরিচিতদের জীবন, গোটা মনুষ্যজাতি, গোটা জীবজগত, গোটা দুনিয়ার ভবিষ্যৎকে বাজি রাখতে পারব। অন্যদের কথা জানি না, আমার জন্য এমন এক মানুষ আছেন। সত্যি সত্যিই আছেন। তাঁর নাম ডেভিড অ্যাটেনবোরো। আজ তাঁর জন্মদিন। ৯৭ থেকে আজ তিনি ৯৮ তে পা রাখলেন। 

১৯৮০ এর দশকের প্রথমদিকের কথা। ব্রিস্টল এর হোয়াইটলেডিজ রোডে বিবিসির অফিস, সেখানে এক অদ্ভুত বিষয় নিয়ে মিটিং চলছিল। এজেন্ডা হল, একজন মানুষ যিনি বিবিসির সঙ্গে প্রায় চার দশক ধরে হিসেবে কাজ করছেন, তিনি পঁয়ষট্টিতে পড়েছেন, তাঁকে আর ফ্রিলান্সার হিসেবেও কাজে রাখা যায় না। কিন্তু মুশকিল হল, তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, বিবিসির বর্তমান ও প্রাক্তন আধিকারিকরা, 'ট্রায়াল অফ লাইফ' বলে যে শেষ সিরিজটি ভদ্রলোক করছেন তাঁর ক্রিউ মেম্বার, বায়োলজিস্ট আর ন্যাচারিস্টদের টিম, এমনকি জুনিয়ার প্রোডিউসার মাইক গুন্টন কেউই কোনও বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। ভদ্রলোক যে ধরনের প্রোগ্রাম করে এই ইউনিটটাকে দাঁড় করিয়েছেন,  তাতে বিবিসির ভিউয়ারশিপ লক্ষগুণ বেড়েছে। গ্লোবাল হিট শুধু নয়, এই কাজগুলো ন্যাচারার ওয়ার্ল্ড আর ডকুমেন্টারি ডিভিশনে একটা নতুন বিপ্লব এনে দিয়েছে, আরো ভালো করে বলতে হলে বলা যায় এই ভদ্রলোক ওয়াইল্ড লাইফ ফিল্মে একটা নতুন ভাষাই গড়ে তুলেছেন। এমন একটা ভাষা, যা শুনতে পরিচিত মনে হলেও একেবারেই অন্য। এই ভাষাটি আর কেউই বলতে পারে না। মাইক মিনমিন করে কথাটা জানাতেই ইউনিট ডাইরেক্টর দাবড়ে উঠে বললেন, "মেলা ফচফচ করছ কেন? কোন ভাষা বলে ওই বুড়োটা?"

শুনে মাইক থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর এদিক ওদিক তাকালেন। কী করে বোঝাবেন? এমন সময় পিছন থেকে একটা নতুন ছোকরা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। গুটিগুটি পায়ে সামনে এসে বলল, "অ্যাটেনবোরো স্যার জীবজন্তুর ভাষা জানেন।"

ডাইরেক্টর হা হা করে হাসতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ঘরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। সবাই ছেলেটাকে সমর্থন করছে। এক বিজ্ঞানী কাম প্রোগ্রাম এক্সপার্ট বললেন, "ঠিকই বলেছে। শুধু তাই নয়, আমরা গাছপালা নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য লভ্য করাই, স্ট্যাট দিই, কিন্তু ডেভিড মনে হয় গাছের সঙ্গে কথা বলে। আমি নিশ্চিত, ও ছাড়া এই কাজ আর কেউই পারবে না।" 

আবারও সমর্থনের গুঞ্জন শোনা গেল। ডাইরেক্টর হাঁ করে রইলেন কিছুক্ষণ, মাইকের দিকে চেয়ে বললেন, "তার মানে ওই বুড়োটা না থাকলে ওয়াইল্ডলাইফ আর নেচার নিয়ে কোনও কাজ করা যাবে না? ও যদি পশুপাখিদের ভাষা জানে, গাছের ভাষা জানে, অন্য কেউই জানবে। না জানলে শিখে নেবে। তাকে খোঁজো!"

মাইক এইবার কিন্তু কিন্তু করে বললেন, "না বস। ডেভিড স্যার পশুপাখি প্রকৃতির ভাষা জানেন, কারণ প্রকৃতি তাঁকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। বিবিসি ফিবিসি নিয়ে তাঁর কিছু আসে যায় না, তাঁর জায়গা অনেক ওপরে। তিনি আমাদের এই গ্রহের, এই প্রকৃতির ধারাভাষ্যকার। নো ওয়ান ক্যান রিপ্লেস স্যার ডেভিড!"

সেদিনের মিটিং এ কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। তার পরের বছরও না। তার পরের বছরও না। পাঁচ বছর পর অ্যালেস্টার ফদারগিল যখন বিবিসি ন্যাচারাল হিস্ট্রি ডিভিজনের ডাইরেক্টর হয়ে এলেন, তখনও এই বিষয়টা উঠল, কিন্তু আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। দু একবার ওপর থেকে চাপ এসেছিল স্যার ডেভিডকে সরানোর জন্য বা তাকে পরামর্শদাতা হিসেবে রেখে অন্য কাউকে কাজটার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। ফদারগিল জানিয়ে দিয়েছিলেন, "সেটা খুব সেন্সিবল হবে বলে মনে হয় না। স্যার ডেভিড হ্যাজ অলওয়েজ বিন আ গ্রেট ওকে ট্রি আন্ডার হুইচ ইটস বিন হার্ড ফর আ স্যাপলিং টু গ্রো।" এরপর বছর গড়িয়েছে।  কিন্তু স্যার ডেভিড অ্যাটেনবোরোর কোনও বিকল্প পাওয়া যায়নি। মাইককে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এসেছে, "আমাদের কাছে উত্তর নেই কে ওঁকে রিপ্লেস করবে? উত্তরটা আমরা জানতেও চাই না!"

ডেভিড অ্যাটেনবোরো এমন একজন মানুষ, যাকে দেখেই মনে হয়, আমাদের পৃথিবীটা কত সুন্দর! এক একটা পোকা, এক একটা মাকড়সা, একটা চুনো মাছ, একটা ঘাসফুল... সব জায়গায় যে প্রকৃতির নিবিড় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, যে অমলিন স্নেহ আর মায়ার বাঁধন দিয়ে আমাদের এই গ্রহের পরিবেশতন্ত্র গড়ে উঠেছে, তিনি হাত ধরে না দেখিয়ে দিলে, না চিনিয়ে দিলে, আমরা জানতেও পারতাম না। এমন একজন মানুষ, যিনি বিজ্ঞানী নন, ন্যাচারাল সায়েন্স নিয়ে রিসার্চ করেন না, পশুপাখি বিশেষজ্ঞ নন, অথচ কোথাও না কোথাও তিনি তাঁদের সবাইকেই ছাড়িয়ে গিয়েছেন। হি ইজ আ ড্রিমার, আ স্টোরিটেলার, আ লাভার অফ দিজ ওয়ার্ল্ড। তাঁর চোখ দিয়ে আমরা এই জগতকে চিনেছি, ভালোবেসেছি, তাঁর চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। আঙুল ধরে তিনি আমাদের আফ্রিকার জঙ্গলে নিয়ে গেছেন, মেরুপ্রদেশে নিয়ে গেছেন, কোস্টারিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গেছেন। যত্ন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, একটা পোকা আর একটা সিংহ... দুজনেই সুন্দর। একটা নাচানি পাখি আর একটা গুবরে পোকা, তাদের দুজনেরই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। একটা গোরিলা বা একটা হাঙর, কেউই হিংস্র নয়, কেউই শুধু শুধু অন্যদের আক্রমণ করে না, সবটাই জীবনচক্র। কখনও নিষ্ঠুর, কখনও ভীষণ সুন্দর। লাইফ অফ আ প্ল্যানেট। লাইফ অন আ প্ল্যানেট। দুটোই জীবন। আর জীবন থেমে থাকে না। লাইফ গোজ অন।

ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলেন ডেভিড। বনবাদাড়ে ঘুরতেন, স্যালামান্ডার নিয়ে এসে পুকুরে রাখতেন, উপুড় হয়ে শুয়ে পোকামাকড়দের জীবন দেখতেন, ব্যাঙের ছাতা আঁকতেন। ফল ফুল পাখি পাতা পোকা মাকড়সা সব কিছুকেই তাঁর ইন্টারেস্টিং মন হত, আহত পাখি বা পশু পেলে বাড়ি নিয়ে আসতেন, চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলতেন। জমিয়ে রাখতেন পাথর, ফসিল ইত্যাদি। এই আটানব্বই বছর বয়সেও তাঁর সংগ্রহের শখ বজায় আছে, গোটা পৃথিবীর ট্রাইবাল আর্ট, ফসিল, ছবি, গান ইত্যাদির সংগ্রহ আছে তাঁর কাছে।

শিক্ষকদের বাড়ি, দু ভাই ছিল, বাবা ছিলেন প্রিন্সিপাল, মা পিয়ানো শিল্পী, সবাই উৎসাহও দিত। ডিনার টেবিলে কথা হত এস্কিমো বা ইনুইটদের নিয়ে, পিগমিদের নিয়ে। সেই বয়সেই ডেভিড অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে, দুজনেই একে অপরের পরিপুরক। এই আগ্রহের বশে তিনি এ নিয়ে আরো পড়াশোনা শুরু করেন, দশ বছর বয়সে 'গ্রে আউল' বলে এক কঞ্জারভেশনিস্টের বক্তৃতা শুনে তাঁর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।

ন্যাচারাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করার সময় টিভির কথা তাঁর মাথাতেও ছিল না, তিনি পেশাগতভাবে বায়ো অ্যান্থ্রপলোজিস্টের কাজই করতেন। তবে পঞ্চাশের গোড়ার দিকে আসতে আসতে তাঁর মনে হয়, পছন্দের অন্য কাজ পেলে করাই যায়। প্রথমে নেচর রিলেটেড ছোটদের বইয়ের সম্পাদনার কাজ, তারপর তার নজর যায় টিভির দিকে। তখন নতুন নতুন টেলিভিশন এর বাজার, টক শো এর জন্য বিবিসি একজন হোস্ট খুঁজছিল। ডেভিড অডিশন দেন এবং...পুরো ফেলটু মারেন। এই ঘটনাটা মনে রেখে দিন। প্রকৃতির ধারাভাষ্যকার হিসেবে যিনি পরিচিত, তিনি বাচিকশিল্পী হিসেবে ফেল মেরেছিলেন! তাহলে সব কিছুই সম্ভব, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভাগ্যিস ম্যারি অ্যাডামস বলে একজন ছিলেন, তিনি ডেভিডের গলায় কিছু একটা দেখেছিলেন। তাঁর কথায় ডেভিড ট্রেনিং এ জয়েন করেন এবং কয়েক বছর পরেই বিবিসির ফুল টাইম এমপ্লয়ী হয়ে যান। কিন্তু তা হলেও ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ড নিয়ে কাজকর্ম শুরুই হত না, ব্যাপারটা ঘটে প্রায় কাকতালীয় ভাবেই। ফি সপ্তাহে লন্ডন জু গিয়ে চক্কর মারতেন ডেভিড, চিড়িয়াখানার কিউরেটর জ্যাক লেস্টারের সঙ্গে সখ্যও ছিল। সেখান থেকেই জীবজন্তুর স্বভাব নিয়ে একটা তিন পার্ট শো এর পরিকল্পনা হয়, নাম অ্যানিমাল প্যাটার্ন, সঙ্গে ছিলেন ন্যাচারালিস্ট জুলিয়ান হাক্সলে। স্টুডিও বাউন্ড শো, আউটডোর শুট নেই, বেশি কেউ দেখেওনি। কিন্তু জ্যাক লেস্টার চাইছিলেন চিড়িয়াখানায় জীবজন্তু ধরে আনার জন্য যে এক্সপিডিশন হয় (না পড়ে থাকলে তিন গোয়েন্দা পড়ে নিন) সেই নিয়ে একটা আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ করতে। সেই থেকেই 'জু কোয়েস্ট' সিরিজের পরিকল্পনা। 

লেস্টার শেষ মুহুর্তে অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর ১৯৫৪ সালে ডেভিড সেই প্রথম টিভি প্রেজেন্টার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর জনপ্রিয়তা বাড়তে এই ধরনের কাজ আরো হয়, সাতান্ন সালে বিবিসি ব্রিস্টলে ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইউনিট খুলে বসেন। বাকিটা ইতিহাস। ডেভিড অ্যাটেনবোরো বিবিসির তরফ থেকে কতরকম শো করেছেন আর কোথায় না গেছেন! আফ্রিকার সাভানা থেকে অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে, আন্টার্কটিকা থেকে সাহারায়, হারিয়ে যাওয়া ট্রাইবের অনুসন্ধান, আর্কিওলজিকাল অভিযান, প্রাচীন সভ্যতা, একের পর এক দুর্দান্ত কাজ সব। আর ওয়াইল্ড লাইফ এর কথা আর কীই বা বলি? তানজানিয়ার হাতিদের জীবনচক্র নিয়ে কাজ করেছেন, গোরিলার আসরে বসে গল্প বলেছেন, জাগুয়ার আর হাঙরকে নিয়ে সিরিজ করেছেন, চেনা অচেনা প্রজাতির বহু পোকমাকড়, পাখি, জীবজগত এর খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। দুনিয়ায় কেউ স্যার ডেভিডের মতো এতটা ব্যাপ্তিতে, এতটা সময় নিয়ে, এতটা এম্প্যাথি নিয়ে ভ্রমণ করেনি, এতটা খুঁটিয়ে কেউ প্রকৃতিকে দেখেনি, তাদের সঙ্গে কথোপকথন চালায়নি! পৃথিবী ও মানবসভ্যতার যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে, শিল্প সাহিত্য স্থাপত্য জীবজগত... যা যা মানুষ কল্পনা করতে পারে, স্যার ডেভিড তার প্রায় সবকিছু কভার করে বসে আছেন। তিনি আমাদের প্রজাতির সেরা ট্রাভেলার, ফর অল টাইম।

১৯৭৯ সালে লাইফ সিরিজ শুরু হয়। লাইফ অন আর্থ-এ মানুষ নতুন করে তাদের পরিচিত পৃথিবীর মুখোমুখি হয়,এ যেন এক অন্য জগত, এক নতুন দুনিয়া ক্রমে উন্মোচিত হতে থাকে স্যার ডেভিডের হাত ধরে। বিংশ শতাব্দীর একটা সময়, যখন অ্যান্থ্রপ্পসিন অ্যাক্টিভিটি ক্রমে প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে চাইছে, তখনও প্রকৃতির মধ্যে এত রহস্য, এত সৌন্দর্য, এত চমৎকার বিস্ময় লুকিয়ে আছে জানলে বিস্মিত হতে হয়। আঙুল ধরে যে মানুষটা আমাদের এসব চেনাল, তাঁর দায় ছিল না কোনও। পদোন্নতি হতে হতে একসময় বিবিসির ডাইরেক্টর পদে চলে গেছিলেন, কিন্তু ফিল্ডে থাকার তাগিদ তাঁকে সেই পদ প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করেছিল। গুরু থেকে গিয়েছিলেন, আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য, স্বপ্ন দেখা শেখানোর জন্য। আজও তিনি দেশ দুনিয়া ঘুরছেন, বই লিখছেন, ডকু করছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর তাঁর অগাধ আস্থা। 

যদি জীবনে কেবল একজন মানুষ সম্পর্কে জানতে হয়, স্যার ডেভিড অ্যাটেনবোরো সম্পর্কে জানুন, পড়ুন। ছেলেমেয়েকে কী করে জীবনে ভালো মানুষ হয়ে ওঠার কথা বোঝাবেন যদি বুঝতে না পারেন, আমার অনুরোধ, এই মানুষটা সম্পর্কে জানান। তাঁর লেখা বই উপহার দিন, তাঁর প্রোগ্রামগুলো দেখান, সঙ্গে নিজেও দেখুন। আমার বিশ্বাস, তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলে আগামী প্রজন্ম এই পৃথিবীটাকে বাঁচিয়ে রাখার সঠিক পথ খুঁজে নেবে, নেবেই।

শুভ জন্মদিন স্যার অ্যাটেনবোরো। দু'শ বছর বাঁচুন, মেরি উমর ভি আপকো লগ জায়ে!











মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪

সিটি অফ মিউজিক

 

কয়েকমাস আগে ইউনেস্কো ভারতের একটা শহরকে সিটি অফ মিউজিক বলে ভূষিত করেছে। ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ক্রিয়েটিভ সিটিজের সূচিতে আরো কিছু শহর আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে এই শহরটার নাম দেখে অনেকেরই ভ্রুকুঞ্চন হয়েছিল দেখেছি,তার কারণও আছে। 

প্রথমেই বলে দিই, শহরটার নাম গোয়ালিয়র। ভারতের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত এই শহরটায় আমি নিজে একসময় মাস চারেক থেকেছিলাম, আর খুবই সন্ত্রস্ত হয়েই থাকতে হয়েছিল সে সময়টা। না, চম্বলের দস্যুরা আজকাল আর শহরে এসে উৎপাত করে না, ল্যান্ড মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যেও ছিল না। যা ছিল, তা হল ধুলোর ভয়। ট্রিপল আইটির সবুজ ক্যাম্পাস থেকে বাইরে বেরোনোর পর যে ফিরে আসত, তাকে দেখে আর চেনার কোনও উপায় থাকত না। 

এমন ধুন্ধুমার ধুলোসর্বস্ব শহর যে একযুগ ধরে ভারতীয় ক্লাসিকালের পূণ্যভূমি ছিল সে কথা বিশ্বাস করা একটু কঠিন তো বটেই। তবে কথাটা ভুল নয়। কারণ, গোয়ালিয়র একমাত্র শহর যেখান থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার সূত্রপাত। আর সম্ভবত এই শহরটাই বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, গোয়ালিয়র ঘরানার বেসক্যাম্প চিরকাল গোয়ালিয়রই ছিল, নাম এক রেখে রাজধানী বদলে নেওয়ার নীতিতে তাদের বিশ্বাস ছিল না। গোয়ালিয়র এর সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক ঠিক কতটা প্রাচীন আর কতটা গভীর, সে কথা এখন আর অনেকেই জানে না। দেখে ভালো লাগল, ইউনেস্কো অন্তত সেই ইতিহাস ভুলে যায়নি। রাগ, রশক, রঞ্জ, আর রঞ্জিশের যে ঐতিহ্য এখানকার রিয়াসতের রক্তে মিশে আছে, সেটা বোঝানোর জন্য একটা গল্প বলা যাক। অনেকেই জানেন হয়তো, কিন্তু নিজে কিছু কিছু নতুন ঘটনা জেনেছি বলেই জার্নাল করে রাখছি আর কি!

মুশকিল হল, এই জগতটা এত বিশাল যে প্রতিটা গল্পের আগে আর পরে লক্ষ লক্ষ গল্প আছে। কী ছেড়ে কী বলব? আমার মতো বহু পাবলিক আছে, যারা ক্লাসিকাল সঙ্গীত সম্পর্কে কিস্যুটি জানে না, থাট তাল তান স্বর সব মিলে জগাখিচুড়ি, রাগ রাগিনী বোঝা তো অনেক পরের কথা। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ইউটিউব ঘেঁটে একটা ভাসাভাসা ধারণা হলেও অনেক। ঘরানা ফরানা শুনলে অনেকেরই মনে হয় হার্ড সাইফির গল্প এর চেয়ে সহজ। 

যাদের বাড়িতে গানবাজনার চর্চা নেই, তাদের এই সমস্যা হবেই। তবে কিনা, গান না বুঝলেও গানের গল্প বুঝতে অসুবিধা নেই। যে কোনও গানই হোক! তাই আমি চটি পরে জ্যাজ কন্সার্টে গেছি, আবার কিছু না বুঝেও সংকট মোচনের সঙ্গীত সভায় গিয়ে ধ্রুপদ খেয়াল ঠুমরি সব শুনে এসেছি। আমাদের মতো আনাড়িদের জানাই, মোদ্দা কথা হল, ধ্রুপদ হল ধ্রুব পদ, মানে এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ার সঙ্গীত, তাতে নিয়ম একদম ধ্রুব মানে স্ট্রিক্ট থাকে। বাকি সব পরে এসেছে। আগে ঘরানা বা স্কুল অফ মিউজিক ছিল না, ছিল বানী। বানী মানে ধরে নিন, কী করে এই নিয়ম ফলো করে গান গাওয়া হচ্ছে! ডাগুর বানী, নৌহর বানী, খণ্ডার বানী আর গৌহর বানী নিয়েই কাজ কারবার হত। পরবর্তীতে খেয়াল গায়েকি এলে শিল্পীরা দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গিয়ে থাকতে শুরু করে, তাদের জায়গায় এক একটা ঘরানা শুরু হয়। গোয়ালিয়র তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন, বা ফার্স্ট লিস্টেই নাম আসবে। অতরৌলী, জয়পুর, ক্যায়েরানা, রামপুর, পটিয়ালা, ম্যায়হর সহ একগাদা ঘরানা আছে, যদিও পরে সবাই ছড়িয়ে গেছে। এখন পটিয়ালার শিল্পীরা কোচিতে, ম্যায়হর স্কুলের গায়করা ভ্যানকুভারে বসে কন্সার্ট করছে। সব গায়েকির রহস্য ওপেন সোর্স প্রায়, তবুও আমজনতার আগ্রহ নেই। এককালে এমন অবস্থা ছিল, এক একটা রাগের গায়েকির রহস্য জানতে স্পাই লাগানো হত, একটা নামকরা শিল্পীর বন্দিশ পণ রেখে সোনাদানা হাতিঘোড়া ছয় মাসের রেশন পাওয়া গেছে, এমন নজিরও আছে। সে দিন আর নেই। 

যাকগে, ব্যাক টু গল্প। প্রথমেই যে বলছিলাম, রাগ (মানে সঙ্গীতের রাগ), রশক (জেলাসি), রঞ্জ (শোক) আর রঞ্জিশ (মানে দুশমনি বা আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক আর কি) নিয়ে এক একটা জমাটি গল্প আছে, শুনলে একদম গায়ে শিহরন জাগে। তবে একটু গভীরে ঢুকলে বোঝা যায়, প্রতিটা গল্পই আবার লেয়ার্ড, বহুস্তরীয়। রশকের গল্পে ইশক আছে, রঞ্জিশের গল্পে স্যাক্রিফাইসও পাওয়া যায়। কেমন? এই হল তার একটা উদাহরণ। যদি পড়েন, কী মানে উদ্ধার করলেন কমেন্টে জানাতএ পারেন!

১৮৫৯ সালে রেওয়ার গোবিন্দগড় প্রাসাদে একটা সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আদেশ দিয়েছেন মহারাজ রঘুরাজ সিং বাঘেল। অনেকের মতে, এই জায়গাতেই রেওয়া দরবারের রামতনু পাণ্ডে আর চন্দেরির ব্যায়েজনাথ মিশ্রার এক কম্পিটিশন হয়েছিল বেশ কয়েকশো বছর আগে (অনেকে আবার বলে, সেটা হয়েছিল আকবরের দরবারে। ঠিকঠাক কোনও প্রমাণ নেই) সেই দিনটা ইতিহাসের খাতায় উঠে গেছে। কেউ কনফিউজড হবেন না, রামতনু আর ব্যায়েজনাথ বলতে তানসেন আর ব্যায়জু বাওরার কথাই হচ্ছে। যাই হোক, এইবারের প্রতিযোগিতা আরো ভয়ানক। কারণ, যেই দুই পরিবারের গায়কদের মধ্যে কম্পিটিশন হবে, তাদের 'রঞ্জিশ'-এর গল্প সবাই জানে। গোয়ালিয়রের দুই যুবক হদ্দু আর হসসু খানের সঙ্গে মোকাবিলায় নেমেছেন তাদেরই চচা মানে বড় জেঠা বড়ে মুহম্মদ খান। বড়ে মুহম্মদ খানের তান শুনে গোটা হিন্দোস্তান সম্মোহিত হয়ে যায়, এদিকে হদ্দু-হসসু জুটিও কম যায় না, তারা কয়েকদিন আগে জয়পুরের দরবারে বড় বড় শিল্পীদের মুখে ঝামা ঘসে দিয়ে এসেছে। সবাই উত্তেজিত, রাজামশাই খোদ জমকালো পোশাক আর মনিমুক্তো দেওয়া দস্তানা পরে নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করছেন। সবাইকে চুপ করাতে তিনি বললেন, "দেখা যাক, কে বড়? রেওয়া না গোয়ালিয়র? কম্পিটিশন ইজ অন, নো ওয়ান উইল স্টপ টিল ডেথ। আজ দরবারে গানের নদী বইবে, সঙ্গে রক্তের নদীও বইবে নাকি?"

একদিনে বড়ে মুহম্মদ খান, অন্যদিকে হদ্দু আর হসসু খান। মুহম্মদ খান আলাপ শুরু করলেন, হদ্দু হসসু তাদের গায়েকি দিয়ে সেই আলাপকে এগিয়ে নিয়ে চলল। বোঝা মুশকিল দুই ভাই আলাদা আলাদা গাইছে। সুরের মূর্ছনায় দরবার গমগম করছে, সবাই সম্মোহিত হয়ে আছে। গোয়ালিয়র ঘরানার গায়েকিতে আলাপ আর তানেএ মাঝে 'বহলাওয়া' বলে একটা জিনিস আছে, (যদিও এই জিনিসটা পরে অনেক ভালো করে ইভলভ করেছে) আলাপ আর তানের মাঝের এই বোল বিস্তারের একটা নিজস্ব শৈলী আছে। তা বড়ে মুহম্মদ খান বহলাওয়া হয়ে তানে এসে গেছেন, হসসু আর হদ্দু খানও জোর তান লাগাচ্ছেন। সুরের যুদ্ধ তো নয়, যেন দুই দলের যোদ্ধারা তরোয়াল ভাঁজছে। একে বলে নঙ্গি তলোয়ার তান। সেকালে শ্রোতারাও সুরের সমঝদার ছিল, সবাই হাততালি দিয়ে এই যৌথ তানাতানির তারিফ করছেন। সবাই মিলে এমন সুর লাগিয়েছে যেন হাতি ডাকছে। মানে, সমঝদার এর ভাষায়, হাতি চিঁঘাড় তান। হদ্দু আর হসসু একে একে গাইছে, কিছুতেই তারা হার মানবে না। বড়ে মুহম্মদ খান আড়চোখে একবার তাদের দিকে তাকালেন, তার চোখে অবজ্ঞার হাসি খেলে গেল।

শট ফ্রিজ। এইবার ব্যাক টু ফ্ল্যাশব্যাক! কেন হাসলেন বড়ে মুহম্মদ খান? কারণ, এই প্রতিযোগিতার আগে দুই পরিবারের মধ্যে অনেক জল বয়ে গেছে। সে গল্প ভুললে চলবে? সেই আদ্যিকালের কতা! অমীর খুসরোর বারোজন কাওওয়াল শিষ্য ছিল, তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল 'কাওওয়াল বাচ্চাদের ঘরানা'! এদের মধ্যে দুজন ছিলেন নেমত খান সদারঙ আর ফিরোজ খান অদারঙ, তারা 'খেয়াল' গেয়ে ফেমাস হয়ে গেছিল। তাদের নাতি ছিল শক্কর খান আর মকখন খান, তারা প্রথম থেকেই গানবাজনা নিয়ে রেষারেষি করত। কে বড় গায়ক? এই রেষারেষি কয়েক প্রজন্ম ধরে চলছে, দিন দিন সম্পর্ক আরো কটু হয়ে উঠেছে। 

শক্কর খানের বড় ছেলে মোহাম্মদ খান গোয়ালিয়র এর রাজা দৌলতরাও সিন্ধিয়ার রাজগায়ক ছিলেন, তাঁর স্যালারি গুগলের সিটিওর স্যালারিকেও ছাড়িয়ে যাবে, হাতি করে দরবারে যেতেন। এদিকে মকখন খানের ছেলে নত্থন পির বখশ লখনউতে ঝড় তুলেছেন। সেখানকার নামকরা শিল্পী শোরি মিয়াঁর কাছে টপ্পা শিখেছেন, আগ্রার শ্যামরং-সরসরঙ এর কাছে ধ্রুপদের তালিম নিয়েছেন, আর কওয়ালির গুণ তো তাঁর রক্তেই ছিল। তাদের খ্যাতি বেড়েছে, দুশমনিও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আর দুশমনি বাড়লে যে খুনোখুনি হবে, সে আর নতুন কী? প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাঁচিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল না সে যুগে। ফলে স্পাইক্রাফট আর অ্যাসাসিনেশন অ্যাটেম্পট চলতেই থাকত। গুপ্তহত্যার নজিরও কিছু কম নেই। 

শক্কর খান নত্থন পির বখশের ছেলে কাদর এর সুপারি দিয়ে তাকে সগগে পাঠালেন। নত্থন বুঝে গেলেন এ ব্যাটারা গোটা পরিবারকে সাবাড় করবে। তিনি লখনউ ছেড়ে পালালেন। গোয়ালিয়রে ভাইপোকে চিঠি লিখলেন, কিন্তু গোয়ালিয়রেও তো শত্রু ফ্যামিলির লোক আছেন... বড়ে মুহম্মদ খান। কিন্তু আপাতত জান বাঁচাও। ভাইপোর কথায় ভরসা পেয়ে তারা চলে এলেন গোয়ালিয়র, সঙ্গে হদ্দু আর হসসু খান, তার দুই নাতিও এল। কিন্তু এসেছেন যখন, আর অপোনেন্ট ফ্যামিলির সবচেয়ে বড় যোদ্ধা যখন কাছেই আছেন, তখন তো চুপ করে বসে থাকা চলে না। হসসু আর হদ্দু তখন পুঁচকে ছেলে, কিন্তু তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে বড়ে মুহম্মদ খানের গানের রহস্য বুঝে আসার জন্য গুপ্তচর করে তোলা হল। সেই পুঁচকে বয়স থেকেই দু ভাই স্পাই। সেকালে সবাই লুকিয়ে রেয়াজ করত, গানের সিক্রেটের কত দাম ছিল আগেই বলেছি। কিন্তু বাচ্চাদের কে সন্দেহ করবে? দুই ভাই ছোটখাটো চেহারা দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে, জানলার পাল্লা দিয়ে গলে বড়ে মুহম্মদ খানের তেহখানাতে চলে যেত, আর তার তান শুনে শুনে বাড়ি এসে প্র‍্যাক্টিস করত। এই করে বছর কাটতে লাগল। সদা সতর্ক থাকতে হত দুই ভাইকে, সন্দেহ হলেই মুণ্ডু ঘ্যাঁচাং। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তিতে ছেদ পড়ল না, ট্রেড সিক্রেট বেহাত হতে লাগল ধীরে ধীরে। একে কী বলব? মিউজিকাল এসপিওনাজ? 

এদিকে কয়েক বছর পর যখন হদ্দু হসসু নিজে গাইতে শুরু করল, বড়ে মুহম্মদ খানের স্পাইরা শুনে জানাল, এরা তো মনে হচ্ছে ঝামেলা পাকিয়েছে গুরু! এ তো হুবহু তোমার তান। বড়ে মুহম্মদ খান প্রথমে বিশ্বাস করেননি, কিন্তু কয়েকবার তাদের গাইতে দেখেই তিনি বুঝে যান সর্বনাশ হয়েছে। বন্দিশ ইজ স্টোলেন, ব্রো! ল্যাও ঠেলা! রেগেমেগে তিনি গোয়ালিয়র ছেড়ে রেওয়ার মহারাজের কাছে চলে যান, কিন্তু রাগটা পুষে রাখেন। বদলা নিতে হবে... এই কথাটা তিনি নিয়ম করে নিজেকে মনে করাতেন। প্রতিটা ওস্তাদের নিজের মার থাকে, আর সেই মার চালতে হয় শেষ দানেই। সুতরাং, রেওয়া মহারাজার দরবারে বসে, হদ্দু হসসু খানের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসলেন। 

হাতি চিঁঘাড় তানের পর দুই ভাই এমনিতেই ক্লান্ত ছিল। কিন্তু এইবার বড়ে মুহম্মদ খান শুরু করলেন এমন এক তান, যা তিনি ছাড়া ভূভারতে কেউ পারত না। কড়ক বিজলি তান এর এই সুর গলায় খেলানো সহজ নয়, নিশ্বাস নেওয়ার সময় থাকে না, লান্সের ওপর প্রচুর চাপ পড়ে, হাড়গোড় কটকট করতে থাকে, মেরুদণ্ড বেঁকে যায়। বড়ে মুহম্মদ খানের সেই তান শুনে হদ্দু খান বুঝলেন আর কিছু করার নেই, তিনি চুপ করে গেলেন। কিন্তু হসসু খান উত্তেজনার বশে একই তান গাইতে গেলেন। তারপর সেটাই হল, যা বড়ে মুহম্মদ খান চাইছিলেন। হসসু খানের মেরুদণ্ড এর হাড় মট করে ভেঙে গেল, লান্স ফেটে গেল, মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরোতে লাগল। রক্তারক্তি কাণ্ড, সবাই চুপ। হসসু খান প্রাণ হারালেন। বড়ে মুহম্মদ খান সত্যিই দরবারে রক্তের নদী বইয়ে দিলেন।

গল্প এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না। হসসু খান মারা যাওয়ার পর হদ্দু খান একদম  নিস্তেজ হয়ে পড়লেন, তার আর কিছুই ভালো লাগে না। গাইতে ইচ্ছাই করে না। মহারাজ জিয়াজিরাজ সিন্ধিয়ার সঙ্গেও মনের মিল নেই। সব ছেড়ে তিনি লখনউ ফিরে এলেন। রাজা বাদশা নবাবদের ছেড়ে নিজের জন্য গাইতে শুরু করলেন। কোনোরকম প্রতিযোগিতা নেই, কোনও দর্শক নেই, শ্রোতা নেই, তিনি নিজেই গাইছেন, নিজের জন্যই রেয়াজ করছেন। এরকম করে বছর কাটতে লাগল। পরিচিত পরিবেশের বাইরে এই একান্ত সঙ্গীত সাধনা ক্রমে হদ্দু খানকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যা কেউ কল্পনাও করেনি। প্রকৃতি তাঁর গায়েকিকে এক অতীন্দ্রিয় রূপ দিল। হয়তো এ তাঁর নিয়তিতেই ছিল।

বহলাওয়া থেকে ঝুমরা তাল... গোয়ালিয়র ঘরানার যে সমস্ত কিছুকে আজ শ্রোতারা জানে, সেই সমস্ত কিছুকে চেহারা দেওয়ার ক্রেডিট হদ্দু খানের। গোয়ালিয়ার ঘরানার কপিবুক অস্টাঙ্গ গায়েকির সমস্ত নিয়ম মেনেও হদ্দু খান যে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, সে জন্য তাকে নোবেলেই দেওয়া যেত, যদি ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল এর জন্য সেকালে নোবেল দেওয়া হত। মজার কথা হল, বড়ে মুহম্মদ খান চিরকাল হদ্দু খানকে স্নেহ করে গেছেন। হসসুর মৃত্যুর পর তাদের সম্পর্কে এক অদ্ভুত উষ্ণতা এসেছিল, যা আজীবন রয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে এই দুই ফ্যামিলি মিলেই গোয়ালিয়র ঘরানা গড়ে তোলে। আবার, এই দুই ফ্যামিলির পরবর্তী প্রজন্মের গাইয়েদের হাত ধরেই অন্যান্য ঘরানার সূত্রপাত হয়েছে, সেটাও দেখতে হবে। যেমন, জয়পুর-অতৌলিয়া ঘরানার আলাদিয়া খান বড়ে মুহম্মদ খানের ছেলে মুবারক অলি খানের শিষ্য, আবার কিরানা ঘরানার অব্দুল করিম খানের সঙ্গেও এই পরিবারের নিবিড় যোগ আছে। এই ঘরানার হাত ধরেই ভারতীয় ক্লাসিকাল পরবর্তীতে ধর্ম, গোষ্ঠী, সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে, হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে গিয়েছে, পরম্পরাগত সঙ্গীত আর আধুনিক সঙ্গীতের মধ্যে একটা সেতুবন্ধনও হয়েছে গোয়ালিয়র ঘরানার শিল্পীদের হাতেই। কিন্তু সে গল্প আবার পরে কখনও হবে। 

(গোয়ালিয়রে আজও হদ্দু হসসু খানের নামে একটা অডিওটোরিয়াম আছে, তার দীর্ণ দশা আমি পনেরো বছর আগেই দেখে এসেছিলাম। কিন্তু ইতিহাসটা রয়ে গেছে। আর কিছুই না, গোয়ালিয়র এর নাম শুনলে এখন আমার প্রথমেই সিটি অফ মিউজিক কথাটা মনে পড়বে। মহারাজ রঘুরাজ সিং বাঘেল ছাড়া এসব শিল্পীদের কোনও অয়েল পেন্টিংও নেই সম্ভবত, তবে মীরা পণ্ডিত আর প্রবীণ কুমার সহ অনেকেই বিশদে বই লিখেছেন, আর আমাদের চেনা বইগুলো তো আছেই।)








সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

অনলগর্ভা (উত্তরাখণ্ড-২০২৪)

 


প্রায় একমাস হতে চলল উত্তরাখণ্ডের জঙ্গলে আগুন লেগেছে। গোটা হিমালয় তো ছেড়েই দিলাম, শুধু কুমায়ুঁ অঞ্চলেই পাঁচশো'র বেশি জায়গায় দাবানল অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে, আটশো হেক্টেয়ার বন পুড়ে ছাই, আগুনের শিখা প্রায় কুড়ি পঁচিশ ফুট ওপরে উঠে গেছে। ছোট ছোট শান্ত সুন্দর পাহাড়ি গ্রামগুলো কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে থাকে, রোদের চিহ্ন নেই। যারা পেরেছে তারা পালিয়েছে, যারা পারেনি তারা মেনে নিয়েছে। এবার শেষ বিকল্প বরাবরের মতো... বৃষ্টি।

বারামাসার রিপোর্ট আর উত্তরাখণ্ডের স্থানীয় মানুষদের করা ভিডিও দেখে বোঝাই যায়, প্রশাসন হাত তুলে নিয়েছে। অবশ্য হাত তারা আগে থেকেই তুলে আছে। প্রতি বছর ওয়াইল্ড ফায়ারের তীব্রতা আরো বাড়ছে, কারো বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। আগে গ্রীষ্মের প্রখর তাপে পুড়ে, প্রাকৃতিক কারণে বনে আগুন লাগত, এক জায়গায় আগুন লাগলেই পাঁচটা গাঁয়ের লোক একসঙ্গে এসে সেই আগুন নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত, গ্রাম পঞ্চায়েত আর স্থানীয় প্রসাশন থেকেও যথাসম্ভব সাহায্য করা হত। আমি নিজে এমন দেখেছি।

এখন সে সব চুলোয় গেছে। জানুয়ারি মাস থেকেই আগুন লাগতে শুরু করে, কেউ কেয়ার করে না। ব্যাপারটা পুরোপুরি নর্মালাইজ হয়ে গেছে। বন থাকলে বন তো জ্বলবেই, পশুপাখি তো পুড়ে মরবেই, ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে চোখ লাগিয়ে বসে থাকলেই জাতির গৌরব বাড়ছে আজকাল। স্থানীয় বন্ধুদের পোস্ট পড়ে যা বুঝলাম, মানুষ হিসেবে আমাদের কালেক্টিভ কানসিয়াসনেসটাই উধাও হয়ে গেছে। পাশের গ্রামে আগুন লাগলে এখন ছেলেছোকরারা সাহায্য করা দূর, উল্টে মস্করা করে 'ব্যাটারা পাপের শাস্তি পেয়েছে' মার্কা কমেন্ট করে। তারপর পাশের গ্রামেও আগুন লাগে, তখন কিছু করার থাকে না। দু গাঁয়ের লোক মিলে সরকারকে দোষারোপ করে (যদিও ভোটে সেই একই সরকারকে জিতিয়ে দেয়), তাতে সরকারের বয়েই গেছে। বন বিভাগ বা পরিবেশ মন্ত্রকের প্রিভেন্টিভ মেজার্স বলতে নীল বাটে সান্নাটা, চেপে ধরলেই বন বিভাগ বলে, ওসব উপদ্রবীদের কাণ্ড। এনজিটি সতর্ক করেছিল আগেই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, তবুও বনবিভাগের কর্মীদের ঠিক ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে কাজ ছেড়ে ইলেকশন ডিউটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এখন আর কেউ দায় নিতে রাজি নয়। এদিকে ইলেকশনের সিজনে এই নিয়েও মিডিয়ায় চিরাচরিত প্রোপাগাণ্ডা শুরু হয়ে গেছে। চোখে পড়ল, অপইন্ডিয়ার মতো রাইট উইং প্রোপাগাণ্ডা ওয়েবসাইটরা ইতিমধ্যেই উপদ্রবীদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম অ্যাঙ্গল খুঁজে বিকৃতভাষ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের কুমায়ুঁ গাড়োয়াল নিবাসী বন্ধুদের কাছে জানলাম, ভীমতাল থেকে Mi-17 V-5 হেলিকপ্টার বাম্বি বাকেট থেকে হাজার হাজার লিটার জল তুলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। বন বিভাগ হাত তুলে নিয়েছে বলে আর্মিকে ডাকা হয়েছে। এদিকে গরমের ত্রাহিমাম থেকে রক্ষা পেতে উত্তর ভারতের অর্ধেক মানুষ আপাতত পাহাড়ে ছুটি কাটাচ্ছে, তাদের অধিকাংশেরই এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। ছেলেমেয়েরা মহা উৎসাহে হেলিকপ্টারের ছবি তুলছে, কালো ধোঁয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে ম্যাগি হাতে সেল্ফি তুলছে, স্পিকারে গান বাজাচ্ছে। 

জঙ্গলে এরকম অনিয়ন্ত্রিত আগুন লাগলে কী হয়? পরজীবী প্রাণী আর ছোট ছোট অসংখ্য কীটপতঙ্গ মারা যায়, প্রজাপতিরা মারা পড়ে। যে সমস্ত পাখির ছানা সদ্য জন্মেছে, তারা পুড়ে মারা যায়। বন্যপ্রাণীদের ঘরবাড়ি হেস্তনেস্ত হয়ে যায়, গুলদার চিতাবাঘ ইত্যাদি জীবরা তখন তল্লাটের গ্রামে এসে হামলা চালায়, তারপর মারা পড়ে মানুষের হাতে। কচি ঘাস পুড়ে যায়, প্রতি বছর আগুন লাগলে মাটির উর্বরা শক্তি কমে আসে, স্বচ্ছ জলের ন্যাচারাল স্রোতগুলো নষ্ট হয়ে যায়, বন পাহাড়ের গোটা ইকোসিস্টেমটাই ধ্বসে যায়, সে সব গড়ে উঠতে বহু বছর লাগে। আর এখন তো সে সময়ই নেই। গায়ের ঘা শুকোতে না শুকোতেই আবার আগুন লাগছে। প্রাকৃতিকগত ভাবে ততোটা নয়, যতটা অ্যান্থ্রপসিন অ্যাক্টিভিটির জন্য, মানুষ ছাড়া কেউ দায়ী নয়। ফলও ভুগতে হবে মানুষকেই। ফসল বর্বাদ হবে, বৃষ্টি হবে না, হলে অতিবৃষ্টি হবে, ক্লাউড বার্স্ট হবে, পাহাড়ি গ্রাম ধ্বসে যাবে। 

এসব কমন সেন্সের কথা। ছোটবেলায় সবাই পড়েছে। গাছ লাগানোর শিক্ষা কোত্থেকে এসেছে, কেন এসেছে সবাই জানে। ইকোসেনসিটিভ জোনে রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে ডিনামাইট ফাটালে কী হতে পারে সবাই জানে? (জোশিমঠের ঘটনা নিয়ে আরো কারো কিছুই বলার নেই) তবু কারো কোনও প্রতিক্রিয়া নেই, কোনও হেলদোল নেই।

আমাজনের জঙ্গলে ৩২ ফুট উঁচু আগুনের শিখা লকলক করছে, মানুষ মরছে চিলিতে। ইউরোপে পর্যন্ত দেখছি শীতকাল সংকুচিত হচ্ছে, গ্লেশিয়ার উধাও হয়ে যাচ্ছে। সারা দুনিয়ায় ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রতিকূল প্রভাব চোখে পড়ছে, তবু সবাই নিরুত্তাপ। 

উত্তরাখণ্ডে ইতিমধ্যেই পাঁচজন মারা গিয়েছে আগুনে পুড়ে। মানুষ স্বার্থপর জীব ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে এতটাও ইনসেন্সিটিভ হল কী করে? আগুনের ছবি আর ম্যাগির প্লেট নিয়ে কেউ ছবি তুলতে পারে? এরকম অবস্থাতেও ভোটের কথা ভেবে হিন্দু মুসলমান করতে পারে? পারে যে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

উত্তরাখণ্ড আর হিমাচলের মতো জায়গায় দাবানল নিয়ন্ত্রণ এর জন্য চিরকাল বনবিভাগ আর গ্রামের লোকজন হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। বিএমসি করার সময় অবসরপ্রাপ্ত ইকো ডেভেলপমেন্ট অফিসাররা বলেছিলেন, শীতের পর দেবদারু ইত্যাদি গাছের শুকনো পাতা সরিয়ে কচি ঘাস আর নতুন পাতা গজানোর ব্যবস্থা করা হয়, বনবিভাগের বিভিন্ন রেঞ্জে 'পতরৌল' আর 'আগল্যায়েন' পোস্টের লোকজনদের নিয়োগই করা হত পিরোল মানে শুকনো পাতা সরানোর জন্য। গত দেড় দু দশকে সে সব কমতে কমতে প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। অ্যাওয়েয়ারনেস ক্যাম্পেনের জন্য আর বাজেট দেওয়া হয় না, স্কুল কারিকুলামে প্রকৃতির কোনও গুরুত্ব নেই। পাহাড় বন জঙ্গল শুধু ইন্সটাগ্রামের ছবি হয়েই রয়ে গেছে। আদিবাসী রাইটস আর এনভায়রনমেন্ট এর কথা বলতে গেলেই অ্যান্টিন্যাশনাল তকমা মেলে, আর পশুপাখিদের নিয়ে কিছু বলা তো ঘোরতর অপরাধ। থার ডেজার্টে এনার্জি ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক এর কাজ গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের প্রায় শেষ করে দিচ্ছে, চিল আর শকুনের পাশাপাশি আরবান পাখির অধিকাংশ প্রজাতি বর্ডারলাইনে চলে গেছে। স্টেট অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস আর ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সার্ভে আর বিশ্লেষণ করে বিবেক মেনন জানিয়েছেন, ৩৩৮টি প্রজাতির ৬০% পাখির সংখ্যা কয়েক দশক ধরে কমছে। অনেক পাখি আইইউসিএন-এর রেড লিস্টে চলে গেছে। মানুষের এম্প্যাথি দিন দিন কমছে, পাখি নিয়ে আজকাল আর বাচ্চারাও মাথা ঘামায় না। 

'অল দ্যাট ব্রিথস' আর 'এলিফ্যান্টস হুইস্পারারস' এর মতো সিনেমা এখনও হয়৷ সে সব বিদেশে পুরস্কৃত হচ্ছে, কিন্তু সে সব নিয়ে মেনস্ট্রিমে কথা হয় না। ট্যাক্স ফ্রি হয় কেরালা স্টোরি আর আর্টিকল ৩৭০ এর মতো ছবি। 'পোচার' এর মতো হালকা সিরিজও কোনও সোশ্যাল ডিস্কোর্স তৈরি করতে পারে না, লোকজন  হিউমান অ্যানিমাল নিয়েই নাচছে। প্রজেক্ট চিতা নিয়ে এত লাফালাফি করা হল, কিন্তু চিতাগুলো যে মারা গেল, সে নিয়ে সরকার একটা কথাও খরচ করবে না। চেন্নাই থেকে দিল্লি প্লেনে করে গেলে মাঝেমধ্যে প্লেনটা অনেক নিচে দিয়ে যায়, তখন বোঝা যায়, একটা এত বড় দেশ, তার প্রায় গোটাটাই পাথুরে জমি হয়ে আছে, ব্যারেন ল্যান্ডস! সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। 

আসামের কনজারভেসনিস্ট পূর্ণিমা দেবী বর্মন 'হাড়গিলে'দের নিয়ে কাজ করে সম্মানিত হচ্ছেন, আলোক শুক্ল আজীবন কাজ করে আন্তর্জাতিক স্তরে নাম করছেন, কিন্তু দেশে পরিবেশকর্মীদের পদে পদে লাঞ্চিত হতে হচ্ছে। ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট আর বায়োলজিকাল ডাইভার্সিটি অ্যাক্ট দুটোকেই অ্যামেন্ড করে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, রিলায়ান্স এর বনতারা প্রজেক্ট হোক বা ছত্তিশগড়ের পারসা কোল মাইন, সব কিছুই আরামসে পাস হয়ে যায়, পরিবেশ মন্ত্রক প্রোজেক্ট অ্যাপ্রুভ করার জন্যই বসে আছে। নদীগুলোর অবস্থা কহতব্য নয়, ক্লাইমেট সার্কল পাল্টে গেছে, এপ্রিল মাসে গোটা দেশের তাপমাত্রা ৪০-৪৫, কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কারো কোনও বক্তব্য নেই। একটা পার্টির ম্যানিফেস্টোতেও এনভায়রনমেন্ট নিয়ে তেমন কিছু লেখা নেই, ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে অবশ্য আছে। আরো হাইওয়ে বানানো হবে, আরো এইট লেন করিডোর হবে, আরো বনজঙ্গল কাটা হবে। উত্তরাখণ্ড এর মতো জায়গায় যে দাবানলের সমস্যা আরো বাড়বে, সেটা বুঝতেও কষ্ট হয় না। 

তাপমাত্রা বাড়ছে, সবুজ উধাও হচ্ছে, উপকূলবর্তী গাঁগুলো ক্রমে ভেসে যাচ্ছে, (আরতি কুমার রাও এর লেখা মার্জিনল্যান্ডস' পড়লে সুন্দরবন এর বর্তমান অবস্থা বোঝা যায়) হড়কা বান আর গ্লফ ডিজাস্টার এর এখন কেউ মাথা ঘামায় না, উত্তরাখণ্ড আপাতত ব্রাজিলের আমাজনের আগুনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা তাদের পিছনে ফেলে দেব।  দেখেশুনে বড়ই অসহায় লাগে, কিছু করারও নেই। পরিবেশ ফরিবেশ নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না, এসব নিয়ে পোস্ট দিলে বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললেও খিল্লিই শুনতে হয়। নির্বিকার হয়ে থাকতেই চেষ্টা করি, তবু মাঝে মাঝে রাগ হয়। এসব আর থামার নয়। ভাগ্যিস হাফ জীবন কেটে গেছে। 

প্রকৃতি আর মানুষ, দুটোই পাল্টে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে। এর কোনও প্রতিকার নেই। আর কয়েক দশক, তারপর ডিউন দেখতে আর হলে যেতে হবে না।