মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩

এক থি ক্যাটারিনা

 


কমিউনিস্ট রাশিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যতটা আগ্রহ বা জ্ঞান, অষ্টদশ শতাব্দী বা তার আগের রাশিয়া নিয়ে ততোটা আগ্রহ চোখে পড়ে না। অথচ একটু চোখ বোলালে বোঝা যায়, রাশিয়ার ইতিহাস দারুণ মজাদার। মজাদারই বলা উচিত, কারণ যুদ্ধ-বিগ্রহ-খুনোখুনি-প্রতিশোধ বাদেও জারশাহির ইতিহাসের কেমন একটা নির্বোধ চরিত্র আছে, তাকে খুব একটা কুচুটে বলা যায় না। আরো একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এর প্রধান কারণ হল, রাশিয়ার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি। ওরেব্বাস! কী বিশাল দেশ রে ভাই! সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে খানিকটা এগোতে না এগোতেই গোটা ইউরোপের দূরত্ব কভার হয়ে যাবে, উরালের পার্বত্য অঞ্চল আর সাইবেরিয়ার জনশুন্য বনাঞ্চলেই তিন চারটে ভারতবর্ষ ঢুকে যাবে। এই বিশাল জায়গা জুড়ে লোকবসতি প্রায় নেইই, উরালে তো পাঁচশো বছর আগেও কেউ থাকত কিনা সন্দেহ। থাকবে কী করে? শীতে মাইনাস সত্তর, গরমে প্লাস চল্লিশ! কার মাথা খারাপ হয়েছে? এখানে কাউকে ছেড়ে দিলে হয় পটলপ্রাপ্তি ঘটত, নয় মানুষ নিজেই জানোয়ার হয় শিকার করে কাঁচা মাংস খেতে শুরু করত। ইয়ার্কি নয়, এরকম ঘটনার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। কিছু দুর্দান্ত শিকারী গোষ্ঠী বা কয়েদি ছাড়া এখানে কেউই থাকেনি কোনোদিন, এখনও খুব কম মানুষই থাকে। ভূতপ্রেত তন্ত্র মন্ত্র সব বহাল তবিয়তে আছে। বাংলা অলৌকিক সাহিত্য অনুবাদ করে সাইবেরিয়ায় পাঠালে রাদুগা প্রকাশনের মতো উল্টো বিপ্লব হতে পারে!

মস্কো থেকে ব্লাদিবাস্তক মানে সেই উত্তর কোরিয়ার বর্ডার যেতেই ট্রেনে ছ দিন লাগবে, সে আবার পুরো অন্য দুনিয়া। চারশো বছর আগে যে ব্যাটাচ্ছেলে ব্লাদিবস্তকে থাকত, মস্কো বা উরালের খবর জানার কোনো উপায়ই তাদের কাছে ছিল না। যে সাইবেরিয়ায় থাকবে, সে ফিনল্যান্ডের কাছাকাছি ব্ল্যাক সি লাগোয়া রাশান শহরের কথা থোড়াই না জানবে? এমতাবস্থায় 'দেশ'--এর কোনো ধারণা কি সম্ভব? কে তাদের রাজনীতির পাঠ দেবে? কে বন্ধুর পিঠে ছুরি চালাতে শেখাবে? 

আর মার্ক্সবাদী বিপ্লব? ওরেবাবা! সে আবার কোন চিড়িয়ার নাম? কোথায় ব্ল্যাক সি, কোথায় সাইবেরিয়া, কোথায় লাপ্টেভ সাগর, কোথায় কামচাটস্কা, কোথায় মস্কো? সকলে অন্য দুনিয়ার মানুষ, আরামসে এলিয়েন বলা চলে! যেখানে কারো সঙ্গে কারো কমিউনিকেশনই নেই, কারো কাছে কোনো খবরই নেই, সেখানে বিপ্লবের পরিকল্পনাটাই বা করবে কে? আর করবেই বা কেন? কোথায় কে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো ছাপিয়েছে, সেসব পড়তে যাচ্ছে কে? আবার সর্বহারাদের বিপ্লব? কে জার কে মার্ক্স কে বোলশেভিক... বয়ে গেছে লোকের জানতে! হরিণ শিকার করতে পারলেই তারা খুশি! ঘাসকাটা হলেই আগুন জ্বালানোর আর রাতের উৎসবের বন্দোবস্ত পাক্কা।

তবু কিনা শেষমেশ এই দেশে বিপ্লব হল! আর সেই বিপ্লব গোটা দুনিয়াকে প্রভাবিতও করল। কী করে এই অসাধ্যসাধন ঘটল? ভাইকিং রুশ প্রজাতি আর শমনদের তন্ত্রমন্ত্র থেকে শুরু করে জার শাসন, পিটার দ্য টেরিবল আর পিটার দ্য গ্রেটের গল্প, ক্রিশ্চান, মঙ্গোল, মুসলমানদের সঙ্গে রেষারেষি করা থেকে গোগোল আর পুশকিনের উদ্ভব...তারপর রাশিয়ান বিপ্লব! বলতে পারলে দারুণ মজার গল্প হয়! এই নিয়ে একটা বই পড়তেই প্রথমে একটা দারুণ কিসসা জানা গেল। সংক্ষেপে বলে রাখি। 

রুস শব্দের ট্রাডিশনাল মানে হল 'রো', মানে যে নৌকা চালিয়ে আসে। সন ৮৬২ সালে ভাইকিং সর্দার রুরিক দুই ভাইকে নিয়ে নৌকা চালিয়ে নাভগ্রাদ পৌঁছাতেই স্থানীয় বাসিন্দারা বলল, "তোমাদের দেখে তো বেশ তাগড়া মনে হচ্ছে। আমরা বহুদিন ধরে এখানে সুখে বাস করছি কিন্তু আমাদের গায়ে বেশি জোর নেই। তোমরা দেখছি পালোয়ান লোক, আমাদের রাজা হয়ে রাজত্ব করতে পারছ না?"

রুরিক মাথা চুলকে রাজি হয়ে গেল। এই থেকেই রুশ দেশের সূত্রপাত, যদিও এদের মূল নিবাসী ছিল স্লাভিক। রুরিক সহ অন্যান্য ভাইকিংরা এখানে এসে নিজ নিজ সংস্কৃতি এনেছিল ঠিকই, কিন্তু ধর্ম নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। তখন স্লাভ জাতির লোকজন মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী। পেগানিজম তলানির দিকে, ইসলাম আর ক্রিশ্চানরা রেষারেষি করছে। সে যাই হোক, রুরিক বংশ শুরু হওয়ার চার দশক পরেই রানি ওল্গা কন্সটানটিন মানে ইস্তাম্বুল ঘুরতে গিয়ে প্রায় ক্রিশ্চান হয়ে ফিরে এল। সবাই শুনল, এ এক নতুন ধর্মের আমদানি হয়েছে বুঝি! সে হোক, বাইজান্টিন সাম্রাজ্য মনেপ্রাণে চাইত রুশিরা ক্রিশ্চান হয়ে যাক। মুসলমানদের সঙ্গে ধর্মযুদ্ধ করতে হলে তারা এতে বেশে আপারহ্যান্ড পাবে। কিন্তু সে সময় রুশের রাজা ব্লাদিমির মার যুদ্ধ করে সবাইকে কচুকাটা করছেন, তার শরীরে ভাইকিং রক্ত, কথা বলার আগেই না গলা কেটে ফেলে! তাকে ধর্মান্তরিত করবে কার সাধ্য! এমন সময় একদিন ব্লাদিমির বেডরুমে বসে হাড় চিবুচ্ছেন, পুরাতন ভৃত্য এসে বলল, "শুনেছেন তো!"

'''কী?" ব্লাদিমির অবাক।

"আরে কন্সানটিনের প্রাসাদে এক রয়াল ব্লু সুইট আছে। সেখানে এক পরমাসুন্দরী রাজকন্যা থাকে। ক্যাটারিনা ক্যায়েফ ফেল! কেউ ওকে দেখতে পায় না।"

"ক্যানে রে ভাই? দেখতে পায় না কেনে?" ব্লাদিমিরের হাড় চিবোনো থেমে গেছে। 

ভৃত্য গালে হাত দিয়ে বলল, 'কে জানে? শুনি রাজকন্যা তাঁর সলমান খানের জন্য অপেক্ষা করে আছে!"

আর যায় কোথায়, ব্লাদিমিরের ঘুম চটকে গেল। ঠিক করলেন, বাইজান্টিন সাম্রাজ্য আক্রমণ করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কয়েক মাসের মধ্যেও লুটপাট করে হারেরে করতে করতে ঢুকে পড়লেন সেখানে, একের পর এক শহর ধুলোয় মিশে যেতে লাগল। অবশেষে ক্রিমিয়ার কাছে যখন পৌঁছেছেন, বাইজান্টিনের রাজা বেসিল দ্বিতীয় সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে হাজির হলেন।

ব্লাদিমির হাই তুলে বললেন, "সে আমি চলে যেতেই পারি। এমনকি আরবরা তোমাদের ভড়কি দিলে আমিই না হয় গিয়ে তাদের নাক কেটে আসব। কিন্তু তোমার বোন ক্যাট থুড়ি অ্যানা যে ব্লু সুইটে থাকে, ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে হবে।"

বেসিল রাজা বললেন, "সে বেশ কথা। কিন্তু ও মেয়ে ঠিক করেছে ক্রিশ্চান না হলে বেটি বিয়েই করবে না।"

ব্লাদিমির ভেবে বললেন, "সে ঠিক আছে। আমার দিদা নিজেই ক্রিশ্চান হওয়ার জন্য পাগল ছিল। আমাকে অবশ্য কারা যেন মুসলমান হতেও প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তাতে নাকি হুইস্কি রাম কিছুই খাওয়া যাবে না। তাই হাঁকিয়ে দিয়েছি। পাগল নাকি? রুশিরা ওসব না খেয়ে বাঁচে? তোমাদের ধর্মেও ওসব বারণ নাকি?"

"মাথা খারাপ? আপনি বরং হাগিয়া সোফিয়া এসে আমাদের বিশেষ পানীয় চেখে দেখুন, শহরের শোভা দেখুন! পছন্দ হলে সিদ্ধান্ত নেবেন!"

ব্লাদিমির বললেন, "বেশ। আমি কথা দিচ্ছি, আমার ভালো লাগলে আমি আমার রাজ্যের সমস্ত প্রজা সহ ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে নেব। তারপর তোমার বোনকে বিয়ে করব।"

কী আশ্চর্য, হলও তাই! ব্লাদিমির সহ গোটা রাশিয়া... আই মিন... গোটা রা...শি...য়া একবাক্যে ক্রিশ্চান হয়ে গেল ক্যাটারিনার সঙ্গে রাজার বিয়ে করানোর জন্য। এক কথায়! টুরু লাভ একেই বলে। ওপর থেকে কিছু বদল মনে না হলেও এই ধর্মান্তকরণ ভাইকিং স্বভাবচরিত্রকে ধীরে ধীরে অনেক নরম করে ফেলল। ভাবা যায়! 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন