শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

রোমিও জুলিয়েট ঔর অন্ধেরা

 


কাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে গেছে। প্রেমের দিন। এর আগে লাইন দিয়ে এই ডে, ওই ডে সংক্রান্ত পোস্ট দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ল, একটা সময় অব্দি প্রেম ব্যাপারটা আমার কাছে যথেষ্ট বিরক্তিকর বলেই মনে হত। হাসার কিছু নেই। পাবলিক ডিসপ্লে অফ লাভ নিয়ে যে ধরনের ট্যাবু আমাদের দেশে আছে আর লাভ স্টোরির নামে যে উদ্ভট সিনেমা আমাদের পরিবেশন করা হয়েছে নয়ের দশকে, তাতে এমনটা না হওয়াই অস্বাভাবিক। কিন্তু একদিন, আচমকা একদিন, সব কিছু বদলে গেল। আর কিছুই না, একটা সিনেমা দেখে ফেললাম। সাদা কালো সিনেমা। ভাষা চেক। ইংলিশ সাবটাইটেল। অর্ধেক বুঝলাম, বাকিটা মাথার ওপর দিয়ে গেল। কিন্তু না বুঝলেও গোটা দু আড়াই ঘণ্টা আমি সম্মোহিত হয়ে বসে রইলাম। মনে আছে, তখন আমি সেভেন না এইটে পড়ি। সে রাতে আমার ঘুম হল না। পরের রাতেও না। সিনেমার এক একটা স্টিল আমার মাথায় ঘুরে চলল। কয়েকদিন কেটে গেলে বুঝলাম, না, এ সিনেমার ভূত আমার ঘাড়ে বসেছে। এত সহজে মুক্তি দেবে না।
পরবর্তী কয়েক বছর ধরে আমি ওই সিনেমা সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করেছি। সেই অকালপক্ক বয়সে, বেনারসের মতো ছোট শহরে, প্রাক ইন্টারনেট আর লাইব্রেরিহীন দুনিয়ায় কে আর ইনফো দেবে আমাকে? তাই বিশেষ কিছু জানা হল না। শুধু সিনেমার নামটা মুখস্থ করে রেখে দিয়েছিলাম। চেক সিনেমা। অনুবাদ করলে নামটাও সহজ। রোমিও জুলিয়েট অ্যান্ড ডার্কনেস।
এর দশ বছর পর যখন আবার সে ছবি দেখি, তখন আমি তার ইতিহাস ভুগোল সব জানি। ১৯৬০ সালে ছবিটা পরিচালনা করেছিলেন জিরি ওয়াইজ। চেক সাহিত্যিক য়ান ওতচেনাসেকের নামকরা বই 'রোমিও জুলি আ তামা' ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছিল কিনা জানি না, কিন্তু আমি পড়েছিলাম হিন্দিতে। এই একটা সিনেমা, যা আমাকে দু ঘণ্টার মধ্যে প্রেমের ডেফিনেশন দিয়ে গেল। আমি প্রাগের প্রেমে পড়লাম, অনুবাদকের প্রেমে পড়লাম, নাস্তিকতার প্রেমে পড়লাম, আর প্রেমের প্রেমে পড়লাম। এই। এই হল গল্প।
এই কাহিনি পাবেল আর হাংকার। আঠেরো কুড়ি বছর বয়স দুজনেরই। নিয়তিই তাদের মিলিয়ে দিয়েছিল। সে ১৯৪২ সাল। প্রাগে জার্মানদের জোরজুলুম চলছে। ইহুদিদের ধরে ধরে কচুকাটা করা হচ্ছে, নয় পাঠানো হচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। হিটলার বাহিনীর দৌরাত্ম্যে দেশের উদারমনস্ক মানুষজনও মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য হয়েছে, প্রাণ বাঁচাতে নিষ্ঠুরতাকেই বেছে নিয়েছে সাধারণ মানুষ। ইহুদিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা মানে যে যমরাজাকে ডিনারে ডাকা, সে সবাই বুঝে গিয়েছিল। শুলে চড়তে কেউই রাজি নয়। কিন্তু দুনিয়াতে দু একজন পাগল ছাগল ঠিকই থাকে। পাবেল হল সেই ছাগল। হাংকা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। সে ইহুদি। তার ডাক্টার বাবা নাজিদের হাতে প্রাণ খুইয়েছেন। এবার তার পালা। এমন সময় ভাগ্যদেবতা তার সঙ্গে পাবেলের জীবন জুড়ে দিয়ে নাটক দেখতে চাইলেন। পাবেল আর হাংকার দেখা হল। পাবেল তাকে ঘরের ওপরের সেলারে লুকিয়ে রাখল। কোনো বিপদের সম্ভাবনাই তাকে ভয় দেখাতে পারল না।
সেলারে ঘন অন্ধকার। নিজের হাতই দেখা যায় না৷ জানলা নেই, কাঠের তক্তা ভাঙা একটা ফাঁক আছে, সেখানে একটা ময়লা পর্দা ঝুলছে। সেটা দিনের বেলা সরানো যায় না। কিন্তু রাতে মাঝেমধ্যে হাংকা সেটা সরায়, নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।পাবেলও বসে থাকে তার সঙ্গে। চুপচাপ। এককালে ফোটোগ্রাফির শখ ছিল পাবেলের, এই জায়গাটা ডার্ক রুম হিসেবে ব্যবহার করত সে। কিন্তু সে সব আগের কথা। এখন তাদের পরিবারের অবস্থা খারাপ। ঘরে মা আর দাদু ছাড়া কেউ নেই। দাদু ছিলেন ঘড়ির কারিগর, নতুন মেশিন তৈরি করে বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি এখন জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে গিয়েছেন। কাজকর্ম করতে পারেন না। পাবেলেরও কিছু করার নেই। সে বিজ্ঞানের ছাত্র। নানা বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল, কিন্তু যুদ্ধের ফলে সেসব মাথায় উঠেছে। এদিকে তার মা পাড়াপড়শিদের কাপড় সেলাই করে দিনগুজরান করছে। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এরই মধ্যে খাবার বাঁচিয়ে বা চুরি করে হাংকার জন্য নিয়ে যায় পাবেল। কিন্তু কতদিন আর এসব কথা গোপন রাখবে? একসময় মা জেনেই যায়, তখন পাবেল হাংকার ব্রেড কেনার জন্য তার প্রিয় ক্যামেরাটি বিক্রি করে দেয়।
সেলারে সবসময় ঘোর অন্ধকার। মাঝে মাঝে আলোর জন্য ছটপট করে হাংকা। পাবেল সান্ত্বনা দেয় তাকে। সেই নিশ্বাস বন্ধ করা ঘন অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকে দুজন। কেউ কাউকে দেখতে পায় না। সেই অন্ধকারেই প্রেম আসে। নিবিড় অন্ধকারে জন্মানো নিবিড় প্রেম। হাংকা নদীর কথা বলে, খোলা আকাশ আর ভোরের আলোর কথা বলে, পাবেল বলে তার ফোটোগ্রাফির কথা। সে ফিজিক্স পড়বে, অ্যাস্ট্রোনমি পড়বে, বৈজ্ঞানিক হবে। হাংকা শোনে, হাসে বিষন্ন ভাবে।
হাংকার জীবন তাকে পাবেলের চেয়ে বেশি পরিণত করেছে, তুলনায় পাবেল এখনও খানিক ছেলেমানুষ। হাংকা ভয় পায়, বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলে পাবেলকে সাবধান করে, পাবেল পাত্তা দেয় না। কিন্তু মনে মনে সেও জানে, হাংকা এখানে লুকিয়ে আছে জানলে কী হতে পারে? কিন্তু সব জেনেও সে এই সত্যিটাকে মানতে চায় না, স্বপ্ন দেখা আর নিয়তিকে মানতে না চাওয়াই প্রাপ্তমনস্ক দুনিয়ার বিরুদ্ধে তার বিপ্লব। এরই মধ্যে প্রেম আসে, গভীর হয়। অন্ধকারের মধ্যে পাবেল হাংকাকে ওয়ালজ নাচতে শেখায় একদিন। দুজনে অপেক্ষা করে থাকে রাতের জন্য। জানলার কাঠের তক্তা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়টুকু তাদের কথোপকথনের সময়। সে কথার কোনো মানে হয় না। সবই কল্পনা, বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। তাও কথা হয়।
দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে পাবেল বলে, "ওই তারাটা দেখেছ! ওটা কত দূরে জানো? ওই তারার আলো আমাদের কাছে আসতে দু লক্ষ বছর লাগে!"
হাংকা বিস্মিত হয়ে বলে, "এত দূর! ওর পর কী আছে?"
"আরো কত তারা। গ্রহ নক্ষত্র। গ্যালাক্সি। পুরো মহাকাশ পড়ে আছে।" পাবেল হাসে।
হাংকা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বিষাদঘন স্বরে বলে, "ওখানে ঈশ্বর নেই কোথাও? ভগবান? গড?"
"জানি না। আমি শুধু বিজ্ঞান ফিজ্ঞানের ব্যাপারটাই ভাবি। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?"
হাংকা বলে, "মাঝে মাঝে ভাবি থাকলে কী ভালোই না হত! আমাকে নিজের কাছে ডেকে নিত। মাথায় হাত রেখে বলত, এখানে চলে আয় মা। ওই দুনিয়ায় কেউ তোকে ভালোবাসে না।"
"আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।" পাবেল উদ্বিগ্ন হয়।
"জানি।" হাংকা ছোট করে জবাব দেয়। বলে, "ঈশ্বর নেই। কোথাও নেই সে। নাহলে এসব দেখে সে চুপ করে থাকত না। এই অন্ধকার থেকে আমাদের নিয়ে যেত। এত অন্ধকার আমি আর সইতে পারছি না।"
পাবেল বলে, "ভেবো না হাংকা। আমরা একসঙ্গে থাকব চিরকাল। আমরা... আমরা..."
"আমরা নর্থ পোলে চলে যাব!" হাংকা উজ্জ্বল মুখে বলে, "কত আলো ওখানে! ছয় মাস ধরে দিন থাকে!"
"ছয় মাস রাতও তো থাকে!" পাবেল মনে করায়।
হাংকা বলে, "তখন আমরা সাউথ পোলে চলে যাব!"
স্রেফ কথা। যুক্তিহীন। অবান্তর। বোকা বোকা কথা। দুজনেই জানে এসব কিছুই হবে না। হয়ও না। একদিন পাড়ার লোক হাংকার কথা জেনে যায়। পাবেল বা তার মা আর দাদুকে কেউ পাত্তা দেয় না। জার্মানদের খবর দেওয়া হবে। হাংকা পাবেল আর তার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, পালাতে থাকে। পারে না। জার্মান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যায় সে। তারপর কী হয়, সবাই বুঝতেই পারছে।
এইটুকুই গল্প। রোমিও জুলিয়েট আর অন্ধকার। য়ান ওতচেনাসেক উপন্যাসটা লিখেছিলেন সত্যি ঘটনাকে মাথায় রেখেই, কিন্তু এ গল্প তো তখন গোটা ইউরোপ জুড়ে হত। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, ইহুদিকে আশ্রয় দিয়ে বিপদে পড়া... এ নিয়ে কত গল্প উপন্যাস ছবি সিনেমা হয়েছে! নতুন আর কি! নতুন আর কী হবে? প্রেম কি আর নতুন! মহাপুরোনো জিনিস। কিন্তু ওই পুরোনো জিনিসটা মানুষকে যা করিয়ে নিতে পারে, নতুন জিনিসগুলো তেমনটা আর পারে কই? একবার না হয় ট্রাই করে দেখবেন। সিনেমাটা পাওয়া এখন সহজ, ইংরেজি অনুবাদ পাওয়াই চাপ। আমি তো পাইনি। হিন্দিতে সড়গড় করে বাণী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত নির্মল বর্মার অসামান্য অনুবাদটা পেয়ে যাবেন।
মূল বইয়ের, সিনেমা আর রিসেন্ট নাটকের ছবি সঙ্গে দিলাম।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন