মেয়েটা সেকেন্ড জেনারেশন জার্মান ইম্মিগ্রেন্ট। একে তো চিরকাল টাকাপয়সার টানাটানি। তার ওপর রোগভোগ লেগেই আছে। আমেরিকায় পা জমানো অতটাও সহজ নয়। অর্ধেক জীবন ধরে স্ট্রাগল করে করে যখন জোহানা অবশেষে নিউজার্সিতে এসে উঠল বরের সঙ্গে, তখন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক। জোহানা ভেবেছিল, এইবার বুঝি স্বস্তি হল। তার বর মোটামুটি স্টেবল চাকরি করে, এইবার সে সুখে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘরসংসার করবে। কিন্তু অত সুখের কপাল সকলের নয়। বড় শহরে ঘর চালানো অতটাও সহজ নয়, তারপর তার মেয়ে ডোরা খুবই রুগ্ন। কিছু না কিছু লেগেই আছে। সাত বছর বয়সে তার পোলিও ধরা পড়ল। ডাক্তার বদ্যি ওষুধ অপারেশন নানাবিধ চিকিৎসার জ্বালায় জোহানাদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। কিন্তু টাকাপয়সা জলাঞ্জলি দিয়েও কিচ্ছু লাভ হল না। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন, ডান পায়ের মায়া বাদ দেওয়াই ভালো। পোলিওর ফলে সে পা চিরকালের মতো ডিফর্মড হয়ে গেছে। সেই পার্মানেন্ট লিম্প, সেই বিকৃত পা নিয়েই চলতে হবে, অন্য পাটার অবস্থাও খুব সুবিধের নয়। ডোরা, এইটুকুন মেয়ে, সে সবই দেখল, শুনল, বুঝল। তার বাবা গজগজ করে চলল, মা কেঁদে ভাসাল, ডোরার বিশেষ ভাবান্তর হল না। দিন কাটতে লাগল। অর্থাভাব, রোগভোগ, ঘরে অশান্তি লেগেই থাকে। এহেন ডোরার যখন বারো বছর বয়স, তার বাবা তাদের ফেলে রেখে চলে চলে গেলেন। রয়ে গেল জোহানা। দুটো ছেলেমেয়ে। এই আঘাত কাটিয়ে ওঠা অত সহজ নয়। কিন্তু জীবনে অনেক ঝড়ঝাপট সহ্য করেছে সে, এত তাড়াতাড়ি হার মানার পাত্রীই সে নয়। একসময় জোহানা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। তাকে কাজ খুঁজতে হবে। কিন্তু হোবোকেনের এই ছোট্ট অঞ্চলে থেকে হবে না, বড় শহরে না থাকলে তাকে কাজ দেবে কে? তল্পিতল্পা বেঁধে, সংসার গুটিয়ে, তারা এসে পড়ল নিউইয়র্কে, বাসা বাঁধল দরিদ্র পাড়ার একটা চুনকালি উঠে যাওয়া বাড়িতে। সেই বাড়ি থেকেই মেয়ের হাত ধরে রোজ নিউইয়র্ক শহরে চলে আসে জোহানা, কাজের সন্ধান করে। এ পথ সে পথ, এ পাড়া সে পাড়া। এক একটা অফিসে গিয়ে কাজের খোঁজ করা, তারপর ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা। অকেজো পা নিয়ে লেংচে লেংচে মায়ের পিছনে চলে কিশোরী ডোরা। দেখে, মায়ের কপালে ঘামের রেখা। বিষন্ন মুখ, চোখেমুখে উদ্বেগ। বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে কয়েকদিনে। মনে মনে সে ঠিক করে ফেলল, মা যে সুখের সংসার পায়নি, মেয়েকে সেটা পেতেই হবে। অর্থনৈতিক সমস্যা আর স্বচ্ছল ঘরপরিবার, এই সব অর্জন না করলে ডোরার শান্তি হবে না।
ঘোরাঘুরি করে জোহানা অবশেষে একটা লাইব্রেরিতে কাজ জুটিয়ে ফেলল। কিন্তু ডোরাকে নিয়ে কি করা যায়? ভেবেচিন্তে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল ইহুদি সংগঠনের ধার্মিক স্কুলে, সেখানে তিন হাজার ইহুদির মাঝে ডোরা একমাত্র 'নন-জিউ'। এই সময়ে বেশ কিছু ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধু পাতিয়ে ফেলে সে। পরবর্তী কালে ইহুদিদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার হয়েছে, নিজে জার্মান হয়ে সেটা সে কখনওই মানতে পারেনি। কিন্তু বন্ধুবান্ধব ছাড়া স্কুলে তার মন বসেনি। স্কুল শেষ হলেই সে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, দুর্বল পা নিয়েই চক্কর দেয় গোটা শহর। কত ধরনের মানুষ! খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাদের পিছু পিছু ঘোরে ডোরা, গল্প বানায় তাদের চেহারা দেখে। কল্পনা করতে চেষ্টা করে এই সমস্ত মানুষের সুখ দুঃখের কাহিনি। মাঝেমধ্যে বেঞ্চিতে বসে তাকিয়ে থাকে সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া জনপ্রবাহের দিকে। বয়ে চলা শহর। মানুষের ঢল নেমেছে নিউইয়র্কে। সবাই ব্যস্ত। রুজিরুটির জন্য ছুটোছুটি করছে সবাই, এরই মাঝে হুটহাট ব্যতিক্রমী মানুষ চোখে পড়ে যায়। জননেতা, কবি, স্লোগান দেওয়া ছাত্রদের দল, টুল আর ক্যানভাস নিয়ে বসে থাকা পোর্টেট আর্টিস্ট, স্যাক্সোফোন প্লেয়ার, বিড়াল কোলে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বৃদ্ধা। কত অদ্ভুত চরিত্র চোখে পড়ে! বিচিত্র তাঁদের পেশা, বিচিত্রতর জীবন। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ডোরা, দেখতে দেখতে নেশা লেগে যায় তার। তখনও ডোরা জানে না, এই নেশাই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে সারাজীবন!
বছর ঘোরে। ডোরা বড় হয়। ততদিনে তার দেখার চোখ পরিণত হয়েছে, কিন্তু চেনা শহরের চৌহদ্দি টপকে দুনিয়া দেখার বাসনা তাকে পেয়ে বসেছে। টিন এজ পেরিয়ে যখন সে যুবতী, ডোরা আর তার বন্ধু ফ্লোরেন্স বেটসের সঙ্গে বিশ্বভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়ে। প্রথম লক্ষ্য ক্যালিফোর্নিয়া। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই ডাকাতি হয়ে সর্বস্ব হারায় তারা। শেষমেশ ডোরা এসে থিতু হয় সানফ্রান্সিসকোতে। তখন সে মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে, ক্লিয়ারেন্স এইচ হোয়াইটের কাছে কোলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ফোটোগ্রাফির কোর্স করবে। হোমওয়ার্ক করতে একটা স্টুডিওতে ফিনিশারের কাজ নিয়ে নেয় ডোরা। সব ঠিকঠাক চলছিল। এমন সময় ডোরার দেখা মেনার্ড ডিক্সনের সঙ্গে। ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট হিসেবে ডিক্সনের খ্যাতি ছিল। ডোরা কয়েকদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করে, তারা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বিয়ের প্রস্তাব আসে ঝটপট৷
ডিক্সন যাকে বলে পার্ফেক্ট আমেরিকান জেন্টলম্যান, কোনোকিছুই পরের জন্য ফেলে রাখে না, এরকম বর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ডোরার মনে পড়ে, সে ঠিক করেছিল, মায়ের যা পাওয়া হয়নি, মেয়ে তা অর্জন করবেই। আর সাতপাঁচ না ভেবে হ্যাঁ করে দেয় সে। ইতিমধ্যে একটা ইনভেস্টর পেয়ে গেছে সে, নবদম্পতি একটা পোর্টের্ট স্টুডিও খুলে বসে। ফোটোগ্রাফির শখ কাজে লাগিয়ে টাকা আসছে। ভালো বর, ভালো বাড়ি, সমাজে নামও আছে। দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। এভাবে প্রায় পনেরো বছর কেটে গেল। ডোরা যা চেয়েছিল, সবই পেয়েছে। কিন্তু তবু, কোথাও যেন একটা কাঁটা বিঁধে থাকে। কী যেন খচখচ করে মনে! উচ্চবিত্তদের হাসিমুখ পোর্টেট ছবি তুলতে গিয়ে আচমকা মনে পড়ে যায় নিউইয়র্ক শহরের জনস্রোত। দরিদ্র মানুষের ভিড়। গৃহহীন বালক, অসহায় বৃদ্ধ, ছেলেমেয়ের হাত ধরে ছোট শহর থেকে বড় শহরে এসে পড়া সেই সব উলোঝুলো মানুষ। ঠিক জোহানার মতোই দেখতে লাগত তাদের। এই অচেনা মুখের ভিড়ে দাঁড়িয়ে তাদের বড় আপন মনে হত ডোরার। ভালো লাগত। আজ শত সুখের মাঝে সেই অদ্ভুত ভালো লাগাটা কোথায় যেন উবে গিয়েছে। আজ আর সে পথে পথে হেঁটে বেড়ায় না, মানুষজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের গল্প বোঝার চেষ্টা করে না, এই সাজানো গোছানো শহরের সঙ্গে সম্পর্কটা ক্রমে আরো ম্যাড়মেড়ে হয়ে আসছে। রাতে ঘুম হয় না তার। মাঝেমধ্যে দমবন্ধ হয়ে আসে। কীসের অভাব তার? কী চায় সে? বুঝতে পারে না ডোরা। সত্যিই কি এই জীবন নিয়ে বাকিটা আয়ু কাটিয়ে দিতে চায় সে? এই সুখই কি সে চেয়েছিল? দোনামনা ভাব হয়তো কোনোদিনই কাটত না, কিন্তু এমন সময় একটা খবর ডোরার জীবন বরাবরের জন্য বদলে দিয়ে গেল।
১৯৩১ সাল। আমেরিকার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুতগতিতে পাল্টাচ্ছিল। ১৯২৯ সালের মন্দা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রেট ডিপ্রেশনের ফলে কর্মসংস্থান খুইয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে কয়েক কোটি মানুষ। তিরিশের দশকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের ছোট ছোট টাউন আর মফস্বল থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কাজের সন্ধানে ক্যালিফোর্নিয়ায় যেতে শুরু করে। এদের অনেকেই ঋণশোধ করতে গিয়ে বাড়ি ঘর সব কিছু হারিয়ে পথে বসেছেন। কপর্দকশূন্য অবস্থায় তারা এই কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য পথে নেমে পড়েছে, কিন্তু কাজ কই? ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েও অনেকে ফিরে আসছে, উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই শহর থেকে ওই শহর। সঙ্গে স্ত্রী, সন্তান, বুড়ো বাবা মা। এককালে তাদের ঘরবাড়ি ছিল, রোজগার ছিল, আনন্দ উৎসব ছিল, এখন সে সব স্বপ্নের মতো মনে হয়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলে এই ভ্রাম্যমাণ জীবন। ফসলের সময় ক্ষেতেখামারে কিছু কাজ পাওয়া যায়, সেই কাজ পেতে হাজারে হাজারে মানুষ লাইন দেয়। বাকিরা ছেঁড়াখোড়া তাঁবুতে, ভগ্নপ্রায় ট্রাক বা বিকল মোটরগাড়ির মধ্যে সংসার পেতেছে। ওকলাহোমার বাসিন্দা, তাই মিডিয়া এদের নাম দিয়েছি ওকি। আধপেটা খেয়ে, সহায়সম্বলহীন ভাবে এই ওকিরা জীবন কাটায়। সংকট আরো ঘনিয়ে আসে শীতের সময়। অন্নসংস্থান নেই, গরম জামাকাপড় নেই, ভবিষ্যতের ঠাঁই নেই, কিন্তু তবু তারা হেঁটে চলে, ঘাঁটি বাঁধে ন্যাড়া মাঠে। তুষারপাত আর ধুলোর ঝড় সহ্য করে, ঘাস মুখে নিয়ে চিবোয়, নয়তো পোটলাপুঁটলি টেনে এগোয় অন্য ডেরার দিকে। একটাই উদ্দেশ্য, বেঁচে থাকতে হবে। এই নিদারুণ পরিশ্রম সকলের জন্য নয়। অনেকে অনাহারে মারা যায়, অসুস্থ হয়ে পড়ে। না আছে কোনো পাকা শেল্টার, না সরকারি ব্যবস্থা। বয়স্কদের পায়ে ফোসকা, শিশুদের ছালচামড়া উঠে গিয়ে নাক থেকে রক্ত পড়তে থাকে। দুনিয়ার সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ মানুষ একটা দশক এভাবে কাটিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু কারো কোনও হেলদোল নেই। সবাই তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে।
ওকি ক্রাইসিসের খবর ডোরার কানে যখন পৌঁছাল, তখন সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুখের সংসারের ঘেরাটোপ টপকে যাওয়ার জন্য সে ছটপট করছে। ওকিদের জীবনযাত্রার ছবি তোলার প্রস্তাব এফ এস এ নিজে থেকে দিয়েছিল কিনা ঠিক জানা যায় না কিন্তু ডোরা সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহুর্তও দেরি করেনি। 'আই হ্যাভ হ্যাড এনাফ' বলে সে ক্যামেরার সাজসরঞ্জাম নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল। যেদিন সে প্রথম ওকিদের ছবি তুলেছিল, সেইদিন থেকেই ডোরা সত্যিকারের বড় হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে ডরোথি ল্যাং। তখন সে জানে না যে মানুষের জীবনকে ক্যামেরায় বন্দি করার এই নেশা তাকে সারা দুনিয়ায় নিয়ে যাবে, সোশ্যাল রিয়ালিজম আর ডকুমেন্টারি ফোটোগ্রাফির জন্মদাত্রী বলে জানা হবে তাঁকে। ডরোথি শুধু চেয়েছিল, সেই মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তাদের চোখের দৃষ্টিতে উঁকি মেরে তাদের জীবনের গল্প জানতে। কোনো প্রশ্ন না করেই তাদের আশ্বাস দিতে। তাদের নীরবে জানাতে, যে আমরা আছি তোমার পাশে। দেশের মানুষ তোমাদের ভুলে যায়নি। হাল ছেড়ে দিও না! ডরোথি ল্যাংয়ের স্টুডিও টু স্ট্রিটের এই সফর কোনোদিন থামেনি, শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন হিউমান ক্রাইসিসের ছবি তুলে গিয়েছেন। ১৯৩৫ সালে প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর অর্থনীতিবিদ পল টেলারের সঙ্গে দেখা হয় তার। পল বার্কলেতে পড়ানোর সময়েই বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য আর মাইগ্রেন্ট লেবারদের সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন। পলের সঙ্গে মানসিকতার মিল ছিল ডরোথির। ১৯৩৬ সালে বিয়ে করার পরই এই জুটি পথে নেমে পড়ে। পোর্টেট ফোটোগ্রাফিকে বিদায় জানিয়ে ডরোথি তখন পুরোপুরি পিপল ফটোগ্রাফিতে মনোনিবেশ করেছেন। পরিত্যাক্ত শহর, ধুঁকতে থাকা টাউন, অস্থায়ী ক্যাম্প, রিফিউজি হাসপাতাল ঘুরে বেড়ায় দুজনে। অসহায় মানুষদের কাছে গিয়ে বসে। পল কথা বলেন, ডরোথি শুধু দেখে যান নীরবে। ছবি তোলেন, যখন ইচ্ছে হয়। ছোটবেলায় নিউইয়র্কের রাস্তায় অজান্তেই যে বিদ্যা রপ্ত করেছিলেন, সেসব এখন কাজে লাগছে।
সংবাদমাধ্যমে ডরোথির টানা প্রথম উল্লেখযোগ্য ছবি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালেই। নাড়া দেওয়া সব ছবি। মানুষের মুখ, তাদের রোজনামচা। কিন্তু সব ছবিতেও একটা বিষাদ জড়িয়ে আছে। 'মাইগ্র্যান্ট মাদার' ছবিটা যখন প্রকাশ্যে আসে, তখন প্রথম ওকি ক্রাইসিস নিয়ে হইচই শুরু হয়। কংগ্রেস অব্দি নড়েচড়ে বসে। ছবিটা কে তুলেছে, সে নিয়ে অবশ্য কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনি প্রথম প্রথম। কে ভেবেছিল, এই ছবি পঞ্চাশ বছর পর 'কাল্ট' হয়ে যাবে, নিলামে কোটি কোটি টাকা দর উঠবে সেই সাদাকালো ছবির। হাজার হাজার রিসার্চ পেপার লেখা হবে এই একটা ছবি নিয়েই, সাংবাদিকরা তন্নতন্ন করে এই 'মাদার'-কে খুঁজতে শুরু করবেন। ডরোথি নিজেও কিছুই ভাবেননি যে, সে কথা নিজেই জানিয়েছিলেন পরে। অকেজো পা নিয়ে মাইলের পর মাইল যখন হেঁটেছেন, দরিদ্র শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে শীতে কাঁপতে কাঁপতে রাত কাটিয়েছেন, ভাগাভাগি করে খাবার খেয়েছেন, তখন আসলে অন্য কিছুই মাথায় ছিল না তার। কিন্তু মাইগ্র্যান্ট মাদার বলে সেই কাল্ট হয়ে যাওয়া ছবিতে ডরোথি সম্ভবত তার নিজের মা আর নিজের শৈশবের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন, সেই কথাটা অবশ্য তিনি অস্বীকার করেননি। ছবি সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন--
"I did not ask her name or her history. She told me her age, that she was 32. She said that they had been living on frozen vegetables from the surrounding fields, and birds that the children killed. She had just sold the tires from her car to buy food. There she sat in that lean-to tent with her children huddled around her, and seemed to know that my pictures might help her, and so she helped me. There was a sort of equality about it. The pea crop at Nipomo had frozen and there was no work for anybody. But I did not approach the tents and shelters of other stranded pea-pickers. It was not necessary; I knew I had recorded the essence of my assignment."
ডিপ্রেশন এরা শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৪১ সালে জাপান যখন পার্ল হার্বারে বোমা ফেলে, তখন রুজভেল্ট প্রশাসন কয়েক লক্ষ জাপানিজ আমেরিকান মাইগ্র্যান্টকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। এই অমানবিক জুলুমের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেনি, যদিও এই নিরীহ জাপানিজ আমেরিকান নাগরিকদের কোনও দোষই ছিল না। ডরোথিকে যখন তাদের ফোটোগ্রাফিক ডকুমেন্টেশনের কথা জানানো হয়, অনেকেই ভয় দেখিয়েছিলেন। হাজার হোক, ডরোথি নিজে জার্মান পরিবারের সন্তান আর এই সময়ে জাপানিদের অসহায় অবস্থাকে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে ধরতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে! কিন্তু ডরোথি পরোয়া করেননি। তিনি ইহুদি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, নেটিভ ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মাসের পর মাস সময় কাটিয়েছেন, তার কাছে মানুষের অন্য পরিচয় ছিল না কোনোদিন। মানুষ চিরকাল শুধু মানুষ হয়েই ধরা দিয়েছে তার চোখে। জাপানিজ আমেরিকান ইন্টার্নমেন্টে চলাকালীন ডরোথির তোলা মূল্যবান ছবিগুলো আজ সেই কালো ইতিহাসের অন্যতম দলিল।
ডরোথি মারা যান সত্তর বছর বয়সে। পোস্ট পোলিও সিন্ড্রোম তাঁকে চিরকাল ভুগিয়েছে, ক্যান্সারও ধরা পড়েছিল। ততদিনে অবশ্য তাঁর নাম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর হাতে গড়া 'অ্যাপারচার' পত্রিকা অসংখ্য নবীন ফোটোগ্রাফারদের অণুপ্রাণিত করেছে। (প্রসঙ্গত, ফোটোজার্নালিজম নিয়ে আমার আগ্রহের প্রথম কারণ ছিল এই পত্রিকাটাই) মারা যাওয়ার তিন মাস পর নিউইয়র্কের মোমা মানে মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টস তাঁর কাজের রেট্রোস্পেক্টিভ নিয়ে একটা প্রদর্শনী করে। কোনো মহিলা ফোটোগ্রাফারের কাজ নিয়ে এরকম একটা সোলো এক্সিবিশন সেই প্রথম। ২০২০ সালে যখন মোমায় আবার ডরোথি লংয়ের জীবন নিয়ে একটা প্রদর্শনী করা হয়, সারা দুনিয়া থেকে সেরা ডকুমেন্টারি ফোটোগ্রাফাররা হাজির হয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই ডরোথির কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মাইগ্র্যান্ট মাদারের সেই মহিলাকে খুঁজে বার করা হয়েছিল অনেক আগেও। কবেকার কথা, তবু তিনি ডরোথিকে ভুলতে পারেননি। ডরোথি তাকে দেখেছিলেন, তিনিও ডরোথিকে দেখেছিলেন। কিন্তু, সেই নীরব চাহনি বিনিময়ের মাঝেই অনেক কথা বলা হয়ে গিয়েছিল দুজনের। সেই কথাগুলো আজও ধরা আছে সেই ছবিতে। একজন মানুষকে দেখা আর 'দেখা'-র মধ্যে হয়তো এইটুকুই তফাত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন