শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

কঙ্গো স্কুল অফ পপুলার পেন্টিং

পাঁচের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে গোটা আফ্রিকা জুড়ে স্বাধীনতার বান এসেছিল। প্রায় এক শতাব্দী ধরে যে মহাদেশকে ইউরোপিয়ান শক্তিরা এক্সপ্লয়েট করেছে, সেই আফ্রিকার দেশগুলো ক্রমে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রায় দুই দশক ধরে চলা এই ডিকলোনাইজেশন যে খুব একটা সুখের সময় ছিল না, সে কথা এখন অজানা নয়। রাজনৈতিক শক্তি হস্তান্তরণের পর ব্যাপক দুর্নীতি, জনরোষ, আন্দোলনের পর আন্দোলন, গৃহযুদ্ধ, রায়ট, মাফিয়ারাজ তো ছিলই, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে গুরিল্লা স্টাইল ওয়ারফেয়ারও দেখতে হয়েছে। সে সব এখনও চলছে কমবেশি একাধিক দেশে, কিন্তু সে সময়ের পরিস্থিতি ছিল যাকে বলে ভয়ানক।
স্বাধীনতা অর্জন করা নবীন দেশে যে জিনিসটার সবচেয়ে বেশি অভাব ছিল, তা হল জনতার কাছে এই সমস্ত মারহাঙ্গামা, এই দীর্ঘদিনব্যাপী অত্যাচার আর অসহায়তাকে ভুলে থাকার জন্য, প্রসেস করার জন্য, অন্যদের বোঝানোর জন্য কোনো উপায় ছিল না। প্রায় সব দেশেই কমবেশি একইরকম পরিস্থিতি ছিল, কিন্তু যে দেশটার কথা আলাদা ভাবে বলতে হয়, সেটা হল জায়রে। হ্যাঁ, ১৯৯৭ সালে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো হওয়া পর্যন্ত এই নামই ছিল দেশটার। সেই কঙ্গো নদী আর রহস্যময় বনভূমি ঘেরা যে দেশের অরণ্য অভিযানের রোমাঞ্চকর সব বিবরণ শুনে আমাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে, সেই দেশের মানুষরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি হিংস্রতার সাক্ষী হয়েছিল। জন্তু জানোয়ার নয়, স্রেফ মানুষ। কঙ্গোবাসীদের লড়াই আর যন্ত্রণার ইতিহাস নিয়ে মেনস্ট্রিমে প্রায় কিছুই লেখা হয়নি সেভাবে, কিন্তু এই হার না মানা লোকগুলো তাদের জীবন, তাদের সমাজ, তাদের বক্তব্যকে ঠিকই ডকুমেন্ট করে রেখেছে। নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে কঙ্গোর শিল্পীরা এই বিভীষিকাময় সময়কে ধরতে চেয়েছে।
এই বহির্প্রকাশ এর জায়গা থেকেই জায়রে স্কুল অফ পপুলার পেইন্টিং এর সূত্রপাত। একসময় এই পপুলার শব্দটার বিশেষ কোনও গুরুত্ব না থাকলেও আজ এই স্কুলের শিল্পীরা কলার তুলে সারা দুনিয়ায় ঘোরার সামর্থ্য রাখে। অথচ, এই সাফল্য সত্ত্বেও, শিল্পমহলে স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও এই স্কুল নিয়ে খুব একটা আলোচনা চোখে পড়ে না। তার কারণ, জায়রে স্কুল অফ পেইন্টিং এর দর্শন বা আত্মাটাই ভিন্ন, এই স্কুলের শিল্পীরা ভ্যালিডেশনের পরোয়া করে তুলি ধরেননি, অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে যাওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। এক্সক্লুসিভলি পলিটকাল না হয়েও। কিন্তু, সপাটে। এই আর্ট মুভমেন্ট আসলে একগাল হাসি নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকে চোখ দেখাতে পারে, আবার নিম্নবিত্ত সমাজের জীবনযাত্রাকে নিঁখুতভাবে তুলে ধরতেও পারে।
শুরুটা হয়েছিল ছোট করেই। কিনহাসাতে চেরি সাম্বা বলে এক ছোকরা একটা স্টুডিও খুলে বসে। বিলবোর্ড, কমিক স্ট্রিপের গ্রাফিক স্টাইলটা পেইন্টিংয়েও তুলে এনেছিল সে। ছবি আঁকা হত 'বার্লাপ' মানে পাট ও শনের তৈরি মোটা কাপড়ের ক্যানভাসে, তা সেটাকে বস্তাই বলা যায়। চেরি সাম্বার সঙ্গে এসে যোগ দেন মোকে আর বোডো। এই দুজনেও প্রায় একই ভাবে কাজ করছিলেন। দল বড় হয়। চেরি সেরিন আর চিক লাইডিও ঢুকে পড়েন। অর্থাভাব ছিলই, উপার্জনও বিশেষ হত না। সত্যিকারের বিলবোর্ডও আঁকতে হয়েছে দায়ে পড়ে, উপায় কী? কিন্তু এই দিন আনি দিন খাই ছবি আঁকার মধ্যেই যে সৎ প্যাশনটা নিয়ে এসেছিল এই কয়েকজন, তাতে কোনো খামতি ছিল না। কঙ্গোর মানুষের রোজকার জীবনের সব ছবি। রঙিন, প্রাণবন্ত কিন্তু বহুস্তরীয়। লাইজ, জয় অ্যান্ড পলিটিক্স অফ লাইফ ইন কঙ্গো। কিন্তু খেয়াল করার কথা হল, মোটামুটি একই স্কুলের শিল্পী হলেও এই প্রত্যেকের আঁকার দর্শন একেবারেই ভিন্ন ছিল। চেরি সাম্বা ছবির ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাটো স্টেটমেন্ট গুঁজে দিতেন, মোকে পানশালার সামাজিক জীবনকে মাধ্যম করে ছবি 'ডকুমেন্ট' করতেন (খানিকটা আমাদের মারিও মিরান্ডার মতো) বোডো আবার কুসংস্কারগ্রস্ত সমাজকে আঘাত হানতে সুরিয়েলিস্টিক ইমেজারি ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। ১৯৭০ সালে জোয়ানেস ফ্যাবিয়ান বলে আমস্টারডামের এক নৃতত্ত্ববিদ কঙ্গোর ভিসুয়াল হিস্ট্রি প্রজেক্টের জন্য শিবুম্বা কান্ডা মাটুলুর সাহায্য নেন। মাটুলু নিজেও বড় শিল্পী ছিলেন, জায়রে পলিটিকাল মুভমেন্ট নিয়ে আঁকা তাঁর রাজনৈতিক ছবিগুলো সে-সময় ভালোই সাড়া ফেলেছিল। মাটুলুই দুনিয়াকে জায়রে স্কুল অফ পপুলার আর্ট আর সাইন পেন্টার্স মানে সাম্বা-মোকো-বোডো জুটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ফ্যাবিয়ান পরে 'রিমেম্বার দ্য প্রেজেন্ট' বলে একটা বইও লিখেছিলেন। ইউনিফোর্নিয়া অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেসের এই পেপারব্যাক বইটা এক অসম্ভব মূল্যবান ডকুমেন্ট। প্রথম যখন এই ছবিগুলো ইউরোপ আমেরিকার চিত্র সংগ্রাহকদের সামনে আসে, তাঁদের চোখ কপালে উঠেছিল। ক্রিটিকদের মাথায় হাত। এমন জিনিস কেউই আগে দেখেননি। ভালো মন্দ বলা তো অনেক পরের কথা। ধীরে ধীরে এই স্কুলের শিল্পীরা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, দু দশকের মধ্যে এই আর্ট মুভমেন্ট নতুন আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলন হয়ে উঠল। ২০০১ সালে মোকে মারা গিয়েছেন, সাম্বা-চেরিন-বোডো জুটি আজ আফ্রিকান আর্টের অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

কয়েকটা নমুনা। আগ্রহীরা ইন্টারনেটে আরো ছবি দেখতে পারেন।











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন