বুধবার, ২ জুলাই, ২০১৪

বদায়ুঁ রেপ কেস আর বিপ্লব

 


গত পঞ্চাশ বছরে ভারতবর্ষে ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় ৯০০% বেড়েছে। প্রতিদিন নব্বই থেকে একশোটা রেপ রিপোর্ট করা হয়, গড়ে পনেরো মিনিটে একটা রেপ হয় বলে পরিসংখ্যান বলছে। তার চেয়েও বড় সত্যি হল, যতটা রিপোর্ট হয়, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি রিপোর্ট হয় না। ধর্ষণ বাদে মেয়েদের অ্যাসল্ট কেস যতরকম হতে পারে, তার নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও আইনি দখল হয় না, কেউ কিছু জানতেও পারে না। ফিজিকাল, মেন্টাল, সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট ব্যাপারটা আমাদের দেশে যে ভাবে নর্মালাইজ হয়ে গেছে, তাতে এই পরিস্থিতি ঠিক কীভাবে বদলাবে তার উত্তর কারো কাছে নেই! বছরে দুই বা চার পর এক একটা ঘটনা নিয়ে জনতা রাস্তায় নামে, তুমূল বিক্ষোভ হয়, রাগারাগি হয়, রাজনৈতিক আমলাদের দোষ দিয়ে পদত্যাগ চাওয়া হয়, দোষীদের জাস্টিস সিস্টেমের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি, মানে শূলে চড়ানোর জন্য সকলে হইহট্টগোল করে। মনে হয়, এইবার কিছু বদল হবে। তারপর, যে কে সেই। ভারতবর্ষে ধর্ষণ এক্সপোনেন্সিয়াল গতিতে বাড়ছে। যতই রাজনৈতিক বাতেলা হোক, যতই মিছিল হোক, যতই আইন কড়া হোক, নিট ফল শুন্য। কথাটা আমার নয়, যারা নীরবে মেয়েদের নিরাপত্তা আর রিলোকেশন নিয়ে সারাজীবন ধরে কাজ করে চলেছেন, বক্তব্যটা তাদের৷ বৃন্দা গ্রোভার আজীবন রেপ ভিক্টিমদের নিয়ে লড়াই করছেন, বিলকিস বানো বাদেও বহু নির্যাতিতাকে তিনি আদালতে বিচার পেতে কাজ করছেন। প্রিয়াঙ্কা দুবে পনেরো বছর ধরে দেশে দেশে ঘুরে রেপ ভিক্টিমদের সঙ্গে কথা বলছেন, জেন্ডার অ্যাট্রসিটির বিশ্লেষণ করেছেন... ন্যাশনাল ফেডেরেশন অফ ইন্ডিয়ান ওমেন আর 'ক্ষমতা'-এর মতো একাধিক এনজিও দাঁতে দাঁত চেপে এই লড়াই চালাচ্ছে। কিন্তু খাতায় কলমে যখন দেখা হয়, এত বিপুল বিক্ষোভের পরও কোনো বদল আসে না।


প্রথম যখন আমি এইরকম একটা বিক্ষোভ মিছিলের সাক্ষী হয়েছিলাম, সম্ভবত প্রাইমারির গণ্ডি ছাড়াইনি। তারপর থেকে বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন গ্রামে এক একটা ঘটনা নিয়ে আউটরেজ দেখেছি, অনেকবার নিজেও গিয়েছি মোমবাতি হাতে করে। কখনও লজ্জায় পড়ে, কখনও রাগে, কখনও পিয়ার প্রেসারে পড়ে, কখনও বিপ্লবী হওয়ার বাসনায়। প্রতিবার মনে হয়েছে, এইবার দেশ জেগেছে। এইবার বদল আসছে। কিন্তু... বদল আসেনি। বরং যে কথাটা অন্য কেউ বললে আগে বেশ রাগ হত, সম্ভবত অপোজিট জেন্ডার বলেই, বিদেশিরা যখন দিল্লি বা গোয়ার বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বলে এখানে ঘুরতে আসতে চাইত না, তখন মনে হত ভারতবর্ষকে ফালতু দু একটা ঘটনার মাধ্যমে বদনাম করার চেষ্টা করা হয়। (কই, কত কত মেয়ে সোলো ট্রাভেল করছে, কাজকর্ম করছে, হেসেখেলে বেড়াচ্ছে, সবাই কি তাদের আক্রমণ করবে বলে বসে আছে নাকি?) এখন আর হয় না। বয়স বেড়েছে, দেখার চোখ আর ভাবার পরিধি বদলেছে, অভিজ্ঞতাও কিছু কিছু হয়েছে বইকি। আগবাড়িয়ে অ্যাগ্রেসন দেখানোর কথা আগের মতো মাথায় আসে না। যে কথা নিয়ে এককালে দ্বিধা বা রাগ ছিল, সেটা এখন বলতে আমাকে দু'বার ভাবতে হয় না। ইন্ডিয়া ইজ নট সেফ ফর উমেন। আমার জীবনকালে আমি একটা মেয়েকে দেখিনি, যে আমাকে বুক ঠুকে বলতে পারে, আমি সারাজীবনে একবারের জন্যও মলেস্ট হইনি, ট্রেনেবাসে আমাকে মেন্টাল বা ইমোশনাল টর্চার সহ্য করতে হয়নি, মেয়ে বলে কখনও নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়নি। নো দিদি, নো বন্ধু, নো প্রেমিকা... একজনও নয়! 


এখন, অনেকে বলতেই পারে, অত ভাবলে চলে? ডেভেলাপড দেশেই কি সবাই সেফ? অথবা, ইন্ডিয়া ইজ নট সেফ ফর মেন অ্যাজ ওয়েল। ওয়েল, অন্য দেশের কথাটা থাক, সেফটি স্ট্যান্ডার্ডে ইউরোপ আমেরিকা জাপান কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে। স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে যে রেপ বাড়ছে বলে অনেকে তুলনা টানে, আসলে তারা জানে না এই দেশগুলো উইদাউট কন্সেন্ট যে কোনো কাজকেই রেপ বলে ধরে, এমনকি পঞ্চাশ বছর আগের রিপোর্ট না করা কেসও খুলে তদন্ত করে। তাতে দেশের বদনাম হবে কিনা সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই, মেয়েদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করাই প্রধান। এখানে উল্টো, কেউ কথাটা স্বীকারই করে না। যদি বা কেউ পুলিশের কাছে যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিপোর্ট লেখা হয় না, জিজ্ঞেস করা হয়, 'তুমি ওখানে কী করছিলে? কী পরেছিলে? সঙ্গে কোন ছেলে ছিল?' তাই অন্য দেশের কথা থাক!থাক সে কথা! বাকি অভিযোগ এর জন্য জানাই, এই দাবিও মিথ্যা নয়। একশোবার সত্যি। মেন, কিডস, টিন এজ, অ্যানিমালস, বায়োডাইভারসিটি... কিন্তু প্রসঙ্গ আপাতত সেটা নয়। প্রসঙ্গ হল, মেয়েরা আমাদের দেশে নিরাপদ নয়। পিরিয়ড।


ভারতবর্ষে মেয়েদের নিরাপত্তা কোনো আইনি সমস্যা নয়, পলিসিগত সমস্যা নয়, ইটস আ সোশ্যাল ইস্যু। যতদূর আমি বুঝেছি, ব্যাপারটার গোড়া থেকেই গলদ আছে। মুশকিল হল, মানুষের জন্য রাগ ন্যাচারাল ইমোশন, কিন্তু রাগ দেখিয়ে কোনও সমস্যার সমাধান হয় না। একটা জাস্টিফায়েড ট্রায়েল, একটা ফাঁসি,  পুলিশ, ডাক্টার, জজ এর সাসপেনশন বা টার্মিনেশন, অকর্মণ্য ও লজ্জাহীন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ, জুডিশিয়াল রিফর্ম, স্পিডি ট্রায়াল... এই সব কিছুই স্বাগত, জরুরি, এবং গুরুত্বপূর্ণ... একশবার! কিন্তু সেলেক্টিভ আউটরেজ আর দাবীদাবা দিয়ে একটা দেশের সোশ্যাল ল্যান্ডস্কেপ বদলায় না। রাগ দেখানো সহজ, এনকাউন্টার করা সহজ, কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে আদর্শগত মূল্য নিয়ে জীবন চালানো কঠিন। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উন্নাসিকতা পুরুষদের এমনটা ভাবতে বাধ্য করছে যে মেয়েদের রেপ করা যায়, সেটা বদলানোর জন্য কাজ করা কঠিন। ইটস আ থিন লাইন, আর জীবনের নানা ফ্যাকড়ার মধ্যে কেউ এসব নিয়ে দীর্ঘকালীন ভাবনাচিন্তা করতে আদৌ উৎসাহী নয়। উদাহরণ দিই:


মেয়েটা শর্ট স্কার্ট পরে রাস্তায় বেরিয়েছে সেই জন্য রেপড হয়েছে বলে কিছুসংখ্যক মানুষের ধারণা।


যুক্তি: মেয়েটা শর্ট স্কার্ট পরুক বা বিকিনি পরুক, তাতে কেউ রেপ করার ছাড় পায় না।


দাবী: রেপিস্টদের মেরে ভূত ভাগানো হোক, শূলে চড়ানো হোক, এনকাউন্টার করা হোক!


ধরে নিলাম, এই দাবী মেনে নেওয়া হল। দোষীদের সাজা হল, তারা শুলে চড়ল। কিন্তু সবচেয়ে দরকারি কথাটা আসলে প্রথমেই যা জিজ্ঞেস করার ছিল, তা কেউ জিজ্ঞেস করল না। শর্ট স্কার্ট পরা একটা মেয়েকে দেখে কয়েকজন পুরুষের মনে রেপ করার ইচ্ছে জাগল কেন? হোয়াই? দুনিয়ার ম্যাক্সিমাম দেশে মেয়েরা আর ছেলেরা খোলামেলা পোশাক পরে ঘুরছে, নিউড স্পা বা বিচে গিয়ে একসঙ্গে জীবন উপভোগ করছে, বিয়ারের বন্যা ছোটাচ্ছে একসঙ্গে, সেখানে কারো এরকম ইচ্ছে হচ্ছে না কেন? ভারতীয় পুরুষদের মন ঠিক কীভাবে বিকশিত হয়েছে যে স্বল্প পোশাক পরা নারী দেখলেই তাদের কামুকতার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে? সুযোগ পেলেই মনে হচ্ছে একে রেপ করা যায়? তারা কেন মনে করছে একটা মেয়ের সঙ্গে জোর করে সেক্স করলে, মেরে তার হাত মুখ ভেঙে দিলে 'প্লেজার' পাওয়া যাবে? 


যতদিন না এই প্রশ্নটা অ্যাড্রেস করা হবে, ততদিন আমি অন্তত আশার আলো দেখি না। একটা দুটো ঘটনায় বিচার পাওয়া যাবে, তার চেয়ে বেশি কিছু নউ! মুশকিল হল, এই প্রশ্ন তুলতে হলে, এই সমস্যার সমাধান করতে হলে রাগ আর বিরক্তি ভুলে মানুষকে এমন সব প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হবে, যেখানে দাঁড়াতে তারা কেউ স্বস্তি বোধ করে না। প্রতিদিনের জীবনযাপনের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যুক্তিহীন কিছু বিশ্বাস ও অবিশ্বাস,  গোটা ভারতীয় সমাজকে বেকুব বানিয়ে রেখেছে। শরীর আর চামড়া নিয়ে আমাদের যে সঙ্কোচ, সেক্স শব্দটা নিয়ে যে লুকোচুরি, পিরিয়ড আর মাস্টারবেশন নিয়ে কথা না বলার যে অভ্যেস, অর্ধেক সমস্যা তো সেখানেই! 


ছেলে হয়ে (মেয়ে হয়েও, কিন্তু চারিত্রিক তফাত আছে। একজনকে টর্চারড হতে শেখানো হয়, একজনকে টর্চার করতে) ভারতবর্ষে বড় হয়ে ওঠা যে কী নিদারুণ, সেটা যদি কেউ বসে রিসার্চ করত! বছর কুড়ি ধরে সমাজ ব্রেনওয়াশিং করে!  ছোটবেলা থেকেই আমি দেখছি, বাবা আর জেঠুদের মধ্যে তর্ক হলে যদি মা বা জেঠিমা কিছু বলতে যায়, (বলা ভালো তর্ক থামাতে যায়) তাহলে ধমক দিয়ে তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। যে কোনো খেলাধুলো বা রাজনীতি সংক্রান্ত বচসায় বাড়ির মেয়েদের কোনও ভূমিকা থাকে না, আবার পাড়ায় যে দু একজন মুখরা মহিলা থাকে, তাদেরকে মেয়েরাই উল্টে শাপশাপান্ত করে। দীর্ঘ সময় ধরে আমি বিশ্বাস করতাম, দুনিয়ার সমস্ত সমস্যার মূলেই মেয়ে। এটা কেউ আমাকে আলাদা করে শেখায়নি, পারিপার্শ্বিক থেকেই এই বিশ্বাসটা গড়ে উঠেছিল। এই নিয়ে আমি রীতিমত মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়াই করেছি। দ্রৌপদী না হলে মহাভারত এর যুদ্ধ হয়ে কেউ মরত না, হেলেনা না হলে ট্রয় এর যুদ্ধ হত না...এইসব আলবাল লজিককে কাউন্টার করতে একটা ছেলেও এগিয়ে আসেনি। আমি চিরকাল দেখেছি, বাবা আর জেঠুদের খাবার দিয়ে মা আর জেঠিমারা খাবার নেয়। কিছু কম পড়ে গেলে নিজে খায় না বা সবচেয়ে ছোট মাছের পিস বা ভাঙা শিঙাড়া নিয়ে বলে, আমার তো ক্ষিদে নেই। মায়ের এই স্বভাব আমি আজও পুরোপুরি পাল্টাতে পারছি না, বাবার চেয়ে বেশি মায়েরই ওতে আপত্তি। রোজ টেবিলে বসে তুলকামাম হয়ে যায়, আমি না খেয়ে বসে থাকি, বাবার হাফ খাওয়া হয়ে যায়, মায়ের তখন খাওয়া বাড়াও হয়নি। টেবিল বা মেঝে যেখানেই পাত পেড়ে খাওয়া হোক, সামনে ডালের বাটি বা তরকারি থাকলেও পুরুষরা কেউ নিজে নেয় না, 'দাও' বলে বসে থাকে। মধ্যবিত্ত ভারতীয় ফ্যামিলিতে রোল রিভার্সাল বলে কিছু থাকে না, থাকলেও সেটা হেয় চোখেই দেখা হয়। আমি চিরকাল ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে জেনেছি, মেয়েরা হল সাপ্রেসড ক্রিচার, এদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম। এই মানসিকতা বদলাতে যতটা সময় লাগে, (অনেক সময় সে সময় বা সুযোগ পাওয়াও যায় না) তার মধ্যে থেকেই মনে একটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ধারণা গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ছেলেমেয়ের দেহ বা সম্পর্ক নিয়ে আমাদের যে ধরনের ট্যাবু আছে, সে সব দেখে আমি হাঁ হয়ে যাই। পিরিয়ড কথাটা বলতে বা ছেলেদের সেটা সম্পর্কে জানাতে যে কী অসুবিধা, অনেক ভেবেও আমার মাথায় ঢোকেনি। মেয়েদের আন্ডারগারমেন্টস নিয়ে ছেলেরা তো বটেও, মেয়েরাও লজ্জা করে। মেয়েরা ছেলেদের লুঙ্গি জাঙ্গিয়া কেচে শুকিয়ে দেয়, ছেলেদের সায়া আর ব্রা প্যান্টি শোকাতে লজ্জা লাগে! কেন লাগে? একটা আন্ডারপ্যান্ট আর প্যান্টির মধ্যে এমন কী লজ্জার আছে আমার হেঁড়ে বুদ্ধিতে ঢোকে না। 


আমার বোকাবুদ্ধি দিয়ে বুঝি, লজ্জা নিয়েই যত গোলমাল! এত যে শরীর নিয়ে কীসের লজ্জা কে জানে? একটা বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে যে কোত্থেকে এল সেটা বোঝাতে কীসের সমস্যা? গুড প্যারেন্টিং নিয়ে এখন ভীষণ লাফালাফি হয়, কতজন বাবা মা তাদের ছেলেকে ভ্যাজাইনা, সেক্স (এবং সেফ সেক্স), পিরিয়ড, নিউডিটি মাস্টারবেশন, টিন এজ হার্মোন সম্পর্কে বলে! সন্তান আপনার স্তন, পেনিস, ভ্যাজাইনা দেখলে অত অস্বস্তিতে পড়া কেন? বুঝিয়ে বলে দিলেই হয়! টিন এজ রিলেশনশিপ নিয়েও এত লুকোচুরির কী আছে? পূর্ব পশ্চিম নির্বিশেষে সর্বত্র বারো থেকে আঠেরোর মধ্যে রিলেশনশিপ তৈরি হয়, হরমোন অপোজিট সেক্সের জন্য পাগল ক-রে দেয়, এতে অস্বাভাবিক কী আছে? খোলামেলা ভাবে সব জানিয়ে শরীর আর রিলেশনশিপ  সম্পর্কে সচেতন করা কি গুড প্যারেন্টিং নয়? ভারতের অধিকাংশ পপুলেশন যখন ভার্জিনিটি লুজ করছে, তখন তাদের হর্মোন শুকিয়ে গেছে প্রায়! কেরিয়ার আর পড়ার চিন্তার, অর্থসমস্যা, অথচ শরীরের ভিতর সর্বক্ষণ অস্বস্তি। যদি বা একটা গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড জোটে, সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। বেপাড়ার জেঠু বাড়িতে বলে দিয়েছে বলে ছেলেকে বেদম পিটুনি দেওয়া হয়েছে বা মেয়ের কোচিং ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এসব শুনে আমরা বড় হয়েছি! তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত লোকে জানতে পারে না, অপোজিট জেন্ডারের শরীর আর মন ঠিক কীরকম? এই সাপ্রেশনগুলো একসময় রাগ হয়ে, বিরক্তি হয়ে মাথার মধ্যে ঢুকে যায়! তখন একটা ভায়োলেন্ট সেক্স বা হিরোইক মাচোইজম এর বিজ্ঞাপন সাব-কনশাসে অরগাজম তৈরি করে। একটু ভেবে দেখুন, একের পর এক প্রজন্ম, যারা ছোটবেলা থেকে মেল ডমিনেটেড সোসাইটিতে বড় হচ্ছে, সেক্স ডিপ্রাইভড হয়ে যৌবন কাটিয়ে দিচ্ছে, মনের কথা বলার জন্য বাবা বা আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। ছেলেরা এমন একটা খোলসে নিজেদের আটকে ফেলতে বাধ্য, যেখানে তাদের শেখানোর কেউ নেই, কাউন্সেলিং করার কেউ নেই, কথা বলার কেউ নেই। একজন দুজন নয়, জেনারেশন্স অফ দেম! কোটি কোটি! এরা মেয়েদের সম্মান কী করে করবে? আপনার কতবার দেখেছেন, ছেলেরা মায়ের জন্য স্যানিটারি প্যাড কিনে আনছে? মায়েরা ছেলেদের প্রটেকশন বা কন্সেন্ট নিয়ে কিছু বলছে? ওসব ছেড়েই দিলাম, কতজন আরামসে বাবা মায়ের সঙ্গে বসে ফেস্টিভাল বা অনলাইনে একটা সেক্স সিন দেখতে পারে? জোর করে কালচার টানার দরকার নেই। একটা আর্ট ফর্মের চুম্বন বা সঙ্গম দৃশ্য দেখলে যদি চরিত্র খারাপ হয়, অমন কালচার গোল্লায় যাক!


এ তো গেল সোশ্যাল কন্ডিশনিং এর কথা! এরপর পলিটিকাল কারণ তো আছেই! ভারতের নানান জায়গায় রেপ জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার উপায়, অনেক জায়গায় রেপ ব্যাপারটা ইন্সটিটিউশনালাইজড হয়ে গেছে। আইনে যে আছে রেপ ভিক্টিমের নাম নেওয়া যাবে না, তা রেপ ভিক্টিমকে সম্মান দেওয়ার জন্য বা তদন্তের সবিধার জন্য নয়, রেপ ভিক্টিম এর পরিবারকে দুর্বৃত্ত, সমাজের ঠিকেদার, গুণ্ডা আর রাজনৈতিক দলের কোপ থেকে বাঁচানোর জন্য? নাহলে একজনের নাম বলতে কী অসুবিধা? তার তো কোনও দোষ ছিল না। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাতে নিপীড়িত পরিবারের ওপর কটাক্ষ আর আক্রমণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি, রিলোকেশন করেও সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। 

এটা একটা জার্নাল এন্ট্রি, কোনও প্রবন্ধ নয়। পলিটিকালি কারেক্ট হওয়ার দরকারও আমার নেই।


খুব বিশদে এসব লেখার জন্য যে গ্রাউন্ড নলেজ বা অভিজ্ঞতা চাই, আমার নেই। গ্রামে গ্রামে ঘুরে যেটুকু চাক্ষুষ করেছি, তাতে বলতে পারি সমস্যার শিকড় অনেক গভীর। জন আন্দোলন এর প্রয়োজন আছে, পলিটিকাল উইল আর ল এন্ড অর্ডারের বদলও দরকার, কিন্তু লং টার্মে এসব কিছুই কাজ করবে না যদি কেউ আসল জায়গায় গিয়ে আঘাত না করে। প্রতিটা মেয়ের সমস্যা আসলে ছেলেদেরও সমস্যা। এটা একটা অসুখ। আর কঠিন অসুখ সারাতে হলে লাঠিপেটা করলে চলে না, দীর্ঘকালীম ট্রিটমেন্ট কর‍তে হয়। নাহলে, আজ বদাঁয়ুতে হয়েছে, কাল উড়িষ্যাতে হবে, পরশু দিল্লিতে আবার হবে, কলকাতা, বেঙ্গালুরু বা জয়পুরে হবে। দু একটা ঘটনা নিয়ে আউটরেজ হবে, বাকিগুলো চাপা পড়ে যাবে। আমরা কি তাই চাই? আমরা কি চাই প্রতিটা রেপিস্টকে ধরে ধরে গুলি করা হোক? না আমরা চাই কেউ রেপ করার কথা চিন্তাও না করুক? দ্য চয়েজ রিমেন্স!


এসব আমাদেরই ভাবতে হবে। যদি মনে করেন দ্বিতীয়টাই আসল উদ্দেশ্য, প্রথমটা নয়, তাহলে প্রথমে বিপ্লবটা ঘর থেকে শুরু হোক। অত শুচিবাইয়ের দরকার নেই। অবশ্যই, ছেলেদের দায়িত্ব বেশি, তাই বলে মেয়েদেরও কম নয়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ফরাসি সিনেমা দেখুন, সেক্স আর রিলেশনশিপ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন, ইন্টারকোর্স, পিরিয়ড, প্যাড কন্ডোম, মেনোপজ, কথাগুলো আপনার ছেলে বাবা বা ভাই সাবলীল ভাবে বলতে পারে, সেই স্পেস্টা তৈরি করুন। বউ বা মেয়ে আপনার চেয়ে বেশি উপার্জন করলে হীনমন্যতা বোধের দরকার নেই, আর বর বেশি উপার্জন করলেও তাকে নিজের রক্ষণহর্তা মনে কর‍তে হবে না, রোজ রোজ আপনাকে বাসন মাজতে বললে বাসন ছুঁড়ে গালাগাল করতে পারেন। (কিডিং) মা মাসি পরে খেতে বসলে থালায় হাত দেবেন না, দিদির পিরিয়ড চলছে কিনা জিজ্ঞেস করাটা আর চারটে কথার মতোই সহজ হোক! ননভেজ জোক বন্ধ করার দরকার নেই, কিন্তু সেই জোক যেন ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে বসে শুনে হেসে গড়িয়ে পড়তে পারে, সেই পরিবেশ থাক। কেউ বিকিনি পরলে অত ট্যারা চোখে দেখার কিছু নেই, ইটস আ ড্রেস! বেয়ার চেস্টেড মেয়েরা দুনিয়ার সব বিচে থাকে, মায়েরা সন্তানের সামনে পোশাক পাল্টায়, কেউ ফিরেও তাকায় না। এই দ্বিধা কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায়, আপনি নিজে একটা পাবলিক স্পাতে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসুন। আরো অনেক কিছুই করতে পারেন, কিন্তু দয়া করে ব্যাপারটা বিপ্লব বানিয়ে ফেলবেন না। এই কাজটা একদিনের নয়, সবাই মিলে একটা জীবন ধরে করলে যদি কিছুটা বদল আসে! ২০১৪ সালের এই লেখাটা আশা করি কোনোদিনই ফিরে দেখতে হবে না, তার আগেই আমরা নিজেদের পাল্টে ফেলব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন