তোমার বিনিদ্র চোখের হাসিতে শুভ্র চুনের কলি
রন্দা থেকে সঞ্চয় করা আলো, বাতাস ও বুদ্বুদ
ছায়াঘেরা স্মৃতিতে তোমার কমলালেবুর বাগান,
সেখানেই আমার গানটি দিয়েছি তোমায়
জলপ্রপাত? নাকি অশ্রু ঝরে চলে?
গিরিখাতের নিচ থেকে উড়ে আসা জোড়া পায়রা
বদলে যায় মার্জিত স্তবকে, শুধু পাথর।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি!
~পাবলো গার্সিয়া বায়েনা
১) ১৯৩৭ সালের এক সন্ধ্যেবেলা। পাহাড়ের কোলের ওপর সূর্যের আলো অনেকটাই নিভে এসেছে। আন্দালুসিয়ার পানশালায় বোধ হয় কেউই বন্ধ কামরায় বসে ওয়াইন, বিয়ার অথবা সাঙরিয়া খায় না। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পানশালার বাইরে রঙিন পাথরের চাতালের ওপর বসে নাগাড়ে আড্ডা চলছে মানুষজনের।
ডান দিকের টেবিলে বসা মানুষটা একদৃষ্টে চেয়ে আছেন সামনের আকাশের দিকে। তার উল্টো দিকে বসে থাকা স্যুট পরিহিত দীর্ঘদেহী লোকটি সিগার থেকে ছাই ঝেড়ে জিগ্গেস করলেন, “ফ্রেম পেলে ওয়েলেস?"
ঠোঁট উল্টে অরসন ওয়েলেস জবাব দিলেন, “ফ্রেম খুঁজছি না হে! এমনিতেও স্পেনের গৃহযুদ্ধে যা চলছে, এখানে এসে সিনেমা করার কথা কল্পনাও করা যায় না। তোমার বন্ধুদের কী খবর আর্নেস্ট?"
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সিগারে আরেক টান দিয়ে বললেন, “খবর ভালো নয় হে। মাদ্রিদের বুলফাইট এরিনাতে ফ্রাঙ্কোর দল নেত্য করছে। কোথায় আমাদের চেনা শিল্পীরা? সব প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। আচ্ছা, এমন অবস্থায় আমাদের আন্দালুসিয়ায় এসে বসে থাকা কী ঠিক হচ্ছে? আমাদের বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য করার চেষ্টা করা যায় না?"
ওয়েলেস মুচকি হেসে বললেন, “সিনেমাতে সেটিং ব্যাপারটাই আসল বুঝলে? সেটিং বুঝে গেলে চরিত্রদের নিয়ে কোনো অসুবিধে হয় না। এখানেও সেই ব্যাপার। গৃহযুদ্ধের সময় এক একটা চরিত্রকে ধরে ভবনদী পার করাতে গেলে আসল ছবিটা মিস করে যাবে যে! শিল্পী হিসেবে তুমি দেখে যাও। মন বিচলিত হবে ঠিকই! কিন্তু যতটা তুমি আউটসাইডার হয়ে সেটিংটা বুঝতে পারবে, নিজে জড়িয়ে পারলে সেই পক্ষপাত ছাড়া স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।”
"এই আবার তোমার সিনেমার জ্ঞান শুরু হল! পাহাড়ের কোলে বসে কোথায় সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে কবিতা বলবে তা নয়..."
"সাহিত্য ব্যাপারটা তোমার জন্যে আর্নেস্ট। তুমি বরং ফিরে গিয়ে সংবাদপত্রে খানিকটা এখানের অবস্থা নিয়ে লেখালিখি কর, তাতে অনেক লোকের টনক নড়বে। সঙ্গে এই অদ্ভুত জায়গাটার কথা লিখতেও ভুলো না।”
"অদ্ভুত! ঠিকই বলেছ হে! এত জায়গা দেখলাম, কিন্তু এই ছোট্ট গ্রামটা আমাকে যেভাবে সম্মোহিত করেছে... সেরকম আগে কোনো জায়গাতেই মনে হয়নি। অথচ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এখানে করার কিছুই নেই।”
"সেটাই তো রন্দার মজা হে। এখানের অলস বাতাসে একটা রোমান্টিক ব্যাপার আছে, ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। ঠিক জানাডুর মত..."
"জানাডু? সেটা আবার কি ব্যাপার?"
"সিটিজেন কেন নামে একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছি। সেখানে জানাডু বলে একটা পাহাড়ি শহরে বিরাট এক মহল আছে, ঠিক আমাদের হোটেলটার মতো..."
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর সিগারে একটা টান দিয়ে বললেন, “একটা কথা জানো ওয়েলেস, মানুষ যেখানে জন্মায় সেই জায়গাটার সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। বেনিমামেট শহরে গুপ্তচরদের একটা গোপন ক্যাম্পে গিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে, সেখানে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশের জেনারেল আলেকজান্ডার অরলভের সঙ্গে কথা হল। ভদ্রলোক ‘এনকেভিডি’-র প্রধান, কিন্তু রাশিয়াতে তার বিন্দুমাত্র মন টেকে না। তার ইচ্ছে ফরাসি দেশের কোনও আঙুর বাগানে জীবনের শেষ নিশ্বাস নেবেন। মানুষ যেখানে মরতে চায়, সেটাই তার আসল জায়গা। মৃত্যুর পরেও এখানে থাকতে পারলেই আমি শান্তি পাব।”
"এনকেভিডি? তারা তো আমেরিকানদের পিছনে লেগেই আছে। আর্নেস্ট, কী বলছ গুরু? মার্কিন নাগরিক হয়ে রাশিয়ার গুপ্তচরদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছ, জানতে পারলে যে তোমাকে শূলে চড়াবে সরকার।”
"একান্তই যদি তাই হয়, এখানে এনে কবর দিও হে। এত সাহিত্য লিখলাম, ওইটুকু ছাড় পাব কী বল? হাহাহা.."
১৯৩৭ সালের বিকেলের সেই আড্ডা গড়িয়েছিল দীর্ঘ চল্লিশ বছর। বার বার আন্দালুসিয়ার এই ছোট্ট শহরে ফিরে এসেছেন সাহিত্য আর চলচ্চিত্র জগতের দুই মহারথী, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আর অরসেন ওয়েলেস। কখনও রেডিও, কখনও সংবাদপত্রের মাধ্যমে দুজনেই আহ্বান করেছেন স্প্যানিশ শিল্পীদের, যাতে তারা শিল্পবিপ্লব আনতে পারে স্পেনে। এরপর আস্তে আস্তে ওয়েলেস আর হেমিংওয়ে ছাড়াও বহু কবি, সাহিত্যিক, সুরবিদদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে রন্দার রোমান্টিক শহর।
মালাগার এই ছোট্ট শহরে এমন কী আছে যা সারা ইউরোপ থেকে কবি সাহিত্যিকেরা ফিরে ফিরে আসে এখানে? এর উত্তর কেউই দিতে পারেনি। প্যারিস অথবা ভিয়েনার মত শিল্পচর্চা নিয়ে মাতামাতি হয় না এখানে, রোমের জৌলুস নেই, ফ্লোরেন্সের ইতিহাস নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও অজানা কোনও কারণে বহু শিল্পীর মনে চিরস্থায়ী অবস্থান অধিকার করে আছে পাহাড়ের মাথায় থাকা এই ছোট্ট গ্রামটি।
এককালে জার্মানির সুয়েবি জনজাতির অধিকারে থাকা রন্দার হাত বদল হয়েছে ভিসিগথ, রোমান আর মুসলমানদের মধ্যে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আব্বাস ইবন ফির্নাসের বাসস্থান থাকা এই শহর বরাবর শিল্পচর্চায় অগ্রগণ্য ছিল। এখানের বাতাসেই একটা শিল্পের ছোঁয়া আছে, মধ্যযুগেও সেই চর্চা ছিল অমলিন। স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময় বহু মুসলমান অন্যান্য শহর থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল রন্দার মত পাহাড়ি গ্রামগুলোয়, যদিও রাজার আদেশে সৈন্যের দল এসে বেশিরভাগ লোককেই কচুকাটা করে। নেপোলিয়ানের সঙ্গে স্পেনের যুদ্ধের সময়েও এখানে বহু লোককে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
২) প্রায় আড়াই ঘন্টা বাসে আন্দালুসিয়ার অপ্রতিম দৃশ্য দেখে যখন রন্দার মাটিতে নামলাম, সূর্য মাথার ওপর উঠে গেছে। ছোট্ট জায়গা। কাছেই রন্দার নামকরা পাথরের ব্রিজ 'পুয়েন্তে নুয়েভো'। প্লাজা দে তোরাসের কাছে ঢাউস ষাঁড়ের মূর্তি দেখে বুলফাইটিং রিঙের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্লাজা এস্পানিয়াতে পৌঁছে গেছি। গ্রীষ্মকাল, নানা দেশের পর্যটক বেড়াতে এসেছে গাড়ি করে। রোদের তাপে কাহিল হয়ে অধিকাংশই খাবার দোকানগুলোয় ভিড় করেছে। বাকিরা বাহারি হ্যাট পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পেটে দানাপানি দিয়ে আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম এল তাহো গিরিখাতের ওপর তৈরি পুয়েন্তে নুয়েভো সেতুর ওপর। প্রায় চারশ ফুট উঁচু পাথরের ব্রিজটির ওপর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অনেক নিচে গুয়াদালেভিন নদীর শাখার জল তিরতির করে বয়ে চলছে পাথুরে শৈলশ্রেণীর আঁকাবাঁকা খাতের মধ্যে দিয়ে। খানিক দূরেই দেখা যাচ্ছে পুয়েন্তে রোমানো আর পুয়েন্তে ভিয়েহো ব্রিজের অংশ। একসময় এই ব্রিজ ভেঙ্গে প্রায় পঞ্চাশজন লোক মারা গিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনার পর বিখ্যাত স্থাপত্যকর হোসে মার্টিন দে আল্দেল্হুয়েলা আবার এই সেতুর নির্মাণ করেন এবং প্রধান আর্কের নিচে একটা কুঠুরি বানিয়ে দেন। ওই কুঠুরিতে বন্দিদের রাখা হত। বন্দিশালার কুঠুরির জানলা থেকে দেখতে পাওয়া দৃশ্য সচরাচর এত সুন্দর হয় না। আজকাল অবশ্য সমস্ত জায়গাটাই জাদুঘরে পরিণত হয়েছে।
ছোট্ট জায়গা হলেও রন্দাতে নানান মহল, মিউজিয়াম, বুলফাইটিং রিং, পুরোনো আমলের স্থাপত্যের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য আছে, কিন্তু অত জায়গা দেখতে গেলে বেশ কিছুদিন থাকতে হয় এখানে। আমরা আপাতত ঘুরে ফিরে গিরিখাতের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। হাওয়া দিচ্ছে বলে গরম লাগছে না। পুয়েন্তে নুয়েভোর দু’দিকেই অবজারভেশন ডেক তৈরি করা আছে, সেখান থেকে এই অঞ্চলের উঁচুনিচু পাথুরে প্রান্তর দেখা যাচ্ছে। সবুজের প্রলেপ আলতো করে বোলানো হয়েছে লালচে শৈলশ্রেনীর ওপরে।
ঘাড় ঘুরিয়ে সঙ্গিনীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “দেখেছিস ওই কাঁচা রাস্তাটা? পাহাড়ের ধার দিয়ে নিচের দিকে চলে গেছে, ইচ্ছে করলে ঘন্টাখানেক হেঁটে একেবারে নদীর ধরে চলে যাওয়া যায়। যাবি নাকি?”
স্প্যানিশ দিদিমণি বিশেষ উৎসাহ দেখালেন না। অনেকক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে বললেন, “অত সময় নেই। খানিকটা দূর গিয়ে দেখে আসতে পারি।”
হক কথা। আসল জায়গাতে যেতে অনেক সময় লাগবে, উঠতে সময় লাগবে আরো বেশি। খানিকটা গিয়েই বরং দেখা যাক। সেই ঠিক হল। অনেকেই সেই রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। আমরাও চললুম।
রন্দার অঞ্চলটা সিয়েরা দে গ্রাজেলেমা ন্যাচুরাল পার্কের অন্তর্গত। এখানে কাছাকাছির মধ্যেই অনেকগুলো গ্রামকে পুয়েবলো ব্লাংকো মানে ‘হোয়াইট ভিলেজ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাসারেস, জাহারা দে সিয়েরা, এল বস্ক, উব্রিকে...মন ভালো করা এক একটা মফস্বলি টাউন, সফেদ ওড়না গায়ে দিয়ে শায়রানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছু কৌতূহলোদ্রেককারী পুরাতাত্ত্বিক গুহাচিত্র আছে এই গ্রামগুলোতে। প্রতিটা গ্রামের বাড়িঘর উজ্জ্বল সাদা রঙ্গে রং করা, বাড়িগুলোর টালি লাল অথবা খয়েরি রঙের। ছুটি পেলে অনেকেই এই ছোট্ট গ্রামগুলোতে এসে থেকে যায় কয়েকদিন। অলস ছুটি কাটায়। নদীর জলে ট্রাউট মাছ ধরে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। এইদিকের আঞ্চলিক রান্নার সুনাম আছে, সময় থাকলে পুয়েবলো ব্লাংকোয় মধ্যকালীন জীবনের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ আজও আছে। অনেকটা নেমে সামনে থেকে গিরিখাত সন্দর্শন করে আবার উঠে এলুম বাজার অঞ্চলে।
আমাদের সিঙ্গল মোটো প্রোগ্রাম, তাতে ফোকাস লুজ করি না। হাঁটো। ওয়াক। ওয়াক ইওর টক। ওয়াক ইওর ড্রিম। ওয়াক ইওর ফিয়ার। ওয়াক ইওর লাইফ। পুরোটাই হাঁটার গল্প। কবিতা। বা ধারাবাহিক উপন্যাস। না হাঁটলে মনে হয় দিনটাই জলে গেল। সুতরাং হাঁটতে হাঁটতে চলেছি। হেঁটে সান্তা মারিয়া গির্জা, হেঁটে ইসলামিক রাজাদের থাকার মহল, হেঁটে অতিক্রম করা রাস্তার পাশে অবস্থিত ছোট ছোট মিউজিয়াম। পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেছে। মাঝে মাঝে ডান দিকে বাঁদিকে খেয়াপাথরের পাকা রাস্তা এঁকেবেঁকে হারিয়ে গিয়ে মিশেছে কোনও স্কোয়ার অথবা প্লাজাতে। রাস্তায় লোকজন কম, সাদা বাড়ির সামনের কমলালেবু গাছে থোকা থোকা কমলালেবু দেখতে পাচ্ছি। সঙ্গিনী লাফালাফি করে নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পোড়ো কপালে একটা লেবুও হাতে এল না। একটা পাথরও ছাই নেই রাস্তায় যে পেড়ে খাব। ব্যাজার মুখে দুই মুর্তি এগিয়ে চললাম। এরই মাঝে স্যুভেনির সাজানো দোকান, রকমারি আঞ্চলিক হস্তশিল্প আর পাথরের গয়না নিয়ে বসে গেছে নুড়ি পাহাড়ি দোকান।
এঁকেবেঁকে চলতে থাকা রাস্তা মাঝে মাঝে চড়াই উঠছে। তখন একটু হাঁপ ধরে যায়। আবার ঝাঁকড়া গাছের নিচে বাঁধানো চাতালে বসে এগোই সামনের দিকে। হঠাৎ করে রাস্তা শেষ হয়ে পথের কিনারায় জেগে ওঠে পাহাড়ের ঢাল, সেখান থেকে দিগন্ত বিস্তৃত আন্দালুসিয়ার পার্বত্য অঞ্চল চোখে ধরা পড়ে।
নাম পড়তে পড়তে পথ চলি। পালাসিও দে মন্দ্রাগন, অ্যারাবিক বাথহাউস, আলামেডা ডেল তাহো, এই গির্জা, সেই জাদুঘর, অমুক কবির বাড়ি, তমুক শিল্পীর স্টুডিও। এইটুকুনি শহর, তার পরতে পরতে যত্ন করে রাখা ইতিহাসের পাতা। ভিসিগথ থেকে রোমান সাম্রাজ্য, ইসলামিক প্রাসাদ থেকে অরসন ওয়েলেসের লা সিউদাদের বিশ্রাম গৃহ, সব অক্ষত। এই রুচিশীলতার ঐক্যবদ্ধ চেতনাতেই এখানের অধিবাসীদের আনন্দের বীজ লুকিয়ে আছে।
৩) চল্লিশ বছর আগে যখন রোজগারের অভাবে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা শহরের দিকে পলায়ন করেছিল, তখন থেকেই ইউরোপের নানান জায়গায় গ্রামীণ পর্যটন আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। স্পেনের লোকেরা চিরকালই আমুদে, বিদেশী অতিথিদের পরিবারের অভিন্ন অংশ করে নিতে তাদের দু’বার ভাবতে হয় না। ফ্রাঙ্কোর স্বৈরতন্ত্র চলাকালীন ইউরোপ আমেরিকার নানান সাংবাদিক, লেখকেরা এখানে এসে এই আন্তরিক আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ক্রমে সে কথা ছড়িয়ে যায়, পর্যটকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আন্তরিক ব্যবহারের চাহিদা পেশাদারী সৌজন্যর চেয়ে অনেক বেশি। যারা পয়সা খরচ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে বেরিয়েছে, আঞ্চলিক সংস্কৃতির স্বাদ পেলে তারা আর কিছুই চায় না।
পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক গ্রামগুলোর সংস্কার শুরু হয়, সরকারের সাহায্য নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয় প্রাচীন স্থাপত্যের। গ্রামের লোকেদের বাড়িতে কম পয়সায় শুরু করা বেড এন্ড ব্রেকফাস্টের চাহিদা আজ সারা পৃথিবীতে। অনেকেই শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছে। রিভার্স মাইগ্রেশন। অর্থাভাব নেই তেমন। কেউ ছোট্ট ক্যাফে অথবা হস্তশিল্পের দোকান খুলেছে, অনেকে বাড়ির তৈরি খাবারের স্টল দিয়েছে। অনেকে গাইড হয়ে টুরিস্টদের বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের জায়গায়। প্যারাগ্লাইডিং থেকে সাইক্লিং, কার্নিভাল অপেরা থেকে ফিয়েস্তা ক্লদিং, সকলেই নিজের মত করে রোজগারের রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা করে এখানে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা শহরের অন্য প্রান্তে এসে পড়েছি ততক্ষণে। সেইদিকে ব্রান্ডের বড় বড় দোকানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আঞ্চলিক বুটিকদের ছড়াছড়ি। আইসক্রিমের দোকানে সবচেয়ে বেশি ভিড়। গরমের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে সকলের হাতেই 'জেলাদো'। এই জেলাদো কিন্তু ইতালির 'জেলাতো' নয়। এ হল এখানকার খাস কমলালেবু স্বাদের কাঠি আইসক্রিম। ঘুরতে ঘুরতে প্লাজা ডেল আহেরোতে এসে গেছি। কাছেই বাস স্টেশন। আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা আজই।
ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসে পড়লাম। জনবহুল রাস্তা চলেছে যাত্রীদের নিয়ে। প্রশস্ত চাতাল থেকে দূরের পাহাড় দেখা যায়। ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছে আবেগহীন পর্যটনকে। রন্দা যেন আর চারটে শহরের মত 'সেল্ফি মঞ্জিল'-এ না পরিণত হয়। এই শহরের সুনাম আছে স্বপ্ন দেখার শহর বলে। যাদের চোখে স্বপ্ন আছে, তারাই এখানকার জাদু বুঝতে পারে। বাকিরা পাহাড় আর গিরিখাত দেখেই ফিরে যায়। রন্দার জন্যে ভালবাসা বেঁচে থাক হেমিংওয়ে আর ওয়েলেসের মত শিল্পীদের, বেঁচে থাক তাদের স্বপ্ন। আমরা যেন আবার ফিরে আসতে পারি, স্বপ্ন দেখতে পারি খোলা চোখে। এমনিই থেকো প্রিয় শহর, আবার দেখা হবে!
Puebo Blaco- White Villages |
An walk in serenity |
(ক্রমশঃ)
যাত্রার পরের অংশ
গ্রানাদা-প্রথম পর্ব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন