|
|
আটষট্টি পাতার একটা বই। বই না বলে ডায়েরি বলাই হয়তো ঠিক। বই হিসেবে প্রকাশিত করার কোনও কথাও ছিল না, বিশেষ করে এই দিনলিপি যখন কোনও লেখকের নয়, বরং এক চিত্র পরিচালকের। তখন তাঁর বয়স বত্রিশ, পরপর কয়েকটা ছবি পরিচালনা করে একটু পরিচিতি বেড়েছে, একটু একটু করে সবাই তাঁর নাম জানছে। কিন্তু ছোকরার (স্বভাবচরিত্র বিচার করলে ছোকরা বলাই সমীচীন) সে সব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই, সে চালচুলোহীন জীবন যাপন করছেন মিউনিখে, আগামী ছবির এডিট নিয়ে ব্যস্ত। 'দ্য গ্রেট এক্সট্যাসি অফ উডকার্ভার স্টাইনার' বলে একটা স্পোর্টস ডকুমেন্টারির জন্য তোলা ফুটেজ নিয়ে সে দিনরাত পড়ে থাকে। সে জানে না, তিরিশ বছর পর ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকিংয়ের জগতে সে কিংবদন্তী হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, সিনেমার নাম শুনে চিনে ফেলেছেন অনেকেই। ওয়ার্নার হারজগের কথাই বলছি। ফিটজগারাল্ডো, আগিররে: রাথ অফ গড, মাই বেস্ট ফ্রেন্ড আর গ্রিজলি ম্যানের মতো সিনেমার এই পরিচালকের জীবন নিয়েই খানদশেক অসামান্য সিনেমা হতে পারে! যাকগে, আপাতত ব্যাক টু গল্প। ১৯৭৪ সাল, ভয়ানক শীত পড়েছে মিউনিখে, বরফে ঢেকে গেছে রাস্তাঘাট। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই এমন তুষাড়ঝড় শুরু হয়েছে যে সংবাদমাধ্যম উত্তাল। আল্পসের আবহাওয়া মোটেও ভালো নয়, কয়েকদিনের মধ্যে শীত আরো বাড়বে। কিন্তু হারজগের সে সব নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। তিনি এডিট নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময়, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটা সংবাদ এল তাঁর কাছে। বিখ্যাত ক্রিটিক ও চলচিত্র বিশেষজ্ঞ লোটে আইজনারের অবস্থা মোটেও ভালো নয়, তাঁকে প্যারিসের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুনে হারজগ থ মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এই ইহুদি মহিলাকে তিনি দেবতাতুল্য মনে করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন জার্মান শিল্পসমাজ আর চলচিত্র জগত প্রায় ছারখার হয়ে গিয়েছিল, তখন লোটে নিউ জার্মান ফিল্ম মুভমেন্ট এর দিশারি হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। হিটলারের তুঘলকি শাসন ব্যবস্থার ফলে জার্মান চিত্র পরিচালকরা প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন, বিষয়বস্তু বা ট্রিটমেন্ট নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার উপায় ছিল না। এদিকে দু দশকে ওয়ার্ল্ড সিনেমা তরতর করে এগিয়ে গিয়েছে, কিন্তু বাইরের সিনেমার সঙ্গে নবীন পরিচালকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। লোটে আইজনার সেই কাজটা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইহুদী হওয়ার দরুন তাঁকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছিল, কিন্তু সে সব ভুলিয়ে দিয়ে জার্মান সিনেমার ঐতিহ্য রক্ষা ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছিলেন আইজনার। তাঁর লেখা পড়ে নতুন প্রজন্মের কত ফিল্মমেকার যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তার হিসেব নেই।
প্যারিসে থাকলেও তিনি ছিয়াত্তর বছর বয়সে নিয়মিত লেখালিখি করছিলেন, এমনকি হারজগের প্রথম কাজ দেখেও তাঁকে দীর্ঘ চিঠি লিখে তারিফ জানিয়েছিলেন। হারজগের সঙ্গে এই বৃদ্ধার সম্পর্কটা শুধুই মেন্টারশিপের ছিল না, আইজনার এই আধপাগলা ছোকরাকে বন্ধুই মনে করতেন। হারজগও তাই মনে করতেন। সেই বন্ধুটি আজ প্যারিসের হাসপাতালে ভর্তি। সেই বন্ধুটি আজ মৃত্যুশয্যায়। যা শুনেছেন, আশা কমই পাচ্ছেন। হারজগ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধবাক দাঁড়িয়ে রইলেন খবরটা পেয়ে, তারপর নিজের মনেই বললেন, "এখন আইজনারের পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া মোটেও চলবে না। এই মুহূর্তে নয়। জার্মান সিনেমা ওকে ছাড়া বাঁচবে না। আমরা ওকে মরার অনুমতি দিতে পারি না। এখন উনি কিছুতেই মরতে পারেন না। ওকে বেঁচে থাকতে হবে।"
দিনটা ছিল তেইশে নভেম্বর। বাইরে বরফ পড়ছে, তাপমাত্রা মাইনাস দশেরও কম। এরই মধ্যে হারজগ তাঁর ঢলঢলে জ্যাকেট চাপিয়ে একটা ডাফল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিলেন, সঙ্গে নিলেন একটা ক্যাম্পাস। তৈরি হয়ে নিয়ে তিনি নতুন জুতোটা দেখলেন মন দিয়ে। মজবুত জুতো, অত্যাচার করলেও টিকে থাকবে বলেই মনে হয়। ব্যাগে ছোটোখাটো জিনিস ভরতে ভরতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার কেন জানি মনে হচ্ছিল যে তিনি যদি আইজনারকে দেখতে যেতেই চান, তাহলে তাঁকে হেঁটে যেতে হবে। নাহলে তিনি বাঁচবেন না, তাঁকে বাঁচানো যাবে না। এই অন্তরের বাণীটা দৈবিক বা আধ্যাত্মিক বা স্রেফ হারজগের পাগলামি, সে সব জানার উপায় নেই। কিন্তু পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করায় তিনি নিজেই বলেছিলেন, তিনি প্রায় নিশ্চিত ছিলেন আইজনারকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাঁকে দেখতে যাওয়া জরুরি ছিল আর এই যাত্রাটা যে পায়ে হেঁটেই করতে হবে, এই সত্যিটাও তিনি ভীষণভাবে জানতেন।
মিউনিখ থেকে প্যারিস। পাঁচশো মাইল পথ। শীতকাল। ঝড়ের আশঙ্কা আছে, চারিদিকে বরফে বরফ, কোনো কোনো জায়গায় সেই বরফ প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ফুট উঁচু। জার্মানি থেকে ফ্রান্স যেতে হলে পাহাড়পর্বত ডিঙোতে হবে, কিন্তু মাউন্টেন পাসগুলো এখন বন্ধ। পার্বত্য গ্রামগুলোয় শীতকালে কিছুই খোলা থাকে না, লোকজনও থাকে না প্রায়। আর ভুলে গেলে চলবে না, এই ঘটনা আরো পঞ্চাশ বছর আগের। যাতাযাতের সুযোগ সুবিধা, যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক সীমিত ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে কিছুই হারজগের মাথায় এল না। তিনি কাঁধে ডাফল ব্যাগ ঝুলিয়ে, জ্যাকেট পরে, ইউরোপের ম্যাপ আর কম্পাস পকেটে গুঁজে মিউনিখের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর মাথায় শুধু একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, "আমি হেঁটে প্যারিসে পৌঁছাতে পারলে আইজনার বেঁচে যাবেন।"
হারজগ হাঁটতে শুরু করলেন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলল এই হাঁটা। প্রবল শীতে, পাহাড়পর্বত নদী উপত্যকা পেরিয়ে তিনি হাঁটছেন। মাইলের পর মাইল হাঁটা। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই, থাকার ঠিক নেই, খাওয়ার ঠিক নেই। মাইনাস পনেরো কুড়ি ডিগ্রি শীত। রাতে কোনও গ্রাম পেলে পরিত্যক্ত বাড়ি বা হোটেলে আশ্রয় নেন, নাহলে জানলা ভেঙে ঢুকে পড়েন কোনো কটেজে। কোনোদিন কনস্ট্রাকশন সাইটে কাটে, কোনোদিন শুয়োরের খোঁয়াড়ে। কুঁকড়েমুকড়ে শুয়ে থাকেন শীতে, কোনোদিন পেলে আগুন জ্বালান। কখনো ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ পেলে খাবার জোটে, কখনও বা জোটে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় মরেই গেলেন বুঝি, আর পৌঁছানো হল প্যারিসে এই যাত্রা। নতুন জুতোয় পায়ে ফোসকা হয়েছে, ওজন কমেছে হুড়মুড়িয়ে, নরম বরফে চলতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন, গোড়ালি ধ্বসে যায়, চড়াইয়ের সময় সমস্ত জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসে। কিন্তু হাঁটা থামে না।
এরই মধ্যে হারজগের শিল্পীমন তন্ময় হয়ে প্ৰকৃতির সৌন্দর্য দেখছে। ন্যারাগাছের ওপর তুষারের আবরণ, জমে যাওয়া হ্রদ, দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা উপত্যকা। বদলে যাওয়া ভূদৃশ্য। ছোটছোট রঙিন ঝোপ, আপেল বাগান, ফুল ফল পাখি, এবং মানুষ। ছোট ছোট সব গাঁ, সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, গির্জার কাজকর্ম, ছেলেমেয়েদের খেলাধুলো.. শুধু দেখছেন না, অ্যাপ্রিশিয়েট করছেন, মুগ্ধ হচ্ছেন, লিখেও রাখছেন। কোনোদিন খাওয়া জুটছে না, কোনোদিন পা ফুলে ঢোল, কোনোদিন চোখে অন্ধকার দেখছেন, কিন্তু ডায়েরি লেখা বন্ধ হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না হাঁটাও।
তিন সপ্তাহ পর প্যারিসে এসে পৌঁছান হারজগ। ততদিনে লোটে আইজনার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। হারজগ স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন। যাক, তাঁর যাত্রা সফল। আইজনারকে তারা এখন মরতে দিতে পারে না। এই ঘটনার আট বছর পর লোটে আইজনার হারজগকে ডেকে পাঠান প্যারিসে, তখন তিনি নামকরা পরিচালক, জার্মান সিনেমার সুদিনও ফিরে এসেছে। এই যাত্রার কথা বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে 'অফ ওয়াকিং ইন আইস'-এ, আইজনার সহ অনেকেই তা পড়ে ফেলেছেন। আইজনার প্যারিসে হারজগকে ডেকে নিয়ে বলেন, "দেখো, আমার চোখ খারাপ হয়ে গেছে। পছন্দের সিনেমা আর দেখতে পারি না আমি। হাঁটতেও পারি না। আমার যথেষ্ট বাঁচা হয়েছে, আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু আর বেঁচে থাকলে আমি আর ভালো থাকব না। কিন্তু তুমি আমাকে যেতে দিচ্ছ না। ওয়ার্নি, এবার আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আসি। তোমাদের সিনেমা ভালো হোক। ভালো সিনেমার মধ্যে দিয়েই আমি বেঁচে থাকব।"
হারজগ মাথা নাড়েন। আটদিন পর আইজনার মারা যান। হারজগ সিনেমা বানিয়ে চলেন। একের পর এক সিনেমা। বিচিত্র সব বিষয়, কিন্তু পরিচালনার গুণে সে সিনেমা জনপ্রিয় হয়। তাঁর লেখার হাতও অসম্ভব ভালো, তার প্রমাণ কয়েকটা বই পড়লেই পাওয়া যায়।
আমি হারজগের সিনেমা অনেক পরেই দেখেছি যদিও, কিন্তু দেখেছি যে, সেটাই ভাগ্যের কথা। সিনেমা ইজ সিরিয়াস বিজনেস। জাস্ট লাইক কমেডি। কিন্তু সিরিয়াস সিনেমা করতে হলেই যে জীবনে খুব সিরিয়াস হতে হবে, সেটা হারজগকে দেখলেই বোঝা যায়। আজকাল মাঝেমধ্যে খুচরো সিনেমার গ্রুপে যতসব মিডিওকার আর ভুলভাল সিনেমা নিয়ে মাইলখানেক লম্বা সব পোস্ট চোখে পড়ে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, তখন মনে হয়, আমাদেরও একজন লোটে আইজনার দরকার ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন