রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩

দিনযাপন -বসন্ত ২০২৩

 


দিন কেটে যায়...

দেশ থেকে ফিরে প্রায় দেড় মাস হতে চলল। মাঝে শীত কমেছিল, সোনালি রোদের উত্তাপ বসন্তের আভাস নিয়ে এসেছিল, রঙবেরঙের টুলিপের কুঁড়ি আর সতেজ সবুজ পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে দিন গুজরান করছিলাম বেশ। ভিয়েনা পার্কের শহর, শহরে রাস্তাঘাটের চেয়ে গ্রিন স্পেস ঢের বেশি, প্রতিবার ম্যাপ দেখে এক একটা নতুন পার্ক আবিষ্কার করি, তারপর সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। পার্ক বলতে সারাজীবন আমি স্লিপ আর দোলনা লাগানো ঘাসহীন খালি জমি দেখে এসেছি, বড়জোর ব্যাঙ্গালোরের জগার্স পার্ক, সেখানে ইউরোপের পার্কগুলো আমার স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে। শেষ আর হয় না। মাইলের পর মাইল সবুজের বিস্তার, বসন্তের অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা পত্রহীন গাছের অদ্ভুত শরীরগুলো আঙুল বাড়িয়ে মেঘ ছুঁতে চাইছে, অজানা লেজঝোলা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে, হরেকরকম ঘাসফুল আর টলটলে দীঘিকে সঙ্গে নিয়ে উঁচুনিচু জমি তেপান্তরের মাঠের মতো খেলে বেড়াচ্ছে, আমরা কাঠবিড়ালির মতো সেখানে দাপাদাপি করছি। ইস্টারের ছুটি, বাতাসে একটা মন ভালো করা আমেজ, সূর্য অস্ত যেতে যেতে সাড়ে আটটা, ফলে আঠ থেকে আশি সবাই মনের আনন্দে কমলালেবু রোদ গায়ে মেখে ঘুরতে বেরোয়। আমরাও এই দলে শামিল হয়েছি। দুপুরবেলায় রোদ পিঠে নিয়ে ট্রামে চড়ে বসি, এক একটা পার্কে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। ম্যাগনেলিয়ায় বোঝাই হয়ে থাকে গাছগুলো, এক একটার এক এক রকমের বাহার। গোলাপি, লাল, সাদা তো আছেই, বাদামি সাদা সরভাজা রঙের একটা ফুল দেখে আমি নাম দিয়েছিলাম রাবড়ি ফুল। কিন্তু যে ফুলটা দেখে আমি প্রেমে পড়েছি, সেটা একটা পুঁচকে ফুল। পাঁচটা করে পাঁপড়ি, তিনটে সাদা, দুটো বেগুনি। মাঝখানে সূর্য আঁকা হলুদ কালো ড্রয়িং। বাকি তিনটে পাঁপড়িতেও বেগুনির ছাপ আছে। ফুল বড় হলে সবগুলোই বেগুনি হয়ে যায়, সে যে কী সুন্দর লাগে! নেট ঘেঁটে দেখলাম ফুলের নাম প্যান্সি। কী কাণ্ড! নাম জানি, ফুল চিনি না। এই আমাদের অবস্থা। পাখি, ফুল, ফল কিছুই চিনি না, খালি বার বার অবাক হয়ে যাই। বিস্ময় আর যায় না! হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, প্যান্সিরাও চোখ টিপে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। এদিকে আকাশে তখন মেঘের নৌকা পাড়ি দিয়েছে। রোদ আর ছায়ার সঙ্গে আপস করে মেঘের দল এগিয়ে চলে, সে দেখে আবার বেজায় অবাক হয়ে তাকাই। মুখে অবশ্য ভাব করি কিছুই কেয়ার করছি না, নির্লিপ্তির আড়ালে এদিকে আমার মনে নেরুদার 'মার্চ ডেজ কাম উইথ দেয়ার কোভার্ট লাইট' উঁকি মেরে যায়। 

মার্চের দিনগুলি ফিরেছে তাদের গোপন আলো নিয়ে

আর বিশাল এক মাছ সাঁতার কেটে যায় আকাশপথ দিয়ে...

তারপর একদিন বসন্তবিলাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আচমকা হুট করে আল্পসে তুষারপাত হল আর টুলিপরোদ উবে গিয়ে ফিরে এল শীত। দামাল হাওয়ার দুষ্টুমি আর বৃষ্টির বদমায়েশি নিয়ে আমার অভিযোগ নেই, কিন্তু তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে বলে বৈকালিক ভ্রমণে ছেদ পড়ল। ফায়ারপ্লেস রাত আর স্টেক ডিনারের বালাই নেই, ফলে মুড়ি চানাচুর খেতে খেতে নেটফ্লিক্স দেখা আর অপেক্ষা করা, কবে শীত যায়! শীত গেল না, কিন্তু গরম পড়ে গেল কলকাতায়। আকাশের মুখ ভার, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক খারাপ খবর আসতে লাগল। 

আত্মীয়স্বজনদের শরীর খারাপ, বন্ধুবান্ধবদের ডিপ্রেশন, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, মামলা মোকদ্দমা, মৃত্যুসংবাদ। শুনি। কিছু করার নেই, কোভিডের পর মনের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। মনে পড়ে যায়, দু বছর আগের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কথা। একের পর এক কাছের মানুষকে হারিয়েছিলাম আমরা সবাই,  তখনও করার কিছু ছিল না। দু বছর, এরই মধ্যে সব নিজের জায়গায় ফিরে গিয়েছে, কিন্তু আমাদের বদলে দিয়ে গেছে। বিচ্ছেদ আর বিদায় এখন অনেক স্বাভাবিকভাবে ধরা দেয়, কিন্তু এই নীরব আঘাতের অভিঘাত হয় অনেক বেশি। দিন কয়েক আগে উজ্জ্বলদা, উজ্জ্বল সিংহ মারা গেলেন। বছর আটেক আগে কলকাতা টু ব্যাঙ্গালোর ট্রেন জার্নিতে উজ্জ্বলদা ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ, সেই তিরিশ ঘণ্টার আলাপের পরও আমাদের মনে রেখে দিয়েছিলেন দুজনে।  আমরাও তাদের আন্তরিক ব্যবহার ভুলে যাইনি। এমন হাসিখুশি, সদালাপী, বিদ্বান ব্যক্তি, কবি, অনুবাদক, সম্পাদক...সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, কত বই লিখেছেন, স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছিলেন শুধুমাত্র নিজের মনে পড়াশোনা করবেন বলে, গত বছর স্ত্রীর চলে যাওয়ার পর একা হয়ে গিয়েছিলেন, এবার নিজেও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। শুনলাম। বুকে একটা কাঁটা বিঁধে রইল। উজ্জ্বলদার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একটা ফোনও করিনি, করেও বা কী বলতাম! মনখারাপ আসে, চলেও যায়। কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক মারা গেলেন, তরুণ কবিদের চলে যাওয়ার খবর এল। দু একটা পোস্ট, দু একজনের স্মৃতিচারণ, তারপর রিসেট বোতাম টিপে নিজের নিজের কাজে ফিরে যাওয়া। সেই নতুন বই আর সিনেমা, রান্নাবান্নার ঝামেলা, নতুন জায়গায় ঘোরার প্ল্যান। আকাশের মুখ ভার, তিষ্ঠোতে না পেরে আমরাও বেরিয়ে পড়ি। ভিয়েনা থেকে মার্সেই, মার্সেই থেকে রোডস... পথের কাছে ফিরে যাওয়ার শান্তিটুকু অন্তত কেউ কেড়ে নিতে পারে। নীল আকাশ, নীল সমুদ্র, মানুষজনের জীবনেও যেন এই নীলাভ উষ্ণতার ছাপ পড়েছে। ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমি মানুষের মুখ দেখি, তাদের স্লাইস অফ লাইফ' মুহুর্তগুলোর আড়ালে থাকা গল্পগুলো বোঝার চেষ্টা করি। কত রকমের মানুষ! তাদের রোজনামচা দিয়ে গড়ে ওঠা শহর! শহরের ইতিহাস! বর্তমানও!

গ্রিসে এসে খবর পেলাম, জেঠু মারা গিয়েছে। কিছু এলোমেলো স্মৃতি ভেসে এল, আর বিশেষ কিছু মনে হল না। বেনারসের বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে জেঠুই ছিল সবচেয়ে বড়। বয়স হয়েছিল, মুম্বাইয়েতে দাদার কাছে গিয়ে ছিলেন। আর্মিতে কাজ করতেন, দাপুটে মানুষ, গুণের পাশাপাশি দোষও কম ছিল না। জানতাম, এরকম একটা ফোন একদিন পাবই। ওই বাড়িতে শেষ মৃত্যু ঘটেছিল তেইশ বছর আগে, ঠাকুমার সময়। তারপর বহুদিন কেটে গিয়েছে। সময় বদলেছে, বাড়ির বাসিন্দাদের জীবনও বদলে গিয়েছে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট যে, যার কাছে ওই বাড়ি আর শহরটার স্মৃতি সবচেয়ে বেশি করে জড়িয়ে ছিল, জড়িয়ে আছেও, তার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে বাড়িটার। এ হওয়ারই ছিল। অভিজ্ঞতা বেড়েছে, বন্ধু কমেছে। নতুন বন্ধু অনেক হয়েছে দেশদুনিয়া ঘুরে, কিন্তু কেন জানি না একটা পরিমিত দূরত্ববোধ বজায় রাখতে হয়েছে। কৈশোরের মতো ঘনিষ্ঠতা কারো সঙ্গেই হয়নি, হবেও না। বড় হওয়া, পরিণত হওয়ার এই এক সাইড এফেক্ট, বাস্তবটা মেনে নিতে আর বিশেষ কষ্ট হয় না। অভিমান করার জায়গাগুলো ক্রমে হারিয়ে যায়। এখন আমি জানি, দূরত্ব বাড়লে সম্পর্কের উষ্ণতা কমে আসবে, বয়স বাড়লে মানুষ মারা যাবে, আমার মাথার ওপর যারা ছিল, যারা আছে, যারা স্নেহ করতেন বা করেন, তারা সবাই একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। আমার আগে বা আমার পরে। সাইকেল অফ লাইফ।

তবু, জীবন চলে। আমি দেশ ঘুরে বেড়াই। স্টিল লাইফে ধরে রাখি মানুষের জীবন। এক একটা সাদামাটা মুহুর্ত, যা নিয়ে সেই মানুষটার মাথাব্যাথা নেই, কিন্তু এই মুহুর্তগুলোই তার অলক্ষ্যে তার জীবনের পথ ঠিক করে দিচ্ছে। কেউ জ্যাকেট নামিয়ে কফি খেতে খেতে বই পড়ছে, কেউ উঁচু গলায় ফোনে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া করছে, কলেজ বা ঘুরতে আসা বন্ধুরা হয়তো প্যাস্টিস খেতে খেতে সিনেমা বা বই নিয়ে তুমুল তর্ক করছে,  বেড়ালকে পাঁচিল থেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে এক যুবক। এই সব ছোটোখাটো দৃশ্য। এই নিয়েই আমার বেড়ানো। আর সব ভুলে যাব হয়তো, কিন্তু এই ছবিগুলো থেকে যাবে। থেকে যায়। চিরকাল।





 












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন