বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২

সামান্তা সোবলিনের দুনিয়ায়

 

বইপাগলদের জন্য সম্ভবত বুয়েনাস আইরেসের চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। পার ক্যাপিটা বুকস্টোরের মামলায় আর্জেন্টিনার রাজধানী তাবড় তাবড় শহরকে গোল দেবে। লিবেরিয়া আর বিবলিওথেকের (মানে বইয়ের দোকান আর লাইব্রেরি) যে রমরমা এখানে নজর পড়ল, তাতে মনে হিল্লোল ওঠা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর বইয়ের দোকান 'এল আতের্নো গ্রান্দ স্পেলেন্ডিড' (পাঁচতলা প্রাসাদ, পুরোটাই বই) যেমন আছে, মোড়ে মোড়ে পুরোনো বইয়ের দোকানের বাড়বাড়ন্তও কম নয়। সে সব শুধু নাম কে ওয়াস্তে নয়, লোকজন অফিস ফেরতা গিয়ে উপস্থিত হয় এইসব দোকানে, রাত বারোটা একটা অব্দি বসে বসে বই পড়ে। দোকানদাররাও দিব্যি মধ্যরাত্তির পর্যন্ত দোকান খোলা রাখে ইচ্ছে হলেই।

বলা বাহুল্য, এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের ফোকাস শিফট হতে বাধ্য! কার ফ্ল্যাটে টাকা বেরোল, কোন ওয়েব সিরিজ হিট করল... ওসব নিয়ে মাথা পরে ঘামালেও হবে। ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা দিন হলে দিন, রাত হলে রাত, বইয়ের দোকানের চক্কর মারছি। জায়গা নেই জায়গা নেই করেও আট দশ খান স্প্যানিশ বই কিনে ফেলেছি, তার মধ্যে একটা আবার পুলিশ প্রসিডেরাল। ভালো অজানা বইয়ের কথা জানতে চাইছি শুনেই ওল্ড বুকস্টোরের মালিক সে বইটা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, বইটা নাকি সাতের দশকে প্রকাশিত হয়েছিল । হেক্টর মোরেল, প্লাসিদো দোনেতো, ফেলিক্স কারকাসো সহ পাঁচ ছয় জনের লেখা একাধিক গল্প আছে, পাঠকদের কাছে এই লেখাগুলো Rajarshi দার কানাইচরণের মতোই প্রিয় বলে জানতে পারলাম। তা না হয় হল, আমার আবার কন্টেম্পোরারি রাইটারদের নিয়ে আগ্রহ আছে। সে প্রশ্নে মাথাফাথা চুলকে শেষমেশ পাঁচজনের লিস্ট ধরালেন ভদ্রলোক। যা বুঝলাম, তাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজনের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। সেলভা আলমাদার লেখা পড়েছি, মারিয়ানা এনরিকেজের কলমের স্বাদও কয়েকদিন আগেই নেওয়া হয়েছে (এনরিকেজ অসম্ভব জনপ্রিয় লেখিকা, তবে ডেঞ্জার্স অফ স্মোকিং অফ বেড-এর সব গল্প আমার ঠিক জমেনি। কয়েকটি অবশ্য বাকি আছে। আরো কিছু বই পড়তে হবে)। অবশ্য অনুবাদ হলে দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটাতে হয়, তবে ঘোলও আমার মন্দ লাগে না। ফলে নজর পড়ল তৃতীয়জনের দিকে। সামান্তা সোয়েবলিন।

সামান্তার অবশ্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতে বেশ নামডাক আছে। দু ধরনের বুকারের জন্য দুটো বই মনোনীত হয়েছিল, সিনেমাও হয়েছে তাঁর লেখা বই নিয়ে। কোনটা আগে পড়ি ভাবতে ভাবতে ছোটগল্পের বইটাই আগে তুললাম। নাম 'মাউথফুল অফ বার্ডস'। দিন চারেক আগে বাসে বসে প্রথম গল্পটা পড়তে শুরু করলাম।

ছোটগল্পের একটা নিজস্ব জগত আছে। সেটা বাংলার পাঠকরা ভালোই জানেন, কারণ বাংলা ছোটগল্পের সম্পদ নিয়ে কোনও কথা হবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমার সে সমস্ত গল্প ভালো লাগে, যেখানে ইন্টারপ্রেটাশনের সুযোগ থাকে। আইরনি হল, এই ধরনের গল্প আবার অনেকের মোটেও পছন্দ হয় না, কী হল কী হল করতে করতেই গল্প শেষ হয়ে গেলে লোকে রীতিমত বিব্রত আর বিরক্ত হয়ে ওঠে। সামান্তার লেখাগুলোয় এই ব্যাপারটা পুরোমাত্রায় আছে, ফলে যত পাঠক তারিফ করেছেন, বিরূপ আলোচনাও জুটেছে সমপরিমাণ পাঠকের কাছ থেকে। সামান্তা ছোট ছোট বাক্যে গল্প বলেন, প্রয়োজন না হলে বর্ণনার বাহুল্য দেখিনি। অবশ্য দরকার হলে পরিমিত শব্দে ইমেজারি বা দৃশ্যকল্প তৈরি করতে যে ভালোই পারেন, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। একটা উদাহরণ রইল--

He’s lost his ticket, and from behind the ticket window’s white bars, the station agent refuses to sell him another, saying there’s no change in the drawer. From a station bench, he looks at the immense, dry countryside that opens out in all directions. He crosses his legs and unfolds the pages of the newspaper in search of articles that will make the time pass faster. Night spreads across the sky, and far away, above the black line beyond which the tracks disappear, a yellow light announces the next train. Gruner stands up. The newspaper hangs from his hand like an obsolete weapon. In the ticket window he discerns a smile that, half hidden behind the bars, is directed exclusively at him. A skinny dog that was sleeping now stands up, attentive. Gruner moves toward the window, confident in the hospitality of country people, in masculine camaraderie, in the goodwill that awakens in men when you handle them well.

সে সব পরের কথা। রিওয়াইন্ড করে বাসে ফিরে যাই। প্রথম গল্প পড়তে শুরু করেছি। এদিকে সেদিন বুয়েনাস আইরাসে বৃষ্টি নেমেছে। জম্পেশ ঠান্ডা। তার চেয়েও বেশি কুয়াশা। এমন ঘন কুয়াশা সম্ভবত পনেরো কুড়ি পরে দেখলাম। আমি জানলার শার্সির ওপর নাক ঘষতে ঘষতে বই পড়ছি, বাইরে তাকালেই ভিজে শহরের রাস্তাঘাট চোখে পড়ছে আবছা আবছা। ঘন কুয়াশায় বয়ে চলা পথঘাট, আধখোলা দোকান, কফিশপ আর চা-পাঞ্চোর 'টপরি', থিয়েটার পাড়া, কুকুরবেড়াল, প্রেমিকযুগল, চোঙা টুপি পরে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাঙ্গো আর্টিস্ট... প্রেমের গল্প পড়ার আদর্শ সময়। গল্পের নামও তেমন, 'হেডলাইটস'। আমি প্রথম পাতা শেষ করে দ্বিতীয় পাতায়, ঝিমধরা ভাব এসেছে একটা। এমন সময় বইয়ের পাতায় কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। ছয় না সাত পাতার গল্প, শেষ হতে দেখলাম প্রেম ফ্রেম কোথায় উড়ে গেছে, শেষ বাক্য পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।

এরপর? এরপর আর কী? গোগ্রাসে বইটা শেষ করলাম প্রায়। গল্পের বই তো নয়, যেন হেঁয়ালির কোলাজ। গল্প আবিষ্কার করা পাঠকের কাজ, সামান্তা সে সব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাননি। যা লেখার লিখে দিয়েছেন, বাকিটা তোমার ওপর। বলতে হলে বলতে হয় প্রথমদিকের কয়েকটা গল্প অবশ্য স্রেফ আগুন। ফায়ার। আরো ভালো করে বলতে, ড্রাগন ফায়ার। পড়ে মাথাফাথা ঘুরে যাবে, চেয়ার থেকে পড়ে যেতে পারেন।

এমন সব অদ্ভুতুড়ে প্লট নিয়েও যে এমন গতিশীল গল্প লেখা যায়, সেটা দেখে অবাক হতে হয়। আবার কিছু কিছু গল্প এতটাই সাদামাঠা ভাবে শেষ হয়েছে (বা শেষ হয়নি) যে অনেকের কাছে হয়তো কিছুই ধরা পড়বে না। কিন্ত যে ধরে ফেলবে, তার গা শিরশির করে উঠতে বাধ্য। একটা দুটো গল্প তো সামান্তা জাস্ট পাঠককে চ্যালেঞ্জ করতে ছুঁড়ে দিয়েছেন। দমফাটা উত্তেজনা, কী কী হয় ভাব, অসম্ভব টেনশনে পড়তে পড়তে বাসের স্টপেজ ছেড়ে যায় প্রায়, এমন সময় হুট করে পাতা উল্টে দেখবেন গল্প শেষ। মহা খাপ্পা হয়ে ভাববেন পাতাটাই বাদ গেল নাকি, কিন্তু না, পাতা ঠিকই আছে। তাহলে? কী হল শেষে? হলটা কী রে তোপসে? গল্পটা আবার পড়বেন! আরো মন দিয়ে পড়বেন! কিছুই বুঝবেন না। আবার হয়তো শেষ কয়েকটা পাতা পড়বেন। হয়তো বা চতুর্থ কিংবা পঞ্চমবারে একটা লাইন চোখে পড়বে আপনার, আর খেলাটা আপনি ধরে ফেলবেন আর রোমাঞ্চে আপনার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে, অথবা ধরতে পারবেন না। কিন্তু গল্প ততক্ষণে আপনাকে পেড়ে ফেলেছে। এটাই হল এই বইয়ের ম্যাজিক। ভূতপ্রেত, সান্তাক্লস, ডিস্ফাংশানাল ফ্যামিলি থেকে শুরু করে আর্বান হরার, স্যাটায়ার, ফ্যান্টাসি সবই আছে, কিন্তু সামান্তার নিজস্ব স্টাইলে।

মাউথফুল অফ বার্ডস শেষ করে তড়িঘড়ি 'ফিভার ড্রিমস' ধরেছি, সেই একই স্টাইলে সামান্তা আমার মাথা ভোম্বল করে দিচ্ছেন। জয় গুরু! শেষ করে জানাব।

(নোট-- 'কার্সড বানি', 'মাউথফুল অফ বার্ডস', 'ডেঞ্জার্স অফ স্মোকিং ইন বেড' সহ বেশ কিছু বুকার নমিনেটেড অ্যান্থোলজি পড়লাম। এই বুক ঠুকে বলছি, সৈকতদা মানে সৈকত মুখোপাধ্যায়ের 'তেঁতুলপাতার গল্প' বা 'ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রুণ' ঠিকঠাক জায়গা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হলে আরামসে বুকার লিস্টে জায়গা পেত, সে নিয়ে আমার মনে অন্তত একচুল সন্দেহ নেই। না পড়ে থাকলে পড়ে ফেলুন চটপট।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন