শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

কেউ মনে রাখেনি

 

              The Reader by William Tolliver

ডিসেম্বর মাস। হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। কিন্তু তাই বলে তো আর কাজকর্ম বন্ধ রাখা যায় না। তাই সকাল থেকেই দোকানপাট সরগরম। শীতের এই সময়ে এমনিতেও অনেকের মন ফুরফুরে থাকে। বড়দিনের ছুটি পড়বে, জমিয়ে ফিস্ট হবে, টাকাপয়সাও ঘরে আসবে খানিক। সরকারি কর্মচারিরা সেজেগুজে রাস্তায় নেমেছেন। এদিকে পার্লামেন্টের ভিতর সে সময় উত্তপ্ত আলোচনা চলছে একটা আইন নিয়ে। সরকারের পাস করা এই আইন নাকি অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। এমন সময় দেখা গেল, স্যুট বুট পরা একজন ছেলে ভিড়ের মাঝখান থেকে উঠে দাঁড়াল আর কিছু বোঝার আগেই মাঝের ফাঁকা জায়গাটা লক্ষ্য করে একটা কিছু ছুঁড়ে মারল। পরমুহূর্তেই ছোট্ট একটা বিষ্ফোরণে গোটা পার্লামেন্ট হল কেঁপে উঠল। ততক্ষণে ছেলেটা দু হাতে লিফলেট ছড়াতে শুরু করেছে। জোর গলায় স্লোগান দিচ্ছে সে।

'বুর্জোয়ারা নিপাত যাক! ইনকলাব জিন্দাবাদ!'

সরি, একটু ভুল হল। ইনকলাব কথাটা বলেনি আসলে। ফরাসি ভাষায় ছেলেটা যা বলেছিল, তার ইংরেজি করলে বলতে হয়...'লং লিভ অ্যানার্কি!'

ভগত সিং নয়, এই ফরাসি ছেলেটার নাম ভেলা (Auguste Vaillant) ফ্রান্সের অ্যানার্কিস্ট আন্দোলনের তরুণ নেতা, যাকে লোকে বইপোকা বলে খেপাত। এ ছেলে দিনরাত বই মুখে গুঁজে বসে থাকত, ডায়েরিতে কীসব লিখত! আর তাঁর মাথায় যে সমস্ত উদ্ভট আইডিয়া আসত, সেসব কেউ বুঝতেই পারত না। ফ্রিডম অফ প্রেসকে বুড়ো আঙুল দেখানো কুখ্যাত আইন Lois scélérates সম্পর্কে জনতাকে সচেতন করবে বলে ভেলা ঠিক করেছিল, চেম্বার অফ ডেপুটিজে বোমা ফেলবে। কারো প্রাণহানি অবশ্য সে চায় না। বোমা ফেলে সে নিজেই গ্রেপ্তারি দেবে। শুনে তো বন্ধুরা অবাক। অ্যানার্কিস্টদের ধরতে পারলেই গিলোটিনে চড়িয়ে শিরচ্ছেদ করা হচ্ছে। এমন বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার মানেটা কী? শুধু শুধু বিষ্ফোরণ করেই বা তাহলে কি লাভ হল? ভেলা কি পাগল হয়ে গেল? শুনে একগাল হেসে ভেলা বলেছিল, "কালাদের কথা শোনাতে হলে ওই বিষ্ফোরণই করতে হয়।"

বলাবাহুল্য, পুলিশ এসে সে ছেলেটিকে সত্বর গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য সে তৈরি হয়েই ছিল। মহা সমারোহে স্লোগান দিতে দিতে যখন সে আদালতের দিকে চলল, তখন শহরের জনতাও তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিতে থাকল। ট্রায়াল চলাকালীন বিখ্যাত আইনজীবী ফের্নান্দ লাবোরি (যিনি সারাজীবন ধরে বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে কেস লড়েছেন, এমিল জোলার Dreyfus trial চলাকালীন তাঁর ওপর একাধিকবার হামলাও হয়েছে) ভেলাকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই করেছিলেন, কিন্তু কিছুই কাজে আসেনি। মাসতিনেক পরেই ভেলাকে গিলোটিনে চড়ানো হয়। এই ঘটনা ফ্রেঞ্চ থার্ড রিপাবলিকের অন্যতম ঘটনা হলেও বিস্তারে সে সময় কিছু জানা যায়নি, কারণ প্রেসের স্বাধীনতা ছিল না বললেই হয়। ভেলার সমস্ত লেখালিখি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, তবু কী করে যেন তাঁর লেখা দু একটা চটি বই কালোবাজারে চলে আসে, তাঁকে নিয়ে লেখা অ্যানার্কিস্ট লিটারেচর এর কিছু কপিও ছড়িয়ে যায়, কোনোক্রমে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ডে। ব্রিটিশ প্রকাশকরা ঝটপট সেসব বই অনুবাদ করে ফেলে। তার কয়েকটি সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে এসে পৌঁছায় ভারতবর্ষে। 

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে তখন বিপ্লবের নতুন জোয়ার। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নিয়ে লোকজন ক্ষেপে আছে। এদিকে একদল পড়াশোনা জানা ইন্টেলেকচুয়াল গোছের বিপ্লবীমনা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা দেশ বিদেশের কাগজে প্রবন্ধ লিখে, বই ছাপিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে বিপদে ফেলে দিচ্ছেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুশকিল করেছে কিছু স্বাধীন লেখক অনুবাদক আর প্রকাশক, যারা ভেজা বেড়ালের মতো মুখ করে থাকে কিন্তু সারা দুনিয়ার খবর রাখে। ফ্রান্সের অ্যানার্কিস্ট মুভমেন্ট থেকে আফ্রিকার জেনোসাইড, রুজভেল্ট করোলারি থেকে মেক্সিকান রেভোলিউশন, পাকা সাংবাদিকের মতো ভেতরের খবর বের করে আনে তারা। তারপর সহজ ভারতীয় ভাষায় সেসব নিয়ে বই ছেপে লাইব্রেরিতে রেখে দেয়। এইসব সহজলভ্য বই পড়ে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাথাটা বিগড়োচ্ছে। কিন্তু ব্রিটিশ বেচারিদের কিছু করার ছিল না। জালন্ধারে কে পাঞ্জাবিতে বই লিখছে, বর্ধমানে কে বাংলায় বই অনুবাদ করছে, লাহৌরে কে উর্দুতে অ্যানার্কিস্ট মুভমেন্টের ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে বসে আছে, সেটা ওরা জানবে কী করে? এইসব বই কংগ্রেস সহ অন্যান্য নেতারা সযত্নে নিজেদের গ্রন্থাগারে রেখে দিতেন, পড়তেনও নিয়মিত। 

যাই হোক, ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পর কংগ্রেস ছেলেছোকরাদের বলে, সরকারি কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে এসো। কিন্তু কলেজ ছাড়লেই তো হবে না, পড়াশোনাটা তাহলে হবে কোথায়? সেই ব্যবস্থাও হল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনতার দেওয়া টাকায় বিদ্যাপীঠ অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি খোলা হল। লাহোরে লালা লাজপত রায় এইসময় তিলক স্কুল অফ পলিটিক্স চালাচ্ছিলেন। তাঁকে অনুরোধ করায় সেই কলেজকেই নতুন ইন্সটিটিউটের সঙ্গে মার্জ করে ন্যাশনাল কলেজের পত্তন করা হয়। লালা লাজপত রায় তুখোড় বিদ্বান ছিলেন, এমন প্রলিফিক রাইটার আর এমন ভোরাসিয়াস রিডার পাওয়া কঠিন। তার ওপর সরকারি স্কুলে ভারতীয়দের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলে তিনি এই কলেজে জেনারেল স্টাডিজের পাশাপাশি জার্নালিজম, পলিটিকাল সায়েন্স, ইতিহাস, ইকোনমিক্স ইত্যাদি পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে থাকা পঁচিশ হাজার বই দান করে ন্যাশনাল কলেজের লাইব্রেরিও শুরু করেন। এই লাইব্রেরির নাম দ্বারকাদাস লাইব্রেরি। আর এই লাইব্রেরিতেই ভেলার সঙ্গে ভগত সিংয়ের প্রথম আলাপ। অবশ্য ভগত একা কেন, ভগবতীচরণ বোরা, সুখদেব, এহসান এলাহি, দুর্গা দাস খান্না সহ সোশ্যালিস্ট ইউথ নেতাদের সিংহভাগ এই লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করেছেন, নিজেদের হিরোদের খুঁজে পেয়েছেন। লাল-বাল-পাল এর 'তিকড়ি' অর্থাৎ বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় আর বিপিন চন্দ্র পাল নিয়মিত নতুন বই আনাতেন, অনূদিত বই আর পত্রিকাও পাওয়া যেত দেদার। ফলে দুনিয়ার সমস্ত খবর অ্যাক্সেস করা সহজ হয়ে গিয়েছিল। এই লাইব্রেরিতে বই পড়তে পড়তেই ভগত সিং ভগত সিং হয়েছেন। আমাদের দেশে কতজন বিপ্লবী এমন বইখোর ছিলেন আমার জানা নেই। শুধু বইপড়া নয়, মন দিয়ে পড়ে নিজের ডায়েরিতে কোটগুলো নোট করে রাখতেন, সেই নিয়ে নিজেও পাতার পর পাতা লিখতেন। কীর্তি পত্রিকায় ছাপা তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়লে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। দিল্লির সেন্ট্রাল লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বিতে বোমা ফেলতে যাবেন ভেলার মতো, তার আগে বই পড়ছিলেন। বটুকেশ্বর দত্ত উশখুশ করছে, ভগত বইয়ে ডুবে আছে। বোমা ফেলে ইনকলাব জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দিতে দিতে গ্রেপ্তারি দিয়েছেন, গাড়িতে উঠে প্রথম প্রশ্ন, 'জেলে বই পাওয়া যাবে তো?"

বই বা হাইজিনিক খাবার কিছুই  পাওয়া যায়নি, তাই অনশনে বসেছেন। উপায় না দেখে শেষে বই আনিয়েও দিতে হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে, এদিকে ভগত একের পর এক বই শেষ করছে, নিয়মিত নোটবুক লিখছে। ইউনিস্টার বুক থেকে কমপ্লিট জেল নোটবুক বেরিয়েছে, সেটা পড়লে বোঝা যাবে কী ভীষণ রকম পড়াশোনা করেছেন জেলে বসে। যে তিন মাস পর ফাঁসিতে চড়বে ঠিক হয়ে আছে, সে এত এত বই পড়ে সে সম্পর্কে মতামত লিখে রাখছে, উক্তিগুলো টুকে রাখছে, এরকম ক'জন পারে? (ও, ওই নোটবুকেই বীর সাবরকরের দুটো উক্তি আছে। ভগত সিং অনুপ্রানিত হয়েছিলেন বলা হয়েছে তো, ওইটুকুই। তবে কিনা সাবরকরের '১৮৫৭' বইটি ১৯০৭ সালে লেখা মনে হয়, সেটা পড়ে অনেকেই তারিফ করেছিলেন ঠিকই। হিন্দু মুসলিম ঐক্য নিয়ে খুব স্ট্রং মতামত ছিল সে বইয়ে। জেলে যাওয়ার পর সেই একই ব্যক্তি কাকে কী চিঠি লিখেছেন, সেটা মনে হয় সে সময় ভগত বা অন্যদের পক্ষে জানা কঠিন ছিল। দুই বীরের লেখালিখিতে বিস্তর তফাত। ভগত জানতেন না। তবে নিজের বাবা প্রাণরক্ষার জন্য আবেদন করেছেন জেনে ভীষণ রেগে একখান চিঠি লিখেছিলেন বাবাকে, কাগজেও ছাপাতে বলেছিলেন। আমাকে মারবেন না, সবটাই পড়া-শোনা কথা।)

বক্তব্য হল, ভেলা-ভগত সিং-লাজপত রায়-ব্রিটিশ-কংগ্রেস-সাবরকর ইত্যাদিকে বাদ দিয়ে সেই লেখকের নাম কারো মনে আছে যে ভেলার মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটা চটি বই লিখেছিল? সেই প্রকাশক, যে তাঁর লেখাগুলো একত্র করে ছাপিয়েছিল? সেই অনুবাদক, যে ফরাসি থেকে এই লেখা ইংরেজি করেছিল, বা ইংরেজি থেকে হিন্দি আর পাঞ্জাবি করেছিল? যারা বাজার ভুলে ফরাসি অ্যানার্কিস্ট মুভমেন্ট আর ভিনদেশে চলতে থাকা অবিচার নিয়ে কলম চালিয়েছিল, যারা সেসব চটি বই হিসেবে ছেপেছিল? তাদের আর্থিক লাভ হয়েছিল কি? মনে হয় না। তাদের কথা আর কারো মনে নেই। ন্যাশনাল কলেজ ১৯২৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়, দ্বারকাদাস লাইব্রেরির মূল্যবান বইগুলো পোকায় কেটে জলে ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে খবরে বেরিয়েছিল। এইটুকুই গল্প। পরে অনেক বই চন্ডিগড়ে নিয়ে একই নামে আবার এই লাইব্রেরি খোলা হয়েছিল।

লেখক একটা অদ্ভুত প্রাণী। তারা সবসময় আইট অফ ফোকাসে থাকে। ফার্মার প্রটেস্ট, রেসলার প্রটেস্ট, মণিপুর ক্রাইসিস, টার্কির ইলেকশন, উগান্ডার অ্যান্টি এলজিবিটি আইন থেকে বর্ষীয়ান অভিনেতার বিয়ে, নতুন ওয়েব সিরিজের গল্প বা বন্ধুর জীবনের সমস্যা, তারা চোখ পিটপিট করে সব দেখে। তবে রাগ আর অসহায়তাকে গিলে ফেলে শান্ত হয়েই থাকে। ফেসবুকে পোস্ট করা বা না করার ঊর্ধ্বে তার মাথায় নোট রাখে না বলা কথাগুলো। তারপর, যখন সবাই সে কথা ভুলে গিয়ে নতুন কিছুতে ব্যস্ত, ট্রেন্ডিং ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল, তখন স্মৃতির ঝোলা খুলে সেই সব বের করে লিখতে বসে। কখনও সে লেখা দাঁড়ায়, বা দাঁড়ায় বা। কখনও বই হয়, কখনও হয় না। হলেও অবশ্য বেশি আদেখলাপনা করার দরকার নেই, সে কথা লেখক বুঝেই গেছে। 

একটা বইয়ের ছবি বা বিজ্ঞাপন দেওয়া স্রেফ দেওয়ারই জন্য। অনেকে আগে দেখা সেই প্রচ্ছদ দেখেই ইগ্নোর করবেন, কয়েকজন হয়তো লাইক দেবেন। এরই মাঝে একজন বা দুজন পাঠক থাকেন, যারা পোস্ট লাইক করেন না, ডিস্কাউন্ট দেখে লাফান না, শুধু বইটা দেখে রাখেন। ছয়মাস বা একবছর পর সংগ্রহ করে পড়েন, হয়তো মেসেঞ্জারে এক লাইনে ভালো মন্দ জানান। ওইটুকুই ঝিলিক। ব্যস! বাকি বইগুলো পড়ে পড়ে ধুলো খায়। পুরোনো হয়ে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে থাকে। লেখক নতুন বই নিয়ে ভাবে। সেই বইও ইভেঞ্চুয়ালি ধুলোই খাবে। দিস ইজ ইট। এটাই নিয়ম। All that on the earth is bound to perish.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন