ফরেস্ট ভিলেজ। নিবিড় বনের ভিতর এত্তটুকু এক একটা গ্রাম। শান্ত নিস্তুব্ধ প্রকৃতি আর ঘন সবুজের সঙ্গে মাখামাখি করে জীবনযাপন করা কয়েকঘর মানুষ, যারা পাখির ডাক শুনে চোখ মেলত, রান্না করতে হলে জংলি ঝোরা থেকে জল নিত, দোলে রঙ খেলতে হলে রঙিন ফুলের নির্যাস বের করে জলে গুলে দিত। খুব প্রয়োজন হলে পাশের জেলায় আসত, খাবার দাবার সংগ্রহ করে ফিরে যেত অরণ্যে। নিরবিচ্ছিন্ন জীবন। চিন্তামুক্ত নয়, চিন্তাশুন্যও নয়, কিন্তু ফরেস্ট ভিলেজে থাকা মানুষের চিন্তাভাবনার প্রকৃতিটা শহুরে মানুষের চেয়ে ভিন্ন ছিল সন্দেহ নেই।
ঘন বনের ভিতর এরকম কিছু কিছু গ্রাম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ব্রিটিশ যুগেই৷ বনদপ্তরের আধিকারিকদের কাজ ছিল, তাদের এলাকায় থাকা ফরেস্ট ভিলেজগুলোর দেখাশোনা করা। স্বাধীনতার পর ক্রমে ন্যাশনাল পার্কের বান এসেছে, কিন্তু বনক্ষেত্র ক্রমে সঙ্কুচিত হয়েছে। আজকাল বনবাসীদের উচ্ছেদ করা হয় কোর এরিয়া থেকে, যারা অভয়ারণ্যে থেকে গিয়েছে কোনোভাবে, তাদের সেই সেটলমেন্টের সঙ্গে আগেকার সেই ফরেস্ট ভিলেজের কোনো মিল নেই। এই নিয়ে তেমন কিছু লেখালিখি হয়নি, কেন জানি না। অনেক কিছুই তো প্রচারমাধ্যমের বাইরে থেকে যায়, সাহিত্য সংস্কৃতি মিডিয়া ফেসবুকে সেসব ধরা হয় না। সে জন্য এই পোস্ট নয়। আসল আফসোসটা হল, এরকম একটা ফরেস্ট ভিলেজে জন্মানো যে ছেলেটি ভারতবর্ষ সহ গোটা দুনিয়াকে দেখার জন্য নতুন দৃষ্টি দিয়ে গেল, তাঁকে নিয়ে তার নিজের দেশের কোনো আবেগই নেই। যেটুকু আছে, সেটাকে দৃষ্টিকটু বলাই সঙ্গত হবে।
রজা। কে রজা? রজা বলতে ছোটবেলায় আমি বলিউডের ভিলেন চরিত্রে দেখা রজা মুরাদের কথাই জানতাম, গুরুগম্ভীর স্বরে হুমকি দিতেন বা স্যাঙাতদের হুকুম করতেন। কিন্তু আমাদের দেশে যে আরেক রজা জন্মেছেন, যার প্রতিভার বিচ্ছুরণে গোটা ইউরোপ আর আমেরিকার শিল্পসমাজও ধাঁধিয়ে গিয়েছে, তাঁকে চিনতে আমার অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, সইদ হ্যায়দর রজাকে যে চিনতাম না, এ শুধু আমার লজ্জা নয়, লজ্জাটা দেশেরও। আজ আমরা য়াকুব মেমন আর গৌতম আডানির নাম জানি, বিজয় মালয়া বা দাউদকেও চিনি। ওহো! অশনির গ্রোভার! ওকে না চিনলে তো আবার আজকাল জাতে ওঠা যায় না! শার্ক বলে কতা! আমার বন্ধু তো দেখলাম বইমেলা থেকে শুধু অশনীর স্যারের 'দোগলাপন' কিনে সগর্বে পোস্ট করেছে। একটা বই কিনেই বাজিমাত। কিন্তু সইদ হ্যায়দর রজাকে চেনার লোক নেই, চেনানোর লোকও নেই। যারা আছেন, তাঁদের সংখ্যাও ক্রমশ কমে আসছে।
আমি নিশ্চিত, বহুসংখ্যক মানুষ তাঁকে চিনবেন না। আর্ট ওয়ার্ল্ড নিয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের কথা ধরছি না। আজ, এই মুহুর্তেও রজা অন্ধকারের আড়ালে, যখন তাঁকে নিয়ে ফ্রান্সের বিশ্ববিখ্যাত Centre de’ Pompidou-তে দীর্ঘ তিন মাস ব্যাপী প্রদর্শনী চলছে। রজা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজিত এই এক্সিবিশন যে কোনো ভারতীয় শিল্পীর জন্য সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সারা দুনিয়ার আর্ট ক্রিটিক, শিল্পী আর লেখকরা আজ রজাকে সেলিব্রেট করছেন, নিলামঘর ক্রিস্টি থেকে মানুষজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, একের পর এক নতুন বই উন্মোচিত হচ্ছে। অনেকে লিখেছে, দ্য বিগেস্ট সেলিব্রেশন ইন দ্য কন্টেম্পোরারি টাইমস ফর আ মডার্ন আর্ট লেজেন্ড... এদিকে ভারতবর্ষে কোনো সাড়াশব্দ নেই। হাতে গোনা কয়েকটা সংবাদপত্র লিখেছে, বাকিরা দু লাইনের নিউজ চালিয়ে চুপ। একজন অসম্ভব বুদ্ধিমান নেতা শুনলাম বলেছেন, ওকে নিয়ে অত লাফালাফি করার কী আছে? ও তো নামেই ভারতীয়। শুনলাম তো ফ্রান্সে থাকত!
বটে! সইদ হ্যায়দার রজা ভারতীয় নন, কিন্তু ঋষি সুনক মনে হয় ভারতীয়! ভারতীয় বংশোদ্ভূত যার আগের প্রজন্মও এদেশে ছিল না কোনোকাল, তাঁকে মিডিয়া ভারতীয় বানিয়ে দিতেই পারে! হতেই পারে!
আমি ফাইন আর্টসের ছাত্র নই। শিল্পের সমঝদার নই, গবেষক নই, তেমন কিছু জানাও নেই এ সম্পর্কে। তবু মাঝেমধ্যে দু একটা পোস্ট করি, কারণ ভালো জিনিস অ্যাপ্রিশিয়েট করার বিদ্যাটা অনেক কষ্ট করে আয়ত্ত করেছি। দীর্ঘ সময়, পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে গড়ে তোলা এক একটা কাজ, এক একজন শিল্পীর সারা জীবনের ওয়ার্ক অফ আর্টকে যখন এমন করে তাঁর নিজের দেশেই অবহেলা করা হয়, আমার বুকে খচ করে লাগে। সইদ হ্যায়দর রজা কোনো নতুন শিল্পী নয়, একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী হিসেবে তিনি অনেকদিন আগে থেকেই পরিচিত। যে দৃষ্টি দিয়ে তিনি শিল্পকে দেখেছেন, যে ভাবে ভাবনাকে ক্যানভাসে নামিয়ে এনেছেন, ইউরোপিয়ান রিয়ালিজম আর ইন্ডিয়ান স্প্রিচুয়ালিজমের যে সাম্য তাঁর ছবিতে দেখা গিয়েছে, তা নিয়ে আজ থেকে চর্চা হচ্ছে না। অথচ তাঁর নিজের দেশে তাঁকে নিয়ে একটা এক্সক্লুসিভ প্রদর্শনী করা সম্ভব হয়নি কোনোদিন। হ্যাঁ, শিল্প জগতের রেকামেন্ডেশন অনুয়ায়ী পদ্মবিভূষণ দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, যেমন দেওয়া হয়েছিল এব্রাহিম আলকাজিকে, কপিলা বাতসায়ানকে, মারিও মিরান্ডাকে। ওইটুকুই। দায় মিটে গেছে।
রজা জন্মেছিলেন বাবরিয়া নামের এক ফরেস্ট ভিলেজে। সে একশো বছর আগের কথা। তাঁর বাবা ছিলেন ফরেস্ট রেঞ্জার। রেভেন্যু শিডিউলে সে গ্রামের কোনও নাম ছিল না, ফলে নাম নিয়েও বাবরিয়া হয়েছিল নামহীন। কিন্তু তাতে অসুবিধা হয়নি রজার। বনের ছায়াময় নিস্তব্ধতা আর অশ্রুত শব্দের খোঁজ করতেই দিব্যি দিন কেটে যেত। এই নীরবতার বৈচিত্র্য পরে তার কাজেও ধরা পড়েছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট রেখার আড়াল নিয়ে। আর্ট ক্রিটিকরা বলেছিলেন, 'রজা হ্যাজ আ ওয়ে টু ড্র দ্য লেয়ার্স অফ সাইলেন্স।' লেয়ার্স অফ সাইলেন্স বলে এই কথাটা কথাটা সইদ হ্যায়দার রজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রথম থেকেই।
যে কথা হচ্ছিল, মন্ডলা জেলায় থাকা ঘন বনজঙ্গলে এমন আরো কিছু গ্রাম ছিল। কিছুদূরেই নর্মদা, নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত ছেলেরা। মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর কুয়াশা আর সবুজ সান্নাটা মেখে দিন কেটে যেত। মুশকিল হল, যখন তাকে স্কুলে ভর্তি করা হল। আরেক গ্রাম কাকাইয়া, সেখানে এক ছোট্ট পাঠশালা করা হয়েছিল। কিন্তু ক্লাসে মন টিকত না ছেলের, জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বাইরে। এই দেখে রেগেমেগে তার মাস্টারমশাই নন্দলাল ঝারিয়া একদিন তাকে শাস্তি দিলেন। তেমন কিছু নয়, মনোনিবেশ করার শাস্তি। বোর্ডে একটা বিন্দু আঁকলেন, রজাকে বললেন সব ভুলে ওই বিন্দুর দিকে চেয়ে থাকতে। আর কিছু যাতে চোখে ধরা না পড়ে। খুবই চেনা এক্সারসাইজ! প্রায় সবাই করেছেন! কিছু লাভ হয় না, আমাদের অন্তত হয়নি। কিন্তু রজার হয়েছিল। সেই বিন্দু ছেলের জীবন বদলে দিয়েছিল। একটা বিন্দুতে ধ্যানকেন্দ্র করে গোটা মহাবিশ্ব দেখতে পারতেন রজা, দেখাতেও পারতেন। প্রসঙ্গত, তাঁর আঁকা একটা সিরিজের নামই হল 'বিন্দু'। এই বিন্দুই তার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। সে কথায় না হয় পরে আসছি।
যাই হোক, বাল্যকালে রজার শিক্ষা হয়েছে ছোট ছোট গ্রাম আর জেলার স্কুলেই। তখন তো মধ্যপ্রদেশ ছিল না, গোটা অঞ্চলটাই ছিল ব্রিটিশদের জন্য সেন্ট্রাল প্রভিন্স। নিবিড় অরণ্য আর বন্যপ্রাণীদের ঠিকানা। দু একটা শহর বাদে বড় জায়গা প্রায় ছিলই না। রজার আব্বা ফরেস্ট অফিসে ছিলেন বলে ছেলে ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলের প্রেমে পড়েছিল, আসমানি মেজাজবদল আর লতাপাতার জঙলি রঙমিলান্তির ঘটনা তার চোখে স্বাভাবিক ভাবে ধরা পড়ত। এই অভিজ্ঞতা যে পরে তিনি কতভাবে কাজে লাগিয়েছেন সেসব বলতে গেলে গোটা বই হয়ে যাবে। কৈশোর পেরোনোর পর অবশ্য জঙ্গলের মায়া কাটাতেই হয়, নাগপুর আর বম্বের জে জে স্কুল অফ আর্ট থেকে পড়াশোনা করে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। প্রথমদিকে ল্যান্ডস্কেপ আঁকাতেই তাঁর মন ছিল, কিন্তু ক্রমে অন্যধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন তিনি। এক্সপ্রেসনিস্ট ল্যান্ডস্কেপ থেকে অ্যাবস্ট্রাক আর্টের এই সফরে খুব সূক্ষ্মভাবে রাজপুত আর বনারস ঘরানার কিছু এলিমেন্ট ব্যবহার করেছেন সময় সময়ে, কিন্তু তাঁর ছবিতে প্রথম থেকেই একটা নিজস্বতা ছিল। জাবেদ আখতার গুলজার সম্পর্কে বলেছেন, "অচ্ছি শায়েরি করনা বহুত মুশকিল হ্যায়, পর অপনি শায়েরি করনা উসসে ভি জ্যায়দা মুশকিল হ্যায়। গুলজার সাহব অপনি শায়েরি করতে হ্যায়!"
ঠিক একইভাবে সয়িদ হ্যায়দার রজাও ক্যানভাসে 'অপনি শায়েরি' করতেন। করেছেন, সারাজীবন।
চল্লিশের দশক আসতে আসতে রজা শিল্প জগতে বেশ নাম করে গেছিলেন। ছেচল্লিশ সালে বম্বে স্যালোনে তাঁর প্রথম এক্সিবিশন হয়। কিন্তু নিঃসন্দেহে, রজার লাইফ টার্নিং বছর হল সাতচল্লিশ। কী না হয়েছে এই বছরে? বন্ধু কে এইচ আরা আর এফ এন সুজার সঙ্গে প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলেছেন, যা আগামীতে বহু শিল্পীকে এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। এই বছরই পর পর রজার মা আর আব্বা মারা গিয়েছেন। তারপর স্বাধীনতা পরবর্তী দাঙ্গা। পার্টিশনের পর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব প্রায় সকলেই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। এমনকি হিন্দু বন্ধুরাও পইপই করে রজাকে বুঝিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে পালাতে। একেই তো সময় খারাপ, দু তিন বার একটুর জন্য বেঁচে গেছেন, তারপর স্পষ্টবাদী মনোভাবের জন্য অনেকেই তাঁকে পছন্দ করত না। দাঙ্গার সময়ে রজাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে বলে অনেকেই ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু রজা পাত্তা দেননি। যদি কোথাও যেতে হয়, তার মুল্ক হল হিন্দুস্তান! যেখানেই যান না কেন, মরতে হলে এখানেই মরবেন! সব বিপদের আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। আর আজ কিনা লোকে বলছে রজা ভারতীয়ই নন! ঠিকই।
কয়েক বছর পর ফ্রান্সে চলে যান রজা। সেখানে থাকাকালীনও শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। ফরাসি দর্শন ও শিল্প নিয়ে চর্চা করেছেন, কিন্তু বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভারতের ইতিহাস বা দর্শনের তত্ত্বকে। এরই মধ্যে জেনিনের সঙ্গে দেখা। জেনিনও প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন, দুজনেই একসঙ্গে আঁকা শিখতেন। এরপর পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে রজা আর জেনিন একে অপরের সবচেয়ে বড় 'স্ট্রংহোল্ড' হয়ে কাজ করেছেন। এই প্রেমকাহিনি নিয়ে গুজব রটেনি, কিসসা-কাহিনি শোনা যায়নি, তারা নিজেরাও এ নিয়ে কিছু বলতেন না। কিন্তু রজার সঙ্গে কথা বলতে গেলে, জেনিনের কথা জিজ্ঞেস করলেই তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। অনেক পীড়াপীড়ি করার পর রজা একবার জেনিন সম্পর্কে মাত্র দুটো লাইন বলেছিলেন।
"কাজল কী কোঠরি মে ক্যায়সো হি সুহানো যায়
এক লকির কাজল কী লাগে হ্যায় সো লাগে হ্যায়"
১৯৭০ আসতে আসতে রজা বিদেশের মটিতেও নাম করে ফেলেছিলেন। প্রথম নন ফ্রেঞ্চ আর্টিস্ট হিসেবে রজা Prix de la Critique পেয়েছেন, আমেরিকায় শিক্ষকতা করেছেন, নানান দেশে সোলো এক্সিবিশন করেছেন, কিন্তু নিজে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ১৯৭০ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন, ঘুরতে থাকেন এক শহর থেকে অন্য গ্রাম, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম। অজন্তা, এলোরা, রাজস্থান, বেনারস ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু আসল বদলটা এল নিজের গ্রাম বাবরিয়ায় ফিরে। সেই 'নামহীন' গ্রাম খাঁ খাঁ করছে, বাড়িটা অবশ্য একই রকম আছে। সেই নীরবতার আবেশ কেটে গিয়েছে, ফরেস্ট ভিলেজের সংজ্ঞাও বদলে গিয়েছে। বাবা মা নেই বহু বছর, আত্মীয়স্বজনদের সকলেই পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। রজা তাকিয়ে রইলেন। কত কত স্মৃতি, বনজঙ্গল নিয়ে বেঁচে থাকার কত স্মৃতি, কিন্তু কিছুই তো ঠিক করে ধরা দিচ্ছে না। অস্থির লাগছে বড়। এমন সময় রজার মনে পড়ে গেল, তার শিক্ষক নন্দলাল ঝারিয়া তাঁকে এক বিন্দুর ওপর ধ্যানকেন্দ্র করে মন শান্ত হওয়ার পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। ব্ল্যাকবোর্ড নেই, শুন্যে একটা বিন্দু কল্পনা করলেন রজা। তারপর একাত্ম হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সমস্ত শৈশব, সমস্ত কৈশোর, সমস্ত জীবনটাই সেই বিন্দুকে ঘিরে ঘুরতে লাগল। ছোটবেলার নীরব প্রকৃতি এক একটা রঙ দিয়ে এক একটা স্তর তৈরি করে ফেলল শুন্যের ক্যানভাসে, গড়ে উঠল এক একটা ছবি। বিন্দু, ত্রিভুজ, লাইন, বৃত্ত, চতুর্ভুজ.... রজা কাঁদতে লাগলেন নিঃশব্দে।
পরবর্তী চল্লিশ বছর ধরে সইদ হ্যায়দার রজা এই 'বিন্দু' নিয়ে কাজ করে গেছেন। জিওমেট্রিকাল আর্ট ব্যবহার করে 'ত্রিভুজ' আর 'প্রকৃতি পুরুষ' এর নিজস্ব কন্সেপ্ট আবিষ্কার করেছেন, বিশ্বের সামনে ভারতবর্ষের দর্শন আর শিল্পতত্ত্বকে উন্মোচিত করেছেন। রজা বলতেন, "ইউরোপিয়ান রিয়ালিজমের নিয়ম হল চোখ দিয়ে যা দেখবে, তাই আঁকবে। ভারতীয় শিল্পদর্শন বলেছে, মন দিয়ে যা দেখবে, তাই আঁকবে। আমি দুটোকে মিলিয়ে দিয়েছি। এই মিলনকেন্দ্রই হল আমার বিন্দু। বিন্দু এমন একটি কেন্দ্র যেখানে মানসিক শক্তিগুলি নিবদ্ধ থাকে। স্পেস আর টাইম, দুইই আসলে বিন্দু থেকে উদ্ভূত।"
রজা সেই শিল্পীদের অন্যতম, যাদের কাছে বেঁচে থাকা আর আঁকা সমার্থক ছিল। হি লিভড টু পেইন্ট, হি পেইন্টেড টু লিভ। আটের দশকের পর রজা শিল্পের দুনিয়ার লিজেন্ড হয়ে উঠেছিলেন। ফ্রান্সে থেকে সারা জীবন ভারতের আর্ট নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু তুলির টানে, ভাবনায়, ব্যবহারে, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক। ২০০১ সালে তিনি রজা ফাউন্ডেশনের স্থাপনা করেন। কিন্তু নিজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেননি সব কাজে। পরের বছর, ২০০২ সালেই জেনিন মারা যান ক্যান্সারে। জেনিনের চলে যাওয়ার পর রজা একা হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই একাকীত্ব নিয়েই কাজ চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। রজা ফাউন্ডেশনের সদস্য, বিখ্যাত কবি লেখক ও আর্ট ক্রিটিক অশোক বাজপেয়ি লিখেছেন, "Raza’s art flowed ceaselessly between many dualities: India and France, beauty and fear, the sensuous and the spiritual, image and word, modernity and memory, celebration and prayer, colour and concept, history and eternity, fury and tranquillity, exile and home. His modernity was not marked by disruption, dissonance and disinheritance: It was rooted in memory and nature, in inheritance and harmony, in consonance and peace. It was almost an alternative modernism. In his iconic explorations of the Bindu, he sought a source of energy, a locus of nature, a centre of silence, an origin of life. As a human being, noble and generous, Raza was at home with three religions Islam, Hinduism and Christianity; with three languages Hindi, French and English. His art has human glow, reflective luminosity and integrity of form. Even though highly geometrical in its last phase, Raza’s paintings, at some level, were composed as prayers for grace and peace."
২০১১ সালে রজা ফিরে আসেন ভারতে। মরতে হলে দেশেই মরবেন, সে কথাটা তিনি শুধু শুধুই বলেননি এক যুগ আগে। তখন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। কিন্তু ভারত সরকার তাঁকে বিশেষ পাত্তা দেননি। এক সরকারি এক্সবিশনে তাঁর ষোলটা ছবি রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে ফিরে আসার পর রজাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "কেমন দেখলেন?"
রজা হেসে বলেছিলেন, "ভালোই। শুধু, ছবিগুলো নকল। আমার আঁকা নয়। জালি কাজ করার শিল্পীর তো অভাব নেই।"
এই তো অবস্থা। কিন্তু সে নিয়ে কোনো বিরূপভাব দেখাননি কখনও। সাফদারজংগের ছোট্ট ফ্ল্যাটে একা থাকতেন শেষ দিন পর্যন্ত, রঙ তুলি জিওমেট্রি দর্শন নিয়ে ডুবে থাকতেন। আর্ট মার্কেটে তাঁর ছবির কদর ক্রমেই বাড়তে থাকে। 'সৌরাষ্ট্র' ছবিটি বিক্রি হয় ষোল কোটি টাকায়। ওসব নিয়ে কেউ কথা বলতে গেলে হাসতেন বৃদ্ধ রজা। বলতেন, "কাজের চেয়ে আমরা টাকা নিয়ে চর্চা করি বেশি। আমার অনেক ছবি তো কেউ কেনেইনি। সেগুলো নিয়ে কথা হলে বরং ভালো লাগবে! আমার কাজে অনেক অশ্রুত কথা লুকিয়ে রেখেছি। আমার গ্রাম বাবরিয়া যেমন নাম থাকা সত্ত্বেও নামহীন হয়ে রয়ে গিয়েছে, আমার কাজও তেমন। অর্থ থাকা সত্ত্বেও অনেকের কাছে বিলকুল অর্থহীন। শুধু রঙিন আঁকিবুকি ছাড়া কিছু নয়!"
২০১৬ সালে নিঃশব্দে মারা যান রজা। জন্মভিটে বাবরিয়া থেকে কিছুদূরে, মণ্ডলা জেলার নর্মদার ধারে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। রজা ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় ফরেস্ট ভিলেজের কোলে।
২০২২ সালে একশ বছর পূর্ণ হল সইদ হ্যায়দার রজার জন্মের। একটা ঠিকঠাক সরকারি প্রদর্শনী হয়নি, একটা অনুষ্ঠান হয়নি। ভারত ভবন, ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট, ললিত কলা আকাদেমি... কেউই তাঁকে যোগ্য মনে করেনি, প্রয়োজন মনে করেনি কোনও এক্সিবিশনের। এই তো তাঁর দেশ! তবে রজা তো এসব জানতেনই। তাঁর কোনো দুঃখও ছিল না, কোনও অভিযোগ ছিল বলে মনে হয় না। মনেপ্রাণে দেশকে ভালোবেসেছেন, সেই ভালোবাসা জাহির করতে যাননি কোনোদিন।
২০২৩ সালে পম্পেডুতে এই বিশাল এক্সিবিশন শুরু হয়েছে মাত্র চার পাঁচ দিন হল। এরপর লন্ডন, নিউইয়র্ক আর কোথায় কোথায় প্রদর্শনী হবে বলে ঠিক করা আছে। যারা ওদেশে আছেন, প্লিজ গিয়ে দেখে আসুন। যারা নেই, তাঁরা ইন্টারনেটেই রজার কাজগুলো দেখুন। যারা পড়তে ভালোবাসেন, যশোধরা ডালমিয়ার লেখা বই Sayed Haider Raza: The Journey of an Iconic Artist পড়ে নিতে পারেন৷ কিন্তু যেভাবেই হোক, রজাকে মনে রাখুন। ওঁর সম্মানের জন্য নয়, আমাদের স্বার্থের কথা ভেবেই তাঁকে মনে রাখা দরকার। শুধু এইটুকুই বলার ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন