নাসরীন মোহামেদি। বিংশ শতাব্দী ভারতের ছুপা রুস্তম। এক অনন্যসাধারণ ও ব্যতিক্রমী প্রতিভা, যিনি আজীবন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কাজ করে গেছেন। তইয়াব মেহতা-ভি এস গাইতোন্ডে-এম এফ হুস্যায়েন সহ আধুনিক ভারতীয় শিল্পীদের সমকালীন ও সমকক্ষ (এবং স্নেহধন্য) হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেউই চেনেনি, সে নিয়ে তাঁর মাথাব্যাথাও ছিল না। এমনিতেও আমাদের দেশে শিল্প ফিল্প নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানোর লোক কোনোকালেই বেশি ছিল না, এখনও নেই। এক অমৃতা শেরগিল বাদে কোনো মহিলা শিল্পীর নাম আলোচনায় উঠে আসতে দেখিও না। নাসরিনের ক্ষেত্রে যদিও সেই যশলাভের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, কারণ নাসরীন নিজেও ছোটবেলা থেকেই ভীষণ সংবেদনশীল ও অন্তর্মুখী ছিলেন (লাজুক ছিলেন না অবশ্য), পপুলার মিডিয়ামে মুখ দেখানোর ইচ্ছে তাঁর ছিলও না, ভাইবোন বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হইচই করতে তাকে কেউই দেখেনি।
আটজন ভাইবোন, মা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন, বাবা থাকতেন বাহরিনে। ছেলেমেয়েরা থাকত কারাচিতে পৈত্রিক বাড়িতে। অভাব অনটন অবশ্য ছিল না, এলিট ফ্যামিলিই বলা যায়, চিন্তাভাবনার দিক থেকে অন্যদের থেকে এগিয়েই ছিলেন তারা। ১৯৪৪ সালে যখন হিন্দু মুসলিম মাইগ্রেশন শুরু হয়েছে, একে একে মুসলমানরা বম্বে বা কলকাতা থেকে লাহোর বা করাচি চলে যাচ্ছেন, নাসরিনের পরিবার পাড়াপড়শির কথায় কান না দিয়ে করাচি থেকে ভারতে চলে আসে। কিন্তু এখানে এসেও মেয়ের একাকীত্ব কমেনি, তিনি নিজের দুনিয়াতেই থাকতেন। বেশিরভাগ সময় একা একাই কাটত। বয়ে যাওয়া শহরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত নাসরিন, ইচ্ছে হলে কাগজে আঁকিবুঁকি কাটত। তখন তার অল্প বয়স, কিন্তু সেই বয়সেই এই মেয়ের মনে একটা দার্শনিকতার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। অল্প কথায়, সামান্য এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে নিজের অনুভূতিকে ফুটিয়ে তোলা, আর একেবারে নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তোলা। এই পার্ফেকশন অন্য কেউ বুঝল কিনা, তাতে নাসরিনের কিচ্ছু আসত যেত না। কোনোদিন যায়নি। নিজের জন্য দুনিয়া দেখতেন, নিজের জন্য আঁকতেন, নিজের জন্য লিখতেন। ফোটোগ্রাফিতেও অসামান্য হাত ছিল। নীরবে নিজের জন্য একটা দুনিয়া গড়ে ফেলেছিলেন নাসরীন, একটা নিজস্ব ভাষা আবিষ্কার করেছিলেন। বড় হওয়া, দেশভাগের সাক্ষী থাকা, পরিজনদের বিচ্ছেদ, ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনা, বিদেশ সফর, বাহরিন বা আরব দেশে সাময়িক ভাবে দিন কাটানো, ফিরে আসা, শৈল্পিক মাধ্যম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, শিক্ষক জীবন... সবটাই শান্ত ভাবে, শোরগোল না তুলে, নিজে নিজে করেছেন, কাউকে মনের কথা জানতে দেননি। নিজে কী ভাবছেন, কী অনুভব করছেন, সেটা একমাত্র প্রতিফলিত হত তাঁর আঁকায়!
কেন নাসরীন সব ছেড়ে সারাজীবন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট লাইন ড্রয়িং নিয়ে ক্যানভাস ভরালেন, কেন সারা দুনিয়া চক্কর দেওয়ার সময়ে লিখে রাখা মূল্যবান সব জার্নাল, অসামান্য সব ফোটোগ্রাফ জনসমক্ষে আনতে অনুমতি দিলেন না কাউকে, কেনই বা হেলায় ফিরিয়ে দিলেন অন্যান্য দেশের লোভনীয় সব প্রস্তাব? নাসরীন নিজে জানাননি কিছুই, কেউ জানতেও চায়নি। আর্ট হিস্টোরিয়ান গীতা কপুর পরে জানিয়েছিলেন, নাসরীনের মতো শিল্পী দুনিয়ায় বিরল। ছবি তো দূরস্থান, ফোটোগ্রাফার বা সাহিত্যিক হিসেবেও নাম করতে পারতেন অনায়াসে, কিন্তু সে সবে তাঁর আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ ছিল ছবি নিয়ে, কবিতা নিয়ে, সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে। রাশান শিল্পী কান্ডিস্কির কাজ তাঁর প্রিয় ছিল, তাঁর কাজের কাছে বারবার ফিরে আসতেন উত্তরের খোঁজে।
ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন। পঞ্চাশ ষাট বছর আগে তিনি একা একা ব্যাকপ্যাকিং করে গোটা দুনিয়া ঘুরেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি আর ইরানের ইসলামিক স্থাপত্যশৈলী সূক্ষ্মভাবে বার বার তাঁর ক্যানভাসের বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছিল। এক এক সময় দীর্ঘদিন ভ্রমণ করেছেন নাসরীন। জাপান, আরব আর ইউরোপের ছোট ছোট গ্রাম আর শহরকে নিয়ে লাইন নোটস লিখে রাখতেন, আসলে শহরের আড়ালে থাকা শহরকে ধরতে চাইতেন। এই দক্ষতা তার সহজাত ছিল। লাইন ড্রয়িং এর মাধ্যমে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষের অন্তরীণ জীবনের স্প্রিচুয়ালিটিকে ফুটিয়ে তোলার এই ক্রাফট শুধুই স্কেচ নয়, শুধুই শিল্প নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। নাসরিনের শৈলীর সঙ্গে যে শিল্পীর সবচেয়ে বেশি মিল, তিনি অ্যাগনেস মার্টিন। এই মার্কিন শিল্পীকে নিয়ে এত এত বই লেখা হয়েছে, তথ্যচিত্র হয়েছে, আর সে সব হয়েছে তাঁর জীবনকালেই। কেউ জানতেও পারেনি যে অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেজানিজম আর মিনিমালিস্টিক লাইন পোয়েট্রি নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল, তখন গুজরাতের একটা ছোট্ট স্টুডিওতে বসে নাসরিন এক একটা মাস্টারপিস এঁকে যাচ্ছেন।
মাঝ চল্লিশে এসে জানা যায়, নাসরীনের একটা মারাত্মক রোগ আছে। বিরল প্রকৃতির নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডার, নাম হাংটিংটন কোরিয়া। এই রোগে অবসাদগ্রস্ততার পাশাপাশি মাইন্ড-বডি কোর্ডিনেশন ক্রমে এলোমেলো হয়ে আসে, মানুষ ধীরে ধীরে জড়বস্তুতে পরিণত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ হয় আনুবংশিক, ছোটবেলা থেকেই সিম্পটম ধরা পড়তে থাকে। নাসরীন যে কী করে এই রোগের কবল থেকে বেঁচে আছেন, শুধু বেঁচেই নেই, কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন, সে সব ডাক্টারদের মাথায় ঢুকল না। কেউ বলল ইচ্ছাশক্তি, কেউ বলল ভগবানের ইচ্ছে। নাসরীন যথারীতি কিছুই বললেন না, চুপ করে কাজ করে যাওয়াই তাঁর জীবন। তাই করে গিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে যখন মারা যান, তখনও তিনি আঁকছেন। স্টুডিও ভর্তি ক্যানভাস। সাদা কালোয় আঁকা জিওমেট্রিকাল পোয়েট্রি।
সরকারের পক্ষ থেকে যথারীতি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি নাসরিনের কাজগুলো সংরক্ষণ করার। গীতা কপুর আর বিজয় তলোয়ারের বদান্যতায় প্রাইভেট এক্সিবিশনে তাঁর কিছু কিছু ছবি দেখানো হয়। পরে যখন তলোয়ার আর্ট গ্যালারি খোলা হয়, নিউইয়র্কে প্রথম সোলো এক্সিবিশন হয় নাসরীনের। সেটা ২০০৩ সাল। এরপর থেকে ক্রমে তাঁর কাজ সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে। এক দশকের মধ্যে নাসরীন কন্সট্রাকটিজম আর অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেজানিজমের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে দুনিয়ার লোক জানতে পারে, ভারতের এক মেয়ে মডার্ন আর্টের পরিভাষাই বদলে দিয়েছেন।
আজ পনেরো বছর পর নাসরীন আর্ট ওয়ার্ল্ডের 'কাল্ট ফিগার'। প্যারিস থেকে পার্থ, মোমা থেকে কাসাল... সারা দুনিয়ায় নাসরীনের ছবি প্রশংসা পেয়েছে, তাঁর কাজ ও শৈলী নিয়ে পরপর রিসার্চ পেপার পাবলিশ হয়েছে। বলাবাহুল্য, ভারতে কিছুই হয়নি সেসব। কিরন নাডাল আর্ট কালেকশান আর তলোয়ার প্রাইভেট আর্ট গ্যালারি ছাড়া কোনো সরকারি মিউজিয়ামে তাঁর ছবি আছে বলে আমার জানা নেই।
নাসরীনের মতো কত শিল্পীই যে ভারতে ছিলেন, এখনও আছেন। কেউ খবরও রাখে না। কয়েকদিন আগে ভিয়েনায় লং নাইট অফ মিউজিয়াম হল, এই শহরেরই প্রায় দুশটা মিউজিয়াম অংশগ্রহণ করেছিল। তুলনার কথা হচ্ছে না, কিন্তু বলিভিয়া বা পেরুর মতো দেশেও শহরে শহরে গাদাগাদা মিউজিয়াম থাকে, মূল্যবান সব কাজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। এদিকে দু একটা বাদে আমাদের দেশে সরকারি আর্ট গ্যালারিও নেই, যা আছে সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। দু চারটে তো আমি চোখের সামনে ভেঙে হোটেল বা মল বানাতে দেখেছি। নামচীন শিল্পীদের ক্যানভাস ধুলো খাচ্ছে, অর্ধেক হারিয়ে গিয়েছে, কতগুলো তো পুড়েও গিয়েছে। এদিকে আমাদের গ্রামে গ্রামে কত শিল্পী, আর্ট ফর্মগুলো ধুঁকছে। কতরকম মুখোশ, কত রকম হস্তশিল্প, কত খেলনা বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়, সেগুলোকে রিপ্রেজেন্ট করার কোনো জায়গাই নেই। নতুন পার্লামেন্টের জন্য অবশ্য বিশাল জায়গা পাওয়া গিয়েছে। কেউ প্রশ্ন করলেও উত্তর তৈরিই আছে। ব্রিটিশদের গালাগাল দিয়ে তাদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে সব কিছু জাস্টিফাই করলেই সব চঙ্গা সি। মাঝে মাঝে ভাবি কেউ গল্পের মতো সহজ করে বইটই লিখলেও তো পারে, অনেকে হয়তো আগ্রহী হবেন, কিন্তু জানিই, তাতেও আসলে কিছুই হবে না। কী আর করা!
শুভ মহালয়া। মহালয়ার দিন ইচ্ছে হলে নাসরীন মোহামেদি আর অ্যাগ্নেস মার্টিনের কিছু ছবি দেখে নিতে পারেন ইন্টারনেটে। বিরিয়ানি চিলি চিকেন খেয়ে শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্তর প্রচ্ছদ এবং অলংকরণের প্রদর্শনীটাও দেখে আসতে পারেন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ। আজ শেষ দিন। মনে হয় মহালয়া ভালোই কাটবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন