ফিনফিনে বরফের চাদরে ঢেকে গেছে চেনাব। নদী নালা ঘর দপ্তর পাহাড়চুড়ো, সর্বত্র রূপোলি ঝলক। হাঁটতে বেরোলে কিছুক্ষণ পর পর স্নো ফল হয়, ফিরান ঢেকে যায় নরমের তুষারকণায়। ছোট ছোট পাহাড়ি নদীতে পড়ে থাকা বোল্ডারগুলো অতন্দ্র প্রহরীর মতো চেয়ে থাকে বরফে ঢেকে যাওয়া কাঠের পুলের দিকে, যেন অনুমতি ছাড়া কাউকে যেতে দেবে না।
এমন একটা সময় আট বছরের ছেলেটা হাঁটতে বেরিয়েছিল। ছেলেটি বড় ভাবুক, মাঝেমধ্যেই দেখা যায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কম্বলের ফেরিওয়ালা বা ছাগল চরানো রাখালের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে, পাখির ডাক শুনলে খাওয়ার কথা ভুলে যায়। কয়েকদিন আগেই পাঞ্জাবি আর উর্দুতে পরীদের গল্প পড়েছে সে, কাশ্মীরের এই শীতও তার কাছে মায়ার জগত বলে মনে হয়। রাক্ষুসে সব গাছের শাখা বরফের ভারে ঝুলে থাকে, সেখানে ইতিউতি বসে থাকে হালকা রঙের শীতপাখিদের দল। অদ্ভুতভাবে গলা তুলে ডাকে তারা, মাঝে মাঝে গা ছাড়া দিয়ে বরফ ঝেড়ে নেয়। নরম বুগিয়ালে ওপর ঘুরে বেড়ানো ভেড়ার দলকে এ সময়ে আলাদা করে ঠাহর করা মুশকিল, ছেলেটা তবু দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে বানানো দূরবীনে সে সব দেখার চেষ্টা করে। সাদা বরফ মেখে দাঁড়িয়ে থাকে নদীর ওপর থাকা কাঠের পুলিয়া, তার পাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে ছবি আঁকে সে। চেনাব নদীর ধারে ছোট্ট এক শহরে তার জন্ম, কাশ্মীরের সীমান্তে অবস্থিত ছোট্ট মফস্বল। সেখানেই তার বাড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে কাঠের ব্রিজটার ওপর চলে গিয়েছিল সে। ব্ল্যাক আইস এড়িয়ে পুলিয়ার মাঝ বরাবর গেলে নদীর খরস্রোতা বেগের ওপর বয়ে চলা ফড়িঙদের দেখতে পায়। ঘোরলাগা চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় বাচ্চা ছেলেটা। কাঠের বললেও মাঝেমধ্যে আড়বাঁশ আর তারের বেড়া দিয়ে আটকানো আধপচা তক্তা, বরফের ভারে ভিজে নড়বড় করছিল। হয়তো বা এক মুহুর্ত, বা কিছু বেশিও হতে পারে। ছেলেটার পা সেই ভিজে তক্তার ওপর পড়তেই গোটা ব্রিজটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল।
কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড শীতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল ছেলেটার, হাত পা জমে গিয়েছে। কাঠের পুতুলের মতো তার শরীরটা লেভেল ফাইভের র্যাপিড তীরবেগে ভেসে যেতে লাগল। জলের নীচে থাকা সূচালো পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেতে থাকার ফলে মাথা ফেটে গিয়েছে, শিড়দাঁড়ায় বড়সড় চোট লেগেছে। পাথরের মতো শক্ত বরফ যেন মাংস চিরে হাড়ে ধাক্কা দিচ্ছে, তার বয়ে চলা দেহটা নুড়িপাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে ডুবছে, আবার ভুসভুস করে উঠে আসছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই নদী, এই কাশ্মীর, এই দুনিয়া ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে সে। অজ্ঞান হওয়ার আগে সে দেখল, একঝাঁক শীতপাখি তার চোখের সামনে উড়ছে, অদ্ভুত স্বরে গান গাইছে তারা। শুধু তার জন্য।
ঘুম ভেঙে গেল। কোথায় কী, সে শুয়ে আছে বিছানার ওপর। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। কী হয়েছিল এখন আর ঠিক মনে পড়ে না! সেই দিনের ঘটনাটা এতবার এতভাবে স্বপ্নে দেখেছে যে সব এলোমেলো হয়ে যায়! সে কি ব্রিজ ভেঙে নদীর জলে পড়ে গিয়েছিল? না প্রতিবারের মতো সাঁতার কাটতে গিয়েই ঘটেছিল অঘটনটা? কিন্তু যাই হয়ে থাকুক, কী আর আসে যায়?
সে যাত্রা কী করে বেঁচে গিয়েছিল ছেলেটা, সে এক আশ্চর্য গল্প। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও জীবন বদলে গেল তার। দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল, সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে পারল না। একের পর এক কঠিন সার্জারি হয়, ওষুধ গিলে গিলে মুখের ছাল উঠে গেল। ডাক্টার বদ্যিরা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে, কেউই আশার বাণী দেয় না। অনেকে বলে, পাথরের টুকরো ব্রেনের ভিতর ঢুকে গেছে, সার্জারি করে ঠিক করতে হলে চোখ বা কান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে, মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। আবার না করলেও জটিলতা বাড়বে বই কমবে না। ছেলেটার বাবা অবশ্য হাল ছাড়তে রাজি নন। দিনরাত চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। ছেলের মন ভালো রাখতে গল্প বলেন, শায়েরি শোনান, উর্দুতে লেখা গল্পের বই এনে দেন, এনে দেন নানাধরনের পিকচার বুক। সেই নিয়েই থাকে ছেলেটা। গল্পের ছবিগুলো মনের মধ্যে সাজায় ছবির মতো, টুকটাক আঁকার চেষ্টাও করে। কিন্তু পেন্সিল ধরলেই হাত কাঁপে তার, মাথা ধড়ফড় করে। বেশি মনযোগ দিলে বিপদ হতে পারে, ডাক্টাররা জানিয়ে দিয়েছে। তাই লেখাপড়া বন্ধ, আর স্কুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। মাঝে মাঝে নতুন সার্জারির জন্য হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। এই করে ছয় ছয়টা বছর কেটে গেল। শৈশব গেল, এল কৈশোর। ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হল ছেলেটা। হাঁটতে শুরু করল, বই পড়তে শুরু করল, ইকবাল আর গালিবের মাধ্যমে বুঝতে শুরু করল দুনিয়ার হাল হকিকত। এত কিছুর মাঝে ছোট্ট একটা ক্ষতি, শোনার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলল সে। প্রথম দিকে শব্দগুলো আবছা হয়ে ছিল, ক্রমে সে আবিষ্কার করল যে সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ডাক্টাররা দেখেশুনে মাথা নাড়লেন ফের। কিছু করার নেই। মরেই যাচ্ছিল, প্রাণ বেঁচে গেছে, সেই ঢের! কালা হয়ে বেঁচে থাকা মরে যাওয়ার চেয়ে ঢের ভালো।
ছেলেটা কান্নাকাটি করেনি। শব্দের দুনিয়া থেকে সরে গিয়েছে নিজের মতো করেই। ভুলে গিয়েছে মেঘের ডাক, বাবার ধমক, ভাইয়ের গলার স্বর। ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে রাখা অসীম নৈঃশব্দের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে কিশোর ছেলেটি। এখন সে পাখিদের গান শুনতে পায় না, নদীর জলের শব্দ বা ভেড়ার গলার ঘণ্টিও তার কাছে পৌঁছাতে পারে না, শুধু মাঝে মাঝে চোখ বুজলে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কাশ্মীরের শীতপাখিদের গান শুনতে পায় সে। আসলে শোনা যায় না ঠিকই, কিন্তু ওই গানের তরঙ্গটা অনুভব করে ঠিকই, সেই অনুভবটাই মনে হিল্লোল তোলে তার। সে কথা ভাবতে ভাবতেই একদিন সে কাঁচা হাতে একটা ছবি এঁকে ফেলল। একটা পাখির ছবি। ঠিক পছন্দ হল না, আবার আঁকল সে। আবার। সময়ের তো অভাব নেই। স্কুলগুলো জানিয়ে দিয়েছে, কালা ছেলেকে ভর্তি করা সম্ভব নয়। লিপ রিডিং এর শিক্ষা চলছে, কিন্তু সে আর কোনটুকু? বেশি হাঁটাহাঁটি করলেও দুর্বল লাগে। তাহলে ছবিই আঁকা যাক। কয়েক মাস পর দেখা গেল, তার ঘরে আঁকা ছবির দিস্তে দিস্তে কাগজ জমে পাহাড় হয়ে গিয়েছে। তার বাবা এসে দেখলেন, পরপর ছবি এঁকে চলেছে কিশোর ছেলেটি, আর কিছুতেই তার মন নেই। তিনি একদৃষ্টে ছেলের আঁকা পাখির ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর তার মাথায় হাত দিয়ে নিজের ঠোঁটের দিকে ইশারা করে আস্তে আস্তে বললেন, "আঁকা শিখবি?"
সেই শুরু। শীতপাখিদের গানে কী বার্তা ছিল কেউ জানে না, কিন্তু সেই পাখির ছবিটা না আঁকলে ছেলেটার জীবন হয়তো অন্য খাতে বইত। প্রথমে লাহোরের মায়ো স্কুল অফ আর্ট, তারপর মুম্বাইয়ের স্যার জে জে স্কুল অফ আর্ট, তারপর মেক্সিকোর প্যালেসিও দে বেলাস আর্টেস...দিয়েগো রিভিয়েরা আর দাভিদ সিকোরেস এর অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে কাজ শেখা, সারা দুনিয়ায় আর্ট এক্সিবিশন, এক আর্ট ফর্ম থেকে অন্য আর্ট ফর্ম, পেইন্টিং থেকে সিরামিক্স, ভাস্কর্য থেকে স্থপতিবিদ্যা, সব জায়গাতেই ছেলেটা উজ্জ্বল তারকার মতো এগিয়ে এসেছে। অনেকেই অবাক হয়, বিশ্বাস করতে চায় না সব জেনেও। এ কী করে সম্ভব? একজন বদ্ধ কালা ছেলে, যে বত্রিশ বছর অবধি উর্দু ছাড়া কিছু পড়তেই পারত না, যার প্রথাগত শিক্ষা নেই, ভাষাজ্ঞান নেই, লিপ রিডিংয়ের দক্ষতাও বিশেষ নেই, তার সঙ্গে কথাবার্তা চালানো যায় না, আলোচনা করা যায় না, শারীরিক সমস্যার ফলে সারা জীবন ধরে বারবার যাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়... সে কী করে দুনিয়ার আর্ট ওয়ার্ল্ডের সেরাদের মধ্যে চলে এল? কী এমন হল যে দুনিয়া তাকে ভারতীয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলে ডাকতে শুরু করল? এ তো অলৌকিক কাণ্ড!
সত্যি বলতে, ব্যাপারটা খানিক তাই। অলৌকিক। কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না ঠিকই, কিন্তু সেই দুর্ঘটনার ফলে ওই ছেলেটার ভিতর এমন একটা আশ্চর্য শক্তির সঞ্চার ঘটেছিল যা হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকাশ পেত না। শ্রবণশক্তি হারিয়ে যাওয়ার ফলে ছেলেটা যে নৈঃশব্দের দুনিয়ার সন্ধান পেয়েছিল, সেই দুনিয়াই তাকে আঙুল ধরে আঁকতে শিখিয়েছে, 'এক্সপ্রেস' করতে শিখিয়েছে মনের কথাকে। কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করার কোনও উপায় তার ছিল না, তাই মনের সমস্ত আবেগ সে ঢেলে দিয়েছে তার আঁকায়, তাঁর হাতে গড়া পুতুল বা প্রতিমায়, তাঁর ডিজাইনে। আর্টের সমঝদাররা বলেন, এই ছেলের হাতে সৃষ্ট প্রতিটা আঁকা, প্রতিটা ডিজাইন এক শ্বাশ্বত অর্থ বহন করে নীরবে। তারা কথা বলে না ঠিকই, কিন্তু তাদের না বলা কথা, তাদের নৈঃশব্দ সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত, অনেক বেশি বাস্তব। তার কারণ আর কিছুই নয়, এই সত্তাগুলো সৃজিত হয়েছে যার হাতে, তিনি নিস্তব্ধতার ভাষাটি রপ্ত করেছিলেন সারা জীবন ধরে। আ লাইফ অফ কমপ্লিট সাইলেন্স হ্যাড গিভেন বার্থ টু দ্য আর্ট অফ সাইলেন্স।
বাষট্টি বছরের নীরবতার পর অস্ট্রেলিয়ায় এক জটিল সার্জারির মাধ্যমে শ্রবণশক্তি ফিরে পান এই শিল্পী। সবাই বারণ করেছিল, কারণ একটু এদিক ওদিক হলে মৃত্যু ছিল অনিবার্য। হিয়ারিং নার্ভে একশোটারও বেশি কোষ থাকে, কিন্তু জায়গা খুব কম থাকে বলে চব্বিশটার বেশি ইলেক্ট্রড কানে ইন্সটল করা যায় না। সূক্ষ্ম তার দিয়ে এই চব্বিশটা ইলেক্ট্রডকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল প্রতিটা কোষের সঙ্গে। একটাও এদিক ওদিক হলে ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে, সেও বলে দেওয়া হয়েছিল আগেভাগে। কানে শুনতে পেলেও অবশ্য স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি পাওয়া যাবে না, ধ্বনি তরঙ্গ ইলেক্ট্রনিক বিটসের মাধ্যমে ব্রেনে ধরা দেবে, তারপর ব্রেন সেগুলো নিজের মতো করে ইন্টারপ্রেট করে ফিল্টার করবে। কিন্তু যে মানুষ দীর্ঘ বাষট্টি বছর কিছুই শোনেননি, তার ব্রেন পাখির ডাক বা টেলিফোন কল বা বাজির আওয়াজকে চিনতে পারবে কী করে? পারবে না। সে জন্য সময় লাগবে। এই নিস্তব্ধতার দুনিয়া থেকে শব্দের দুনিয়ায় ফিরে আসার এই জার্নি এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, যা আর্ট স্কুল চেয়ে কোনোমতেই কম নয়। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুন দৃষ্টি দেবে, নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা দেবে, নতুন আশা দেবে... সেইজন্যই সম্মতি দিয়েছিলেন তিনি। সমস্যা এসেছে ঠিকই, প্রথম দিকে কোনো শব্দই চিনে উঠতে পারতেন না তিনি, কিন্তু সে সমস্যা আবারও কাটিয়ে উঠেছে ছেলেটা। বরাবরের মতো। আট বছরের ছেলেটা তখন বৃদ্ধ, কিন্তু সেই জেদি মনটা একই রয়ে গিয়েছিল চিরকাল।
সতিশ গুজরাল। স্বাধীন ভারতের অন্যতম শিল্পীই শুধু নয়, এ যুগের আর্ট লিজেন্ড। ফেসবুকে আকছার মিকেল এঞ্জেলো, ভিঞ্চি আর বেটোফেনকে নিয়ে লেখা চোখে পড়ে, তুলনায় সতিশ গুজরালকে নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। সবাই তাকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরালের ভাই হিসেবেই চেনেন। অথচ তার বডি অফ ওয়ার্ক নিয়ে সারা দুনিয়ায় কাজ হচ্ছে। সত্যি বলতে তার গোটা জীবনটাই তো একটা রূপকথার শামিল। কোভিড শুরু হওয়ার ঠিক আগেই ভদ্রলোক এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু কাজগুলো রেখে গিয়েছেন আমাদের জন্য। সময় থাকলে, নেটে খুঁজে দেখবেন। বিশেষ করে পার্টিশন সিরিজের আঁকাগুলো।শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও নিজের মতো করে বেঁচে থাকার আনন্দটা খানিকটা হলেও হয়তো বোঝা যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন