শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

পিটার টার্নলির ইউক্রেন সিরিজ

 


পিটার টার্নলিকে আবিষ্কার করেছিলাম পুরোনো নিউজউইক পত্রিকা থেকে। আট আর নয়ের দশকে এই মার্কিন-ফরাসি ফোটোগ্রাফারের ছবি নিয়মিত ভাবে নিউজউইকে ছাপা হত। সেকালে ফ্রেঞ্চ স্কুল অফ হিউম্যানিস্ট ফোটোগ্রাফিতে বাইরের শিল্পীদের বিশেষ পাত্তা দেওয়া হত না, তাই টার্নলিকে নিয়েও প্রথমে কেউ মাথা ঘামায়নি। এমনিতেও এই মানুষটা ছিলেন খানিক ক্ষ্যাপা পাগলা টাইপ। ইন্ডিয়ানাতে জন্ম, সেখানে পড়াশোনা করার সময় থেকেই জমজ ভাই ডেভিডের সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়তেন, সঙ্গে থাকত একটা আদ্যিকালের ক্যামেরা। ফিরে আসতেন ঝুলি, থুড়ি ক্যামেরা ভর্তি করে। স্ট্রিট ফোটোগ্রাফি ব্যাপারটা মনে হয় তাঁর রক্তে ছিল, সে সব তাঁকে শিখতেও হয়নি।

আগামীতে পিটার Instituts d'études politiques থেকে উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন, সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এই ফরাসি ইন্সটিউশনের এমন নামডাক যে বলার নয়। অর্ধেক ছেলেমেয়েই ভর্তি হতে পারত না, নাহলে ডাহা ফেল করত। আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা এলেও অনেকেই পালিয়ে যায় বেগতিকে পড়ে। সে অন্য গল্প। মোদ্দা কথা পিটার টার্নলে আর তাঁর ক্যামেরা, দুজনেরই চোখ ছিল আলাদা। আলাদা ছিল মনও। পিটার যে ভাবে মানুষকে দেখেছেন, দেখছেন, সকলে পারে না। মানুষের জীবনকে ডকুমেন্ট করার জন্য পিটার কোথায় না পাড়ি দিয়েছেন? গত চল্লিশ বছরে দুনিয়ার যে কোনো কনফ্লিক্ট জোনের কথা মনে করুন, পিটার সেখানে গিয়েছেন। যে কোনো হিউম্যান ট্র‍্যাজেডি বা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা ভাবুন, পিটারের ক্যামেরা সেখানে উপস্তিত। চেচেনিয়া, বসনিয়া, প্যালেস্তাইন, হাইতি,  আফগানিস্তান... গাল্ফ ওয়ার, সোমালি সিভিল ওয়ার, তিয়ানমেন স্কোয়ার, ৯/১১ পরবর্তী গ্রাউন্ড জিরো, বার্লিন ওয়ার ডেমোলিশন, কোভিড... পিটার কিছুই বাদ রাখেননি। কিন্তু তাতে কি! এরকম কত ফোটোজার্নালিস্টই তো আছেন। সবাই পিটার টার্নলি হয় না। 

পিটারের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি নিজেকে চিত্রসাংবাদিক ভাবেনই না। তাঁর কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই, কোনো এসওপি নেই। তিনি ক্যামেরা ব্যাগে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন, তারপর হাঁটতে থাকেন। হাঁটতেই থাকেন। প্রয়োজনে লোকাল ট্রান্সপোর্ট নেন। সেটা প্যারিস বা নিউইয়র্ক হোক, বা হালের ধ্বসে যাওয়া ইউক্রেন। বিপদ বা ঝুঁকির কথা তাঁর মাথাতেই আসে না। চায়ের দোকানে, কফিশপে, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। নিজে থেকে কিছুই জানতে চান না, লোকেরাই তাঁকে গল্প বলে। তিনি শুনে যান। গল্পের পর গল্প জমতে থাকে। একসময় টুক করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেন, ফের ডুবে যান গল্পে। এই করে দিন কাটে। এক সপ্তাহ, এক মাস, দু মাস... আবার যখন প্যারিস বা নিউইয়র্ক এ তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন, সেই ছবিগুলো বের করেন। যে গল্পগুলো তাঁর মনে দাগ কেটে যায়, সেগুলো সামনে আনেন, বাকি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখে দেন। এই করে করে পিটার গোটা মানবসভ্যতাকে ডকুমেন্ট করে ফেলেছেন। মাঝে মাঝে এই অভিজ্ঞতাগুলো লিখেও রাখেন তিনি। সেইগুলো পড়া একটা অভিজ্ঞতা বটে। খারকিভে একটা ছবি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন।

Vitali, 48, from Kharkiv, stood outside a box car staring into a window where his daughter Valeria, 8, and his wife, Lelena, were looking back at him. They stared at each other quietly but intensely for a long time. Suddenly, without notice, the train began to move, and before the family could be prepared they were separated. I found myself wanting to stop the train, to give Vitali time to say goodbye—but it was gone, and so was any certitude of a family’s future.

বহু বছর আগে 'প্যারিসিয়ান' বইতে পিটারের তোলা ছবি দেখার পর আমার রীতিমত নেশা লেগে গিয়েছিল। সে নেশা আর ছাড়েনি। পিটারের নাম দেখলেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর কাজ দেখি। ছবি তো নয়, কবিতা। যদি সিনেমা দেখার অভ্যেস থাকে, তাহলে বলতে পারি, তার্কোভস্কির ছায়াছবি দেখে যেরকম মনের ভাব হয়, পিটার টার্নলির ছবি দেখেও আমার প্রায় তাই হয়। এক একটা ছবি নিয়ে বসে থাকি বুঁদ হয়ে, চোখই সরতে চায় না। কিছু কিছু অশ্রুত গল্প যেন আমিও শুনতে পাই সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে। 

কিছু ছবি দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না। এইগুলো অধিকাংশই ইউক্রেন যুদ্ধের, গত মার্চে তোলা।









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন